ভিন্ন স্বাদের ইতালি
শ্রাবণী ব্যানার্জি
~ ইতালির আরও ছবি ~
বন্ধুরা যখন জিজ্ঞাসা করেন কোন দেশটা তোমার সবথেকে ভাল লাগে, ইতালির নামটাই সবার আগে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। প্রকৃতি প্রেমিক থেকে ইতিহাসপ্রেমী কেউই এদেশে এসে নিরাশ হবেন না। আগে যতবারই ইতালি গেছি, ততবারই ঐতিহাসিক জায়গাগুলির পেছনে ছুটে বেড়িয়েছি আর সেগুলি বেশিরভাগই পড়েছে বড় বড় শহরের আওতায়, যেমন ভেনিস, ফ্লোরেন্স, রোম, নেপলস ইত্যাদি। আজ যে ভিন্ন স্বাদের ইতালির কথা লিখতে চলেছি, তা টুরিষ্টবর্জিত নয়, কিন্তু এখানে অন্যধরণের মানুষজনের আনাগোনা। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, ফুলে ফলে ঢাকা জায়গাগুলি, ইতালি তথা ইউরোপের উচ্চবিত্তদের ছুটি কাটানোর জায়গা। এখানে রাস্তায় হকারদের হাঁকডাক নেই, ঠেলাঠেলি নেই, নোংরা গ্রাফিতি নেই, ট্যুরগাইডদের ঝাণ্ডা হাতে এগিয়ে যাওয়া নেই, এমনকি পকেটমারও নেই। এ যেন এক অনাবিল আনন্দে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে গা ভাসিয়ে দেওয়া।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল লেক কোমো। মিলান শহর থেকে মাত্র ঘন্টা খানেকের পথ। অদূরে তুষারাবৃত পর্বতমালা ও কাচের মতো স্বচ্ছ নীল হ্রদের ধারে ছোট ছোট ফুলে ঢাকা গ্রামগুলিকে যেন একটা পিকচার পোষ্টকার্ড। লিয়েরনা ভিলেজে যে বাড়িটি ভাড়া করেছিলাম, তার সামনের প্রায় পুরোটাই কাচ দিয়ে ঢাকা, যাতে ঘরে বসেই সবাই লেক ও পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। ভিলার মালিক মার্কো ও সোফিয়া দুজনেই খুব আদরযত্ন করে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেল। এত অল্প বয়সে এই দামি জায়গায় কী করে এরা এই ভিলাটি করেছে সেটা ভেবে একটু অবাকই লাগছিল। মার্কো জানাল তার দাদু মারা যাবার আগে আদরের নাতিকে এই বাড়িটা লিখে দেন। সেদিন থেকে চাকরি ছেড়ে ভিলা ভাড়া দিয়ে ঘরে বসেই দিব্যি মোটা টাকা রোজগার করছে!
লেক কোমোর ধারে সবথেকে নামকরা ভিলেজ হল "বেলাজিও", যাকে নাকি নকল করে আমেরিকার লাসভেগাসে বেলাজিও তৈরি হয়। এখানে হলিউডের জর্জ ক্লুনি, ম্যাডোনা, ভারসাচি ও সিলভেস্তার স্তালোনের বাড়ি আছে। তারকাদের দর্শন না মিললেও পরের দিন যখন ফেরি নিয়ে জায়গাটিতে পৌঁছলাম তখন প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে গেল। এতটাই নিখুঁত সুন্দর করে সাজানো যে রাস্তার ধারে বড় বড় টবে রংবেরং-এর ফুলগুলির মধ্যে কোথাও শুকনো ঝরা ফুলও চোখে পড়ল না। লক্ষ্য করলাম কয়েকজন টব থেকে শুকনো ফুলগুলো তুলে হাতে ঝোলানো প্লাষ্টিকের ব্যাগে ফেলছেন। পাথরের রাস্তার দুধারে সারি সারি বাড়ির বারান্দাগুলি ফুলে ফুলে ঢাকা আর তাদের তলায় তলায় দোকান। দোকানে জিনিসের দাম দেখে অবশ্য চোখ প্রায় কপালে উঠে গেল। হীরে, মুক্তো, চোখ ধাঁধাঁনো অস্ট্রিয়ান ক্রিস্টালের ঝাড়লন্ঠন থেকে গুচি ফেন্ডির ব্যাগ - সবারই আকাশছোঁয়া দাম। এইসব বড়লোকের তল্লাটে হকাররা নকল গুচির ব্যাগ নিয়ে রাস্তা সরগরম করে না - যা বিক্রি হয় সবই একেবারে ষোলআনা খাঁটি! একটি রোলেক্সের হাত ঘড়ির দাম লেখা আছে ষাট হাজার ইউরো। একটি সাদামাটা টিশার্ট সত্তর ইউরো, আর তার পাশে রাখা ব্লু জিনসটির দাম দুশো ইউরো। হীরে-পান্নার দাম আর দ্যুতি দুই-ই এখানে সমান তালে চলে। কেউ কোন অংশে খাটো নয়। বুঝলাম এদেরকে দোকানের বাইরে থেকে দেখাই বাঞ্ছনীয়। তবুও কথাতেই আছে 'স্বভাব যায় না মলে' তাই একসময় আর থাকতে না পেরে একাই হনহনিয়ে একটা ক্রিস্টালের দোকানে ঢুকে গেলাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশ থেকে একজন প্রশ্ন করল "এনি পারচেজো মিস?" কনফিডেন্টলি উত্তর দিলাম "নো পারচেজো, নো পারচেজো, ল্যুকিংও, ত্যু এক্সপেনসিভো"। লোকটা হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব সম্ভবত আমাকে ছিটগ্রস্ত বা নেশাগ্রস্ত কিংবা দুটোই মনে করে বলল "নো প্রবলেমো মিস, নো প্রবলেমো"।
জনান্তিকে জানিয়ে রাখি ইতালিতে পা দেবার সাথে সাথেই 'অনুস্বরং দিলেং পরেং সংস্কৃত হয়েং' এর মতো আমিও লাগুক না লাগুক প্রায় প্রতিটি ইংরাজী শব্দের পেছনে 'ও' কার যোগ করে এবং 'ট' কে 'ত' বলে দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। লোকজনকে পাকড়ে মার্কেতো যাবার ডিরেকশানো নিয়ে ভালোভালো সুস্বাদু খাবার কিনে আনতাম। হাতের লটবহরগুলিকে স্টেশনে ডিপোজিটো করে সঠিক ডেসটিনেশানোর টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে পড়তাম। ট্রেনের গতির ওপর নির্ভর করে কেউ র্যাপিতো কেউ এক্সপ্রেসো আর সোজাসুজি গেলে তারা হন ডিরেকতো। প্রতিবার তিকিতটাকে ভ্যালিডেতো করে না নিলে সে তিকিত হয়ে যাবে ইনকম্প্লিতো। সেই অবস্থায় তিকিত চেকারের হাতে পড়লে খুবই মুশকিলো এবং প্রচুর টাকা খেসারৎ দিয়ে তবেই সেটা হবে পারফেক্তো।
সে যাই হোক কোমো লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ খেয়াল করলাম অনেকটা দূরে একটা ভিলার সামনে একটা হাইড্রো প্লেন একেবারে সটাং আকাশ থেকে দিব্যি জলে নেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লমবারগিনির মতো দামি গাড়ি দেখতেও চোখ বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। লেকে দেখলাম বড় বড় রাজহাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক কথায় জায়গাটিকে অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। লেক থেকে পাহাড়ের দিকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে, আর তার দুধারে বাড়ি। এখানকার লোকজনের চেহারাও খুব ছিপছিপে কারণ প্রতিদিন অতগুলি সিঁড়ি ওঠানামা করলে কোন জিমে গিয়ে আলাদা করে স্টেয়ার মাস্টার করার দরকার হয় না। লোকজনের চালচলন, দামি সাজপোষাক, ফুলে ফুলে ঢাকা রাস্তাঘাট, দামি দামি গাড়ি আর দোকানে দোকানে জিনিসের বাহার দেখলে এই বেলাজিও যে একটি অভিজাত বড়লোকদের বাসস্থান সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহই থাকে না।
পরেরদিন যে ভিলেজে গেলাম তার নাম মিনিজিও। পাথরের রাস্তাগুলি কিছু কিছু জায়গায় কাশীর গলির মতনই সরু, তফাৎ শুধু এই যে দুধারের বাড়িগুলি ফুলে ফুলে ঢাকা পড়ে গেছে এবং কিছু ঝরা ফুল ছাড়া রাস্তাঘাটে একটা নোংরা কাগজও চোখে পড়ল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসোলিনি এই মিনাজিওতেই বহুদিন গা ঢাকা দিয়ছিলেন। এখান থেকে আমরা লঞ্চে চড়ে গেলাম লেনো নামে একটি ভিলেজে। এই তল্লাটের রেনফরেস্টে ঢোকার সৌভাগ্য হল এখানে। পাহাড়ের ওপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে একটি শকিং পিংক চিনে পঞ্চো বার করে গায়ে গলিয়ে নিলাম। চতুর্দিকে দামি দামি ছাতা ও বর্ষাতির মধ্যে আমার এই দারুণ গোলাপি পঞ্চোটি যে কিছুটা বৈচিত্র্য এনেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, খেয়াল করলাম অনেকেই একটু টেরিয়ে টেরিয়ে আমাকে দেখছে। বৃষ্টি থামতেই সেটিকে তাড়াতাড়ি খুলে একটু ঝাড়া দিতেই চীনে পঞ্চোর পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটে গেল। অবশেষে রেনফরেষ্ট পেরিয়ে যখন ভিলার কাছে এসে পৌঁছলাম, দেখি সামনে বড় বড় করে লেখা 'নো অ্যাকসেসো' - ওখানে নাকি সিনেমার স্যুটিং চলছে।
পরেরদিনের গন্তব্য ট্রমেজো ভিলেজে আর সেখানে একটি ভিলার সাইজ এবং বাইরে থেকেই সৌন্দর্য দেখে বেশ মুগ্ধ হয়ে গেলাম - নাম 'শারলটা ভিলা'। আঠারোশো তিরানব্বই সালে প্রাশিয়ার রানি এই সতের একরের বোটানিকাল গার্ডেন সমেত ভিলাটি তাঁর কন্যাকে বিয়ের যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন। এখন এটি ইতালিয়ান গভর্নমেন্টের নিয়ন্ত্রণে, অর্থাৎ রানির বংশধরদের এখন আমারই মতো টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। ভিলার সবথেকে বড় আকর্ষণ অসাধারণ বোটানিকাল গার্ডেন - সেখানে অজস্র নাম না-জানা ফুলের সমারোহ। লেকের ধারেই বড় বড় স্ট্যাচু আর ফোয়ারা। লেক, স্ট্যাচু, ফোয়ারা ও বাগান সমেত ভিলাটি নিঃসন্দেহে রানির জন্যই উপযুক্ত।
প্রতিদিন রাতে ফিরে এসে মার্কো ও তার বউ-এর সাথে বেশ জমিয়ে গল্প হত। দু-একদিনের মধ্যেই আমরা এতটাই বন্ধু হয়ে গেলাম যে তারা নিজেদের রান্নাঘর থেকে ভাল ভাল ইতালিয়ান ডেলিকেসি আমাদের খাওয়াতে শুরু করল। একবার খেলাম কাঁচা পাতলা করে কাটা হ্যাম আর মোজারেলা চীজ যার নাম 'প্রসুতা'। কাঁচা মাংস খাওয়া আমার একেবারেই অভ্যেস নেই তবুও ওদের আগ্রহে হাসি হাসি মুখে কোনও রকমে গলাধঃকরণ করে 'ডিলিসাস্' বললাম। পরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে জেনেছি ওরা আমাদের খুব দামি খাবারই খাইয়েছিল কিন্তু একেবারেই অপাত্রে দান অর্থাৎ সাহেবকে সুক্তো খেতে দেবার দশা! দ্বিতীয়টা অবশ্য খুবই ভাল খেতে। বাইরেটা বেশ মুচমুচে আর ভেতরে মিষ্টি দেওয়া চীজ যার নাম 'স্কোলিয়া তেলে'।
পরেরদিন মার্কো ও সোফিয়ার উৎসাহে গেলাম ভেরেনা বলে একটি ভিলেজে - বেলাজিওর মতো অত দামি দোকানপাটের চাকচিক্য না থাকলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বেলাজিওকেও ছাড়িয়ে যায়। সেই রাতে ওরা দুজনেই আমাদের বলল ওদের ভারতবর্ষে যাওয়ার খুব ইচ্ছা আছে - মিলানে প্রচুর বলিউডি সিনেমা দেখেছে। হিন্দি সিনেমা দেখে ওদের ধারণা হয়েছে ভারতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই সুযোগ পেলেই রাস্তায় নাচে। রাস্তাঘাটে সারাক্ষণই গরু, শুয়োর, বাঁদর ও গেরুয়া বসনপরা সন্ন্যাসীরা ঘুরে বেড়ায় - এক কথায় খুব 'ফ্যাসিনেটিং' জায়গা। আমি তাদের ভুল ধারণা কিঞ্চিৎ সংশোধন করে দিলাম।
চারদিন পর সোফিয়ার কাছে বিদায় নিয়ে স্টেশনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। মার্কো কিছুতেই আমাদের হেঁটে স্টেশন যেতে দিল না, তার ছোট্ট গাড়িটা নিয়ে আমাদের পৌঁছে দিল।
পথ চলতে গিয়ে মার্কো আর সোফিয়ার মতো কতরকম মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাদের কাছে স্থানীয় জায়গার গল্প শুনেছি। পথের আলাপ অনেক সময় পথেই শেষ হয়ে গেছে তবু কখনও সীমিত সময়ের ট্যুরপ্যাকেজে দৌড়াতে মন চায়নি। মনে পড়ে রাস্তায় আলাপ ইন্দোনেশিয়ার সেই অল্পবয়সী ছেলেটির কথা যার একমাত্র স্বপ্ন সে হিন্দু তাই জীবনে একবার মা গঙ্গাকে দর্শন করবে, সেই জন্য কত কষ্ট করে ভারতবর্ষে আসার টাকা জমাচ্ছে, মনে আসে বাঁকুড়ার ট্রেনের সেই উদাস বাউলের কথা যার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গন্তব্যস্থলে না নেমে বন্ধুরা মিলে পিছুপিছু তার বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। আজও ভুলিনি ভরতপুরের জঙ্গলে সেই সাধুবাবার কথা যিনি শিব মন্দিরের লাগোয়া তাঁর ছোট্ট মাটির ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। সম্পত্তি বলতে কম্বল, একটি উনুন, কড়াই, অ্যালুমিনিয়ামের থালা আর একটি ছোট ঘটি। এইভাবেই তিনি পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে এই নিবান্দাপুরিতে একাই বাস করছেন। সেদিন ওঁর নিজস্ব কত জঙ্গলের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম। অত দূরের স্মৃতি রোমন্থনেরই বা দরকার কি? ইতালির এই ট্রিপেও যখন দিন তিনেকের জন্য রোমে থেমেছিলাম তখনকার একটি ঘটনার কথা বলি।
রোদের তাপে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে যখন রোমের বিখ্যাত স্কোয়ার 'পিয়াজা ডেল্ পোপোল'-এ বসে ফোয়ারা থেকে জল নিয়ে মুখে চোখে ছেটাচ্ছি, কোথা থেকে একদল বাংলাদেশি হকার রোদের তাপ থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্য ছাতা, গগলস্ আর ঠাণ্ডা জলের বোতল নিয়ে ধেয়ে এল। নাঃ আমাদের বয়স দেখে এখন আর কেউ গোলাপ ফুল বিক্রি করতে আসে না শুধু ঠাণ্ডা জলই আনে! দেখলাম একজনের টিশার্টে বড় বড় করে বাংলায় লেখা 'বাড়ি নাই, গাড়ি নাই, স্টেটস্'। তার সঙ্গে একটু গল্প জুড়তেই কোথা থেকে এক খাঁটি ইতালিয়ান গ্ল্যাডিয়েটরের বেশে কোমর থেকে একটি প্লাষ্টিকের ছোরা বার করে বাংলায় গান শুরু করে দিল। আমি তো তাজ্জব! 'পরাণ' এবং 'জ্বলিয়া', এই দুটি শব্দই বুঝতে পেরেছিলাম। পরে জানলাম সে তার বাংলাদেশি হকার বন্ধুদের কাছ থেকে দু-এক লাইন করে কয়েকটি বাংলা গান শিখে নিয়েছে। আমাকে ওদের ভাষায় কথা বলতে দেখে তাক্ লাগানোর জন্য গানটি গেয়েছিল। হায়! দুহাজার বছর পরে খোদ রোমে বসে খাঁটি রোমানের মুখে বাংলা গান শোনা যাবে তা বোধহয় জ্যুলিয়াস সীজার অতিবড় দুঃস্বপ্নতেও কল্পনা করেননি। সীজারকে অনেক কষ্টে বহু লোকক্ষয় করে 'ভিনি, ভিডি, ভিসি' বলতে বলতে রাজ্য জয় করতে হয়েছিল আর আজ বাংলাদেশি হকাররা সম্পূর্ণ অহিংসভাবে বিনা ঢাল-তলোয়ারেই একের পর এক ইউরোপীয় শহরগুলি দখল করে নিচ্ছে। তাদেরকে দাবায়ে রাখে কার সাধ্যি!
এই রাস্তাতেই কতরকম মানুষজনের সঙ্গেই যে আলাপ হয়েছে - সত্যি বলতে কী শুধু তাদের নিয়েই একটা গল্প লেখা যায়। তাই আমার কাছে বেড়ানোটা শুধু দর্শনীয় স্থানগুলি দেখাই নয়, তার আশেপাশের মানুষগুলির দিকেও একটু তাকিয়ে দেখা। রোমে এবারেও যখন 'লারগো আর্জেন্টিনার' ধ্বংসাবশেষের সামনে বসে ছুরির ঘায়ে লুটিয়ে পড়া জ্যুলিয়াস সীজারের সেই অন্তিম সময়টির কথা চিন্তা করছিলাম, বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবতে হয়নি কখন ট্যুর অপারেটর এসে বলবে "ইওর টাইম ইজ আপ"। জীবনের অন্তিমে সে ডাকে সাড়া দিয়ে তো চলে যেতেই হবে, তবে আগে থাকতেই এত তাড়া কেন?
লেক কোমো থেকে আরও কয়েকটি জায়গা ঘুরে নেপলস শহরে এসে পৌঁছলাম। আমাদের গন্তব্যস্থল ছিল এখান থেকে ঘন্টাখানেক দূরে 'সোরেন্তো' বলে একটি জায়গা। সোরেন্তো যাবার পথে আমাদের বাস দু-হাজার বছরের পুরনো 'পম্পেই' নগরীতে এসে দাঁড়াল। ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে ঊনআশি খ্রীস্টাব্দে এই বিলাসবহুল নগরীটিতে প্রায় কুড়ি হাজার লোক প্রাণ হারায়। তার সতেরোশো বছর পরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে এটিকে পুনরুদ্ধার করেন। সুন্দর একটি একতলা ভিলা চোখে পড়ল যার সামনে ফোয়ারা, স্ট্যাচু এমনকী দরজার মুখে একটি চেনে বাঁধা মোজাইকের কুকুর। চব্বিশ অগষ্টের সেই দিনটি আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতনই শুরু হয়েছিল। লোকজন বাজার দোকান করছিল। একটি বাড়ির টেবিলে কিছু ডিম ও দুহাজার বছরের পুরনো কিছু রুটি রাখা আছে। এরা মারা যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেও পাহাড়ের গায়ে ধোঁয়া দেখে গ্রাহ্য করেনি, স্মরণগ্রাহ্য কালের মধ্যে অগ্নুৎপাত হয়নি ভিসুভিয়াসে – আগ্নেয়গিরি কথাটাই ওদের জানা ছিলনা। ফুটন্ত ছাইগুলো মানুষের গায়ের ওপর জমা হয়ে ধীরে ধীরে শক্ত ইঁটের মত হয়ে যায়। বেশ কয়েকজন টাকার থলি নিয়ে পালাচ্ছিল, তারা সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে, আজও তাদের চোখ মুখের আতঙ্ক পরিস্কার বোঝা যায়। অধিকাংশই মারা যায় ধোঁয়া আর ছাই-এ দমবন্ধ হয়ে।
পম্পেই ছাড়ার পর আমাদের বাস পাহাড় ও সমুদ্রের ধার ঘেঁষে সরু, বেঁকানো রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল। সমুদ্রের ধারে বড় বড় কালো পাথরের ওপর নরনারী নির্বিশেষে সবাই যৎসামান্য পোষাক পরে রোদে বেগুনপোড়া হচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড়ের পাদদেশে অসংখ্য লেবু গাছে শয়ে শয়ে হলুদ লেবু ঝুলছে। পৌঁছে আমাদের ভিলাটিতেও দেখলাম চতু্র্দিকে লেমন্ গাছ। পরে জেনেছিলাম এই লেবু থেকেই তাদের বিখ্যাত ড্রিংক 'লেমোন সেল' তৈরি হয়। রাত্রে সোরন্তোর মেন স্কোয়ারে গিয়ে দেখি ঠিক যেন রথের মেলা বসেছে। রেস্তোঁরার সামনে গানবাজনা হচ্ছে, কেউ তালে তালে নাচছে আর কেউবা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করছে। চারদিকেই রকমারি জিনিসের সঙ্গে হলুদ বোতলে লেমন মেশানো ড্রিঙ্কস বিক্রি হচ্ছে। এক কথায় সবাই বেশ ফুর্তির মুডেই আছে। চিনি, অ্যালকোহল ও লেবুর খোসা দিয়ে তৈরি একটা বড়সড় লেমন সেলোর বোতল কিনে নিলাম ভিলাতে গিয়ে উপভোগ করব বলে। ইতালিতে সবাই ডিনারে রেস্তোঁরায় জলের বদলে ওয়াইন পান করে, আমিও 'যস্মিন দেশে যদাচার'-এর মত একদিন তাদের সঙ্গে দিব্যি তালে তাল মিলিয়ে চলছিলাম। লেমন সেলো গলায় ঢালতে মনে হল ঠিক যেন আমার স্বর্গতা ঠাকুমার হাতের তৈরি লেবু-মিছরির সরবৎ। ভুলে গিয়েছিলাম আমার ঠাকুমা আর যাইহোক লেবুর সরবতে অ্যালকোহল ঢালতেন না। স্মৃতিবিভোর হয়ে বেশ কিছুটা খাওয়ার পর মাথা যখন বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে আরম্ভ করল তখন আর কোনওরকম উচ্চবাচ্চ্য না করে সে রাত্রের মত বিছানার আশ্রয় নিলাম।
পরের দিন বাসে চেপে টিরেনিয়ান সীর ধার ধরে পেসিতানো ও আমলফির দিকে রওনা হলাম। একদিকে খাড়া পাহাড় আর অন্যদিকে নীল সমুদ্র, মাঝে মধ্যেই ভয় লাগছিল ওই রাস্তায় বাস ড্রাইভারের হাত একটু নড়ে গেলেই সমুদ্রের কোন অংশে যে গতি হবে তার ঠিক নেই। বাসে উঠেই সকলে ড্রাইভার থেকে আরম্ভ করে আশপাশের সবাইকে 'বোনজোরনো' বলে সম্ভাষণ জানাচ্ছে - ইতালিয়ান ভাষায় গুডমর্ণিং। আমরা পোসিতানো বলে একটি জায়গায় নেমে গেলাম। এ তল্লাটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি আর একটি বিষয় খেয়াল করলাম নারী পুরুষ সবাই বড় সুন্দর দেখতে। পাহাড়ি রাস্তায় ওঠানামা করার জন্য কীনা জানিনা কারও শরীরে এতটুকু মেদ নেই। ঝাঁকড়া চুলে ব্লু জিনস্ আর চোখে গগলস্ পরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষেরা আহা যেন প্রত্যেকেই এক একটি 'ক্যাসানোভা'।
পোসিতানোতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে রওনা দিলাম আমালফির দিকে। এখানে রোমান সম্রাটরা ছুটি কাটাতে আসতেন। সম্রাট টেবেরিয়াসের বিরাট ভিলা ছিল এখানে - রোমে রাজত্ব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এই সুন্দর জায়গাগুলিতে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন। এখান থেকে আরও কিছুটা দূরে রেভেল ভিলেজ যেখানে হামফ্রি বোগার্ট কয়েকটা ছবির স্যুটিং করতে এসেছিলেন। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশেছে মানুষের হাতে তৈরি তা সাজিয়ে রাখার চাকচিক্য। এইসব দেখতে দেখতে নিজের দেশের কথা ভেবে মনটা খারাপই লাগছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তো কোন অভাব নেই ভারতবর্ষে, বরং অনেক স্থানই বিদেশের যেকোন জায়গাকে হার মানাবে। যেটা নেই তা হল আমাদের সৌন্দর্যবোধ। সুন্দর জায়গায় আবর্জনা ফেলে আর যত্রতত্র পথের ধারকে পাবলিক টয়লেট বানিয়ে কুৎসিত করে তুলেছি আমরাই।
আমাদের এই অন্যরকম ইতালির শেষ গন্তব্য ছিল 'লাস্পেজিয়া'। এই জায়গাটিকে কেন্দ্র করেই আমাদের 'পোর্তোফিনো' ও 'চিংকেটেরে' যাবার প্ল্যান ছিল। চিংকে মানে পাঁচ আর টেরে হল গ্রাম। ভূমধ্যসাগরের ধারে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে ট্রেকিং করা যায়। এই লাস্পেজিয়ার মত ছোট জায়গাতেও যে এত বাংলাদেশি হকার দেখব তা স্বপ্নেও ভাবি নি। একটি পাকিস্তানি কাবাবের দোকানে দেখলাম শাহরুখ খানের সিনেমা দেখানো হচ্ছে আর তার পাশেই একটি ক্যালেন্ডারে বিশাল ঐশ্বর্য্য রাই-এর ছবি। কাবাবের সঙ্গে সামোসা গোলাপজামুনও সেখানে বিদ্যমান! অদূরেই দেখলাম একজন বাংলাদেশি গেরুয়া বসন পরে সাধুর বেশে ত্রিশঙ্কু হয়ে শূন্যে ঝুলে রয়েছেন, অবশ্য যোগবলে নয়, কোন ম্যাজিকের সাহায্য নিয়ে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম ইনি ইতালিতে একেবারেই নবাগত, এখনও স্থানীয় ভাষা রপ্ত করতে পারেন নি তাই আপাতত চোখ বুঁজে মৌনব্রত অবলম্বন করে ধ্যানে মগ্ন রয়েছেন - একবার ভাষাটা কব্জা করে নিতে পারলেই অন্যান্য হকারদের মত মাঠে নেমে যাবেন। পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে যেই ছবি তুলতে গেছি অমনি সাধুবাবা চোখ মেলে বললেন "ট্যু ইউরো", অর্থাৎ তার ভাসমান ছবি তুলতে গেলে প্রতিবার তার শ্রীচরণে দুই ইউরো করে দক্ষিণা দিতে হবে। নাঃ, এই যোগী পুরুষের ধ্যান ভাঙাতে কোনও সুন্দরী অপ্সরার সাহায্য লাগে না ক্যামেরার একটি ক্লিক শব্দই যথেষ্ট!
হোটেল খুঁজতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে আর একজন বাংলাদেশি হকারকে হোটেলের নাম্বারটা দিয়ে সেলফোনে ডিরেকশনটা জেনে নিতে বললাম। জাহাঙ্গীর ও তার বন্ধুরা ইতালিয়ান থেকে বাংলায় অনুবাদ করে হোটেলে যাওয়ার রাস্তাটি বেশ সুন্দর বুঝিয়ে দিল। তাদের অনেকেই দুঃখ করে জানাল চিনা জিনিসে বাজার ছেয়ে যাওয়াতে ইতালিয়ান কোম্পানীগুলি সব লালবাতি জ্বেলেছে। অত দাম দিয়ে কেউ আর ইতালিয়ান লেদার বা সিল্ক কেনে না সে কারণে ইতালির লোকজনের অবস্থা এখন যথেষ্ট খারাপ। এখন তারা সামান্য ফুটপাথের জিনিসও এই হকারদের কাছ থেকে অত্যন্ত দরদাম করে কেনে সেটা নাকি আগে আদৌ তাদের স্বভাবে ছিল না। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম চিনেদের জন্য সারা পৃথিবীরই একই দুরবস্থা, এমনকী আমেরিকারও তাদের হাত থেকে রেহাই নেই। ভারতবর্ষেও এখন বেনারসী শাড়ি থেকে মা লক্ষীর পট - সব চিন থেকেই আসে। ভয় হয় কোনদিন দেখব কুমারটুলিকে লাটে উঠিয়ে খাঁদা নাকে শয়ে শয়ে মা দুর্গা ছেলেপুলের হাত ধরে সোজা চিনের ফ্যাকট্রি থেকে কলকাতায় এসে হাজির হচ্ছেন।
জাহাঙ্গীরকে বললাম "তোমরা হকারি না করে বরং শুধু বাঙালিদের জন্য একটা ইউরোপ ভ্রমণ এজেন্সি খোল। ইউরোপের চতুর্দিকেই তো দেখলাম, তোমাদের বাংলাদেশি দোকান যেখানে ইলিশ-পাবদা থেকে ল্যাংড়া আম সবই পাওয়া যায়। অনেক বাঙালিই মাছ-ভাত ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারে না আর স্থানীয় ভাষা বোঝে না বলে একা একা আসতে ঠিক ভরসা পায় না। তোমরা পাশে থাকলে তাদের খাওয়া থেকে ভাষা কোনও সমস্যাতেই পড়তে হয় না। তবে ভুলেও মাছভাত খেতে খেতে ইতালি ভ্রমণের বিজ্ঞাপন দিও না, তাহলে কোন লোক পাবে না। এখন ফিউশন্-এর যুগ তাই বিজ্ঞাপনও সেইমত হওয়া চাই। যেমন ধর 'পাবদা থেকে পাস্তা' বা 'পাস্তা পোস্তর মিলনযাত্রা' তাহলেই দেখবে শয়ে শয়ে কলকাতার বাঙালি ইতালি আসার জন্য লাইন দিয়েছে। জাহাঙ্গীর অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে বলল তার খালাতো ভাই কলকাতার ইকবালপুরে থাকে পরের দিনই সে এই ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলে দেখবে। ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে সে রাতের মত পাকিস্তানি দোকানের কাবাব ও গুলাবজামুন খেয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
পরের দিন ট্রেনে চেপে চিংকেটেরের পাঁচটি গ্রামের মধ্যে একটিতে গিয়ে উপস্থিত হলাম যার নাম 'মনটেরোসো'। এখানে ভূমধ্যসাগরের ধারে পাহাড়গুলো অনেকজায়গাতেই একেবারে দেওয়ালের মত খাড়া, আদৌ ঢেউ খেলানো নয়। মনটেরোসো থেকে ভারনাজা গ্রাম পর্যন্ত আমাদের ট্রেকিং-এর পরিকল্পনা ছিল। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সরু সরু তিনশোটা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর মনে হল 'ছেড়ে দেমা কেঁদে বাঁচি'। পাহাড়ের গায়ে লেবু ও আঙুরের ক্ষেত আর তার নীচেই গাঢ় নীল রং-এর ভূমধ্যসাগর। রাস্তা এতটাই সরু যে উল্টোদিক থেকে কেউ এলে অনেকসময় দাঁড়িয়ে যেতে হয়, তাছাড়া পা হড়কালেও সমূহ বিপদ। যেতে যেতে প্রচুর জাপানি, আমেরিকান ও ইউরোপীয়ান ট্যুরিষ্টদের দর্শন মিলল। অনেকেই অবশ্য আমারই মত কিঞ্চিৎ চওড়া রাস্তা দেখলেই তার পাশে বসে হাপরের মত হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার কর্তামশাই লাঠি হাতে একাই যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রার মত এগিয়ে চলেছেন, পেছনের সঙ্গীরা কে রইল বা কে পড়ে গেল সেদিকে কোনও খেয়ালই নেই! পথে বহুবার থামতে থামতে এবং হাঁপাতে হাঁপাতে অবশেষে যখন ভেরনাজাতে পৌঁছলাম, দেখি রাস্তার ধারে একজন বেহালা বাজাচ্ছে - যেন সশরীরে স্বর্গে আসতে পারার জন্য অভ্যর্থনা!
লাস্পেজিয়া থেকে দিন দুয়েক পরে লঞ্চে রওনা হলাম পোর্তোফিনোর দিকে। বহুবছর আগে আমার প্রিয় গায়ক 'আন্দ্রেয়া বোচ্চেলির' গলায় 'লাভ ইন পোর্তোফিনো' গানটি শুনে গায়ক এবং জায়গা দুটোরই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু দুঃখের বিষয় যতবারই পোর্তোফিনো যাবার প্রস্তাব করেছি ততবারই ঘরের মানুষটির কাছে শুনতে হয়েছে "যেখানে ইংল্যান্ডের রানি কী এলিজাবেথ টেলরের মত লোকজন ছুটি কাটাতে যায় সেখানে তুমি গিয়ে কী করবে"? আরে বাবা নাই বা হলাম লিজ টেলর, তাই বলে কি একবার 'পোর্তোফিনো' যেতে পারব না? কুঁজোরও তো এক আধবার চিৎ হয়ে শোবার ইচ্ছা হয়। তাই এবার 'কার হেন সাধ্য যে রোধে তার গতির' মত সোজা পোর্তোফিনোতে গিয়ে হাজির হলাম। এখানে গ্রেটা গার্বো, সফিয়া লরেন, লিজ টেলর ও রিচার্ড বার্টনের মতো মানুষেরা ছুটি কাটাতে আসতেন, ম্যাডোনা তার পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন পালন করতে এখানেই এসেছিলেন। নেমেই শুনলাম স্টিভেন স্পিলবার্গ ও রিহানাকে নাকি লোকজন ঘুরতে দেখেছে। আমার বরাৎ খারাপ তাই কারুর সঙ্গেই মোলাকাৎ হয়নি। সমুদ্রের ধারে এই জায়গাটি নিঃসন্দেহে খুবই সুন্দর, তবে এর থেকেও সুন্দর জায়গা ইতালিতে আছে - তফাৎ একটাই গ্ল্যামার বা চাকচিক্যে।
হোটেলগুলিকেও পাহাড়ের ধাপে ধাপে এমনভাবে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে, যাকে বলে একেবারে পারফেক্ট। বেন্টলি বা লমবারগিনি যে দামি গাড়ি সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। বাইরের কেউ এখানে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে পারে না, এটাই নিয়ম। শেষ লঞ্চটিও ছাড়ে বিকেল চারটেয় যাতে আমার মতো আমজনতারা তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে পারে। ব্যুটিকের দোকানে জামাকাপড় থেকে জিনিসপত্র সবারই গগনছোঁয়া দাম। লঞ্চে একটি ছোট্ট পিৎজা পঁচিশ ইউরো দিয়ে কিনে খেতে খেতে মনে হল পেটে গিয়ে হজম হলে হয়! হোটেলগুলো যা দামি, দেখে মনে হয় সবাই যেন এক একটি সুন্দরবনের বাঘ। দূর থেকে এক ঝলক দেখেই সাধ মেটানো ভাল, কাছে গিয়ে শুভদৃষ্টি করতে গেলেই হয় প্রাণে নয় ধনে মারা যাবার সম্ভাবনা। বাইরে থেকে সেগুলো দেখতেও প্রায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতনই সুন্দর। ট্যুরিষ্টরা দেখলাম তিনগুণ দাম দিয়েই পোর্তোফিনো লেখা টিশার্ট কিনছে। লাস্পেজিয়াতে ফিরে গিয়ে খেয়াল করলাম দোকানে একই টিশার্ট হাফ দামে বিক্রি হচ্ছে। দামের এত তফাৎ কেন জিজ্ঞাসা করাতে দোকানদার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল ,"দিস ইজ লোকাল মার্কেতো, দোজ্ আর ফর স্তুপিডো ত্যুরিস্তো"!
লেখাটা শেষ করার আগে হঠাৎ খেয়াল করলাম বাংলা উচ্চারণের সাথে ইতালিয়ান উচ্চারণের অনেকক্ষেত্রেই বেশ মিল আছে। আমরা বাঙালিরা সারাক্ষণই যেন মুখে রসগোল্লা পুরে দিব্যি গোল গোল উচ্চারণ করি তাই রজনীকান্ত আমাদের কছে হয় রজোনীকান্তো। সেইরকমই ইতালিয়ানদের কাছে মার্ক হয় মার্কো বা অ্যাঞ্জেল হয়ে যায় অ্যাঞ্জেলো। তাই উচ্চারণ ঠিক রেখে এবং অযথা ওকার যোগ করে দেখি শেষ পাতে কিছুটা ইতালিয়ান স্বাদ আনা যায় কিনা। এতক্ষণ ধরে যে ভিন্ন স্বাদের ইতালির কথা লিখলাম সেখানকার লোকজোন নিঃসন্দেহে খুবই মার্জিতো, শিক্ষিতো এবং অতিমাত্রায় অভিজাতো। দুপুরে কিঞ্চিতো ঝিমোন্তো থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে গান বাজনা ও ওয়াইন সহযোগে তারা হয়ে ওঠেন জীবন্তো, যদিও কখনই মাত্রা ছাড়িয়ে হন না অশান্তো। পাহাড়ি রাস্তায় এরা সারাক্ষণই চলন্তো তাই অত জিলতো খেয়েও শরীর মেদবর্জিতো যাকে ইতালিয়ানোতে বলে একেবারে পারফেকতো। এককথায় পাহাড়, হ্রদ ও নীল সমুদ্রের খাঁজে খাঁজে ফুলে ফলে ঢাকা এই ভিলেজগুলো একেবারে দুর্দান্তো। পড়তে পড়তে আমার বন্ধুরাও বোধ হয় এতক্ষণে ক্লান্তো, তাই আমার এই ভ্রমনকাহিনি আজ এখানেই করলাম সমাপ্তো বা কমপ্লিতো। (পুনশ্চোঃ বানান ভুলগুলো ইচ্ছাকৃতো। )
~ ইতালির আরও ছবি ~
শ্রাবণী ব্যানার্জির জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীত ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে সারা বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।