আমার মায়ের বাপের বাড়ির দেশে

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়


মায়ের বাপের বাড়ি অর্থাৎ মামার বাড়ির প্রতি আকর্ষণ কার না নেই? আর সেখানে মামা-মামী, দাদু-দিদা সবাই থাকলে তো ব্যাপারটাই আলাদা। তার সঙ্গে উপরি যদি পুকুরের মাছ, বাগানের গাছের আম-কাঁঠাল, আর ক্ষীর-ছানা-চাঁচি-সন্দেশ এসবও থাকে তাহলে আর কথাই নেই! আমার পরম সৌভাগ্য যে এমন একটা জায়গাতেই আমার মামার বাড়ি। এরপরেও বাড়তি পাওনা বাড়ির কালীপুজোয় সবাই মিলে হইচই। আর হাতের কাছেই চমৎকার সব বেড়ানোর জায়গা।
আমার মামার বাড়ির দেশ বর্ধমান জেলার উত্তর-পূর্বে কাটোয়ার কাছে - দাঁইহাট রেলস্টেশনের পাশের গ্রামে, নাম নলহাটি। গঙ্গার তীরবর্তী হওয়ার সুবাদে মাটি খুব ঊর্বরা - গাছগাছালির অন্ত নেই। সারাটা গ্রাম জুড়ে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অগুনতি নারকেল আর তাল গাছ। রয়েছে বড় ছোট পুকুর। মনে পড়ে ছেলেবেলায় কালীপুজোর সময় খুব সকালে জেলেরা বাড়ি বাড়ি এসে ডেকে বলে যেত পুকুরে মাছ ধরা হয়েছে - মাছের ভাগ নেবার জন্য পুকুর পাড়ে যেতে হত। বালতি ভর্তি মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আজ আর সেদিন নেই। গ্রামের প্রায় সব পুকুরই মাছ-চাষের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। পুজোর সময় আর মাছ ধরা হয় না। বাজার থেকে মাছ কিনে আনতে হয় প্রয়োজনে।
মামার বাড়িতে গত পঞ্চাশ বছরে আর কেউ থাকে না। আমার দিদিমা, যাঁকে আমরা সকলে বড়মা বলে ডাকতাম, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন সেই ষাটের দশকের প্রথম দিকে। সেই থেকে বাড়িতে তালা - রাত্রে মাইনে করা লোক এসে বাড়িতে শোয়। দাদা মশায় ছিলেন কবিরাজ। মায়ের কাছে শুনেছি তিনি আয়ুর্বেদ পড়তে গিয়েছিলেন কাশীতে। পসার বেশ ভালোই ছিল। ঘোড়ায় বা পাল্কিতে চড়ে আশেপাশের গ্রামে চিকিৎসা করতে যেতেন। সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন। বাড়ির বৈঠকখানাটাই ছিল রোগী দেখার ঘর - বই আর পুঁথিতে ঠাসা। আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ছোট বেলায় দেখেছি কবিরাজি ওষুধ তৈরির জন্য বড় ছোট নানা মাপের পাথরের খল নুড়ি, হাতির দাঁতের ছোট ছোট চামচ, ওজন করার তুলা দণ্ড ইত্যাদি নানান সব জিনিস। সেসব দেখে দাদামশায় মানুষটা কেমন ছিলেন মনে মনে একটা ধারণা করার চেষ্টা করতাম।
দাদামশাই কাশীতে যখন পড়তে যান, আমার ধারণা সেটা ঊনবিংশ শতকের শেষের দিক। ভাবতে অবাক লাগে সেই যুগে এমন একটা গণ্ডগ্রাম থেকে কিভাবে সাহস করে অত দূরে পড়তে গিয়েছিলেন। আজকের মত তখন পাকা রাস্তা ছিল না। তবে গ্রামের পাশ দিয়েই রয়েছে রেলপথ, সোজা চলে গেছে হাওড়া। আমার সঠিকভাবে জানা নেই ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগে এই অঞ্চলে রেলপথ বসেছিল কী না। তবে দাঁইহাট শহর এবং পৌরসভা দুই-ই অতি প্রাচীন।
নলহাটির পাশেই জগদানন্দপুর। সেখানে রয়েছে প্রাচীন মন্দির - প্রতিষ্ঠা ১২৪৮ সালের বৈশাখে। প্রবেশ পথের দরজার ওপরে খোদাই করা আছে। তবে মন্দিরের সেবাইতেরা দাবি করেন মন্দিরটি আরও প্রাচীন। দাঁইহাটের বাগটিকরা অঞ্চলে আরও একটি পোড়া মাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। ফলকটি অদৃশ্য হওয়ায় প্রতিষ্ঠাকাল আর সঠিক জানা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল ষোড়শ শতকে।
মামার বাড়ির কালীপুজোর উল্লেখ করেছি একেবারে শুরুতেই। প্রাচীন এই পুজোটি কবে শুরু হয়েছিল তার হদিস পাইনি। গত শতকের একেবারে প্রথমে মেটিয়ারি নিবাসী নিবারণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'কাটোয়ার ইতিহাস' গ্রন্থে কালীপুজো (৺বড় ঠাকুরানীমাতার পুজা) এবং আমার দাদামশায় ৺চন্দ্রভূষণ ভট্টাচার্য্যের উল্লেখ রয়েছে। বইটির কথা জানতে পারি কাটোয়া কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কালীচরণ দাসের কাছে – চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
গ্রামটি উত্তর-দক্ষিণে ছড়ানো - উত্তরদিকে রেললাইন - ব্যান্ডেল-কাটোয়া রেলপথের অংশ। তিনদিকে পাকা রাস্তা রয়েছে। পশ্চিমদিকের পথ চলে গেছে মালডাঙ্গা এবং দক্ষিণের পথের একদিকে কাটোয়া অপরদিকে কালনা অর্থাৎ কালনা-কাটোয়া স্টেট হাইওয়ে। দাঁইহাটের পরের স্টেশন কাটোয়া – ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন শহর। শ্রী চৈতন্যদেব এখানে এসেছিলেন। কাটোয়া শহরের উত্তরে অজয় নদ গঙ্গা (ভাগিরথী) নদীতে মিশেছে। এই সংগমের উত্তরে অবস্থিত উদ্ধারণপুর – শ্মশান এবং সাধন ক্ষেত্র হিসাবে বিখ্যাত।
মামার বাড়ি এসে কয়েকটা দিন কাটানোর পরই মনটা আনচান করে, কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসতে ইচ্ছে হয়। সুযোগ পেলেই গায়ে পাঞ্জাবীটা চড়িয়ে ঝোলায় একটু মুড়ি, জল আর ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আশেপাশেই অনেককিছু দেখার আছে। আর একটু সময় নিয়ে বেরোলে তো কাছেপিঠে অনেক জায়গাই রয়েছে। ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের সুবিধার জন্য কাটোয়া রেলস্টেশনে আশপাশের দ্রষ্টব্য স্থানের মানচিত্রসহ একটা তালিকা রেখেছেন। ওই তালিকাভুক্ত কয়েকটি জায়গা হল – লাভপুর (সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান), ফুল্লরা (শক্তিপীঠ), নানুর (বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাসের জন্মস্থান), অট্টহাস (দেবীপীঠ), সোনারন্দি (একটি রাজবাড়ি আছে), কেতুগ্রাম (দেবী বহুলার মন্দির), শ্রীপাট শ্রীখন্ড (পাটবাড়ি – নরহরি সরকারের জন্মস্থান), কাগ্রাম ( কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের এবং চৈতন্যমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা কবি লোচন দাসের জন্মস্থান), ক্ষীরগ্রাম (দেবী যোগদ্যার মন্দির), মুশুরী, ছোট এবং বড় পোষলা (দেবী ঝংকেশ্বরী। গ্রামের লোকেরা বিষধর সাপকে দেবীজ্ঞানে পূজা করে), মাধাইতলা, কাটোয়া ( শ্রীচৈতন্য শিষ্য মাধাইয়ের সমাধি), গৌরাঙ্গবাড়ি, কাটোয়া (শ্রীচৈতন্যদেব এখানে তাঁর গুরু কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করেন), সাঁখাই ঘাট ( ভাগিরথী এবং অজয়ের সংগমস্থল), যাজিগ্রাম ( শ্রীনিবাস আচার্য্যের জন্মস্থান)।

শৈশব থেকেই কালীপুজোর সময়টা মামাবাড়িতেই কাটে। পুজো উপলক্ষে কাটোয়ার উত্তরের গ্রাম থেকে ঢাকীরা আসে। এই ঢাকের আওয়াজ বড়ই মধুর। শহরাঞ্চলে ঢাকে চামড়ার বদলে সিনথেটিক পর্দার ব্যবহার হচ্ছে, তাই ঢাকের গমগম আওয়াজের পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। পুজোর আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকীরা চলে আসে। ঠিক সন্ধ্যার পরপরই মন্দিরের সামনে চত্ত্বরে সকলে জমায়েত হয়ে ঢাক বাজাতে শুরু করে। সেই আওয়াজ আমার মত পরিণত বয়স্ককে আজও চঞ্চল করে তোলে। ঠাকুরের রঙ করা শুরু হয় এই সময়েই। এ দৃশ্য দেখার জন্যই তো ছুটে যাওয়া।
গ্রামের উত্তরদিকে জগদানন্দপুর। এখানে রয়েছে প্রায় ৮২ ফুট উঁচু পাথরের রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। এটি পঞ্চরত্ন মন্দির - প্রাচীর ঘেরা। উৎকৃষ্ট প্রস্তর শিল্পের নিদর্শন হওয়া সত্ত্বেও মন্দির সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের ঔদাসীন্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অধ্যাপক কালীচরণ দাস মহাশয় তাঁর বই "শুধু দুই পা ফেলিয়া"-তে এই মন্দিরটির বিশদ বিবরণ এবং ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। বাগটিকরা অঞ্চলের যে মন্দিরটির কথা আগে বলেছি সেটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেরাকোটা মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। অথচ খুব কম মানুষই এর খোঁজ রাখেন। মন্দিরটি দাঁইহাটের বিখ্যাত চন্দ্র পরিবারের প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দিরটি সম্বন্ধে অধ্যাপক দাস লিখেছেন, "বাগটিকরা টেরাকোটার মূর্তিগুলির সিংহভাগ অ-প্রাকৃত। মানুষ, দেব-দেবী কিম্বা পশুর পেশীগঠনে অসাধারণ নৈপুণ্য। খাজুরাহোর ভাবানুকরণে রয়েছে প্রাক্-মৈথুন দৃশ্য। রয়েছে বিত্তবানের নারী সম্ভোগ। দুর্গা কিংবা কালীর মূর্তি-গঠনে অদৃষ্টপূর্ব শিল্পবোধ কিন্তু মহাদেবের মূর্তি সাদা-মাটা, মুখমন্ডলে কোন লালিত্যের ছোঁয়া নেই। সব মিলিয়ে বাগটিকরায় এক দুর্লভ শিল্পের সমাবেশ। ..."

শুধুমাত্র একটি কালীমূর্তির কথাই বলব। এই বর্ণনা থেকেই বোঝা যাবে মন্দির গাত্রে টেরাকোটার মূর্তিগুলি কী অনন্যসাধারণ। অন্যত্র কোথাও এই মূর্তি আমার চোখে পড়েনি। এই কালীমূর্তির মুখমণ্ডল পশুর মত। দেবী এখানে চতুর্ভূজা। এক হাতে খড়্গ, অন্য হাতে ছিন্ন নরমুণ্ড। কোমরে ছিন্ন হস্তের মালা, গলায় ছিন্ন মুণ্ডের মালা। জিহ্বা সর্পের ন্যায়। পায়ের কাছে মহাদেবের বদলে মনুষ্য লিঙ্গ। এই জাতীয় কালীমূর্তি কল্পনা সত্যিই বিরল। বাগটিকরার মন্দির ছাড়া ভাউসিং অঞ্চলে আরও একটি পোড়া মাটির মন্দির রয়েছে। মন্দির গাত্র অলংকরণে কৃষ্ণলীলা, রামলীলার সঙ্গে রয়েছে দেবদেবীর মূর্তি। তবে ভাউসিং মন্দিরটি বাগটিকরার মন্দিরের তুলনায় নবীন।
দাঁইহাটের মন্দির দুটি সম্বন্ধে আলোচনায় অধ্যাপক দাস বর্ধমানরাজদের সমাজবাড়ি সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। লিখেছেন - "দাঁইহাট পৌরসভার অধীনে টেরাকোটা সজ্জিত দুটি শিব মন্দির আছে। এই শহরের মধ্যে স্টেশনের কাছে বাগটিকরা অঞ্চলে, অন্যটি সরে যাওয়া গঙ্গার তীরে ভাওসিং-য়ে (জে.এল নং ৯১, প্লট নং ২৬১)। গঙ্গা এখন অনেক দূরে সরে গেছে। কয়েক-শো গজ উত্তরে ওই পরিত্যক্ত গঙ্গা-তীরে বর্ধমানের রাজা আবু রায় থেকে কীর্তিচাঁদ (মৃত্যু ১৭৪০ খৃষ্টাব্দ) পর্যন্ত সকলের ভস্ম সমাধি আছে বলে প্রকাশ।" সমাজবাড়ির কাছেই বর্ধমানরাজদের গঙ্গাবাস, বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। কথিত আছে মারাঠা সেনাপতি (বর্গি দলপতি) ভাস্কর পণ্ডিত বর্ধমানরাজের গঙ্গাবাসে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। তৎকালীন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ এই সংবাদ পেয়ে হঠাৎ ভাস্করদের আক্রমণ করেন। ভাস্কর পণ্ডিত পুজো ছেড়ে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান। এখানে কান পাতলে এমন কত গল্পই শোনা যায়। দাঁইহাটের গঙ্গা পার হলেই যাওয়া যায় অপর দিকের মেটিয়ারি বা মাটিয়ারি - পিতল-কাঁসা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে পিতল-কাঁসা্র ব্যবহার কমে যাওয়ার জন্য এই শিল্প মার খাচ্ছে।

দাঁইহাটের দক্ষিণে অগ্রদ্বীপ। এখানে গোপীনাথজীর পূজা উপলক্ষে মহোৎসব হয়। বিরাট মেলা বসে। উত্তরে কাটোয়া পেরিয়ে বেশ কিছুটা গেলেই কর্ণসুবর্ণ রেল স্টেশন। কথিত আছে এখানেই ছিল রাজা শশাঙ্কের রাজধানী। এখানে এলে দেখা যাবে বড় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
আমার মামার বাড়ির দেশের কথা বলে কোনদিনই শেষ করতে পারব না। তার আকর্ষণ আমার কাছে অফুরান।



তথ্যসূত্র – 'শুধু দুই পা ফেলিয়া' – ড. কালীচরণ দাস, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়


 

প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের নেশা বেড়ানো আর ছবি তোলা। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা চোখের আড়ালে চলে যাওয়া টেরাকোটার মন্দিরশিল্পকে ক্যামেরার দৃষ্টিতে পুনরুদ্ধার করাই তাঁর ভালোলাগা। পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখা।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher