পাহাড় পানির দেশে
মো: মহিউদ্দিন
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। এখনও আমাদের এইযাত্রার গাইড নুরভাই এসে পৌঁছাননি। খবর পেয়েছি তিনি অটোতে করে গাড়ি ধরতে ছু্টেছেন। ততটা উদ্বিগ্ন হচ্ছিনা অবশ্য - আর যাই হোক যাত্রাবাড়ির জ্যাম পেরোতে আমাদের একঘন্টাতো লাগবেই। অবশেষে কমলাপুর এসে নুরভাই আমাদের ধরে ফেললেন। ঈদের আগে যাচ্ছি, শেষ মুহূর্তে বাসের টিকিট করাতে একেবারে পিছনের সিটগুলোই জুটেছে। জ্যাম ছাড়তেই প্রায় রোলার কোস্টার এর মত ছুটে চলেছি।
রাত দশটায় ছেড়ে ভোরে সূর্য ওঠার আগেই আমাদের নামিয়ে দিল রাঙ্গামাটি বাস স্ট্যান্ডে। রাতে ঘু্মানো তো দূরের কথা বাস থেকে নেমে আগে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলাম। হাতমুখে পানি নিয়ে নাস্তা সারলাম ডাল পরটা আর ডিমে। আমাদের গন্তব্য ছোট হরিনা, যেতে হবে পানি পথেই। কাপ্তাই ও কর্ণফুলীর বুক চিরে কিছু ছোট ছোট লঞ্চ চলাচল করে। খুব সুন্দর এই লঞ্চগুলো। দোতলাটা কাঠের ফ্রেমের, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভাল লাগল। প্রথম দিকে স্থানীয় মানুষরা অপরিচিত আমাদের দেখছিলেন কৌতূহলী দৃষ্টিতে। খুব বেশীক্ষণ অপরিচিত থাকতে হলনা অবশ্য, বেগ ভাই তাদের সঙ্গে দিব্যি গল্প জুড়ে দিলেন। আমরাও জুটে গেলাম। ৭:১০ এ লঞ্চ ছাড়ার আগে বাজার থেকে বেগ ভাই কয়েকটা কমলা আনলেন, খেলাম - মন ভাল হয়ে যাবার মত টক!!
কাপ্তাই প্রথম দেখছি। সকালের রোদে মায়াবী লাগছিল ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা এই বিশাল সবুজ জলরাশি। কৃত্রিম এই লেকের পানি মনে হচ্ছে যেন মাছের অভয়ারণ্য। কিছু জেলেকে মাছ ধরতে দেখা যাচ্ছে। হালকা বাতাসে মৃদু ঢেউ উঠছে টলটলে পানিতে। পর্যটন আকর্ষণ পেদা টিং টিং, শুভলং ঝরনা পার হয়ে বরকলের দিকে ছুটছি। এদিকটাতে গুগুল-এ আগেই দেখেছিলাম অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপের ফাঁকে ফাঁকে পানি লুকিয়ে আছে। এক কথায় অসাধারণ। মনে হল কোন একটা দ্বীপে ঘর বেঁধে থেকে যাই। ভারত থেকে আসা কর্ণফুলী নদীতে এখন আমরা। বরকলের পাহাড়গুলো একটু বড় বড়ই মনে হল। পাহাড়, নদীর মিশ্রণে বর্ণিল আকাশ দেখতে দেখতে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পানি পথে কলাবইন্না, গোরস্থান, ভুশনছড়া পার হয়ে দুপুর ১২:০৬-এ পৌঁছলাম ছোট হরিনায়। ছোট একটি বাজার ও অদেখা বিজিবি ক্যাম্প, দুপাশে ছোট বড় পাহাড় আর পাশেই বয়ে চলা কর্ণফুলী নদী এই হল ছোট হরিনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। লঞ্চ থেকে নেমে বিজিবি ক্যাম্পে সরল আত্মসমর্পণ। আমাদের দেখে নিতান্তই অবাক হয়ে নানারকম প্রশ্ন করলেন তাঁরা। হাসিমুখে একে একে সব উত্তর দিলেও তাদের বোঝাতে হয়ত পারলাম না আমাদের ভ্রমণের উন্মাদনা। ঈদের সময় কেউ কি এই অজপাড়ায় আসে?? নাম ঠিকানা বিস্তারিত জমা দিয়ে ঘণ্টা খানেক পর ছাড়া পেলাম তাদের কাছ থেকে।
থাকার ব্যবস্থা বলতে বাজারে দু্টো মেসের মত আছে কবির ও এমদাদ ভাইয়ের। তবে তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কিছু না পেয়ে একটা খাবারের হোটেলে ঢুকলাম। বাহ! এখানে খাবারেরও মহামারী হত যদি আরও একটু দেরি করতাম। তবে তৈরি ছিলনা, রান্না করে দেবে, তাও ভাল। দোকানে বসেই ঝিমোতে লাগলাম। থাকার ঠিকানা এখনও বিরল। নুর, ডায়না ঘুমের সাগরে আর দুপুরের তীব্র গরম ও শরীরের ক্লান্তিকে কর্ণফুলীর জলে ভাসাতে চলল বেগ ভাই। দুপুরের খাবার তৈরি হলে নুর, ডায়নাকে ডেকে ডাকতে গেলাম বেগ ভাইকে, দেখলাম ভাইয়া পানিতে না লঞ্চ থেকে হাসি মুখে নামছে। লঞ্চের সবার সাথে সখ্যতা আগেই হয়ে গিয়েছিল, সেটাকেই সাঙ্গ করে তাদের সঙ্গে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে এসেছেন। অগত্যা খাওয়া শেষ করে গৃহ প্রবেশ করলাম - সঙ্গে থাকা তাঁবু দুটো লঞ্চের পেছনের ছাদে টাঙিয়ে ফেলে। সবাই একটু অবাক হয়েই দেখছিল আমাদের, যেমনটা আমরা সার্কাসে গিয়ে দেখি আরকী। ঘরবাড়ি টাঙিয়ে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিশে গেলাম। বিকেলে ক্লান্ত শরীর কর্ণফুলীর শীতল পানিতে এক অন্যরকম প্রশান্তির সন্ধান পেল। চায়ের সঙ্গে জমে উঠল সান্ধ্য আড্ডাও। ফুরফুরে মন নিয়ে আড্ডার ফাঁকেই ডায়নাকে নিয়ে নুর চলল ঈদের বাজার আর রাতের খাবার কেনাকাটা করতে। ফিরে এল সকালের জন্য দুধ, সেমাই, চিনি ও রাতের জন্য গোল আলু ও ডিম নিয়ে!!! লবণ দিয়ে ডিম ও আলু সেদ্ধ। খোলা আকাশের নীচে এমন খাবার, সত্যি বলতে কী ভালোই লাগলো। পূর্ণিমা না হলেও চাঁদ তার রাজত্ব সাজাতে শুরু করেছে। রাতের আকাশ সেজেছে নক্ষত্রের সমারোহে। রাত জাগা পাখি ও আমরা ক'জন ছাড়া মায়াময় এই পৃথিবীতে সবাই-ই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
আকাশের তারা দেখতে দেখতে চোখের পাতা ভারি হয়ে এল আমাদেরও।
নদীর কোলে, কুয়াশার চাদর গায়ে দেওয়া ঘুম ভাঙ্গতে একটু কষ্ট হল। ভোরের পাখির কলকাকলিতে সকালটা ভালই লাগছিল। নদীর বুকে মেঘ এখনও ঘুমিয়ে। সূর্য এখনও কুয়াশার আবডালে ঢাকা। আজ ঈদুল আযহা, কোরবানির ঈদ। বেগ ভাই ও নুর ভাইকে নিয়ে নামাজ পড়তে ছোট বাজারের বড় মসজিদে গেলাম। মায়ের কাছে শুনেছি এই ঈদে খালি পেটে নামাজ পড়তে যেতে হয়, নামাজ শেষে বাসায় এসে খেতে হয়। নামাজ শেষে ভ্রাম্যমাণ বাড়িতে ফিরে দেখি ডায়না সেমাই ও নুডলস রান্না করে আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।
লঞ্চ আজ ফিরবেনা, সারা দিন এখানেই কাটাতে হবে। বিজিবি কর্মকর্তারা কাল থেকে আমাদের একরকম নজরবন্দী করে রেখেছিলেন। আজকেও সকাল সকাল দেখা করে আমাদের তাঁবুবাড়ি দেখে প্রশংসাও করলেন। পাহাড়ের দিকে যেতে নিষেধ করলেও ওপারে বাঙালির গ্রামগুলো দেখে আসার পরামর্শ দিলেন। ওদিকটাতে যাওয়ার বাহন বলতে কিছু মটোর সাইকেল আছে। নিতান্তই একটা পায়ে চলা পথ। আজ সারা দিন হাঁটব বলেই প্রস্তুত হলাম। আমাদের ক্রুজের ইঞ্জিনিয়ার সুমিত চাকমা ভাই আমাদের সঙ্গে পা বাড়ালেন। গ্রাম যেহেতু আছে, ঘরবাড়ি তো থাকবেই, ঘরবাড়ি যদি থাকে মানুষতো থাকবেই। তাই খালি হাতে যেতে ইচ্ছা হল না। এক বড় বোয়াম চকলেট সাথে নিয়ে নিলাম। আমাদের পাঁচ জনের ঈদ যাত্রায় যত ক্ষুদে বন্ধুদের পেলাম সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে করাতে এগোলাম। তাদের কেউ কেউ ছিল অবাক, কেউবা ভীত, কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে চেয়েই রইল। তবে হাতে চকলেট পাওয়ার পর সবাই আমাদের হাসি মুখেই বিদায় জানাল। নিজেদের ঠিক রবি ঠাকুরের 'কাবুলিওয়ালা'র মত লাগছিল। আনন্দ বিলানোর মত আনন্দ কমই আছে।
শহরের নিরেট যান্ত্রিকতার ভিড় ভুলে সবুজের মেলায় হাঁটছি। বর্ষা শেষ, শরৎও বিদায় চাইছে, নদীর পানি এখনও পরিপূর্ণ। দোয়েল, শালিক, কোকিল, ঘুঘু, চড়াইয়ের ডাকে মুখরিত চারিদিক। গাছপালায় সবুজ পাতা যেন সেজেছে ঈদের সাজ। টুকরো টুকরো মেঘের ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে সোনালি রোদ। প্রকৃতির এই মোহিনী সৌন্দর্য সুধায় মাতোয়ারা হয়ে আমরা পাঁচ অভিযাত্রী হেঁটে চলেছি আর গলা ছেড়ে গাইছি প্রাণের গান।
চলতি পথে অনেকগুলো বাড়ি পড়ল। প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেলাম। তাই আরও নিশ্চিন্তে হাঁটতে লাগলাম। পথে যেতে যেতে মালিকের অনুমতিতে গাছ থেকে ডাব পেড়ে তা কিনে নিয়ে প্রাণ ভরে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলাম। সেই বাড়িতে ঘুঘু মারার ফাঁদ দেখারও সুযোগ হল। অভিনব কায়দা - বলা যায় ধোঁকা দিয়ে ঘুঘু ধরা। ব্যাটায় ডজন খানেক ফাঁদ বানিয়েছেন যার প্রতিটাতে একটি করে ঘুঘু। ব্যাপারটা খারাপ লাগলেও অপরিচিত জায়গায় ওনাদের বাড়িতে বসে আর এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারলামনা।
পথ এবার পাহাড়ি রূপ নিল। হঠাৎ ভর দুপুরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পেলাম। গাছ এখানে ঘন হয়ে এসেছে। রোদের আলো গায়ে পড়ছে না, গাছের বাধায়। শীতল একটা অনুভুতি বয়ে নিয়ে এল নদীর বাতাস। গল্প করতে করতে হেঁটে চললাম। গা ছমছমে এই পথ পাড়ি দিয়ে ভুশনছড়ায় পৌঁছলাম। অবশিষ্ট চকলেট বিলিয়ে দিলাম বাজারে থাকা ক্ষুদে বন্ধুদের। পাহাড়ি, বাঙালি উভয়েরই দোকান আছে এ বাজারে। গাঁয়ের মেঠোপথের দুধারে গড়ে ওঠা কয়েকটা দোকান নিয়ে ভুশনছড়া বাজার। আজ ঈদ হলেও বাজারে খুব বেশি লোকজন চোখে পরলনা। একটা দোকানে বসে চা পান করে ফিরতি পথ ধরলাম। এ গাঁয়ের এক শুভাকাঙক্ষী তাঁর বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। খানিক এগোতেই দেখি বেগভাই কার সঙ্গে যেন হাত মেলালেন। কাছে গিয়ে দেখলাম আমন্ত্রণদাতা সেই ভদ্রলোক!!! চলে যাচ্ছেন কোন এক কাজে। ঈদে গরম গরম গোস্ত খাওয়ার স্বপ্নও মনে হল তাঁর সঙ্গে উধাও হয়ে গেল। ওনারইবা দোষ কী? ঘড়িতে তিনটে অনেক আগেই বেজে গেছে। যাক বিমর্ষ মন নিয়ে আমাদের লঞ্চের দিকেই চললাম। তারমধ্যেই নুরভাইয়ের উদ্যোগে নিমন্ত্রণ জুটে গেল আরেকটি বাড়িতে। মাটির ভিটাটা অনেকটা উঁচুতে। গাছের ছায়ায় ভরদুপুরেও ঠাণ্ডা পরিবেশ। এক বোল ভাত, গরম্ন, খাশির সবজি ও ডাল আমাদের সামনের হাজির করলেন এমদাদ ভাই, যাঁকে খুঁজেছিলাম গতকাল কটেজের জন্য। 'আমার কটেজে যেহেতু আপনাদের রাখতে পারি নাই তাই এক বেলা খাওনোর খুব ইচ্ছে ছিল আপনাদের', এমনটাই বললেন এমদাদ। খুব অবাক হলাম এভাবে সব মিলে যেতে দেখে। আসলে এটাই তো হবার কথা। হ্যাঁ, আমার বাংলাদেশ এমনই।
সন্ধ্যা হয়ে গেল ফিরতে ফিরতে। ফেরার পুরো পথটুকু এমদাদ ভাই আমাদের সঙ্গেই এলেন। নদীর এপার থেকে দেখতে পেলাম আমাদের লঞ্চ বাড়ি। অনেকটা পরিচিত হয়ে গেলাম এই ছোট হরিনার সঙ্গে। সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে। পাখিরা ফিরেছে নীড়ে। আমরাও ফিরে এলাম লঞ্চে। সন্ধ্যায় বিজিবির কর্মকর্তারা আরেকদফা সাক্ষাৎ করে গেলেন। রাতে সেই দুপুরের খাবার ক্রুজের সবাইকে নিয়ে উৎসবের মত করেই খেলাম। কাল সকালে ভোরে লঞ্চ ছুটবে রাঙ্গামাটির দিকে। আমাদের গন্তব্য শুভলং। লঞ্চ ধরার কোন টেনশন নেই, তাই ঘুমাতে যাওয়ার তাড়াও নেই। রাতের আকাশে চাঁদ, তারা আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলা। মৃদু কুয়াশাও আছে। সবাই ঘুমের দেশে। এমনি এক মহেন্দ্রক্ষণে আমরা হারিয়ে গেলাম পুরনো স্মৃতির পাতায়। মনের সিন্দুক থেকে একে একে বের হয়ে এলো হারিয়ে যাওয়া কিছু ঘটনা। প্রকৃতি ও বন্ধুর কাছে মনটা হালকা করে, এক ভিন্ন ঈদের আনন্দ নিয়ে ঘুমোতে গেলাম।
সকাল হল সারেং ভাইয়ের ডাকে। ০৫:৩০ ঘড়িতে, আজ ছোট হরিনা ছেড়ে যাবে লঞ্চ। আমরা যাব শুভলং পর্যন্ত। ৬ টায় ছাড়বে। লঞ্চের ক্যান্টিন পরিচালক মোসলেম ভাই নিয়ে এলেন গরম গরম চা। চা হাতে তাঁবু থেকে বেরিয়েই চোখ-মন জুড়িয়ে গেল আরও একবার কর্ণফুলীর বুকে সকাল দেখে। নদী, পাহাড় ও কুয়াশার এক মায়াবী মিশ্রণ। হাজার হাজার শালিক চড়ুই ব্যস্ত সারা দিনের পরিকল্পনায়। তাদের কলকাকলীতে সরব হয়ে উঠেছে ছোট হরিনা, মনে হচ্ছিল যেন আমাদের বিদায় দিতেই এই আয়োজন।
টুং টাং, বেজেই যাচ্ছে ফোন। একে একে তেত্রিশটা মুঠো বার্তা। ঈদের শুভেচ্ছা জানালো সবাই, একদিন পরে পেলাম। ওদিকে নূর ভাইয়ের ফোনে শামিমের কণ্ঠ শোনা গেল। আজ তাদের বরকল আশার কথা তান্নিকে নিয়ে। আমাদেরও বরকল নামার কথা ছিল। তবে মারিসশা যেহেতু আমাদের আজকের গন্তব্য তাই আগে শুভলং জেতে হবে, ওদেরকেও ওখানেই নামতে বললাম। অল্প কিছু নাস্তা কিনে নিলাম বরকল বাজার থেকে।
একে একে লঞ্চের সবার কাছে বিদায় নিয়ে শুভলং নামলাম। মারিসশার লঞ্চ আসতে একটু সময় লাগবে। পাহাড়ি এলাকা এই শুভলং। পাহাড়িদের কাপড়ের দোকান চোখে পড়ল। মোটামুটি বড় বাজার। প্রচুর পর্যটক আসে বলেই হয়তো। কিছু কেনাকাটাও হল। হাতে আরও সময় আছে তাই খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। শুধুই চড়াই তাই ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তার ওপরে সূর্যের তাপও প্রচণ্ড। নীচে নেমে আসতেই লঞ্চ চলে এল। স্থানীয় লঞ্চ, মানুষে বোঝাই হয়ে আছে। কোন রকমে আগুপিছু হয়ে বসে ছুটলাম কাপ্তাই এর অবারিত জলরাশির মন মাতানো ভুবনে। শুভলং-এর পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছিল কাপ্তাই-এর বিস্তৃত নীল রাজত্ব। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ। ছোট এই লঞ্চটি দ্বীপগুলোর পাশ কাটিয়ে ছুটে চলল বাঁধন হারা পথে। সাধারণ মানুষের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে তাদের সঙ্গে গল্প-গানে মেতে উঠলাম কিছু পথ। স্বচ্ছ পানির নীচের শেওলা, ছোট ছোট পানির গাছ দেখা যাচ্ছে বেশ স্পষ্ট। তার ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে লেকের বাসিন্দা মাছের ঝাঁক। দারুণ উপভোগ্য। লেকের স্বচ্ছ পানি পূর্ব দিকে মিশেছে বরকলের পাহাড়ের গায়ে। বরকলের এই পাহাড়ের রেঞ্জটা মারিসশা পর্যন্ত গেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল সেই দুর্গম পথে পাড়ি দিই। সচরাচর কেউ এ পথে যায়না, তবে পাহাড়িদের সঙ্গে সেটেলারদের খারাপ সম্পর্কও এর একটা কারণ। তাই স্থানীয় লোকজন আমাদের বারণ করেছিলেন। তবে আমাদের বিশ্বাস এই পাহাড়ে যাঁরা বাস করেন, অন্যান্য জায়গার মতই তাঁরা ভালো ব্যবহারই হয়ত করতেন। সেই আশা নিয়েই হয়ত পরবর্তী কোন এক সময় আবার আসব। ঈদের দ্বিতীয় দিন, আজ সেজেগুজে মানুষ আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছেন। সেজেছে এখানকার প্রকৃতিও, অসাধারণ রূপে সেজেছে আমার দেশ, মনের অজান্তেই গুনগুন করে গান গাইছিলাম আর ক্যামেরার চোখে কিছু মুহূর্ত ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম।
পথে ছোট বড় কয়েকটা দ্বীপে থামল লঞ্চটি। বিকেলের দিকে লোক কমে গেল অনেকটাই। জায়গা নিয়ে বেশ আয়েশ করেই বসলাম এবার। লেক এখানে সরু নদীতে বদলে গেছে। দুপাশে ধান খেত, মাঝে মাঝে গ্রামের ছোট ছোট পাড়া। গ্রাম বাংলার রূপের সঙ্গে সাঁঝের বেলার গল্প জমে উঠল। গল্প শুনছিল পাশে থাকা যাত্রীরাও। তাদের মাঝ থেকে ছোট্ট একটি ছেলে আমাদের প্রশ্ন ছুড়ে দিল – 'আপনারা কি নিশাত মজুমদার কে চিনেন?' জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম তার নাম জয়নাল আবেদিন আজাদ। দুরছরি বাজারের জগন্নাথ মন্দিরের পেছনে তার বাড়ি, শহর থেকে অনেক দূরে থাকে সে। এমনই এক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলের মুখে পরিচিত নাম শুনে অবাক হলাম। পাল্টা প্রশ্ন করলাম, 'তুমি কি করে চিন তাকে?' আজাদ বলল, 'পেপারে পড়ছি। এভারেস্ট জয় করেছিল তিনি।' সঙ্গে যোগ করল তার নিজের স্বপ্নের কথাও - বন্ধুদের নিয়ে নিশাত আপুর সঙ্গে এভারেস্ট যাবে সে। পড়ার টেবিলে বসে এমনই কল্পনা তার। আরও কথা হল তার সঙ্গে। বেশ অবাক হলাম। দুরছরিতে নেমে যাওয়ার আগে আজাদের ফোন ও ঠিকানা নিয়ে নিলাম। কখনও যদি সুযোগ হয় তাকে তার স্বপ্নের পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।
সন্ধ্যা নামল। চাঁদের রুপোলি আলো স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে তার ভুবন সাজাতে শুরু করলো। আমরা পরিতৃপ্ত মন নিয়ে মাঝি মাল্লার গান গাইতে গাইতে পৌঁছে গেলাম মারিসশায়। থাকার জায়গা পাবতো!!! লঞ্চের সঙ্গে আগে ভাগেই কথা বলে নিলাম। তারপর নিশ্চিন্ত মন নিয়ে ঠিকানা খুঁজতে বের হলাম। ঘাট থেকে উঠেই একটি বিশাল মাঠ চোখে পড়লো, মাঠকে বামে রেখে কিছু দূরে হাঁটতেই একটা রেস্ট হাউস পেলাম। কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে ঘরও পেয়ে গেলাম। রাতে খাওয়া হল জম্পেশ - আলু ভর্তা, মুরগির ঝাল তরকারি, মরিচ ভর্তার সাথে ভাত। গরম গরম জিলিপি দিয়ে মিষ্টি মুখ করলাম। তবে মনের মিষ্টির যোগান দিল বেগ ভাই। সাজেক কিন্তু' খুব বেশি দূরে নয়। ইচ্ছে হলে কাল ঘুরে আসা যায়!!! অনেক দিন এপথে আসার অনুমতিও ছিলনা। তাই তীরে এসে তরী না ডুবিয়ে একটা জীপ ভাড়া করে ফেললাম। মারিশার থেকে সাজেক ঘুরিয়ে বাঘাইছড়ির পথে ছেড়ে দেবে। সাজেক ভ্রমণের রোমাঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালাম।
সকালের নাস্তা প্যাক করে নিয়ে নিলাম, পথে খেয়ে নেওয়া যাবে। প্রায় সবাই মিলেই গাড়ির ছাদে চড়ে বসলাম। ইঁট বিছানো পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ঘন সবুজ বনের ভেতর দিয়ে যেন উড়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। খানিকটা এগিয়ে পিচ ঢালা মসৃণ পথ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে কখনও ওপরে আবার কখনওবা তীক্ষ্ণ বাঁক ধরে দুরন্ত গতিতে নেমে যাচ্ছে। পিচঢালা পাহাড়ি এই সরু পথের দুধারে বড় বড় ঘাসের বন। একেকটা চার-পাঁচ ফুটের সমান হবে। পথটি তাই অসাধারণ লাগছিল। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল পথ্টা যেন সোজা মিশে গেছে আকাশে। ওখানে গেলেই বুঝি আকাশটা ছোঁয়া যাবে। রাঙ্গামাটি ছেড়ে দুপাশের পাহাড়গুলো খাগড়াছড়িতে প্রবেশ করেছে। এখানে পাহাড়ের উচ্চতাও বেড়ে গেছে অনেকখানি। পাহাড়ের উঁচু থেকে নীচে দেখা যাচ্ছে শত শত ছোট ছোট টিলা। সাজেক ভ্যালি! অনেক নাম শুনেছিলাম। আজ দেখে আমাদের কেউ কেউ একে বাংলাদেশের দার্জিলিং বলে ফেলল। সত্যিই যেন তাই মনে হচ্ছিল। ভাল লাগা - এর জন্যই হয়তো বেঁচে আছি। ছবি তুলছিলাম একের পর এক। আমাদের জীপটা রিজার্ভ করা থাকলেও পথে স্থানীয় মানুষদেরও তুলে নিচ্ছিলাম। তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্যও। আবার আর্মি ক্যাম্প!!! আমাদের দেশটাকে তখনই ছোট মনে হয় যখন বাধা পাই একটু স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে। যাই হোক এই ক্যাম্পে আমাদের থামতে হল না। ছুটে চললাম নিজেদের গন্তব্যে।
পথে মাঝে মাঝে ছোট বড় বাজার পড়ল, সেখানে নেমে পানি খেয়ে নিলাম। চলন্ত গাড়িতে বাতাসের বেগ থাকায় সূর্যের তাপ এতক্ষণ টের পাইনি। গাড়ি থেকে নামতেই হাত-মুখ সব জ্বালা করতে লাগল। রোদ থেকে বাঁচতে গামছা জড়িয়ে নিলাম। মাইল ফলক দেখছি একটু পর পর, ধীরে ধীরে চলে এলাম সাজেক। ০ পয়েন্ট থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার আগে একটা চার্জ আছে সেখানে নামিয়ে দিল গাড়ি চালক। বলল এখান থেকে হেঁটে যান, ভাল লাগবে। এতক্ষণ দেখার আনন্দে নাস্তা খেতে ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি সেগুলোর সদ্গতি করলাম।
সাজেক ভ্যালির রূপের কথা আমার কলমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তারপরও চেষ্টা করছি। অসংখ্য পাহাড়ের গা বেয়ে সাজেকের রিজে চড়ার পিচ ঢালা পথ ০ পয়েন্টের আর্মি ক্যাম্প পর্যন্ত গেছে। প্রায় ১৫০০ ফুট উঁচুতে শেষ হয়েছে এই পথ। রাস্তার দুপাশ খাড়া নীচে নেমে গেছে, ওপর থেকে তাকালে চোখে পড়ছে অগণিত ছোট ছোট পাহাড়ের ভ্যালি। তিনটি হেলিপ্যাড ও আর্মি ক্যাম্প জুড়ে রেখেছে পুরো এলাকাটি। ডান দিকে দেখা যায় বিশাল এক দেওয়াল। মায়ানমারের পাহাড় ওই দেওয়ালটা। সেটাও একটা পাহাড়ের রিজ তবে অনেকটা উঁচু। আর এই দুইয়ের মাঝে অনেক নীচুতে সারি সারি ছোট ছোট পাহাড়।
ফেরার পথে জীপ আমাদের বাঘাইছরি উপজেলার বাঘাইহাটে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে দীঘিনালা পর্যন্ত স্থানীয় জীপে চড়ে গেলাম। তারপর ছোট্ট একটি বাসে চেপে খাগড়াছড়ি। আজই ঢাকায় ফিরব তাই প্রথমেই বাসের খোঁজে কাউন্টারে গেলাম। রাত ৯ টায় গাড়ি ছাড়বে। হাতে এখনও পাঁ-ছ'ঘণ্টা সময় আছে। চটপট দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটা সি.এন.জি. রিজার্ভ করা হল। শ পাঁচেক টাকা নেবে। বিনিময়ে আমাদের রিয়াংসুই ঝরনা ও আলু টিলা দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা হলে ঝরনার দিকে যাওয়া মুশকিল হবে তাই সেদিকেই আগে চললাম। মূল রাস্তা থেকে ডানদিকে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে একটু পরেই নামতে হল। গাড়ি আর যাবেনা, বাকী মিনিট কুড়ির পথ হেঁটে যেতে হবে। কিছুটা পথ কাঁচা রাস্তা হলেও ঝরনার পাশে পাকা সিঁড়ি করা হয়েছে পর্যটকদের সুবিধার্থে। পানির ধারা প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে একটি ঢালু জমিতে। বিশাল সেই ঢালু জায়গাটার ডান কোনা দিয়ে পানির ধারা নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কেউ কেউ সেখানে স্লিপও খাচ্ছে দেখতে পেলাম। গরমে শীতল পানির আরাম নিতে আমিও নামার তোড়জোড় করলাম। তখনই খবর পেলাম কেউ একজন পাথরে পা পিছলে পড়ে মাথা ফাটিয়েছে। ভালোই লেগেছে দেখলাম।। ফার্স্ট এইড বক্স সঙ্গে ছিল। প্রাথমিক ভাবে যা করার করে তাকে দ্রুত হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে যেতে বললাম। হাতে সময় কম থাকায় হাল্কা গা-মাথা ভিজিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। পরের গন্তব্য আলু টিলা। অন্ধকার নেমে এসেছে পাহাড়ি জনপদে। লাইট জালিয়ে চলেছে সব গাড়িই।
আলু টিলা। এখনও প্রবেশ দুয়ার খোলা। কোন গার্ড নেই, নেই কোন দর্শনার্থীও। আমাদের দলের সবাই দার্জিলিং গিয়েছি হিমালিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং-এর প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানকার রাতের দৃশ্য মনে পড়ে গেল। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখতে পেলাম খাগড়াছড়ির রাতের রূপ। পাহাড়ি শহর। পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা ঘর বাড়ি। সেখানে জোনাকি পোকার মত জ্বলছে বাতিগুলো। অসাধারণ লাগল।
অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেলনা, স্থানীয় পুলিশ আমাদের নিজেদের সুরক্ষার খাতিরেই বিদায় নিতে বলল ভদ্রভাবেই।
এবার ফেরার পালা, আকাশের চাঁদ মধ্য গগনে বিরাজ করছে, শহরের দিকে ফিরছি আমরা। চাঁদের সাজ দেখে মনে হল আজ বা কাল পূর্ণিমা। তান্নি জানালো খাগড়াছড়িতে নাকি কোন এক পূর্ণিমাতে হাজার বাতির এক উৎসব হয়। সেদিন তারা হাজার হাজার মোমবাতি জ্বালায়, ফানুস ওড়ায়, প্রার্থনা করে। এটা বৌদ্ধদের খুব বড় একটা উৎসব।
শহরে ফিরে এলাম। ঢুকেই দেখলাম একটা বাড়িতে অনেকগুলো মোম জ্বলছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল সবার মধ্যেই। আজই কি তাহলে সেই উৎসব - "আশ্বিন পূর্ণিমা"? বাহ! এরই নাম কপাল। সাড়ে ন'টার এখনও এক ঘণ্টা দেরি আছে। ওদের সঙ্গে চলে গেলাম এক মাঠে। প্রদীপ জ্বালালাম সেই আনন্দ উৎসবে।
সুন্দর একটা মনভরানো ভ্রমণের শেষে উৎসবের রেশটুকু মনের মধ্যে বুনে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
মহম্মদ মহিউদ্দিন – মাউন্টেনিয়ারিং আর নানান অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা ছেলেবেলা থেকেই। 'এক্সপ্লোর বাংলাদেশ' ট্যুরিজম সংস্থার ট্রাভেল এক্সিকিউটিভ মহি-র স্বপ্ন সাইকেলে সারা বাংলাদেশ ভ্রমণ।