স্থিতিধরের শিখর ছুঁয়ে
দেবজিৎ ভৌমিক
~ স্থিতিধর ট্রেক রুটম্যাপ ~ স্থিতিধর ট্রেকের আরো ছবি ~
আওয়াজ হল ঝুপ!
অভিজিৎদা তাড়াতাড়ি স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এসে টর্চটা জ্বালাল। তাঁবুর ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, বরফ পড়ছে, আজকে আর ঘুমানো যাবে না!
খানিক পরে পরেই হাত দিয়ে খুঁচিয়ে বরফ ফেলা চলতে থাকল। প্রথমে একটু ভয় পেলেও, পরে নিশ্চিন্ত হলাম এই ভেবে যে অভিজিৎদা আছে। শেষের দিকে খানিকটা ঘুমিয়েও পড়েছিলাম । পরের দিন শেষপর্যন্ত প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। এইভাবে তাঁবুর ওপর বরফ পড়ার জন্য চাপা পড়ে ট্রেকারদের মারা যাওয়ার ঘটনা এতদিন শুধু শুনেইছিলাম, নিজেদের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারলাম সত্যিকারের ব্যাপারটা কতটা ভয়াবহ। ভাগ্যিস আমরা ঠিক সময়ে টের পেয়েছিলাম!
এইসব শুরু হয়েছিল প্রায় তিন মাস আগে, যখন আমাদের ক্লাব 'অ্যাডভেঞ্চার'-এর পক্ষ থেকে এই হাই অল্টিচুড ট্রেকে যাওয়ার কথা ঠিক হয়। মানালির কাছে ১৭,০০০ ফুট ওপরে স্থিতিধর এবং ফ্রেন্ডশিপ এই দুই পাহাড় চূড়ায় ওঠার লক্ষ্যে। পাঁচজনের দলে বাকী চারজনেরই রক ক্লাইম্বিং-এ ভালো প্রশিক্ষণ ছিল। তাই ঠিক হল আমি বেস ক্যাম্পেই থেকে যাব আর বাকীরা পাহাড় চূড়ায় উঠবে।
কাহিনি শুরুর আগে পাত্রপাত্রীদের অর্থাৎ নিজেদের একটু পরিচয় দিয়ে রাখি – আমি আর দলনেতা অভিজিৎদা দুজনেই বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে ডক্টরেট শেষ করে ওখানেই কর্মরত। আমাদের দলের সবচেয়ে দায়িত্ববান অভিজিৎদার ভাই সন্তু কগনিজেন্টে আছে। ট্রেকের এই ব্যাপারটার ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্বই প্রথম থেকেই নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। তাপস বনগাঁর একটা স্কুলের পার্শ্ব শিক্ষক। সুজয় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করে পাটনায়। শেষের তিনজন একসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে শিলিগুড়ি থেকে। সুজয় আমার দেখা প্রথম এবং সম্ভবত শেষ মানুষ যার ইনার পায়জামার মত ঢিলে হয়ে পতপত করে উড়তে পারে। তাপস আর সুজয় খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে সবসময় চূড়ান্ত পর্যায়ের ঝগড়া চালিয়ে যায়, দেখে মনে হয় এবার মারপিট হবে। একটা মজার গল্প শুনেছিলাম – গতবছর ওরা দুজনে মিলে রক ক্লাইম্বিং-এর প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল। প্রথম দিন সকাল থেকেই সাংঘাতিক ঝগড়া শুরু অরে, এমনকী দড়ি ধরে উঠতে উঠতেও ঝগড়া করছিল। বাকীরা কেউ ওদের চিনত না তাই সবাই সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে ছিল। দুপুরে দেখা গেল তাপস পাগলের মত সুজয়কে খুঁজছে সিগারেট খাবে বলে, একা তো খেতে পারে না! এদিকে লোকজনেরা সবাই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল কিচ্ছু বুঝতে না পেরে। তখন সন্তু তাদের বলে যে এরা নিজেদের এগারো বছর ধরে চেনে আর এটাই ওদের প্রতিদিনের রুটিন।
৪ অক্টোবর হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে ৫ তারিখ বিকেলে দিল্লি পৌঁছালাম। সেখান থেকে বিকেলের বাস ধরে মানালি। যাবার পথেই খবর পেলাম আমাদের গাইড বলবাহাদুর আর দুজন পোর্টার উত্তর কাশী থেকে ৬ তারিখে মানালি এসে পৌঁছাতে পারবেনা কারণ সেখানে তখন চাক্কা বনধ্ চলছে। শুরুতেই একদিন নষ্ট। যাইহোক আমরা মানালিতে নেমেই কাঁচা বাজার আর মুদির দোকান থেকে কেনাকাটা সেরে রাখলাম। এখান থেকে আরও দুজন পোর্টারও নিয়ে নিলাম।
৭ তারিখ সকালে তাড়াতাড়ি উঠে মালপত্র, স্যাক সব নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। আমাদের লক্ষ্য ডুণ্ডি। ওখানে পৌঁছে জলখাবার খেয়ে হাঁটা শুরু হবে। পথে জানা গেল এই ট্রেকটা করতে গেলে হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিজম থেকে একটা অনুমতি পত্র করাতে হয়। আর তা আমাদের কাছে নেই। আমাদের আগে ঠিক করাই ছিল যে মানালি পৌঁছে ট্যুরিজমের অফিস থেকে ট্রেকরুট ও অন্যান্য খোঁজখবর নেওয়া হবে। কিন্তু গতকাল রবিবার থাকায় সরকারি দপ্তর সব বন্ধ ছিল। তাই স্রেফ গাইডের আশ্বাসের ভরসাতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। এবারে আশ্বাস এল ড্রাইভারের কাছ থেকে। অতএব এগিয়ে চললাম।
সোলাং ভ্যালির পর চেক পোষ্টে পথ আটকালো – পারমিট কাঁহা?
ড্রাইভার জবাব দিল – ইয়ে ইন্সটিটিউট ওয়ালে হ্যায়।
চেক পোষ্ট ওয়ালে এবারে জানতে চায় – তো ইউনিফর্ম কাঁহা হ্যাঁয়?
ড্রাইভারের আত্মবিশ্বাসী উত্তর – হ্যায় না, ব্যাগ মে।
চেকপোষ্ট পেরোনোর পর ড্রাইভার গর্বের সঙ্গে জানায়, তার গাড়িতে ইন্সটিটিউট ওয়ালারা খুব যাতায়াত করে, না হলে আমাদের এত সহজে ছেড়ে দিত না।
খরস্রোতা বিপাশার পাশ ধরে ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। খানিক পরে ডুণ্ডি ঢুকলাম। দুটো সরকারি বাড়ি ছাড়া জায়গাটায় আর কিছুই নেই। বিপাশার বন্যায় আগের ব্রিজ ভেঙ্গে যাওয়ায় নতুন ব্রিজ তৈরির কাজ চলছে। বুঝলাম যে এখানে কোনমতেই খাবার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এখনপর্যন্ত কলকাতায় বসে পাওয়া আমাদের কোন খবরের সঙ্গেই বাস্তব কিচ্ছু মিলছে না।
এযাবত আমার স্যাকটা অনেকটাই খালি ছিল, বাকীরা সেই সুখবরটা জানা মাত্র নিজের নিজের কিছু কিছু মালপত্র আমার স্যাকে চালান করল (এর মধ্যে ৭৫০ মি. লি.-এর একটা ওল্ড মঙ্কও ছিল, কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ফেরার পথে 'বড়াখানা' হবে তখন কাজে লাগবে) – ওদের সবার স্যাকই ইতিমধ্যে প্রায় ফেটে যাওয়ার সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছিল। শুনে একটু আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে ওই জগদ্দলটা পোর্টারদের কাঁধে যাবে আর আমি ফাঁকা যাব। কিন্তু সে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী – পোর্টাররা জানালো মাল বেশী আছে, ওই স্যাক আমাদেরই নিতে হবে। তবে বাকীরা আমাকে সবথেকে হাল্কা স্যাকটাই দিয়েছিল। আর অসীম সাহসে সন্তু ওটাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিল। পরে স্যাকটা নিয়ে বুঝেছিলাম ওটা কাঁধে নিলে আমাকে আর হাঁটতে হতো না। অনেকটা যাওয়ার পর সন্তুর প্রতিদিনের জিম করা শরীরও জবাব দিতে শুরু করেছিল।
প্রায় এগারোটা বাজে। আমাদের প্রথম দিনের লক্ষ্য 'বিয়াস কুণ্ড'। খালিপেটে অতটা যাওয়া যাবে কীনাও তাও বুঝছিনা। তাও অভিজিৎদা বলবাহাদুরকে বলল, 'চলিয়ে'।
জানতামনা এবারেই আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় চমকটা অপেক্ষা করছে। বলবাহাদুর নির্লিপ্ত গলায় জানালো, 'রুকিয়ে পুছতে হ্যায়, কাঁহাসে যানা হ্যায়?'
আমরাতো কেউ রাস্তা জানিইনা, এবারে টের পেলাম স্বয়ং গাইডও রাস্তা জানে না, কারণ মানালিতেই সে এই প্রথম এসেছে! পোর্টাররা এবার হাসতে শুরু করল, 'ক্যায়সে যাওগে খুদকো রাস্তা মালুম নেহি, গাইডকোভি মালুম নেহি?' অগত্যা রাস্তা জানা পোর্টার বাবাজিই এই যাত্রায় আমাদের গাইড হল।
বিপাশার পাশ দিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। প্রথমদিকে হাঁটা বলতে স্রেফ বোল্ডার ডিঙানো। এরপর খালি ওপরে ওঠা। আস্তে আস্তে মানুষের কোলাহল, যন্ত্রের আওয়াজ, আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে শেষে চুপ করে গেল। বিপাশার কল্লোলে ভরপুর প্রকৃতির সৌন্দর্য তখন আমাদের ঘিরে রেখেছে । বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর খালিপেটে থাকার কষ্ট আর ক্লান্তি শুরু হল। সঙ্গে থাকা গ্লুকোজ জল আর ভেজানো ছোলা-বাদাম বেশ কাজে লাগলো। মাঝে মাঝে খানিক জিরিয়ে নিয়ে এগোতে লাগলাম।
ওপরে ওঠার পথে আরেকটা বড় দলের সঙ্গে দেখা হল, এরা আরেকটি শৃঙ্গ হনুমান টিব্বা জয় করে ফিরছে। একদল বিদেশিরও দেখা মিলল, এরা বিভিন্ন দেশ থেকে এজেন্সির মাধ্যমে এসেছে। প্রায় ঘন্টা দুই হাঁটার মধ্যে বেশ কয়েকবার ভেড়ার পাল চোখে পড়ল। তবে যেটা দেখার মতো তা হল ভেড়া পাহারা দেবার কুকুর। কল্পনাশক্তিকে একটু উদ্দীপিত করলে ওগুলোকে অনায়াসে কেঁদো রয়াল বেঙ্গল টাইগার আর টিবেটিয়ান ম্যাস্টিফের ক্রস ব্রিড বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। তিনঘন্টার রাস্তা শেষে আমরা বারকাথাচ (১১০০০ ফুট) এসে পৌঁছালাম, ঠিক হল এখানেই আমাদের তাঁবু পড়বে।
বিকেলের দিকে ঠিক হল কাছের ক্যাম্পটায় যাওয়া হবে। এটা 'অটল বিহারী বাজপেয়ী মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যালায়েড স্পোর্টস'-এর স্থায়ী বেস ক্যাম্প। যাবার কারণটা অবশ্য গুরুতর। এতকিছু আনা হলেও দেশলাই আনা হয়নি, ফলে রাতের রান্না বসানো যাচ্ছে না। পথের হদিশ জেনে নেওয়াটাও জরুরি। কিন্তু দেশলাই পাওয়া গেলেও রাস্তার নির্দেশ ঠিক পাওয়া গেল না, কারণ যে গাইডরা জানে তারা দল নিয়ে এগিয়ে গেছে। তবে আশা এটাই যে পথে ওদের দেখা মিলবে।
একটা কথা মাথার মধ্যে কয়েকদিন ধরেই ঘুরছিল যে 'বড়াখানা' ব্যাপারটা কী? জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ফেরার দিন এখানে রাতে ক্যাম্প করা হবে। আর একটা ভেড়া কিনে হবে জমিয়ে ভোজ। ভেড়ার শিককাবাব খাওয়ার সম্ভাবনায় বেজায় আনন্দ হল। যদিও অসহায় ভেড়াটার কথা ভেবে খারাপও লাগছিল। তবে সেই ভেড়ার এই জন্মের বা আগের জন্মের অশেষ পুণ্য তাকে শেষপর্যন্ত বাঁচিয়ে দেয় – যথাসময়ে সে প্রসঙ্গে আসছি।
৮ তারিখ সকালে উঠে আবার রওনা। নদী পেরিয়ে ফের গাদা বোল্ডার। তারপর খাড়া পাহাড়, দেখে মনটা দমে গেল কিন্তু সামনে নতুন কিছু দেখতে পাবার আশায় লড়ে গেলাম। বারবার দম নিয়ে এগোতে লাগলাম। সুজয়তো একেবারে নিশ্চিত যে এরপরেই উপত্যকা পাওয়া যাবে আর স্থিতিধরের দেখা মিলবে। কোনোমতে পাহাড়টার মাথায়তো উঠলাম। উঠে দেখি যতদূরে চোখ যায় নানা আকার আর আয়তনের সাদা বোল্ডার সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। খাড়া পাহাড়ে ওঠা তাও ভালো কিন্তু বোল্ডার আরও বিপজ্জনক। পা দিলেই দেখা যায় বোল্ডারগুলো হয় কাঁপছে, নয় গড়িয়ে পড়ছে। আর পা আটকে গেলেতো ভাঙ্গা অনিবার্য। একপ্রস্থ দম নিয়ে একটু ভয়ে ভয়েই এগোলাম। খানিক চলার পর আবার পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলাম, যাক শান্তি।
একটু এগিয়ে এবার খাড়া নামা। বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে কতগুলো রঙিন তাঁবু চোখে পড়ছে। কিন্তু টেলিফটোলেন্স লাগিয়েও 'বিয়াস কুণ্ড' খুঁজে পাচ্ছি না। তবে তাঁবুগুলোর পাশে একটা বড় ঝরনা দেখে আন্দাজ করতে পারছি ওর নীচেই থাকবে। অনেকটা নীচে নেমে তারপর হঠাৎ করে পাওয়া একদম সমতল মাটিতে হেঁটে খরস্রোতা বিপাসার মুখোমুখি হলাম। কয়েক বর্গ কিলোমিটার উপত্যকা জুড়ে বিপাশা তার অগুন্তি শাখা-প্রশাখা নিয়ে বয়ে এসে আমাদের সামনে মিশে চওড়া হয়ে সশব্দে পাহাড় ফাটিয়ে মহা কোলাহলে এগিয়ে চলেছে। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় সত্যিই মানুষের থাকার কোন দরকার আছে কি? আমাদের ছাড়া দিব্যিইতো দিন কাটছে বিপাশার, বরং আমরাই প্লাস্টিক ছড়িয়ে বাঁধ বানিয়ে সর্বনাশ করছি।
বিপাশার পাশ দিয়ে আমরা ঝরনার দিকে এগোলাম। কাছাকাছি আসতে বুঝলাম ঝরনাটা বেশ ভালোই উঁচু, বহু উপর থেকে সাদা জল বিপুল বেগে নীচে এসে পড়ছে। কলকাতায় অনেকে বেশ অবাক হন এই ভেবে যে পুজোর আনন্দ ফেলে এত টাকা খরচ করে, এত কষ্ট করে এসব করা কেন? ঝরনার সেই অপরূপ সৌন্দর্যের সামনে এসে মনে হল তাঁরা যদি কোনদিন এখানে এসে দাঁড়াতে পারেন তাহলে নিজেরাই সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।
এবারে বিপাশার প্রধান শাখাটা পেরোতে হবে। সহজ অংশটা অনেক নীচে ফেলে এসেছি। এখানে নদীটা তুলনায় সরু হলেও অন্তত দশ ফুট চওড়া। আমরা পাঁচজনে হিউম্যান চেন বানিয়ে কোনক্রমে নদী পার করলাম, ভেসে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। আরও কিছুটা এগিয়ে আমাদের বেস ক্যাম্পটা (১১,৫০০ ফুট) চোখে পড়ায় নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু তাও বিয়াস কুণ্ড নজরে এল না। পোর্টার আঙুল তুলে সরু একটা ঝরনা দেখিয়ে বলল ওর নীচে। আমরাও ক্যাম্পে স্যাক নামিয়ে সেদিকে এগোলাম।
আমি নিজের চোখে এত পরিস্কার জল নীল জল আগে কখনও দেখিনি। এতটাই স্বচ্ছ্ব যে অনায়াসে কুণ্ডের প্রায় ত্রিশ ফুট গভীর পর্যন্ত পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। সারাটাদিন কাটলো বিপাশার সঙ্গেই। রাতে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে অবাক হয়ে গেলাম – আজি যত তারা তব আকাশে, সত্যিই যেন মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে... । আকাশে একসঙ্গে এত তারা থাকতে পারে – আমার ত্রিশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে আগে কখনও দেখেছি বলেতো মনে পড়ে না!!
৯ তারিখ সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। বেশিরভাগ মালপত্র বেসক্যাম্পেই থাকবে। সেসব পাহারা দিতে রয়ে যাবে আমাদের এক পোর্টার লাকি। তাঁবু ও জরুরি কিছু জিনিস নিয়ে আমরা উঠব। অ্যাডভান্সড বেসক্যাম্পে পৌঁছানোর আগে পর্যন্তও আমরা নিশ্চিত নই যে ঠিক কোন পাহাড়টায় চড়ব। একটাই আশা যে আমাদের সঙ্গে যে বিদেশিরা উঠেছে ওদেরও লক্ষ্য স্থিতিধর। ফলে ওদের গাইডের কাছ থেকেই অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পের পথ জানা যাবে। সোজা ভাষায় বললে ওদের পিছু পিছু গেলেই ঠিক পৌঁছে যাব এই আশাই করে আছি।
সকাল দশটা নাগাদ বিদেশিদের অনুসরণ করে আমাদের চলা শুরু হল। প্রথম চড়াইটায় উঠেই আমি বুঝতে পারলাম আর ওপরে গেলে আমার অসুবিধা হতে পারে, সেক্ষেত্রে সবাইকে নেমে আসতে হলে ব্যাপারটা ভালো হবে না। ঠিক করলাম বেসক্যাম্পে ফিরে যাব। ফিরে এলাম। গোটা চত্ত্বরে শুধু আমি আর লাকি ছাড়া অন্য কোনো মানুষ নেই। সকালে বেশ ঝকঝকে আকাশ ছিল, দুপুর দুটোর পর থেকে আকাশের মুখ ভার হতে শুরু করল। আমাদের দলটাকে যতক্ষণ পারলাম ক্যামেরা দিয়ে অনুসরণ করলাম। একসময় ওরা মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল।
এর পরের ২৬-২৮ ঘন্টার কথা বাকীদের বর্ণনা শুনে এক জায়গায় করেছি। একটা কথা সবাই ফিরে এসে একমত হয়েছিল যে আমার ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা একদম সময়োপযোগী হয়েছিল। বাকী রাস্তাটা স্রেফ খাড়া ওঠা ছাড়া কিছু নয়। জায়গায় জায়গায় রাস্তা বলতে প্রায় ৮০ ডিগ্রি খাড়া পাঁচিল হাতড়ে হাতড়ে ওঠা। সুজয়ের বর্ণনায়, 'যমের বাড়ির দক্ষিণ দুয়ারের রাস্তা'। সবার শরীরের অবস্থাই শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। মাঝরাস্তায় অভিজিৎদা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। সন্তু একটা ক্যাডবেরি আর জল খাওয়ায়। এরপর সুজয়ের কথা অনুযায়ী, 'দাদা যে সেই দৌড় লাগালো, আর দেখা গেল না। একটা ছোটো ক্যাডবেরির এত শক্তি তা জানতাম না।' পুরোটা প্রায় চার ঘন্টার টানা চড়াই ছিল।
আমাদের টিম অ্যাডভান্সড বেসক্যাম্পে বেস ক্যাম্পে (১৪,৭০০ ফুট) পৌঁছে দেখল ইতিমধ্যে বিদেশিদের ন'টা তাঁবু লাগানো হয়ে গেছে। আর মাত্র একটা তাঁবু লাগানোরই জায়গা রয়েছে, অথচ লাগাতে হবে মোট তিনটে তাঁবু। শেষে বলবাহাদুর আর তার ভাই তেজবাহাদুর মিলে খাদের ধার থেকে পাথর সরিয়ে কোনমতে সামান্য একফালি সমান জায়গা বের করে পাশাপাশি দুটো তাঁবু লাগায়। খাদের ধারের তাঁবুতে সারারাত অ্যাভালাঞ্চের শব্দ শুনতে শুনতে আর ঘুমাতে পারেনি সন্তু।
১০ তারিখ সকালে হালকা জলখাবার খেয়ে ওরা রওনা দেয়। আগেরদিন যে ছোট হিমবাহটার সামনে আমাদের তাঁবু পড়েছিল, আজ তাকে পেরিয়েই উঠতে হবে। পথের সম্বল অল্প কিছুটা দড়ি আর খানকয়েক আইস অ্যাক্স। এইটুকু দড়িতে ওঠা সম্ভব নয় রাতেই অন্য দলের লোকজন বলেছিল। বিদেশিদের সরঞ্জামের বহর দেখে সন্তু আর সুজয় কিছুটা ঘাবড়েও গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক এই জায়গাতে এসেই আমাদের রাস্তা না জানা দুই বাহাদুরের ওস্তাদি বোঝা গেল। ওরা আগে এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের দেওয়ালে দড়ি বাঁধতে লাগলো আর দলের বাকীরা বরফ এড়িয়ে খালি পাথরের দেওয়াল ধরে এগোতে থাকল। এরমধ্যে একটা ছোট অ্যাভালাঞ্চ পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। যেটা সবচেয়ে বড় অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল তা হল ছোট ছোট আলগা ঝুরো পাথর। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে হিমবাহ গলে গিয়ে তলার পাথর বেরিয়ে এসেছে।
সবচেয়ে সামনে দুই বাহাদুর তারপর অভিজিৎদা উঠছিল। সবশেষে তাপস, মাঝে সন্তু আর সুজয়। এরমধ্যে হঠাৎ করে ওপর থেকে একটা বড় পাথর গোলার মতো ছুটে আসে। আসার পথে তেজ বাহাদুরের সঙ্গে থাকা বিস্কুটের বাক্স উড়িয়ে নিয়ে যায়। অভিজিৎদা পরে বলছিল, 'ওপর থেকে দেখছি পাথরটা ভাইটার দিকে যাচ্ছে, ওকে আর ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব কীনা এই কথাটা মনে হচ্ছিল'। বরফ ছড়িয়ে পাথরটা চলে যাবার পর প্রথমে সন্তুকে ওখানে দেখা যাচ্ছিল না। কয়েক মুহুর্ত পরে বোঝা যায় ও আর উপায় না দেখে বরফের ওপরে সটান শুয়ে পড়ে। পাথরের গোলা সামান্যর জন্য ওকে ছুঁতে পারে নি। মুহুর্তের একটা সিদ্ধান্ত কত কিছু বদলে দিতে পারে ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। তবে টানটান এই পুরো ঘটনাটায় কমিক রিলিফের মন্তব্যটা এল তাপসের কাছ থেকে। বেশ খানিকটা পরে ও নীচ থেকে ওপরে এসে দেখে বরফের ওপর বিস্কুট ছড়িয়ে আছে। একটা পাথর ভেঙ্গে কীকরে বিস্কুট ছড়াতে পারে সেটা কিছুতেই ওর মাথায় ঢুকছিল না। নিঃসন্দেহে খুব ভয়াবহ চিন্তা!
আরও কিছুটা এগিয়ে দেখা গেল রাস্তা 'Y'-এর মতন দু'ভাগ হয়ে গেছে। সুজয় অনেক আগে থেকেই আপনমনে নিশ্চিত ছিল যে বাঁদিকেই যেতে হবে। এখানে আবার দ্বিতীয় বাহাদুরি থুড়ি গোয়েন্দাগিরি দেখালো বলবাহাদুর – ডানদিকের রাস্তায় খানিক দূরে একটা সানগ্লাস আর গ্লুকোজের কৌটো পড়ে আছে। এই অসামান্য এবং অভ্রান্ত পথনির্দেশ দেখে আমাদের দল ডান দিকে এগিয়ে গেল। কেবল সুজয় শেষপর্যন্তই কিন্তু কিন্তু করে যাচ্ছিল। এমনকী পাহাড় চূড়ায় পৌঁছেও সে অভিজিৎদার কাছে সন্দেহ প্রকাশ করে যে ঠিক চূড়ায় পৌঁছেছিতো? ভাবখানা এই যে ডাইনে বাঁইয়ে আর যে কটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে সেগুলো একবার ঘুরে নিলে বেশ নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। একেতো নিশ্চিন্ত হতে পারছে না, তার ওপর এত কষ্ট করেও বেচারার অনেকদিনের একটা স্বপ্নপূরণ হল না। ওর দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল কোন একটা পাহাড়চূড়ায় উঠে সেখানে বসে গোটা একটা বিড়ি একাই খাবে। কিন্তু বিড়ি জ্বালিয়ে সবে দুটো সুখটান দিয়েছে অমনি অভিজিৎদার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। বেচারাকে স্বার্থত্যাগ আর বিড়িত্যাগ দুটোই করতে হল।
অ্যাডভান্সড বেসক্যাম্পে বেস ক্যাম্প থেকে বিপাশার বেস ক্যাম্প পর্যন্ত নেমে আসার সময় আর গোটা দুয়েকই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। আকাশজোড়া বিশাল একটা রামধনু দেখে ওরা মুগ্ধ হয়েছিল, কিন্তু ছবি তোলা হয়নি। দ্বিতীয় ঘটনাটা বেশ সাংঘাতিক – বেশ খানিকটা নেমে আসার পর সুজয় হঠাৎ খেয়াল করে ওর পিঠে ব্যাগ নেই যাতে ওর মোবাইল ফোন, সানগ্লাস আর আমাদের যাবতীয় ওষুধ ছিল। অতএব ওকে আরও একবার যমের দক্ষিণ দুয়ারের পথে হাঁটা লাগাতে হয়।
১১ তারিখ সকাল থেকেই শুরু হল বৃষ্টি। একেবারে শিলাবৃষ্টি – নারকেল নাড়ুর আকারের বরফের টুকরোয় খানিকক্ষণের জন্য চারদিক সাদা হয়ে গেল। পরে অবশ্য রোদও উঠেছিল। দুপুরে বলবাহাদুর একাই বেরিয়ে গেল ফ্রেন্ডশিপ শৃঙ্গের রাস্তা খুঁজতে। বিকেলের দিকে আবহাওয়া আরও খারাপ হয়ে এল। তাও আমরা ঠিক করলাম পরেরদিন সকালেই ফ্রেন্ডশিপের অ্যাডভান্সড বেসক্যাম্পে বেস ক্যাম্পের জন্য বেরিয়ে পড়া যাবে। ১৩ তারিখ শৃঙ্গ বিজয় সেরে বারকাথাচে গিয়ে তাঁবু ফেলব (আমার মনে শিককাবাবের স্বপ্ন ভিড় করে এল)। রাতে বৃষ্টির সঙ্গে তুষারপাতও শুরু হল। খানিক পরেই টের পেলাম তাঁবুর ভিতরে জল পড়ছে মানে তাঁবুর ওপরের প্লাস্টিকের চাদর সরে গেছে। আমি বাইরে বেরিয়ে চাদরটার পেরেকগুলো ঠিক করে ফাটা চাদর প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দিলাম। উফফ্ কী কনকনে ঠাণ্ডা – এত ঠাণ্ডায় আগে কখনও বাইরে বেরিয়েছি বলে মনে পড়ে না, আসলে প্রাণের দায় বড় দায়। যদিও নিজেকে বেশ সুপারম্যানের মতোও মনে হচ্ছিল।
সুজয়ও বাইরে এসেছিল। নীচু হয়ে তাঁবুর একটা পেরেক ঠিক করার পর মাথা তুলে দেখে ওর সামনে টর্চ নিয়ে আট-দশজনের একটা বড় দল। ওরা এই অন্ধকারের মধ্যেই অ্যাডভান্সড বেসক্যাম্পে ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ বিদেশিদের দলটা কোনো বড় দুর্ঘটনায় পড়েছে এরা উদ্ধারকারী দল।
১২ তারিখ সকালে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিক সাদা, আকাশের মুখ প্রবল গোমড়া। এখানেই অভিযান মুলতুবি করে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ইতিমধ্যে আরও একটি উদ্ধারকারী দল নীচ থেকে উঠে এসেছে। জানতে পারলাম গতকাল বিকেল থেকে একজন বিদেশি সহ মোট তিনজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা পাহাড় চূড়া থেকে নেমে আসার পর যে বড় পাথরে দড়ি বেঁধে নামছিল সেটাই হঠাৎ গড়িয়ে চলে আসে। ভাগ্য ভালো যে বাকী দলটা তখন রাস্তা থেকে সরে গিয়েছিল। কেবল শেষজন পোর্টারকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গাইডের ছবি তুলছিল। নেমে আসার সময় শেষ যে খবর পাই পোর্টার আর সাহেবের দেহ পাওয়া গেলেও গাইডকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। উদ্ধারকারী একের পর এক দল আর সরকারি অফিসারদের হাঁটাচলায় বিয়াস কুণ্ড ক্রমশঃ সরগরম হয়ে উঠছিল। বারকাথাচে আর না থেমে আমরা সরাসরি মানালিতে নেমে আসি। এযাত্রায় ভেড়ার শিক কাবাবের দুঃখ তাওয়া চিকেন দিয়েই ভুলতে হল। সত্যি বলতে কী অক্ষত অবস্থায় সশরীরে নেমে আসতে পেরেছি এতেই যথেষ্ট আনন্দ হচ্ছিল।
তাহলে মরাল অফ দ্য স্টোরি যা দাঁড়াল - যাওয়া আসার ট্রেনের টিকিট কাটা থাকলে স্রেফ মনের জোরেই শুধু মাত্র জায়গার নাম শুনে শুনে পাহাড় পর্যন্ত জয় করে আসা যায়। তাই না?
~ স্থিতিধর ট্রেক রুটম্যাপ ~ স্থিতিধর ট্রেকের আরো ছবি ~
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেল বায়োলজি বিভাগের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট দেবজিৎ ভালোবাসেন বই পড়তে, ফটো তুলতে আর সময় পেলেই ট্রেকিং-এ বেরিয়ে পড়তে।