বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য এবার পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পত্রিকার পাতায়।

 

[আনুমানিক ১৮৫৭ সালে অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার হরিপুরে প্রসন্নময়ী দেবীর জন্ম হয় - দুর্গাদাস চৌধুরী ও মগ্নময়ী দেবীর প্রথম সন্তান। শৈশবে পিতার কাছেই লেখাপড়ার প্রাথমিক পাঠ। দশ বছর বয়সে পাবনা গুণাইগাছার কৃষ্ণকুমার বাগচীর সঙ্গে বিবাহ। বিয়ের মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যে স্বামী উন্মাদরোগগ্রস্ত হওয়ায় প্রসন্নময়ী বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসেন। তাঁকে ইংরেজি ও গীতবাদ্য শেখানোর জন্য মেম-শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত করা হয়। অসুস্থ শরীর সারাতে দুই ভাইয়ের সঙ্গে উত্তর ভারত ভ্রমণ করেন প্রসন্নময়ী। ঊনবিংশ শতকে 'আলোচনা' ও 'নব্যভারত' পত্রিকায় তাঁর এই ভ্রমণ কাহিনি 'আর্য্যাবর্ত্তে বঙ্গমহিলা' নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। এইসময়ে তিনি 'নীহারিকা' ছদ্মনামে লিখতেন। এরই প্রথম অংশ পুস্তকাকারেও সেইসময় প্রকাশিত হয়েছিল। 'আর্য্যাবর্ত্ত – জনৈক বঙ্গমহিলার ভ্রমণকাহিনী' – ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত এই বইটিই বাঙালি মহিলার লেখা প্রথম ভারত ভ্রমণ পুস্তক। আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই অনেক পরে তিনি আরও দুটি ভ্রমণ কাহিনি লিখেছিলেন 'সুপ্রভাত' এবং 'নবশক্তি' পত্রিকায়। সেই সময়কার নানা সাময়িকপত্রে তাঁর কবিতা ও নানাবিধ গদ্যরচনা প্রকাশিত হত। তাঁর প্রথম কবিতার পুস্তক 'আধ-আধ-ভাষিণী' ১৮৭০ সালে (১২৭৬ বঙ্গাব্দে) প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই – 'বনলতা' ও 'নীহারিকা' (কাব্যগ্রন্থ), 'অশোকা' (উপন্যাস), 'আর্য্যাবর্ত্ত' (ভ্রমণ-বৃত্তান্ত), 'পূর্ব্বকথা' (আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ)। একমাত্র সন্তান প্রিয়ম্বদা দেবীও লেখিকা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। বেশ কয়েকটি ভ্রমণ কাহিনিও লিখেছিলেন প্রিয়ম্বদা। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্নময়ীর মৃত্যু হয়।
'নব্যভারত'-এ প্রকাশিত মূল ধারাবাহিক লেখাটির কিছু নির্বাচিত অংশ এখানে প্রকাশিত হল।]

আর্য্যাবর্ত্তে বঙ্গমহিলা

প্রসন্নময়ী দেবী


এটোয়া পরিত্যাগ।

২৪ ফেব্রূয়ারি, প্রত্যুষের ট্রেণে আমরা এটোয়া ত্যাগ করিয়া আগ্রাভিমুখে যাত্রা করি। প্রভাতে গাড়ী "তুণ্ডুলা" পৌঁছিলে সে গাড়ী ছাড়িয়া আগ্রার গাড়ীতে উঠিলাম এবং ৮৷৷৹ ঘটিকার সময় আগ্রা গিয়া উত্তীর্ণ হইলাম। কতক পথ যাইতে না যাইতে অর্দ্ধ-প্রকাশিত, অর্দ্ধ-লুক্কায়িত ভাবে নীলাকাশ স্পর্শ করিতে করিতে তাজমহলের ধবল প্রস্তর নির্ম্মিত অপূর্ব দীপ্তিময় শিল্প-প্রভার উজ্জ্বল গৌরব আমাদিগের দৃষ্টিপথে সহসা প্রতিভাত হইল, এবং সেই স্বপ্নময় স্মৃতিমাখা তাজের গগণস্পর্শী শ্বেত চূড়া কতক দেখিয়াই কেমন যেন এক মোহ স্বপ্নে ডুবিয়া গেলাম। আমি সে অবস্থা বর্ণনার চেষ্টা করিব না। চক্ষের সম্মুখে সকলি জীবন্ত চিত্র, অথচ যেন তাহা বহু দিন দৃষ্ট অতীত স্বপ্নবৎ ভাবপূর্ণ, স্মৃতিতে জাগিবে জাগিবে করিয়া জাগিতেছে না, দেখিতে পাওয়া যাইতেছে সব, কিন্তু ছুঁইতে কি ধরিতে ক্ষমতা নাই। দূর হইতে সেই মানসমোহন তাজমহলের শিখরমালা নিরীক্ষণ করিয়া কত আশার কথা, কত নিরাশার অশ্রু হৃদয়কে সুখে দুঃখে হাসি কান্নাময় করিয়া ফেলিল, - আমি আমাকে তখন ভুলিবার জন্য অন্যমনা হইবার প্রয়াস পাইলাম, এমন সময় উদার সৌন্দর্য্য-পূর্ণ সুবিস্তৃত যমুনা সেতু দেখিয়া মুহূর্ত্ত মধ্যে তাজমহল ভুলিয়া গেলাম এবং "যমুনা লহরী" সঙ্গীতের "নির্ম্মল সলিলে বহিছ সদা, তটশালিনী সুন্দর যমুনে ও" ভাবিতে ভাবিতে সেতু পার হইলাম।
আমরা গাড়ী হইতে নামিয়া পথভ্রান্ত পথিকপ্রায়, ক্লান্তভাবে, কোথায় যাইব, কি করিব ভাবিয়া (Overland) সেতুর উপর কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। তখন একজন হিন্দুস্থানী, বর্ণে কাফ্রী বিনিন্দিত, নাসিকায় চীনবাসী লজ্জা পায়, স্বশরীরে আসিয়া আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া একখান খাতা দেখাইল। তাহাতে অনেক বাঙ্গালী যাত্রীর পরিচিত নাম দেখিয়া আমরাও তাহার গৃহে বাসা লইতে স্বীকৃত হইলাম। তার গৃহে যাইবার সময় পথি-মধ্যে কয়েকটী স্ত্রীলোক সহসা আমাদিগকে যেন ছিনাইয়া লইবার চেষ্টা করিল। তাহারা ইতর স্ত্রীলোক, বিদেশী পথিকদিগকে প্রলোভন দেখাইয়া আগে নিজ গৃহে লইয়া যায় ও পরে যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করে। আমরা বহু কষ্টে সেই মায়ারূপিনী রাক্ষসীগণের হস্ত হইতে নিস্তার পাইয়া পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তির গৃহে বাসা লইলাম।
আমরা যে গৃহে বাসা লইয়াছিলাম, তাহা দ্বিতল ও যমুনা নিকটস্থ রাজ পথবর্ত্তী। পথশ্রান্তির পর তাহা পরিপাটী এবং নয়ন-তৃপ্তিকর বোধ হইল।
আমরা আসিবা মাত্র কিরূপে যে সেই সংবাদ আগ্রাবাসী ফেরিওয়ালাদিগের মধ্যে টেলিগ্রাফ হইল, সে রহস্যভেদ করিতে এখনও পারি না। অল্প কালের মধ্যেই তাহারা ঝাকে২ আসিতে লাগিল ও নানা প্রকার কারুকার্য্য বিশিষ্ট বিবিধ প্রস্তর সামগ্রী বিক্রয়ার্থে আনিয়া মন ভুলাইতে লাগিল। সেই সকল সুন্দরতর শিল্পকার্য্য দেখিয়া মন আনন্দে পরিপ্লুত হইয়া যায়। তবে তাহার অসম্ভব মূল্য শুনিয়া দীনহীনের হর্ষ বিষাদে পরিণত হইয়া থাকে। ধর্ম্মভয়-বিরহিত বিক্রেতাগণ সর্ব্বত্রই সমান। সেই বিক্রেতাদিগের মধ্যে কেহ কেহ আবার অপেক্ষাকৃত কিছু বেশি বুদ্ধিমান্। তাহারা বিক্রীত দ্রব্যের সহিত অনেক বড় লোকের নামও মস্তকে বহন করে এবং বাঙ্গালী দেখিলে তাহা বিজয় নিশান স্বরূপ দর্শন করাইয়া থাকে। তাহাদিগের সেই পণ্য দ্রব্যের অংশ রূপ নামাবলীর মধ্যে প্রত্নতত্ত্ববিৎ শ্রীযুত রাজেন্দ্র লাল মিত্র মহাশয়ের নাম দেখিলাম। কিন্তু তাহাতে দাম করিয়া দ্রব্যক্রয়ের কোনই সুবিধা হইল না। তখন ভাবিলাম, "স্বদেশীয় (এন্টিকোয়েরিয়ান) পণ্ডিত ব্যক্তির নামে বিদেশে সুলভ মূল্যে কিছু পাওয়া যায় না, বরং বড় লোকের রেটে গরিবরা অনেক সময় মারা যায়।" দূর প্রবাসে স্বজাতির পণ্ডিত ব্যক্তির অপরিচিত নিদর্শন হস্তাক্ষর দেখিয়া, সত্যই বড় আনন্দিত হইয়াছিলাম। তাহা দেখাইয়া যে বিক্রেতাগণ আমাদিগকে ঠকাইতে পারে নাই, সে জন্য এখনও সন্তুষ্ট আছি। আমরা আহারান্তে সেই দিনই আগ্রানগরী, তাজ এবং যমুনার শোভা দেখিবার জন্য বাহির হইলাম।

অগ্রবন
(আগ্রা)

অগ্রবন মোগল বাদসাহদিগের সময়ের মহা সমৃদ্ধিশালী রাজধানী ও হিন্দুদিগের একটী তীর্থ, মথুরা বৃন্দাবনের চৌষট্টি ক্রোশের মধ্যে যে সকল স্থান আছে, সে সমুদায় তীর্থ মধ্যে পরিগণিত এবং তাহাদের অগ্রবর্ত্তী বলিয়াই আগ্রার প্রাচীন নাম অগ্রবন। ভক্তবৎসল শ্রীকৃষ্ণ এখানেও বিহার করেন, তাহাতেই তীর্থযাত্রী বৈষ্ণবগণ রীতিমত পূর্ব্বে অগ্রবন পরিদর্শন ও যমুনায় স্নানাদি করিয়া শেষে মথুরা বৃন্দাবন যায়। আমরা তীর্থ-যাত্রী না হইলেও, আগে অগ্রবন দর্শন করি, তবে যমুনায় স্নান করিবার সৌভাগ্য আমার ভাগ্যে ঘটে নাই।
যমুনার তীরপরি সৌষ্টবময়ী শ্রী-সম্পন্না "সুন্দরীতরা" প্রস্ফুটিতা নগরী আগ্রা আলেখ্যবৎ বিরাজিতা। তাহার অতুলনীয় "ধবল সৌধছবি" নীল সলিলে আপনার মুখ আপনি দেখিয়া দেখিয়া যেন প্রতিবার মুগ্ধ হইয়া যাইতেছে। সেই প্রতিবিম্বিত রূপরাশি "মরি মরি কোন বিধাতা গড়িয়া ছিলরে।" দর্শকের চিত্তমুগ্ধকর সে শোভার কথা কিরূপে ভাষায় প্রকাশ করিব?
অসংখ্য জনস্রোত আগ্রার বৃহৎ প্রস্তরময় রাজপথে অবিরাম প্রবাহিত হইতেছে, তাহার বিরাম নাই, কেবলি কলরব ও মনুষ্যমস্তক শুনিবে এবং দেখিবে মাত্র। সেই কঠিন শিলাময় ধূলিরঞ্জিত রাজবর্ত্মে পদব্রজে বাহির হওয়া সুখকর ব্যাপার বোধ হয় না।
আগ্রার বিপণীগুলি পরিপাটী রূপে সুসজ্জিত এবং প্রস্তরের কারুকার্য্যের দোকান সকল নয়ন-প্রীতিকর। পথিকগণ রাজ পথে চলিতে চলিতে অনেক সময় অনন্যমনে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া যায় ও তাহা দেখিয়া যেন পথক্লান্তি দূর করিয়া থাকে।

তাজ।

যখন অস্তগামী অংশুমালীর কনক-কিরণে পশ্চিমাকাশ অনুরঞ্জিত, সেই হৈম রশ্মিকণা যমুনার নীলবক্ষে মৃদুল তরঙ্গে কখন ভাসিয়া, কখন ডুবিয়া জলক্রীড়া করিতেছিল, যমুনা-হৃদয়ে সেই কিরণমালার লুকোচুরী খেলা – শোভার মাধুরী নয়ন ভরিয়া দেখিতে দেখিতে দিবাবসানে আমরাও তাজমহলের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম।
ইতিহাসে ও বন্ধুপ্রমুখাৎ আশৈশব শ্রবণ করিয়া এবং কল্পনা নেত্রে নির্জ্জনে কখন কখন দেখিয়া তাজমহল যেন আমার চিরপরিচিত হইয়া গিয়াছিল। সে কল্পনা-জাত মানসচিত্র তাজমহল, এখন আবার তাহার অপূর্ব্বশরীরী মাধুরীময় ছবি, সেই সর্ব্বজন-মনোমোহনমূর্ত্তি চক্ষুর সম্মুখে জীবন্ত হেরিয়া হৃদয় কেমন যে হইয়া গেল, সৌন্দর্য্য-মুগ্ধ আমি স্তম্ভিত ও অবাক হইয়া গেলাম এবং মুহূর্ত্ত মাত্র শূন্য দৃষ্টিতে সেই অনন্ত শোভাপূর্ণ অমরাবতীসম প্রণয়-সমাধি-সৌধের কারুকার্য্য নিরীক্ষণ করিয়া আত্মহারা হইয়া কি যেন ভাবিতে লাগিলাম। সে স্মৃতিময় চিন্তা শৈশবের সুখস্বপ্নের মত অস্ফুট নহে। প্রকৃত প্রণয়ের প্রথম দৃষ্টির ন্যায় তাহা মধুময়, প্রিয়তমের প্রেম-সম্ভাষণের ন্যায় তাহা প্রাণস্পর্শকর, ললিত সঙ্গীত অনুভবে আজিও তাহা হৃদয়ে সজীবতা আনিয়া দেয়। সে স্মৃতি ভুলিবার নহে। পৃথিবীতে "সাতটী আশ্চর্য্য দ্রব্য" আছে, আমার ভাগ্যে অন্যগুলির দর্শন না ঘটিলেও, তাজমহলকে সর্ব্বশ্রেষ্ট বলিতে যেন ইচ্ছা করে। কঠিন প্রস্তরে ললিত সঙ্গীত, ভাবুক জনহৃদয়ে আশার হাস্য, প্রণয়ের স্বপ্নময় সুখদ সম্মিলন এবং শিল্পের চরোমোৎকর্ষ অপূর্ব্ব শিলায় একত্র সন্নিবেশিত দেখিয়া, কে না ক্ষণকালের নিমিত্ত, এই রোগ শোক দুঃখ বিজড়িত পার্থিব জগৎ এবং মনুষ্যজীবনের গত নৈরাশ্যের যন্ত্রণা ভুলিয়া যাইবে?
মৃতপত্নীর প্রণয়-স্মৃতি ইহ জগতে চিরস্থায়ী করিবার জন্য এই অমূল্য, অতুলনীয় তাজ (সমাধি) নির্ম্মিত হইয়াছে। অপরিমিত অর্থ, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং শিল্পের চরমোৎকর্ষ ইহাতে পর্য্যবসিত হইয়া গিয়াছে। তীর্থস্থানে কোন মহাপুরুষ কিম্বা কোন দেবমূর্ত্তি দর্শন করিবার নিমিত্ত পর্ব্বদিনে যেমন জনসমাগম হইয়া থাকে, তেমনি প্রতিদিন প্রদোষে এই অমর সমাধি দর্শনার্থে অগণ্য লোক একত্র দেখিতে পাওয়া যায় ও বারেক মাত্র সকলে যেন ইহার শোভা দেখিয়া নয়ন সার্থক জ্ঞান করে। প্রদীপ্ত চন্দ্রালোকে তাজ দেখিতে আরো মনোহর।
তাজমহলের অনির্ব্বচনীয় সৌন্দর্য্য সন্দর্শন করিয়া জনৈক ইংরাজ মহিলা একটী কবিতায় লিখিয়াছিলেন যে, "তুমি নারী কুলে ভাগ্যবতী, তাই এই স্বর্গীয় রশ্মিমালাবিনির্ম্মিত তাজ তোমার সমাধিমন্দির, তুমিই পতি-সোহাগিনী, তোমার ন্যায় ভাগ্য এজগতে কাহার আর?" কিন্তু আমি তাজ দেখিয়া এত যে মোহিত হইয়াছিলাম, স্বর্গের স্বাপ্নিক মাধুরী যেন প্রস্তরে বিকশিত দেখিলাম বোধ হইল, - তথাচ আমি মনে করি, প্রকৃত অকৃত্রিম অপার্থিব পবিত্র প্রণয় এই সুন্দর মহান সমাধি-সৌধ তাজ অপেক্ষা সুন্দরতর, মহত্ত্বতর ও অনন্ত সজীব। প্রকৃত এবং অমর প্রণয়ের গৌরবে অযুত অযুত তাজ নিমগ্ন ও বিলীন হইয়া যায়। যে প্রণয়ে নাস্তিক হৃদয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও পরলোকে বিশ্বাস, ব্রাহ্মে পৌত্তলিকতা এবং ইহজীবনেই অনন্ত অক্ষয় জীবন্ত স্বর্গ আনয়ন করে ও যে প্রেমে দুই পৃথক আত্মা একত্রীভূত হইয়া পরমাত্মাতে শেষে সম্মিলিত হয়, ও একের অস্তিত্বে অন্য জীবন ধারণ করে, সে প্রণয়ের স্মৃতি চিরস্থায়ী করিবার জন্য কোন পার্থিব সমাধির যে প্রয়োজন আছে, আমি ত তাহা বুঝিতে পারি না। একজনের মৃত্যুতে অন্য একজন জীবিত, ইহলোকেই যাহার জীবন্ত সমাধি হইয়া থাকে, সেই অপার্থিব প্রেমের অবিনশ্বর সমাধির স্থান এ অনন্ত বিভব নহে। তাজমহল স্বরূপ অলৌকিক সমাধিমন্দির দেখিয়াও তাহার অভ্যন্তরে চিরনিদ্রিতা সাজাহান প্রেয়সী মহিষীকে "নারীকুলে ভাগ্যবতী" কিম্বা "পতি-সোহাগিনী" বলিয়া আমি মনে করি না।
তাজ দেখিয়া অনেক ইংরাজ ভ্রমণকারী নানা প্রকার মত প্রকাশ করিয়াছেন, সে সকল এস্থলে উল্লেখ করিবার কোন প্রয়োজন নাই – কিন্তু কিছুদিন হইল একজন ইংরাজ, Statesman পত্রিকায় ঐ বিষয় সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছিলেন, তাহাতে বেশ একটু নূতনত্ব ও সার আছে এবং আমি তাঁহার মত সম্পূর্ণ সহানুভূতির সহিত গ্রহণ করিয়াছি।
সাজাহান আপন সুন্দরী প্রিয়তমা রমণীর সমাধিহর্ম্ম্যে অগণ্য অর্থ ঐ প্রকারে ব্যয় না করিয়া, যদি তাঁহার স্মরণার্থে কোন পতিতাশ্রম, পান্থশালা কিম্বা কোন শিক্ষালয় স্থাপন করিয়া যাইতেন, তাহাতে তাঁহার কীর্ত্তিময় উপকার জগতে যেমন চিরস্থায়ী ও স্মরণীয় হইত, ইহাতে সে প্রকার কিছু হয় নাই। কখন কোন পথিক দর্শক, অথবা কোন ভ্রমণকারী একদিন মাত্র তাজ দেখিয়া যে সুখ পায়, তাহা অকিঞ্চিৎকর! তাজমহলের দ্বারা সংসারের অন্য কোনই উপকার দেখি না। ইহাকে হৃদয়বিহীন পাষাণময়ী দেব প্রতিমার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে, কারণ, বাহিরে তাহার অতুলনীয় শোভাময় হেম কিরণবৎ মাধুরী ঝরিয়া পড়িতেছে যেন দেখিয়া মনে হয়, অঙ্গুলী দ্বারা স্পর্শ করিতে সাহস হয় না, বোধ হয় যেন মনুষ্যের কর স্পর্শে তাহার দেবত্ব, কমনীয় কান্তি মলিন হইয়া যাইবে, "ছুঁইলে নখের কোণে বিষম বাজিবে প্রাণে" ভাবিয়া কোমন স্নেহের করেও স্পর্শ করিতে প্রাণে কেমন ব্যথা লাগে, কিন্তু তাহার হৃদয় মাঝারে মৃত শরীর সমাধি শয্যায় প্রোথিত রহিয়াছে, ভাবিলে, কল্পনায়ও মন বিষণ্ণ হইয়া যায়। বাহিরের চাকচিক্যে ভিতরের মলিনতা দূর হয় না। অমিশ্রিত পবিত্রতা অতীব উপাদেয় এবং অপার্থিব।
তাজমহলের ভিতর প্রবেশ করিবার সময় মুসলমানগণ জুতা পরিহার করিতে বারম্বার অনুরোধ করে এবং কখন বা দীন হীন দেখিলে কিছু কর্কশতা প্রদর্শন করিয়া থাকে। কিন্তু শ্বেতপদের সর্ব্বত্র সমান সম্মান ও অধিকার, মানবের সমাধি-মন্দির-প্রবেশে দেবজাতি পাদুকা ত্যাগ করিবে কেন? এই পাদুকা রহস্য অবলম্বন করিয়া সেই স্থানীয় মুসলমানেরা বিষণ্ণ ভাবে যাহা বলে, তাহার অর্থ, -

"বৃটিশ সিংহের বিকট বদন,
না পারি নির্ভয়ে করিতে দর্শন,
কি বাণিজ্যকারী অথবা প্রহরী –
জাহাজী গৌরাঙ্গ কিবা ভেকধারী,
সম্রাট ভাবিয়া পূজি সবারে।"

তাজমহল, তাহার সম্মুখস্থ রমণীয় পুষ্পোদ্যান এবং তাহার হৃদয়ে কৃত্রিম উৎস একে একে নয়ন ভরিয়া অবলোকন করিয়া পরিশেষে আমরা সায়াহ্ন সমীরণ সেবন করিতে করিতে মন্দির ইসলামদৌলা* (ইহার প্রকত উচ্চারণ আমি জানি না, সেখানে যাহা শুনিয়াছি, তাহাই লিখিলাম) গিয়া পৌঁছিলাম। এই রম্য হর্ম্ম্যের প্রস্তরময় ভিত্তি যমুনা-বক্ষে প্রোথিত। আগ্রার সৌধমালার প্রত্যেকটীর এমন এক অপরূপ সৌন্দর্য্য আছে যে, তাহার কোন্‌টী রাখিয়া কোন্‌টী দেখিব, তাহা অনুমান করা যায় না। বাদসাগণ এই ইসলামদৌলার প্রশস্ত উচ্চ প্রোথিত প্রাঙ্গণে বসিয়া প্রদোষে যমুনার জলক্রীড়া দর্শন করিতেন। সেই অনৈসর্গিক রূপরাশি যমুনা, যখনি দেখা যায় তখনি মন আহ্লাদে পরিপ্লুত হইয়া থাকে, বটে, কিন্তু সৌন্দর্য্যময়ী নীলবর্ণা যমুনা বর্ষাকালে যখন পূর্ণাঙ্গিনী হইয়া রূপভরে উছলিয়া পড়ে, তৎকালে তাহার সেই তরঙ্গায়িত পূর্ণ মাধুরী কল্পনাতীত শোভা ধারণ করে। অতীতের সাক্ষী-রূপিণী "লীলাময়ী যমুনার তরঙ্গ" নিচয় দর্শন করিয়া অনেক বিষাদময়ী চিন্তার আঘাত আমার হৃদয়ে লাগিয়াছিল।
উৎসব দিবাবসানে, প্রিয়জন প্রবাসগমনে, বিজয়াদশমীর দিনে, নির্জ্জন গৃহে একক নিশীথে হৃদয় যেমন এক প্রকার অবসাদ ও পরিত্যক্ত ভাবে নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিমগ্ন হইয়া যায় ও সুখময় ভূত স্মৃতি কেবল মাত্র শূন্যতা আনয়ন করে, যমুনার তীর ছাড়িয়া আমার মনও সেই প্রকার কেমন এক অবসন্ন ভাবে বিষাদে ডুবিয়া গিয়াছিল। অশান্তির স্বপ্নময় ভাঙ্গাভাঙ্গা নিদ্রায় দীর্ঘ রজনী অতিবাহিত করিলাম। সুখ দুঃখ উভয়ই সমানে চলিয়া যায়, তাহার স্মৃতিমাত্র আমরা আজীবন অন্তরে বহন করি। এস্মৃতিও চিরদিন আমার হৃদয়ে জাগরূক থাকিবে।

দুর্গ।

পরদিন অরুণোদয়ে শয্যা ত্যাগ করিয়া আমরা আগ্রাদুর্গ প্রবেশার্থে "পাস" (Pass) সংগ্রহে ব্যস্ত হইলাম। বিশ্রাম বারে (রবিবার) ইংরাজের আফিস ইত্যাদি বন্ধ, সুতরাং পাস পাইতে সে দিন একটু পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিতে হইল। শুনিলাম, সেখানকার Brigade General লোক ভাল, ভদ্রলোকের সম্মান রাখিয়া থাকেন। আমরা তাঁর কর্ম্মচারীগণের নিকট পাস পাইলাম। আমরা দুর্গ ইত্যাদি দেখিবার জন্য বেলা প্রায় দ্বিতীয় প্রহরের সময় বাসা পরিত্যাগ করিলাম। প্রথমে দুর্গদ্বারে প্রবেশ করিবামাত্র জনৈক সজ্জিত শিক সৈনিক আমাদিগের পাস দেখিতে চাহিল। আমাদের গাড়ীর বাহিরে General সাহেবের চাপরাশি ছিল, সে মুখে পাস আছে কহিয়া অন্যদ্বারে গাড়ী লইয়া গেল। আমরাও সেই স্থানে গাড়ী হইতে নামিলাম। দিবা দ্বিপ্রহরে পশ্চিমের আতপ তাপে দগ্ধ হওয়া বড় সুখকর নহে। প্রস্তরময় ভূমি, - তপ্ত অগ্নিকণাবৎ পদতল তাহাতে নিষ্ঠুর ভাবে দগ্ধ করিয়া এবং প্রচণ্ড সূর্য্যকর মস্তকে ধরিয়া পুড়িতে পুড়িতে তখন দুর্গের মধ্যে যাইবার নিমিত্ত দ্বিতীয় দ্বারে গিয়া দাঁড়াইলাম। সেখানে একজন গোরা সৈনিক পাহারায় বসিয়াছিল, সে আবার পাস "তলপ" করিল। এবার ত আর মুখের কথায় চলেনা, এবার তা দেখাইতে হইল। সে তাহা সম্রাট সম প্রভুত্বের সহিত মঞ্জুর করিলে আমরা দুর্গ মধ্যে যাইতে পারিলাম।

আগ্রা-দুর্গ হৃদয়ে আর একটী চিত্রিতা সুন্দরী নারী যেন শোভা পাইতেছে। তাহার মনোমোহন সৌন্দর্য্য, তখন তৃপ্তিকর চারুতা দেখিয়া কতক্ষণ চাহিয়া থাকিতে হয়। অচেতন সৌন্দর্য্য, সচেতন জীবের প্রাণে কত আনন্দ দেয়। ইংরাজ সৈনিক পুরুষদিগের বাসগৃহগুলি এই দুর্গের ভিতর এবং তাহা অতি পরিপাটী ও পরিষ্কার। প্রাঙ্গণে সুস্থকায় প্রফুল্ল স্বাধীন প্রকৃতি ইংরাজ বালক বালিকাগণ আনন্দে ক্রীড়া করিতেছে – যেন শকুন্তলা-সুত সিংহ-শিশুর কেশর ধরিয়া বিক্রমে খেলিতেছে – এমনি স্বাধীন ও জীবন্ত ভাব। ভারতের অতীত দিনে বীরপুত্রগণ যেরূপ করিয়া ক্রীড়া করিত, তাহা কেবল পুরাণ এবং ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু এই বালকের স্বাধীনতাময় খেলায় ও নির্ভীকতায় সেই ভূত কালের চিহ্ন কিছু রহিয়াছে মনে হয়।
পূর্ব্বে যেখানে বাদসাহদিগের বিলাসভূমি ও আরাম নিকেতন ছিল, আজি সেখানে বিদেশীয় সামান্য সৈনিকগণের বাস, - ইহা দেখিলে ভবিষ্যৎ সে চির অজ্ঞাত ও ধন, সম্পদ, মান, সম্ভ্রম যে কেবলমাত্র কথার কথা, ইহাই মনে হয়। যে জীবনের শেষ চিহ্ন শ্মশান-মৃত্তিকায় কিম্বা সমাধিতলে, তাহার জন্য এত হিংসা দ্বেষ বা পরনিন্দা কেন?
"মতি মসজিদ" ও অন্যান্য প্রাসাদগুলিও এই দুর্গের মধ্যে অবস্থিত। "মতি মসজিদ" মোগল বাদসাহগণের পারিবারিক ভজনালয়, ইহাও মর্ম্মর বিনির্ম্মিত, এবং দেখিতে যেমন মনোহর, তেমনি মূল্যবান্ প্রস্তরে পূর্ব্বে ভূষিত ছিল। এখনও তাহার সেই রাজকীয় গৌরবের কতক কতক নিদর্শন রহিয়াছে, কিন্তু সে স্বজনতা আর নাই। সমাধিমন্দির অমরাবতীসদৃশ নিরুপম শোভান্বিত হইলেও, তাহার জীবনশূন্য পরিত্যক্ত ভাবে দর্শকের চিত্তরঞ্জন করিতে পারে না। যখন বন্ধু বান্ধব পরিবেষ্টিত হইয়া উপাসনালয়ে বাদসাহগণ "নমাজ" করিতেন, সে এক দিন, আর আজ এ এক দিন। সময়ের সর্ব্বসংহারক মূর্ত্তি কি ভয়ানক! যাহা যায়, তা আর ত ফিরিয়া আইসে না। থাকে কেবল - শোকের হাহাকার দৃশ্য!
বাদসাহদিগের সায়াহ্ন সমীরণ-সেবন-স্থান কেমন পূর্ব্ব আরাম স্মরণ করাইয়া দেয়। এই খানে বসিলে যমুনার লীলাময়ী শোভা মুক্তভাবে নয়নে প্রতিভাত হইয়া থাকে। আমরা ঘুরিতে ঘুরিতে যেই এই খানে আসিয়া দাঁড়াইলাম, কে যেন "যাদুকর দণ্ডসম পরশি হৃদয়,

সৃজিয়া নূতন ভব
শত দৃশ্য অভিনব
নয়ন সমীপে আজি ধরিল আমার"
কিম্বা সবার।

প্রদোষের সূর্য্যকরে যেন জগৎ নূতন এক পরিচ্ছদে আমাদের সম্মুখে ফুটিয়া উঠিল। আমরা তখন কি ছাড়িয়া কি দেখিব, বুঝিতে পারিলাম না। সম্রাট আকবর সকল ধর্ম্মের প্রতি ভক্তিপরায়ণ ছিলেন। শুনিলাম, তিনি নাকি এই প্রাসাদের উপর দাঁড়াইয়া অস্তগামী রবিকরে মথুরার দেব মন্দিরের চূড়াদর্শন করিতেন। একথা কতদূর সত্য তাহা জানিনা; তবে এখান হইতে অপরাহ্নে নিমীলিত দিবাকরে মথুরার দেবালয়ের চূড়া বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। জ্যোৎস্নাময়ী রজনীতে যমুনা-হৃদয়-স্পর্শকারী শীতলবায়ু সেবন করিতে করিতে সম্রাটগণ এইখানে বসিয়া নর্ত্তকীকন্ঠ বিনিঃসৃত মধুর সঙ্গীত শ্রবণ করিতেন।
এখানে দুইখানি "তক্ত" প্রস্তরাসন আছে। কৃষ্ণবর্ণ শিলাসনে স্বয়ং বাদসাহ ও শ্বেতাসনে বীরবল (মন্ত্রী) বসিয়া কখন কখন নিশীথে গুপ্ত দরবার করিতেন। সেই দুইখানি আসন বহুদিন রৌদ্রতাপে দগ্ধ হওয়াতে, কিম্বা যে কারণে হউক, বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে; এবং সম্রাটের কৃষ্ণাসনের মধ্যে একটা দাগ পড়িয়াছে; কিন্তু সম্পূর্ণ ভাঙ্গে নাই। তবে প্রবাদ এই যে, ইংরাজ কোম্পানী পলাসির যুদ্ধে বিজয়ী হইয়া যখন আগ্রায় আসিয়াছিলেন, তখন নাকি দুর্গের মধ্যে এদিক সেদিক বেড়াইয়া শেষ এই আসন দেখিতে আসিয়া, সম্রাটের প্রভুত্বের পরিচয় স্বরূপ এই তক্তে একলম্ফে আরোহণ করেন। তাই ইংরাজের (লম্ফ লাগিয়া) পদস্পর্শে অভিমানে কৃষ্ণাসন ফাটিয়া যায়। তাহার মধ্যে যে রক্ত বর্ণ দাগ পড়িয়াছে, তাহা অভিমানীদিগের বিদীর্ণ হৃদয়ের শোণিত চিহ্ন; প্রস্তরের লাল বর্ণ নহে।

"শীশমহল" (আয়নার প্রাসাদ) বেগমদিগের চারু নিকেতন। ইহার বাহিরের ভিত্তি চুণী "পান্না" দ্বারা বিভূষিত এবং ভিতরের সমুদায় প্রাচীর খণ্ড খণ্ড আয়নাতে বিমণ্ডিত। প্রতি প্রকোষ্ঠ এমন মনোহর, দেখিলে যেন কল্পনায় ইন্দ্রালয়ের চিত্র মানসে সমুদিত হয়। এই গৃহে একজনের প্রণয়াভিলাষিণী শত মহিলা পৃথক পৃথক ভাবে বসবাস করিতেন। এমন উপাদেয় রম্য প্রাসাদে, শত সহস্র পরিচারিকা সেবিতা ও পরিবেষ্টিতা মহিষীগণ যে নিরুপম সুখে কালাতিপাত করিতেন, ইহা আমার বিশ্বাস হয় না।
বেগমগণ প্রাসাদের নিম্নতলে তাঁহাদিগের "বাঁদী"রা থাকিত। সে স্থান অতি শোচনীয়। সূর্য্যকর দিবা দ্বিপ্রহরেও ভুলিয়াও সেখানে যাইত কি না, সে বিষয়ে সমূহ সন্দেহ আছে। রৌদ্র বায়ু পরিবর্জ্জিত সেই গৃহে বাস এবং কখন কখন বেগমসাহেবদিগের সেবার অনুমাত্র ত্রুটি হইলে আবার তাহার পার্শ্বস্থ অন্ধকূপে দণ্ডস্বরূপ কয়েদ থাকিয়া তাহারা যে মনুষ্য জীবনের প্রতি অনুরাগিনী ছিল, তাহা ত সহজে অনুভব করা যায় না।
পূর্ব্বে এই দুর্গের প্রাঙ্গণে অতি রমণীয় পুষ্পোদ্যান ছিল। কাশ্মীর, ইস্পাহান, পারস্য প্রভৃতি দেশজাত ও বহু ব্যয়ে আনীত বিবিধ উপাদেয় স্বর্গীয় গোলাপ ও নানাবিধ মনোহর কুসুমে তাহা নন্দনকানন শোভায় বিরাজিত ছিল। যেমন অন্তঃপুরে অলৌকিক লাবণ্যময়ী মহিষীগণ, তেমনি এ উদ্যানে দুর্লভ ফুল্ল কুসুমরাজি। যমুনা শীকরবাহী সমীরণ, তাহার প্রাণভরা মুক্ত সৌরভ অনিবার বহন করিয়া আগ্রার দ্বারে দ্বারে বিতরণ করিত। আজি সেই নন্দনকানন অন্ধকার, গুটিকত বিলাতী ফুলে – "ফিঁকে ভায়লেট গন্ধ নাহি তাহাতে" – তাহাকে পুষ্পোদ্যানে অবিহিত করিতেছে। শত শত কৃত্রিম উৎস, সুবাসিত বারিপূর্ণ প্রাণে, উথলিত হৃদয়ে, যেখানে ক্রীড়া করিত, এখন সেখানে জলকণার চিহ্নমাত্র নাই। বিশুষ্কভাবে সকলি পূর্ব্ব সৌভাগ্যের সহিত বিলীন হইয়া গিয়াছে।
বেগমদিগের স্নান-হর্ম্ম্য অতীব রমণীয়। তাহার প্রাচীর রজতনিভ দর্পনখণ্ডে পরিশোভিত। স্নানের নিমিত্ত ইহার ভিতর একটী বৃহৎ কৃত্রিম সরিৎ এমন কৌশলের সহিত প্রস্তুত করা হইয়াছে যে, আপনা হইতে যমুনার সুশীতল পূত বারি তাহাতে অনায়াসে আইসে এবং একজন ব্যক্তি সুখে ভাসমান হইয়া সেই তরঙ্গবিহীন সরিৎসাগরে অবগাহন করিতে পারে।
"দেওয়ানী আম" (অর্থাৎ সাধারণের সহ দরবার স্থান) এবং "দেওয়ানী খাস" (কেবল আত্মীয়ের সহিত দরবার করিবার স্থান) ক্রমে দেখিয়া যখন আমরা অন্যদিকের প্রাঙ্গণে আসিলাম, তখন উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের লেপ্টেনান্ট গভর্ণর "কলভিন" সাহেবের যত্ন-প্রোথিত সমাধি আমাদিগের নয়ন-পথে পতিত হইল। সিপাই বিপ্লবে (১৮৫৭ সালে) ইঁহার মৃত্যু হয়। সমাধি প্রস্তরে জীবন মৃত্যু এবং গুণাবলী সুবর্ণ অক্ষরে খোদিত করিয়া ইংরাজ-রাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছেন।
ঢোলপুর মহারাজাকে পরাজয় করিয়া ইংরাজ কর্ত্তৃক আনীত তাঁহার কামান দ্বয়ও এই স্থানে রক্ষিত হইয়াছে, দেখিলাম। আমাদিগের জাতি ছুরিকা গৃহে রাখিতেও এখন স্বাধীন নহেন, তখন এত বড় কামানের মর্য্যাদা তাঁহারা বুঝিতে অবশ্যই অপারক কি অনভিজ্ঞ ছিলেন না। শুনিলাম, ঐরূপ সুন্দর কামান আপাতত নাকি পাওয়া যায় না।
দুর্গের মধ্যবর্ত্তী সমুদায় দর্শনীয় মনোহারিতা পরিদর্শন করিয়া সেই সমুদায় দৃশ্য পরিত্যাগ করিবার সময় আমরা সোমনাথে মন্দিরের শ্বেতচন্দন বিনির্ম্মিত বৃহৎ ভগ্নদ্বার দেখিতে গেলাম। এই জীর্ণ স্মৃতি একটী ভগ্নপ্রায় মলিন গৃহে ধূলি ধূসরিত ভাবে রহিয়াছে, কিন্তু তাহার সৌন্দর্য্য এখনও সম্পূর্ণ রূপে তিরোহিত হয় নাই। এই পবিত্র দ্বার সোমনাথের গৌরবের সাক্ষীরূপে জীর্ণতায়ও অদ্যাপি আপনার মহিমা প্রকাশ করিতেছে এবং যবনরাজ কর্ত্তৃক সোমনাথের ধ্বংশ ও অসংখ্য মণি মুক্তাদি আহরণের ইতিহাস স্মরণ করাইয়া দিতেছে। দিবাবসানের পূর্ব্বেই আমাদিগের অশ্বযান সেকেন্দ্রাভিমুখে প্রধাবিত হইল এবং অনতিবিলম্বে আমরা সেই সমাধিক্ষেত্রে গিয়া নামিলাম। সেকেন্দ্রা আগ্রা নগরীর বাহিরে, তবে অতি সামান্য দূর মাত্র। এখানে গাড়ী দেখিলেই মুসলমানগণ আপ্যায়িত করিতে দলে দলে আইসে কিন্তু সেই আত্মীয়তার বিনিময়ে অযাচিত অনুগ্রহের প্রতিদানে পয়সা দিতে হয়। সেকেন্দ্রাতে আকবর বাদসাহের ও তাঁহার অন্যান্য পারিজনবর্গের সমাধি রহিয়াছে। সেই সকল সমাধির অবস্থা এখন অতীব শোচনীয়। কাহারও মন্দিরভগ্ন, কাহারও প্রস্তর খণ্ডের স্বর্ণাক্ষর বিলুপ্ত, কাহারও বা সমাধিশয্যা সম্পূর্ণ ভাঙ্গিয়া ধূলিসাৎ হইয়া গিয়াছে। চারিদিকে শ্মশানের হাহাকার এবং জনশূন্যতার নিস্তব্ধ রোদন, কি দেখিব, কি শুনিব, বুঝিতে পারিলাম না, কেবল দীর্ঘ নিশ্বাসের সহিত শ্মশানের সেই ভগ্ন চিত্র স্মৃতিতে মিশাইয়া গেল।
বাদসাহদিগের সমাধির একটু দূরে আর একটী সমাধি-সৌধ দেখিলাম, কিন্তু তাহার ভিতরে আমরা যাই নাই। সেই খানের লোকের মুখে শুনিলাম যে, এই "শীশমহল" মহারাজ মানসিংহের ভগ্নীর স্মরণার্থ সংস্থাপিত এবং তাঁহার ভগ্নাবশেষ উক্ত মন্দির-হৃদয়ে যত্নে সমাধিতলে প্রোথিত করা হইয়াছে। এই জনশ্রুতি কতদূর সত্য, তাহা আমি বলিতে পারি না।
আকবর বাদসাহের সমাধির পার্শ্বে তাঁহার ধাত্রী-পুত্রের সমাধি রহিয়াছে। ধনী মুসলমানগণ ধাত্রীর স্তন্যদুগ্ধে নাকি প্রতিপালিত হন। সেই জন্য তাঁহারা ধাত্রীকে মাতৃ সম জ্ঞান করিয়া তাহার পুত্রকে সহোদরের ন্যায় স্নেহ ভক্তি করিয়া থাকেন। সম্রাট আকবর পরম ধার্ম্মিক ছিলেন, সুতরাং তাঁহার সকল কাজই প্রীতিকর এবং উল্লেখযোগ্য বলিয়া বোধ হয়।
আমরা এই সমাধির অট্টালিকার উপর হইতে ফতেপুর শিকড়ির দৃশ্য কতক কতক দেখিলাম। কিন্তু চর্ম্ম চক্ষে তত রূপ দেখা গেল না, "দূরবীক্ষণের চক্ষে" দেখিলে হয়ত আরও সুন্দরতর দেখাইত। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার নিকট দূরবীক্ষণ ছিল না। সুতরাং "যন্ত্রহীন বিধাতা-নির্ম্মিত চারু মানবনয়নে" যাহা দেখা সম্ভব, তাহাই দেখিয়া, পরিতৃপ্ত মনে, সায়াহ্ন সমীরণ সেবন করিতে করিতে বাসায় প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া দিবা-ক্লান্তি দূর করিলাম।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সাভিফা

[ * ইতমৎ-উদ-দৌলা - সম্রাট জাহাঙ্গীরের পত্নী নূরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াসউদ্দিনের সমাধি। ভারতে প্রথম লাল বেলে পাথরের পরিবর্তে শ্বেতপাথরে তৈরি সমাধি সৌধ - কথিত যে এটিই পরবর্তীতে তাজমহল নির্মাণের অনুপ্রেরণা। - সম্পাদক ]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher