ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - হিমালয়ের ডায়েরি
হেমকুণ্ডের পথে
সুবীর কুমার রায়
আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার কথা, কেন জানিনা হঠাৎ আমার মনে হিমালয়, বিশেষ করে গঙ্গার উৎপত্তি স্থান গঙ্গোত্রী, গোমুখ আর যমুনোত্রী দেখার ঝোঁক চেপে বসে। তখন না ছিল সঙ্গী, না ছিল সামর্থ্য। এর কিছু পরে শঙ্কু মহারাজের বিখ্যাত কাহিনিটি অবলম্বনে নির্মিত "জাহ্নবী যমুনা, বিগলিত করুণা" সিনেমা দেখে, আমার এই ঝোঁক যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল। এরও বেশ কিছুদিন পরে, ১৯৭৭ সালে আমার প্রথম হিমালয় দর্শনের সুযোগ ঘটে। অবশ্য গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী নয়। সুযোগ আসে নৈনিতাল, রানীক্ষেত, আলমোড়া, কৌশানি, গোয়ালদাম ইত্যাদি জায়গা দেখার। সেই দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারি নি। চারদিকে পাহাড়ের প্রাচীর - বহুদূরে ত্রিশুল, নন্দাদেবী, নন্দাঘুন্টি, প্রভৃতি বরফে ঢাকা শৃঙ্গ, চোখ জুড়ানো সূর্যোদয়। তবু মনে হয়েছিল আমার কল্পনার সঙ্গে যেন মোটেই মিল নেই। কোথায় সেই বন্ধুর পথ? কোথায় চটিতে রাত্রিবাস? তবু হিমালয়কে অনেক কাছ থেকে বাস্তবে পেয়ে, পূর্বের ঝোঁক যেন আবার নতুন করে প্রাণ লাভ করলো। সময়, সুযোগ, সঙ্গীর প্রতীক্ষা করে থাকলাম।
পরের বছরেই সুযোগ এসে গেল। কিন্তু সঙ্গে বাবা-মা থাকায়, সে ইচ্ছাকে সাময়িক ভাবে ঘুম পাড়িয়ে, আমরা দেখলাম হরিদ্বার, দেরাদুন, মুসৌরী, হৃষিকেশ। সেটা ছিল সারা দেশ জুড়ে বন্যা প্লাবিত ১৯৭৮ সালের নভেম্বরের শেষ। মুসৌরীর লাল টিব্বার ওপর থেকে জাপানী দূরবীক্ষণে, দূরের গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদার, বদ্রীনারায়ণকে কাছে বরফ ঢাকা অবস্থায় পেলাম। তার ওপর আবার হৃষিকেশে কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীগামী বাসগুলোকে আমাদের ফেলে চলে যেতে দেখে, মনটা হুহু করে উঠলো। ঠিক করলাম আর নয়, সামনের বছর যেতেই হবে।
আমার প্রত্যেকবারের ভ্রমণসঙ্গী, মাধব ব্যানার্জ্জীকে সঙ্গে নিয়ে দিনক্ষণ স্থির করে ফেললাম। সঙ্গী হল আরও একজন, দিলীপ পাল। স্থির হল প্রথমে যাব যমুনোত্রী, তারপর গঙ্গোত্রী-গোমুখ, এরপর কেদারনাথ, সব শেষে নন্দন কানন, হেমকুণ্ড হয়ে বদ্রীনারায়ণ। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে যাবার দিন স্থির হয়ে গেল। দিন আর কাটে না। ক্রমে ক্রমে দিনটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে আসা হল। স্থির হল তেরই আগষ্ট, ১৯৭৯ সাল। উত্তর প্রদেশ টুরিষ্ট বিভাগ আমাদের পরামর্শ দিল প্রথমে নন্দন কানন যেতে, কারণ আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে নন্দন কাননের সমস্ত ফুল ঝরে যেতে শুরু করবে। কাজেই আমাদের পূর্ব পরিকল্পনাকে ঠিক উল্টো করে, রাস্তা ঠিক করলাম। স্থানীয় একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী সম্বন্ধে অনেক প্রয়োজনীয় ও নতুন তথ্য পেলাম, যা উত্তরপ্রদেশ টুরিষ্ট বিভাগেরও অজানা। যাহোক, নির্দিষ্ট সময়ে আমরা দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বারের তিনটে টিকিট কাটলাম। হান্টার স্যু, পলিথিন সিট, ওয়াটার প্রুফ, ওয়াটার বটল ইত্যাদি কেনাকাটাও করে নিলাম। প্রস্তুত হলাম শুভদিনের শুভক্ষণের জন্য।
১৩ই আগষ্ট, ১৯৭৯ সাল। আমরা তিনজন মালপত্র নিয়ে দুন এক্সপ্রেসে নিজেদের আসন দখল করলাম। বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রেডিওর খবরে হরিদ্বারে জলবৃদ্ধির সংবাদও অনেক আগেই পেয়েছি। তাই মনটা অস্থির ও খারাপ হয়েই ছিল। রাত ন'টা ত্রিশ মিনিটে ট্রেন ছাড়তে, কেন জানিনা, আস্তে আস্তে সমস্ত দুশ্চিন্তা মন থেকে দূর হয়ে গেল। আসন্ন যাত্রাপথ নিয়ে আলোচনায় মশগুল হয়ে গেলাম। রাস্তায় ট্রাভেলার্স চেক ভাঙ্গানো সম্ভব নয়। তাই সমস্ত টাকা পয়সা নগদ সঙ্গে থাকায় আর এক চিন্তা।
পনেরই আগষ্ট সকালে হরিদ্বার পৌঁছলাম। ট্রেন থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে নেমে দেখি, চারদিক ঘন কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে। বাসস্ট্যাণ্ড কিছুটা দূরে, শেয়ার ট্যাক্সিতে জায়গা করে নিলাম। বৃষ্টিতে ট্যাক্সির কাচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার চারদিকে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। গঙ্গার ধারে, রাস্তার পাশে, একটা অয়েল ট্যাঙ্কার কাত হয়ে রাস্তা প্রায় বন্ধ করে রেখেছে। দূরের পাহাড় ঘন মেঘে কালো হয়ে আছে। সব কিছু মিলে গোটা পরিবেশটাই একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বুঝতে পারছি আমাদের কপালেও দুঃখ আছে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ট্যাক্সি কালীকম্বলী ধর্মশালার কাছে আমাদের ছেড়ে দিল। একুশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে, গুটিগুটি পায়ে বৃষ্টিতে ভিজে ধর্মশালায় পৌঁছলাম। ধর্মশালার নতুন বাড়িটা বেশ ভাল। সব রকম সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু কী কারণে জানিনা, কর্তৃপক্ষ আমাদের নতুন বাড়িতে স্থান দিতে সম্মত হ'লেন না। স্থানীয় একজনের বাড়িতে আঠারো টাকা ভাড়া দিয়ে একখানা ঘর ঠিক করলাম। ভদ্রলোক আমাদের বাঙালিবাবু বলে সম্বোধন করে বললেন, 'আপনারা ডিম খাবেন? আমার কাছে ডিম পাবেন'। আশ্চর্য হয়ে গেলাম!
যাহোক, বাইরে কিছু চা-জলখাবার খেয়ে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। ভদ্রলোক আবার খোঁজ করলেন আমাদের কিছু প্রয়োজন আছে কী না। আমরা না বললেও নাছোড়বান্দাভাবে বললেন, "এ বাড়ি আপনাদেরই নিজেদের বাড়ি বলে মনে করবেন। কোন রকম অসুবিধা হলেই আমাকে জানাবেন"। খানিক পরে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে জানতে পারলাম যে, বেলা দু'টোয় বদ্রীনারায়ণগামী বাস ছাড়বে এবং সেটা সন্ধ্যায় শ্রীনগরে হল্ট করবে। সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মালপত্র গোছগাছ করতে লেগে গেলাম। প্রত্যেকটা হোল্ড-অল এর ভিতরে কম্বলগুলো পলিথিন সীট দিয়ে মুড়ে নিলাম। হোল্ড-অলটাও একটা পলিথিন কভারে পুরে ফেললাম। বৃষ্টিতে কম্বল ভিজবার আর কোন সম্ভাবনাই থাকলো না। সব সময় প্রয়োজন হতে পারে, এমন সমস্ত জিনিস, সামান্য করে শুকনো খাবার, চিকলেটস্ ইত্যাদি একটা সুটকেসে নিয়ে, সমস্ত জিনিস অন্য সুটকেস দু'টোয় ভরে নিলাম। টাকার হিসাব করতে গিয়ে মহা বিপদ হল। একটা পাঁচ টাকার প্যাকেট, অর্থাৎ পাঁচশ' টাকা, কোথাও খুঁজে পেলাম না। আবার সমস্ত সুটকেস ঘেঁটে, শেষ পর্যন্ত একটা ওয়াটার প্রুফের ভেতর সেটাকে পাওয়া গেল। চটপট তিনজনে স্নান সেরে নিলাম। জানিনা কবে আবার এ সুযোগ পাব। মালপত্র ঘরেই রেখে, দুপুরের খাবার খেতে গেলাম। কিছুক্ষণ আগেই চা-জলখাবার খাওয়ায় খিদে নেই, তবু সামান্য কিছু ভাত, ডাল, তরকারি একটা পাঞ্জাবি হোটেলে খেয়ে নিলাম। মনে মনে স্থির করলাম, এরপর থেকে সব জায়গায় রুটি খাব। ভাত খেলে বড্ড ঘুম পায় আর হাঁটতেও কষ্ট হয়।
খাওয়া সেরে গেলাম বাসের টিকিট কাউন্টারে। আমাদের সামনে একজন পাঞ্জাবি সাধু পাঁচটা গোবিন্দঘাটের টিকিট কাটলেন। আমাদেরও ওখানকারই টিকিট প্রয়োজন। গোবিন্দঘাট থেকেই নন্দনকানন ও হেমকুণ্ড যাওয়ার হাঁটা পথের শুরু। মোটামুটি খোঁজখবর নিয়ে আমরা তিনটে গোবিন্দঘাটের টিকিট কাটলাম। ভাড়া লাগলো পঁচাশি টাকা পঞ্চাশ পয়সা। সামনের রাস্তা আমাদের সকলেরই অজানা। গাইড ম্যাপ ও কিছু লোকের মুখের কথার ওপর আমাদের সমস্ত ট্যুরটার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। নিজেদেরও এই জাতীয় ভ্রমণ, এই প্রথম। তাই বোধহয় একটু অস্বস্তিও হচ্ছিল। ঘরে ফিরে এসে সমস্ত মালপত্র নিয়ে বাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে আমাদের বাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে বললাম, 'বাসের টিকিট পেয়ে গেলাম, তাই আর অপেক্ষা না করে আমরা চলে যাচ্ছি। আপনি যদি ভাড়ার ব্যাপারটা একটু কনসিডার করেন, তাহলে খুব উপকার হয়'। যে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আগেও আমাদের বলেছিলেন, এ বাড়িটা নাকি আমাদেরই, তিনিই এখন বললেন, 'এটাতো হোটেল, তাই একঘন্টা বা একদিনের একই ভাড়া।' বললাম, 'জোর কিছু নেই, তবে আমরা আবার হৃষিকেশেই ফিরে আসবো এবং কয়েকদিন এখানে থেকে বিশ্রাম নেব।' তবু কোন লাভ হ'ল না, পুরো ভাড়াই দিতে হ'ল।
দিলীপকে বাসে চাপিয়ে, সামনের দিকে দু'টো শিট রেখে, মালপত্র সব বাসের ছাদে তুলে, আমি আর মাধব গেলাম পয়েন্টেড লাঠি কিনতে। ওটা সঙ্গে থাকলে হাঁটার কষ্ট অনেক কম হবে। তিনটে ভাল লাঠি ছ'টাকা দিয়ে কিনে, বাসে ফিরে এসে জায়গা দখল করে বসলাম। আরও আধঘন্টা পরে বাস ছাড়ার কথা। সময় আর কাটে না। আমাদের সামনে দু'টো করে দু'দিকে শিট আছে। সেগুলো সমস্ত পাঞ্জাবি ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা দ্বারা অধিকৃত। একবারে সামনে, ড্রাইভারের বাঁপাশে একটা সিঙ্গল সিটে, সেই পাঞ্জাবি সাধুবাবা বসে আছেন। বাকী সমস্ত পাঞ্জাবিরা তাঁকে খুব সম্মান দেখাচ্ছেন, তাঁর সুবিধা অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখছেন। আমাদের ঠিক পিছনেই মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা একটা দল, যাবে বদ্রীনারায়ণ। পিছনে ডানদিকে উত্তরপ্রদেশের কয়েকজন আছে। বাদবাকীর খবর জানতে পারলাম না। বাস থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে, নিজেদের মন ও শরীরকে একটু চাঙ্গা করে নিলাম। উত্তেজনায় বারবার জল পিপাসা পাচ্ছে। বাসে ফিরে এসে জানলার ধারে বসে রইলাম।
পৌনে দু'টো নাগাদ বাস ছেড়ে দিল। অনেকদিনের স্বপ্নপূরণের সূচনার সেই মুহূর্তের কথা ঠিক বোঝাতে পারবো না। ক্রমে লছমনঝোলা পুলকে ডানপাশে রেখে, প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন দৃশ্যকে পিছনে ফেলে বাস এগিয়ে চললো। অনেকেই জোর গলায় ভগবানের নাম করতে লাগলেন। আমার পাশে মাধব, অপরদিকে জানালার ধারে দিলীপ। যত ভাল ভাল দৃশ্য, সব যেন ওর দিকেই রয়েছে! ওর পাশে একজন স্থানীয় ভদ্রলোক। তিনি এই পথের নানা জায়গা, বা নিকটবর্তী জায়গা সম্বন্ধে দিলীপকে নানা কথা বলছেন।
ক্রমে দেবপ্রয়াগ পেরোলাম। খুব সুন্দর জায়গা। সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছলাম গাড়োয়ালের রাজধানী, পাহাড়ি শহর শ্রীনগর। সামনেই একটা ছোট হোটেলে রাতে থাকবার কথা বলতে, হোটেল মালিক এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিলেন। তিনি ঘরের ভিতরে মালপত্র রেখে, আমাদের রাস্তার পাশে বারান্দায়, খাটিয়ায় শোবার ব্যবস্থা করতে বললেন। কী করবো ভাবছি। সমস্ত পাঞ্জাবিরা চলে গেছে সামনের গুরুদ্বোয়ারায়। হঠাৎ একজন ভদ্রলোক আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন আমরা বাঙালি কীনা। ভদ্রলোক স্থানীয়, কেদারনাথের পথে ট্রান্সপোর্টে কাজ করেন। আমরা ইতিবাচক উত্তর দিয়ে জানালাম হাওড়ায় থাকি। ভদ্রলোক বললেন তিনি কালীকম্বলী ধর্মশালায় আজ রাতটা থাকবেন, আমরা ইচ্ছা করলে ওখানেই থাকতে পারি। চেনা চেনা লাগছিল, এবারে মনে পড়ল, ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে একই বাসে এসেছেন, যাবেন শ্রীনগর ছাড়িয়ে আরও কিছুটা দূরে। ধর্মশালায় আমাদের তিনজনকে প্রথমে থাকতে দিতে সম্মত হ'ল না। ভদ্রলোককে একটা ঘর অবশ্য দিয়ে দিল। শেষে ওঁর বারংবার অনুরোধে, আমাদেরও একটা ঘর ধর্মশালা কর্তৃপক্ষ দিতে রাজি হ'লেন। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানাতে বললেন, তিনি বাঙালিদের খুব পছন্দ করেন, সাহায্য করতে চেষ্টা করেন, কারণ একসময় মাস ছয়-সাতেক কলকাতায় ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনে, নিজেদের খুব ছোট মনে হ'ল। ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে করে সমস্ত শ্রীনগর শহর ঘুরে দেখালেন। সন্ধ্যার শ্রীনগর বড় সুন্দর। সেদিন আবার স্বাধীনতা দিবস। অনেক জায়গা নানাভাবে সাজানো হয়েছে।
ষোলই আগষ্ট। ভোরবেলা তৈরি হয়ে মালপত্র নিয়ে বাসে উঠলাম। নিজেদের সিটে বসতে, পাঞ্জাবি সাধুবাবা আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা গতকাল কেন তাঁদের সঙ্গে গুরুদ্বোয়ারাতে থাকলাম না? বিড়ি-সিগারেট খাওয়ার অসুবিধার জন্যই কি? গুরুদ্বোয়ারায় ধুমপান নিষেধ। আমি কী উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে বললাম যে, তাঁদের সঙ্গে অনেক লোক, গুরুদ্বোয়ারায় হয়তো জায়গা হবে না। তাই আমরা ওখানে না গিয়ে অন্যত্র উঠেছিলাম। সাধুবাবা বললেন, যত লোকই আসুক, গুরুদ্বোয়ারায় জায়গা হবেই, খাওয়ার ব্যবস্থাও হবে। আমাদের ধারণা ভুল। বললাম এরপর থেকে তাঁদের সঙ্গে গুরুদ্বোয়ারাতেই থাকবো। বলবার একমাত্র কারণ, গোবিন্দঘাটে একটা গুরুদ্বোয়ারা ছাড়া, কোন হোটেল বা থাকবার জায়গা নেই বলেই জেনেছিলাম। এঁরা অসন্তুষ্ট হলে যদি সেখানে স্থান না পাই? আমরাও তাঁকে একটু আলাদা সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম।
রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে বাস থেকে নেমে, চা জলখাবার খেয়ে নিয়ে, জায়গাটা এক চক্করে দেখে নিলাম। খুব সুন্দর লাগল, অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নদী এখানে মিশেছে। তবে একটা কথা বারবার মনে হচ্ছিল। জিম করবেট-এর 'রুদ্রপ্রয়াগের চিতা' পড়েছি। কত বছর আগেকার ঘটনা। জায়গাটা এখনই এই, তাহলে তখন কী ছিল! করবেট সাহিব কীভাবে ওইরকম একটা হিংস্র চিতাকে এখানে মেরেছিলেন, ভাবতেও অবাক লাগছিল।
ক্রমে গৌচর, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ অতিক্রম করে আমাদের বাস এগিয়ে চললো। শেষে চামোলী নামে একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল। সামনে ধ্বস নেমেছে। একটা বুলডোজার দেখলাম রাস্তা পরিস্কারের জন্য প্রস্তুত। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তা পরিস্কার হয়ে যাওয়ায়, বাস আবার ছাড়লো। কণ্ডাক্টারের কাছে জানতে পারলাম সামনেই পিপলকোঠি, ওখানেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। ঠিক সময়ে বাস এসে নির্দ্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়ালে চটপট বাস থেকে নেমে, সামনেই একটা ছোট্ট হোটেলে রুটি তরকারির অর্ডার দিলাম। একটু পরেই আমাদের বাসের পাঞ্জাবিরা এসে ওই হোটেলে জায়গা করে নিল। একসঙ্গে অত খদ্দের পেয়ে, দোকানদার আমাদের ভুলে গিয়ে তাদের আগে খাবার পরিবেশন করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমরা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর শেষে বিরক্ত হয়ে অন্য একটা ছোট হোটেলে রুটি, সবজি আর টক দই খেয়ে নিয়ে বাসে ফিরে এলাম। সামান্য এগিয়েই বাস আবার থেমে গেল। বুঝলাম আবার পাহাড়ে ধ্বস নেমেছে। দেখলাম দশ-বার বছরের কয়েকটা বাচ্চা ছেলে রাস্তা পরিস্কার করছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা রাস্তা পরিস্কার করে ফেলল দেখে বেশ আশ্চর্যই হলাম।
কিন্তু আমাদের কপাল সত্যিই খুব খারাপ। খানিক এগিয়ে দূর থেকেই দেখি বাস, জীপ, ট্রাক সব সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের বাস অনেকগুলো গাড়িকে কাটিয়ে, একবারে সামনের দিকে গিয়ে দাঁড়ালো। শুনলাম সামনে এমন ধ্বস নেমেছে যে হেঁটেও যাওয়া সম্ভব নয়। ঘড়িতে দুপুর দু'টো। একটা বাঁক পেরিয়েই দেখতে পেলাম ওপর থেকে বিরাট বড় বড় পাথর রাস্তার ওপর পড়ে, রাস্তাকে নিয়ে তলায় চলে গেছে। একজন পাঞ্জাবি মিলিটারির তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু বাচ্চা ছেলে রাস্তা পরিস্কারের কাজ করছে। ধ্বসটার অপর দিকে হেলং নামে একটা শহর। ধ্বসের ওপারে কতগুলো বাস দাঁড়িয়ে আছে জানিনা, তবে আমাদের এদিকে বাস, জীপ ও ট্রাক মিলে প্রায় চল্লিশটা গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বাসের আমরা তিনজন ও কয়েকজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক, ওই মিলিটারিটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা কাজে হাত লাগাবো কিনা। কিন্তু কেন জানিনা, আমাদের কোন কাজে হাত লাগাতে দেওয়া হ'ল না।
আসবার পথে অনেক ঝরনা চোখে পড়ছিল। ভাবলাম এই ফাঁকে আমাদের তিনটে ওয়াটার বটল ভরে নিয়ে আসি। কিন্তু এখানে কাছেপিঠে কোন ঝরনাই নেই। অনেক লোক বালতি, হাঁড়ি, ডেকচি নিয়ে জলের খোঁজে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছুটা এগিয়ে দেখলাম, একটা পাথর জলে ভিজে রয়েছে। খুব সরু একটা জলের ধারা পাথরটার ওপর দিয়ে গড়িয়ে রাস্তায় পড়ছে। একজন পাথরটার ওপর একটা গাছের পাতা এমন ভাবে পেতে দিল, যে ওই জলধারা পাথরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে না পড়ে, পাতার ডগা দিয়ে টপটপ করে পড়তে শুরু করল। সেই পাতা থেকে নিজেদের বালতি, হাঁড়ি ভরে নেবার জন্য অনেক লোকের ভিড়। আমি এগিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে বললাম, 'এত লোক, আর এই সামান্য জল। প্রত্যেকে অল্প অল্প করে নাও'। আমার জামাকাপড় একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আর চেহারা-চালচলন শহুরে বলেই বোধহয়, ওরা আমাকে আগে জল নিতে দিল। বাস আজ আর ছাড়বার আশা খুবই কম। সঙ্গে খাবার বলতে এক শুকনো চিঁড়ে আছে। ফলে জল অনেক বেশি করেই প্রয়োজন। আমার ওয়াটার বটল ভর্তি হয়ে গেলে, স্বার্থপরের মত দেখালেও দিলীপ আর মাধবকেও ভরে নিতে বললাম।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। অনবরত ডিনামাইট দিয়ে পাথর ভেঙ্গে রাস্তা পরিস্কারের কাজ চলছে। এরমধ্যে ঠিক হ'ল, এদিকের যাত্রীদের ওদিকের বাস নিয়ে যাবে, ওদিকের যাত্রীদের এদিকের বাস। একটা আশার আলো দেখা গেল। কিন্তু সমস্যা হ'ল, এই রাস্তায় তিন-চার রকম কোম্পানীর বাস চলে। একই কোম্পানীর বাস দু'দিকে থাকলে, তবেই এ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমরা এ সুযোগ পেলাম না। বেশ কিছু যাত্রী মালপত্র নিয়ে এপার-ওপার করতে আরম্ভ করে দিল। ফলে রাস্তা পরিস্কারের কাজে বিলম্ব হতে শুরু করলো। শেষে মিলিটারি ভদ্রলোক ঘোষণা করলেন, আজ আর কাজ করা সম্ভব নয়। আকাশও কালো মেঘে ঢেকে গেছে। ড্রাইভার বাসের যাত্রীদের বলল, পিছনে তিন কিলোমিটার দূরে 'লংসী' নামে একটা গ্রাম পাওয়া যাবে। ওখানে গেলে রাতে থাকার ও খাওয়র ব্যবস্থা করা যাবে। এ রাস্তায় রাতে বাসে থাকার নিয়ম নেই, উচিতও নয়। খবরটা শুনে বাসের সব যাত্রীই খুব খুশি।
বাসটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে কথামতো লংসী গ্রামে আসা হ'ল। রাস্তায় দু'টো বড় ও একটা ছোট ঝরনা দেখলাম। গ্রাম মানে দু'টো ছোট চায়ের দোকান। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু জনবসতি থাকতেও পারে। একটা দোকানে চা আর পকোড়া খেয়ে নিলাম। বুঝলাম খিদে পেলে ঠাণ্ডা ন্যাতন্যাতে পকোড়াও কত উপাদেয় হয়। যাহোক, পনের টাকা ভাড়ায়, একটা মাত্র ঘর পাওয়া গেল। সে ঘরে দাঁড়িয়ে থাকলেও, বাসের অর্ধেক লোকের জায়গা হবে না। ফলে কেউই থাকতে রাজি হল না। ঠিক হল সবাই রাস্তায় ও বাসেই রাতটা কাটিয়ে দেবে। বুঝতে পারছি বিপদে পড়ে আমরা কখন যেন একই পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছি।
বাসের কাছে ফিরে এসে দেখি, তিনজন পাঞ্জাবি ভদ্রমহিলা ও একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক, বাসের পাশে বড় একটা পলিথিন শিট পেতে শুয়ে আছেন। ওই পরিবারের একজনের সঙ্গে বেশ আলাপ হ'ল, নাম তীরথ সিং। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাতিয়ালায় কাজ করে, পাতিয়ালাতেই থাকে। তার সঙ্গে এই যাত্রায় মা, বোন, ও ভগ্নীপতি আছে। যাবে হেমকুণ্ড সাহিব। আমরা হেমকুণ্ড আর নন্দনকানন যাব বললাম। তীরথ জানালো তার খুব নন্দনকানন দেখবার ইচ্ছা। কিন্তু আর সব পাঞ্জাবিরা হেমকুণ্ড দেখে ফিরে আসবে। আমরা তাকে আমাদের সঙ্গে যাবার সুযোগ দিলে, তার ইচ্ছাপূরণ হয়। মা, বোন ও অসুস্থ ভগ্নীপতি ঘাঙরিয়াতে গুরুদ্বোয়ারায় থাকবেন। আমরা রাজি হয়ে গেলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামলো। বেশ জোরেই হচ্ছে। বাসের সবার খাওয়া হয়ে গেছে। আমরাও পুরি- তরকারি খেয়ে ছুটে বাসে ফিরে এলাম। ঘুম আসার কোন সম্ভাবনা নেই। কালও যাওয়া হবে কীনা সন্দেহ। মহিলারা দিব্যি ম্যানেজ করে বাসের মেঝেতে বা তিনজনের জন্য বসার পিছনের দিকের সিটে শুয়ে পড়েছে। আমি আর মাধব আমাদের নিজেদের সিটে বসে। দিলীপ অপর দিকে তার নিজের সিটে। একটু কাত হব তার উপায় পর্যন্ত নেই। বোধহয় একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। দেখি আমার হান্টার স্যু পরা শ্রীচরণদুটো সামনের সিটের পাঞ্জাবি ভদ্রমহিলার পেটের ওপর। তাড়াতাড়ি আবার সোজা হয়ে বসলাম। সব কিছুরই একটা শেষ আছে। রাত্রিও ক্রমে শেষ হয়ে ভোর হয়ে এল।
ভোরের আলোয় দেখলাম, জায়গাটা খুব সুন্দর। অদ্ভুত একটা বেগুনী রঙের চার পাপড়ির ফুল, চারিদিকে ফুটে আছে। অনেকটা প্রজাপতির মতো দেখতে। এর আগে সমস্ত রাস্তায় হালকা বেগুনী দোপাটির মতো একরকম ফুল দেখে আসছিলাম। এখানে সে ফুল দেখছি না। একটা মিলিটারি ভাঙ্গাচোরা জীপকে একটা মিলিটারি ট্রাক টেনে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত। দিন দু'এক আগে নাকি একটা বাসের সাথে ধাক্কায়, জীপটার এই হাল হয়েছে। বাসের সামনের চাকা জীপের ছাদে উঠে গিয়ে আটকে যাওয়ায়, গভীর খাদে পড়া থেকে রক্ষা পায়। জীপের ড্রাইভার অজ্ঞান হয়ে গেলেও, বিশেষ কোন আঘাত পায় নি।
সকাল ন'টার সময় আমরা দোকানটায় খাবার খেতে গেলে, দোকানদার জানালো, পুরি আর তরকারি পাওয়া যাবে। আটা মাখার সময় লক্ষ্য করলাম, অজস্র সাদা রঙের ছোট্ট ছোট্ট পোকা, আটার মধ্যে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকটা শুঁয়ো ছাড়া, বাচ্চা শুঁয়োপোকার মতো দেখতে। দু'চারটে আটা থেকে বেছে বেছে বাইরে ফেলে বুঝলাম, বৃথা চেষ্টা করছি। আটার থেকে সম্ভবত পোকার পরিমাণ বেশি। উঠে এলাম ওখান থেকে। পুরি তৈরি হলে গরম "আমিষ পুরি", তরকারী সহযোগে খেতে বাধ্য হলাম। খাবারের দাম দেওয়ার সময় দোকানদার আমাদের কাছে দাম নিতে চাইল না, কারণ আমরা নাকি কিছুই খাই নি। সে বলল, এত অল্প খাবারের জন্য আর কী দাম নেব? দাম দিতে হবে না। তাকে জোর করে দাম দিয়ে ভাবলাম, আমরা ভারতবর্ষেই আছি তো!
যাহোক, বেলা দশটা নাগাদ, আমরা আবার সেই ধ্বসের কাছে এলাম। ড্রাইভারের দক্ষতায় এবারও আমরা প্রায় সবার আগেই। চারদিকে মহিলারা স্টোভে খাবার তৈরি করছে। এরা সমস্ত রাত এখানেই ছিল। মাত্র দু'টাকা কিলোগ্রাম দরে একরকম স্থানীয় আপেল, রাস্তার পাশে পাশে প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। কিছুটা সংগ্রহ করে রাখলাম। খুব হাল্কা বৃষ্টি আরম্ভ হল। আজ কিন্তু কালকের সেই মিলিটারি পাঞ্জাবি ভদ্রলোক, আমাদের রাস্তা পরিস্কারের কাজে হাত লাগাতে অনুমতি দিলেন। শুরু হল বৃষ্টিতে ভিজে খাদে পাথর ঠেলে ফেলা। রাস্তা থেকে ঠেলে ফেলা পাথর, তলায় অনেক নীচে নদীতে গড়িয়ে পড়ছে। উঃ, সে কী ভয়ঙ্কর শব্দ। এখানেই দেখলাম তীরথ সিং এর ক্ষমতা। আমরা সবাই কাজ করছি, তবু তার ক্ষমতার তুলনা হয় না। একটা শাবল দিয়ে পাথর ভেঙ্গে, একা খাদে ঠেলে ফেলছে। বেলচা দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করছে। মাঝে মাঝে ডিনামাইট দিয়ে বড় বড় পাথর ভাঙ্গা হচ্ছে। লম্বাটে গোলাকার ধূপকাঠির প্যাকেটের মতো পাঁচ-সাতটা জিনিস একসঙ্গে তার দিয়ে জড়িয়ে বড় বড় পাথরের ওপর রেখে পাহাড়ের ধার থেকে ভিজে মাটি নিয়ে তার ওপর ভাল করে চাপা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। এরকম অনেকগুলো বাণ্ডিল বিভিন্ন বড় বড় পাথরের ওপর রেখে, প্রত্যেকটার সঙ্গে তার যোগ করে, বেশ কিছুটা দূর থেকে ওই মিলিটারি পাঞ্জাবি ভদ্রলোক ওগুলোকে ব্লাস্ট করাচ্ছেন। কী ভাবে ভদ্রলোক ব্লাষ্ট করাচ্ছেন দেখার খুব ইচ্ছা থাকলেও, তাঁর নির্দেশে অনেক দূরে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে। একটু পরে দেখি তিনি বাঁশি বাজিয়ে আমাদের আরও দূরে চলে যেতে বলে, নিজেও দৌড়ে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে খাদের ওপারের পাহাড় থেকে বিকট একটা বোমা ফাটার আওয়াজ হল। চমকে উঠতেই, আমাদের ঠিক পাশে উঁচু পাহাড়টা থেকে আবার সেই আওয়াজ। মনে হল খাদে পরে যাব। সঙ্গে সঙ্গে আবার খাদের ওপার থেকে আওয়াজ। এইভাবে বেশ কয়েকবার প্রতিধ্বনি হয়ে সব নীরব।
যাহোক, ডিনামাইট দিয়ে ব্লাষ্ট করাবার পরে আমরা এগিয়ে এসে আবার সেই ভাঙ্গা পাথর তলায় ফেলছি। যত তাড়াতাড়ি রাস্তা পরিস্কার হবে, তত তাড়াতাড়ি আমরা এই মরণফাঁদ থেকে মুক্তি পাব। বৃষ্টি আবার বেশ জোরে নামলো। আমরা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজেদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। জামাপ্যান্ট ভিজছে, তবে খুব অল্প। তীরথ কিন্তু বৃষ্টিতেও কাজ করে গেল। মুশকিল হ'ল, পাথর যত তলায় ঠেলে ফেলা হচ্ছে, সেগুলো তত ভাঙ্গা রাস্তাকে সঙ্গে করে নিয়ে তলায় নামছে। ফলে ওই জায়গায় রাস্তা আরও সরু হচ্ছে। এবার একজন স্থানীয় ছেলে খাদের দিকে কিছুটা নেমে, ভাঙ্গা রাস্তার খাদের দিকটায়, কী অদ্ভুত কায়দায় পাথরের দেওয়াল তৈরি করে দিল। এটাকে এখানকার লোকেরা দেখলাম "পাক্কা রাস্তা" বলে। রাস্তা একটু পরিস্কার হতে, ধ্বসের ওদিক থেকে গোটা দু'তিন মোটর সাইকেল, এপারে আমাদের দিকে চলে এল। প্রতি মোটর সাইকেলে দু'জন করে যুবক যাত্রী, হাতে এক গোছা ফুল। শুনলাম এগুলোই নাকি ব্রহ্মকমল। কী আনন্দই যে হল, আমরা তাহলে ফুলের দেশে প্রায় এসে গেছি।
শেষ পর্যন্ত বিকেল সাড়ে চারটের সময়, আমাদের দিক থেকে প্রথম একটা মিলিটারি জীপ ওপারে গিয়ে রাস্তা উদ্বোধন করলো। তারপর সমস্ত যাত্রীদের বাস থেকে নামিয়ে একে একে সব ফাঁকা বাস খুব ধীর গতিতে ধ্বসের ওপারে চলে গেল। ওপারে গিয়ে দেখি, ওদিকের যাত্রীদেরও করুণ অবস্থা। তাদের আগে ছাড়া হয়নি বলে তাদের খুব দুঃখ। তবে এদের গতকাল রাতে খাবার জুটেছে, কারণ সামনেই দু'একটা দোকান আছে।
বাসে উঠে বসলাম। পাঞ্জাবিরা আমাদের খুব প্রশংসা করছে। সবাইকে বলছে যে আমরা রাস্তা পরিস্কারের জন্য খুব কাজ করেছি। এরপর থেকে আমাদের তিনজনকেও তাদের দলভুক্ত করে ফেলল। বিশেষ করে সেই তীরথ সিং। সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছলাম যোশীমঠ। আজ বাস আর যাবে না, কারণ কোনমতেই রাতের আগে বদ্রীনারায়ণ পৌঁছতে পারবে না। মাঝপথে যদিও গোবিন্দঘাট, কিন্তু সেখানে রাত্রে থাকার জায়গার অভাব, তাই যোশীমঠেই থাকতে হল। চারদিকে ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।
পাঞ্জাবিদের সাথে মালপত্র নিয়ে গুরুদ্বোয়ারায় উঠলাম। পাশেই বিড়লা গেষ্ট হাউস। অজস্র ফুল ফুটে আছে। থাকার জায়গাও আছে, চার্জও খুব একটা বেশি নয়। তবু ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওদের সাথে গুরুদ্বোয়ারায় গেলাম। মাঝখানে উপাসনা কক্ষ। সাধুবাবা তীরথের গেষ্ট, তার সঙ্গেই এসেছেন। তিনি আমাদের জায়গা করে নিতে বললেন। ওদের পাশেই হোল্ড-অলগুলো খুলে তিনজনের শোয়ার ব্যবস্থা করে নিলাম। মাথা থেকে টুপি খুলতে গেলে তীরথ জানালো, গুরুদ্বোয়ারায় খালি মাথায় থাকতে নেই। আমরা রাস্তায় এসে চা জলখাবার খেয়ে, একটু ঘুরে বেড়ালাম। কুয়াশায় জামাপ্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে গুরুদ্বোয়ারায় ফিরে এলাম। চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। একটু পরে উপাসনা ঘরে প্রার্থনা শুরু হল। "শতনাম এ হ্যায় গুরু", আর সকলের সাথে প্রার্থনা ঘরে আমরাও সুর করে গাইলাম। প্রার্থনা শেষে সামান্য সুজি প্রসাদ পেলাম। তীরথের মা, বোন এবং আর সব মহিলারা গেলেন সবার জন্য রুটি বানাতে। একসময় ডাক এলে আমরাও একসঙ্গে খেতে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে লম্বা শতরঞ্চি পাতা। একটা কল থেকে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল পরছে। হাত ধুয়ে বসে পড়লাম। হাল্কা ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। আমরা সকলে বৃষ্টিতে বসে আছি। একটু দূরেই রুটি তৈরির কাজ জোর কদমে চলছে। এবার কয়েকজন পাঞ্জাবি খাবার পরিবেশন করা শুরু করলো। বিরাট বিরাট থালা প্রত্যেকের সামনে রেখে দিয়ে যাওয়া হ'ল। এক পাত্র করে ডাল থালায় ঢেলে দিয়ে যাওয়া হ'ল, সঙ্গে একটু করে বিট-গাজরের আচার। এবার ওরা রুটি নিয়ে এল। রুটি কিন্তু থালায় দেবার নিয়ম নেই। হাত পাততে হবে, ওরা হাতে দিয়ে যাবে। একটা রুটি কেউ বলে না, এক লাখ রুটি, বা এক লাখ প্রসাদী বলতে হয়। এত কিছুর পরেও কিন্তু খাওয়া শুরু হল না। মাধবকে বললাম, দ্বিতীয়বার যদি এ অবস্থায় থাকতে হয়, তাহলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া হবে। যাহোক, খুব তাড়াতাড়ি দু'টো রুটি শেষ করে ফেললাম। খিদে থাকলেও বৃষ্টিতে ভিজে, ডালরুটি খাবার ইচ্ছা আর রইলো না। তীরথ আমাদের একটু বসতে বললো। একসঙ্গে উঠতে হবে, এটাই প্রথা। কিন্তু এরপর যা শুনলাম, তাতে তো অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। বাসন নিজেদের মেজে পরিস্কার করে দিতে হবে। ধনী, দরিদ্র, সবার এক নিয়ম। এখনও বুঝতে পারছি না শুধু নিজের থালা মাজতে হবে, না রান্নার সমস্ত বাসন নিজেদের মাজতে হবে। এবার দেখা গেল অনেকেই ছাই দিয়ে বাসন মাজতে শুরু করেছে। বড় বড় দুটো ড্রামে গরম ও ঠাণ্ডা জল রাখা আছে। আমরা কোনমতে জল দিয়ে থালা ধুয়ে একছুটে ঘরে ফিরে এলাম। নিজেদের শোবার জায়গায় ফিরে এসে দেখি, পাঞ্জাবিদের নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে খুব তর্ক বেধেছে। উত্তেজনা ক্রমশঃ বাড়ছে। শিখরা কোমরে ছোট তরবারি রাখে, যাকে কৃপাণ বলে জানতাম, কিন্তু এখানে দেখি তারা বেশ বড় বড় তরবারি কোমরে ঝুলিয়ে এসেছে। দেখি শিখরা কোমরে ঝোলা খাপ থেকে তরবারি বার করে, "মাঠমে আও দেখ লেঙ্গে" ইত্যাদি বলতে শুরু করেছে। হাতে খোলা তরবারি, মুন্ডু যাবে কিনা চিন্তায় আছি। শেষে এক সাধু পাঞ্জাবি ওদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে, আমাদের জানালেন যে, ভয়ের কোন কারণ নেই, এটা ওদের নিজেদের ব্যাপার। বুঝলাম ইনি এই গুরুদ্বোয়ারার প্রধান। ক্রমে রাত বাড়ছে। শুয়ে পড়লাম।
ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল তীরথের ডাকে। চটপট হোল্ড-অল বেঁধে নিলাম। সামান্য কয়েক চুমুক চা খেয়ে মালপত্র নিয়ে, বাসে চলে এলাম। মালপত্র রেখে, জলখাবার খেয়ে নিলাম। আজই আমরা গোবিন্দঘাট থেকে হেঁটে ঘাংঘারিয়া যাব। যোশীমঠ থেকে বাস রাস্তা খুব সরু। বদ্রীনারায়ণ থেকে সকালে যে সব বাস ছেড়েছে, সেগুলো একে একে যোশীমঠ এসে পৌঁছল। সবার শেষে যে গাড়িটা আসলো, তাতে একটা সবুজ পতাকা লাগানো আছে। এটাই এ পথের সিগনাল। সবুজ পতাকা মানে এরপর আর কোন গাড়ি ওদিক থেকে এদিকে আসবে না। এবার এদিক থেকে গাড়ি ছাড়তে পারে। এবার এদিক থেকে একে একে বাস ছাড়তে শুরু করলো। সব শেষের গাড়িতে সবুজ পতাকাটা লাগানো হবে। এখান থেকে গোবিন্দঘাট মাত্র আঠার কিলোমিটার পথ। সকাল সাড়ে দশটার সময় নামলাম গোবিন্দঘাটে। সামান্য দূরেই গুরুদ্বোয়ারা। তীরথ চটপট ওদের ও আমাদের মালপত্র এক জায়গায় গুছিয়ে রেখে দিল। সিমেন্টের ছোট ছোট খোপে মাল রাখার সুন্দর ব্যবস্থা। মাল রাখার রসিদও পেলাম। একতলায় নেমে এসে চা খেলাম।
এবার হাঁটতে হবে। কাঁধের ঝোলাব্যাগে ওয়াটার প্রুফ ও টুকিটাকি জিনিস নিয়ে নিলাম। তিনজনের তিনটে ঝোলাব্যাগের একটার ভিতর একটা রামের বোতল। আমার অফিসের আর্মডগার্ড কল্যাণদা এনে দিয়েছিল। একটা ব্রীজ পার হয়ে অপর পারে এসে জায়গাটার একটা ছবি তুলে নিলাম। ইতিমধ্যে তীরথ, ওর বোন, মা ও ভগ্নীপতি এসে উপস্থিত হ'ল। তীরথের বোন আমাদের তিনজনকে অনেকটা মনাক্কা, কিশমিশ, পেস্তা, মিছরি আর ছোট এলাচ দিল। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। তের কিলোমিটার পথ হেঁটে, আজ যাব ঘাংঘারিয়ায়। এইরকম হাঁটা আমার এবারই প্রথম। ফলে মনে বেশ হিরো হিরো ভাব। হাঁটতেও বেশ ভাল লাগছে। অনেকটা পথ হেঁটে 'জঙ্গলচটি' তে পৌঁছে সামান্য পকোড়া আর চা খেয়ে নিলাম। তীরথ কিছুতেই দাম দিতে দিল না। ভগ্নীপতি তীরথের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছে। ফলে ওদের হাঁটার গতি খুব কম। ওদের সাথে ওর বোনও হাঁটছে, মা যাচ্ছেন কাণ্ডিতে। এরপর 'পাল্লুগাঁও' বা 'পান্নাগাঁও' এসে আর এক দফা চা, বিস্কুট ইত্যাদি খেয়ে নিয়ে, তীরথদের চা বিস্কুটের দাম অগ্রিম দিয়ে, ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে হাজির হ'ল। তীরথরা আসতেই দোকানদার ওদের চা, বিস্কুট দিল। আবার দু'হাত ভরে পেস্তা, মনাক্কা ইত্যাদি নিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। এত পরিস্কার মিছরি, এত বড় বড় মনাক্কা ও কিশমিশ এর আগে খাওয়া তো দূরের কথা, চোখেও দেখি নি! 'ভিউডাঁর' নামে একটা ছোট্ট গ্রামে এসে পৌঁছলাম। এখানে তীরথ আমাদের আপেল, পালকপাতা নামে একপ্রকার পাতার বড়া আর চা খাওয়ালো। বড়াগুলো অনেকটা এখানকার বেগুনীর মতো। গরম গরম খেতেও বেশ ভালই লাগছিল। ক্রমে ক্রমে শুধু তীরথের দলটাই আমাদের সঙ্গে রয়ে গেল। এবার আমরা অনেকটা এগিয়ে গেলাম। পথ যেন আর শেষই হয় না। বেশ কষ্টকরও বটে। তবে যতই খারাপ রাস্তা হোক, এই প্রথম হাঁটছি, তাই সেরকম কোন কষ্ট হচ্ছে না। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা উপত্যকা মতো। সেটা পার হয়ে দাঁড়ালাম। যতদূর চোখ যায় দৃষ্টি প্রসারিত করেও, কোন লোকজন চোখে পড়লো না। আরও কিছুটা পথ হেঁটে ঘাংঘারিয়া এসে পৌঁছলাম।
একটা দোকানে বসে চা খেলাম এবং ডিম পাওয়া যায় দেখে, আমাদের তিনজনের জন্য তিনটে ডিম সিদ্ধ করতে বলে, তীরথদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। পাঞ্জাবিদের একটি দলের সঙ্গে গেলাম গুরুদ্বোয়ারায়। তীরথও তার সঙ্গীদের নিয়ে পৌঁছল। বাইরে নোটিশ বোর্ডে বড় বড় করে লেখা আছে যে, গুরুদ্বোয়ারায় মাদক ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। ধূমপান নিষিদ্ধ। খুব চিন্তা হচ্ছিল এই ভেবে যে, আমার কাপড়ের ঝোলা ব্যাগে রামের বোতল আছে, তামাক তো আছেই। ব্যাগে একটু হাত লাগলেই বোঝা যাবে, ভিতরে কী আছে! রামের বোতল যতই ওষুধ হিসাবে নিয়ে আসি বা ব্যবহার করি না কেন, মাদক দ্র্রব্য তো বটে।
যাই হোক গুরুদ্বোয়ারা কর্তৃপক্ষ আমাদের দশ নম্বর ঘর দিলেন। এই ঘরগুলো মূল হলঘরের মতো ভাল নয়। টিনের ঘর। ঘাংঘারিয়ার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট। রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা পড়বে। ঘর নিয়ে আমরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লাম। যা বুঝলাম, মূল হলঘরে শুধু পাঞ্জাবি শিখদেরই জায়গা দেওয়া হয়। তীরথ কর্তৃপক্ষকে জানালো যে আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে এসেছি। ফলে আমাদের, তীরথ ও আর সব পাঞ্জাবিদের সাথে, মূল হলঘরে স্থান দেওয়া হল। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গোটা বার-তের কম্বল পেলাম। মেঝেতে বেশ কয়েকটা পেতে, গায়ে দেওয়ারগুলো ভাঁজ করে সাজিয়ে রেখে, দু'টো কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ ও ওয়াটার বটলগুলো মাথার কাছে রেখে, যে ব্যাগটায় রামের বোতল আছে, সেটা নিয়ে বাইরে যাব বলে প্রস্তুত হলাম। তীরথের মা বললেন, বেটা সব সামান এখানে প্রেমসে রেখে যাও, কোন চিন্তা নেই। কী বলবো ভেবে না পেয়ে বললাম, ব্যাগে গরম জামা আছে। ঠাণ্ডা লাগলে পরে নেব। হলঘর থেকে বেড়িয়ে আবার সেই চায়ের দোকানে আসলাম। ডিম সিদ্ধগুলো এবার কাজে লাগানো গেল। সঙ্গে আর এক রাউন্ড গরম চা। লক্ষ্য করলাম দোকানটার পাশেই একটা ডাকবাংলো আছে। ঠিক করলাম আর এক মুহূর্তও ওই গুরুদ্বোয়ারায় থাকা নয়। কোনভাবে জানাজানি হয়ে গেলে আমাদেরও বিপদ, তীরথও খুব অপমানিত হবে। মাধব ও দিলীপ গেল ডাকবাংলোয় খোঁজ নিতে। কিন্তু ওখানে জায়গা পাওয়া গেল না। ওদের বললাম, গুরুদ্বোয়ারার পাশেই একটা ছোট্ট হোটেল মতো আছে, ওখানে একবার চেষ্টা করে দেখতে। ব্যবস্থা হলে তীরথকে একটু বুঝিয়ে বলতে যে, আমাদের গুরুদ্বোয়ারায় থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। ভাবছিলাম তীরথ চাইছে কী করে আমাদের আরও বেশি আরামে, আরও ভালভাবে রাখা যায়, আর আমরা চাইছি কী করে ওদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মাধব ও দিলীপ চলে গেল। আমি সমস্ত বাধার একমাত্র কারণ, ছোট্ট একটা বোতল আগলে, দোকান থেকে একটু দূরে একটা পাথরের ওপর, ওদের ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকলাম। হেমকুণ্ড সাহিব প্রায় পনের হাজার দুশ' ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। ভেবেছিলাম এখানে থাকলে সুবিধা মতো ঘর না পেলে, ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে সামান্য রামের প্রয়োজন হতে পারে। এখন দেখছি গোবিন্দঘাটে ওটাকে সুটকেসে রেখে এলেই ভাল করতাম। প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গেল, একা একা বসে আছি, কারো পাত্তা নেই। বাধ্য হয়ে আবার গুরুদ্বোয়ারার দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি মাধবরা তীরথের সাথে গল্প করছে। আমাকে দেখেই তীরথ বললো, 'রায় তোমার কোন চিন্তা নেই, আমি আছি। ঘরের মধ্যে খেও না। বাইরে যতবার ইচ্ছে খেয়ে আস, কেউ কিছু বলবে না'। বুঝতে পারছি না ওরা তীরথকে ঠিক কী বলেছে। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছি, যে ওরা নিশ্চয় বলেছে যে আমার অসুবিধা হচ্ছে, তাই ওরা এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। আরও বুঝলাম যে সে চেষ্টা সফল হয় নি। ভাবছি ওদের হাত থেকে মুক্তি পেতে আমাকে ওরা তীরথের কাছে মাতাল বানিয়ে ছাড়েনি তো? পরে সব জানলাম। ওরা বুদ্ধিটা ভালই বার করেছিল। ওরা তীরথকে বলেছিল, আমি প্রচণ্ড রকম ধূমপান করি। এখানে সেটা একবারে নিষিদ্ধ। তাই আমি চাই এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে। অবশ্য সারাদিন আমরা এক সঙ্গেই থাকবো, এক সঙ্গেই পথ হাঁটব।
পাশের একমাত্র হোটেলে জায়গাও ছিল। ভাড়া মাত্র পনের টাকা। মাঝ থেকে লাভ হল, পালানো তো গেলই না, অনবরত তীরথ মাধবকে বলছে, 'এই ব্যানার্জী, রায়কো সিগারেট দেও'। সে এক মহা অস্বস্তি। ক্রমে রাত নেমে এল। তীরথের সঙ্গে ভেতরে গেলাম। ভয় হচ্ছিল এখানেও খোলা জায়গায় বসে, রুটি হাতে 'শতনাম এ হ্যায় গুরু' গাইতে হবে কী না। পাশের চায়ের দোকানে গরম আলুর পরোটা পাওয়া যায় শুনে এসেছি। তবু গরম পরোটা ছেড়ে তীরথের সাথে ডাল, রুটি খেতে যেতে হল। এখানেও দেখছি সমস্ত মহিলারা রান্নার কাজে ব্যস্ত। তবে খাওয়ার জায়গাটা খোলা আকাশের নীচে নয়। এখানে ঠাণ্ডা অবশ্য অনেক বেশি। বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে হাত ধুয়ে, সবার সাথে লাইনে বসে পড়লাম। ডাল, তরকারি ও রুটি। দু'টো রুটি খেলাম। তীরথ ভাবলো আমরা লজ্জা পাচ্ছি। সে আমাদের আরও রুটি খাবার জন্য জোর করতে লাগলো। সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে, ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গেলাম বাসন মাজতে। তীরথের বোন কিন্তু এবার আমাদের কিছুতেই বাসন মাজতে দিল না। সে বললো, 'হাম তুমকো ভাইয়া বোলা', ইত্যাদি। যাক ভাগ্য ভাল, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। তীরথ পাশের চায়ের দোকানে ছুটে গিয়ে আমাদের, বিশেষ করে আমাকে, সিগারেট দিতে বলে এল। এত লজ্জা করছিল কী বলবো! বৃষ্টি শুরু হল। ঘরে ফিরে এসে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
আগষ্ট মাসের উনিশ তারিখ। ঘুম ভাঙ্গলো তীরথের 'এ রায় উঠো' ডাকে। উঠতেই কফির গ্লাস এগিয়ে দিল। ভাবলাম গুরুদ্বোয়ারা থেকেই কফি দেওয়া হয়েছে। পরে শুনলাম পাশের চায়ের দোকান থেকে তীরথ আমাদের তিনজন ও ওর পরিবারের সবার জন্য কফি কিনে এনেছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। কিছু খাওয়া হল না। মনে মনে ঠিক করলাম রাস্তায় যাহোক খেয়ে নেব।
হেমকুণ্ড যাবার রাস্তা একটু ওপরে উঠে ইংরাজি "ওয়াই" (Y) অক্ষরের মতো দু'ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকটা নন্দন কাননের পথ, ডানদিক গেছে হেমকুণ্ড সাহিব। এখানে এসে জানতে পারলাম, হেমকুণ্ডে বিশাল গুরুদ্বোয়ারা স্থাপিত হচ্ছে। গুরুদ্বোয়ারা তৈরি শেষ হতে ১৯৮২-৮৩ সাল। বর্তমানে ওখানে থাকবার ব্যবস্থা নেই। হেমকুণ্ডের উচ্চতা ১৫,২১০ ফুট। দূরত্ব ঘাংঘারিয়া থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। তীরথ তার ভগ্নীপতিকে নিয়ে হাঁটা শুরু করার আগে, মুঠো মুঠো কিশমিশ, পেস্তা, মনাক্কা, ছোট এলাচ আমাদেরও দিল, নিজেরাও নিয়ে চিবোতে শুরু করলো।
অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি। আশ্চর্য, এ পথে এত লোকের যাতায়াত, কিন্তু কোন দোকান নেই। চারদিকে নানারকম ফুলের সমারোহ। বেশিরভাগ ফুলের রঙ বেগুনী। এমন কী প্রজাপতিগুলো পর্যন্ত বেগুনী রঙের। এতটা রাস্তায় ব্রহ্মকমল কোথাও দেখলাম না। তীরথরা পিছিয়ে পড়েছে, তাই মাঝেমাঝেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছি। দেখা হলে আবার এগিয়ে যাচ্ছি। এতক্ষণে একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। চা খেয়ে নিলাম। তীরথের মা ও বোন, দু'জনেই দেখলাম এবার কাণ্ডি নিয়েছেন। আমরা বেশিরভাগ পাকদণ্ডি ব্যবহার করায়, অনেক এগিয়ে গেলাম। এবার রাস্তার পাশে গ্লেসিয়ার নেমে এসেছে দেখে খুব ভাল লাগলো। সাদা বরফের টুকরো হাতে নিয়ে অনেকটা পথ গেলাম। এখানে দেখি চারপাশে হলুদ রঙের একরকম থোকা থোকা ফুল ও হালকা নীল রঙের একরকম চার পাপড়ির ফুল। আমার মনে হল এই নীল রঙের ফুলটাই, এ রাজ্যের সবথেকে সুন্দর ফুল। নন্দন কানন, যাকে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স বলে, সেখানেও এত সুন্দর ফুল আছে কীনা কে জানে। সর্বাঙ্গে কাঁটা, আর কী যে অদ্ভুত একটা নীল রঙ কী বলবো। আর কিছুটা পথ এগিয়েই দূরে, বহু ওপরে, ফিকে সবুজ রঙের ফুলের সাম্রাজ্য চোখে পড়লো। একজন যাত্রীর কাছে শুনলাম, ওগুলোই ব্রহ্মকমল। এই ফুলেই কেদারনাথের পূজা হয়। ১৪,০০০ থেকে ১৬,০০০ ফুট উচ্চতায়, পাথুরে জমিতে এরা জন্মায়। হাঁটার গতি যেন বেড়ে গেল। রাস্তায় দু'একটা ব্রহ্মকমল পরে থাকতে দেখলাম, বোধহয় কোন যাত্রী তুলে আবার ফেলে রেখে গেছে। আমরা কুড়িয়ে নিলাম। এত উগ্র গন্ধ বোঝাতে পারবো না। আমার মনে হল, আমাদের এখানকার শিয়ালকাঁটা ফুলের গন্ধের সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল আছে। তবে গন্ধের তীব্রতা বেশ কয়েকগুণ বেশি। ফুলের ভিতরে চার-পাঁচটা ফুলের মতো রেণুর আধার। খুব হাল্কা সবুজ রঙ। ভুট্টার খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে, শেষের দিকে যেমন সাদাও নয়, সবুজও নয় গোছের রঙ দেখা যায়, অনেকটা সেরকম। পাপড়িগুলো এত পাতলা, যে মনে হয় এদিক থেকে ওদিক দেখা যাবে। তীরথ এসে হাজির হল। ও বললো পরে অনেক পাবে, এগিয়ে চল। ওর হেমকুণ্ড এই দ্বিতীয়বার। হেমকুণ্ড সাহিব ওদের ধর্মের একটা অতি পবিত্র জায়গা।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা সত্যিই ব্রহ্মকমলের রাজত্বে এসে পৌঁছলাম। গাছগুলো অনেকটা মূলো গাছের মতো, গোটা গাছটায় ওই ফুলের গন্ধ। গাছে হাত দিতে আমাদের হাতে, জামাকাপড়ে তীব্র ফুলের গন্ধে ম'ম করতে লাগলো। গাছের পাতার মধ্যে যে শিরাগুলো দেখা যায়, সেগুলো বেশ উঁচু ও স্পষ্ট, অনেকটা খরগোশের কানের মতো। হেমকুণ্ড প্রায় পৌঁছে গেছি। মেঘ করে আসছে ছবি তুলতে হবে, তাই ফুল না তুলে হাঁটার গতি বৃদ্ধি করলাম। রাস্তা এবার দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা পথ সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে হয়। অনেকগুলো সিঁড়ি, তাই সিঁড়ি ভাঙ্গার কষ্টও প্রচুর। তবে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায়। অপর পথটা রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হয়। কষ্ট লাঘব করতে ও প্রাকৃতিক দৃশ্যকে উপভোগ করতে, আমরা রাস্তা দিয়েই এগোলাম। দূরে একটা নীল ও হলুদ রঙের পতাকা উড়তে দেখা গেল। সমস্ত গুরুদ্বোয়ারায় এই দুই রঙের পতাকা উড়তে দেখেছি। পতাকা লক্ষ্য করে আমরা গুরুদ্বোয়ারাতে এসে হাজির হলাম। কাজ শেষ হতে এখনও অনেকদিন লাগবে। এতবড় এলাকা নিয়ে, এত বিশাল গুরুদ্বোয়ারা এখানে তৈরি হচ্ছে, ভাবতেও পারি নি! বড় বড় লোহার স্ট্রাকচার, টিনের ছাদ, মাঝখানে একপাশে মন্দিরের মতো। ওখানে ওদের ধর্মগুরুর ছবি। ছবিতে প্রচুর ব্রহ্মকমল ফুল দেওয়া আছে। ব্রহ্মকমলের মালা দিয়ে সাজানো। গুরুদ্বোয়ারার পিছনেই কুণ্ড। ওপরের পাহাড় থেকে এই বিশাল বড় লেক বা কুণ্ডের জলে গ্লেসিয়ার নেমে এসেছে। কুণ্ডের পারে দাঁড়িয়ে মনে হ'ল, জলের গভীরতা খুব বেশি নয়। এই এলাকাটা সাতটা পাহাড়ের চূড়া দিয়ে ঘেরা। আগে এ জায়গাটা লোকপাল নামে পরিচিত ছিল। দশরথ পুত্র লক্ষণ এই এলাকার আরাধ্য দেবতা ছিলেন। যাহোক, কুণ্ডের একপাশে অনেক পাঞ্জাবির ভিড়, সবাই কুণ্ডে স্নান করতে ব্যস্ত। সকলে আমাদের এই কুণ্ডে স্নান করার জন্য অনুরোধ করলেন। অনেকে আবার বললেন, যে কুণ্ডের জল গরম এবং এই কুণ্ডে স্নান করলে, সব রকম রোগমুক্তি হয়, শরীর ভাল হয়, পুণ্য অর্জন তো আছেই। রোগমুক্তি হয় কীনা জানিনা, তবে কুণ্ডের জল যে কীরকম গরম, সে তো গ্লেসিয়ার দেখেই বুঝতে পারছি। একে মেঘ করে আছে ও বেশ ঠাণ্ডা, তার ওপর ওই বরফগলা ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে আমরা রাজি হলাম না। ওরাও ছাড়বার পাত্র নয়। সবাই একসঙ্গে সাহস ও উৎসাহ দিতে লাগল, দেখে মনে হয় নিজেরা স্নান করে রোগমুক্তি ও পুণ্যলাভের থেকে, আমাদের স্নান করিয়ে রোগমুক্ত ও পুণ্যলাভ করানোয়, তাদের আগ্রহ অনেক বেশি। একটা জাপানি ছেলেকে দেখলাম, ওই ঠাণ্ডা জলে মনের সুখে সাঁতার কেটে যাচ্ছে। ওর ক্ষমতা দেখে অবাক হতে হয়। আমাদের সাথে কোন দ্বিতীয় বস্ত্র, এমন কী গামছা পর্যন্ত নেই। কুণ্ডের ধারে ধারে জলের মধ্যে অনেক বড় বড় পাথর পড়ে আছে। আমরা একটা পাথরের ওপর কিছুক্ষণ বসে চলে আসবো ঠিক করলাম।
এবারে গুরুদ্বোয়ারার সাধুবাবা এগিয়ে এসে প্রায় হাত জোড় করে আমাদের স্নান করতে অনুরোধ করলেন। তিনিও বললেন এই জলে স্নান করলে রোগমুক্তি হয়, অনেক সুস্থ বোধ হয়। তাঁর বয়স, সৌম্য চেহারা, ধবধবে সাদা দাড়িগোঁফ, এবং সমস্ত পাঞ্জাবি সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর সম্মান দেখে, তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আগে জানতাম না তাই সঙ্গে স্নান করার কোন কাপড় নিয়ে না আসায়, স্নান করায় অসুবিধা আছে। ভাবলাম সবজান্তা বাঙালি বুদ্ধিতে এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। ও বাবা, আমাদের বাসের পরিচিত পাঞ্জাবিরা আমাদের শুকনো ভাঁজ করা ধুতি দিয়ে, স্নান করতে বললো। বাধ্য হয়ে প্রথমে আমি প্যান্ট জামা ছেড়ে, ধুতি পরে হাঁটু জলে নামলাম। মনে হ'ল এক হাঁটু বরফে পা দু'টো ঢুকে গেল। ডুব না দিয়ে পারে উঠে এলাম। পাঞ্জাবিরা পারে দাঁড়িয়ে, একসঙ্গে হাত নেড়ে উৎসাহ দিয়ে আমাকে ডুব দিতে বললো। আবার নামলাম, আবার উঠে এলাম। ডুব দেওয়া ঠিক হবে কীনা বুঝে উঠতে পারছি না। এবার আবার সেই বৃদ্ধ সাধুবাবার অনুরোধ। যা আছে কপালে ভেবে ডুব দিয়ে দিলাম। এক ডুবেই কাত, পঞ্চ ইন্দ্রিয় বন্ধ হবার জোগাড়। চোখে যেন ঝাপসা দেখছি, কানের ভিতর লক্ষ ঝিঁঝিঁ পোকা একসাথে গলা সাধতে শুরু করে দিল। ঢোক গিললে গলা সাধা সাময়িক বন্ধ করেই, আবার শুরু হয়। পাথর ধরে মিনিট খানেক দাঁড়াতে, একটু সুস্থ বোধ করলাম। উঠে এসে গা মুছে প্যান্ট জামা পরে নিলাম। বাকীরাও একইভাবে স্নান সারল। সবার পোষাক বদল হলে, গুরুদ্বোয়ারার ভিতর গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় গ্লাসে গরম চা দিয়ে গেল। এবার বুঝছি স্নান না করলে কী ভুল করতাম। মনেই হচ্ছেনা সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে, পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতা পেরিয়ে এসে, আমরা এখন ১৫,২০০ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছি। একবারে নতুন ঊৎসাহ ফিরে পেলাম। শরীর খুব সুস্থ বোধ হচ্ছে। ওঁরা বললেন গুরু গোবিন্দ সিং-এর আশীর্বাদ।
আকাশে বেশ মেঘ করে আছে। তীরথ বললো এবার ফেরা প্রয়োজন, বৃষ্টি এলে রাস্তায় কষ্ট হবে। আরও কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে, বারবার পিছনে তাকাতে তাকাতে, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। শরীরে-মনে যেন অনেকটা জোর বেড়ে গেছে। মনে হল আজই একবার নন্দন কানন ঘুরে এলে বেশ হত। পথে আসতে আসতে দু'হাত ভরে যত পারি ব্রহ্মকমল তুলে, পলিথিন ব্যাগে ভরে নিলাম। নানা রকম ফুলও দু'চারটে করে তুলে নিলাম। এ যেন দীঘার সমুদ্রপারে ঝিনুক কুড়োনো। এগুলো নিয়ে কী হবে জানিনা, জানিনা ব্রহ্মকমলগুলো এত সব জায়গা ঘুরে বাড়ি নিয়ে আসতেও পারবো কীনা, তাও মনের আনন্দে তুলছি। ধীরে ধীরে আগেকার পথ ধরে নামতে লাগলাম। এখন সব চেনা চেনা দৃশ্য। আকাশ কিছুটা পরিস্কার হয়ে আসছে।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। ভ্রমণ কাহিনি ছাড়া গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লিখতে ভালো লাগলেও এই প্রথম কোন পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠানো।