ভালকি মাচানের ডাকে

তপন পাল

 

ভালকি মাচান – নামটা বড় সুন্দর।
'আমাদের ছুটি'-র ফেসবুক গ্রুপে ভালকি মাচান-এর একটা ছবি দেখে জায়গাটা সম্বন্ধে কৌতূহল জাগল। খোঁজখবর করে জানা গেল খুব দূরও নয় – বর্ধমান জেলার মানকরের কাছে।
জঙ্গল আমার খুব একটা ভালোবাসার নয়। আমাকে টানে জল - নদী, সমুদ্র, নিদেনপক্ষে দীঘি। যখন শুনলাম ভালকি মাচানের কাছে যমুনাদীঘি, আর মাচানে বসে বর্ধমানের রাজ পরিবারের সদস্যরা ভালুক শিকার করতেন তাই এই নাম, মনে হল গেলেই হয়।
তা জঙ্গলে যাওয়ার অনেক হ্যাপা। এটা কোরো না, ওটা কোরো না। বছর কুড়ি আগে, পুত্র একদিন স্কুল থেকে ফিরে বায়না ধরল – সে হাতি দেখবে। ঠিক আছে, সামনের রবিবার চিড়িয়াখানায় যাব'খন। না তা হবে না। পরিবেশ সচেতন পুত্র বাঁধা হাতি দেখতে চায় না – সে ছাড়া হাতি দেখবে।
খোঁজখবর করে কুলডিহায়। দূর থেকে হাতির দল দেখে পিতা পুত্র যখন উদ্বেল, সঙ্গী স্থানীয় লোকটি বললেন, এ আর কি, যদি দুটো তরমুজ আনতেন, হাতিরা আরও কাছে আসত। শুনে পুত্র বেঁকে বসল। হাতিকে তরমুজ না খাওয়ালে সেও আর কোনদিন তরমুজ খাবেনা। অগত্যা প্রত্যাবর্তন, এবং একমাস পরে পুনর্গমন; ধৌলির লাগেজ ভ্যানে এক বস্তা তরমুজ বুক করে।
তবে ভালুকদের সঙ্গে আমার চিরকালের একাত্মতা – তারা আমার মতই সর্বভুক – নিরামিষ-আমিষের প্রভেদ করে না এবং মাংস পেলে তা দ্বিপদ না চতুষ্পদের, চতুষ্পদ হলে সে ব্যা-ব্যা ডাকত না হাম্বা-হাম্বা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না।
একটা কারণে অবশ্য আমি ভালুকদের সমঝেও চলি। স্কুলে একবার নস্যি নেওয়া, ধুতি পরা সংস্কৃত স্যার 'ঋক্ষ' শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাঁর নাকি সুরের জন্য আমি শুনেছিলাম 'বৃক্ষ'। বলেছিলাম - 'গাছ'। শুনে ভদ্রলোক আমাকে একবার পেটালেন, পরদিন বাজারে দেখা হতে বাবাকে বললেন – আপনার ছেলে পড়াশোনা কিছু করছে না – শুনে বাবা বাড়ি ফিরে আরেকবার।
অতএব ভালকি মাচান না গিয়ে উপায় নেই।
কিন্তু যাওয়াটা সহজ নয়।
হাওড়া থেকে সরাসরি মানকর যাওয়ার তিনটি মাত্র রেলগাড়ি – ২২৩৮৭/২২৩৮৮ ব্ল্যাক ডায়মন্ড, ১৩০৪৯/১৩০৫০ অমৃতসর এক্সপ্রেস, লোকে যাকে ভালোবেসে বারাণসী বলে ডাকে আর ১২৩৩৯/১২৩৪০ কোলফিল্ড। এদের মধ্যে দ্বিতীয় গাড়িটা সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভালো। কোলফিল্ডে সময়টা সবচেয়ে কম লাগে কিন্তু ব্ল্যাক ছাড়ে একেবারে ভোরে – ১৪৪ কিমি যেতে লাগে সোয়া দু'ঘন্টা – মন্দের ভালো আরকী। অগত্যা ব্ল্যাক। ফিরব কিসে? ভেবেচিন্তে ৯ কিলোমিটার দূরের পানাগড় থেকে ১৩০৫২ হুল এক্সপ্রেস ধরা সাব্যস্ত হল। ইনিও খুব সুবিধের গাড়ি নন। ১৫৪ কিমি যেতে তিনি সময় নেন তিন ঘন্টা, কিন্তু ভাড়া ব্ল্যাক ডায়মন্ডের চেয়ে কম – ৩০৫-এর বদলে ২৮৫।
রবিবার, ১২ অক্টোবর, সকালবেলা হাওড়া। অতি দীর্ঘ ব্ল্যাক ডায়মন্ড আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। ছাড়ল সোয়া ছ'টায়। শেওড়াফুলি, ব্যান্ডেল, বর্ধমান পেরিয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে মানকর। ঘড়িতে তখন আটটা আটত্রিশ। বলে রাখা ভাল সারা রাস্তায় জুতো পালিশ ছাড়া কোন হকার ওঠেনি। ওমলেট, টোষ্ট তো দূরস্থান, শশা, মুড়ি এমনকী চা-ও মেলেনি।
অপর বাতানুকূল কামরাটি থেকে এক পরিবার নামল – বাবা, মা আর একটি বছর চারেকের কন্যা। প্ল্যাটফর্মে নেমেই মেয়েটি বমি করে ফেলল। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম পেট খালি থাকায় আমি অসুস্থ বোধ করছি, আর ছোট মেয়েটিকে রাত থাকতে ঘুম থেকে তুলে সারা রাস্তা বাবা-মা এমন খাওয়াতে খাওয়াতে এনেছে যে তার জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হায় রে, জীবন কেন যে এত বৈপরীত্যে ভরা!
দু-নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমেছিলাম। তার গা দিয়েই রাস্তা। কিন্তু যানবাহন কিছু চোখে পড়ল না। উল্টোদিক দিয়ে বেরিয়ে দেখি কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তারই একটার সঙ্গে কথা বলে ঠিক হল ভালকি মাচান দেখিয়ে আমাকে তিনটের মধ্যে পানাগড় স্টেশনে নামিয়ে দেবে – দক্ষিণা আটশ টাকা।
গ্রামের পথ ধরে গাড়ি এগোয়। ইতিমধ্যে দেশলাই কেনার জন্য পথের ধারে একটা ছোট দোকানে থামি। দোকানদার অনুপস্থিত। বেশ কিছুক্ষণ বাদে তিনি এলেন – শ্মশ্রুশোভিত এক বয়স্ক ব্যক্তি। 'কি গো কাকা, কোথায় ছিলে?' – 'আর বোলো না কো, হাতি বেরিয়েছে' – তাঁর নির্বিকার জবাব। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল দলছুট এক পুরুষ প্রাপ্তবয়স্ক হাতি গ্রামে ঢুকে পড়েছে। 'যাও না' - এখান থেকে এক কিলোমিটার হবে। ওয়াচটাওয়ারের নিরাপদ উচ্চতা থেকে হাতি দেখতে ভালো লাগে। তাই বলে মুখোমুখি, একই জমিতে!! বন্যেরা বনে সুন্দর, হাতিরা ছবিতে।

রাস্তার ধারেই মাচান, ইঁটের বেশ উঁচু একটি কাঠামো, সংস্করাভাবে জীর্ণ। তার শিখর থেকে আকাশের দিকে ডানা মেলেছে উদ্ধত এক ন্যগ্রোধ। আয়লা, গিরি, থানে, নীলম, ফিলিন, হুদ হুদ......আর কতদিন মাচান যে মাথা তুলে থাকতে পারবে কে জানে! মাচানের গোড়ায় এক গভীর গর্ত, তার মুখে লোহার এক শক্তপোক্ত জাল; ওই মাচান থেকে বর্ধমান রাজবাড়ি (২৫ কিমি) গুপ্ত সুড়ঙ্গপথের গল্পের উৎসমুখ।
ঠিক বিপরীতে একটি বেসরকারি রিসর্ট – বিস্তৃত এলাকা জুড়ে উই ঢিপি, পুকুর, ফুল, পাতাবাহার আর অযত্নলালিত বনস্পতিকুল। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে, বৃষ্টিস্নাত সকালে অরণ্যের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুভব আলাদা, খুব ভালো লাগছিল। সেখানকার বাগিচাকর্মীদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল যমুনা দীঘি বেশ দূরে। আর ভগ্নপ্রায় মন্দিররাজি ভালকি গ্রামে। দুটো জায়গাই হেঁটে যাওয়ার পক্ষে অনেকটা দূর। গাড়ি নিয়েই যেতে হবে। ড্রাইভার বাবাজীবনকে সে কথা বলতেই বলে আরও পাঁচশ টাকা লাগবে। কিন্তু তখন কীই বা আর করা যায়। অগত্যা...
রাস্তায় দু-হাত পর পর মা কালীর ভক্তদের চাঁদার জন্য উৎপাত। জনা দশেক যুবক, রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে দশ টাকার দাবি নিয়ে। সারাদিনে ওই রাস্তায় কটা গাড়ি চলে; কত টাকা আদায় হয়; তার চেয়ে যদি এরা এই ভরা মরশুমে মাঠে কাজ করত, বেশি রোজগার হত। কিন্তু গ্রাম বাংলার কর্মবিমুখ, অলস, আমোদকামী যুবকরা কবে আর খেটে খেয়েছে!

ভালকি বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। ধানক্ষেত, পুকুর, সদ্য রঙ হওয়া দোতলা বাড়ি, বাড়ির সামনে দ্বিচক্রযান এবং/অথবা ছোট চার চাকার গাড়ি। গ্রামে ঢোকার মুখে রাস্তার ওপরে সেলফোনের দোকান। এসব দেখে গ্রামীন সমৃদ্ধির একটা ধারনা পাওয়া যায়। এতদসত্ত্বেও মন্দিরগুলি জীর্ণ; ভগ্নপ্রায়, ফাঁসির আসামীর মত দিন গুনছে। বোঝা গেল গ্রামের একদা ভূস্বামী পরিবারটির অবস্থা এখন পড়তির দিকে। কিন্তু গ্রামবাসীরাই বা কেন চাঁদা তুলে মন্দিরগুলি সারায় না। সম্ভবত, একদা ভূস্বামী পরিবারটি অদ্যাবধি অতীত গরিমার জ্যোতিতে আত্মমগ্ন – বাড়ানো হাত ধরতে হয়ত অনীহা। তবুও মন্দিরগুলির দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায় – মনের কোনে ভেসে ওঠে অতীত গরিমা ও বৈভবের দিনগুলি। জোড়া শিব ও জোড়া বিষ্ণু মন্দির, কারুকার্যখচিত নাট মন্দির। নাট মন্দিরে মা দুর্গার কাঠামো। ঢোকার মুখে বারোয়ারিতলা – সেখানে মা জগদ্ধাত্রী...।
মনটা খারাপ হয়ে গেল এইসব দেখে। কিন্তু জুড়িয়ে গেল যমুনাদীঘিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্যদপ্তরের অধীন এক বিস্তীর্ণ খামার - পর পর পুকুর, দূরে বৃক্ষচিহ্নিত বাঁধ - খামারের সীমানা, তারপর সবুজ ধানক্ষেত আর মাথার ওপরে শরতের নীলিমা। দূর থেকে দেখা গেল একটা পুকুরের এক জায়গায় জল চঞ্চল। এক বন্দুকধারী প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'ওখানে জলে কী ফেলেছে গো?' 'কোথায়?' 'ওই যে জল ফুটছে'। 'কিছু ফেলে নি'। জানতে পারলাম মাছকে খেতে দেওয়ার সময় হয়েছে, তাই মাছেরা একজায়গায় জড়ো হয়েছে।
তারপর পুকুরের পর পুকুর, অভিনীত হতে থাকল সেই একই দৃশ্য। মাছেরা পাড় ঘেঁষে এক জায়গায় জড়; খাবার দেওয়ার লোকটিকে পুকুরপাড়ে দেখামাত্র পাখনা নাড়িয়ে উল্লাস, তারপর গামছায় ঢেলে মৎস্যখাদ্য পুকুরে ছুঁড়ে দেওয়া মাত্র কাড়াকাড়ি, একটি মাছকে অপর মাছেরা তলা থেকে ঠেলে তুলে দিয়েছে জলের ওপরে। খাবি খেয়ে তার কী দুরবস্থা!
বেশ কিছুক্ষণ কাটল সেথায়, মহানন্দে, বিস্তৃত প্রান্তরের মাঝে।

বেরিয়ে পড়লাম তখন মাত্র সাড়ে এগারটা। আমার ফেরার গাড়ি পানাগড় থেকে তিনটে বাইশে। এতক্ষণ কী করব! ড্রাইভারটিকে বললাম, 'ডোকরাগ্রাম' এবং দুর্গাপুরের অজয়পাড়ে ইছাই ঘোষের দেউল দেখাতে। কিন্তু সে প্রবল অনিচ্ছুক। গ্রামের ছেলে হয়েও সে মাঠে কাজ করে না, গাড়ি চালায়; তাই তার ধারণা সে ভদ্রলোক শ্রেণীর অন্তর্গত, সেকথা সে বার বার জোর দিয়ে বলছিল। যদিও তার নিজের কথাতেই, বাজার খারাপ, মানকরে অনেক গাড়ি হয়ে গেছে; প্রতিদিন ভাড়া জোটে না। মধ্যে মধ্যে সারা সপ্তাহ বসে থাকতে হয়, কারণ স্থানীয়রা গাড়ি ভাড়া করেন মূলত অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে – দুর্গাপুরে ডাক্তার দেখাতে যেতে বা রোগী ভর্তি করতে। তাসত্ত্বেও বাবু শ্রেণীভুক্ত হওয়ার কারণে সময়ে আহার ও বিশ্রাম তার কাছে বড়ই গুরুত্বপূর্ণ।
অগত্যা পানাগড়। স্টেশনের ধারে কাছে ঘোরাঘুরি করে একটা ভাতের হোটেল পাওয়া গেল। ভাত ডাল খেয়ে স্টেশনে – সবে একটা বাজে। দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে হাওড়াগামী গাড়ি আসবে। প্লাগে সেলফোন চার্জ হতে দিয়ে জাঁকিয়ে বসা গেল। ট্রেন আসছে...যাচ্ছে...। স্টেশনের পানীয় জলের ট্যাঙ্কটি ১৮৯৯ সালে ই.আই.আর (ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েঃ ১৮৪৩ সালে লন্ডনে নিবন্ধীকৃত) দ্বারা নির্মিত। কে জানে তার পর থেকে একবারও পরিস্কার করা হয়েছে কীনা। কিন্তু সঙ্গের জল শেষ। ঘুমন্ত স্টেশনে জলের বোতল কেন, চা অবধি পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা ওই জলই সই। অবশেষে আমার গাড়ি এল। বাতানুকুলিত কামরায় উঠে জল, চা, ঝালমুড়ি সবই পাওয়া গেল। লিলুয়ায় কিঞ্চিৎ বিরতি দিয়ে হাওড়া ছ'টা পঁয়তাল্লিশ।


পশ্চিমবঙ্গ অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher