মহাপ্রস্থানের পথে

সুজয় গোস্বামী


সতোপন্থ তাল ট্রেক রুট ম্যাপ ~ ট্রেকের আরও ছবি

কলকাতা থেকে ১৮ই মে, ২০১৩ দুন এক্সপ্রেসে রওনা হলাম হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে বদ্রীনাথ হয়ে যাব তিব্বত সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রাম "মানা"। মানা থেকেই শুরু হবে আমাদের মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা, অর্থাৎ সতোপন্থ তাল ট্রেক।
হরিদ্বার থেকে আমাদের প্রথম দিনের লক্ষ্য ছিল যোশীমঠ, কারণ সতোপন্থ তাল ট্রেকের জন্য ওখান থেকেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পারমিট নিতে হয়। কিন্তু যথারীতি দুন এক্সপ্রেসের বদান্যতায় আমাদের প্রথম দিনের দৌড় চামোলিতেই শেষ হল। চামোলি বাসস্ট্যান্ডে অত্যন্ত সস্তা এবং সুন্দর কেদার বদ্রী মন্দির কমিটির অতিথিশালায় রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে যখন যোশিমঠের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি, অতিথিশালার ম্যানেজার কথা প্রসঙ্গে জানালেন, যোশিমঠে কিছুই করতে হবে না; তাঁর এক ভাই মানায় লোকাল গাইড, তাকে তিনি ফোন করে দেবেন, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ভদ্রলোকের কথায় এমন একটা জোর ছিল যে আমরা রাজি হয়ে গেলাম।
দুপুর একটা নাগাদ মানা পৌঁছে সেই 'লোকাল গাইড' মহাশয়ের কাছে আমাদের পরিকল্পনা ব্যক্ত করতে তিনি কিছুটা নেতিবাচক ভঙ্গিতেই সাফ জানিয়ে দিলেন পোর্টার পড়বে ১২০০ টাকা দিনপ্রতি আর গাইড ২০০০ টাকা। আমি কোনদিন এতটা ধাক্কা খাইনি, আর আমার একমাত্র ট্রেকসঙ্গীটির মুখেও স্পষ্ট হতাশার ছাপ। বলেই দিলাম আমরা পারবনা, বরং ফিরেই যাই। এমতাবস্থায় কী মনে হল, ভদ্রলোক বললেন, আসুন দেখি এখানে একজন 'ট্রেইন্‌ড গাইড' আছেন, তিনি যদি কোন ব্যবস্থা করতে পারেন।
মাস দুয়েক আগে ইণ্টারনেটে সতোপন্থ সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে গিয়ে মন্নু সিং রাওয়াত নামে একজন গাইডের সন্ধান পাই। তখন তাঁর রেটটা খুব বেশি মনে হয়েছিল। ভাগ্যের ফেরে সেই মন্নুজির সঙ্গেই আমাদের মোলাকাত হল। তিনি তো কোনমতেই আমাদের সাহায্য করতে রাজি নন। ফাইল খুলে দেখাতে শুরু করলেন সতোপন্থ তাল ট্রেকের পারমিট সংক্রান্ত হাজার ফ্যাকড়া, আর আমাদের হাতে সময় নেই। আমারও রোখ চেপে গেল। এতদূর যখন এসেছি ট্রেক না করে ফিরে যাব না। বেশ কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডার পরে এবং আমাদের পুরোদস্তুর সাজ-সরঞ্জাম দেখে হঠাৎ মন্নুজি বললেন, ঠিক আছে আমি পোর্টার গাইড দেব, রেট ওই ৬০০/- আর ৮০০/-ই থাকবে, কিন্তু আপনাদের বণ্ড দিয়ে যেতে হবে, কারণ এই মরসুমে আপনারাই প্রথম গ্রুপের ট্রেকার, বরফ খুব বেশি আর রাস্তাও বিপজ্জনক। আর আমাদের পায় কে! শুধু প্রকাশ্যে নাচাটাই বাকি রেখে শুরু করে দিলাম ফর্ম ফিলাপ। এরপর ঘুরেফিরে পারমিটের কথা উঠতে মন্নুসিং একটা চওড়া হাসি দিয়ে বললেন, "ম্যায় হুঁ না" । সেদিন থেকে গেলাম মন্নুসিং-এর বাড়িতেই। বিকেলবেলায় এক বছর-চব্বিশের সুদর্শন যুবক এসে নিজের পরিচয় জানাল, সে জগদীশ – আমাদের গাইড।
