কানাডার তুষাররাজ্যে কয়েকদিন
অয়ন চৌধুরী
"ল্যাণ্ড অফ ম্যাপল লিফ" বা কানাডায় পা রেখেছি প্রায় বছর দুয়েক হল। কানাডা বলতে প্রথমেই মনে পড়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কথা। না, আজ নায়াগ্রার গল্প বলব না। আজ যে জায়গার অভিজ্ঞতার কথা লিখব, সেটা নায়াগ্রার মত প্রচার আর জাঁকজমকতায় ঢেকে যায়নি। প্রায় সাড়ে সাত হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কানাডার সবচেয়ে পুরনো এই Algonquin Provincial Park - পাইন আর ম্যাপলের জঙ্গল, ছোট পাহাড় আর অসংখ্য লেক নিয়ে তৈরি। এখানে যদিও লোকজন অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ম্যাপল পাতার বর্ণময় রং দেখতে আসে, আমরা গেছিলাম নেহাতই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। এই বছর অর্থাৎ ২০১৪-তে কানাডার ভয়ঙ্কর শীতের কথা হয়ত অনেকেই জানেন, এমনকী নায়াগ্রাও জমে গেছিল এবছরের ঠাণ্ডায়। সেই শীতকে চ্যালেঞ্জ করা অভিজ্ঞতার কথা আমি ডায়েরি থেকে তুলে ধরছি...
আমরা সাতজনের দলে বেরিয়ে পড়েছিলাম, সবাই একই ইউনিভার্সিটিতেই পড়ি এবং কয়েকজন একই পর্বতারোহণ ক্লাবের সদস্যও। উদ্দেশ্য ছিল তিন দিন ট্রেক করে -২৫ ডিগ্রির নীচে সেই ঘন জঙ্গলের ভিতর তুষার রাজ্যে তাঁবু খাটিয়ে থেকে একটা অপ্রচলিত রুট অতিক্রম করা। অনন্যসাধারণ এক ভয়ঙ্কর সুন্দর এবং রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার শরিক হওয়ার জন্যই। আমি ছাড়া সবাই অবশ্য ইউরোপিয়ান। রওনা দেওয়ার কয়েকদিন আগে সব পরিকল্পনার ছক তৈরি হল। এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে যেতে গেলে নিজেদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া খুব দরকার, আর দরকার অবশ্যই মানসিক আর শারীরিক জোর।
শীতের পোশাক বেশ ভালই দরকার ছিল -তিন-চারটে স্তর, তার সঙ্গে স্নো-বুট, বিশেষ ধরনের জ্যাকেট, স্নো-ট্রাউজার, এছাড়া স্লিপিং-ব্যাগ, রুকস্যাক তো আছেই। একটা সাধারণ সানগ্লাস নিয়ে নিলাম স্নো-ব্লাইন্ডনেস এড়াতে। উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন খাবার দাবার সঙ্গে নেওয়াটা খুব জরুরি ছিল। নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলাম কে কী নেবে। ঠিক হলো প্রাতরাশ, এবং রাতের খাবার আমার গ্রুপের দুজন আনবে, আমি নিয়ে যাব পর্যাপ্ত পরিমাণ হট-চকলেট, চা, কফি, চকলেট। দুপুরের খাবার সবাই নিজেরটা নিজে। আমি বেশ কিছু বার্গার, চীজ, হ্যাম, আমন্ড, আপেল, ডিমসেদ্ধ, কলা এই সব নিয়ে নিলাম। সারা বছর ভেতো বাঙালি হয়ে থাকলেও এই কদিন একটু খাবারের অভ্যেস পাল্টাতে হবে। অতিরিক্ত জামাকাপড় বলতে একটা জিন্স, উলের সোয়েটার, গরম মোজা নিলাম, এতেই বেশ ভারি হয়ে গেল স্যাক, পনেরো কেজির মত হবে।
৭ ফেব্রুয়ারি, সকাল ১০.৩০ - আগের দিন রাতে রুকস্যাক গুছিয়ে রেডি করে রেখেছিলাম, শুধু সকালে উঠে কিছু খাবার-দাবার ভরে নিয়েছি। আমাদের গাড়িতে আমরা চারজন - আমি, সিয়ান, এমিলিয়া আর ক্যাটি। বাকীরা অন্য গাড়িতে, আমরা ওখানে পৌঁছে মিট করব। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কিছু হালকা প্রাতরাশ সেরে নিলাম, লাঞ্চ রাস্তায় করা হবে এই রকমটাই ঠিক ছিল। সবাই আসার পর মালপত্র গাড়ির পিছনে তুলে আমরাও উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে ব্যস্ততম হাইওয়েতে, ৪০১ নম্বর। আপাতত ঘন্টা পাঁচ-ছয়-এর রাস্তা, আমরা টরন্টোর ওপর দিয়েই যাব।
