বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন এইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য পুরোনো সাময়িক পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকার পাতায়।

 

abala bose

১৮৬৪ সালে বহরমপুরের কাজলাগ্রামে (অন্যমতে নদীয়ার চুয়াডাঙ্গায়) কৃষ্ণভাবিনীর জন্ম হয়। দশ বছর বয়সে কলকাতা , হাইকোর্টের উকিল শ্রীনাথ দাসের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ দাসের সঙ্গে বিবাহ। দেবেন্দ্রনাথ নিজে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং নিজের আদর্শ ও শিক্ষায় স্ত্রীকে গড়ে তোলেন। দেবেন্দ্রনাথ যখন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য প্রথমবার বিলেত যান তখনই কৃষ্ণভাবিনী দুই সন্তানের মা। দেবেন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরে আসার আগেই তাঁদের প্রথম সন্তানের মৃত্যু হয়। দেবেন্দ্রনাথ যখন দেশে ফেরেন তখন তাঁদের কন্যা তিলোত্তমার বয়স পাঁচ। বিলেত ফেরত ছেলেকে ত্যজ্যপুত্র করেন শ্রীনাথ। দেবেন্দ্রনাথও আবার পাড়ি দেন বিলেত। এবারে সঙ্গী স্ত্রী কৃষ্ণভাবিনী। কিন্তু শ্রীনাথের আপত্তিতে কন্যা তিলোত্তমা রয়ে যায় ঠাকুরদাদার কাছেই। মাত্র দশ বছর বয়সে তার বাবা-মায়ের অমতেই তিলোত্তমার বিয়ে দিয়ে দেন শ্রীনাথ। এই বিবাহ সুখের হয়নি। আট বছর বিলেতে থাকার পর ফিরে এসেও আর মেয়ের সঙ্গে মায়ের নতুন করে কোন যোগসূত্র তৈরি হয়নি। ১৯০৯ সালে কৃষ্ণভাবিনী পরপর স্বামী ও কন্যাকে হারান। এরপর যে দশ বছর কৃষ্ণভাবিনী বেঁচেছিলেন, জনসেবা, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, বিধবাশ্রম ও পতিতাশ্রম নির্মাণে কেটেছিল।
ইংলন্ডে থাকাকালীনই কৃষ্ণভাবিনী তাঁর একমাত্র গ্রন্থ 'ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা'-র পান্ডুলিপি প্রকাশের জন্য কলকাতায় পাঠান এবং তা ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটিই বাংলাসাহিত্যে মহিলার লেখা প্রথম ভ্রমণগ্রন্থ এবং প্রথম বিদেশ ভ্রমণ কাহিনি। দেশে ফিরে দীর্ঘকাল বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায় কৃষ্ণভাবিনী সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবন্ধের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও লিখেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি রচনায় ইংলণ্ড ভ্রমণের স্মৃতি ফিরে এসেছে। তেমনই একটি লেখা 'বিলাতের গল্প'। কিন্তু আর কখনও অন্য কোথাও বেড়াতে গিয়ে নতুন ভ্রমণ কাহিনি লেখেননি। ১৯১৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ২০১৪ সাল তাঁর জন্মের সার্ধ শতবর্ষ।


বিলাতের গল্প

কৃষ্ণভাবিনী দাস


আমাদের দেশের যেমন কলিকাতা, বিলাতের সেই রকম রাজধানী লণ্ডন। লণ্ডনের মত প্রকাণ্ড নগর পৃথিবীর আর কোন দেশে নাই। উহা কলিকাতার চারগুণ বড়, আর সেখানকার লোক সংখ্যা কলিকাতার আট গুণ। আমাদের দেশে অনেক পাড়াগেঁয়ে লোক প্রথম প্রথম সহরে এসে – "ও বাবা! রাস্তায় এত ভিড়" – বলিয়া চমকিয়া যান; কিন্তু তাঁহারা এক বার বিলাতের রাজধানীতে গেলে এক পা চলিতেও থমকাবেন – সেখানে এমনি লোকের ঠেলাঠেলি!
আবার লণ্ডন এত বড় ও লোকপূর্ণ হলেও এখনও উহার শেষ নাই। আমাদের যেমন ভবানীপুর, শ্যামবাজার প্রভৃতি সবার্বের যোগে কলিকাতা ক্রমে বাড়িতেছে, লণ্ডনও ঐরকম চারিদিকের ছোট ছোট পল্লীতে মিশিয়া দিন দিন আরও প্রকাণ্ড হইয়া পড়িতেছে। পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে উহার চারি পাশে যে সকল মাঠ ছিল, এখন সেখানে ঘাসের পরিবর্ত্তে অসংখ্য বাড়ী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, দেখে বিশ্বাস হয় না, যে কয়েক বৎসর আগে সে স্থান একেবারে পাড়া গাঁ ছিল।
বাহির হইতে দেখিতে বিলাতের রাজধানীটী বড় সুন্দর নয়। উহাতে আমাদের সহরের মত ধপধপে চুণকাম করা বড় বড় বাড়ী নাই, আর তাহাতে সবুজ খড়খড়ের বাহারও নাই। যেখানে যাও দেখিবে রাস্তার দুই পার্শ্বে কেবল এক রকম ধোঁয়াটে রঙের কাল কাল বাড়ী, সার বেঁধে দাঁড়াইয়া আছে। আমাদের দেশের মত বাড়ী গুলির মধ্যে খোলা জায়গা বা কিছুমাত্র ফাঁক নাই। আবার সব রাস্তার দুই পার্শ্বে যেমন সার গাঁথা বাড়ী, অনেক রাস্তার দুই পার্শ্বে তেমনি কেবল দোকান – এমন বাড়ী ও দোকানের মালা এ দেশে নাই। বোধ হয়, কলিকাতায় সবশুদ্ধ যত বাড়ী আছে, লণ্ডনে শুধু দোকানের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশী। রাত্রিতে দোকানের শোভা দেখিতে বড় চমৎকার হয়; সে দেশে অতি সুন্দর ও পরিপাটী রূপে দোকান সাজায়, আর গ্যাস বা ইলেকট্রিক আলোতে ভিতরের সব জিনিস ঝক্ ঝক্ করিতে থাকে।
লণ্ডন অতি প্রকাণ্ড সহর বলিয়া ডাকিবার সুবিধার জন্য উহাকে উত্তর, পূর্ব্ব, পশ্চিম, মধ্য প্রভৃতি আট ভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে। ঐ নগরে তোমাদের কোন বন্ধুকে চিঠি লিখতে হলে বাড়ীর নম্বর ও রাস্তার নাম ছাড়া কোন্ ভাগে সে রাস্তা আছে, তাহাও লিখে দিতে হয়। লণ্ডনের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগে অধিকাংশ বড় মানুষেরা থাকে – ঐ ভাগের রাস্তা গুলি অন্যান্য ভাগের চেয়ে ভাল বাঁধান ও অতি পরিষ্কার, আর দোকান সকলও অধিক দামী জিনিসে সাজান। মহারাণী ও যুবরাজের প্রাসাদ এই ভাগে আছে।
পূর্ব্ব-মধ্য ও পশ্চিম-মধ্য ভাগে যত কাজের স্থান; পশ্চিম-মধ্য ভাগে অনেক স্কুল, কলেজ, থিয়েটার ও বড় বড় আপিস আছে, আর দোকানেরও ত ছড়াছড়ি। পূর্ব্ব-মধ্য ভাগকে 'সিটি' বলে। ঐ স্থানটী দেখিলে কলিকাতার বড়বাজারের কথা মনে পড়ে। অবশ্য, আমাদের বড়বাজারের মত উহা অত অপরিষ্কার নয়। যত ব্যঙ্ক, বড় বড় কারখানা ও আড়তে 'সিটী' পূর্ণ; প্রতি বাড়ীতেই অনেক দোকান বা আফিস আছে; আর এক একটী বাড়ী সাত আট তালা উঁচু – কাজেই বুঝিতেছ জায়গার কি টানাটানি। ঐ ভাগে অনেক ছোট ছোট গলি ও সরু রাস্তা আছে। আর দু পাশের বাড়ী গুলি প্রকাণ্ড বটে কিন্তু এত কাল যে, মনে হয়, কেউ উহাদের গায়ে পাঁক লেপে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নয়। বিলাত শীতের দেশ বলিয়া প্রায় বার মাসই সব লোকের বাড়ীতে, ঘরে, দেয়ালের গায়ে কয়লার আগুন জ্বলে, - বিশেষ লণ্ডনে অনেক বড় বড় কারখানা আছে বলিয়া প্রত্যহ যত ধোঁয়ানল (চিমনী) থেকে রাশি রাশি ধোঁয়া বাহির হয়, শীতকালে সেই সব ধোঁয়া উপরে উঠিতে পারে না, বাড়ীর গায়ে ও গাছ পালায় লাগিয়া সব কাল করিয়া দেয় – এই কারণেই বাহির থেকে দেখিতে লণ্ডন এত কাল।
আমাদের দেশে দুর্গা পূজার ভাসানের দিন রাস্তায় যেমন লোকের ও গাড়ীর ভিড় হয়, সে বড় বড় রাস্তায় রোজই সেই রকম ভিড় হয়ে থাকে। রাস্তায় এত লোক ও গাড়ী ঘোড়ার ঠেলা ঠেলি যে খুব সাবধানে চলিতে হয়, ও অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকিতে হয়।
কলিকাতার ইডন গার্ডেনের মত লণ্ডনে অনেক গুলি সুন্দর বেড়াইবার স্থান আছে; উহাদের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়টীর নাম রিজেন্টস্ পার্ক; উহা লণ্ডনের উত্তর পশ্চিম ভাগে স্থিত ও বেড়ে প্রায় দেড় ক্রোশ। শীতকালে ঐ খানে বেড়াতে তত আমোদ নাই; সব গাছ পাতা-শূন্য, কোন রকমের ফল ফুল নাই। জমিতে কেবল শুকনা ঘাস – দূর থেকে দেখিলে যেন গা শিউরে উঠে। কিন্তু একবার যদি তোমরা ভিতরে যাও তাহা হলে আর বাহিরে আসিতে চাহিবে না। মাঠের উপর কত ছেলেমেয়ে দড়ি ডিঙ্গিয়ে লাফাচ্ছে ও ব্যাট বল খেলা করছে। ঝিলের জলে রাজহাঁস, পাতি হাঁস, পেরু প্রভৃতি নানা রকম জলচর জন্তু সাঁতরে বেড়াচ্ছে, আর ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মা বাপ বা ঝিয়ের সঙ্গে এক এক ব্যাগ পুরিয়া রূটি এনে ঐ হাঁস প্রভৃতিকে খেতে দিচ্ছে।
পার্কের ভিতর কোন স্থানে বা জল একটু জমিয়া গিয়াছে আর বড় বড় ছেলেরা তার উপর হড় হড় করে পা সড়কিয়া 'স্লাইড' করছে, ঐ রকম খেলিতে খেলিতে কেউ বা পা পিছলিয়া পড়িয়া গেল, আর তার চারিদিকের লোক হো হো করে হেসে উঠল। তার কিন্তু হাসা বা লাগার প্রতি ভ্রূক্ষেপ নাই, সে আবার উঠিয়া স্লাইড করিতে লাগিল। এই সবে নবেম্বর মাস এখনও পার্কের বড় বড় ঝিল জমিয়া যায় নাই, নহিলে পোষ মাঘ মাসে বরফের উপর ছেলেদের স্কেটিংএয়ের ধূম দেখে কে? এই সব নানা রকম ক্রীড়া ও আমোদ দেখে মন এমন ভুলিয়া যায় যে, শীতে হাত পা কাঁপিলেও ঐ বাগান ছাড়িয়া বাড়ী ফিরিতে ইচ্ছা করে না।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা

[ অভ্রতে কিছু কিছু বাংলা বানান টাইপের অসুবিধাটুকু বাদ দিলে মূল বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক ]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher