অন্য ইতালি

কাকলি সেনগুপ্ত

~ ত্রিয়েস্তের আরো ছবি ~

সম্পাদক বললেন, "ইতালি ঘুরে এলে, সেই নিয়ে পত্রিকায় কিছু লেখো।" আমি ভাবি, কী নিয়ে লিখি? ভেনিস-রোম-ফ্লোরেন্স-মিলান – সর্বত্রই বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। টিভি খুললেই দেখি ইতালির অপূর্ব সব ভাস্কর্যের সামনে বাংলা সিনেমার কুশীলবরা চিত্র-বিচিত্র পোশাকে নেচে চলেছেন। মিলানের রাস্তায় তো পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পোশাকে এক অভিনেত্রীকে নাচে যোগ দিতে দেখলাম, বেশ লাগলো। সেই নাচের সূত্র ধরে বাংলা সিনেমা-টিভির দর্শকেরা দেখে নিয়েছেন ইতালির বিখ্যাত শহরগুলির দ্রষ্টব্য সব জায়গা। এর মাঝে আমি যদি ইতিহাসের পাতা খুলে বলি - ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের ওই ওবেলিস্কটা চার হাজার বছরের পুরনো। সাঁইত্রিশ খ্রীস্টাব্দে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রোমে নিয়ে আসা হয় সম্রাট ক্যালিগুলার নির্দেশে। পরবর্তীকালে সম্রাট নিরোর সার্কাসের মধ্যমণি ওই ওবেলিক্স হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। এর সামনে গ্লাডিয়েটররা লড়াই করেছে। যীশুর অনুগামী হওয়ার অপরাধে অজস্র মানুষকে অত্যাচার করা হয়েছে; ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে = এখানেই। এর সামনে সেন্ট পিটারকে মাথা নীচু করে ক্রুশে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক এর সামনেই নাচাগানা না-ই বা করলে! .... কিন্তু তাতে বোধহয় আমার কপালে 'বেরসিক' উপাধি-ই শুধু জুটবে। আনন্দের হাটে তালভঙ্গ হোক, কে-ই বা চায়! উৎসব চলতে থাকুক। আমরা বরং উত্তর ইতালির ছোট্ট শহরের এক কোণে পড়ে থাকা অজানা ইতিহাসকে একটু নেড়েচেড়ে দেখি।
এমনই এক ছোট্ট সুন্দর বন্দর-শহর উত্তর ইতালির ত্রিয়েস্তে (Trieste)। ভেনিস থেকে দু'ঘন্টার সফরে রেল অথবা সড়কপথে পৌঁছে যাওয়া যায়। ভেনিসের তুলনায় খানিকটা উঁচুতে পাহাড়ের পাদদেশে, আদ্রিয়াতিক সাগরের গা-ঘেঁষা এই শহরের ইতালীয় পরিচয় বেশ নতুন। দীর্ঘকাল ত্রিয়েস্তে ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের অংশ। এখানকার অধিবাসীরা বেশিরভাগই ছিল স্লাভ (Sloven)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে স্লাভদের আধিক্য নষ্ট করে ইতালীয়দের প্রভাব ও সংখ্যা বাড়তে থাকে। 'ব্ল্যাক শার্ট' মিলিশিয়াদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। এখন অবশ্য এটি পুরোদস্তুর ইতালীয় শহর।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ভেনিসে নেমে না-গরম না-ঠাণ্ডা, বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া পেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ বিকেলে যখন ত্রিয়েস্তে পৌঁছলাম, তখন খানিকটা ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে। ঘটনাচক্রে এপ্রিলের শেষ ক'দিন রাতে হিটারও চালাতে হয়েছিল। মে মাসে ত্রিয়েস্তের আবহাওয়া চমৎকার। ঝকঝকে রোদ উঠলেই সমুদ্রসৈকতে রোদ পোহানোর ভিড়। ত্রিয়েস্তে হচ্ছে ইতালির কফি-রাজধানী। অজস্র কাফে ছড়িয়ে রয়েছে সারা শহরে। একশো বছরের পুরনো কাফে সান মার্কোর খ্যাতি ছড়িয়েছে জেমস জয়েস ও সমসাময়িক বহু লেখক-শিল্পীর আড্ডাঘর হিসেবে। কিন্তু শহর ঘুরতে-ফিরতে আমার বারবার মনে হয়েছে এই শহরে অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের সংখ্যা খুব কম। অল্পবয়সীরা কাফের থেকেও বার-এ যেতে বেশি পছন্দ করে। খোলা চত্ত্বরেও (Piazza, Square) দেখা যায় ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে আড্ডা মারছে। আর কাফেতে যারা সারাদিন - সারা সপ্তাহ বসে থাকেন তারা প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ। শনি-রবিবার অবশ্য অনেকেই আসতেন সপরিবারে। ইতালীয়দের অনেক কিছুই বাঙালিদের মতন (ভোজনরসিক, আড্ডাবাজ, ফুটবল-পাগল, খানিকটা অলস – দুপুরের ঘুমটা খুব ভালবাসে, পরিবারকেন্দ্রিক এবং মায়েরা বেশ কড়া ধাঁচের – প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদেরও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন)। খুব ভালো লেগেছে দেখে যে এরা এখনও আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটায় আর তখন মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকেনা।