Algonquin area, বিকেল ৫টা, আমরা এসে পৌঁছেছি একটু আগে। একটা ছোট বরফের ময়দানের ওপর গাড়ি পার্ক করিয়েছি, যার পাশ থেকে ট্রেইল শুরু হয়েছে পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। চারিদিকে শুধু বরফের রাজত্ব, পাশেই একটা লেক জমে বরফ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে থেকে তুষারপাত শুরু হয়েছে, সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডা। গাড়ির তাপমাত্রা-সেন্সর বলছে -২০ মত, উইন্ড-চিল -২৫ এর নীচে হবে। আমরা নেমে গাড়ি থেকে স্যাকগুলো বার করে স্নো-বুট, স্নো-ট্রাউজার সব পড়ে নিলাম, কারণ একটু পরই শুরু হবে আমাদের পথ চলা। কনকনে হাওয়ায় শরীর যেন কেটে নিচ্ছে, এক মুহুর্তের জন্যে গ্লাভস খুললে মনে হচ্ছে ফ্রস্ট-বাইট হয়ে যাবে। এখনই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আগামী তিন দিন কী হবে কে জানে, বেঁচে ফিরতে পারলে হয়!
ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে গরম পোশাক পড়ে সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। বরফের জুতোগুলোও পরে ফেললাম। এত বরফে হাঁটতে গেলে এটা অত্যন্ত জরুরি, তলায় ক্র্যাম্পন লাগানো থাকায়, ঢালে চলতে সুবিধা হবে। গাড়ি দুটোকে একদিকে পার্ক করিয়ে আমরা হাইকিং-এর প্রস্তুতি শুরু করলাম। তখন সন্ধে হবে হবে করছে, আমাদের প্রায় ৬-৭ কিমি মত যেতে হবে ক্যাম্প-১ পৌঁছতে গেলে। সুতরাং রাত হয়ে যাবেই। যে যার হেড-টর্চ রেডি করে রাখল। আমি ভুল করে সাধারণ টর্চলাইট এনেছি, সেটাই বের করে পকেটে রাখলাম। বিকেল ৫.৩০ নাগাদ আমরা হাঁটা শুরু করলাম। প্রথমের দিকে রাস্তা মোটামুটি ভালই ছিল, কিন্তু যত গভীরে ঢুকতে শুরু করলাম, ততই বরফের ঘনত্ব বাড়তে লাগল, চলাও কষ্টকর হতে শুরু করল। সঙ্গে অবিশ্রান্ত স্নো-ফল আর ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুরিয়ে রাতের অন্ধকার গোটা জঙ্গলকে গ্রাস করল। আপাতত শুধু হেড-টর্চের আলো, বরফের ওপর চলার মচ-মচ আওয়াজ, জঙ্গলের গভীর থেকে আরও গভীরে এগিয়ে যাওয়া। রাস্তা কখনও চড়াই, কখনো উতরাই, চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা...
ক্যাম্প-১, রাত ১১টা - প্রায় ৫-৬ ঘন্টার বিরামহীন পথ চলার পর আমরা অবশেষে পৌঁছেছি। বেশিরভাগ রাস্তাটাই হেঁটেছি অন্ধকারে। বরফের ঢালে নামার সময় মাঝেমধ্যেই পা হড়কেছে সবারই। আমিও একবার আছাড় খেয়েছি। সবচেয়ে মুস্কিলের ব্যাপার হল উঠে দাঁড়ানো, চারিদিকে শুধু নরম বরফ, ধরার কিছুই নেই, ওই অবস্থায় ১৫ কেজি নিয়ে উঠে দাঁড়ানোটা খুব কষ্টকর। নরম বরফের ওপর দিয়ে ঢালু জায়গায় চলা যে এত কষ্টকর আগে বুঝিনি। যতক্ষণ পথ চলার মধ্যে রয়েছি, ঠাণ্ডা সেভাবে বুঝতে পারছিলাম না, একটু থেমে গেলেই যেন সব হিমেল হাওয়া শরীরে এসে জড়ো হচ্ছে...
মাঝে একটা সময় আমরা বেশ কিছুক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলাম, আসলে সিয়ান তখন একটু পিছিয়ে পড়েছিল। নিশুতি রাতে বরফে ঢাকা জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভূতি ঠিক কীরকম সেটা প্রকাশ করার মত ভাষা আমার নেই। এমনটা হতেই পারত যে জঙ্গল থেকে হঠাৎ কোনো ভালুক বা বুনো জানোয়ার বেরিয়ে এল! অথচ সেই মুহূর্তে কী অদ্ভুত একটা প্রসন্নতা গোটা জঙ্গল জুড়ে, শুধু আমরাই যেন সেই শান্ত অরণ্যের কোন অংশ নই। বিভূতিভূষণের আরণ্যকে চাঁদনি রাতে জঙ্গলের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই অভিজ্ঞতা আমার হয়নি, কিন্তু আমার কাছে স্বর্গ বলতে আজকের এই রাতটা। এখানে লবটুলিয়ার জঙ্গলে চাঁদনি রাতে ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়ার সময় শুকনো পাতার মচ-মচ শব্দ নেই, কোয়েল নদীর অববাহিকায় পূর্ণিমা রাতে জঙ্গলের বুনো আওয়াজ নেই, এখানে চারিদিকে যেটা আছে তা হল মৃত্যুর হিমশীতল জগত, আর তার অপার সৌন্দর্য। Life is what you make it - দশটা-পাঁচটা করা বাঙালির জীবন সুখের হতে পারে, কিন্তু তাহলে প্রকৃতির এই রূপ দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর তাছাড়া আমিও তো এই বন্য প্রকৃতিকে আমার কল্পনার প্রেমিকার শরীরের মতই কামনা করি।
ক্যাম্প-সাইটে পৌঁছে প্রথমেই দুটো কাজ সবচেয়ে জরুরি ছিল - আগুন জ্বালানো আর তাঁবু খাটানো। এই বরফের রাজত্বে শুকনো কাঠ খুঁজে বের করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। সবাই মিলে অল্পসল্প করে মোটামুটি বেশ কিছু জ্বালানি সংগ্রহ করা হলো। খানিক সমতল একটা জায়গা তাঁবুর জন্যে বাছা হল - পাশাপাশি দুটো তাঁবু লাগানো হবে। আমাদের কাছে একটা কোদাল ছিল, সেটা দিয়ে প্রথমে যতটা সম্ভব নরম বরফ সরিয়ে ফেলে জায়গাটাকে দুরমুশ করতে লাগলাম সবাই মিলে, যাতে সমতল জমি পাওয়া যায়। একে ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে, তার ওপর গ্লাভস খুলে তাঁবুর দড়ি লাগানো প্রায় অসম্ভব কাজ। এরমধ্যে আবার তাঁবু খাটানোর লাঠিগুলো বরফের স্তর ভেদ করে শক্ত জমি অব্দি পৌঁছাচ্ছেনা, তাই ভালো করে আটকানোও যাচ্ছেনা। ওই ভাবেই কোনরকমে দুটো তাঁবু খাটানো হল পাশাপাশি। হাওয়া ঢোকা বন্ধ করতে তাঁবুর চারপাশ বরফের পাঁচিলের মত তুলে দিলাম বেলচা দিয়ে বরফ সরিয়ে। এইসব করতে করতেই অনেক রাত হয়ে গেল, কত রাত জানিনা। ইতিমধ্যে দেখি রেগি বেশ কায়দা করে আগুন জ্বালিয়ে ফেলেছে। বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারার বিয়ার গ্রিলস-এর একটা কথা মনে পড়ছিল, এক্সট্রিম সারভাইভাল-এর ক্ষেত্রে আগুন জ্বালাতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় - সত্যিই তাই! আগুনের কাছে গিয়ে একটু গরম হয়ে নিলাম সবাই। কিন্তু এদিকে পেটে তখন আগুন জলছে। পথে আসতে আসতে টুকটাক কিছু খাওয়া হলেও যে পরিমান ক্যালরি খরচ হয়েছে সেটা কিছুই নয় সেই তুলনায়। আর সবচেয়ে বেশি দরকার জীবনদায়ী জল, নাহলে ডিহাইড্রেটেড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমনিতেই পথে আসার সময় বোতলগুলো ঢাকা সমেত জমে যাওয়ার ফলে জল থাকা সত্ত্বেও খেতে পারিনি, সেগুলো খুলতে আগুনের কাছে নিয়ে গিয়ে অনেক কসরত করতে হয়েছে। জল বলতে বরফ গলানো, তাই এক পাত্র নরম বরফ ভরে মিনি-স্টোভে চাপিয়ে দেওয়া হল, আর একটা পাত্রে রান্না। প্রথম দিনের ডিনারের জন্যে এমিলি এনেছিল মিট অ্যান্ড সস, সেটা গরম করে নেওয়া হল। বরফ গলে জল হয়ে ফুটতে শুরু করলে সবাই নিজের নিজের বোতল ভরে নিলাম। শরীরের সংস্পর্শে বোতলগুলো রাখলাম, নাহলে সব জমে যাবে। এদিকে ক্যাম্প-ফায়ার জ্বালানো হল ঠিকই, কিন্তু অবিরাম স্নো-ফলে আগুন টিকিয়ে রাখাই দায়, তারজন্য আরও শুকনো কাঠ দরকার । নিশুতি রাতে জঙ্গলে ঢুকে কাঠ সংগ্রহ করাও একটা ছোট-খাটো অ্যাডভেঞ্চার বৈকী, বরফে প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছি! শরীর গরম রাখতে এক কাপ হট-চকলেট খেয়ে নিলাম শুতে যাওয়ার আগে, আর আমাদের খাবারদাবারগুলো দড়ি দিয়ে গাছের উঁচু ডালে টাঙিয়ে দেওয়া হল, যাতে বন্য জন্তু নাগাল না পায়। শুতে গিয়ে দেখি আমার স্লিপিং-ব্যাগের এর টেম্পারেচর লিমিট -২০ ডিগ্রি, আর বাইরে ঠাণ্ডা মোটামুটি -২৫ এর নীচে, ভাগ্গিস একটা ফ্লিস লাইনার এনেছিলাম, এটা আরো ১০-১২ ডিগ্রি মত আরাম দেবে। শুধু ভারি জ্যাকেট, স্নো-ট্রাউজার আর স্নো-বুটটা কোনরকমে খুলে সটান স্লিপিং-ব্যাগের ভিতর। সকালে কী করে উঠব সেই চিন্তা করতে করতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন চোখটা লেগে গেল...
৮ই ফেব্রুয়ারি, সকাল আন্দাজ ৮টা - আমার ঘুম ভাঙ্গল সবার আগেই, কিন্তু কিছুতেই আর স্লিপিং-ব্যাগ ছেড়ে বেরোতে পারছিনা। কোনরকমে উঠে জ্যাকেট, স্নো-বুট পরে বাইরে এলাম। বেরিয়েই দেখি অদ্ভূত সব দৃশ্য চারপাশে! কাল রাতে অন্ধকারে ভালো করে বুঝতে পারিনি। যে দিকে চোখ যায় শুধু পাইনের জঙ্গল সাদা বরফের চাদরে মোড়া, বরফের ভারে পাইনের ডালগুলো বৃদ্ধ মানুষের মত ঝুঁকে পড়েছে। আর ঠিক আমাদের ক্যাম্পের পাশেই বিশাল লেকটা জমে বরফ হয়ে গেছে। সকালের সোনালি রোদ এসে পড়েছে সাদা বরফের প্রান্তরে, অদ্ভূত এক নিঃশব্দতা যেন জমে উঠেছে চারদিকে। এই রূপও এভারেস্টের মেদহীন রাজসিক রূপ, অথবা পূর্ণ যৌবনা কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপের চেয়ে কম কিছু না। একে মৃত্যুপুরী না স্বর্গলোক কী বলব জানিনা, কারণ এখানে যেমন অপার্থিব সৌন্দর্য আছে, তেমনি এই প্রকৃতি জীবন কেড়ে নিতেও পারে যখন তখন।
প্রকৃতির একেবারে কাছাকাছি চলে এসে নিজেকে পৃথিবীর রাজা মনে হচ্ছিল তখন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে, অথচ কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিনা ওই বরফের ময়দান থেকে। কাল রাতের বেলায় যে পথ পেরিয়ে এসেছি, সেই দিকে একটু এগিয়ে দেখি সরু শুঁড়ি পথের মত রাস্তা চলে গেছে পাইনের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আমাদের চলার রাস্তাটা বোঝা যাচ্ছে। চারদিকে শুধুই বরফ, পা দিলেই হাঁটু অব্দি ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের টেন্ট দুটোও সাদা বরফের চাদরে মুড়ে গেছে সারারাতের তুষারপাতে, বাইরে রাখা স্যাক, জুতো সব বরফে ঢেকে গেছে। এই অদ্ভূত পরিবেশটাকে মনের ভিতর তো ধরে রাখলামই, ক্যামেরার লেন্সে বন্দী করতেও ভুললাম না। ভাগ্গিস তিনটে ব্যাটারি ছিল, এই ঠাণ্ডায় খুব তাড়াতাড়ি চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর সিয়ান উঠল, আর একটু পর বাকী সবাই। প্রথমেই বরফ গলিয়ে জল তৈরি করা হল সবার জন্যে, তারপর প্রাতরাশে ওটমিল, ডিমসেদ্ধ (জমে পাথর হয়ে গেছিল, দাঁতে করে ভেঙ্গে খেতে হয়েছে), এলমন্ড, সসেজ, আপেল আর হট-চকলেট। একটু ভারি খেয়ে নেওয়া হলো কারণ আজ প্রায় ১০-১১ কিমি হাইক করতে হবে এবং লাঞ্চ হবে রাস্তায় যেতে যেতে টুকিটাকি খেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই তৈরি হয়ে তাঁবু গুটিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম। আজও সকাল থেকে তুষারপাত শুরু হয়েছে, জানিনা কখন থামবে।
দিনের বেলায় একটা সমস্যা হল যেটা কাল রাতে বুঝতে পারিনি, ঘাম হতে লাগল ওই প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যেও, কারণ রাস্তা বেশ চড়াই এবং আমরা ভালই ওজন বহন করছি। একটু দাঁড়ালেই আবার খুব শীতও করছিল। ঘাম বসে যাওয়াও খারাপ জিনিস, অথচ জ্যাকেট খুলতেও পারছিনা ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে। এইভাবেই তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগলাম, আর মাঝে মাঝে একটু জিরিয়ে নেওয়া। পকেটে কিছু আমন্ড, লজেন্স রেখেছিলাম পথ চলতে খাওয়ার জন্যে। আমার দু-পকেটে দুটো জলের বোতল, পিঠে ভারি রুকস্যাক, চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। জল জমে যাওয়া রুখতেই এই পন্থা। রাস্তায় যাবার পথে অদ্ভূত সব দৃশ্য, সুযোগ পেলেই ক্যামেরাবন্দী করছি। জটায়ুর ভাষায় বলতে গেলে, রুদ্ধশ্বাস, মুগ্ধভাষ, বিমুগ্ধ বিমূঢ় বিস্ময়! মাঝে একটা বেশ চড়াই এল, সেটা পেরিয়ে একটু সমতল আর খোলা মত জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, তুষারপাতের তীব্রতা গেল বেড়ে। অদ্ভূত লাগছিল তখন - চারদিক পেঁজা তুলোর মত বরফ সবাইকে সাদা করে দিচ্ছে, কাছাকাছি আমরা ছাড়া আর কোনও জনমানব নেই।
প্রায় ঘন্টা পাঁচ-ছয় ওই ভাবে পথ চলেছি, দেখতে দেখতে সূর্য ডোবার সময় হয়ে এল, বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। শরীরও বেশ ক্লান্ত। সারাদিনে সেভাবে কিছু ভারি খাবার খাইনি, বেশ খিদে পেয়ে গেছিল। খাবার দাবার সব স্যাকের ভিতর, রাস্তায় চলার সময় বের করে খাওয়ার সুযোগ হয়নি। বাকীরা একটু এগিয়ে গেলে ব্যাগ থেকে হ্যাম-বার্গার বের করে খাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হ্যামগুলোও জমে গেছে। কোনও রকমে বের করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম, কারণ হাত একটু খোলা রাখলেই জমে যাচ্ছে। তারপর আবার চলা শুরু। বেশ কিছুক্ষণ আমি একা পথ চলছি, একটাই ভয় লাগছে রাস্তা যদি ভুল করে ফেলি! যদিও সামনের বরফের ওপর সবার চলার পথ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আধো-আলো আধো-অন্ধকারে ভুল হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
তখন সন্ধে হয় হয়, গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, শরীরটাও অবসন্ন। হঠাৎ বাড়ির কথা মনে হল, মায়ের কোলই মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ আশ্রয়। 'ইন টু দ্য ওয়াইল্ড' সিনেমাটার কথা মনে হচ্ছিল বারবার, সত্যি যদি আমি আর না চলতে পারি, এখানেই হয়ত মৃত্যুর হিমশীতল জগতে চলে যাব। একবার যদি পাশে বরফের মধ্যে ঢুকে যাই, কেউ আর আমাকে খুঁজে পাবে না। এইসব আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে শরীর দুর্বল লাগছিল। মনে জোর এনে আবার চলতে শুরু করলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রুপে ফিরতে পেরে খানিক আশ্বস্ত লাগল। সবাই-ই অবশ্য ক্লান্ত। আজও আমাদের সন্ধে হয়ে গেল, এখনও অনেকটা রাস্তা বাকি। সময় বাঁচাতে ঠিক করা হল জমা লেকের ওপর দিয়েই যাওয়া হবে, যদিও সেটায় বেশ বিপদেরই সম্ভাবনা। সাত-পাঁচ না ভেবে প্রায় অন্ধকারের মধ্যেই আমরা নেমে পড়লাম জমে যাওয়া লেকের ওপর। কোনও কথা নেই, শুধু সাতটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে মচ-মচ শব্দ করে পেরিয়ে যাচ্ছি লেকটা আড়াআড়িভাবে। অবশেষে এসে পৌঁছলাম ক্যাম্প-২, তখন সবার শরীর প্রায় অবসন্ন। কিন্তু তার মধ্যেও চারপাশের সৌন্দর্য নজর কাড়ে, এই জায়গাটা যেন আগের ক্যাম্পের চেয়েও সুন্দর, যদিও এখন অন্ধকার।
আজ তাঁবু দুটো একটু দূরে-দূরে লাগানো হল সমতল জায়গার অভাবে। বেশি জ্বালানি পাওয়া যায়নি, আর স্নো-ফলের জন্যে ভালোভাবে আগুনও জ্বালানো যায়নি। কোনরকমে তাঁবু খাটিয়ে ভিতরে বিছানা তৈরি করে নিলাম, যত তাড়াতাড়ি শুয়ে পরা যায় ততই মঙ্গলের, আর শরীর টানছে না। ঝটপট রান্না করে ফেলা হল পাস্তা দিয়ে। কোনরকমে খেয়ে সটান স্লিপিং-ব্যাগে। জায়গাটা ভালো করে সমান করা হয়নি, পিঠে উঁচু-নীচু বরফ লাগছে। আজ ঠাণ্ডা আরও বেশি, মাথা অব্দি ঢেকে দিয়েও শীত করছে। বেশি শীত করার আর একটা কারণ হচ্ছে আমাদের স্লিপিং প্যাড-এও বরফ জমে আছে, অন্ধকারে সব গুছাতে গিয়ে বরফ্ময় হয়ে গেছে। সারভাইভাল-এ রাতগুলোই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং...
৯ই ফেব্রুয়ারি, সকাল ৮:৩০ - ঘুম থেকে উঠেই সেল-ফোনটা অন করে সময় দেখলাম, প্রায় সাড়ে-আটটা বাজে। উঠেই আবার লড়াই, আজ আর একটা সমস্যা হল, আমার স্নো-বুট জমে গেছে, কিছুতেই পড়তে পারছিনা। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় গলালাম পায়ে, জ্যাকেটটাও যেন জমে কাঠ। তবে জলের বোতল দুটো সঙ্গে নিয়ে শুয়েছিলাম বলে একেবারে ঠিক আছে। বাইরে বেরিয়ে আবার একটা অসাধারণ সকাল, এ যেন এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও। আজ সবাই উঠে পরেছে, আমাদের তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, নাহলে সময়ে পৌঁছাতে পারবনা। ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া হল, আমার নিয়ে আসা কলা, ডিমসেদ্ধ কোনও কাজে এলো না, কারণ সব কিছুই জমে পাথর হয়ে গেছে। স্যান্ডুইচ আর হট-চকলেট দিয়ে প্রাতরাশ সারলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পরলাম শেষ গন্তব্যের দিকে, অর্থাৎ ফেরার পথে। আজ আমরা ৬-৭ কিমি মত হাইক করব, এবং আবার সেই রাস্তায় গিয়ে মিশব যে রাস্তা দিয়ে প্রথম দিন এসেছিলাম। আজও সকাল থেকে তুষারপাত হচ্ছে, তার মধ্যে দিয়েই আগের মত পথ চলা। একটা জায়গায় এসে দেখি রাস্তা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, একটা চলে গেছে সোজা, আর একটা নীচের দিকে। ব্যাগপত্র রেখে আমরা নীচের রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম কৌতুহলবশত। বেশ কিছুটা চড়াই উতরাই কাটিয়ে একটা ছোট পাহাড়ের মাথায় এসে দেখি এক অভাবনীয় দৃশ্য, গোটা লেক অঞ্চলটা নীচে দেখা যাচ্ছে, সব সাদা হয়ে আছে, মাঝে শুধু পাইন গাছের সারি, আর আমরা ওপরে। ঠিক ছবিতে বা ক্যালেন্ডারে যেমন দেখি। ওখানে আমরা মিনিট দশ-পনের ছিলাম।
ফিরে এসে আবার পথ চলা, মাঝে অল্প বিরতি। একটা জায়গায় ছোট সেতু মত পড়ল, জায়গাটা খুব সুন্দর। বরফের প্রান্তরের মাঝে একটা জায়গায় ছোট্ট ফুটো, সেখান দিয়ে কল-কল করে জল বয়ে চলেছে। আমাদের পায়ের কয়েক ইঞ্চি নীচেই বয়ে চলেছে সেই হিমশীতল জলের ধারা। সেসব পেরিয়ে আমরা কয়েক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম যেখান থেকে এই হাঁটা শুরু হয়েছিল, তখন বিকেল তিনটে।
সবাই মিলে সেলিব্রেট করা হল। অদ্ভূত ভাবে তিনটে দিন কেটে গেল স্বপ্নের মত। এবার ফেরার পালা, যে যার কাজে আবার জড়িয়ে পড়বে, শুধু থেকে যাবে মাঝের এই কয়েকদিনের স্মৃতি। রাস্তায় আসার সময় একটা জায়গায় সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া হলো, তারপর একে অপরকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসা যে যার জগতে। হয়ত এদের সঙ্গে এখান থেকে চলে যাবার পর কোনদিন দেখাও হবেনা, কিন্তু এই তিনদিনের স্মৃতি থেকে যাবে চিরকাল। হয়ত কোনও এক শীতের বিকেলে কলকাতার ময়দানে লেবু-চা বা কফি হাউসে কোল্ড-কফি, কাটলেট নিয়ে বসে ড্যানিয়েল, সুকান্ত, বা শুভজিতের সঙ্গে গল্প করব এই সব অভিজ্ঞতা, একদিন হয়ত বলব "those were the best days of my life"...
ডানকুনির ছেলে অয়ন চৌধুরী বর্তমানে কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে পিএইচডি করছেন। প্রধান নেশা পর্বতারোহণ। এদেশে থাকতে দক্ষিণ কলকাতার একটি পর্বতারোহণ ক্লাবের সদস্য ছিলেন। পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গে ইউনিভার্সিটির ক্লাইম্বিং ক্লাবের সক্রিয় সদস্য অয়ন পর্বতারোহণের নেশাটা বজায় রেখেছেন বিদেশে গিয়েও। এছাড়াও ফটোগ্রাফি, ঘুরে বেড়ানো, ব্লগ লেখা তাঁর অবসর সময়ের আকর্ষণ।