সাইকেলে দেশ দেখি
মহম্মদ শরীফুল ইসলাম
~ সাতক্ষীরা থেকে সিলেট সাইকেল ভ্রমণের আরো ছবি ~
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া - এই লাইনকে মিথ্যে করার জন্য প্রায় পাঁচ বছর আগে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলাম তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ দেখার জন্য। সে অভিজ্ঞতার কথাতো আমাদের ছুটির পাঠকেরা জানেনই। সেই থেকেই সাইকেলে চড়ে দেশ দেখা শুরু। রামনাথ বিশ্বাস অথবা বিমল মুখার্জির মতো পৃথিবী ঘুরতে না পারলেও, নিজের দেশটাকে সাইকেলে ঘুরে দেখাটা নেশায় পরিণত হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় মাথার মধ্যে ঘুরছিল সাতক্ষীরার ভোমরা থেকে সিলেটের তামাবিল বর্ডার পর্যন্ত সাইকেল ভ্রমণের ইচ্ছেটা। সঙ্গী খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম নিয়াজ ভাইকে। শেষ সময়ে বোনাস হিসেবে লিপু ভাইও জুটে গেল আমাদের সঙ্গে। আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা মিলল ট্রেকার্স বিডি ও আরও কয়েকজনের তরফ থেকে। ঈদের তিন দিন আগে রওনা দেব ঠিক করে টিকিট কেটে ফেললাম। যথাসময়ে আমি আর লিপু ভাই কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি নিয়াজ ভাই যথারীতি লেট। শেষপর্যন্ত তিনি গাবতলী থেকে বাসে উঠলেন। আমাদের সাইকেল আগেই এস. এ. পরিবহনের মাধ্যমে সাতক্ষীরা পাঠিয়ে দিয়েছি।
সকালে সাতক্ষীরায় বাস থেকে নেমে দেখি আকাশ বেশ মেঘলা। এস. এ. পরিবহন থেকে সাইকেল ছাড়িয়ে রওনা দিলাম ভোমরা সীমানার দিকে। ভোমরা জিরো পয়েন্ট থেকে ছবি তুলে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য খুলনা শহর। পথে লোকজন সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করছে, 'ভাই ঘটনা কি? কই যাবেন?' উত্তর শুনে তো থ! নিয়াজ ভাইয়ের কাছ থেকে একজন বিস্তারিত শুনে সাতক্ষীরার ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনারো কি ঈদেও সাইকেল চালাবেন?' নিয়াজ ভাইয়ের উত্তর, 'হুম'; অপরিচিত লোকের উত্তর, 'তা হলি তো পারি আপনাগি ঈদি মাটি হই গেল!' এই ধরনের মজার মজার ঘটনার মধ্যেই চুকনগরের বিখ্যাত 'চুইঝাল' খেয়ে খুলনা শহরে যখন পৌঁছালাম ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলো নিয়াজ ভাইয়ের বন্ধু সোহেল ভাইয়ের বাসায়। খুলনার জেলখানা ঘাট থেকে নৌকায় করে সোহেল ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম। বাড়ি দেখেতো সবাই অবাক, বিশাল এক রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন।
রাজপ্রাসাদের আরামে সকালে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিতে দিতে অনেক বেলা হয়ে গেল। আমাদের আজকের গন্তব্য ভাঙ্গা, দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সোহেল ভাইয়ের কাছ থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা জেনে নিলাম - উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বরোড দিয়ে না গিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়া। সোহেল ভাইয়ের বাসা থেকে বের হতে যাব ঠিক তখনই লিপু ভাইয়ের সাইকেলের পিছনের চাকা বার্স্ট করলো, নতুন একটি টিউব লাগিয়ে আমরা রওনা দিলাম। পথে দুবার বৃষ্টির জন্য থামতে হলো, এরপর যে কয়েকবার থামলাম বেশিরভাগই ছবি তোলা আর নামাজের জন্য। গোপালগঞ্জ ঢুকে মনে হল যেন উন্নত কোন এক শহরে এসেছি। গোপালগঞ্জ থেকে টেকের হাটের রাস্তা ধরে চলতে থাকলাম ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে। নদীর পাড় ধরে ভারী সুন্দর রাস্তা। এই পথে গাড়ির সংখ্যা কম, তাই আমাদের চালাতেও সুবিধা হচ্ছিল। ইফতারের ঠিক পরপরই আমরা পৌঁছে গেলাম ভাঙ্গায়। ভাঙ্গায় থাকার ব্যবস্থা হলো লিপু ভাইয়ের খালার বাসায়, লিপু ভাই তাঁর খালার বাসায় এসেছেন বহু বছর পর। তাঁর খালাতো ভাই ভেবেছিলেন আমরা মোটর সাইকেলে আসছি, কিন্তু আমাদের সঙ্গে সাইকেল দেখে তিনি অবাক। বহু বছর পর বেড়াতে আসার সুবাদে আমাদের জোরদার খাওয়া-দাওয়াও হলো ।
তৃতীয় দিনে শুরু হলো ঢাকার উদ্দেশে পথ চলা। পথে মাওয়া ফেরি পার হতে হবে। আগামীকাল ঈদ, রাস্তায় তাই অনেক গাড়ি, ঈদে সবাই বাড়ি ফিরছে। পাওয়া পৌঁছানোর আগে রাস্তায় দুটি অ্যাক্সিডেন্টের পরের ঘটনা দেখলাম। একটা বাস আর মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ, আরেকটা নসিমন আর বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ। মাওয়া পৌঁছাতে যত না সময় লাগলো তার চাইতে বেশি সময় লাগলো ফেরিতে উঠতে। খুব ভিড়। ওপাড়ে নেমে ভিড় ঠেলে রওনা দিলাম ঢাকা শহরের দিকে। সন্ধ্যায় লিপু ভাইয়ের বাসায় ইফতার করে তারপর রওনা দেব শাহবাগের উদ্দেশে। ঈদের দিন সকালেও খাওয়া-দাওয়া করবো লিপু ভাইয়ের বাসায়। ইফতারের ঠিক আগের মূহুর্তে পৌছে গেলাম লিপু ভাইয়ের বাসায়। ইফতার শেষ করে শাহবাগ ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশের আড্ডায়। এর মধ্যে নিয়াজ ভাই আন-স্মার্ট থেকে স্মার্ট-এ উপনীত হলেন মানে স্মার্টফোন কিনে ফেললেন। ফলে পরবর্তী কয়েকটা দিন আমাদের খবর সরাসরি ফেসবুকে দিয়ে দেওয়ার একটি মাধ্যমও তৈরি হয়ে গেল। আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা বেজে গেল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঈদের নামাজ শেষ করে রওনা দিলাম লিপু ভাইয়ের বাসায়। সেখানে ইচ্ছামত পোলাও, মাংস খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। আজকের গন্তব্য ভৈরব। রাস্তা একদম ফাঁকা, তবে মাথার ওপর প্রচণ্ড রোদ। গত তিনদিন আকাশ মেঘলা ছিল, কিছুটা বৃষ্টিও হয়েছে। একজন আরেকজনের সঙ্গে নানারকম গল্পের মাঝে শুনলাম সদ্য চিন থেকে ফিরে আসা লিপু ভাইয়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। লিপু ভাই চিনে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী পান্ডা দেখেছেন। তাঁর কাছ থেকে পান্ডা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জানতে পারলাম। পান্ডা খাওয়ার মধ্যে খায় কচি বাঁশ। এরা এতই অলস যে পারতপক্ষে একজন আরেকজনের সঙ্গে মিলিত হতেও চায় না। সেইজন্যে এদের বংশ বৃদ্ধিও দিন দিন অনেক কমে যাচ্ছে। এদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাই বাধ্য হয়ে অতিমাত্রার ভায়াগ্রা খাইয়ে বংশ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এই ধরনের মজার মজার অজানা সব গল্প শুনতে শুনতে একসময় পৌঁছে গেলাম ভৈরব শহরে। ভৈরবে উঠলাম একটি হোটেলে। আমাদের জন্য আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা নাঈম ও শরীফ। রাতে ভৈরব ব্রীজের নীচে পাথরের ওপর আর পরে ব্রিজের ওপর বসে বসে স্থানীয় শিল্পীদের গান শুনলাম।
পরদিন ভোর থাকতে থাকতেই রওনা দিলাম। আজকে অনেক দূর যেতে হবে - ১২০ কিলোমিটারেরও বেশি। ভৈরব সেতুর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রওনা দিলাম। সেতু পার হয়ে নাস্তা করলাম উজানভাটি রেস্তোরায়। পথে কোন ঝামেলা ছাড়াই সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে শ্রীমঙ্গল শহরে ঢুকে পড়লাম। আর মাত্র ১৮ কিলোমিটার চালালেই আজকের মতো সাইকেল চালানো শেষ। তবে শ্রীমঙ্গলে বিশাল একটি বিরতি দিলাম, কুটুম বাড়িতে সন্ধ্যায় খেলাম দুপুরের খাবার। সেখানে পুশান ভাই আর তার বন্ধুরাও যোগ দিলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা আবার সাইকেলে উঠে রওনা দিলাম। মৌলভীবাজারে ঢোকার মাত্র ৬/৭ কিলোমিটার আগে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। ছোট্ট একটি দোকানে সবাই মিলে আশ্রয় নিলাম। প্রায় দু'ঘণ্টা বসে থাকার পরও বৃষ্টি থামার নাম নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম এই বৃষ্টিতেই রওনা দেব, যদি সারা রাত বৃষ্টি হয় তো এখানে বসে থাকার কোন মানেই হয় না। তাছাড়া মৌলভীবাজারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন পুশান ভাই ও মিশা ভাই। আজকে রাতে মিশা ভাইয়ের বাসায় থাকবো ঠিক করা হয়েছে। মৌলভীবাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। একটি হোটেলে খাওয়া শেষ করতে করতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন মৌলভীবাজারের ছেলে রাহী ভাইও। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বেশ রাতেই পৌঁছলাম মিশা ভাইয়ের বাসায়।
পরদিন একটু বেলা করেই মিশা ভাইয়ের বাসায় খিচুড়ি দিয়ে নাস্তা করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরোলাম। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভাল না, কালকে সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। বের হওয়ার সময় ঠিক করে নিয়েছি যত বৃষ্টিই হোক আজকে তার মধ্যেই চালাবো। আমরা মৌলভীবাজার- সিলেটের মূল রাস্তা বাদ দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের রাস্তা দিয়ে রওনা দিলাম। পথে ভৈরবের নাঈমের ফোন পেলাম, তিনি কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে হেঁটে সিলেটের পথে রওনা হয়েছেন। ভৈরবে আমাদের দেখেই তার মাথার মধ্যে এসেছে তারও একটা কিছু করতে হবে! শাহপরানের মাঝারের কাছ যেতে যেতে বৃষ্টির পাল্লায় পরলাম। ভিজতে ভিজতেই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের কাছে এক বাজারে ডিম আর পরোটা দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। পথে সিলেটের দুই সাইক্লিস্টের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম আমি আর লিপু ভাই। নিয়াজ ভাই অবশ্য সবসময় ঘণ্টায় ২০/২৫ কিলোমিটার বেগে সামনে এগিয়ে থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সন্ধ্যার দিকে লিপু ভাইয়ের পেছনের চাকা দ্বিতীয়বারের জন্য পাংচার হলো। টিউব পাল্টে ফেলা হলো। মোহাম্মদ ভাইয়ের অফিসের ফ্যাক্ট্রি টি এস সি ও পাওয়ার লিঃ-এ থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন মোহাম্মদ ভাই। ফ্যাক্ট্রিটি তামাবিল বর্ডারের ঠিক ৩ কিলোমিটার আগে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এই নামে ফ্যাক্ট্রিটি চেনে না, চেনে খাম্বা ফ্যাক্ট্রি নামে। এই ফ্যাক্ট্রিতে বিদ্যুতের খাম্বা তৈরি করা হয়। আমরা খাম্বা ফ্যাক্ট্রিতে পৌঁছালাম রাত ৮ টার পরে। রাতে খাওয়াদাওয়া তারপর পুকুরের গোসল করা, ১২ টার পরে বারবিকিউ পার্টি - সব মিলিয়ে অসাধারণ।
ইচ্ছা ছিল খুব ভোরে রওনা দেব, কিন্তু বৃষ্টির জন্যে তাড়াতাড়ি বেরোনো গেল না। সকালে নাস্তা হিসেবে খিচুড়ি খেয়ে রওনা দিলাম আমাদের শেষ গন্তব্য তামাবিল। তামাবিল শেষ গন্তব্য হলেও আমরা এরপরে জাফলংয়েও যাব। এত কাছে এসে জাফলং না গেলে ভ্রমণটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তামাবিল পৌঁছে কিছু ছবি তুললাম, তারপর জাফলং। জাফলংয়ে খুব ভালো কিছু সময় কাটিয়ে, সিলেটের পথ ধরলাম, তবে সাইকেলে না একটি পাথরবোঝাই ট্রাকে।
~ সাতক্ষীরা থেকে সিলেট সাইকেল ভ্রমণের আরো ছবি ~
বিপদেআপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই 'সেইফ' (Safety Assistance For Emergencies) -এর প্রধান কাজ। এর বাইরেও সেইফের নিয়মিত কর্মী শরিফুলের জীবনের আরেক নাম ভ্রমণ। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, নৌকায় এযাবত নানান অভিযানে অংশ নিয়েছেন তিনি। এরমধ্যে সাইকেলে বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলা ভ্রমণ, পায়ে হেঁটে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ, সাইকেলে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সময় পেলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ভ্রমণের পাতায় লেখেন সেইসব অভিজ্ঞতার কথা।