বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য এবার পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পত্রিকার পাতায়।
[ঠাকুরবাড়ির বিদূষী মহিলা, ঊনবিংশ শতকের অন্যতম মহিলা লেখক ও সম্পাদক স্বর্ণকুমারী দেবী (আনুমানিক ১৮৫৫-১৯৩২) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা । শিক্ষালাভ অন্তঃপুরে আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশির কাছে। বিবাহ ১৭ নভেম্বর ১৮৬৭ নদীয়ার জয়চন্দ্র ঘোষালের পুত্র জানকীনাথের সঙ্গে। সাহিত্য চর্চা শুরু অল্পবয়স থেকেই। গল্প, উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রবন্ধ রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন স্বর্ণকুমারী । বঙ্গাব্দ ১২৯১ থেকে ১৩০১ এবং ১৩১৫ থেকে ১৩২১ অবধি 'ভারতী' পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তৎকালীন বাংলাদেশের থিয়সফিকাল সোসাইটির মহিলা শাখার সভাপতিও নির্বাচিত হন। ১২৯৩ বঙ্গাব্দে প্রধানত অনাথা ও বিধবা মহিলাদের কল্যাণের জন্য 'সখি-সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন কন্যা হিরন্ময়ী দেবী প্রতিষ্ঠিত বিধবা-শিল্পাশ্রমের সভাপতি। স্বামী জানকীনাথের সঙ্গে রাজনীতির চর্চাতেও আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৯০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন প্রতিনিধি হিসাবে। ১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করে বঙ্গসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখিকারূপে সম্মান জানায়।
১৮৮৫-৮৬ থেকে ১৯১২-১৩ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে স্বর্ণকুমারীর লেখা ভ্রমণ কাহিনি ভারতী পত্রিকায় ছাপা হলেও সেগুলি একত্রে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। ভারতীতে প্রকাশিত তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনি - ১২৯৩ (১৮৮৬) সালে প্রকাশিত প্রয়াগ ভ্রমণ, ১২৯৫ (১৮৮৮) সালে প্রকাশিত দার্জিলিং ভ্রমণ, ১২৯৬ (১৮৮৯) সালে প্রকাশিত গাজিপুর ভ্রমণ, ১২৯৮-৯৯ (১৮৯১-৯২) সালে প্রকাশিত সোলাপুর ভ্রমণ, ১৩০২ (১৮৯৫) সালে প্রকাশিত উটি ভ্রমণ ইত্যাদি। এছাড়া ১৩০৬ (১৮৯৯) –এ প্রকাশিত 'পেনে প্রীতি' এবং ১৩২০ (১৯১৩) সালে প্রকাশিত 'পুরী' লেখাদুটিও খুবই আকর্ষণীয়।]
প্রয়াগ দর্শন
স্বর্ণকুমারী দেবী
(১)
মুসলমানদের এলাহাবাদ অর্থাৎ আল্লার স্থান আর আমাদের পুণ্যতীর্থ প্রয়াগ,- এখানে আসিয়া পবিত্র গঙ্গা যমুনার সঙ্গমে স্নান করিয়া কত পাপী তাপী তরিয়া গেল, অধম আমার কিছু হইল না, আমি যে পাপের বোঝা সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলাম – তাহা যেমন তেমনি রহিয়া গেল, এখানে আসিয়া অবধি আমার একদিন গঙ্গাস্নান হয় নাই। এই শীতের দেশ, ভোরে উঠিয়া গঙ্গাস্নানের কথা মনে করিতে গেলেও গায়ে কাঁটা দিয়া উঠে, - তবু না হয় এক দিন কষ্টে শ্রষ্ঠে তাহাও করিব ভাবিয়াছিলাম, কিন্তু শুনিলাম পাণ্ডাদের কিছু কিছু দিয়া মাথা না মুড়াইতে পারিলে শুধু গঙ্গাস্নানের ফল হয় না। তা প্রথমটিতে আমার আপত্তি ছিল না, দ্বিতীয় কথাটি শুনিয়া অবধি এমনি আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছে যে সেই দিন হইতে এই সহজ পুণ্য লাভের আশাটা একেবারে ছাড়িয়া বিজ্ঞ দার্শনিক হইয়া মনে মনে সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছি – এত সহজে পাপমুক্ত হইয়া তৃপ্তি নাই। কর্ম্ম দ্বারাই কর্ম্মকে জয় করা উচিত। যাহউক তাই বলিয়া পুণ্যসঞ্চয়ের অন্য কোন সহজ উপায় পাইলে আমি যে ছাড়িয়া কথা কই তা নয়, - মাথা না মুড়াইয়া আর এই শীতের সময় গঙ্গাস্নান না করিয়া শুধু স্থানদর্শন দ্বারা যতদুর পুণ্য লাভ করা যাইতে পারে তাহার বড় বাকী রাখি নাই, এখানে দেখিবার মত যাহা আছে সকলি প্রায় দেখিয়া লইয়াছি।
প্রয়াগের প্রধান মাহাত্ম্য ত্রিবেণী-সঙ্গমে, গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর পুণ্য মিলন-স্থলে। এখান হইতে সরস্বতী যদিও অনেক দিন অন্তর্ধান করিয়াছেন (পাণ্ডারা বলে অন্তঃশীলা বহিতেছেন) কিন্তু গঙ্গা যমুনার যুগলরূপ এখানে আসিয়া যিনি না দেখেন তাঁর আসাই মিথ্যা। আমরা নৌকা করিয়া একদিন এই সঙ্গম দেখিতে গিয়াছিলাম। যমুনার কালজলে নৌকা ভাসিল, যমুনাপুলের জল-প্রোথিত প্রকাণ্ড স্তম্ভের মধ্য দিয়া তরতর বেগে নৌকা দুর্গ প্রাকারের নিকটে আসিয়া পড়িল। এই দুর্গ আকবর সাহ নির্ম্মাণ করিয়া গিয়াছেন, ইংরাজেরা এখন ভোগ দখল করিতেছেন। একদিন দুর্গের সিংহাসন-আকারে-গঠিত বারাণ্ডার উপর বসিয়া মোগল সম্রাট যখন গর্ব্বভরে চারিদিক নিরীক্ষণ করিয়াছিলেন – তখন তিনি জানিতেন না পেন্টুলুনের মধ্যে কামিজ কসা, রাঙ্গামুখওয়ালা, সমুদ্রপারের সামান্য সৈনিক বাচ্ছারা এক দিন সেই বারান্দায় দাঁড়াইয়া সমান দর্পভরে দূরবীনের ভিতর দিয়া চারিদিক নিরীক্ষণ করিবে। এ জ্ঞানটা সে দিন আমাদের ভাগ্যে ঘটিয়াছিল।
কি প্রকাণ্ড দুর্গ! ইহার গঠনই বা কি মজবুত। দুর্গের পশ্চিম দিকের প্রাকার ভিত্তি ঠিক জলের উপর হইতে উঠিয়াছে, কত শতাব্দীর বর্ষার ভীম তোড় ইহার উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে, তবু দুর্গ এখনো অটল-পাষাণের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে, ভবিষ্যতের শত সহস্র বৎসরের অত্যাচারকে পায়ে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিবার জন্য ভীমদর্পে অপেক্ষা করিতেছে। কি মসলায় গঠিত হইয়া দুর্গের গাঁথনি এত কঠিন হইয়াছে, অনেক চেষ্টা করিয়াও ইংরাজেরা তাহা এখনো আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। নদীর ধারে দুর্গ প্রাকারের এক স্থানে ইহাঁদের আমলে একটু ফাটিয়া যায়, ইহাঁরা তাহা যতবার মেরামত করিতেছেন, ততবারই ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে, কিছুতেই ঠিক দুর্গের অন্য স্থানের মত ইহা মজবুদ করিতে পারিতেছেন না। যমুনার তীরে দুর্গের ঠিক নীচে একটি ধ্বজা পোঁতা দেখিলাম, এই ধ্বজা-নিম্নস্থ কূপেই নাকি এখন সরস্বতী বিরাজিত – তাই ইহার নাম সরস্বতী কূপ। মাঝিরা বলিল উপর হইতে দাঁড়াইয়া দেখিলে কূপের জল দুধের মত শাদা দেখায়। এই কূপে পাণ্ডাদের বিলক্ষণ উপায় হয়। দেখিতে দেখিতে গঙ্গায় আসিয়া পড়িলাম। পূর্বে যমুনার মত গঙ্গাও দুর্গের গা ঘেঁসিয়া বহিত। এদেশের একটি প্রবাদই আছে,
দরিয়াবাদ দরিয়া কিনারে, ফরিয়াবাদ নিশানী,
আকবর যো কিল্লা বানায়া, ত্রিবেণীকা পাণী।
এখন গঙ্গা একটু সরিয়া পড়িয়াছে, তবে বর্ষাকালে অবশ্য এখনো গঙ্গা দুর্গের ভিত্তিতে আসিয়া লাগে। গঙ্গা যমুনার মিলনস্থলে জলের কি তোড়, দুইটা প্রকাণ্ড জলরাশিই একটার উপরে একটা ঝাঁপাই ঝুড়িতে ঝুড়িতে অবশেষে এক হইয়া প্রশান্ত ভাবে সরিয়া পড়িয়া সমুদ্র পানে চলিয়াছে, দুই সতীনে কে স্বামীর কাছে আগে পৌঁছিবে – এই বিবাদে উন্মত্ত হইয়া যেন একজন একজনকে ভীমবেগে ছাড়াইয়া চলিতে চাহিতেছে। ঠিক সঙ্গমস্থানটি দেখিলে কৃষ্ণের মোহিনী মূর্ত্তি মনে পড়ে। আধো কাল আধো শাদা, আধো জটা আধো চিকুর, এই আধ আধ রূপে যেন দিক ভরিয়া গিয়াছে। আধো আধো মিশিয়া এক হইয়া গিয়াও দাম্পত্য প্রেমের মিলনের মত গঙ্গা যমুনার স্বাতন্ত্র্য লোপ হয় নাই।
এখানে নৌকার উপর হইতে গঙ্গার দুই পারের দৃশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। আমাদের ডানদিকে (এলাহাবাদের পরপারে গঙ্গার উপরে খানিকটা লইয়া এবড়ো খেবড়ো উচু নীচু পাহাড়ময় স্থান, ইহার নাম ঝুসি – ইহার কোন অংশে কোন কেল্লার ভগ্নাংশ, (শোনা যায় এপারে ৪ টা কেল্লা ছিল) কোন স্থানে বা কয়েকটা কুঁড়েঘর – কোথায় বা গাছ পালার মধ্যে একটা সামান্য মন্দির, আর পাহাড়ের সর্ব্বোচ্চশিখরে তীরোত্থিত সিঁড়ি সংযুক্ত একটি ক্ষুদ্র ইটের দোতালা বাড়ী অতি দূর হইতে লোকের নজরে পড়িতেছে। (এখানে একজন পরমহংস বাস করেন – এখানকার লোকেদের তাঁহার প্রতি পরম ভক্তি, আমরা তাঁহার কাছে দুই তিনবার গিয়াছিলাম।) এই পাহাড়ময় স্থান খানিকদূর গিয়া সমতল হরিৎক্ষেত্রে শেষ হইয়াছে, শ্যামশষ্যপূর্ণ এই সমক্ষেত্রতীর আবার আমাদের পশ্চাতে যমুনার তীরের সহিত মিশিয়াছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য পূর্ণ গঙ্গার এই তীর দেশ দেখিলে সুখ দুঃখে উদাসীন নিষ্কাম সন্ন্যাসীর গম্ভীর মূর্ত্তি মনে পড়ে, আর আমাদের বামদিকের বেণী ঘাটের প্রতি চাহিলে তাহাতে লোভ কলহময় একটি সংসার মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। এই বৃহৎ ঘাটতীর লোকে লোকে নিশানে নিশানে একাকার। (ভিন্ন ভিন্ন নিশান দেখিয়া লোকে নিজের নিজের পাণ্ডা ঠিক করিয়া লয়) সেই নিশানের মাঝে মাঝে ও গঙ্গার জলময় কূলে কূলে,- সারি সারি তক্তাপাতা। গঙ্গা স্নান করিয়া কেহবা তক্তার উপর বসিয়া ফোঁটা কাটিতেছে, কেহ কাপড় ছাড়িতেছে, কেহ পূজা আহ্নিক করিতেছে, কেহবা তক্তাতে বইয়া নীচের জল তুলিয়া তুলিয়া স্নান করিতেছে, আর গঙ্গার জলের সারবন্দি লোকের কথাই নাই। গঙ্গার ঠিক ধারে – এমন কি ঠিক বা জলের উপরও মাঝে মাঝে এক একখানা অস্থায়ী বন্দবস্তের সামান্য রকম আটচালা দেখা যাইতেছে, শোনা গেল তাহার একখানিতে সেরাজপুরের রাণী মকদ্দমা করিতে আসিয়া কল্পবাস করিতেছেন। তীরে নানা রকমের দোকান। নিশানের মাঝে মাঝে এক একটা বড় বড় তাল পাতার ছাতির নীচে পাণ্ডারা এক একটা মাটীর ঢিবি, পাথরের ঢিবিকে রং চঙ্গে কাপড় পরাইয়া ঠাকুর সাজাইয়া দোকান পাতিয়া বসিয়াছে। যাত্রীদের এই সকল মূর্তিকেই দক্ষিণা দিয়া যাইতে হয়। ইহা ছাড়া সত্যকার দোকানঘর দেবদেবীর মূর্ত্তিরও এখানে অভাব নাই। যখন বর্ষাকালে এই তীর ডুবিয়া যায় তখন পাণ্ডারা উপরে ফোর্টে যাইবার উঁচু রাস্তার ধারে সমস্ত দোকান তুলিয়া আনে। বর্ষাকালে ঠিক এই রাস্তার নীচে পর্য্যন্ত জল আসে। এখন গঙ্গা এই রাস্তা হইতে কত দূরে পড়িয়াছে। এখন এই রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া দেখ তোমার সম্মুখে নীচে সুদূর প্রসারিত বালির চড়া ধূ ধূ করিতেছে, সেই বিশাল চড়ার এক পাশে অতি দূরে একটা সূক্ষ্ম রেখার মত গঙ্গা আঁকিয়া বাঁকিয়া গিয়া যমুনার সহিত মিশিয়াছে। এই সরু গঙ্গা দেখিলে তাহাকে গঙ্গা মনে হয় না, সে যেন একটা স্বপ্ন দৃশ্য। কে জানে নৌকার উপর অপেক্ষা এই উঁচু রাস্তার উপর হইতে গঙ্গার এই দৃশ্যটা যেন আমার বেশী ভাল লাগে।
এই রাস্তার ধারে একটি গাছের তলায় একজন বৃদ্ধ জৈন বসিয়া আছেন এইখানে বেড়াইতে আসিয়া আমরা দুই দিন তাহাকে দেখিয়াছিলাম। তিনি অন্ধ, গাত্রে কোন বস্ত্র নাই, পরণে নেংটিমাত্র, তাঁহার দাড়ী বুকে আসিয়া পড়িয়াছে। দুই দিনই দেখিলাম – তিনি বিজির বিজির করিয়া মালা জপিতেছেন। আমরা কথা কহিলাম – তিনি বুঝিতে পারিলেন না, চেলাদের জিজ্ঞাসা করিলেন "কেহ আসিয়াছে কি?" তাহারা বলিল "হাঁ"। আমরা চেলাদের দিয়া তাঁহাকে দুএক কথা কি প্রশ্ন করিলাম, কিন্তু বৃদ্ধের তাহা ইন্দ্রিয়গম্য হইল না তিনি অন্যরূপ উত্তর দিতে লাগিলেন, চেলারা হাসিতে লাগিল। বৃদ্ধের নাম সুরদাস – শুনিলাম অনেক দিন হইতে দিন রাত্র নাই, শীত রৌদ্র নাই সমান এই স্থানে বসিয়া আছেন। গবর্ণমেণ্ডের রেকর্ডেই পাওয়া যায় – তিনি ৫৫ বৎসর কাল এইরূপে বসিয়া আছেন, অনেকে বলেন – আরো বেশী দিন হইতে তিনি এইখানে বসিয়া আছেন। কি অসীম ধৈর্য্য! আগে আগে নাকি রাত্রি দুইটার সময় একবার করিয়া তিনি হাঁটিয়া গঙ্গা স্নান করিতে যাইতেন – এখন এমন শক্তিহীন – যে চেলারা তুলিয়া না লইয়া গেলে তিনি আর নড়িতে পারেন না। ইনি কাহারো নিকট ভিক্ষা করেন না, ইচ্ছা করিয়া যে যাহা দেয়। শুনিলাম এখন ইহাঁর এত টাকা জমিয়াছে – যে ইহাঁর নামে এলাহাবাদে একটী ব্যাঙ্ক চলিতেছে, পরে তাঁহার চেলারাই তাঁহার বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইবে।
বেণীসঙ্গম দেখিয়া আমরা অক্ষয়বট দেখিতে এই রাস্তা দিয়া দুর্গ মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দুর্গ-সুড়ঙ্গে প্রবেশ করিয়া যাখন শস্ত্রধারী প্রহরীদের নিকট দিয়া দুর্গদ্বার অতিক্রম করিতে লাগিলাম – গাটা যেন ঝম ঝম করিয়া উঠিতে লাগিল।
এই দুর্গ নির্ম্মাণ কৌশল – আর কলিকাতার দুর্গ নির্ম্মাণ কৌশল শুনিলাম এক, এই দুর্গ দেখিয়াই নাকি ইংরাজেরা সেই ধরণে কলিকাতার দুর্গ নির্ম্মাণ করিয়াছেন। দুর্গের একেবারে ভিতরে প্রবেশ করিতে হইলে একে একে চারিটি প্রকাণ্ড দ্বার অতিক্রম করিতে হয়। প্রতি দ্বারেই শস্ত্রধারী প্রহরী, এক দ্বার অতিক্রম করিয়া আর একটি দ্বার পর্যন্ত্য স্থান যেন সৈনিকপূর্ণ গোলা-কামানপূর্ণ এক একটি ক্ষুদ্র রাজ্য। দুর্গের পয়ঃপ্রণালীর এমনি বন্দবস্ত যে ইচ্ছামাত্র দুর্গ দ্বারের নিম্নের দুই পার্শ্বের স্থান একেবারে জলময় করিয়া তোলা যায়,- শত্রু আসিতে হইলে প্রথমতঃ সেই জল পার হইয়া দুর্গবাসীদের সহিত যুদ্ধ করিয়া তবে দ্বারে প্রবেশ করিতে পাইবে। সচরাচর সকলে দুর্গের তৃতীয় দ্বারের ভিতর পর্য্যন্ত যাইতে পারে – আমরাও তিনটি দ্বার পার হইলাম, দেখিলাম – প্রথম ও দ্বিতীয় দ্বারে দেশী সৈন্য তৃতীয় দ্বারে ইংরাজ সৈন্য পাহারায় নিযুক্ত। যদি মরিতে হয় আগে আমাদের দেশের লোকগুলা – যা শত্রু পরে পরে। পাশ না থাকিলে চতুর্থ দ্বার অতিক্রম করিয়া কেহ আসল দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। এখানে আর কি অস্ত্রাগার প্রভৃতি আছে। আমাদের পাশ ছিল না – আমাদেরও ইহার মধ্যে যাওয়া হইল না। কিন্তু এবার না হউক - আর একবার আমরা পাশ লইয়া অস্ত্রাগার দেখিতে গিয়াছিলাম। সে কি কাণ্ড! ঘরের চারিদিকে কত রকম করিয়া বন্দুক সাজান, দেয়ালে দেয়ালে বর্ষা তরবার সঙ্গীন ঝক ঝক করিতেছে – যে দিকে চাই – চোক যেন ঝলসিয়া যায়। যাক – আমরা তৃতীয় দ্বার পার হইয়াই সম্মুখের বাগানে অশোক স্তম্ভ দেখিলাম। স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার সময় প্রভৃতি পালিভাষায় স্তম্ভের গায়ে লেখা আছে। এদেশে ছোট লোকেরা ইহাকে ভীমের গদা বলে। এ গদা দেখিয়া ভীমকে কল্পনা করা সহজ কথা নহে। এই স্তম্ভ ছাড়াইয়া কিছু দূরেই অক্ষয়বটের সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের কাছে আমাদের গাড়ী আসিয়া থামিল – আমরা কয়জনে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া সুড়ঙ্গে প্রবেশ করিলাম। নামিবা মাত্র অন্ধকারে চ'খে যেন ধাঁদাঁ লাগিয়া গেল – একজন পাণ্ডা আলো হাতে লইয়া আমাদের পথ দেখাইয়া চলিল। সিঁড়ি হইতে নামিয়াই সুড়ঙ্গের এক পাশে – আমাদের সম্মুখে একটি প্রস্তর মূর্ত্তি, তাহা দেখাইয়া পাণ্ডা বলিল – " ইহা প্রয়াগের ত্রিবেণীমাধবের মূর্ত্তি। যেখানে এখন এই দুর্গ দেখিতেছ এই দুর্গ নির্ম্মাণের আগে এ স্থান গঙ্গার জলে পূর্ণ ছিল, আকবর তাহা দেখিয়া ত্রিবেণীমাধবের কাছে আসিয়া এই বর প্রার্থনা করিলেন – যে ৫০০ বৎসরের জন্য গঙ্গা কিছু সরিয়া যাউন বেণীমাধবজি তাঁহার স্তবে তুষ্ট হইয়া বলিলেন '৫০০ বৎসর কেন আমি গঙ্গা লইয়া হাজার হাজার বৎসরের জন্য এখান হইতে হটিয়া যাইতেছি – তুমি এই স্থানে দুর্গ নির্ম্মাণ কর'।
গল্প শুনিতে শুনিতে সুড়ঙ্গটা দেখিয়া লইলাম, সুড়ঙ্গটা উচ্চে দেড় মানুষ আন্দাজ, প্রস্থে পাশাপাশি বোধ হয় – ২/৩ জন লোক এক সঙ্গে চলিতে পারে – আর দৈর্ঘ্যে আন্দাজ ২৫। ৩০ হাত মনে হইল। সুড়ঙ্গের দুই পাশের দুই দেয়ালে অনেক কোলঙ্গা, এক এক কোলঙ্গায় এক এক দেবতামূর্ত্তি; মূর্ত্তিগুলি সবই প্রায় পাথরের – তাহার কোনটারই না আছে ছাঁদ না আছে শ্রী, সবই নিতান্ত অদ্ভুত রকমের। কোলঙ্গাস্থিত দেবতাগুলির নাম বলিতে বলিতে পাণ্ডা আমাদের পথ দেখাইয়া চলিতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে একটি কোলঙ্গায় রাম লক্ষ্মণের মূর্ত্তির কাছে প্রস্তর খোদিত আলাদা একখানি পা দেখিলাম। শুনিলাম, উহা ভগবানের শ্রীচরণ – বিনা আয়াসে আশার অতীত ফল লাভ করলাম – ভগবানের চরণ দর্শন ঘটিল – দুঃখের মধ্যে তাহাতে সশরীরে স্বর্গ লাভ ঘটিল না। পাণ্ডা বলিল রামচন্দ্র বনে যাইবার সময় যখন প্রয়াগ হইয়া যান তখন এই পদাঙ্ক রাখিয়া গিয়াছেন। পাণ্ডার সে কথা শুনিয়া আমাদের সঙ্গের একজন দেশী হিন্দু চাকরের মনে এতটা ভাবোদয় হইল – যে সে ওহো ওহো করিয়া উঠিল – চোখে জল আসিয়াছিল কি না সেটা ঠিক দেখিতে পাই নাই। অক্ষয়বটের কাছাকাছি আসিয়া সুড়ঙ্গের মেজেতে কয়েকটি শিব স্থাপনা দেখিলাম – একটা শিবের পাথর খানিকটা ভাঙ্গিয়া গেছে। পাণ্ডা বলিল আরঞ্জীব ইহা ভাঙ্গিয়া দিয়াছিলেন – ভাঙ্গিবামাত্র রক্তে সুড়ঙ্গ ভাসিয়া গিয়াছিল। আরঞ্জীব কি রূপ অত্যাচারী ছিলেন, কত হিন্দু দেব দেবী নষ্ট করিয়াছিলেন তাহাও সে গল্প করিতে লাগিল। কথা কহিতে কহিতে আমরা সুড়ঙ্গের প্রায় শেষ ভাগে আসিয়া বটবৃক্ষের সম্মুখে দাঁড়াইলাম। যাহা দেখিলাম আশ্চর্য্য হইয়া গেলাম। সেই রৌদ্রহীন বায়ুহীন নিরালোক বন্ধ প্রদেশে দু একটি নবীন পাতা মুঞ্জরিত একটি ছিন্নমস্তা জীবন্ত বৃক্ষ দেখিয়া আশ্চর্য্য হইয়া গেলাম।
গাছের প্রধান যে গুঁড়ি তাহা মাটি হইতে আন্দাজ আধ হাত উর্দ্ধে উঠিয়া সেখান হইতে অপেক্ষাকৃত দুইটা ছোটগুঁড়িতে ভাগ হইয়া উর্দ্ধে উঠিয়াছে। অর্থাৎ প্রধান গুঁড়ির দুইদিক হইতে দুইটা মোটা মোটা গুঁড়ির মত ডাল উঠিয়া গুহার ছাতের কাছাকাছি পৌঁছিয়াছে। গাছ সুড়ঙ্গের মাথা স্পর্শ করিবে ভয়ে – গুঁড়ির ছাদমুখী আগা দুইটি একেবারে কাটা। সুতরাং এই গাছের চেহারা মাটীতে পোঁতা একগাছা মাথা কাটা খোলা রান্নার বেড়ীর মত। প্রধান গুঁড়ির দুই পাশে দুই জায়গায় এক একটি নিতান্ত ছোট সরু ডাল বাহির হইয়াছে, সেই ডালে কাঁচা কাঁচা দুই চারিটি পাতা, তাহা ছাড়া সমস্ত গাছে একটি ডাল নাই, একটি পাতা নাই, বেড়ীর ডাণ্ডার মত সেই মোটা মোটা গুঁড়ি দুইটিই এই গাছের সর্ব্বস্ব। এই গুঁড়ি দুইটি গাঁটে গাঁটে ভরা – সেই গাঁট গুলি দেখিতে কাঁচা কাঁচা, মনে হয় উহা হইতে কিছু দিন পরে নূতন পাতা বাহির হইবে। কিন্তু শুনিলাম – নূতন পাতা এগাছে কদাচিৎ দেখিতে পাওয়া যায়। অনেক দিনের পর এবার নূতন পাতা দুই একটি বাহির হইয়াছে, আবার অল্পদিনের মধ্যে শুকাইয়া যাইবে। ইহা কিছুই আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, বিনা বাতাসে বিনা আলোকে গাছটি বাঁচিয়া আছে ইহাই আশর্য্য। এই গুহা অক্ষয়বটের জীবন্ত সমাধি। পৃথিবীতে শুনিয়াছি সাতটি আশ্চর্য্য সামগ্রী আছে আমার ত মনে হইল এই অক্ষয় বটকে আর একটি আশ্চর্য্য বলিয়া গণ্য করা উচিত।
এ গাছটি কত কালের কেহ বলিতে পারিল না – আমাদের পথপ্রদর্শক পাণ্ডা বলিল – "ইহা সৃষ্টির প্রথমে জন্মিয়াছে। আবার যখন প্রলয় কালে পৃথিবী জলমগ্ন হইবে তখন এই গাছ হইতে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তিনটি পাতা উৎপন্ন হইয়া সেই জল ঢাকিয়া দিবে – আর সেই তিনটি পাতাতে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর আবার জন্ম গ্রহণ করিয়া পুনর্সৃষ্টি করিবেন"। পাণ্ডাটি দেখিলাম গল্পের ভাণ্ডার, যা জিজ্ঞাসা কর উত্তর মুখে লাগিয়া আছে, তা সে উত্তর তুমি ঠিক অঠিক যা মনে করে লও তাহাতে তার কিছুই আপত্তি নাই। অক্ষয়বটের পর অল্প দূর গিয়া সুড়ঙ্গের শেষ, শেষটা একেবারে বন্ধ নহে, একজন মানুষ যাইতে পারে এইরূপ ফাঁক আছে। পাণ্ডা বলিল এই সুড়ঙ্গ বরাবর কাশি পর্য্যন্ত গেছে। পাণ্ডার কাছে আকবরের জন্মের একটি বড় মজার গল্প শুনিলাম। অক্ষয় বটের কাছাকাছি সুড়ঙ্গের মেজের এক জায়গায় একটু খোঁড়া খোঁড়া গর্ত্তের মত আছে, পাণ্ডা তাহা দেখাইয়া বলিলেন "এইখানে বালমুকুন্দ নামে এক ব্রহ্মচারী বসিয়া ধ্যান করিতেন, একদিন তাঁর শিষ্যেরা তাঁহাকে যে দুধ পান করিতে দিয়াছিল তাহাতে একগাছি গরুর লোম ছিল, সেই লোম মুখে পড়িবা মাত্র ব্রহ্মচারী বলিলেন – হা শিষ্যগণ কি করিলে – আমাকে এমন পাপলিপ্ত করিলে! এই বলিয়াই তিনি তখনি তনুত্যাগ করিলেন, আর সেই পাপে মুসলমানের ঘরে আকবর বাদশা রূপে জন্মগ্রহণ করিলেন।" আকবরের প্রতি দেশের লোক কিরূপ সন্তুষ্ট ইহা হইতে বুঝা যায়। আকবরের এবং তাঁহার মন্ত্রী বীরবলের প্রশংসা এদেশের লোকের মুখে ধরে না। পাণ্ডা বলিল আকবরই অক্ষয় বটের এই সুড়ঙ্গ নির্ম্মাণ করিয়া দেন, আর মন্ত্রী বীরবল এই সুড়ঙ্গ স্বর্ণনির্ম্মিত করিতে গিয়াছিলেন – শেষে তাহাতে দস্যু উপদ্রব হইবে ভাবিয়া তাহা করেন নাই। এত গল্প করিয়াও তবু সেদিন পাণ্ডার অনেক গল্প বাকী রহিয়া গেল তাই পরদিন তাহাকে আমাদের বাড়ী আসিতে বলিলাম। সেদিন আসিয়া ইংরাজ গবর্ণমেন্টের হাতে পড়িয়া তাহাদের আয়-পসার কিরূপ কমিয়াছে সেই দুঃখই সে বেশী করিল; যাহা বলিল তাহার মর্ম্ম এই, -
ইংরাজদের ইচ্ছা নয় যে পাণ্ডারা ফোর্টে থাকিতে পায়, তাহাদের উঠাইবার জন্য তাহারা কত চেষ্টা করিয়াছে কিন্তু আকবরের পরোয়ানার জোরে তাহারা বাঁচিয়া গেছে, আকবর দুর্গ নির্ম্মাণের সময় পাণ্ডাদের এইরূপ পরোয়ানা দিয়াছেন যে "তাহারা বংশানুক্রমে এই দুর্গমধ্যে থাকিয়া এই বৃক্ষের আয় ভোগ দখল করিবে – এখান হইতে অন্য কোন রাজা তাহাদিগকে উঠাইতে পারিবে না।" ইংরাজেরা এ মকদ্দমায় পরাজিত হইল বটে কিন্তু রবিবার দিন যাত্রীদের এখানে আসা বন্ধ করিল, পাণ্ডাদের তাহাতে বিলক্ষণ ক্ষতি, তাহারা অনেক হেঙ্গাম করে প্রয়াগবাসী বরোদার ভূতপূর্ব্ব মন্ত্রী দিনকর রাওকে ধরিয়া গভর্নর জেনারেলের কাছ হইতে ২।৩ বৎসরমাত্র সে নিয়ম রহিত করিবার হুকুম আনাইয়াছে। কিন্তু তাহাদের সম্পূর্ণ অসুবিধা যে এখনো দূর হইয়াছে তাহা নহে, দিনের মধ্যে সকল সময় যাত্রী অক্ষয়বট দেখিতে আসিতে পায় না, সকালে বিকালে কয়েক ঘন্টা করিয়া অক্ষয়বট দেখিবার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। ইহার উপর (পাণ্ডারা প্রতি দিন যত লাভ করুক না করুক) গোরা প্রহরীদের প্রতিদিন নাকি পাঁচসিকা করিয়া ঘুষ দিতে হয়, নহিলে তাহারা যাত্রী ভাগাইয়া দেয়। আমরা যেদিন গিয়াছিলাম, দেখিলাম – অনেকে ফুল দিয়া গাছ পূজা করিতেছে, তাহার মধ্যে একজন সন্তান কামনায় আসিয়াছে।
খসরুবাগ এখানকার দেখিবার আর একটি প্রধান স্থান। জাহাঙ্গীরের পুত্র খসরু যখন এ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন তখন তিনি এ বাগান প্রস্তুত করেন, তাঁহার মৃত্যুর পর এই সাধের বাগানেই তাঁহার সমাধি হইয়াছে। এখন এ বাগান গবর্ণমেন্টের হাতে। ৩।৪ শত টাকা বেতনে একজন নাকি এ বাগানের ইংরেজ তত্ত্বাবধায়কই আছে। বাগানের দুইটি গেট। প্রথম গেটের ভিতরকার কম্পাউণ্ড এখন বাগানের সামিল নহে, সেখানকার দোকান রাস্তা এখন গবর্ণমেন্টের। আগে এইখানে বাগানের খাস দোকান বসিত। ইহার কাছে একটি কূপ-বাটিকা আছে। দোতালা বাড়ির মধ্যে কূপ, কূপের ভিতর পর্য্যন্ত সিঁড়ি, গরমি কালে বেগমেরা আর কি এইখানে বাস করিতেন। প্রথম গেটের কমপাউণ্ডের সীমায় দ্বিতীয় আর একটি প্রকাণ্ড গেট – ইহা উচ্চে ৫০ হাতেরও হয়ত অধিক হইবে ও এই গেটের শিল্প-কার্য্যও বড় চমৎকার। গেটের মধ্যে ঢুকিয়া বাগানের রাস্তার দুই পাশে চাহিয়া দেখ চিত্র বিচিত্র মখমল শয্যা বিছান রহিয়াছে, সে মখমল পশমের মখমল নহে, ঘাসের মাঝে মাঝে নানান বর্ণের বিলাতি ফুল ফুটাইয়া ঠিক মখমলের মতো সাজান হইয়াছে। তারপর ফুল বাগান, হাজার হাজার নানা রঙের নানা আয়তনের গোলাপ একসঙ্গে ফুটিয়া সৌরভে চারদিক আকুল করিয়া রাখিয়াছে, গোলাপফুলের এমন কারখানা আর কখনও দেখি নাই। অন্য ফুল যে একেবারে নাই তাহা নহে, তবে খসরুবাগ গোলাপের জন্যই প্রসিদ্ধ।
বাগানের মধ্যে এক লাইনে তিনটি সমাধি মন্দির। প্রথমটি খসরুর মাতার, দ্বিতীয়টি শূন্য। খসরুর এক স্ত্রীর জন্য ইহা নির্ম্মিত হয়, কিন্তু রুগ্নাবস্থায় দিল্লিতে বায়ু পরিবর্তন করিতে গমন করিয়া সেইখানেই প্রাণত্যাগ করেন এবং সেইখানেই তাঁহার দেহ প্রোথিত হয় – সুতরাং এখানকার মন্দিরটি শূন্যই রহিয়া গিয়াছে। তৃতীয় মন্দিরটিতে স্বয়ং খসরু ও তাঁহার দুই বালক পুত্র শয়ান আছেন। হতভাগ্য খসরু সাজাহানের প্ররোচনায় তাঁহার দুইটি বালক পুত্রের সঙ্গে একই দিনে একজন হাবসি ক্রীতদাস কর্তৃক নিহত হন। খসরু ও সাজাহান দুই সহোদর ভ্রাতা, ইহাঁদের মাতা মানসিং হের ভগিনী। পিতা জাহাঙ্গীর বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতেই রাজ্যলোভে দুই ভাইয়ে বিবাদ আরম্ভ হয়। এই বিবাদ নিবৃত্তির জন্য দুই ভাইকে স্বতন্ত্র রাখিবার ইচ্ছায় জাহাঙ্গীর খসরুকে এলাহাবাদের শাসনভার দিয়া এইখানে প্রেরণ করেন। সাজাহান ও খসরুর বিবাদে খসরুর মাতা সাজাহানকেই দোষী দেখিতে পান ও তাহাতে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া তিনি তাঁহার মুখ দর্শন করিবেন না স্থির করিয়া পুত্র খসরুর সহিত এলাহাবাদে আগমন করেন। খসরু এখানে আসিয়াও নিস্তার পাইলেন না। একদিন তিনি ও তাঁহার দুই পুত্র খসরুর সহিত আহার করিতেছেন, মুহূর্তের জন্য অন্য ভৃত্যবর্গ সরিয়া গিয়াছে – এই সময় খসরুর এক ভৃত্যবেশি সাজাহানের লোক তিনজনকে একসঙ্গে হত্যা করে। কিন্তু পরে সাজাহান দোষমুক্ত হইবার জন্য ইহাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া মারিয়া ফেলিতে আজ্ঞা দেন। পুত্রশোকে রাজ্ঞীও কিছুদিন পরে প্রাণত্যাগ করেন।
যে ফকীরের উপর এই তিনটি সমাধি মন্দির দেখিবার ভার, আর যে আমাদের সঙ্গে লইয়া মন্দিরগুলি দেখাইয়া বেড়াইতেছিল, তাহার কাছেই আমরা এই সব কথা শুনিলাম। ফকির পারস্য দেশের ভাষা বেশ জানে। সমাধি মন্দিরে খোদিত কথা পড়িয়া সে আমাদের তাহার মর্ম্ম বুঝাইয়া দিতে লাগিল। খসরুর সমাধি মন্দিরের ভিতর দিকের দেয়ালে অনেকগুলি এই মর্ম্মের কবিতা লেখা আছে - ধনের জন্য কি-না হয় – পুত্র পিতার অবাধ্য হইয়া পড়ে, ভাইকে ভাই নিধন করে – ইত্যাদি। একস্থলে অন্যরূপ অর্থে দুই ছত্রের কবিতা বড় ভাললাগিল – তাহার অর্থ এই, "এই যে নবাব খসরু – ইনি অতি সূক্ষ্মবস্ত্রের ভার সহ্য করিতে পারিতেন না, অঙ্গে ব্যথা লাগিত, এখন কত মন পাষাণভারের নীচে স্বচ্ছন্দে শুইয়া আছেন।"
খসরুর গোরের পাথরের উপর কতকগুলি ফুল ছড়ান দেখিলাম। শুনিলাম, মুসলমানেরা অনেকে অনেক কামনা করিয়া খসরু ও তাঁহার পুত্রদিগকে পূজা করিয়া যায়, বিনা-অপরাধে হত হইয়া আর-কি ইহাঁরা "সহিদ" অর্থাৎ দেবতা হইয়াছেন।
এইসব দেখিয়া শুনিয়া একটা ঔদাস্যময় কষ্টের ভাব সঙ্গে লইয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। সমাধিস্থল দেখিলে মনে কি যে একটা কিছুই কিছু নয় ভাব আসিয়া পড়ে, সহজে সে ভাব মন হইতে তাড়ান যায় না। অথচ এই কষ্টেরও এমন একটা আকর্ষণ আছে – সমাধি-ক্ষেত্রে আসিলে আর ফিরিতে ইচ্ছা করে না, - কে জানে মৃত্যুর মধ্যে কি মায়া নিহিত, মৃত্যুকে সকলে দূরে রাখিতে চায়, মৃত কেহ দেখিতে চায় না – তবু শব দেখিলে তাহার দিকে না চাহিয়া যেন কেহ থাকিতে পারে না। একদিন এখানকার ইংরাজদের গোরস্থান দেখিতে গিয়াছিলাম। কত সাধের স্ত্রী মরিয়াছে – স্বামী সেই মৃতদেহের উপর উচ্চ স্মৃতি স্তম্ভ নির্ম্মাণ করিয়াছেন, কত স্ত্রী মৃত স্বামীর গোরের উপর অশ্রুমাখা কাতরোক্তি লিখিয়াছেন। একজন ধনীর একটি মাত্র পুত্র একুশ বৎসর বয়সে ঘোঁড়া হইতে পড়িয়া মরিয়া গিয়াছে, একজন একে একে চারিটি পুত্র কন্যা ও স্ত্রীকে এই খানে শুয়াইয়া রাখিয়া গেছেন, সংসারে বুঝি আর তাহার কেহ নাই। কত পুত্র কন্যা পিতামাতা ভাই ভগিনী স্বামী স্ত্রী অশ্রুজল ও হৃদয় বেদনা মাখাইয়া প্রিয় মৃতের মাটি শয্যার উপর ফুল শয্যা নির্ম্মাণ করিয়া গিয়াছে। এ যে স্থল এখানে অশ্রু বেদনা স্নেহ প্রেম কিছুই পৌঁছে না। সমাধি ক্ষেত্রে আসিলে স্নেহ প্রেমের অশ্রু বেদনার এই উপেক্ষা দেখিয়া মর্ম্ম বিদ্ধ হয়, সংসারের অনিত্যতা প্রাণের ভিতরে ভিতরে প্রবেশ করে, অহঙ্কার ভুলাইয়া দেয়, - ক্রমে সেই কষ্টের মধ্যে একটা পবিত্র প্রশান্ত ভাব অন্তঃশীলা বহিতে আরম্ভ হইয়া সেই কষ্টটাকে উপভোগ্য করিয়া তুলে, তখন সমাধি মন্দির হইতে আর ফিরিতে ইচ্ছা হয় না, তাহার মধ্যে একটি সত্য দেখিতে পাওয়া যায়।
(২)
গঙ্গার যেমন বেণী ঘাট প্রধান, যমুনার তেমনি বড়ুয়া ঘাট প্রধান। কিন্তু বেণী ঘাট সঙ্গমঘাট বলিয়া ইহা একটি প্রধান তীর্থ স্থান, কাজেই এঘাটে যেমন লোকের ভিড়, নিশানের কারখানা বড়ুয়া ঘাটে তাহার কিছুই নাই।
আমরা দুই দিন নৌকা করিয়া যমুনায় বেড়াইতে গিয়াছিলাম। বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি – এখানকার নদীতে স্রোতের তেমন জোর নাই, কেননা সমুদ্র নিকটে নহে বলিয়া গঙ্গা যমুনায় এখানে জোয়ার ভাঁটা খেলেনা, সুতরাং নৌকা যেদিকে ইচ্ছা অতি সহজে চালান যায়। এখানে নৌকার চলাচল যে বেশী আছে তাহা নয়, যমুনার পুলের কাছে – নৌকার আড্ডাস্থলেই মোট ৪।৫ খানি মাত্র নৌকা সর্ব্বদা বাঁধা থাকে, আর নদীর বুকে মাঝে মাঝে দু-এক খানি নৌকা চলিতে দেখা যায়। ধোপারাই এখানকার নদীর শোভা। যমুনার ধারে ধারে সারা দিনই প্রায় সার গাঁথিয়া ধোপারা আহা ওহো শব্দ করিতে করিতে তালে তালে কাপড় কাচে – কোথায় যমুনা পুলিনে শ্যামের বংশীধ্বনি আর কোথায় ধোপাদের এই চীৎকার সঙ্গীত! বড়ুয়া ঘাটের কাছে যমুনার ধারেই দুইটি বড় বড় অট্টালিকা, আর ঘাট হইতে কিছু দূরে সুন্দর একখানি বাঙ্গলা। বাঙ্গলাখানি মিশনারীদের, আর অট্টালিকা দুইটির একটি কাশীর রাজার, একটি একজন ফকীর। ফকীর সম্প্রতি মরিয়াছে। কাশীর রাজার বাড়ীটির প্রস্তর-গেট চন্দন কাঠের বাকসের মত বড় সুন্দর লতাপাতা ফুলকাটা। এদেশের লোকে পাথরের উপর বড় সুন্দর কাজ করিতে পারে, - এখানকার ধনী মাত্রেরই প্রায় পাথরের বাড়ী।
প্রথম দিন আমরা নৌকা করিয়া বড়ুয়া ঘাট হইতে আন্দাজ এক ক্রোশ চলিয়া আসিয়া দেখিলাম গহনা গাঁটী ও রঙ্গি কাপড় পরা স্ত্রীলোকেরা ঝমঝম করিয়া ও ফিটফাট পুরুষেরা সার গাঁথিয়া তীর দিয়া চলিয়াছে। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করায় মাঝিরা বলিল – "নিকটে শ্যামা মাজির গাছ তলায় মেলা ছিল – সেখান হইতে লোকেরা ফিরিয়া যাইতেছে।" শুনিলাম সে বৃক্ষটি নিকটেই নদীর তীরে। আমরা সেইখানে নোউকা লাগাইতে হুকুম দিলাম। খানিক পরে একটা পাহাড়ের মত উঁচু জায়গার নীচে নৌকা থামিল – আমরা নৌকা হইতে তীরে নামিয়া সেইখানে উঠিলাম, দেখিলাম সেই উচ্চস্থানে একটা বাঁধান গাছতলায় কতকগুলা ভাঙ্গাচোরা মূর্ত্তি, তাহাই শ্যামামায়িজি। সকালে এইখানে মেলা হইয়া গিয়াছে, পুতুলগুলো সব সিঁদুর মাখান, আর নিকটে অনেক ভাঁড় কোড় পড়িয়া আছে – তাহাই মেলার অবশেষ। সেই উচ্চ পাড়ের নিম্ন দেশ দিয়া যমুনার একটা শাখানদী বর্ষাকালে কানপুর পর্য্যন্ত চলিয়া যায়, এখন তাহার শুষ্ক চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে। এই উচ্চ স্থান হইতে যমুনা দেখিতে কি সুন্দর – নীল আকাশ প্রতিবিম্বিত যমুনার জল এত ঘোর নীল যে সমুদ্র ও যেন অত নীল নহে। সেই কাল জলে – তীরের বৃক্ষছায়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে – সূর্য্যের কিরণ চিক চিক করিতেছে, সমস্ত আকাশটা তাহার মধ্যে ঢেউএর মত উঠিতেছে পড়িতেছে, একটা ছোট্ট হৃদয়ের মধ্যে একটা অসীম জগৎ সংসারের যেন লীলাখেলা চলিয়াছে।
সেদিন আর বেশীদূরে যাওয়া হইল না সেইখান হইতে বাড়ী ফিরিলাম। পরদিন খুব ভোরে নৌকায় উঠিয়া সেস্থান ছাড়াইয়া আরো অনেক দূরে যমুনার বক্ষে একটি পাহাড় দ্বীপ উঠিয়াছে, দুইটার সময় সেইখানে পৌঁছিলাম। দ্বীপটির নাম সুজান দ্বীপ। দ্বীপটি স্তরে স্তরে দীর্ণ বিদীর্ণ একটি প্রকাণ্ড পাষাণ মূর্ত্তি। তাহার পদতলে নদীর জলে বড় বড় ভাঙ্গা পাথর গড়াগড়ি যাইতেছে – তাহার গায়ে এক একটা বড় বড় চাঙ্গড়া এমনি ভাবে ঝুঁকিয়া আছে – যেন এখনি পড়িয়া যাইবে। যমুনার জলের মধ্যে স্তরে স্তরে মর্ম্মে মর্ম্মে বিদারিত সেই উচ্চ পাহাড়ের মাথায় একটি শিব মন্দির। মন্দিরে উঠিবার জন্য নীচে হইতে মন্দির পর্য্যন্ত বরাবর পাহাড় কাটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়া আমরা মন্দিরে উঠিলাম। মন্দিরটিতে জন মানব নাই, মন্দিরের নিকটে একটি মাত্র নিম গাছ – আর আশে পাশে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া দুএকটা আগাছার জঙ্গল ছাড়া তাহার চারিপাশের অসমান জমি মাজা পাথরের মত ঝরঝরে। মন্দিরের ভিতরের দেয়ালে দেয়ালে ফার্সি লেখা, শিবমন্দিরে ফার্সি লেখা কেন বুঝিতে পারিলাম না।
এই দ্বীপের সম্মুখে যমুনার তীরে আর একটি উঁচু পাহাড় – মধ্যে একটা জলের ব্যবধান; দেখিলে মনে হয় – এই দুই পাহাড় আগে একটি মাত্র সংলগ্ন পাহাড় ছিল, পরে কোন কারণে ইহাদের মধ্যস্থিত পাহাড় অংশ ভাঙ্গিয়া ইহারা এমন বিচ্যুত হইয়া পড়িয়াছে সুজান দ্বীপ দেখা হইলে আমরা আবার নৌকা করিয়া তীরে নামিয়া ঐ পাহাড়ের উপর উঠিলাম। ঐ পাহাড়ের উপর সমুখা সমুখি দুইটি মন্দির – একটি কৃষ্ণ রাধার, একটি শিবের। কৃষ্ণ রাধার মন্দিরটি বেশ সুসজ্জিত। এ পাহাড় জন শূন্য নহে, এখানে মন্দিরের কাছে লোক জনের বসতি আছে, মন্দিরের উদ্যান ভূমির মধ্যেই একজন পুরোহিত বাস করেন। এই পুরোহিতের কাছে শুনিলাম নবাব সাসুজা তাঁহার একজন প্রিয় হিন্দু কর্ম্মচারীর অনুরোধে – যমুনা বক্ষস্থ ঐ দ্বীপের মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দিয়া, তাঁহার নিজের নামে ঐ মন্দির ও দ্বীপের নামকরণ করেন, তখন বুঝিলাম শিবের মন্দিরে ফার্সি লেখা কেন।
এই সব দেখিয়া শুনিয়া নৌকা ছাড়িতে প্রায় ৪ টা হইয়া গেল। বিকালে যমুনার দৃশ্য কি চমৎকার! পশ্চিম আকাশের লাল আভায় নৌকার পশ্চিমদিকের নদীর জল লালে লাল হইয়া উঠিয়াছে – সে দিকে নদীর বুকের ভিতর যেন সহস্র সহস্র রাঙ্গা জবা ফুটিয়া উঠিয়াছে – আর তাহার কুলে উঁচু উঁচু সোজা সোজা পাড়ের উপরে ছোট ছোট কুটীর ও বড় ছোট গাছ পালার গায়ে গায়ে সে লালের স্নিগ্ধ লাবণ্য পড়িয়াছে। সেই সোজা পাড়ের ঐ কুটীরগুলি দেখিলে কেমন ভয় ভয় করে – মনে হয় তাহারা যেন নদীর শোভাময় লাল জলে জীবন বিসর্জ্জন করিতে উন্মুখ হইয়া রহিয়াছে। এই ভাঙ্গন-ধরা তীরের উপর আর এক বর্ষা পর্য্যন্ত কুটীর গুলি যে রক্ষা পাইবে এমন মনে হয় না।
পশ্চিমের এই আলো পথ দিয়া আমরা পূর্ব্বদিকে অন্ধকারের রাজ্যে অগ্রসর হইতে লাগিলাম, সন্ধ্যা হইল, পশ্চিম এখনো স্নিগ্ধ লাল-লাবণ্যময়, কিন্তু পূর্ব্বদিক একেবারে অন্ধকার – কুয়াসায় আচ্ছন্ন। সেই কুয়াসার প্রাণের মধ্যে এক একবার কেবল পুলের দিকের একটা আলো জ্বলিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে – আর পাশের জানালা দিয়া আকাশের এক একটা তারা চোখের সমুখে আসিয়া পড়িতেছে – দুই একটা তারা নদীর জলে মাঝে মাঝে নৃত্য করিয়া উঠিতেছে। একদিকে আলোক একদিকে অন্ধকার – আমরা মধ্যখানে সন্ধিস্থলে বসিয়া আলোকের রাজ্য ছাড়িয়া ক্রমাগত অন্ধকার কুয়াসার দিকে ছুটিয়া চলিয়াছি – সেখানে আশ্রয় ফেলিয়া আসিয়াছি, মানুষ – মানুষ আমরা।
এখানে রাস্তা ঘাটে সহরে মাঠে যেখানে সেখানে মন্দির; এত মন্দিরেও তবু এখানকার লোকেদের আশ মিটে নাই, যেস্থানটি একটু নির্জ্জন, সুদৃশ্য, সেইখানেই একটি বাঁধান গাছতলায় একটা কোন না কোন রূপ মূর্ত্তি খাড়া করিয়াছে, বলিতে কি এখানে এমন একটা বড় গাছতলা বা উঁচু ভালরকম জায়গা দেখিলাম না, যেখানে একটা সৃষ্টিছাড়া মূর্ত্তি পড়িয়া নাই। আর যেখানেই এইরূপ মূর্ত্তি সেই খানেই এক একটা নিশান পোতা, - নিশান দেখিলেই বুঝা যায় ইহা একটি দেব আড্ডা। এইরূপ মূর্ত্তি পূজার এক একটা বিশেষ দিন থাকে, অনেক দূর হইতে সেদিন সেখানে লোক জমে, দোকান পসারি বসে – একটা মেলা হয়। তাপর যে যেখানে চলিয়া যায় – মূর্ত্তি একাকী পড়িয়া থাকে।
সৌন্দর্য্য পূজার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হইতে যে প্রথমতঃ এইরূপ স্থলে দেব কল্পনা করা হইয়াছে তাহার সন্দেহ নাই। বলিতে কি আমাদের দেশের লোকের মত প্রকৃতি পূজা করিতে, স্বভাব-সৌন্দর্য্যে জীবন্ত কবিত্ব অনুভব করিতে আর দ্বিতীয় জাতি নাই।
আমরা সর্ব্ব প্রথমে এখানে ভরদ্বাজের আশ্রম মন্দির দেখিতে যাই। রামচন্দ্র বনে যাইবার সময় আরকি এখানে তিন দিন বাস করিয়া গিয়াছিলেন। যাইবার সময় মনে করিলাম কি একটি নির্জ্জন পবিত্র স্থান দেখিতে যাইতেছি – কিন্তু লোকালয়ের ভিতর দিয়া ধূলায় হাবুডুবু খাইতে খাইতে একটা গণ্ডগোল, চিকরা চিকরি – অপরিষ্কার ও ধূলার কারাগার মধ্যে প্রবেশ করিয়া শুনিলাম এই ভরদ্বাজের মন্দির। যত মন্দির দেখিয়াছি এমন অপরিষ্কার ধূলিময় কোনটি দেখি নাই। এখানে দুইটি মন্দির ঘর – এক ঘরে রাম লক্ষণ সীতার মূর্ত্তি এক ঘরে একটি শিবের মূর্ত্তি। দুইটি সিঁড়ি পথ আছে সেইখান দিয়া নীচের অন্ধকার গহবরে নামা যায়। ইহার একটি গহবর বশিষ্ঠ মুনির একটি ভরদ্বাজের তপঃস্থান বলিয়া কথিত। আমরা মন্দিরে প্রবেশ না করিতে করিতে জনকতক পুরুষমূর্ত্তি-স্ত্রী-পাণ্ডা আমাদের ঘেরিয়া ফেলিয়া ডাক হাঁক আরম্ভ করিয়া দিল; মন্দির দেখিব কি আমাদের হৃৎকম্প উপস্থিত; মনে হইল আজ বুঝি এইখানেই কয়েদী হইয়া পড়ি। কমপাউণ্ডের মধ্যে কাছাকাছি আরো অনেক অনেক মন্দির, সকল মন্দিরের লোকেরা একসঙ্গে জুটিয়া নিজের নিজের দেবতার জন্য পয়সা চাহে, নিজের নিজের মন্দিরে লইয়া যাইবার জন্য চীৎকার করে, ঘন ঘন হাত নাড়িতে নাড়িতে কাছে আসে, অতিকষ্টে আমাদের দারোয়ানেরা তাহাদের সরাইয়া রাখে। যাই হৌক খানিকক্ষণ তাহাদের চীৎকারের বড়ষিতে নাকানি চোবানি খাইয়া অবশেষে অনেক কষ্টে ছিপ কাটিয়া তাহাদের হাত এড়াইয়া গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। তাহাতেও নিস্তার নাই, গাড়ীর অর্দ্ধেক পথ আবাল বৃদ্ধ বণিতারা চীৎকার করিতে করিতে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল। এমন বিপদে আর কখনো পড়ি নাই। যদি ভরদ্বাজ মুনি জানিতেন তাঁহার শান্তির আশ্রম এমন অশান্তির আলয় হইয়া উঠিবে তাহা হইলে বোধ করি ইহার চিহ্নমাত্র তিনি রাখিয়া যাইতেন না।
সহরের মধ্যে রাজার মন্দির নামে আর একটি মন্দির আমরা দেখিতে গিয়াছিলাম। ইহা একটি প্রস্তর নির্ম্মিত লালবর্ণের নূতন মন্দির। মন্দিরটি সবে ১৬ বৎসর মাত্র একজন রাজা নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছেন। মন্দিরটি বেশ দেখিতে, ইহার চূড়াগুলি সব স্বর্ণমণ্ডিত। যে দ্বার দিয়া মন্দিরের কমপাউণ্ডে প্রবেশ করিতে হয় – তাহা সুবৃহৎ। এই দ্বারদেশে একটি মজার ঘড়ি, একটা নল দিয়া ফোঁটা ফোঁটা করিয়া একটা জল পাত্রে জল পড়িতেছে, জলে বাটীটির কতখানি পুরিয়া উঠিতেছে তাহা দেখিয়াই সময় ঠিক হইতেছে। বাটীটি একেবারে জলপূর্ণ হইলে তখন তাহা ফেলিয়া নাবার খালি করিয়া লইতে হয়। মন্দিরটি শিব মন্দির, মন্দিরের মধ্যে দেয়ালে অনেক দেব দেবীর চিত্র। শিব মন্দিরের সমুখাসমুখি কমপাউণ্ডের মধ্যে একটি একতালাগৃহে কৃষ্ণ রাধার মূর্ত্তি। সেই গৃহের ছাতে কৃষ্ণ রাধার মাথার উপর কয়েকটি বিলাতি মূর্ত্তি (Statue)। এই মূর্তিগুলি বেশীর ভাগ স্ত্রীমূর্ত্তি, পুরুষও আছে, একজন নাইট একটা হরিণ পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবমন্দিরে এইরূপ বিলাতি দৃশ্য দেখিয়া ভাবিলাম – বুঝি বা বাল্মীকি, লক্ষ্মী, সরস্বতী আজ এইরূপ বেসে শিবের সম্মুখে বিরাজ করিতেছেন। আশ্চর্য্যই বা কি! শুনা যায় আজ কাল কোন কোন গৃহে দেবতার পাউরুটি বিস্কুটের ভোগ নহিলে চলে না !
এখানে আর দুইটি যে মন্দির দেখিয়াছি তাহা দেখিতে এমন জমকাল নহে, কিন্তু তাহার সম্মুখের দৃশ্য বড় চমৎকার। দুইটিই গঙ্গার ধারের মন্দির। একটি দারাগঞ্জে অন্যটি সহরের বাহিরে শিবকোটি নামক স্থানে। দারাগঞ্জ নদীর ধারের একটি স্থান, বড় বড় বাড়ী ইমারত মন্দিরে মন্দিরে ইহা ভরা। নদীর উপর হইতে এই স্থানটি দেখিতে ঠিক যেন ছবির মতন, বড় সুন্দর! এখানে আমরা যে মন্দিরটি দেখিতে গিয়াছিলাম তাহা বাসুকীর মন্দির – ইহা একটি উচ্চ ভূমির উপর অবস্থিত। পাথরের সুবিস্তৃত সিঁড়ি দিয়া আমরা মন্দিরের বারান্দায় উঠিয়া ঘুরিয়া সর্প রাজের সম্মুখের বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলাম, এই বারান্দা হইতে নীচে গঙ্গা পর্য্যন্ত দুই পাশে দেয়ালওয়ালা একটি বাঁধান ঘাট, বর্ষাকালে সম্মুখের প্রসারিত মাঠ ঢাকিয়া এই ঘাটে জল আসে, কিন্তু এখন গঙ্গা শুকনো হলদে মাঠের আকাশের একপাশে একটা ক্ষীণ বিদ্যুৎ-রেখার মত শুইয়া আছে। তাহার মাথার উপর অনন্ত প্রসারিত আকাশ আর চারি পাশে অনন্ত প্রসারিত মাঠ ধূ ধূ করিতেছে। মাঠের সীমান্তে যে বড় বড় গাছ, মন্দিরের উচ্চ ভূমির কাছে তাহাও ঈষৎ উচ্চ সমান সবুজ জমির মত হইয়া পড়িয়াছে, বিকালের প্রশান্ত কনক আভা – হরিদ্রাবর্ণের এই ক্ষেত্রাকাশে শয়ন করিয়া চারিদিকে একটা গম্ভীর নিরাশার ভাব, একটা বৈরাগের তান তুলিতেছে – বাসুকী সহস্র ফনা তুলিয়া তাহারদিকে চাহিয়া সেই বৈরাগ্য সঙ্গীত শুনিতে কাণ পাতিয়া আছে।
শিব কোটির মন্দির ("শিউকোটি" অর্থাৎ শিব মন্দির। ইহা হইতে সমস্ত স্থানটার নামই শিউকোটি হইয়া পড়িয়াছে) আমরা রাত্রিকালে দেখিতে গিয়াছিলাম। স্থানটি একেবারে সহরের বাহিরে, বড় নির্জ্জন। মন্দিরের পুরোহিতগণ ছাড়া এখানে আর কেহই বাস করে না। সে দিন পূর্ণিমা, সাদা ধবধবে গম্বুজওয়ালা ছোট মন্দিরের উপর, কাল পাথরের ঘাটের উপর, মন্দিরের নীচের ধূ ধূ কারী বালির চড়ার উপর, দূরে অস্পষ্ট গঙ্গার কাল একটা রেখার উপর জ্যোৎস্না ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সেই ঘুমন্ত জ্যোৎস্নাকে কম্পিত করিয়া পুরোহিতদিগের স্তব গান মন্দিরের মধ্য হইতে স্তব্ধ আকাশে উথলিয়া উঠিতেছে, চারিদিক গমগম করিতেছে, চারিদিক পবিত্র হইয়া উঠিতেছে – আমার মনে হতে লাগিল আমি ঋষি আশ্রমে সাম গান শুনিতেছি। সেই স্তব শুনিতে শুনিতে পুতঃ হইয়া আমরা সিঁড়ি দিয়া নামিয়া বালির চড়া ভাঙ্গিয়া নদীর ধারের দিকে চলিতে লাগিলাম। পুরোহিতগণের স্তুতিগান ধীরে ধীরে মিলাইয়া আসিতে লাগিল। এখানে কি গভীর নিস্তব্ধ ভাব! নিজের নিশ্বাস শব্দ পর্য্যন্ত যেন এখানে শোনা যায়। এই জ্যোৎস্নাময় স্তব্ধ রজনীতে আমরা পরস্পরের দিকে চাহিয়া চাহিয়াই যেন বিস্মিত হইতে লাগিলাম, মনে হইতে লাগিল যে, আমরা এখানে কেন আসিলাম। আমরা বিস্ময়ে স্তব্ধভাবে তীরে বালির উপর বসিয়া গঙ্গার পানে চাহিয়া রহিলাম? গঙ্গার উপরে যেখানে পূর্ণ চাঁদ তল তল ঢল ঢল করিতেছে – তাহার কাছেই – আকাশের একখানা কালমেঘ পড়িয়া ঘন ঘোর করিয়া তুলিয়াছে – মানুষের হৃদয়ের মত গঙ্গার হৃদয়েও যেন একই সঙ্গে হাসি কান্না গাঁথা রহিয়াছে, আর গঙ্গা হৃদয়ের হাসির সেই ছোট ছোত তরঙ্গ গুলিই যেন কুলকুল শব্দে আমাদের পায়ের কাছের তট দেশ আঘাত করিতে লাগিল, আর মাঝে মাঝে ওপারের পাড় ভাঙ্গিবার শব্দ মৃদুতর হইয়া গঙ্গার শোক সঙ্গীত যেন আমাদের কাণে পশিতে লাগিল। ওপারে মেঘের মত আবছা আবছা গাছপালার ভিতর একটি মাত্র আলো টিপ টিপ করিতেছে – এদিকে গাছ পালার ভিতর সন্ধ্যার তারা জ্বল জ্বল করিতেছে – আমার তীরে বসিয়া একটি কথা মনে হইতে লাগিল – একদিন এইরূপ জ্যোৎস্না রাত্রে নদীর শোভা দেখিয়া একজন যে বলিয়া উঠিয়াছিল – "যদি মরিতে হয় ত এই সময় গঙ্গার বুকে –" আমার সেই কথাটি মনে পড়িতে লাগিল। ক্রমে আমাদের স্তব্ধতা ভাঙ্গিয়া গেল, - আমরা অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই জ্যোৎস্নাধৌত চড়ার উপর বসিয়া বেড়াইয়া গল্প করিয়া কাটাইলাম, - অবশেষে বাড়ী ফিরিলাম। এই খানেই আমাদের মন্দির দেখা শেষ নহে। আমরা এই মন্দির দেখার গল্প করিতেছি – একজন বলিলেন – গঙ্গার ওপারে পাড়িলা গ্রামে যে একটি শিবমন্দির আছে – বড় চমৎকার। শুনিয়াত আমার বন্ধুটি ক্ষেপিয়া উঠিলেন – যাইবার সব ঠিক ঠাক হইল – এবার যাত্রী আমরা ৪ জন স্ত্রীলোক – সঙ্গে দারোয়ান চাকর বাকর। ঘরের গাড়ী গঙ্গার ধার পর্য্যন্ত গেল, - তাহার পর গঙ্গার কাঁচা পুল ভাঙ্গিয়া উবড়ো খাবড়ো গ্রাম্য রাস্তা দিয়া যাইতে যাইবে, সে পথে কিছু আর ঘরের গাড়ী চলে না, - কাজেই এ দেশে খাঁচার মত ছোট ছোট যে একরূপ ঘোড়ার গাড়ী আছে, আমরা তাহার এক এক খানিতে দুইজন করিয়া চড়িলাম। একখানিতে আমি ও আমার তন্বাঙ্গী বন্ধুটি, আর একখানি কিছু অতিরিক্ত রকম জুড়িয়া গেল। মন্দির দেখার প্রসাদে আমাদের এক্কা চড়া পর্য্যন্ত হইয়া গেল, এক্কা চড়িয়া আমাদের আনন্দ দেখে কে? আমাদের দুইজনকে ঝাঁকাইতে ঝাঁকাইতে – দোল দিতে দিতে যখন পুল দিয়া এক্কাখান আয়েষে হেলিয়া দুলিয়া চলিল – আমার ত বড় মজার লাগিতে লাগিল, - আমরা দুজনে তখন প্রাণের যত সুখের গল্প করিতে বসিলাম, মনে হইতে লাগিল – সঙ্গীর গুণেই স্বর্গ-নরক, স্থানের গুণে নহে।
এইরূপ হাসিতে খুসিতে অর্দ্ধ ক্রোশ পুলটা পার হইয়া গ্রাম্য কাঁচা রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম, সকলেরই মনে হইল – এইবার গম্য স্থানের কাছাকাছি আসা গেল – অল্পক্ষণের মধ্যেই মন্দিরে পৌঁছিব, ওমা – কোথায় কি? যতই যাই শুনি আরো যাইতে হইবে – পথের যেন আর শেষ নাই। চাকররা যারা সংগে ছিল তারা ঠিক পথ জানে না, - মাঝে মাঝে রাস্তার লোক ধরিয়া ধরিয়া তাহারা পথ জিজ্ঞাসা করে, - কেহ বলিয়া দেয় এ রাস্তায় যাও, কেহ বলে ওরাস্তায় যাও – পথের না আছে একটা ঠিক, না আছে একটা কথার ঠিক, - গাড়োয়ানেরা একবার এরাস্তায় একবার ওরাস্তায় গাড়ী দুটাকে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত ঘুরাইতে ঘুরাইতে অবশেষে একটা মাঠের পথে আনিয়া ফেলিল – শুনিলাম এই পথে গেলে শীঘ্র যাওয়া যাইবে, - তখন বুঝিলাম – মহাদেবের মন্দিরে – কিন্তু তার পর দেখিলাম আর খনিকটা এইরূপ পথে চলিলে শীঘ্রই শেষ স্থানে যাওয়া যাইবে। মাঠের সেই পথহীন আঁকা বাঁকা ঢিবে ঢাবা উচু নীচু পথে বার বার স্বর্গ হইতে রসাতলে দুম দাম করিয়া পড়িতে পড়িতে গাড়ি চলিতে লাগিল। এক এক বার সমুখে একটা উঁচু ঢিবি দেখি কি করিয়া পার হইব প্রাণটা আঁতকাইয়া উঠে, আর গাড়ীটার দুই দিকে লোকেরা ধরিয়া মজেমে মজেমে (ধীরে ধীরে) করিতে করিতে অতি সন্তর্পণে – কিন্তু অবশেষে দুম করিয়া নামাইয়া দেয় – মনে মনে বলি মজাটা যথেষ্ট হইয়াছে এখন একটু কমিলে বাঁচি। এইরূপ এক একটা ঢিবি পার হওয়া কলিকালের আর কি অগ্নিপরীক্ষা। আমাদের গাড়ীটা তবু হালকি সওয়ারি, - দ্বিতীয় গাড়ীখানি এইরূপে পার করিতেছে। এক একবার লোকদেরো প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় – যাত্রীদেরও ত্রাহি মধুসূদন হইয়া পড়ে, দুই একবার ত যাত্রী দুইটী গাড়ী হইতে নামিয়া উঁচু ঢিবি পার হইয়া লইলেন – তাঁহাদের মধ্যে একজনের ক্রমাগত মনে হইতে লাগিল – তিনি আহার করিয়া শিব দর্শনে আসাতেই যত অনর্থ উৎপত্তি হইয়াছে, - আর কখনো এরূপ করিবেন না বলিয়া তিনি মাননা করিতে লাগিলেন। কোন রকমে যখন মাঠের সে ভবনদীটা পার হইয়া মন্দিরে আসা গেল – রমণী বলিলেন – তিনি মাননা না করিলে কখনই আজ মন্দিরে আসা ঘটিত না।
যাক্, এতটা সুখে রাস্তা পার হইয়া মন্দির দেখিয়া চক্ষুস্থির – একটা গলি ঘুঁজির মধ্যে একটা এঁদো পচা জায়গায় ছোট খাট একটা শিবের মন্দির, - এইত পাড়িলা মহাদেব। যাহক দুপুরের সময় বাড়ী ছাড়িয়া ৪টের সময় আমরা এখানে আসিয়া পৌঁহুছিলাম – ৪।। টের সময় আবার বাড়ী মুখো ফিরিলাম – অমন উঁচু নীচু পথে রাত হইলেই সর্ব্বনাশ, তাহা হইলে মাঠেই রাত কাটাইতে হইবে। সঙ্গে আবার একটা আলো জ্বালিবার বন্দোবস্ত পর্য্যন্ত নাই, দুপুর রৌদ্রে বাড়ী ছাড়িয়া কার মনে অন্ধকার রাত্রের বিপদ মনে আসে? এবার সে রাস্তা না ধরে অপেক্ষাকৃত ভাল রাস্তা ধরা গেল। শীতকাল, বিকাল হইতে হইতে সন্ধ্যা আসিয়া পড়ে, সন্ধ্যা না আসিতে আসিতে অন্ধকার হয়, শীঘ্রই চারিদিক ঘোর ঘোর হইয়া আসিল – দৌড়াদৌড়ি তাড়াতাড়ি করিয়াও গাড়ী মাঠ না ছাড়াইতে ছাড়াইতে সন্ধ্যা হইয়া পড়িল, বেচারা ঘোঁড়ারাই বা কত পারে, তবু তাহারা প্রাণ পণে চলিতে লাগিল, বাবলা গাছের নোয়ান ডালপালার কাঁটার আঁচড় খাইয়া, নীচে গাছগাছড়ার উপর তার প্রতিশোধ লইয়া গাড়ী দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল – আর খানিকটা গেলেই গাড়ী মোহনগঞ্জের গ্রাম্য রাস্তায় আসিয়া পড়ে – সকলের মনে এই মাত্র ভরসা; এই ভরসার উপর নির্ভর করিয়া আমরা সেই মাঠের দিকে চাহিতে চাহিতে চলিলাম, ক্ষেত্রের মাঝে আঁধার গাছপালা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না, সহরের মত এখানে হিমের ধূঁয়া নাই – তাই সন্ধ্যাতেও একটু একটু চারিদিক নজরে পড়িতেছে। শীত কন কন করিতেছে – সজোরে ঠাণ্ডা হাওয়া বহিতেছে – যেদিকে চাই ত্রিসীমায় একটা লোক নাই লোকালয় নাই একটা পথ দেখা যায় না, মাঝে মাঝে কেবল এক একটা শেয়াল যা আমাদের দিকে তাকাইয়া চলিয়া যাইতেছে। - যত অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল – হৃৎকম্প হইতে লাগিল, রাত্রি হইয়া গেলে আর কোন উপায় নাই – সমস্ত আমোদ প্রমোদ ফুরাইয়া গেল – সকলে নিঃঝুম হইয়া পড়িলাম। এই সময় আমার একবার মনে হইল নভেল লেখকগণ কেমন সহজে পথিককে দিক হারা করিয়া ফেলেন, কিন্তু দিকহারা অবস্থাটা যে কি ভয়ানক তাহা তাঁহাদের একবার হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দিই। যাহউক কোন জন্মের নিতান্ত পুণ্যবলে আমরা শীঘ্রই গ্রামের রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম, - আর ভাবনা রহিল না, বুঝা গেল যত রাত্রেই হৌক বাড়ী পৌঁছান যাইবে। তাহার পর যে বাড়ী ফিরিয়াছি তাহা আর বলার আবশ্যক নাই। এখন ঘরে বসিয়া সেদিনকার কথা মনে করিতে বড়ই লাগিতেছে ভাল, - মনে হইতেছে এত মন্দির দেখিয়াছি – এমন আমোদ কোথায় হয় নাই। একটা কথা, এত কষ্ট করিয়া কোথায় গঙ্গার পারে পাঁড়িলা মহাদেব তাহা পর্য্যন্ত দেখিয়া আসিলাম আর আমাদের বাড়ীর কাছেই যে একটি ভাল মন্দির আছে তাহা এ পর্য্যন্ত কখনো দেখা হইল না। যাহা সহজে পাওয়া যায় তাহার আর কি এমনি হতাদর। এখানে আসিয়া আমরা গভর্ণমেন্ট হাউস, লাইব্রেরি, মেয়োহল, পার্ক প্রভৃতি যাহা কিছু দেখিবার সব দেখিয়াছি কিন্তু কলিকাতায় যে এরূপ ধরণের কত ভাল ভাল বাড়ী উদ্যান আছে – তাহা দেখিবার কথা মনেও হয় না। এ বিষয়ে ঘরের ছেলের পাণ্ডিত্য আর বাসস্থান সমান। ঘরের ছেলে অন্য লোকের কাছে যখন মহা পণ্ডিত তখনও আপনাদের কাছে সে ঘরের ছেলে বই কিছুই নয়। যাহাকে জন্মিতে দেখিয়াছি – মানুষ করিয়াছি, চিরকাল যাহাকে আবল তাবল বকিতে শুনিয়াছি আঃ কপাল তিনি আজ আবার পণ্ডিত! সে পাণ্ডিত্য আবার চোখে লাগে!
অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন – কলিকাতায় মনুমেন্টে চড়িয়াছ? অমুকস্থানে গিয়াছ ওমুকস্থান দেখিয়াছ? আমি ভাবি চিরকাল যাহার রক্তমাংসের মধ্যে বাস করিয়া আসিতেছি, তাহাকে আবার নূতন আলাদা করিয়া কি দেখিব! কলিকাতাটা নাকি আবার একটা পদার্থ!
এখানে আর কি ইংরাজি প্রবার্বটা ঠিক খাটে Familiarity brings contempt –
এখানকার মেয়োহলটি মেয়োর স্মরণ চিহ্ন। ইহা বেশ সুদৃশ্য জমকালো একটি বাড়ী। কিন্তু ইহার প্রধান জিনিস ইহার স্তম্ভটি। ইহা কলিকাতার মনুমেন্টের মত অত উচ্চ না হউক – কিন্তু তবু বড় কম উচ্চ নহে – আমরা ত উঠিতে হিমঝিম খাইয়া গিয়াছিলাম, স্বর্গে উঠিতে গেলে যে কিরূপ কষ্ট সহ্য করিতে হয় – এই মঞ্চে উঠিবার সময় তাহার কতকটা আমাদের ধারণা হইয়াছে, - শেষদিকের সোজা সোজা উঁচু উঁচু ধাপগুলা এক একটা করিয়া উঠি আর মনে হয় – বুঝি আর পারিলাম না, বুঝি এইবার নামিতে হয়। যাহক অতদূর উঠিয়া আবার নামিয়া পড়া নেহাত অমানুষের কর্ম্ম – তাই জীবন মরণ পণ করিয়াও শেষে উঠিয়া পড়িলাম, উঠিয়া সমস্ত পথ শ্রান্তি নিমেষে ভুলিয়া গেলাম, মনে হইল সত্যই স্বর্গে আসিয়াছি – চারিদিকে কি সুন্দর দৃশ্য! নীচের গাছ পালার মধ্যে ঘর বাড়ী সব একসা হইয়া গিয়াছে – বড় বড় স্তম্ভ ছোট ছোট ডাণ্ডার মত হইয়া পড়িয়াছে – মানুষগুলো পোকার মত কিলবিল করিয়া চলিতেছে – চারিদিকে একটা সীমা হীন দৃশ্য; দিগন্তের সঙ্গে আকাশ মিশিয়াছে – ছোটর সহিত বড় মিলিয়াছে – এই খানে দাঁড়াইয়া দেখিলা মনে হয় সংসার যেন একটা ছেলে খেলা, যেন একটা পুতুলের রাজ্য, আকাশ গম্বুজে আসীন আক মহান পুরুষ সেই পুতুলদিগকে খেলাইয়া বেড়াইতেছেন। উঠিতে এত কষ্ট নামিতে কিছুই না! আমরা যখন নামিয়া আসিলাম দেখিলাম পশ্চিমের লাল আলো না মিশাইতে চাঁদ উঠিয়াছে, বিকাল না ফুরাইতে সন্ধ্যা হইয়াছে – বিকালের লাল আলো আর চন্দ্রমাশালিনী সন্ধ্যার রজত আলো একত্র মিশিয়াছে, কলিকাতায় কখনো এমন সন্ধ্যা দেখিয়াছি বলিয়া মনে হইল না।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার
[ অভ্রতে কিছু কিছু বাংলা বানান টাইপের অসুবিধাটুকু বাদ দিলে মূল বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]