ঝরনার পাড়ে তাঁবুর ফানুস
সুরাইয়া বেগম
'বলতো মানুষ কীভাবে সবচেয়ে বেশি শিখতে পারে?' - কলেজে প্রথম দিনেই স্যার এই প্রশ্নটা করেছিলেন। তিনিই আবার বলেছিলেন, 'মানুষ সবচেয়ে বেশি শিখতে পারে বই পড়ে আর ভ্রমণ করে।' স্যারের কাছে অনেক আগের শোনা সেই কথাটা কেমন করে মাথার ভেতর ঢুকে গেল তা বুঝতেও পারিনি। অল্পই বই পড়েছি কিন্তু সেভাবে কখনও ভ্রমণ করা হয়নি। কিন্তু সবসময় সুযোগ খুঁজেছি কোথায় যাওয়া যায়। অপেক্ষার ইতি টেনে দিল পিক ৬৯। তারা বান্দরবানে একটা ট্যুরের আয়োজন করছে খবরটা পেতেই এক বন্ধুর সাহায্যে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেললাম। যত সময় ঘনিয়ে আসছিলো আমার মন তত বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। জীবনের প্রথম ভ্রমণ বলে কথা!
তারিখটা ছিল ১৩, বুধবার। সেদিন রাতেই আমরা রওয়ানা দেব। সেদিন ছিল আরেকটা বিশেষ দিনও - বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। এটাই তাঁর মৃত্যুর পরের প্রথম জন্মদিন। সারাদিন গোছানোর ফাঁকে ফাঁকে তাঁর নানান লেখার কথা মনে পড়ছিল বারবার, টিভির নানা অনুষ্ঠানেও মাঝেমধ্যে চোখ রাখছিলাম। জামাকাপড় গুছিয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসা থেকে বের হলাম। প্রথম গন্তব্য আজিজ মার্কেটে পিক ৬৯-এর অফিসে। সেখানে দুজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। একজন মানিক ভাই আর অন্যজন ফারজানা আপু। সেখান থেকে আমরা চলে এলাম বাস স্ট্যান্ডে। আস্তে আস্তে সবাই এসে জড়ো হতে লাগলো। আমরা মেয়ে ছিলাম পাঁচ জন। আমি আর ফারজানা আপু ছাড়া টুম্পা আপু, ফারিহা আপু আর সাদিয়া আপু। সবার সাথেই ধীরে ধীরে পরিচয় হয়ে গেল। বাস ছাড়ল রাত ১০:৩০ টায়। যে যার পছন্দমত জায়গায় বসে পড়ল। শুরু হল আমার জীবনের এতকালের কল্পিত ভ্রমণের বাস্তব রূপ।
রাস্তায় বিশাল জ্যাম আর তাই বাস মোটামুটি ঠেলা গাড়ির মত চলা শুরু করল। আমাদের বাসের ড্রাইভার আবার সদ্য সুদূর আরব দেশ থেকে ড্রাইভিং করে এসেছেন, তাই কিছুক্ষণ পরপর শুধু মরুভূমির দিকে বাস নামিয়ে দিচ্ছিলেন অর্থাৎ সোজা রাস্তায় না গিয়ে বারবার রাস্তার পাশের খোলা জায়গায় নেমে যাচ্ছিলেন। ঝাঁকুনির চোটে আমার চিন্তা হচ্ছিল হাড্ডিগুলো জোড়া লাগানোর জন্য আমাদের আবার কুমিল্লার মগবাড়িতে থেকে যেতে হবে না তো! যাইহোক তিনটের সময় কুমিল্লায় ধানসিঁড়ি হোটেলে রাতের খাওয়া সেরে আবার বাসে উঠলাম। বাস চলল রাতের আধাঁর পেরিয়ে ভোরের দিকে।
আমাদের বাস ভ্রমণ শেষ হলো আঠেরো ঘন্টায়। ড্রাইভার আমাদের নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে পরের দিন বিকেল ৪:৩০টেয় নিক্ষেপ করলেন কেরানির হাটে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন জুমন ভাইয়া। উনি আগেই আমাদের খাবারের বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন। দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমরা বান্দরবান যাওয়ার জন্য মহেন্দ্র নামে গাড়িতে উঠলাম। এগুলো দেখতে সিএনজির মতো কিন্তু সিএনজিও না আবার টেম্পোও না। আমি, টুম্পা আপু, শরীফ (গাইড) এবং লিমন ভাইয়া একটায় উঠে বসলাম।
সন্ধ্যা ছ'টার দিকে বান্দরবান শহরের দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম। রাস্তার দুপাশে আবছা আবছা আলো পড়ে হঠাৎ হঠাৎ একঝলক দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল ছোট বড় পাহাড়। এটাও একটা মজার জিনিস। পুরো দেখা যাচ্ছেনা বলেই যেন মনের ভিতর এর একটা ইচ্ছেমতো প্রতিকৃতি আঁকতে পারছিলাম। মাঝে মাঝে জোনাকির ঝাঁক। আমাদের গাড়ির আলো পড়লে বোঝা যায় না। কিন্তু দূর থেকে দেখে মজা পাচ্ছি। এখন আর দিনে না আসতে পারার আক্ষেপটা নেই। জোনাকির আলোয় বিলীন হয়ে গেল সকল ক্লান্তি। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। বুকের ভিতর কোথায় যেন ছুঁয়ে যায়।
আমরা বান্দরবান শহরে এসে পৌঁছালাম সন্ধ্যে ৭টায়। রাতে থাকব সুমাইয়া নামে একটা হোটেলে। হোটেলের পাশে একটা বড় ব্রিজ আছে। আমরা সংখ্যায় তেরো হওয়ায় পাঁচটা রুম নেওয়া হল। প্রতিটা রুম বড় এবং সবাই মোটামুটি আরামেই থাকতে পারবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ব্রিজটার ওপর কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। আড্ডা শেষে রাতের খাওয়া হল।
৮:৩০-র দিকে আমরা ট্রেকিং শুরু করলাম। লক্ষ্য পাইখংপাড়া। ঝিরি ধরে হাঁটতে লাগলাম। ছোট বড় পাথর ডিঙিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ছবি তোলা হচ্ছে। বেশ অনেকটা এগিয়ে পনেরো মিনিটের একটা ব্রেক নিলাম। এমন করে মোটামুটি তিন চারটে ব্রেক নিয়ে আমরা দুপুর দুটোয় পৌঁছলাম পাইখংপাড়ায়। এখানে আমরা পিটার দাদার ঘরে জিনিসপত্র রেখে ঝরনা দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। দু-তিনজন থেকে গেল রান্না-বান্নার জন্য। মোটামুটি আধ ঘণ্টা হাঁটার পর ঝরনার সন্ধান পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে সবার মনেও যেন খুশির ঝরনা বইতে শুরু করল। আমি জীবনে প্রথম ঝরনা দেখলাম। উত্তেজনায় চোখে পানি চলে এল। তা গোপন করে সবার সঙ্গে খুশিতে আবার উচ্ছ্বল হয়ে উঠলাম। এই সুন্দর দৃশ্য দেখে ততক্ষণে সবাই সারা দিনের হাঁটার কষ্টটা ভুলে গেছি।
দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা দিলাম ক্যাম্প সাইডের দিকে। আমাদের সঙ্গে স্থানীয় তিনজন পথপ্রদর্শক রয়েছেন আর আমাদের পিটারদা। সবচেয়ে মজার বিষয় হল তাঁদের কাছে একটা প্রাগৈতিহাসিক বন্দুকও ছিল। যেটা দিয়ে তাঁরা সচরাচর শিকার করেন! সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, এদিকে আমি, টুম্পা আপু, রাব্বি ভাই, লিমন ভাই, জুমন ভাই আর শরীফ পেছনে পড়ে গেছি। এরমধ্যেই আবার রাস্তা ভুল করে অন্য পথে অনেকখানি এগিয়েও গেছি। অনভ্যস্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার আর টুম্পা আপুর জান যায় যায় আর কী। তবু অন্যদের কথা ভেবে প্রায় নীরবেই সহ্য করছি একটুআধটু উঃ আঃ ছাড়া। যাইহোক শেষপর্যন্ত ঠিকপথে ফিরতে পারলাম। দেখি আমাদের দুই বন্দুকধারী পাহারাদার উদ্বিগ্ন চিত্তে অধীর আগ্রহে পথপানে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাঁফ ছেড়ে একগাল হেসে বললেন, ইতিমধ্যেই তাঁরা আমাদের খোঁজে আবার পাইখংপাড়া থেকে ঘুরে আসছেন। আমি তো শুনে গোপনে একবার ভাল করে তাদের আপাদমস্তক দেখে নিলাম। এটা কী করে সম্ভব! আমাদেরতো একবার আসতেই এই কাহিল অবস্থা। বাকীরাও আমাদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এবারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে সবাই মোটামুটি কাছাকাছি থাকবে আর স্থানীয় একজন সামনে দু'জন মাঝখানে এবং একজন পেছনে। অর্থাৎ কীনা আমাদের বেঁধে ফেলা হল অদৃশ্য দড়ি দিয়ে।
অবশেষে আমরা ক্যাম্প সাইডে এসে পৌঁছালাম। এখানে ঘটল আরেক ট্রাজেডি। রিচার্ড ভাইয়া নামতে গিয়ে পাথরে পা পিছলে আছাড় খেল এবং তাকে ধরতে গিয়ে আরেকটা আছাড় খেল ফারিহা আপুও। আমি তাদের সামনেই ছিলাম। মনে মনে ভাবছি কী বাঁচাটাইনা বেঁচে গেলাম কারণ আমাকে ধরার জন্য কেউতো ওখানে ছিল না।
রাতটা বেশ মজার ছিল। এমন দৃশ্য না দেখে মরে গেলে হয়তো আফসোসই থেকে যেত। এখন বুঝতে পারছি মানুষ কেন সুন্দর কিছু সময়ের কথা মনে করে বেঁচে থাকতে চায়। আমি যদি কখনও আমার জীবনের সুন্দর দু-একটা দিনের কথা মনে করি তাহলে প্রথমে এই দিনটির কথাই মনে পড়বে। ক্যাম্প সাইডে এসে সবাই বসে পড়লাম। এমন সময় রাব্বি ভাই বলল যে, আমরাই প্রথম ট্যুরিস্ট যারা এই সুন্দর জায়গাটাতে ক্যাম্প করছি। এটাও আরেকটা মজা। রাতে মুরগীর বারবিকিউ হবে। সবাই বারবিকিউ করার আয়োজনে নেমে গেল। কেউ কেউ তাঁবু টাঙানো শুরু করলো। আর স্থানীয় সঙ্গীরা আগুন জ্বালিয়ে দিল। সবাই যে যার মত ব্যস্ত, এরি মধ্যে আমাদের সবজান্তা সাদিয়া আপু কবিতা লিখতে বসে গেলেন। আবার ওনার কবিতাটি আমরা কেউ দেখার আগেই তিনি সেটার সলিল সমাধি রচনা করে ফেললেন আগুনে পুড়িয়ে! আহা আফসোস, যদি একটু দেখতে পেতাম! তাঁবুগুলো টাঙানো হলে একটা অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হল। তাঁবুগুলোর ভেতরে আলোর আভায় মনে হচ্ছিল সেগুলো যেন একেকটা ফানুস। পানির ওপর পাথর, তার ওপর তাঁবুর ফানুস। মনোমুগ্ধকর একটা দৃশ্য।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি স্থানীয় একজন বসে আছেন। ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘুমান নি? উত্তরে বুঝলাম বিভিন্ন তাঁবুতে সমবেত নাক ডাকার চোটে ওনার আর ঘুম হয়নি। ভাগ্যিস আমি আগেভাগে শুয়ে পড়েছিলাম। আসলে দুই পাশের দুই তাঁবুতে ছিলেন লিমন ভাই ও মানিক ভাই। বাকিরাও ঘুম থেকে উঠে হাসতে হাসতে বললেন আমরাতো রাতে ওনার (মানে মানিক ভাইয়ের তাঁবু দেখিয়ে) নাক ডাকা শুনে ভাবছি যে ভালুক আসছে বুঝি তাই তাড়াতাড়ি বন্দুক নিয়ে বের হলাম। বের হয়ে তো দেখলাম এই অবস্থা!
চা-বিস্কুট দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে তাঁবু গুছিয়ে আবার রওনা দিলাম পাইখংপাড়ার উদ্দেশে। দুপুর একটায় পাইখংপাড়ায় পৌঁছে খেয়ে নিয়ে ফিরতি পথে রওনা দিলাম ট্রাকে করে। এই ট্যুরে আমার সব কিছুই নতুন তাই ট্রাক জার্নিটাও নতুন। ট্রাকে ওঠার পর মনে হল ঢাকায় হয়তো এযাত্রা আর ফিরে যেতে পারব না। এতো সেই বাস ড্রাইভারের চেয়েও এক ডিগ্রি বেশি। ট্রাক আমাদেরকে একবার ওপরে তোলে আবার ছেড়ে দেয়। ফুটবলের মতো লাফাতে লাফাতে খালি মনে হচ্ছিল বোধহয় এই ট্রাকিং এর থেকে ট্রেকিং-ই ভাল ছিল! ট্রাকে আমাদের দু-একজন অসুস্থও হয়ে পড়ল। কিন্তু এত ঝামেলার মধ্যেও মানিক ভাই হাসতে হাসতে আর হাসাতে হাসাতে চললেন। সত্যি ক্ষমতা আছে!
ট্রাক থেকে নেমে আবার ট্রেনে রওনা ঢাকার দিকে। ভালোয়মন্দয় আমার প্রথম ভ্রমণ শেষ। এবারে আবার কবে বেরিয়ে পড়ব তার চিন্তা শুরু হল।
'দ্য পিপলস্ ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ' নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনার্স পড়ছেন সুরাইয়া। ভালোবাসেন বই পড়তে, চলচ্চিত্র দেখতে, কবিতা লিখতে, ভ্রমণ করতে। তিনি কিছু ভ্রমণ কাহিনি অনুবাদও করেছেন।