ইতালির যে কোনো শহরের মতোই ত্রিয়েস্তে সৌন্দর্যে ভরপুর, ইতিহাসে ভরপুর এবং অবশ্যই সুখাদ্যে ভরপুর। নোবেল পুরস্কারজয়ী পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ডঃ আবদুস সালাম ১৯৬৪ সালে এই শহরে International Centre For Theoretical Physics (ICTP) স্থাপন করেন। এই সংস্থাটি তৃতীয় বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানচর্চায় খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। ত্রিয়েস্তেতে তাই এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই নজরে পড়ে। আই.সি.টি.পি.তে আসা বেশির ভাগ লোকজন অবশ্য আশপাশের চত্ত্বরে থাকাই পছন্দ করেন। বছর দশেক আগেও শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে অ-ইউরোপীয় লোকজন বিশেষ ছিল না। এখন বেশ কিছু দোকান চিনারা ও তুর্কীরা চালায়। এদের ছেলেমেয়েরা স্থানীয় স্কুলে পড়ে। বেশ কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবারও এখানের স্থানীয় বাসিন্দা। আমাদের দেশে যেমন যেখানে সেখানে শিবের থান দেখা যায়, ইতালিতে তেমনই এ-গলি সে-গলির ফাঁকে গীর্জা রয়েছে। অতি সাধারণ গীর্জারও ভেতরের সাজসজ্জা খুব সুন্দর। আর সেখানে যখন ঘন্টা বাজত মনে হত স্বর্গে পৌঁছে গেছি। কিছুটা লম্বা সময় ধরে থাকায় ত্রিয়েস্তের বহু জায়গাতেই একাধিকবার ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন কিছু দেখার তাগিদে ইন্টারনেট খুঁজে দেখি রিসিয়েরা দি সান সাব্বা – ইতালির একমাত্র নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। জায়গাটি এখন মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। এক সপ্তাহান্তে বাস ধরে পৌঁছলাম সেখান। সৌভাগ্যবশত বাসে এক পাকিস্তানি ভদ্রলোক ছিলেন, যিনি দীর্ঘদিন আই.সি.টি.পি.-র সঙ্গে যুক্ত। সঠিক জায়গার হদিশ দিলেন তিনিই। নাহলে মুশকিলে পড়তাম; কারণ স্থানীয় মানুষেরা এই মিউজিয়ামের খবর একেবারেই রাখেনা। ১৯৪৩-৪৫ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর অপরাধগুলোকে ভুলে থেকেই এরা অস্বীকার করতে চায়।
১৮৯৮ সালে তৈরি এই চালকলকে (Risiera Rice husking mill) কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করে জার্মানরা, মুসোলিনির সাহায্যে ও আনুকূল্যে। যদিও এটিকে মূলতঃ ট্রানসিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হত ( বেশীরভাগ বন্দীকেই এখান থেকে Dachau বা Auschwitz–এর ক্যাম্পে পাঠানো হত), চার হাজারেরও বেশি বন্দীকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে পালিয়ে যাওয়ার সময় জার্মানরা ডিনামাইট দিয়ে ক্যাম্পটি উড়িয়ে দিয়ে যায়, নিজেদের কুকর্মের প্রমাণ ধ্বংস করার জন্য। পুরো ক্যাম্প চত্ত্বরটা এতটাই ছোট যে পনেরো মিনিটেই একবার ঘুরে ফেলা যায়। অথচ আমরা এক পা-দু'পার বেশি এগোতে পারছিলাম না। বন্দীদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা পড়ে এক অসহ্য দম বন্ধ করা কষ্ট হচ্ছিল। অসম্ভব ছোট ছোট খুপরিতে চল্লিশ-পঞ্চাশজনকে ঠেসে ঢোকানো হত। এছাড়াও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের নানা পন্থাতো ছিলই। একটি ছোট ছেলের লম্বা ডোরা দেওয়া পোশাক (Boy with the striped pajamas ফিল্মে অনেকেই হয়তো দেখেছেন) দেখে আমার ছেলে বলল, " এই ছেলেটা হয়ত আমার বয়সীই ছিল!" রিসিয়েরা মিউজিয়াম দেখে ও এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছিল যে ওর খুব প্রিয় কাজ ছবি তোলার কথাও ভুলে গেছিল। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বলতে আমরা মূলতঃ ইহুদী-নিধন বুঝি। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন ক্যাম্পে হাজার হাজার এথনিক স্লাভ, ক্রোয়েশীয়, পোলিশ ও রোমানীয় জিপসিদের হত্যা করা হয়েছে। রিসিয়েরার কয়েদীরা বেশিরভাগই ছিল স্লাভ ও ক্রোয়েশীয় - লেখক বরিস পাহর (এঁর বিখ্যাত উপন্যাস Necropolis) তাদের মধ্যে একজন। পরবর্তীকালে ইহুদীরা (বকলমে ইজরায়েল) সমস্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু স্লাভরা রিসিয়েরার অধিকার পুরোপুরি ছাড়তে রাজি হয়নি। মিউজিয়ামটি বর্তমানে ইতালি সরকারই দেখাশোনা করে। সমস্ত তথ্য ইতালীয়, ইংরাজি ও স্লাভ ভাষায় লেখা ( বাকি সব ক্যাম্পে হিব্রুতে লেখাও আবশ্যিক)। রিসিয়েরায় যুদ্ধকালীন যে অপরাধ হয়েছিল তার বিচার শেষ হয় ১৯৭৬ সালে। বিচারের নামে প্রহসনই বটে! অপরাধীদের কাউকেই ইতালিতে আনা যায়নি। প্রায় সবারই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। একজন অপরাধী (জোসেফ ওবেরহাউসের) তখনও মিউনিখে মদ বেচে চলেছে। বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু ইতালি ও জার্মানির মধ্যে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি ১৯৪৮ সালের ঘটে যাওয়া অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; কাজেই ......।

রিসিয়েরা দেখার অভিজ্ঞতা আজও আমাকে যন্ত্রণা দেয়। ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে মানুষ মানুষকে কতটা আঘাত করতে পারে, মনুষ্যত্বের কতটা অবমাননা হতে পারে। সেটা সমগ্র পৃথিবীর পক্ষে কী ভীষণ ক্ষতিকর! তবু মানুষ বারবার ভুল করে। নৃশংস আক্রমণের হাত থেকে স্কুল-হসপিটালও ছাড় পায়না। স্কুলে পড়তে গিয়ে বাচ্চারা আর বাড়ি ফিরে আসেনা। বোমার আঘাতে নিহত শিশুদের দেহে মর্গ উপচে পড়ে, দেহ রাখতে হয় আইসক্রীমের ফ্রিজারে। একজন মা হিসেবে নিজেকে তখন খুব অসহায় মনে হয়। তাই আজ আলো ঝলমলে রোম-ভেনিস সরিয়ে রেখে রিসিয়েরার অন্ধকার কুঠুরির গল্পটাই বললাম; এই আশায় যে একদিন এই ঝড় থেমে যাবে। "You may say I'm a dreamer. But I'm not the only one"।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - www.risierasansabba.it/english/

~ ত্রিয়েস্তের আরো ছবি ~

মফস্বল শহর বালীতে বড় হয়ে ওঠা কাকলি সেনগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ ছেড়েছেন ১৯৯৭ সালে। তারপর নানা জায়গা ঘুরে ২০০৪ সাল থেকে থিতু হয়েছেন গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্হলে - এলাহাবাদে। গল্প করে ও গল্প বলে লোকজনকে বিরক্ত করার জন্য খ্যাতি আছে। বেড়ানোর সাথে সাথে দেশ-বিদেশের খাদ্য ও পানীয়ের বিষয়েও সমান আগ্রহী।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher