বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন এইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য পুরোনো সাময়িক পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকার পাতায়।

 

abala bose

বাংলাদেশের প্রথমদিককার নারীবাদী হিসেবে লেডী অবলা বসু একটি পরিচিত নাম – তাঁর জন্ম ১৮৬৪ সালের ৮ আগস্ট। বাংলার মেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ১৯১৯ সালে 'নারী শিক্ষা সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অবলা। বিধবাদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে 'বিদ্যাসাগর বাণীভবন', 'মহিলা শিল্প ভবন' ও 'বাণীভবন ট্রেনিং স্কুল' নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বামী প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর তাঁর সঞ্চিত এক লক্ষ টাকা দিয়ে 'অ্যাডাল্টস প্রাইমারি এডুকেশন' নামক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। ১৯৫১ সালের ২৬ এপ্রিল অবলা বসু কলকাতায় মারা যান। আমৃত্যু তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদিকা। ২০১৪ সাল তাঁর জন্মের সার্ধ-শতবর্ষ।
তৎকালীন নামী ইংরেজি পত্রিকা 'মর্ডান রিভিউ'-এ নারীশিক্ষা-নারীস্বাধীনতা বিষয়ক তাঁর একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। পাশাপাশি বিভিন্ন বাংলা সাময়িক পত্রিকায় বেরিয়েছিল তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ কাহিনি। জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে বহুবার দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেন অবলা। তাঁর ছড়ানো ছিটানো গদ্য রচনাগুলির কিছু নিদর্শন একটিমাত্র সংকলনেই পাওয়া যায় – জগদীশচন্দ্র বসু ও লেডী বসুর প্রবন্ধাবলী নামে।
প্রথম জাপান ভ্রমণকারী বাঙালি মহিলা হরিপ্রভা তাকেদার 'বঙ্গমহিলার জাপানযাত্রা' বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। এর ঠিক পরে পরেই ১৯১৬ সালের প্রথমদিকে অবলার লেখা 'জাপান ভ্রমণ' কাহিনিটি সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাকেদা জাপান গিয়েছিলেন ১৯১২ সালে। অবলা বসু ১৯১৫ সালের মে-জুন মাস নাগাদ জাপান যান।


জাপান ভ্রমণ

অবলা বসু


এখন এসিয়া, কেবল এসিয়া কেন, সমগ্র জগতে জাপান এক মহাজাতি বলিয়া সভ্য জগতে গণ্য ও বরণীয়, কিন্তু অর্দ্ধশতাব্দী পূর্ব্বে এই জাপানের নাম কেহ শুনে নাই। কি করিয়া এই জাতি এত অল্পদিনে এত উন্নতি করিল, ইহা জানিতে উৎসুক হইয়া আমি আমেরিকার কালিফর্ণিয়ার সানফ্রানিস্কো বন্দর হইতে এক খানি জাপানী জাহাজে জাপান যাত্রা করি। আমি ইহার পূর্ব্বে অনেক ইংরাজী জাহাজে যাতায়াত করিয়াছি বটে, কিন্তু জাপানী জাহাজে সামান্য কর্ম্মচারী পর্য্যন্ত যে সৌজন্য ও ভদ্রতা দ্বারা আপ্যায়িত করেন, তাহা দেখিলে মুগ্ধ হইতে হয়। তাঁহারা