--> :: Amader Chhuti : :স্মৃতির ভ্রমণ

বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য এবার পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পত্রিকার পাতায়।

 

[অক্ষয়কুমার নন্দী (১৮৮২-১৯৪৯) ছিলেন প্রথিতযশা অলঙ্কারশিল্পী। তাঁর দেশ ছিল অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার বাটাজোড় গ্রামে। ছোট থেকেই ভালোবাসতেন অজানা পথে বেরিয়ে পড়তে। প্রথম ভ্রমণ সাত বছর বয়সে বাড়িতে না জানিয়ে স্টিমারে চড়ে। তিরিশ বছর বয়সে মাত্র বাইশ টাকা সম্বল করে ঘুরে আসেন উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
সাংসারিক অভাবের জন্য ছাত্রবৃত্তি পাস করবার পরই স্বর্ণকারের কাজ শিখতে শুরু করেন। একসময় কলকাতার পথে পথে হালুয়া-পুরী আর গোলাপী রেউড়ি বিক্রি করেছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেছেন নিজের তৈরি গহনা। খুব সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের পরিশ্রম এবং বুদ্ধির জোরে পরবর্তী জীবনে ব্যবসাক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন। স্বদেশী ভাবনায় বিশ্বাসী এই মানুষটি ভারতীয় অলঙ্কার শিল্প এবং হ্যান্ডিক্রাফটস প্রসারের লক্ষ্যে কলকাতায় 'ইকনমিক জুয়েলারি ওয়ার্কস' নামে একটি অলঙ্কারের কারখানা খুলেছিলেন। ১৯২৪ সালে লণ্ডনে এবং ১৯৩১ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীতে অক্ষয়কুমার ভারতীয় অলঙ্কার নির্মাণ, গজদন্ত ও রত্নখচিত সূক্ষ্ম কারুশিল্পে তাঁর প্রতিভার পরিচয় দেন। তাঁর প্রথমবার লণ্ডন ভ্রমণ নিয়ে লিখেছিলেন 'বিলাত ভ্রমণ' বইটি। 'মাতৃমন্দির' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অক্ষয়কুমার নন্দী মেয়েদের শিক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যেও নানান পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সহধর্মিনী সুশীলা তাঁর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে 'মাতৃমন্দির' পত্রিকাটির সম্পাদনাও করেছেন। স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর তাঁর কন্যা।
অক্ষয়কুমারের 'বিলাত ভ্রমণ' বইটি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছিলেন, "আমি এইখানি পড়ে বুঝলাম, বেশ একটা খাঁটি রকমের ভ্রমণ। বইখানায় ইংরেজ জাতির বর্তমান civilization-এর বাহ্যিক চাকচিক্যের কথা বাদ দিয়ে বিলাতের সাধারণ রীতিনীতির কথা লেখা হয়েছে। বিশেষত তার মধ্যে আমাদের দেশের সম্মুখে ধরবার মতো বিষয়গুলি বেশি করে ফুটে উঠেছে। এতে বাংলায় লেখা আর আর বিলাতভ্রমণ থেকে এখানা বেশ একটু স্বতন্ত্র রকমের হয়েছে।"]


বিলাত ভ্রমণ

অক্ষয়কুমার নন্দী

চতুর্থ অধ্যায়

লণ্ডনের বিবরণ
রবিবারের চিঠি – প্রথম

বিলাতে প্রথম প্রথম গতিবিধি করতে কতটুকু সুবিধা অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে, তারই একটা চিত্র – লণ্ডন হতে আমার লিখিত ভ্রমণ বৃত্তান্ত কয়েকখানি চিঠি থেকে উদ্ধৃত করা গেল।
১৭ আগষ্ট – ১৯২৪
মধ্যাহ্নের আহার বাসায় শেষ করে বিকাল ৩টায় বেড়াতে বের হলাম। বাসার নিকট Kilburn High Road থেকে 8B নং বাস ধরে খানিকটা গিয়ে পথে New Oxford Streetএ এলাম। যদিও রবিবার - সবই বন্ধ রয়েছে – তবু বাইরেই অসংখ্য দেখবার রয়েছে। প্রায় বেশীর ভাগ দোকানগুলিতেই বড় বড় কাচের পরদা, তার ভিতর দিয়ে দোকানের প্রায় সব জিনিষই দেখা গেল। এই রাস্তার বড় বড় দোকান গুলির সাজসজ্জা অতি অপূর্ব্ব। আমি New Oxford Street পার হয়ে Oxford Street ধরে ক্রমাগত পূর্ব্বদিকে চলতে চলতে দু-ধারের দোকানগুলি অনেক দেখলাম। লণ্ডনের এই দু'টি রাস্তাই সবচেয়ে বড় বড় দোকানে সজ্জিত।
পরে অন্য বাসে করে Westminister Bridge নামক টেমস্ নদীর উপরের সুন্দর পোলটি পার হয়ে সুবৃহৎ Waterloo Stationটি দেখলাম। এ ষ্টেশনটি সহরের প্রান্তে সুবিস্তীর্ণ স্থানব্যাপী। রেল ষ্টেসন যে এত বড় হতে পারে, তা না দেখলে কল্পনায় আনা যায় না। হাওড়া ষ্টেসনের কয়েকটা তার মধ্যে স্থান পেতে পারে। অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত ষ্টেসনটিতে ঘুরে ফিরে দেখলাম। এখানে এসে আর এক নূতন বুদ্ধি মনে হল – টেমসের উপর দিয়ে পোল পার হয়ে এসেছি, এবার ফিরবার পথে Tube রেলে করে টেমসের নীচে দিয়ে যেতে হবে; "উপরে জাহাজ চলে, নীচে চলে নর" - দেখতে হবে। টেমসের সুড়ঙ্গ বলে যা বিখ্যাত সে কিন্তু এ নয়, সেগুলি সহরের পূর্ব্বে সমুদ্রের দিকে। আমি Charring Crossএর একখানা টিকিট করলাম।
আমাদের দেশের রেলপথে চলতে নূতন লোকের কত কি যে জিজ্ঞাসা করতে হয় আর কত যে আপিসের বাবুদের তাড়া খেতে হয়, তার অন্ত নাই। এখানে রেলপথের অজানা ব্যাপার আমাদের দেশ অপেক্ষা বহুগুণ বেশী, কিন্তু এমন ভাবেই সব লেখা রয়েছে যে, এত কাণ্ডকারখানার মধ্যেও কাউকে কিছু জিজ্ঞাসার আবশ্যক হয় না। সবই সুন্দর পরিষ্কার ভাবে বোঝান। কোন কোন স্থানে এমন বন্দোবস্ত রয়েছে যে, টিকিটের দামের পেনী কয়েকটা কলের মধ্যে ফেলে instruction মত কল টিপলেই যেখানকার টিকিট চাই সেখানকার টিকিট বের হয়ে পড়ে। অথচ সকলেই এ কাজটি সহজে বুঝে নিতে পারে। ষ্টেসনগুলিতে সিগারেট, ম্যাচ, চকলেট ও নানারকম ব্যবহার্য্য দ্রব্য কিনতে কলে পেনি দিয়ে কল টানলেই ঐ সব জিনিস বের হয়। আমি আড়াই পেনি দিয়ে একটি টিকিট বের করলাম। এখানে প্রতি দু' মিনিটে একখানা করে ট্রেণ টেমসের নীচে দিয়ে পার হয়।
ট্রেণে উঠবামাত্রই গাড়ী ছেড়ে টেমসের নীচের সুড়ঙ্গে প্রবেশ করল; টেমসের নীচেয় ট্রেণে চলতে অন্যান্য Underground পথের মতই মনে হল। মুহূর্ত্ত মধ্যে Charring Cross ষ্টেসনে গাড়ী এল। Charring Cross ভারী জমকাল স্থান। আমি এখানে আর একটি bus ধরে একেবারে Hyde-Park Corner অতিক্রম করে Marble Archএ এসে পৌঁছলাম। এখানে রবিবার বিকালে বহু লোকের সমাগম হয়। লোকে Hyde-Parkএ বেড়াতে আসে আর এই Hyde-Park Cornerএর কাছে নানা প্রকার বক্তৃতা হয় তাই শোনে। আমি এক একটি করে তিন-চার জায়গায় খানিকটা করে দাঁড়িয়ে নানা প্রকার বক্তৃতা শুনলাম।
একটা স্ত্রীলোকের বক্তৃতায় একটী কথা বড় মনে ধরল। তিনি বললেন "স্বর্গ বলে কোন স্থান আছে কিনা জানি না, কিন্তু খ্রীষ্টই আমার স্বর্গ – তাঁর অনুসরণই আমার স্বর্গভোগ।" তাঁর বক্তৃতার পর আমি খানিকটা তাঁর সঙ্গে গল্প করে বাসায় ফিরলাম।

রবিবারের চিঠি – দ্বিতীয়

২৪শে আগষ্ট -
আজ সকালকার কাজকর্ম্ম সম্পন্ন করে প্রথমে মনুমেন্ট দেখব বলে বের হলাম। লণ্ডনে অনেক বড় বড় মনুমেন্ট আছে তথাপি একটাই বিখ্যাত, শুধু মনুমেন্ট বলতে সেটাকেই বোঝায়। কোন্ busএ চড়তে হবে জানা নাই – অনুমানেই সেই দিকের একটা busএ চাপলাম। লণ্ডন-গাইড বই ছোট একখানা পকেটে ছিল, তাই দেখেই ঠিক করলাম – কোন খানে নামতে হবে। ৮ পেনির পথ চলবার পর মনোনীত জায়গায় পৌঁছে – নামলাম। নেমে দেখি মস্ত বড় একটা জায়গা, আটটি বড় বড় রাস্তার মোহনা এটা, একে Heart of the city বলা চলে। তিন দিকে তিনটা প্রকাণ্ড বাড়ী Bank of England, Royal Exchange, Mansion House. দেখলাম, প্রত্যেক রাস্তার মাথায় Undergroundএর সুড়ঙ্গ রয়েছে – একটা পথ ধরে নীচে গিয়ে দেখি রেলষ্টেসন, পাতালপুরীতে দ্বিতীয় এক লণ্ডন সহর। ষ্টেসনটির নাম 'ব্যাঙ্ক', মাটীর নীচে সুড়ঙ্গ-পথে নানা দিকে কয়েকটি রাস্তা গিয়েছে। তার প্রত্যেক দ্বারে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে যাবার পথ লেখা রয়েছে। রাস্তার গোলাকার ছাদ ও পাশের দেওয়াল বড় বিজ্ঞাপনের টিনের প্লাকার্ডে ঢাকা। লণ্ডন সহরের বিজ্ঞাপনের কথা বলতে গেলে সে স্বতন্ত্র আর এক প্রবন্ধ আরম্ভ করতে হয়, সেকথা এখন থাকুক। যেদিকে মনুমেন্টের রাস্তা লেখা রয়েছে সেইদিকে খানিকটা গিয়ে উপরে উঠলাম – একটু হেঁটেই মনুমেন্টে গিয়ে হাজির হলাম। রবিবার – কাজেই আজ উপরে ওঠা যাবে না – তার চারিদিকে ঘুরে দেখে নিকটেই London Bridge নামক টেমসের একটী পোলের উপর গিয়ে উঠলাম। লণ্ডনের মধ্যবর্ত্তী টেমসের ১২ মাইল পথের মধ্যে ২৫টা পোল, আর টেমসের নীচে পাঁচ-ছটা সুড়ঙ্গ-পথে কেবল ট্রেণ চলে। উপরেও রেলের পোল আছে। Bridge পার হয়ে অপর পারে এসে London Bridge নামক ষ্টেসনটিতে উপস্থিত হলাম। ওপারে দেখে এসেছি জমির নীচের ষ্টেসন, এপারে এ ষ্টেসনটি সাধারণ জমি ছেড়ে প্রায় ১৫ হাত উঁচুতে; দুই পারেই লণ্ডন সহর। ষ্টেসনটীতে খানিকটা বিশ্রাম করা গেল। এখানে আমি সাত পেনির কয়েক রকম ফল ও দু'পেনির পাউরুটী কিনে মধ্যাহ্নের ভোজন সম্পন্ন করলাম।
এখান থেকে সুবিখ্যাত London Tower এবং Tower Bridge দেখব মতলব করলাম। একটী ট্রাম ধরে এক পেনির পথ অর্থাৎ প্রায় এক মাইল গিয়ে নামলাম – এটা কোন্ খানে এসেছি ঠিক করতে না পেরে সঙ্গের Guide বই দেখে একটা রাস্তা ধরে চলতে চলতে একটা ছোট বস্তীর ভিতরে গিয়ে পৌঁছলাম – দেখলাম অনেক ছোট ছোট বাড়ী, অনেক ছেলেমেয়ে পথে খেলা করছে।
বেশী ছেলে মেয়ে একস্থানে খেলতে দেখে আমার বড় আনন্দ হল, সেখানে একটু দাঁড়াতেই অনেক ছেলে মেয়ে আমার কাছে ছুটে এল – তাদের অনেকেই ভারতীয় মানুষের সঙ্গে কোন দিন পরিচয় করে নাই – তারা অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক ভারতীয় কথা আমার কাছে শুনল এবং তাদের স্কুলের অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক বলল। আমি Tower Bridgeএ যাব শুনে পথ দেখাবার উপলক্ষে অনেক ছেলে মেয়ে আমার সঙ্গে চলল – এখানে কুড়ি বছর বয়স পর্য্যন্ত মেয়েদেরও বালিকা সুলভ স্বভাব দেখলাম। যে এক দল ছেলে মেয়ে আমার সঙ্গে এল, তাদের মধ্যে দু'টী মেয়ে অনুমান আঠার কি কুড়ি বছরের। এরা দু'জনে খানিকটা পথ দেখিয়ে ফিরে গেল – আর ৮/১০ টী ছেলে মেয়ে আমার সঙ্গে এসে গল্প করতে করতে চলল। ঠিক Bridge যখন দেখা গেল, চারটি মেয়ে বাদে আর সব ছেলে মেয়ে ফিরে গেল। মেয়ে চারটি আমার সঙ্গে এসে Bridgeটীর সমস্ত বৃত্তান্ত আমাকে বলে ভাল করে দেখাল। জাহাজ চলবার সময় মাঝখানে কবাট খুলে দু'পাশে উঁচু করা হয় কি উপায়ে তাও দেখাল। বাস্তবিকই Tower Bridge একটী বিস্ময়কর জিনিষ।
পোল দেখান শেষ করে তাদের আর দু'টী মেয়ে ফিরে গেল, বারো তেরো বছরের দু'টী মেয়ে নদীর অপর অপর পারে আমাকে Tower দেখাতে চলল। আমি বললাম, তোমরা বাড়ীতে না বলে আমার সঙ্গে এতদূর চলছ, এতে তোমাদের বাপ মা রাগ করবে না ত? তারা বলল, না কিছুই না – এখন আমাদের স্কুলের গরমের ছুটীর দিন তাই আমরা এখন খুব বেড়াতে পারি। বুঝলাম, স্বাধীন দেশের মেয়ে বটে। আমাদের দেশের পল্লীগ্রামে একটা বিদেশী ইংরাজ গেলে ছেলে মেয়েরা ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, যার বড় সাহস সে না হয় একটু নিকটে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে – আর এই মেয়ে দু'টী নিঃশঙ্কচিত্তে, পরিচিত ভাইদের সঙ্গে চলার মত আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে চলল। অল্পক্ষণেই আমরা পোল পার হয়ে Tower দরজা অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকলাম। টেমসের তীরে খুব খানিকটা স্থান নিয়ে London Tower এর বড় বড় বাড়ীগুলি।
লণ্ডনের সব চেয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক দৃশ্য সকল এই Towerএর ভিতরে রয়েছে। রবিবার বলে ভিতরের জিনিষ সব বন্ধ। আমরা বাইরের জিনিষগুলি দেখলাম। বাইরেই এত দেখবার রয়েছে যে, একদিনে সেইগুলি দেখে শেষ করা দায়। টেমসের তীরে সারি সারি প্রায় একশত বড় বড় প্রাচীন কালের কামান রয়েছে। আহা, ভারতের জিনিষ দেখলেই প্রাণে কেমন লাগে! ভারতীয় কামানগুলি আমি দূর থেকে দেখেই চিনলাম। একটীর গায়ে লেখা রয়েছে – " ভরতপুর থেকে East India Company কর্ত্তৃক ১৮১৬ সালে আনীত।" দু'টী বড় পিতলের কামান দেখলাম, তার একটী ৭ হাত, অপরটী ১২ হাত দীর্ঘ। তাতে লেখা রয়েছে – "সলিমের পুত্র সলমন কর্ত্তৃক হিজরী ৯৩৭ সালে প্রস্তুত।" এত বড় কামান ভারতে তৈরী হয়েছে জেনে বড়ই আশ্চর্য্য বোধ হল। ভাবলাম – বিলাতে এই যে ভারতীয় এত বড় বড় কামান আনা হয়েছে, এর দু'একটা তো কলকাতা যাদুঘরে থাকা উচিত ছিল। কলকাতা যাদুঘরে আমরা যে ছোট দু'একটি পিতলের কামান দেখতে পাই, ওকেই ভারতীয় শিল্পের পরাকাষ্ঠা মনে করতাম, কিন্তু বিলাতে এত বড় বড় কামান ভারত থেকে এসেছে, এর খবর আমাদের দেশবাসী অনেকেই জানেন না।
এর পর আমরা চীন, জাভাদ্বীপ ও আফ্রিকা থেকে আনীত অনেক কামান দেখলাম, চীন ও জাভার কামানগুলিও বেশ বড় বড় এবং তার গায়ে সুন্দর সুন্দর চিত্র আঁকা।
এক পশলা বৃষ্টি এল, আমরা গেটের নীচেয় গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে একটী বুড়ীকে পেয়ে তার সঙ্গে গল্প আরম্ভ করতেই সে, তার বাপ ভারতে মরেছে, সেই দুঃখের কাহিনী আরম্ভ করল। বৃষ্টি থামল কিন্তু বুড়ীর কাহিনী আর থামতে চায় না। পরে আমরা Towerএর আর আর বাগানবাড়ী প্রভৃতি অনেক দেখলাম। এই টাওয়ারটা অতি প্রাচীন কালে একটী জেলখানা ছিল – এখন একে একটা প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে পরিণত করা হয়েছে। এর ভিতরেই কোহিনূর, রাজমুকুট ইত্যাদি রক্ষিত আছে।
মেয়ে দু'টী বাড়ী ছেড়ে এক মাইলের বেশী পথ এসেছে এখন এদের শীঘ্র করে বাড়ী ফেরাই উচিত, তা না করে এরা জানাল আমায় বাসায় পৌঁছাবার busএ তুলে দিয়ে তবে দু'জনে ফিরবে – কি সম্বন্ধই যে দু'এক ঘন্টার পরিচয়ে হয়ে গেল এদের সঙ্গে, তা বোধহয় কখনও ভুলব না। পথে চলতে চলতে এরা আমাকে অনেক নূতন বিষয় দেখাল। খানিকটা দেখাশুনার পর পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে আমায় বাসায় ফিরবার busএ তুলে দিল। আমি চাইতেই তারা আমার নোট বইতে তাদের নামধাম দিল, আমি দু'জনকে মাত্র ৪টী পেনি উপহার দিলাম এবং ওয়েম্বলীতে একজিবিশনে গেলে আমার ষ্টলে দেখা করতে বলে আমার কার্ড দিলাম। বিদায়ের কালে তাদের দু'জনের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম; তারা আনন্দে আমাকে ট্রামে তুলে দিয়ে রুমাল তুলে গুড্ বাই, গুড্ বাই করতে করতে বিদায় নিল।

পঞ্চম অধ্যায়

[একজিবিশনে]
আমাদের কার্য্য

২৪ এপ্রিল (১৯২৪) বৃটিশ এম্পায়ার একজিবিশন খোলা হয়। সম্রাট পঞ্চম জর্জ্জ এর দ্বারোদ্ঘাটন করেন। একজিবিশনে ইংরেজ রাজত্বের প্রত্যেক দেশের জন্য পৃথক প্যাভিলিয়ন বা মণ্ডপ তৈরী হয়েছিল। পরম রমণীয় সুবিশাল ইণ্ডিয়া প্যাভিলিয়নের বেঙ্গল কোর্ট নামক অংশে আমাদের ষ্টল হয়েছিল। এইরূপ বিরাট প্রদর্শনীটির বিবরণ প্রত্যেকেরই জানা দরকার। এই পুস্তকের শেষাংশে বৃটিশ এম্পায়ার একজিবিশনের কিছু কিছু বিবরণ দেওয়া গেল।
বেঙ্গল কোর্টে বাংলা গবর্ণমেন্টের পক্ষ থেকে বাংলার কৃষিজাত দ্রব্য ও নানাবিধ শিল্পের ছয়টী ষ্টল হয়েছিল। তার মধ্যে বটকৃষ্ণ পালের ঔষধাদি, বেঙ্গল ক্যানিং এর রক্ষিত ফল ও মিষ্টাদি খাদ্য, এইচ. বসুর সুগন্ধি দ্রব্যাদি, ঢাকার কাপড় ও শঙ্খের শাঁখা, মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের খেলনা, বাংলার বিভিন্ন স্থানের কাঁসা পিতলের বাসন প্রভৃতি ছিল। বাংলা থেকে কেবল আমরাই বে-সরকারী অর্থাৎ স্বাধীনভাবে আমাদের ইকনমিক জুয়েলারী ওয়ার্কসের অলঙ্কারের একটি ষ্টল ক'রেছিলাম।
আমাদের ষ্টলে আমি প্রথমে শ্রীমতী মৃণালিনী ঘোষ নাম্নী একটী সম্ভ্রান্ত বংশীয়া বাঙ্গালী মহিলাকে ষ্টল-পরিচালনের কার্য্যে নিযুক্ত করি। এ সময়ে এঁর স্বামী লণ্ডনে ইণ্ডিয়ান সিবিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ইনি প্রদর্শনীক্ষেত্রে নানাদেশীয় সুশিক্ষিতা মহিলাকে কার্য্য করতে দেখে বাঙ্গালী মহিলার যোগ্যতা প্রদর্শনের জন্য নিজেই কার্য্যে নিযুক্ত হবার জন্য আমার কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। শ্রীমতী ঘোষ শাঁখা-শাড়ী পরতেন, কপালে সিন্দুর পরতেন। অভিনব সাজে সজ্জিতা বাঙ্গালী মেয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলার অভিনব ধরণের অলঙ্কারের দোকান ইয়োরোপীয়দের চক্ষে সত্য সত্যই খুব চিত্তাকর্ষক হয়েছিল।
মে, জুন দু'মাস একজিবিশন চলার পর আমাদের ষ্টলের বিক্রি খুব বৃদ্ধি পেল। তখন আমি আর দু'টি ইংরাজ কন্যাকে আমাদের ষ্টলে কার্য্যে নিযুক্ত করলাম। বড়টির নাম Miss Adams, বয়স ২৪ বৎসর, ছোটটীর নাম Miss Jones, বয়স ১৫ বৎসর। শ্রীমতী ঘোষ এবং এই দু'টী কন্যা – এঁরা সকলেই অতি সুন্দর ভাবে কাজ করতেন। সমস্ত কাজই নিজের কাজের মত যত্নের সঙ্গে করতে দেখে আমার বড় আনন্দ হত। এঁদের প্রত্যেককে আমি সাপ্তাহিক পৌণে তিন পাউণ্ড অর্থাৎ মাসিক কমবেশী পৌণে দু'শো টাকা হিসেবে বেতন দিতাম।
মিস জোনস্ নাম্নী ১৫ বৎসর বয়স্কা যে মেয়েটি আমাদের ষ্টলে কাজ করত, সে অল্প দিন হ'ল স্কুলের পড়া শেষ করেই আমাদের কাজে এসেছিল, তার সদানন্দ চঞ্চল ছুটোছুটিতে আমাদের ষ্টলটি আনন্দে ভরপুর থাকত। আমি তাকে একখানি বাংলার সাড়ী উপহার দিয়েছিলাম, ষ্টলে সে তাই পরে বাঙ্গালী বেশে গ্রাহকদের নিকট জিনিস বিক্রি করত। দর্শকগণ তাকে ভারতীয় মেয়ে বলে মনে করে কখন কখন ভারতীয় সংবাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত, সে হেসে জানাত – সে ইংলণ্ডেরই মেয়ে। মিস জোনস্ অল্প বয়সের বালিকা হলেও স্বাস্থ্যের উৎকর্ষতায় তাকে পূর্ণাঙ্গ-সুন্দরীর মত দেখাত। এই পুস্তকে আমাদের ষ্টলের যে ছবি দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যস্থলে এই কন্যাটি ঠিক বাঙ্গালী মহিলার মতই সুন্দর শোভা পাচ্ছে।
আমাদের ষ্টলের এই ইংরেজ মেয়ে দু'টি বড় শান্ত স্বভাবের ছিল, গ্রাহকদের নিকট বেশী কথা বলে জিনিস বিক্রির অত্যধিক চেষ্টা এরা কখনও করত না, আমিও এদের এই ভাব বেশ পছন্দ করতেম।
শনিবার একজিবিশনে খুবই ভিড় হত, আমি যে পরিবারে বাস করতাম, সেই বাড়ীর একটি বার বছরের মেয়ে প্রতি শনিবারে একজিবিশনে এসে আমার কাজের সহায়তা করত। শনিবারে বিলাতের ছেলে মেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকে তাই একজিবিশনে আসার তার সুযোগ ছিল। হাসিখুসি স্বভাবের মেয়ে, এর কথা আগেও বলেছি। এ সেই ডলি, একে নিয়ে মাঝে মাঝে প্রদর্শনীর উৎসব ক্ষেত্রে বেড়িয়ে বড়ই আনন্দ পেতাম।
বিলাতে শ্রমসাপেক্ষ কাজগুলি পুরুষেরা করেন, অপেক্ষাকৃত অল্প পরিশ্রমের কাজ মেয়েরা করেন। ভাল ভাল দোকানে দ্রব্যাদি বিক্রয় অধিকাংশ স্থানে মেয়েদেরই কাজ। বৃটিশ এম্পায়ার একজিবিশনের কার্য্যকারকদিগের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল সতর হাজার। এ হতেই পাঠকগণ প্রদর্শনীর বিশালতা কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারেন।
বিলাতের মেয়েরা আমাদের দেশের মেয়েদের মত বেশী দামী গহনা পরা বিশেষ পছন্দ করে না। মোটামুটি গলায় সরু হার, কানে লম্বা দুল, হাতে একটা আংটি – এই তাদের গহনা। কেউ মাত্র একটি হাতে অতি সাদাসিদে রকমের ব্রেসলেট বা বালা পরে; আজকাল হয়েছে আর্মলেট, - তাগার মত একটা জিনিস ওপর হাতে পরে, গলার হারের স্থানে হাল ফ্যাসানে হয়েছে – এক রকম সরুমোটা মালা, এগুলি হাতিদাঁত, ঝিনু্‌ক, রঙ্গিন পাথর প্রভৃতির তৈরী; উপরে সরু আরম্ভ হয়ে ক্রমে নীচেয় মোটা।
আমাদের হাতিদাঁতের উপর গিনিসোনায় মোড়া 'বীণাপাণি শাঁখা' ইংরেজ মেয়েরা পছন্দ করেছে। 'বীণাপাণি আর্মলেট' নানা রকম খুবই বিক্রি হয়েছিল, কারণ আর্মলেট পরা ইংরাজদের হাল ফ্যাসান।
আমরা আমাদের অলঙ্কারের সঙ্গে হাতিদাঁতের প্রস্তুত নানা রকম সেপটীপিন, মালা, ফুল, লকেট, খেলনা, পুতুল প্রভৃতিও বিক্রয় করতাম; সেগুলো কতক আমাদের ঘরে আর কতক মুর্শিদাবাদের তৈরী।
বেঙ্গল-গবর্ণমেন্ট- ষ্টলগুলিতে যে সকল শিল্পদ্রব্য ছিল, তার মধ্যে বাংলার মেয়েদের হাতের প্রস্তুত লেস্, রুমাল ও নানা রকম সূচীশিল্প ছিল। অনেকগুলি সুন্দর কাঁথা বাংলার পল্লী থেকে সংগ্রহ করে একজিবিশনে পাঠান হয়েছিল। সেগুলো দেখে ইংরেজ-মেয়েরা বাংলার মেয়েদের ধৈর্য্যের খুবই প্রশংসা করত। কাঁথাগুলো এতই সুন্দর যে কোন কোন খানা ২০ পাউণ্ড অর্থাৎ পৌনে তিন শত টাকা পর্য্যন্ত বিক্রি হয়েছিল।
বিলাতের সর্ব্বত্র সমস্ত জিনিষই এক দরে বিক্রি, মূল্যবান দ্রব্য থেকে শাক তরকারী পর্য্যন্ত কোন জিনিষেরই দর দস্তুর করবার প্রথা নাই। এইরূপ সুনিয়ম থাকায় আমরা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক জিনিষ বিক্রি করতে পেরেছিলাম।
তিনটী মেয়ের উপর সমস্ত কার্য্যভার দিয়ে আমি প্রদর্শনীক্ষেত্রের নানাস্থান ঘুরে নানাপ্রকার শিল্প-বাণিজ্য সম্বন্ধীয় দ্রব্যের বিষয় অবগত হতাম। ছ'মাস কালব্যাপী দীর্ঘ সময় একজিবিশন দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেম, তথাপি অনেক বিষয় দেখতে সময় হয় নি।
প্রদর্শনীক্ষেত্র নানাপ্রকার আমোদ-উৎসবাদিতে সর্ব্বদা ভরপুর থাকত, আমরা অবকাশ মত সেগুলির কিছু কিছু দেখতাম। বিলাতে পথ ঘাটে সর্ব্বত্র সমপরিমাণ মেয়েপুরুষের গতিবিধি, কিন্তু প্রদর্শনী বা আমোদ-উৎসবাদিতে বেশীর ভাগ মেয়েরাই যোগ দিয়ে থাকেন। আমি দেখতাম, একজিবিশনের সমস্ত লোকের মধ্যে তিনভাগের দুইভাগই স্ত্রীলোক। প্রায় সকলেই ছোট ছেলে মেয়েদিগকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। শিশুদিগকে রাখবার একটী চমৎকার বাড়ী প্রস্তুত হয়েছিল। যে সকল স্ত্রীলোকের শিশুসন্তান বাড়ীতে রেখে আসবার সুযোগ নাই, তাঁরা সন্তান সঙ্গে করেই এসে ঐ স্থানে তাদের রেখে দিয়ে নিশ্চিন্তভাবে একজিবিশন দেখতেন। শিশুদের সেখানে রাখবার খরচ ৪ ঘন্টায় ছয় আনা এবং সমস্ত দিনের জন্য বার আনা নির্দ্ধারিত ছিল। সন্তান রাখবার কর্ত্তৃপক্ষেরা সন্তান রেখে অভিভাবককে একটি টিকিট দিতেন, সন্তান নেবার সময় ঐ টিকিট দেখিয়ে সন্তান ফিরিয়ে নিতে হত। শিশুদের আহারাদির ও সর্ব্বপ্রকার তত্ত্বের চমৎকার ব্যবস্থা সেখানে ছিল, অধিকন্তু সেখানে শিশুদের উপযোগী এমন সুন্দর সুন্দর আমোদ উৎসবের ব্যবস্থা ছিল যে, তাদের পক্ষে উহাই প্রদর্শনীর আমোদ উপভোগের জন্য যথেষ্ট হয়েছিল।
সহর ও পল্লী থেকে স্কুলের শিক্ষক শিক্ষয়িত্রীগণ আপন আপন স্কুলের ছাত্র ছাত্রীগণকে নিয়ে একটী দল বেঁধে একজিবিশন দেখতে আসতেন। ঐ সকল শিক্ষক শিক্ষয়িত্রীগণকে ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি সন্তানের মত ব্যবহার করতে দেখতাম। তাদের সকলকারই জ্ঞানস্পৃহা অত্যন্ত প্রবল।
আমাদের ষ্টলে বিক্রয়ের জন্য হাতির দাঁতের প্রস্তুত তাজমহল, হাতির উপর সজ্জিত বেশে ভারতীয় রাজা, জগন্নাথের রথ, গরুর গাড়ী, ময়ূরপঙ্খী বাইচের নৌকা, বজরা নৌকা, রাধাকৃষ্ণ, শিবদুর্গা, বুদ্ধ, গৌরাঙ্গ প্রভৃতির মূর্ত্তি এবং নানাবিধ ভারতীয় জীবজন্তুর মূর্ত্তি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছিল। শিক্ষক শিক্ষয়িত্রীগণ এবং অনুসন্ধিৎসু দর্শকগণকে আমরা ঐ সমস্ত জিনিষের বিবরণ শুনাতাম, তাতে আমাদের ষ্টলের সম্মুখে অনবরত ২৫ হতে ১০০ দর্শক উপস্থিত থাকত।
সম্রাট পঞ্চম জর্জ্জের মহিষী রাণী মেরী একদিন বেঙ্গল কোর্টে এসেছিলেন, - আমাদের তৈরী অলঙ্কার দু'একটি হাতে নিয়ে দেখে প্রশংসা করেছিলেন। আর একদিন স্পেনের রাণী আমাদের ষ্টলে এসে 'বীণাপাণি আর্মলেট' কিনে নিজে পরেছিলেন; তাঁর সঙ্গে আর একটী রাজপরিবারস্থ কন্যা ছিলেন, তিনিও একটী কিনে হাতে পরেছিলেন।
একজিবিশনে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখতাম। ভারতের নানা প্রদেশের অনেক লোকও সেখানে একজিবিশন দেখতে গিয়েছিলেন। একটী বাঙ্গালী মহিলা নিযুক্ত হয়েছিলেন – বেঙ্গল গভর্ণমেন্টের বস্ত্রবিভাগীয় ষ্টলে; ইনি বাংলার সুবিখ্যাত বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল মহাশয়ের মধ্যমা কন্যা কুমারী লীলা পাল। ইংলণ্ডের নানাস্থানের বাঙ্গালী ছাত্র-ছাত্রীগণ আমাদের ষ্টলে আসতেন এবং বাংলার শিল্পকে বিলাতে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার এই ক্ষুদ্র প্রয়াসের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। ১০।১২ টী বাঙ্গালী মহিলার সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচয় হয়েছিল; তার মধ্যে শ্রীমতী লতিকা বসুর নাম এ দেশে অনেকেই জানেন।
মে মাসের প্রথমেই সুরু হয়ে অক্টোবরের শেষ পর্য্যন্ত ছ'টী মাস বেশ সরগরমের সঙ্গে একজিবিশনটি চলেছিল। এই ছ'টী মাস আমরা যে কত আনন্দে কাটিয়েছি, কত নূতনত্বের মধ্য দিয়ে চলেছি তা মনে করেও আনন্দ হয়।
বেঙ্গল কোর্টে ইংরেজ বাঙ্গালী স্ত্রীপুরুষে আমরা প্রায় পঞ্চাশ জন লোক কাজ করতাম, আমাদের সকলের মধ্যে বড়ই সদ্ভাব জন্মেছিল। একজিবিশন শেষ হবার পর আমাদের পরস্পরের এই বিচ্ছেদ আমাদের প্রাণে বড়ই ব্যথা দিয়েছিল।
বেঙ্গল গবর্ণমেন্ট – পক্ষ থেকে কলকাতা কো-অপারেটিভ সোসাইটীর রেজিষ্ট্রার রায় যামিনীমোহন মিত্র বাহাদুর, খাঁ বাহাদুর কোমরুদ্দিন আহম্মদ এবং শ্রীযুক্ত কিরণচন্দ্র সেনগুপ্ত মহাশয় বেঙ্গল কোর্টের তত্ত্বাবধায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। এঁদের সহায়তায় আমি নানা অযোগ্যতার মধ্য দিয়েও আমাদের ষ্টলের কার্য্যে সফলতা লাভ করেছিলাম।

একাদশ অধ্যায়

[লোকচরিত্র]

লণ্ডনে একদিন পথ চলতে হঠাৎ দেখলাম, মণিব্যাগ হারিয়েছি, খরচের পয়সা নাই – এক মাইল দূরে ব্যাঙ্কে গিয়ে খরচের টাকা আনতে যাব, অথচ আধ ঘন্টার পরেই ব্যাঙ্ক বন্ধ হবে। ট্রামে যাবার পেনিটি পর্য্যন্ত পকেটে নাই – তাই মনে হল, আজ পথের লোকের কাছে একটি পেনি চাইতে হবে। তারপর মনে একটা ঔৎসুক্য এল যে, এই পেনিটি চাওয়া যার-তার কাছে চাইব না, এই চাওয়া উপলক্ষে দেশটাকেও বুঝতে হবে। তাই খুব গরীব পোষাক পরা একটী চৌদ্দ বছরের মেয়েকে পথে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে তারই কাছে বললাম, ট্রামে যাবার পয়সা নাই, আমাকে একটী পেনি দেবে? বলতেই দেখলাম, দুটী অর্দ্ধপেনি আমার হাতে দিল। বোধ হয় আধ পেনি দুটী মাত্রই তার সম্বল ছিল, সে আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করল না, আমার মুখের দিকেও চাইল না – পেনি দুটী দিয়েই পূর্ব্ববৎ দাঁড়িয়ে রইল। আমাদের দেশে এমন অপ্রত্যাশিত দান চাইতে হলে দাতার নিকট কিছু না কিছু কৈফিয়ৎ দিতে হত।

বৃটীশ এম্পায়ার একজিবিশনে আমাদের ষ্টলে একটী কারুকার্য্যপূর্ণ 'কাস্কেট' ছিল, তার দাম লেখা ছিল বাইশ পাউণ্ড। একজন আমেরিকান সেটা কেনার ইচ্ছা করে বললেন – এটী আমাকে বিশ পাউণ্ডে দিতে পারবেন কি? বিলাতে দরদস্তুরের রীতি নাই, আমরাও কখন নির্দ্ধারিত দামের চেয়ে কমে বিক্রি করতাম না। লোকটী কম দাম বলায় আমি আশ্চর্য্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কম দাম বলছেন কেন? তিনি বললেন, এখানকার জিনিষ আমেরিকায় নিতে বিশ পাউণ্ডের বেশী দাম হলে কাষ্টম ডিউটী আর পাঁচ পাউণ্ড অতিরিক্ত দিতে হয়, তাই বাইশ আর পাঁচ সাতাশ পাউণ্ড জিনিসটীর দাম পড়ে। কিন্তু ঐ জিনিসের জন্য অত খরচ করতে পারি না, কুড়ি পাউণ্ডে পেলে আর কোন খরচ অতিরিক্ত বইতে হয় না। তাঁর এই কথা শুনে আমি যে উত্তর করলাম তা বলতে এখানে লজ্জা হচ্ছে; আমি বললাম, আপনি যদি বাইশ পাউণ্ডে জিনিসটী আমার কাছে ক্রয় করেন তবে আপনার কাষ্টম ডিউটী বাঁচাবার জন্যে আমি বিশ পাউণ্ডের একটী রসিদ আপনাকে দিতে পারি। আমার এই প্রবঞ্চনার প্রস্তাব শুনে লোকটী আর আমার সঙ্গে কথা কইলেন না। ধীরে ধীরে যে ভাবে তিনি প্রস্থান করলেন, তাতে বেশ বুঝলাম, দেশকে ফাঁকি দিতে পরামর্শ দেয় – এমন লোকের কাছে জিনিস কিনতে তিনি অত্যন্ত ঘৃণা বোধ করেন।

একদিন ট্রেণে খুব ভিড় হয়েছে, অনেক লোক গাড়ীতে দাঁড়িয়েই চলছে। ওদেশে ট্রেণে প্রায় সকলেই বই বা খবরের কাগজ কিছু-না-কিছু পড়তে থাকে। একটি লোক অপরের ঘাড়ের উপর খবরের কাগজ রেখে পড়ছে আর লোকটি পাঠকের সুবিধার জন্য ঘাড় নত করে রয়েছে, অথচ এদের দু'জনের মধ্যে পরিচয় নাই। দেশবাসী সকলের মধ্যে কি সুন্দর একাত্মবোধ!

পূর্ণ এক বৎসরের মধ্যে মাত্র দু'টি ছেলে দু'জায়গায় দেখেছি, পথে চলতে তাদের পায়ে জুতা ছিল না। তাদের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম – জুতা কিনবার পয়সার অভাব। এই দৈন্যকে তারা প্রকারান্তরে ঢাকতে চেষ্টা করে নাই। এইখানেই পেলাম তাদের মনের বলের পরিচয়।

একজিবিশনে আমাদের ষ্টলে একটি ১৫ বছরের মেয়ে কিছুদিন কাজ করেছিল, নাম তার ভায়োলেট, বড় ভাল স্বভাব। একদিন বেঙ্গল কোর্টের একটি বাঙ্গালী যুবক চা খাবার ঘরে তাকে একাকী পেয়ে হঠাৎ তার মুখচুম্বনে অগ্রসর হয়েছিল। সে আমার ষ্টলে তার চেয়ে বড় যে মেয়েটি কাজ করত তার কাছে ব্যাপারটা প্রকাশ করতেই বড় মেয়েটি বেঙ্গল কোর্টের প্রধান মেয়ে-কর্ম্মচারীর কাণে কথাটা দিল। সঙ্গে সঙ্গে বেঙ্গল কোর্টের এসিষ্ট্যাণ্ট কমিশনারের নিকট কথাটা অভিযোগ রূপে উপস্থিত হল। সেই দিন বিকালেই বিচার হয়ে যুবকটির চাকরী গেল। পরদিন যুবকটি মর্ম্মাহত হৃদয়ে আমাদের ষ্টলে এসে আমাকে জানাল যে, সে ভায়োলেটের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি তাকে তিরস্কার করে জানালাম, আমি ভায়োলেটের সঙ্গে তোমায় দেখা করতে দেব না। ভায়োলেট ষ্টলের ভিতরে ছিল, সে এসে আমাকে বলল, যুবকটি কি বলে? আমি বললাম, তোমার তাতে প্রয়োজন নাই, পোড়ারমুখো তোমার সঙ্গে আবার কথা কইতে চায়! ভায়োলেট বলল – আমি যদি জানতাম, ওর চাকরী যাবে, তবে কথাটা আর প্রকাশ করতাম না, যাহ'ক, ও কি বলে আমি শুনতে চাই। আমি বাধা দেওয়া সত্ত্বেও সে যু্বকটির কাছে গেল। যুবকটি বলল – আমি আমার চাকরী এবং যশঃ দুই-ই হারালাম, তুমি যদি আমার জন্যে এসিষ্ট্যাণ্ট কমিশনারের নিকট একটু অনুরোধ কর তবে আমি পুনরায় চাকরী পাবার জন্যে দরখাস্ত করতে পারি। ভায়োলেট তখনই ছুটে গিয়ে এসিষ্ট্যাণ্ট কমিশনারের নিকট যুবকটির দোষ ক্ষমা করতে অনুরোধ করে তার চাকরী বহাল করে দিল। অপরাধীর প্রতি কি আশ্চর্য্য ব্যবহার। কি ক্ষমা! কি উদারতা!

একদিন একটি দোকানে তাদের কারখানায় নুতন ধরণের তৈরী চুল-ঢাকা জাল বিলি হচ্ছিল। শত শত মেয়ে পুরুষ ঐ জিনিস পাবার জন্যে তাদের দোকানের সামনের প্রসারিত ক্ষেত্রে ভিড় করল। দোকানের মালিক নিকটে বা দূরে যাকে লক্ষ্য করে ফিতে ছুঁড়ে দিচ্ছিল, কেবল সে-ই মাত্র হাত তুলে ফিতে ধরছিল, আর ফিতে পাওয়া মাত্রই সে ( আর ফাঁকি দিয়ে পুনরায় পাবার আশায় না থেকে) চলে যাচ্ছিল। আশ্চর্য্য এই যে বহু বহু লোকের মধ্যে অল্প সংখ্যক লোকের ভাগ্যেই ফিতে মিলছিল। কিন্তু এর জন্যে হুড়োহুড়ি নাই, নীরব নিশ্চল হয়ে দর্শকগণ ফিতে পাবার আশায় দাঁড়িয়ে ছিল। এক একজনের হাতে ফিতে পড়তেই তার পার্শ্ববর্তী দশ- পনেরো জনে হেসে আনন্দ প্রকাশ করছিল।– আমার মনে পড়ছিল আমাদের দেশের কথা, সভাক্ষেত্রে প্রোগ্রাম বিলির সময়েও লোকদের ধৈর্য্যের অভাবে সভাক্ষেত্র কি রকম গণ্ডগোলময় হয়ে ওঠে।

দু'টি ছেলে রাস্তায় মারামারি করছিল, রাস্তায় লোক দাঁড়িয়ে দেখছিল। যতক্ষণ তাদের ধস্তাধস্তি চলছিল ততক্ষণ কোন পথিকই তাদের এই কাণ্ডে বাধা দেয় নাই, কিন্তু যখন একটি ছেলেকে পরাস্ত করে অপরটি তার উপর বিষম মারপিট আরম্ভ করল, তখন পথিকেরা দু'জনকে তুলে পৃথক করে দিল। আশ্চর্য্য এই, দুটি ছেলেই পরস্পর নীরবে মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের ক্ষোভ মিটিয়ে দু'জনেই "গুডবাই" বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ঠিক এমনই ঘটনা আর একদিন দু'টি মাতালের মধ্যে দেখেছিলাম, তেমনই বিদায়ের বেলায় "গুডবাই"। দেখলাম ঝগড়া হ'ক, মারামারি হ'ক তবুও সারা দেশ যেন ভাই ভাই।

লণ্ডনে একটি ছাপাখানায় এক হাজার কাগজ ছাপার একটি অর্ডার দিয়ে একখানা চেক দিয়ে দাম শোধ করে পাঠিয়েছিলাম। ছাপা ওয়ালারা ডাকে নির্দ্দিষ্ট সময়ে আমার লণ্ডনের বাসায় ছাপান কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কার্য্য গতিকে আমি তখন গ্লাসগোতে থাকায় সেগুলি গ্লাসগোতে আমার নিকট পৌঁছল। আমি দেখলাম, একটা অক্ষর বানান ভুল হয়েছে। গ্লাসগো হোটেলের ঝি-মেয়েটি এই বিষয়টি দেখেই আমাকে বলল, আপনি সেই ছাপাখানায় জানালেই তারা নূতন করে আপনাকে আবার ছাপিয়ে দেবে, তার জন্যে আপনাকে ছাপা খরচ, কাগজের দাম বা ডাক খরচ কিছুই দিতে হবে না। আমি ছাপাখানায় চিঠি দিয়ে জানাতেই ঠিক সময়ে আমার কাছে নূতন আর এক হাজার সংশোধিত ছাপান কাগজ এসে হাজির হয়েছিল। ছাপাখানার সততাই এখানে বড় কথা নয় – তার চেয়ে বড় কথা এই যে, একটি হোটেলের ঝিও নিঃসন্দেহে জানে যে, তাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কখনও গ্রাহককে ঠকায় না, বা গ্রাহকের মনে অসন্তুষ্টি থাকতে দেয় না।

একদিন ট্রেণে চলছি, পথে একদল স্কুলের ছোট মেয়ে ট্রেণে উঠল। ওখানে তৃতীয় শ্রেণীতেও প্রত্যেক জনের জন্য এক একটি পৃথক বসবার স্থান। মেয়েগুলি ট্রেণে উঠেই খালি সিটগুলি অধিকার করে বসল, কিন্তু যখন দেখল, দশ বারোটি মেয়ে স্থান না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখন তারা সকলেই উঠে দাঁড়াল। তারপর অপরিচিত প্যাসেঞ্জারেরা ছোট মেয়েদিগের এক একটিকে টেনে নিয়ে কোলে বসাল, তারপর খালি সিটগুলিতে আর সব মেয়েরা বসল। মেয়েদের মধ্যে একাত্মবোধ আর প্যাসেঞ্জারদের কর্ত্তব্যজ্ঞান দুই-ই উল্লেখযোগ্য!

একজিবিশনে আইল অব ম্যান নামক দ্বীপে ভিজিটর অর্থাৎ দর্শক আমদানী করবার উদ্দেশ্যে সেখানকার মনোরম দৃশ্য সম্বলিত উৎকৃষ্ট কয়েক প্রকার ছবি বিতরণের জন্য এক স্থানে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানে বিলি করবার জন্য কোন লোক রাখা হয় নাই, কেবল লেখা ছিল – "প্রত্যেক ছবির এক একখানা করিয়া মাত্র লইবে।" একটি ছেলে তার মায়ের সঙ্গে এসে ঐ ছবি এক একখানা করে নিয়েছে; তারপর তার পছন্দমত ছবিখানির আর একখানা নেবার জন্য তার মায়ের আদেশ চাইতেই মা বললেন – "না, তুমি কখনই এক একখানার বেশী নিতে পার না।" ছেলেই বা কেমন সুন্দর শিক্ষা পেয়েছে যে, আর একখানা নিজ ইচ্ছায় তুলে না নিয়ে মায়ের অনুমতি চাইল; আর মা যে উপযুক্ত শিক্ষাদাত্রী মা – তার তো কথাই নাই।

ওদেশে কোন জন-সমাগমের প্রবেশ পথে যেখানে একটু ভিড় হয়, সেখানে কেউ ঠেলাঠেলি করে আগে যেতে চেষ্টা করে না – একের পর আর শ্রেণীবদ্ধ হয়ে যায়। পর পর লোক এসেই শ্রেণীর পশ্চাতে দাঁড়ায়। এ রকম শ্রেণী কখন একশত হাতের উপর দীর্ঘ হতে দেখেছি। একদিন দেখলাম, একটা উৎসব-ক্ষেত্রের প্রবেশ-দ্বারে উপরের আচ্ছাদনযুক্ত স্থান ছেড়ে লোকের শ্রেণী বাইরে অনেক দূর গিয়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এল তবু লোকগুলি শ্রেণী ভেঙে আচ্ছাদিত স্থানে এগিয়ে এলো না, পরে ধীরে ধীরে একে একে প্রবেশ করল। আমাদের দেশে কিন্তু এইরূপ ক্ষেত্রে সামনের লোক পিছনে ফেলে আগে ঢোকবার চেষ্টাটাই বেশী লোক করে, আর কোন কোনখানে এত লোকের চাপাচাপি হয় যে, তাতে কারো বা সর্দ্দিগর্ম্মি হয়, তার মাঝে আবার পকেটমার পর্য্যন্ত আমদানী হয়।

লিভারপুলের একটা বহুজনপূর্ণ হোটেলে একদিন সন্ধ্যার পর দেখলাম, একটি আমেরিকান যুবক একখানি পাউরুটি মাত্র খাচ্ছে। এই হোটেলটিতে অনেক গরীব লোক খায় বটে কিন্তু এমন শুধু রুটিমাত্র কিনে খেতে কাউকে দেখি নাই। তার সঙ্গে কথাবার্ত্তায় জানলাম, সে একখানি জাহাজে রান্নার কাজ করে। জাহাজখানা আসতে দেরী হচ্ছে, এরই মধ্যে তার খরচের টাকা ফুরিয়ে গেছে। তার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে; কিন্তু পয়সার অভাবে রাস্তার সিগারেট টুকরা কুড়িয়ে তাই দিয়ে সিগারেট তৈরী করে খায়। শোবার খরচ হোটেলে দৈনিক এক শিলিং এর কমে হয় না, তার অভাবে সে গত দুই রাত্রি রাস্তায় ঘুরে কাটিয়েছে। আমি বললাম, এই হোটেলে এত লোক বাস করছে, তুমি তোমার এই অভাবের কথা কাউকে বল নাই কি? সে বলল – "এদেশবাসী ইংরেজদের কাছে বলতে লজ্জা করে।" আমি সে রাত্রির শোবার জন্য এক শিলিং এর একটা টিকিট করে তাকে দিলাম। দু'দিন পরে তাকে আর একটি যুবকের সঙ্গে মিলে এক খানা রুটীমাত্র দু'জনে খেতে দেখে সেদিন জানলাম, সে যে নূতন বন্ধুটি পেয়েছে, তারও পয়সার অভাব, তাই দুজনেই পরস্পরের দুঃখের দরদী হয়েছে। আমি সেদিন তাদের সম্মতি নিয়ে তাদিগকে চারিটি শিলিং দিলাম। তারা আমার ঠিকানা চাইল, আমি বললাম, এটা ধার দেওয়া নয় – শোধ করবার জন্যে ঠিকানার প্রয়োজন হবে না। এই যে বিদেশে এসে এত অর্থাভাবের মধ্যে পড়েছে তবু এদের কারও প্রাণে একটুও ভাবনা চিন্তার লক্ষণ দেখলাম না; বিদেশে এসে এদের মত মানুষ দেখে আমারও মনের বল একটু বেড়ে গেল।

কয়েকটি লোককে নিয়ে একটি Group ফটো তুলবার মন করে তাদিগকে বলেছিলাম – তোমরা মাত্র এক শিলিং করে দিলেই প্রত্যেকে একখানি করে ফটো পাবে। ঐ ফটোর জন্য কিছু বেশী খরচ হয়েছিল বলে পরে তাদিগকে বলেছিলাম, প্রত্যেকে দুই শিলিং করে দিলে ঠিক হয়। তখন তাদের মধ্যের একটি বালিকা আমাকে বলল, "বৃটেনের ভূমিতে দাঁড়িয়ে তুমি একমুখে দুই কথা বলতে পারবে না।" আমি লজ্জিত হয়ে আমার কথাটা ফিরিয়ে নিলাম।

এডিনবরায় একটি মিশনারী সভায় একদিনকার বিষয় ছিল "চীনদেশে স্কটিস্ মিশনের কার্য্য।" একটি বৃদ্ধা ধর্ম্ম-প্রচারিকা তাঁদের সম্প্রদায়ের তরফ থেকে চীনদেশে যে যে কার্য্য করেছেন, ম্যাজিক লন্ঠনের সাহায্যে তাই বক্তৃতা করে শোনাচ্ছিলেন। চীনে তাঁদের ধর্ম্মপ্রচার কার্য্যের যা বর্ণনা করলেন – তাতে বাস্তবিকই তিনি অত্যন্ত প্রশংসা পাবার যোগ্যা। সভাভঙ্গের অব্যবহিত পূর্ব্বে একজন বক্তার মুখে শোনা গেল, ম্যাজিক লন্ঠনের ঐ সুন্দর ছবিগুলি সমস্তই ঐ বক্তৃতাকারিণী মহিলার নিজ হাতের আঁকা। তাঁর বক্তৃতার মধ্যে কিন্তু তিনি তা ঘূণাক্ষরেও প্রকাশ করতে প্রয়াস পান নাই। মহৎ চরিত্রের পরিচয় নয় কি?

বার্ম্মিংহামের বাইরে এক পল্লীতে রবিবারে বেড়াতে গিয়েছি। ফেরবার সময় ট্রামের অপেক্ষায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। দু'টি মেয়ে দেখলাম, সান্-ডে স্কুল (রবিবারের ধর্ম্মশিক্ষার স্কুল) থেকে ফিরছে। আমার ট্রাম আসতে দেরী হচ্ছিল তাই তাদের ধর্ম্মশিক্ষা প্রণালী সম্বন্ধে কিছু কিছু শুনছিলাম। ট্রাম আসতেই উঠলাম, পাড়াগাঁয়ের ট্রাম, দু' একজন লোক মাত্র ছিল। আমি একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসতেই একটি ভদ্রমহিলা ট্রামে উঠে ঠিক আমারই পাশে বসলেন। তিনি আমাকে বললেন, মেয়েদের সঙ্গে আপনার আলোচনা আমি দাঁড়িয়ে শুনছিলাম, তাতে আমি বড় খুসী হয়েছি। তারপর তিনি আমাদের ধর্ম্মপ্রণালী সম্বন্ধে অনেক কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন; নিজেও কিছু ধর্ম্মকথা কইলেন। তারপর অত্যন্ত নূতন কথা এই যে, বার্ম্মিংহামে আমার ফিরবার টিকিট একটা নয় আনা দিয়ে আমার জন্যে কিনে দিলেন, আর তাঁর নিজের জন্যে নিলেন এক আনার একখানি টিকেট। আমি ধর্ম্মপ্রাণ মহিলার দান প্রত্যাখ্যান করলাম না। আমার সঙ্গে ধর্ম্মালোচনার একটু সুযোগ নেবার জন্যেই তিনি ট্রামে চেপেছিলেন, তারপর ফিরে গেলেন। এইখানে একটু পল্লীর প্রাণের পরিচয় পেলাম।

ওদেশে ট্রামের বা বাসের পয়সা কেউ ফাঁকি দিতে চেষ্টা করে না। একদিন এক পেনির পথ এসে আমার নির্দ্দিষ্ট স্থানে নামলাম, কিন্তু টিকিটওয়ালা তখন উপরে থাকায় পয়সা দিতে পারি নাই; হাতের পেনিটি হাতে করেই নামতে হল, কিন্তু পেনিটি আমি পকেটে ফেলতে পারলাম না, পথের একটি বালককে দিলাম। আমাদের এদেশে কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে পয়সাটি পকেটে ফেলতে আমাদের মনে কোন দ্বিধা হয় না। দেশ-কাল বুঝে মনের অবস্থাও এতটুকু তফাৎ হয়।

বার্ম্মিংহামে স্যালভেসন-আর্ম্মির বার্ষিক ধর্ম্মসভার অধিবেশনে একদিন আমাকে কিছু বলতে হয়েছিল। আমি চৈতন্যদেবের প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্ম্মের কয়েকটি বিষয় আলোচনা করেছিলাম – যা খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের পক্ষে অনুকূল অথচ নূতন। সভাপতি মহাশয় আমার বক্তৃতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, তা হবেই ত – আমাদের স্যালভেসন আর্ম্মির প্রতিষ্ঠাতা বুথ সাহেব ভারতে গিয়ে ধর্ম্ম প্রচার করেছিলেন, তারই একটা সুফল আমরা আমাদের এই ভারতীয় বন্ধুর নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করলাম। কি আশ্চর্য্য! চৈতন্যদেবের প্রচারিত ধর্ম্ম থেকে যে ভালটুকু পাওয়া গেল, তাকেও তাদের বুথ সাহেবের কার্য্যের ফল বলে ধরে নেওয়া হল। নিজেদের গণ্ডির বাইরে যে কিছু ভাল থাকতে পারে এ ধারণা তাদের অনেকেরই নাই।

রিজেন্টস্ পার্কের একটি অংশে বহু কাঠবিড়াল, নানা রকমের পাখী স্বাধীন ভাবে চরে বেড়ায়। তারা মানুষ দেখে ভয় করে না, কখন কখন হাত থেকে খাবার নিয়ে খায়। মাত্র কয়েকটি নোটীশ দেওয়া আছে – 'কোন জন্তুকে কেহ বিরক্ত করিও না।' – এরই বলে জীব জন্তুরা মানুষকে ভয় করে না। দেশের আইন কানুন সাধারণে কেমন মেনে চলে, তা এ থেকেই বোঝা যায়।

একদিন রাস্তায় একটি মেথরকে জিজ্ঞাসা করলাম – চুল কাটাবো কোথায়? সে আমার মুখের দিকে চেয়েই বুঝল যে বিদেশী; তখন সে ঝাড়ু সেখানেই ফেলে রেখে আমাকে নিয়ে তিন চার মিনিটের পথ দূরে একটা হেয়ার-কাটার স্যালুনে উপস্থিত করে চুল কাটার বন্দোবস্ত করে দিয়ে আনন্দে হাসতে হাসতে বিদায় হল। মেথর কি আর মেথর!

১৯১৯ সালে ১১ই নবেম্বর বেলা এগারটার সময় গত জার্ম্মাণ মহাযুদ্ধের শান্তি স্থাপন হয়। তাই প্রতি বৎসর ঠিক ঐ দিনে ঐ সময় দু'মিনিট নিস্তব্ধ থেকে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করবার রীতি আছে। ঐ দিন দেখলাম, ঠিক লোকজন ঘরে বাইরে যে যে অবস্থায় ছিল এগারটা এগার মিনিটের সময়ে একেবারে পাথরের মত নিশ্চল হয়ে রইল। রাস্তায় গাড়ী ঘোড়া, লোকজন সবই স্থির। - বুঝলাম নিয়মানুবর্ত্তিতাই এ সব দেশকে বেশী শক্তিশালী করে তুলেছে।

দু'টি ভারি জিনিস নিয়ে আমাকে ট্রেণ থেকে নামতে হবে দেখে ট্রেণের একটি বারো বছরের ছেলে ধাঁ করে একটি জিনিস প্ল্যাটফর্ম্মে নামিয়ে দিয়ে ট্রেণে তার জায়গায় গিয়ে বসল। এমন অযাচিত সাহায্য ওদেশে খুবই প্রচলিত।

লণ্ডনে এক সময় যে গৃহস্থ বাড়ীতে থাকতাম, সেই বাড়ীর কর্ত্তার মেয়ের নিকট আমাদের বাংলার পদ্মার পোলের গুরুত্ব বর্ণন করছিলাম। পোলটি তৈরীর জন্যে জগতের অনেক বড় বড় জাতিকে জানান হয়েছিল কিন্তু সমর্থ হবে না বলে কেউ এগোয় নাই – তারপর জার্ম্মানীরা গিয়ে করে দিয়েছিল। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল – ইংরেজ জাতিকে বলা হয়েছিল? আমি বললাম, হাঁ হয়েছিল। শুনে মেয়েটির মুখ ভার হয়ে গেল; সেদিন আর অন্য দিনের মত সে হেসে খেলে গল্প করতে পারল না। দেখলাম, তের বছরের মেয়েটির প্রাণও তার জাতির মান অপমানের সঙ্গে গভীর ভাবে বাঁধা।

ঐ পরিবারের কর্ত্তার নিকট একদিন কথাবার্ত্তায় আফ্রিকা সম্বন্ধে একটা সামান্য বিষয় তুলেছিলাম। সেই কথাটা আমাকে ভাল করে বুঝিয়ে দেবার জন্য তাঁরা তাঁদের সেই সাধারণ পরিবার থেকে রাশি রাশি বই বার করে দু' ঘন্টা পরিশ্রম করে নির্দ্দিষ্ট বিষয়টি বের করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। - সামান্য বিষয়টি নিয়েও যারা এত অনুসন্ধিৎসু, বড় বড় বিষয়ে তারা কত শক্তি সামর্থ্য প্রয়োগ করে!

আণ্ডার গ্রাউণ্ড রেলের একটা বড় ষ্টেশনে একজন সাধারণ লোককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – অমুক খানে যাব, কোন প্ল্যাটফর্ম্মের গাড়ীতে উঠতে হবে। সে যে প্ল্যাটফর্ম্মের কথা বলেছিল, সেখানে গিয়ে জানলাম, সে প্ল্যাটফর্ম্ম নয়। তখন একজন রেল কর্ম্মচারী আমাকে ঠিক প্ল্যাটফর্ম্মে পৌঁছিয়ে দিল। একটু পরেই দেখি পূর্ব্বের সেই ব্যক্তি ব্যস্তভাবে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, আমাকে পেয়েই বলল – আপনাকে ভুল সংবাদ দিয়েছিলাম, ক্ষমা করবেন। আপনাকে বলার পর আমার একটু সন্দেহ থাকায় ষ্টেশনে জেনে আপনাকে ঠিক সংবাদ দিতে খুঁজছি। কর্ত্তব্যজ্ঞান এমনই থাকা চাই বটে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগার
সাদা-কালো আলোকচিত্রগুলি শ্রীমতী অমলাশঙ্করের 'সাত সাগরের পারে' গ্রন্থ থেকে গৃহীত

[অভ্রতে কিছু কিছু বাংলা বানান টাইপের অসুবিধাটুকু বাদ দিলে মূল লেখার বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher