দমন (Daman) - মনোরম সমুদ্রতট, প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ, নজরকাড়া পর্তুগিজ স্থাপত্যশিল্প - সব নিয়ে ছবির মতো সুন্দর দ্বীপ দমন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দমন ছিল গোয়ার অংশ। বর্তমানে দমন ও দিউ সম্পূর্ণ পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। সমুদ্রপিয়াসী তো বটেই, প্রাচীন স্থাপত্য, কীর্তি ও ইতিহাসের প্রতি অমোঘ টান রয়েছে যাঁদের - দমন দ্বীপ তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা। দমন দ্বীপের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে পর্তুগিজবাসীদের নানা ঐতিহাসিক কীর্তি। চারশো বছরেরও বেশি প্রাচীন পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৬১ সালে।
ভারতের পশ্চিম উপকূলে ক্যাম্বে উপসাগরের দক্ষিণ সমুদ্র ঘেঁষা ৭২ বর্গ কিলোমিটার ব্যপ্ত দমন দ্বীপ, দেশের মধ্যে বিদেশ সফরের আনন্দ এনে দেয়। সোনালি বালুকাময় সমুদ্রতটের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে পর্যটককে। একই সঙ্গে ট্রাইবাল, আরবান, ইউরোপিয়ান ও ভারতীয় সংস্কৃতির অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে এই ছোট্ট ভূখণ্ডে। নৃত্যগীত দমন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মিশ্রসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দমন-এ ছড়িয়ে রয়েছে অনেক দুর্গ ও চার্চ। দমন শহরটিকে দুটি অংশে ভাগ করা যায়- উত্তরে নানিদমন ও দক্ষিণে মোতিদমন।
মোতিদমন ও নানিদমন- দুই শহরের মাঝে বহমান দমনগঙ্গা নদী। প্রাচীন ফোর্ট, ১৫৫৯-১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হওয়া কারুকার্যময় সে ক্যাথিড্রাল অফ বমজেসাস চার্চ, দি চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ রেমেডিয়োস, লাইট হাউস, সবেরই দেখা মিলবে মোতি দমনে। মোতি দমন-এর সেরা আকর্ষণ হল ১০টি বুরুজ, ২টি তোরণ ও পরিখা বেষ্টিত প্রায় ৩০ হাজার বর্গ মিটার ব্যপ্ত বিশালাকার দুর্গ ফোর্ট হিয়েরোনিমাস। এই দুর্গের ভিতরেই রয়েছে প্রশাসনের যত গুরুত্বপূর্ণ অফিস কাছারি ও সচিবালয় । নদীবেষ্টিত পরিখাটি সরাসরি সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত। সারি সারি মাছ ধরার নৌকো ও তাদের দিশারি লাইট হাউস মোতি দমন-এর এক অসাধারণ দ্রষ্টব্য। ফ্লোরাল স্টোন-এ কারুকার্যশোভিত দমন মঠ সত্যিই অপূর্ব।
তিনটি বুরুজ ও দুটো তোরণযুক্ত নানিদমন আয়তনের তুলনায় বেশ ছোট, উঁচু পাথরের দেওয়াল ঘেরা নানিদমন-এর দু’ধারে সেন্ট জেরোম-এর স্ট্যাচু ও বিশালাকায় মানবমূর্তি ও তার সামনে নদী - যেন পটে আঁকা ছবি। নদীতীরে ১৬১৪-১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হওয়া সেন্ট জেরোম দুর্গ। এই দুর্গের ভিতরে রয়েছে বিদ্যালয়, বেতারকেন্দ্র, দূরদর্শনকেন্দ্র, বাজারহাট, হোটেল ইত্যাদি সবকিছুই। দুর্গ থেকে কিছুটা দূরে মনোরম সমুদ্রতট জামপোর-এর নিথরনিস্তব্ধ সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেয়। সারি সারি কাজুবাদামের গাছের ফাঁকে পড়ন্ত বেলার আলো আধাঁরি পরিবেশ মুগ্ধ করে পর্যটককে। সূর্যাস্তের আলোছায়ায় তৈরি বালুকাতটের অনাবিল সৌন্দর্য এক স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে।
নানিদমন থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে দিগন্ত প্রসারী সমুদ্র সৈকত ডেবকা বিচ ট্যুরিস্টদের খুবই পচ্ছন্দের জায়গা। ছোটদের জন্যও আদর্শ। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ফুড স্টল, ঘোড়ার পিঠে ভ্রমণ-সবকিছুর আনন্দ উপভোগ করা যায় এই সমুদ্রতটে।
যাওয়াঃ- ভারতের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত যে কোনও শহর থেকেই সহজেই দমন পৌঁছনো যায়। সড়ক ও রেল উভয়পথে দমন যাওয়া যায়। সব থেকে কাছের স্টেশন ভাপি, দমন থেকে মাত্র ১২ দূরে কিলোমিটার । ভাপি স্টেশন থেকে প্রচুর শেয়ার ট্যাক্সি রয়েছে। এছাড়া বাস সার্ভিসও চালু রয়েছে। ৮নং জাতীয় সড়ক ধরে দমন যাওয়া যায়। আমেদাবাদ থেকে দমনের দূরত্ব ৩৬৭ কিমি ও ভাদোদরা থেকে ৩০০কিমি। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মুম্বই বিমানবন্দর দমন দ্বীপ থেকে মাত্র ১৯৩ কিমি দূরে অবস্থিত।
মরসুমঃ- দমন বেড়ানোর ভালো সময় অক্টোবর থেকে মে মাস। ক্রিসমাসের সময় দমন হয়ে ওঠে রঙিন বর্ণময় ও উৎসবমুখর।
দিউ (Diu)- অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর প্রাচীন দুর্গ, পর্তুগিজ চার্চ ও পুরনো মন্দির নিয়ে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় দ্বীপাকার দিউ। হিন্দু আর সুলতানি শাসনের পর ষোড়শ শতকে পর্তুগিজ দখলে চলে যায় এই অঞ্চল। পর্তুগিজ শাসনের স্মৃতির সাক্ষী হয়ে প্রাচীন দুর্গ বা চার্চগুলোর মতোই যেন রয়ে গেছে হোকা গাছগুলি। দিউয়ের কাছাকাছি পৌঁছাতেই রাস্তার দু’পাশে হোকা গাছ নজরে পড়ে। সমুদ্রসৈকতের পথেও রয়েছে হোকার ঝোপ। বহুশাখার এই তালজাতীয় গাছটি আফ্রিকা থেকে দিউতে এনেছিল পর্তুগিজরা। ঘোঘলার ব্রিজ পার হয়ে শহরে ঢুকে পড়া যায়। ঘোঘলার জেটির ধারে জলে ভাসে রঙিন রঙিন নৌকো। সামনে জলের মধ্যে দ্বীপের ওপর একটি ছোট দুর্গ এবং একটু দূরে তীরের গায়ে ১৫৩৫-১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৈরি হওয়া বিশালাকার দুর্গ প্রাসা-ডি-দিউ। প্রাচীন এই দুর্গকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে আরবসাগর আর ব্যাকওয়াটার। দুর্গের বিশাল প্রাকার, দীর্ঘ পরিখা। প্রাচীরে নানান জায়গায় কামান বসানোর ব্যবস্থা রয়েছে, বুরুজের ছাদে এখনো রয়েছে প্রাচীন কামানের সারি।
দিউয়ের চার্চগুলোর মধ্যে অন্যতম সেন্ট পলস চার্চ, সেন্ট টমাস চার্চ, সেন্ট ফ্রান্সিস অব অ্যাসিস প্রভৃতি। বিভিন্ন সমুদ্র তীরে রয়েছে প্রাচীন হিন্দুমন্দিরগুলি। যারমধ্যে গঙ্গেশ্বর শিবমন্দির, চন্ডীমন্দির প্রভৃতি দর্শণীয়। জলন্ধর সৈকত, চক্রতীর্থ সৈকত ও নাগোয়া সৈকত ভারি সুন্দর।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ভেরাবল ও জুনাগড়। ভেরাবল ৮৭ কিমি ও জুনাগড় ১৮৫ কিমি দূরে। তবে নানা দিক দিয়েই দিউ চলে আসা যায়। কাছাকাছি গুজরাটের শহর উনা। দূরত্ব ১৫ কিমি। সোমনাথের দূরত্ব ৮৫ কিমি। আমেদাবাদ থেকে দিউয়ের দূরত্ব ৪৮৩ কিমি।
থাকাঃ- দমন ও দিউতে নানা মান ও দামের বেসরকারি হোটেল এবং দিউতে পি ডব্লু ডি ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স আছে।