যাত্রীগণের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি জাগ্রত দৃষ্টি রাখেন, অন্যান্য কোম্পানির জাহাজ অপেক্ষা অল্প ব্যয়ে কিন্তু তদপেক্ষা অধিক আরাম ও সুখে জাপানী জাহাজে যাতায়াত করা যায়। সুতরাং জাপানী জাহাজ কোম্পানী ধীরে ধীরে যে অন্যান্য প্রতিযোগী জাহাজ কোম্পানীকে পরাস্ত করিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে অদ্বিতীয় প্রভুত্ব স্থাপন করিবে, এখনই তাহার সূচনা দেখা যাইতেছে।
মধ্যে মধ্যে তার বিহীন টেলিগ্রাফ যোগে পৃথিবীর সংবাদ আমাদের জাহাজে আসিত, ভোজন সময়ে প্রত্যেকের আসনের নিকট সে সকল সংবাদের এক এক খণ্ড প্রতিলিপি প্রদত্ত হইত। আমাদের জাপান পৌঁছিবার দুই দিন পূর্ব্বে জাহাজ কোম্পানীর ডিরেক্টর একজন প্রসিদ্ধ ধনী জাপানী তারহীন টেলিগ্রাফ যোগে জাহাজের যাত্রীদিগকে তাঁহার বাটীতে নিমন্ত্রণ করিলেন। টোকিও পৌঁছিয়া প্রতি যাত্রী তাঁহার গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করিয়া তাঁহার সৌজন্য ও যত্নে আপ্যায়িত হইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, যে প্রতি সপ্তাহে তাঁহাদের জাহাজ বন্দরে আসিলেই প্রতি যাত্রী এইরূপে তাঁহার গৃহে নিমন্ত্রিত হইয়া নূতন দেশে বিদেশীয়ের আতিথ্যে মুগ্ধ হইয়া জাপানী জাহাজ ভিন্ন অন্য জাহাজে যাতায়াত করেন না।
ইয়াকোহামা বন্দরে অবতরণ মাত্র এই নূতন দেশটী আমাদের চক্ষে অতি মনোরম বোধ হইল। এ পর্য্যন্ত যত দেশ দেখিয়াছি, তাহা হইতে এই দেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। পূর্ব্বে বলিয়াছি, যে পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বে কেহ জাপানের নাম শুনে নাই, যখন আমেরিকার জাহাজ বলপূর্ব্বক তাহাদের বন্দরে প্রবেশ করে, তখন তাহাদের চক্ষু ফুটিল এবং জ্ঞান জন্মিল, যে জাপান ভিন্ন অন্য দেশ আছে এবং সে দেশের লোক শৌর্য্যবীর্য্যে কিরূপ পরাক্রান্ত। তাহা দেখিয়া তাহারা আপনাদের সর্ব্ববিধ উন্নতি সাধনে দৃঢ়সংকল্প হইল। ইয়ুরোপ ও আমেরিকা হইতে উপযুক্ত শিক্ষক আনাইয়া দেশে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিল। এতদ্ভিন্ন তাহারা শিক্ষার জন্য ইয়ুরোপ ও আমেরিকায় দলে দলে যুবকদিগকে পাঠাইতে লাগিল; তাহারা কেহ মুটে, কেহ দৈনিক শ্রমজীবী হইয়া কেহ বা পাচক ও ভৃত্য হইয়া ভদ্র গৃহে প্রবেশ করিয়া তাহাদের রীতিনীতি শিখিত, কেহ বা কারখানা ও দোকানে কাজ শিখিত। এই ক্ষুদ্রকায় জাতির নম্রতা ও বিনয়ে তুষ্ট হইয়া সকল দেশের লোকই তাহাদের ভালবাসিত। তখন কেহ স্বপ্নেও মনে করে নাই, যে এই জাতি জগতের অন্য সভ্য জাতির সহিত সমকক্ষতা করিবে বা একদিন তাহাদের শিক্ষকের স্থান অধিকার করিবে। নানা দেশ হইতে বহু লোক পূর্ব্ব দেশে অবস্থিত এই সুন্দর দেশ দেখিতে আসেন। আমাদের সঙ্গে দুই জন স্কটলণ্ডদেশীয়া নারী জাপানে যাইতেছিলেন, ইহার পূর্ব্বে একবার তাঁহারা ছয় মাস জাপানে বাস করিয়াছিলেন, কিন্তু তখন চেরী ফুল ফুটিবার সময় নয়, সুতরাং সেই ফুল দেখিবার জন্য এই দ্বিতীয়বার তাঁহারা জাপান যাইতেছিলেন, ইহাতে বুঝিতে পারিবে, যে জাপান দেখিবার ঔৎসুক্য পৃথিবীর লোকের মনে আজ কাল কিরূপ প্রবল এবং দর্শকগণের আগমনে জাপানের আয় কিরূপ বৃদ্ধি হয়। যাহা হউক, এত অল্প দিনে ইহাদের এমন উন্নতি হওয়াতে ইহাদের মনে অহঙ্কার অতিশয় প্রবল হইয়াছে এবং বাহিরে ভদ্র ও বিনয়ী হইলেও ইহাদের অন্তরে অন্তরে ধারণা, যে পৃথিবীর মধ্যে ইহারাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং ইহাদের তুলনায় জগতের অন্য সকল জাতি বর্ব্বর মাত্র।
জাপান দেশটী প্রকৃতির এক রম্য কানন। ইহার প্রতি বৃক্ষলতা, প্রতি গিরিনির্ঝর, প্রতি গৃহ সৌন্দর্য্যময়। প্রকৃতিদেবী এই দেশের উপর তাঁহার ভাণ্ডারের সমুদয় সৌন্দর্য্য রাশি অজস্র ধারায় বর্ষণ করিয়াছেন, আর জাপানীরাও প্রকৃতিদেবীর যথার্থ ভক্ত উপাসক। প্রতি সুন্দর স্থান, ইঁহারা এমন পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও সুশোভন করিয়া রাখেন, যে তথায় গেলে আর তাহা ত্যাগ করিয়া আসিতে ইচ্ছা হয় না।
বন্দরে অবতরণ করিয়াই দেখিলাম, রিকস গাড়ীগুলি শ্রেণীবদ্ধ হইয়া শোভা পাইতেছে। প্রতি গাড়ী পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ঝক্ ঝক্ করিতেছে, তাহার কোন স্থান মলিন বা ছিন্ন নহে। ভাড়াও নির্দিষ্ট, তাহার জন্য কোন গোলমাল নাই। এক এক জন জাপানী এক একটী গাড়ী টানিয়া লইতেছে, তাহাতে কোন কষ্ট নাই। সেখানে রিকস গাড়ীই অধিক প্রচলিত, যাঁহারা অত্যন্ত ধনী, তাঁহাদের দুই চারি খানি ঘোড়ার গাড়ী আছে, সম্প্রতি মোটরেরও আবির্ভাব দেখা যায়, কিন্তু তাহার সংখ্যা অতি অল্প। আমেরিকা এক বিশাল দেশ, ইহার অট্টালিকা গুলি ষোল বা কুড়ি তল, রাজপথ গুলি যেন ঘোড়দৌড়ের মাঠ, প্রান্তর গুলি অনন্ত বিস্তৃত, এই সকল দেখিয়া আসিয়া যখন এই ক্ষুদ্র দেশে খর্ব্বাকৃতি মানুষ গুলি, তাহাদের অদ্ভুত বেশ ভূষা, তাহাদের কাষ্ঠ নির্ম্মিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাড়ী, কাগজের দ্বার, জানালা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতি বস্তু দেখিলাম, তখন বড় অদ্ভুত মনে হইল। কিন্তু এই খর্ব্বকায় মানবেরা অতিশয় পরিশ্রমী ও কর্ম্মঠ।
আমেরিকান পিতা মাতা সন্তানদের আদর দিয়া নষ্ট করেন, আমেরিকা থাকিতে আমার এই ধারণা হইয়াছিল, কিন্তু জাপানের সন্তান পালন প্রণালী আরও বিস্ময়কর। জাপানে ষোড়শ বৎসর পর্য্যন্ত সন্তান দিগকে কোন প্রকার শাসন করা হয় না, তাহারা যাহা ইচ্ছা, তাহাই করে। মাতা কখনও সন্তানের গায়ে হাত তুলেন না। জাপান শিশুদেরই দেশ, শিশুদের এত আদর যত্ন আর কোথাও এমন দেখি নাই, রেলের গাড়ী বা সভা সমিতিতে দেখিয়াছি, বালক বালিকাদের বসিতে দিয়া স্থানাভাব হইলে বয়োজ্যেষ্ঠেরা দাঁড়াইয়া থাকেন, আমাদের চক্ষে ইহা অতিশয় বিসদৃশ বোধ হইত। আশ্চর্য্যের বিষয় এই, জাপানে সামাজিক শিষ্টাচারের নিয়ম অতিশয় কঠোর, জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইয়াছিলাম, যে ষোড়শ বৎসর বয়সে যখন সন্তানদিগকে সামাজিক সমুদয় নিয়মের সম্পূর্ণ অধীন হইতে হয়, তখন তাহাদিগকে তাহা শিক্ষা দিতে পিতা মাতাকে বিব্রত হইতে হয় না। তখন তাহারা বিনীত, বাধ্য ও পিতা ও মাতার সম্পূর্ণ অধীন হইয়া পড়ে; বিদ্যা, জ্ঞান ও কার্য্য সুচারুরূপে শিখিয়া দেশের ভক্ত সন্তান হইয়া জীবনের সকল কর্ত্তব্য পালন করে। সমগ্র দেশব্যাপী দুইটী উৎসব ইহাদের অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, একটী বালক ও অপরটী বালিকাদের উৎসব। গৃহে সন্তান জন্মগ্রহণ মাত্র এই উৎসবের সূত্রপাত হয়। বালকদিগের জন্য পুরুষগণের পুত্তলিকা ও বালিকাদের জন্য আদর্শ নারীদের পুত্তলিকা সকল প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎসবের দিনে প্রতি গৃহ হইতে বাদ্যধ্বনি করিতে করিতে পুত্তলিকা গুলি রাজপথে বহির্গত হয় এবং বালক বালিকার প্রিয় নানা মিষ্টান্ন দ্রব্য প্রস্তুত হয়। বালকদিগের উৎসব যে মাসে হয়, সেই মাসের প্রথম হইতে যে বাড়ীতে যত পুত্র সন্তান আছে, ততগুলি রোহিত মৎস্যের প্রতিকৃতি বাঁশের উপর ঝুলিতে থাকে। জাপানীদের সংস্কার এই, রোহিত মৎস্য অতি বুদ্ধিমান ও তেজস্বী, তাহারা ঝরণার উপরেও গিয়া উঠিতে পারে, তাহারা আশা করে, পুত্রেরাও রোহিত মৎস্যের তুল্য তেজস্বী ও বুদ্ধিমান হইবে এবং বালকদের মনে এই ভাব মুদ্রিত করিবার জন্য কাগজে রোহিত মৎস্যের প্রতিকৃতি নির্ম্মাণ করিয়া অঙ্গনে বাঁশের উপর ঝুলাইয়া দেয়, কাগজের মাছগুলি যখন বায়ুভরে উড়িতে থাকে সে এক দৃশ্য। ইয়ুরোপীয় প্রথার অনুরূপ না হইলেও জাপানে নারীগণের স্বাধীনতা আছে, তাঁহারা প্রকাশ্য রাজপথ দিয়া অবাধে যাতায়াত করেন, তাহাতে লজ্জা নাই। চাকরাণী না থাকিলে সন্তান গুলি লইয়া বাহিরে বেড়াইয়া আনা গৃহিণীরই কর্ত্তব্য। কিন্তু গৃহে সকল পুরুষের সঙ্গে ইঁহারা মিশেন না, গৃহস্বামীর বন্ধুগণ তাঁহার নিকটে আসেন, গৃহিণীর বন্ধুরা গৃহিণীর নিকট আসেন, কিন্তু বাটীর বাহির হইবার সময় স্ত্রীলোক ও পুরুষেরা একত্র বাহির হইয়া থাকেন। স্ত্রীলোকের অবরোধ প্রথা না থাকাতে সেখানে সকলের শরীর হৃষ্টপুষ্ট ও সবল। রেল গাড়ী ও ট্রামে নারী ও পুরুষ অসঙ্কোচে যাতায়াত করিতেছে, দেখা যায়। জাপানীরা সৌন্দর্য্যের উপাসক। সাধারণ উদ্যান বা বিশেষ বিশেষ নগরে বিশেষ বিশেষ ফুল ফুটিবার সময় সহস্র সহস্র নর নারী পুত্র কন্যা লইয়া সেই শোভা দেখিতে আগমন করে। তখন সেই সাধারণ উদ্যান লোকে লোকারণ্য হয় এবং বালক বালিকাদিগের প্রফুল্ল মুখশ্রী ও পরিচ্ছদের শোভায় সেস্থান আরও রমণীয় হইয়া উঠে। জাপানী নারী শিক্ষিতা, পরিশ্রমকুশলা ও গৃহকার্য্যে নিপুণা। তাহাদের বসন ভূষণের আড়ম্বর নাই। রাজ পরিবারস্থ মহিলা বা অতিশয় ধনবানের গৃহের নারীগণ ব্রোচ বা শিরোভূষণ ধারণ করেন বটে, কিন্তু তাহা রাজকীয় উৎসব ব্যাপারে, সাধারণ সময়ে নহে। আমি প্রিন্স আখ্যাধারী এক ধনী পরিবারে চা পান করিতে নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম; তাঁহার পত্নীর মণিবন্ধ, কন্ঠ, কি শরীরের অপর কোন স্থানে কোন অলঙ্কার দেখিলাম না। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারের নারীগণেরও সেইরূপ, তাঁহাদের পরিচ্ছদ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সংযত ও সর্ব্বপ্রকার বাহুল্য বর্জ্জিত। কাহাকেও অলঙ্কার ধারণ করিতে দেখি নাই। আমার চক্ষে জাপানী পুরুষ বা নারী কাহাকেও সুন্দর মনে হয় নাই। তাহাদের শরীরের কোথাও অলঙ্কার ব্যবহার করিতে দেখি নাই। তাহাদের বর্ণ গৌর; কিন্তু কোটরগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চক্ষু এবং গণ্ডস্থল উচ্চ। জাপানী পুরুষ ও নারীর পরিচ্ছদে বড় পার্থক্য নাই, স্ত্রীলোকেরা পৃষ্ঠদেশে রেশমী ফিতায় নির্ম্মিত একটী জিনিস পরিধান করেন, তাহাতে এই খর্ব্বাকৃতি নারীদের আরও খর্ব্ব দেখায়। এই বস্তুটীর মূল্য ৫ হইতে ৫০ টাকা পর্য্যন্ত হইতে পারে, ইহাই জাপানে ধনী ও দরিদ্রের বিভিন্নতা প্রকাশ করে। জাপান এমন সুন্দর দেশ, তাহার অধিবাসীরা প্রতি কার্য্যে তাহাদের সৌন্দর্য্য জ্ঞান ও মার্জ্জিত রুচির এমন সুন্দর পরিচয় দেয়, কিন্তু তাহাদের পরিচ্ছদে সে উন্নত রুচির কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।
জাপানীদের গৃহস্থালী অতি সুন্দর; কাঠের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘর, জানালা ও দ্বার কাগজের, ঘরের মেজে মাদুরে আবৃত, মাদুর প্রায় এক হাত পুরু, তাহার উপর তাহারা পুরু আসন বা প্রশস্ত চতুষ্কোণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গদির উপর জানু পাতিয়া বসে। বিছানা, কাপড় চোপড় গুছাইয়া দিনে দেওয়ালের মধ্যের দেরাজে রাখে, রাত্রিতে দেরাজ হইতে বাহির করিয়া মেজেতে বিছানা পাতিয়া শয়ন করে। আমাদের মত তাহাদের গৃহে আবশ্যক, অনাবশ্যক গৃহসজ্জার প্রাচূর্য্য নাই। এই জাতি যেমন পরিষ্কার, তেমন শৃঙ্খলাপ্রিয়; গৃহসজ্জা বাসন প্রভৃতির বাহুল্য নাই বটে, কিন্তু যে কয়টী আছে, তাহা সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন, প্রতি গৃহস্থের বাটীতে কূপ আছে এবং জল তুলিবার জন্য পাম্প আছে, তাহা বাঁশ ও কাষ্ঠ নির্ম্মিত; বাঁশের নল দিয়া স্নান ও রন্ধনগৃহে জল যায়। ইহাদের রন্ধন প্রণালী অতি সহজ, সমুদয়ই প্রায় সিদ্ধ করা, তাহা চাটনী দিয়া খায়। জাপানিরা ভাত বেশী খায়, মাছ ত কাঁচাই অধিক খায়। তাহাদের মিষ্টান্ন দ্রব্যের প্রধান উপকরণ চাউলের গুঁড়া, এই গুলি অতিশয় উপাদেয়। আমরা হাত দিয়া ভাত খাই, কিন্তু জাপানীরা তাহা অতিশয় ঘৃণা করে, তাহারা দুইটী কাঠি দিয়া খায়। তাহারা আপামর সাধারণ সকলে জুতা ও মোজা ব্যবহার করে এবং দেশ দরিদ্র বলিয়া জুতার পরিবর্ত্তে খড়মও পরিয়া থাকে। জুতা দ্বারে রাখিয়া ঘরে প্রবেশ করিবার নিয়ম, বিদেশীয়গণ যাঁহারা বাঁধাজুতা পরেন, তাহাদের জুতার উপর কাপড়ের জুতা পরাইয়া তাঁহাদের গৃহ মধ্যে লওয়া হয়।
জাপানে প্রতি বালক বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করিতে আইন অনুসারে বাধ্য। তাহার জন্য সেখানে প্রত্যেকে লিখিতে ও পড়িতে পারে। প্রতি পল্লীতে স্কুল আছে, বেতন অতি অল্প ৷৹ ৷৶৹ কি ৷৷৹ । তাহাদের শিক্ষাদান প্রণালী অতি সুন্দর এবং দিন দিন তাহা উন্নতি লাভ করিতেছে। বালক বিদ্যালয়ে বালকেরা প্রতি মাসে একবার কি তিন মাস অন্তর একবার পিঠে বোঁচকা বাঁধিয়া শিক্ষকের সঙ্গে দেশভ্রমণে বাহির হয়। তাহাতে তাহারা দেশের কোথায় কি আছে, জানিতে পারে। পুস্তকে পঠিত ব্যাপার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এবং দেশের কোন কীর্ত্তি বা জাতীয় গৌরবজনক অনুষ্ঠান দেখিয়া জাতীয় গৌরবে তাহাদের মন উদ্দীপ্ত হয় ও সেরূপ কার্য্য করিতে তাহাদেরও মনে প্রবল আকাঙ্খা জন্মে, সুতরাং এরূপ শিক্ষার মূল্য অনেক। বালিকা বিদ্যালয়ে লিখিতে পড়িতে শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে নারীর দৈনন্দিন জীবনের করণীয় সমুদয় কাজ শিক্ষা দেওয়া হয়। রন্ধন, বস্ত্র পরিষ্কার, হিসাব রক্ষা, সামাজিক সৌজন্য প্রকাশের সমুদয় রীতিনীতি, ফুল সাজাইবার প্রণালী, চা পানে নিমন্ত্রণ করিবার সমুদয় নিয়ম শিক্ষা দেওয়া হয়।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি, জাপান বিগত পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে আপনাদের জাতীয় জীবনের সর্ব্ব বিভাগে দ্রুত উন্নতি করিয়াছে। জাপান তাহার রণতরীর সাহায্যে ইংলণ্ডের বাণিজ্য রক্ষা করিতেছে। ইংরাজ জাপানের সহায়তা পাইয়াই প্রশান্ত মহাসাগরে নিরাপদে যাতায়াত করিতেছে। ইংরাজ বিপুল রণতরীর প্রভাবে সমুদ্রে যাতায়াত একচেটিয়া করিয়া জার্ম্মাণ জাহাজ সকল Kiel canal-এ বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে। জাপানের সাহায্যেই ইংরাজ প্রশান্ত মহাসাগরের উপনিবেশ সকল রক্ষা করিতে পারিয়াছে, ইহা জাপানের সামান্য গৌরবের কথা নহে। শিক্ষাপ্রণালীর গুণেই জাপান অল্প দিনে এমন উন্নতি করিতে পারিয়াছে। স্বদেশের প্রতি প্রেম ইহাদের অস্থি মাংস মজ্জাগত হইয়া গিয়াছে। তাহারা দেশের জন্য প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে সর্ব্বদা প্রস্তুত। দরিদ্র দেশ হইলেও তাহাদের অধিক পরিমাণে রাজস্ব দিতে হয়, কিন্তু তাহা তাহারা আনন্দে দেয়। এই অনুপম স্বদেশপ্রীতি সমুদয় জাতিকে একতা বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগার, শান্তিনিকেতন

[ অভ্রতে কিছু কিছু বাংলা বানান টাইপের অসুবিধাটুকু বাদ দিলে মূল বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher