হাম্পি – পাথর আর গ্রামের গল্প
দোলা দত্তরায়
~ হাম্পির তথ্য ~ হাম্পির আরো ছবি ~
পাথরগুলো সব অদ্ভুত দেখতে – কোনও কোনওটা একে অন্যের ওপর এমনভাবে বসে যেন এখনই গড়িয়ে পড়বে হুড়মুড়িয়ে – সব কিছুকে গুঁড়িয়ে দিয়ে। আশ্চর্য লাগছিল দেখে যে এখানকার লোকেরা তাদের শান্ত গ্রামের আশেপাশে এইসব ভয়ঙ্কর পাথরের মাঝেই সাহস করে গড়েছে মন্দির আর উপাসনাস্থল। পাথর, পাহাড় আর প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসস্তূপের এই রাজ্যে আমরা পৌঁছেছিলাম কিছুদিন আগেই। হাম্পি ভ্রমণের সাম্প্রতিক এই অভিজ্ঞতা এককথায় অসাধারণ।
দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটক রাজ্যের হাম্পি রয়েছে ইউনেস্কোর 'বিশ্বের বিস্ময়'-এর তালিকায় – একদা শক্তিশালী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতীক তার স্মারক স্তম্ভ আর রাজপ্রাসাদগুলির ভগ্নাবশেষ আগলে আজও জেগে।
ভূগোলের দৃষ্টিতে জায়গাটা বৈপরীত্যে ভরা। আমাদের গন্তব্য ছিল ছোট্ট গ্রাম আনেগুণ্ডি, পথের একপাশে রুক্ষ লাল মাটি – শুধুই বড় বড় পাথর আর বোল্ডার, অন্য পাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের খেত, মাঝে মধ্যে আখের ঝাড় আর নীল আকাশের নিচে ঘন সবুজ গাছগাছালি।
আনেগুণ্ডি যেতে ফেরি করে পেরোতে হল 'তুঙ্গভদ্রা' বা পম্পার এক উপনদী – চওড়া পাড়ে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা পাথরগুলোও ভারী সুন্দর লাগছিল – যেন হঠাৎ ছিঁড়ে যাওয়া মালা থেকে মুক্তোগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। শুনলাম মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে দ্বীপগুলোর সংযোগের জন্য কংক্রিটের ব্রিজ তৈরির চেষ্টা হয়েছিল - কিন্তু ২০০ মিটারেরও বেশি গভীর নদীতে সেটা ভেঙে পড়ে। ওপারে একটা অটো রিকশা আমাদের পৌঁছে দিল আনেগুণ্ডি গ্রামের ভিতরে।
পরিচ্ছন্ন ছোট্ট গ্রামের মাঝে কিষ্কিন্ধ্যা ট্রাস্ট পরিচালিত উরাম্মা হেরিটেজ হোমে পৌঁছে মন ভরে গেল। একসময় যেটা কোন ধনী ভূস্বামীর আবাস ছিল তা এখন সাজানোগোছানো সুন্দর এক অতিথিশালা। হাম্পির ধ্বংসাবশেষ দলে দলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের টেনে আনতে শুরু করাতেই সময়ের সঙ্গে এই পরিবর্তন। আদপে এটা তৈরি হয়েছিল একটা পরিবারের বসবাসের জন্য – দুটো শোওয়ার ঘর – সংলগ্ন পশ্চিমি কেতার স্নানঘরসহ, একটা বড় বসার ঘর, বারান্দা আর পিছনদিকে ছোট রান্নাঘর। ছাদে ওঠার সরু সিঁড়িতে রেলিং নেই – একদিকে দেওয়াল – কেউ কেউ হয়তো তাতে একটু ঘাবড়ে যেতে পারে। তবে এখানের ট্রাডিশনাল স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে গ্রাম্যতার ছোঁয়াচ অথচ আধুনিক সব ব্যবস্থা সারাদিন ধরে হাম্পিতে ঘোরাঘুরি আর পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা-নামা করে বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে এসে বিশ্রামের জন্য একেবারে আদর্শ পরিবেশ।
উরাম্মা হেরিটেজ হোমের অদূরে ঘেরা জায়গায় রিসর্টের নিজস্ব খেত – সবজি, ফলের পাশাপাশি ধান, ভুট্টাও চাষ হয় সেখানে। জমির পাশে ছোট ছোট কটেজ – যারা প্রকৃতির একেবারে কাছে থাকতে চায় তাদের জন্য। ওখানেই কমন কিচেন আর ডাইনিং এরিয়া – সকালে আমরা প্রাতরাশ সারতে যেতাম। সুন্দরভাবে সাজানো আর নারকেল ও তালগাছে ঘেরা জায়গাটায় নানান পাখির কলতান – সারস, মাছরাঙা ছাড়াও দৌড়ে বেড়াচ্ছে হাঁস-মুরগির দল। এরপরে গ্রামের পথে হাঁটার সময় যখন আমাদের সঙ্গে যোগ দিত 'পবিত্র' গরুবাছুরের পাল তখন আর বিন্দুমাত্র আশ্চর্য লাগত না। আসলে আমাদের কাছে কয়েকটাদিনের অন্যরকম এই অভিজ্ঞতাটা শুধু মনোরম বললে বড় কম বলা হবে।
গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ত পাথুরে চাতালে উবু হয়ে বসা গল্পে মগ্ন বৃদ্ধদের, কোথাও বয়স্ক মহিলারা বড় বড় বেতের চালাতে রাখা চাল থেকে পাথর বাছতে ব্যস্ত আর তরুণীরা ঝাড়া-পোঁছা করছে তাদের বাড়ির উঠোন – তারপর নবরাত্রির জন্য চকের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দিচ্ছে। কেউবা ব্যস্ত ঘরের কাজে – গাছে টাঙানো দড়িতে ভিজে কাপড় শুকোতে দিতে। শিশুরা খালি পায়ে খেলে বেড়াচ্ছে সারাদিন – এই ক'দিনেই আমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল তাদের উল্লসিত গলার 'এল্লো' আর 'বাই-বাই' শুনতে শুনতে। ছোটরাতো বটেই তরুণীরাও নিজেদের ছবি তুলতে ভারী আগ্রহী ছিল। নানারকম পোজ দিয়ে ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখাটাই ছিল তাদের কাছে একটা মজার ব্যাপার। তারপর নিজেদের কাণ্ড দেখে নিজেরাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। একদিন কাছেই এক রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপে উঁকি দিলাম আমরা – পুনর্গঠনের কাজ চলছে সেখানে।
স্থাপত্যবিদ আর পুরাতাত্ত্বিকের স্বর্গ হাম্পিতে বিঠল আর বিরূপাক্ষ মন্দিরের নজরকাড়া সৌন্দর্য, রাজকীয় এলাকার অবিশ্বাস্য বিশালতা, রানির স্নানাগার, এককালের প্রভূত ধনশালী বিজয়নগর রাজপ্রাসাদের বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, তখনকার 'বাজার'-এর ছড়ানো ছেটানো নিদর্শন – এককথায় অসামান্য। পাথরের দেওয়াল, ছাদ, দরজা-জানলার ভগ্নাবশেষের সূক্ষ্ম কারুকার্য মুগ্ধ করেছিল আমাদের। বিরাট বিরাট সব মোনোলিথ - 'উগ্র নরসিংহ', বৃহত্তম 'শিব লিঙ্গ' এমনকী 'গণেশ'-এর মূর্তি সত্যি তাকিয়ে দেখার মতো। অবশ্য ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর, ধুলো আর ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এইসব দেখা মোটেই সহজ কাজ হয়নি – কিন্তু তার জন্য কোনও আফসোস নেই।
তবে সবথেকে ভালো লেগেছিল – 'নবরাত্রি'তে আনুগেণ্ডি গ্রামের 'দশেরা' উদ্যাপন। গ্রামের প্রত্যেকে – ছোট থেকে বড় – নতুন পোষাকে সার দিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে – 'রামায়ণ' যাত্রা এবং হাতির পিঠে দেবী উরাম্মার মূর্ত্তি নিয়ে মিছিলের গ্রাম পরিক্রমা। দারুণ রঙিন, ঝলমলে আর সুন্দর এক অভিজ্ঞতা – স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের ট্রাডিশনাল পোষাকে নাচ।
স্থানীয় কিছু দোকানের আন্তর্জাতিক মানের খাবারের স্বাদও ছিল এককথায় অসাধারণ – এ বিষয়ে হাম্পি সত্যিই কসমোপলিটান। 'গোয়ান কর্নার'-এ ডিনার সারার কথাও মনে থাকবে চিরকাল। 'ম্যাংগো ট্রি'-র খাবার-দাবার-ও খুব ভাল আর জনপ্রিয়ও।
তিন দিন দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে কেটে গেল। কাছের শহর হসপেটে ফেরার জন্য নদীর বুকে ফেরিতে বসে ভেসে যেতে যেতে অনুভব করলাম সারাজীবন মনে রাখার মত কিছু স্মৃতিতে ভরে উঠেছে মনের মণিকোঠা।
অনুবাদ – দময়ন্তী দাশগুপ্ত
~ হাম্পির তথ্য ~ হাম্পির আরো ছবি ~
কলকাতায় জন্ম হলেও পড়াশনার সূত্রে দীর্ঘদিন আমেরিকা প্রবাসী দোলা দত্ত রায়ের কলমে ইংরেজিই সহজাত। কিছুদিন কলকাতায় বিজ্ঞাপনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর বর্তমানে লেখালেখি, ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।