২২শে মে সকাল ৭টা - মন্নুসিং এর নজর সর্বত্র। এর মধ্যেই তিনি আমাদের পথচলতি কেরোসিন, গাইড-পোর্টারের জন্য ম্যাট্রেস, স্লিপিং ব্যাগ, সানগ্লাস, আইস অ্যাক্স – সব গুছিয়ে দিলেন। প্রায় সকাল ৮টায় আমাদের যাত্রা শুরু হল।
মানা গ্রাম থেকে সতোপন্থ তালের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি, উচ্চতা ১৪,০০০ ফুটের কিছু বেশি। আমরা যারা বেশিরভাগ সিকিম হিমালয়ে ট্রেক করি তাদের কাছে ১৪,০০০ ফুট আর গাড়োয়ালের ১৪,০০০ ফুটের মধ্যে বেশ খানিকটা ভৌগোলিক পার্থক্য চোখে পড়ে। সেটা কিছুটা অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের তারতম্যের জন্য আর অনেকটাই পূর্ব হিমালয়ে শিবালিক পর্বতমালার অনুপস্থিতির কারণে।
Satopanth Taal Trek Route Map আজ আমাদের গন্তব্য লক্ষ্মীবন, মানা থেকে প্রায় ৮ কিমি দূরে। মন্নুসিং নিজেই আমাদের ভীমপুল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এই রাস্তা তীর্থযাত্রীর ভিড়ে ভারাক্রান্ত। মহাভারতের কাহিনি অনুসারে সতোপন্থ তালের এই পথ আসলে পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের পথ। এই পথেরই বিভিন্ন স্থানে দ্রৌপদী এবং চার পাণ্ডব একে একে দেহত্যাগ করেন। অবশেষে সতোপন্থ তালের ধারে স্বর্গারোহিণী হিমবাহের পাদদেশে যুধিষ্ঠিরের জন্য স্বর্গের রথ নেমে আসে। স্থানীয় মানুষের আরও বিশ্বাস - ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর – এই ত্রিমূর্তি বছরের একটি বিশেষ সময়ে সতোপন্থ তালের তিন প্রান্তে অবগাহন করতে আসেন। ভীমপুলের পর তীর্থযাত্রীর ভিড় হাল্কা হয়ে এলেও দু'এক জন সাধু সন্ন্যাসীকে দেখলাম আমাদের পথেই হাঁটতে।
হাঁটা শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দেখি পথের বাঁ দিকে প্রায় ৪০০ মিটার লম্বা এবং প্রবল চড়াই - এক বিশাল গ্লেসিয়ার, যা আসলে নারায়ণ পর্বতের হিমবাহ, অলকানন্দায় এসে মিশেছে। জগদীশ জানাল আমাদের ওই আইস ব্রিজ পার করে ওপারে যেতে হবে। ব্রিজের নীচ দিয়ে প্রবল গর্জনে বয়ে চলেছে অলকানন্দা। দুরু দুরু বক্ষে গ্লেসিয়ারে পা রাখলাম। বরফ বেশ শক্ত, হড়কালেই সোজা অলকানন্দায়। তাই বেশ জোরেই জুতোর কিনারা দিয়ে পা ঠুকছিলাম। বরফের চড়াই ভেঙে ওপরে পৌঁছে চোখ জুড়িয়ে গেল – একটা ছোট্ট বুগিয়াল। সবুজ ঘাসের মধ্যে একটা দুটো করে রঙিন ঘাসফুল সবে মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে – সামনে দূরে উঁকি দিচ্ছে 'চৌখাম্বা ফোর'।
কিছুক্ষণ চামতোলিতে বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম আমাদের প্রথম ক্যাম্প লক্ষ্মীবনের দিকে – দূরত্ব প্রায় ৩ কিমি। পুরো পথটাই প্রবল বোল্ডার জোন আর জমাট গ্লেসিয়ারে ভর্তি। গ্লেসিয়ারগুলো ছোট ছোট কিন্তু খুবই খাড়া আর পতন হলেই সোজা অলকানন্দার আহ্বান, ফলে জায়গায় জায়গায় স্টেপ কাটতে হচ্ছিল। বেলা দুটো নাগাদ এসে পৌঁছলাম লক্ষ্মীবন। মানা থেকে সতোপন্থ তাল পর্যন্ত প্রথম এবং শেষ গাছের (বৃক্ষ) দেখা মেলে এই লক্ষ্মীবনেই এবং সেগুলি ভূর্জপত্রের গাছ। পুরাণ অনুসারে এই গাছের বাকলেই ব্যাসদেবের কথনে গণেশ মহাভারত রচনা করেছিলেন। লক্ষ্মীবনের ক্যাম্পগ্রাউণ্ডটাও ভারি সুন্দর। একদিকে গগনচুম্বী পর্বত, অপরদিকে অলকানন্দা এখানে সুবিস্তৃত। পুরো ক্যাম্পগ্রাউণ্ড জুড়েই সরু সরু জলের ধারা। ক্যাম্পসাইট থেকে ভূর্জপত্রের বনে যাওয়ার পথ প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি উৎরাই। সদ্য বরফ গলার কারণে মাটি ভিজে এবং পিচ্ছিল। পথে কয়েকটা প্রমাণ সাইজ বোল্ডার দেখে তাতে হাত-পা মক্‌শ করার লোভ সামলানো গেল না। উল্টোদিকে একটা অনামা গ্লেসিয়ার নেমে এসেছে অলকানন্দাকে পুষ্ট করার জন্য আর তার পেছনে একগুচ্ছ সূচীমুখ পর্বতশৃঙ্গ – স্থানীয় বিশ্বাসে কুবের বা যক্ষের পুরী। সূর্যের আলো পড়ে আসতেই লক্ষ্মীবনের উচ্চতা ঠাণ্ডার জানান দিতে লাগল। টেণ্টে ফিরে এলাম। এখানে সূর্য ডোবে প্রায় সাতটা নাগাদ, তার আগে খেয়ে নেওয়াই দস্তুর, কারণ আগুন জ্বালানোর কোন ব্যবস্থা নেই। রাতে ঘুম ভাল হল না, চতুর্দিকে গ্লেসিয়ার ভাঙার শব্দ।
সকালে লক্ষ্মীবনের আরেক রূপ! পুবের আলো সোজা পড়েছে চৌখাম্বা ফোর-এ, আর শেষনাগ পাহাড়ের ওপর কুণ্ডলীকৃত মেঘের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন সদ্য উনুন ধরিয়েছে। আটটা নাগাদ হাঁটা শুরু হল এক প্রাণান্তকর বোল্ডার জোন দিয়ে। আজ (২৩/০৫/২০১৩) আমরা লক্ষ্মীবন থেকে ৩ কিমি দূরে বলপাটি হয়ে যাব চক্রতীর্থ, পথে পড়বে সহস্রধারা, নীলকণ্ঠ বেসক্যাম্প, পার্বতীকুণ্ড আর ডানদিক বরাবর চলবে অলকাপুরি গ্লেসিয়ার। বলপাটিতেও দুটো গুহা আছে, একটা বেশ বড়ো, বসবাসযোগ্য, অপরটার ভেতরে-বাইরে আপাততঃ কয়েক ফুট বরফের চাদর। বলপাটি থেকে এক কিলোমিটার যেতেই শুরু হল অনন্ত হিমানি সাম্রাজ্য। বাঁদিকে পড়ল সহস্রধারা। এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে অগুনতি জলের ধারা নেমে এসেছে বলে এই নাম, তবে এখন অধিকাংশই জমে রয়েছে।
প্রাণান্তকর চড়াইয়ে ঘণ্টাখানেক যুদ্ধের পর অবশেষে পার হলাম সহস্রধারা। ডানদিকে দেখা যাচ্ছে অলকাপুরি গ্লেসিয়ারের স্নাউট (অলকানন্দা নদীর উৎস), আর বাঁদিকে দূরে প্রথম দেখা গেল নীলকণ্ঠ, তার পাশে পার্বতী। বদ্রীনাথ থেকে নীলকণ্ঠ পর্বতের যে ক্লাসিকাল রূপ দেখতে আমরা অভ্যস্ত, এখানে কিন্তু তা সম্পূর্ণ অন্যরকম; আসলে আমরা এখন চলে এসেছি নীলকণ্ঠের ঠিক উল্টোদিকে। এখান থেকে আমাদের আজকের লক্ষ্য চক্রতীর্থ আরও প্রায় ৮ কিমি দূরে। পুরোটাই যেতে হবে বরফ ভেঙে। মাঝে মাঝে কয়েকটা বিক্ষিপ্ত পাথর সমুদ্রের বুকে দ্বীপের মত মাথা তুলে রয়েছে, সেখানে উঠে উঠে জুতোর বরফ ঝাড়ছি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নীলকণ্ঠ বেসক্যাম্প, পথে বাঁদিকে পড়ল জমাট বেঁধে যাওয়া পার্বতীকুণ্ড। আমরা বরফ ছেড়ে উঠে এলাম ডানদিকে পাথুরে রিজের মাথায়। নীলকণ্ঠ বেসক্যাম্পের নীচে পৌঁছলাম তখন বেলা একটা।
এবার পথ বেশ বিপদসঙ্কুল। পুরোটাই অ্যাভালাঞ্চ জোন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপরের আইস শেরাক ফাটার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। আমাদের দ্বিতীয় দিনের ক্যাম্প আরও ৩ কিমি। পায়ের নীচে বরফের তলায় কুল কুল করে জল যাওয়ার আওয়াজ আর দূরে পাহাড়ে পটকা ফাটার মত অ্যাভালাঞ্চের গর্জন। যখন চক্রতীর্থ দেখতে পেলাম ঘড়িতে সোয়া তিনটে বাজে। তিন-চারশো মিটার খাড়া বরফের ঢাল দিয়ে নেমে একটা বাটির মত জায়গা। কিন্তু টেণ্ট পিচ করব কোথায়? পুরোটাই তো দেখি গ্লেসিয়ারের দখলে! হাঁটতে আর ইচ্ছে করছিল না, তাই বসে স্লাইড করে নেমে গেলাম (স্যাকের তলাটা ফাটল)। চতুর্দিকে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা এই চক্রতীর্থ সম্বন্ধেও পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে যে শ্রীকৃষ্ণ এই স্থানে একদা তাঁর সুদর্শন চক্রটি রেখে বিশ্রাম নিয়েছিলেন – সেজন্যই স্থানটির এমন অদ্ভুত আকৃতি এবং এই 'চক্রতীর্থ' নাম। গ্লেসিয়ারের পাশে দু'একটা ব্রাউন প্যাচ, তার মধ্যেই একটা মোটামুটি কম ঢালযুক্ত জায়গায় টেণ্ট পিচ করলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সতোপন্থ তালের ধারে এক রাত থেকে পরদিন স্বর্গারোহিণী আইসফলের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের পোর্টার জানাল সে চক্রতীর্থের চড়াই মাল নিয়ে উঠতে পারবে না। কথাটা শুনে ভাল করে নজর করে দেখি "ওরে বাবা"! কিলোমিটার খানেক দূরে একটা প্রকাণ্ড প্রাচীর দেখা যাচ্ছে, তার ঢাল প্রায় ষাট ডিগ্রি, আর পুরোটাই পা হড়কানো শক্ত বরফে ঢাকা। অগত্যা চক্রতীর্থকে বেস করে সতোপন্থ দেখে ফিরে আসব এই সিদ্ধান্ত হল।
ক্রমে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তে শুরু করল আর শুরু হল তুষারে রঙের খেলা। সারাদিনের ক্লান্তির পর চোখ তুলে চারপাশে তাকিয়ে মোহিত হয়ে গেলাম। চক্রতীর্থের মত এমন সুন্দর জায়গায় রাত কাটানো প্রত্যেক ট্রেকারের স্বপ্ন। প্রায় ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায় এই বাটির মত জায়গাটার চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে নামী - অনামী অনেক তুষারশৃঙ্গ। গ্রাউণ্ডের অধিকাংশটাই তুষারাবৃত, আর আমাদের টেণ্টের কয়েক ফুটের মধ্য দিয়ে গ্লেসিয়ার গলা একটা ছোট নালা কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে। চোখের সামনেই তাপমাত্রা নামার সাথে সাথে নালার উপরিভাগ জমে ভারগ্লাস হয়ে গেল। কতগুলো নাম না জানা ছোট্ট পাখি বরফের বুকে জেগে থাকা পাথরে কেমোফ্লেজ করে লুকোচুরি খেলতে খেলতে যখন বাস্তবিকই দৃষ্টির অগোচর হল তখন হুঁশ ফিরল সত্যিই সন্ধে হয়েছে। রাতে যথারীতি সেই গ্লেসিয়ার ভাঙার আওয়াজ। মাঝরাতে একবার টেণ্টের বাইরে মাথা বের করে চমকে গেলাম - অদূরে তুষারাবৃত প্রান্তর আর চারপাশের তুষারশৃঙ্গে জ্যোৎস্নার প্রতিফলন এক অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গা ছমছম করে উঠল। ফের স্লিপিং ব্যাগের আশ্রয়ে ফিরে এলাম।
পরদিন (২৪/০৫/১৩) ভোর সাড়ে পাঁচটায় টেণ্ট থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে মাথা ঘুরে গেল। এরকম তিনশ ষাট ডিগ্রি জুড়ে সূর্যোদয়ের রঙ দেখার সৌভাগ্য কখনও হয়নি। পশ্চিম থেকে পুবে বালাকুন, চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ এবং আরও ছোট বড় চুড়োতে একে একে রঙ ধরছে আর তার প্রতিফলন হচ্ছে সামনে জমে থাকা জলের ধারায়। লাল থেকে সোনালি, সোনালি থেকে সাদা - পাগলের মত শাটার টিপেই চলেছি, এমন সময়, "স্যার কফি" – জগদীশ হাজির। ছোকরা আমাদের ট্রেক করা ছাড়া আর কিছুই করতে দেবে না প্ল্যান করে রেখেছে। কফি খেতে খেতে দূরের প্রাচীর সদৃশ চড়াইটা দেখছি আর বেশ ভয় পাচ্ছি, তখন আমাদের পোর্টার লাকিবাবু আমার কাছে একটা সাবান চাইলেন। তিনি নাকি ক্যাম্প ম্যানেজার হয়ে বসে থাকবেন আর ওই বরফ গলা জলে চান করবেন!
আটটা নাগাদ তিন মূর্তি রওনা হলাম সতোপন্থের উদ্দেশ্যে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল পাশাপাশি দুটো গুহা যেখানে গতরাতে দুই সাধুবাবা আশ্রয় নিয়েছিলেন। গুহাগুলো পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম প্রাণান্তকর বরফাবৃত চড়াইয়ের দিকে। প্রায় ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় রিজে পৌঁছে দেখি বিশ্রাম নেব কী! সেখানে পাশাপাশি দু'পা রেখে দাঁড়ানোরই জায়গা নেই। কোনোমতে ঘোড়ায় চড়ার মত করে বসে দেখি অপর দিকেও খাড়া ঢাল এবং প্রবল ঝুরো মাটি… তারপর বিস্তীর্ণ প্রান্তর… পুরোটাই তুষারাবৃত। তিনদিকে ঘিরে রয়েছে নীলকণ্ঠ, চৌখাম্বা, বালাকুন শৃঙ্গ; আর এদের থেকে নেমে আসা গ্লেসিয়ার একত্রিত হয়ে পুষ্ট করছে মূল অলকাপুরি গ্লেসিয়ারকে। ওপারে নামতেই শুরু হল এক নতুন উৎপাত- 'রক-ফল জোন'। দুরুদুরু বুকে এক দমে জায়গাটা পার হওয়ার পর জগদীশ আমাদের দেখাল দূরে আরও একটা তরোয়ালের মত ধারালো রিজের মাথায় একটা লাল পতাকা পত্‌পত্‌ করে উড়ছে। আমাদের গন্তব্য আগতপ্রায়। আসলে প্রকৃতিই এই জায়গাগুলোকে নিজের মত করে রক্ষাকবচ দিয়ে ঘিরে রেখেছে। সরু ঝুরো রাস্তায় ক্যাটওয়াক করে অবশেষে দেখা মিলল সতোপন্থ তালের। বিভিন্ন ভ্রমণ পত্রিকায় ত্রিভুজাকৃতি সতোপন্থ তালের যে পান্নাসবুজ রূপ দেখে আমাদের ট্রেকের পরিকল্পনা শুরু, সেই প্রচলিত ছবির সাথে আজকের দেখা তালের অনেক ফারাক। এখন লেকের চারপাশ তো বটেই, এমনকি জলেরও সত্তর ভাগ জমে বরফ। সাদার চালচিত্রে একচিলতে সবুজ জল যেন আরও বর্ণময় হয়েছে। ছবিতে দেখা মানা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৈরি লেকের ধারের একমাত্র আস্তানাটিও বরফের তলায়। তালের উপরের দিকে দু'টি গুহার একটিতে দেখি এক সুইস তান্ত্রিক আস্তানা গেড়েছেন, অপরটির মালিকানা রহস্যময়… তবে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য মজুত আছে।
রিজ ধরে স্বর্গারোহিণী আইসফলের দিকে কিছুটা এগিয়ে দেখি গ্লেসিয়ার নিজেই তাল পর্যন্ত চলে এসেছে, ফলে দুঃখ আরও কমে গেল। জগদীশের তাড়া সত্ত্বেও আমাদের ফটোগ্রাফির ঠেলায় রওনা হতে প্রায় বেলা একটা বাজল। প্রবল ঝুরো উৎরাই ভেঙে চলেছি এমন সময় আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়ার মত শব্দে সভয়ে তাকিয়ে দেখি নীলকণ্ঠের আইসক্যাপ থেকে অ্যাভালাঞ্চ নেমে আসছে। আমাদের রাস্তা থেকে শ'তিনেক মিটার দূর দিয়ে তিনি পার হলেন; বুঝলাম জগদীশের তাড়ার কারণ। রোদের তেজ বাড়ার দরুণ বরফের উপরিভাগ পিছল হয়ে ক্রমাগত পা হড়কাতে লাগল। অবশেষে আবার সেই তরোয়ালের মত গিরিশিরায় সওয়ার হয়ে তিনশ ষাট ডিগ্রি দর্শন এবং বিশ্রাম।
ফেরার সময় লক্ষ্য করলাম পথের দু'ধারে প্রচুর বেগুনি হলুদ ঘাসফুল ফুটেছে। সকালে ওদের দেখেছি বলে তো মনে পড়ল না, তবে কি সতোপন্থ তাল ঘুরে আসার জন্য প্রকৃতি তার নিজ পদ্ধতিতে স্বাগত জানাল? দূরে দেখা যাচ্ছে আমাদের টেণ্ট, আর সামনের গ্লেসিয়ারের গলা জলে ছায়া পড়ছে কুবের পর্বতের। মনটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল।

প্রয়োজনীয় তথ্য
কিভাবে যাবেনঃ হরিদ্বার থেকে বাসে বা গাড়িতে যোশিমঠ (যোশিমঠের শেষ বাস হরিদ্বার থেকে ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে ছেড়ে যায়)। যোশিমঠে পারমিট করিয়ে গাড়িতে বদ্রীনাথ হয়ে মানা গ্রাম।
পারমিটঃ সতোপন্থ তাল যেতে এখন আর ইনারলাইন পারমিট লাগে না। যোশিমঠের ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্ট থেকে ট্রেকের পারমিট করাতে হয় উপযুক্ত পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সাইজ ছবি দিয়ে। যোশিমঠে না থেমেও সরাসরি মানা চলে যাওয়া যায়; সেক্ষেত্রে আগে থাকতে পারমিট করিয়ে রাখা যায় মানা গ্রামের মন্নু সিং রাওয়াতের মাধ্যমে। বিশদ বিবরণ- M. Hill Adventures, Ph # 09412966171, 0955764463
পোর্টার-গাইডঃ এজন্য মন্নু সিং রাওয়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করাই ভাল, কারণ এই অঞ্চলে পোর্টার-গাইডের রেট অস্বাভাবিক বেশি।
আদর্শ সময়ঃ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর যাওয়ার জন্য ভাল সময়। তবে তুষারের সৌন্দর্য পেতে হলে মে-জুনে যেতে হবে।
মনে রাখা ভালঃ পথে অধিকাংশ পড়াও-এ প্রাকৃতিক গুহা থাকলেও টেণ্ট নেওয়াই সমীচীন, কারণ একাধিক দল গেলে স্থান সঙ্কুলান হওয়া মুশকিল।


সতোপন্থ তাল ট্রেক রুট ম্যাপ ~ ট্রেকের আরও ছবি

 

পেশায় ব্যবসায়ী সুজয় গোস্বামী পাহাড় আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বেরিয়ে পড়েন যখন তখন।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher