অন্নপূর্ণার চরণতলে
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
~ ~ অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প ট্রেক রুট ম্যাপ ~ অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প ট্রেকের আরও ছবি ~
"ভিক্ষাম দেহি কৃপাবলম্বণকারী
মাতান্নপূর্ণেশ্বরী"
"পরিকল্পনা"
"অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প? পাগল নাকি? অসম্ভব!" এটাই ছিল আমার প্রথম রি-অ্যাকশান যেদিন নীলাদ্রি প্রস্তাব পেশ করল জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ফোর্থ ফ্লোরে আমাদের রুমে। আমাদের মানে, আমার, সুদীপ আর নীলাদ্রি-র অফিসের বসার ঘরে। মনটা খুব খারাপ ছিল সবারই। "হিমালয়ান সুনামি"-তে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল উত্তরাখণ্ড, আর তার সঙ্গে আমাদের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ট্রেক-এর সব পরিকল্পনা। টিকিট শেষ মুহূর্তে ক্যান্সেল করে মনখারাপ সঙ্গে নিয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায় তখনই নীলাদ্রি বলে উঠল এবিসি যাওয়ার কথাটা। সেরকম বড় কোনও ট্রেক এর অভিজ্ঞতা আমার ছিল না, তাই শুনেই এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিলাম। সুদীপও কিন্তু ওর কথায় নেচে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করল আমাদের ট্রেক ক্লাব "পদাতিক" এর চতুর্থ সদস্য সৌনীপ এর সঙ্গে। আমি জানতাম ও রাজি হবেই। হলও তাই। অগত্যা এক যাত্রায় পৃথক ফল না করে শুরু হল "মিশন এবিসি" -এর রিসার্চ। বেশ কয়েকদিনের ইন্টারনেট সার্ফিং এবং অন্যান্য খোঁজ খবর করার পর কাটা হল টিকিট। জোগাড় হল জুতসই ঠাণ্ডা প্রতিরোধী জ্যাকেট, স্লিপিং ব্যাগ, খাবার দাবার আর অদম্য ইচ্ছে।
"যাত্রা শুরু"
২৩ নভেম্বর ২০১৩, অনেক দিনের অপেক্ষার পর এসে গেল সেই দিন। স্বপ্নপূরণের যাত্রা শুরু মিথিলা এক্সপ্রেসের স্লিপার ক্লাসে। আমরা চারজন - সুদীপ, নিলাদ্রি, সৌনীপ আর আমি - ট্রেক ক্লাব "পদাতিক"-এর চারমূর্তি। ট্রেন যথারীতি সুনাম বজায় রেখে মাত্র পনেরো মিনিট লেট করে পরদিন সকাল সোয়া ন'টা নাগাদ পৌঁছে দিল রক্সৌলে। পিঠের ভারি রুকস্যাক সামলে পৌঁছালাম টাঙ্গা স্ট্যান্ডে। তারপর ধুলোর ঝড়ে স্নান করে আর কোমরের ব্যাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নেপাল বর্ডার পেরিয়ে বীরগঞ্জ। ১০০ ভারতীয় টাকায় ১৬০ নেপালি টাকা পেয়ে সব ফান্ডের টাকা কোথায় রাখি ভাবতে ভাবতে ঘুম উড়ে গেল। সুদীপ আর নীলাদ্রি ততক্ষণে হ্রদের শহর পোখরা যাবার গাড়ি ঠিক করে ফেলেছে।
"হ্রদের শহর পোখরা"
আট ঘন্টার বিশাল জার্নি শেষ করে যখন "হোটেল নিউ উইন্ডস"-এ পৌঁছনো গেল তখন বাজে প্রায় সাতটা। ঠাণ্ডা বেশ, তবে যতটা ভেবেছিলাম ততটা নয়, ১২-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। হোটেল রুমে মিনিটখানেক বিশ্রামের পরই বেরোনো হল ওখানকার সিমকার্ড জোগাড় করার জন্য, নাহলে বাড়িতে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। রাতের খাবার অর্ডার দিয়ে সিমকার্ড নিয়ে আর চারপাশের রাস্তায় হাল্কা পায়চারি করে রুমে ফিরলাম সকলে। ট্রেনে ভাল ঘুম হয়নি। পরের দিনটায় আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া (আক্লেমেটাইজেশন) আর গাইড ঠিক করার প্ল্যান নিয়ে ক্লান্ত শরীরকে আর কষ্ট না দিয়ে লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেলাম সবাই।
পরদিন ভোর ভোর আমি আর নীলাদ্রি বেরোলাম পোখরার বিখ্যাত ফেওয়া লেক দর্শনে। হাল্কা মর্নিং ওয়াক সেরে হোটেলে ফিরতেই বাকিদের গালাগালি শুনতে হল, কেন ওদের ডাকিনি। ব্রেকফাস্টের বেরোন হল গাইডের সন্ধানে। সুদীপ ওদের শ্রীরামপুরের এক ক্লাবের দাদার কাছ থেকে এনেছিল 'দেবী ভান্ডারী' বলে এক ভদ্রলোকের ঠিকানা। তাকে খুঁজে বের করতে বেশি পরিশ্রম করতে হলনা। উনি পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের ভ্রমণসঙ্গী, গাইড এবং পোর্টার রাজেন্দ্র রাই-এর সঙ্গে। আমাদের থেকে কয়েক বছরের মাত্র বড়, ছ'ফুট এর কাছাকাছি লম্বা নেপালি ভদ্রলোক প্রথম দর্শনেই বললেন "আরে ইয়ার আচ্ছি জমেগি হামারি"। পরদিন সকালে ট্রেকিং পারমিট এবং গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যাবার কথা দিয়ে আর আমাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া একগাদা খাবার-দাবার বইবার জন্য একটা রুকস্যাক এর ব্যবস্থা করে ভান্ডারী আমাদের বিদায় দিলেন। বাকি দিনটা আমরা ফেওয়ার চারদিকে ঘুরে, ছবি তুলে, মার্কেটে বিদেশিনি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, টাকাপয়সার হিসেব কষে (আমিই ছিলাম ক্যাশিয়ার তাই সব সময় ট্যাঁকে করে আলাদা পয়সার ব্যাগ ক্যারি করতে হচ্ছিল), স্যাক গুছিয়ে আর টোয়েন্টি নাইন খেলে কাটিয়ে দিলাম।
সকাল সাতটায় গাড়ি এসে হাজির। আমরাও স্যাক গুছিয়ে রেডি। বেরোনোর আগে দেখা করতে গেলাম 'দেবী'র সঙ্গে। 'বেস্ট অফ লাক' আর 'সেফ জার্নি' উইশ করে উনি বললেন "ইউ গাইস ডোন্ট ওয়াক অ্যান্ড টেক পিকচারস সাইমালটেনিয়াসলি। মেক এ স্টপ, দেন টেক দি স্ন্যাপ অ্যান্ড ওয়াক এগেইন; বি কেয়ারফুল অ্যান্ড ডোন্ট প্লে উইথ 'হিমাল' (নেপালিরা হিমালয়ের পাহাড় কে হিমাল বলে)"। আমাদের আর অপেক্ষা সইছিল না। স্যাকগুলো গাড়ির ছাদে বাঁধা শেষ হতেই আমরা উঠে পড়লাম আর নীলাদ্রি চেঁচিয়ে উঠল - "বন্ধুগণ যাত্রা শুরু"।
"ফার্স্ট-ডে ফার্স্ট শো"
পোখরা থেকে এসে পৌঁছলাম নয়াপুল। এবার শুরু হবে স্যাক কাঁধে হাঁটা। আগামী সাতদিনের জন্য শুধু পা'ই ভরসা। মিনিট দশ হাঁটার পর চেকপয়েন্ট পড়ল। এখানে পারমিটে স্ট্যাম্প মেরে দিল। আধঘন্টা আরও হাঁটার পর পৌঁছলাম বীরেথান্টি। এখানে "এসিএপি" পারমিট রেজিস্টার করা হল। বীরেথান্টি হচ্ছে সেই জায়গা যেখান থেকে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প যাওয়ার দুটো রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে। বিদেশি ট্রেকারদের পছন্দ পুনহিল-ঘোরেপানি-তাতোপানি হয়ে যাওয়া, যেটার আরেক নাম অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেক। পুনহিলে একটা ওয়াচটাওয়ার আছে, যেখান থেকে সূর্যোদয়ের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায় এবং পরপর অন্নপূর্ণার চারটি (মেইন, সাউথ, ১ ও ২) এবং মচ্ছপুচ্ছারে, ধৌলগিরি, হিউনচুলি হিমালয়ের এইসব বিখ্যাত শৃঙ্গগুলি একসঙ্গে দেখা যায়। আমাদের হাতে সময় কম। তাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় না থাকায় সর্টকার্ট নিতে হল সোজা ঘান্দ্রুক-এর দিকে। পরে জানতে পারলাম ঘান্দ্রুক অবধি বাস বা শেয়ার জিপে যেতে পারতাম। দুপুর দেড়টা নাগাদ পৌঁছনো গেল অর্ধেক রাস্তা এবং লাঞ্চ ব্রেকের জায়গা সয়ূলিবাজারে।
গোটা ট্রেকের সবচেয়ে বাজে ভেজ মোমো আর ভেজ রাইস খেয়ে যখন অবস্থা বেশ সঙ্গীন, ঠিক তক্ষুনি রাজ বলে উঠল - "আরে ভাই চলো চলো, কিতনা বইঠোগে। সামনে সিঁড়ি হ্যায়, উসসে চলেঙ্গে তো দেড় ঘন্টা কম সময় লাগেগা"। তখন কে জানত সিঁড়ি ওঠা সেই শুরু! নামেমাত্রই সিঁড়ি, আসলে কাটা পাথরের ধাপ। কোনোটার হাইট এক ফুট তো কোনোটার দু ফুট হবে, কোনও সামঞ্জস্য নেই। পিঠে স্যাক, সামনে একটা ছোট ল্যাপস্যাক আর কাঁধ থেকে ঝোলা নোটবুক, পেন, ওষুধ আর টাকা সম্বলিত ছোট আরেকটা ব্যাগ নিয়ে ওই সিঁড়ি উঠতে ঊঠতে মনে হচ্ছিল কেন এলাম! এক এক সময় ওই ধাপগুলোও একজিস্ট করছিল না, আর সেখানে ঢাল প্রায় ৭৫-৮০ ডিগ্রি, রীতিমত ক্লাইম্ব করতে হচ্ছিল আমাকে কারণ আমার হাইট মাত্র পাঁচ ফুট। বাকীরাও ক্লান্ত। রাজ যেন দৌড়চ্ছে। যখনই দেখা হচ্ছে, খালি বলে "আরে ইয়ার, ভাগো ভাগো, কিতনা স্লো চলতে হো আপলোগ"। "রাজ ভাইয়া আউর কিতনা"? "আরে ও জো লাল পেড় দিখ রাহা হো না, উসকে পিছে হে ঘান্দ্রুক"। আমরা যতই হাঁটি, লাল পেড়-এর কাছে আর পৌঁছতে পারি না। আমায় নীলাদ্রি জিজ্ঞেস করল - "ভাই আর কদ্দুর"? বললাম- "হুই যে লি লি করতিসে" (যারা নারায়ণ দেবনাথের নন্টে-ফন্টে পড়েছেন তারা আশাকরি বুঝলেন)। চারজনে একসঙ্গে হেসে উঠলাম। প্রায় ৫০০০ সিঁড়ি ভেঙ্গে সেই লাল পেড় এর কাছে পৌঁছনোর আরও ৪৫ মিনিট পর, প্রায় অন্ধকারের মধ্যে, ৫.১৫ নাগাদ আমরা পৌঁছলাম নাইট-স্টে "মেশ্রাম গেস্ট হাউস"-এ, একেবারে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায়। ডিনারে স্যুপ খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। ঠান্ডা খুব, প্রায় ২-৩ ডিগ্রি এর কাছাকাছি। স্লিপিং ব্যাগ এর ওপর লেপ চাপা দিয়েও ঠান্ডা কাটছিল না। কিছুতেই ঘুম আসছে না। হাঁটুতে অসহ্য ব্যথা। ভলিনি স্প্রে লাগালাম, পেন কিলার হিসেবে একটা প্যারাসিটামলও খেতে হল। কী করে বাড়ি ফিরব? এইতো সবে প্রথম দিন? নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, আমার জন্য এই ট্রেক পণ্ড হতে দেব না। আই ক্যান ডু ইট। ওষুধ বোধহয় কাজ করতে শুরু করেছিল। ঘুমিয়ে পড়লাম।
"চড়াই-উতরাই"
ভোরবেলা অ্যালার্ম বাজলো পাঁচটায়। সূর্যোদয়ের মুহূর্তটা মিস করার কোন ইচ্ছে ছিল না। টেম্পারেচার মাইনাসে না হলেও জিরোর কাছেই। আস্তে আস্তে আলোর ছোঁয়া লাগল দূরের অন্নপূর্ণা সাউথ শৃঙ্গে তারপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভার্জিন পিক মচ্ছপুচ্ছারেতে। সেই মায়াবি গোলাপি আলো ধীরে ধীরে বদলে গেল সোনালিতে। আমরা ফ্রেশ হয়ে চা, বিস্কুট আর ডিমসেদ্ধ খেয়ে রেডি হয়ে পড়লাম দ্বিতীয় দিনের চলার জন্য। দিনের শুরুতেই একটা জরুরি শিক্ষা পাওয়া গেলো বিল মেটাতে গিয়ে। ওখানকার সব হোটেলেরই নিয়ম, যেখানে থাকবে সেখানকারই খাবার খেতে হবে, (মোট বিল কম করে যেন ৩০০০ নেপালি টাকা হয়) নাহলে গাইড খেতে পাবে না, শুতেও পাবে না আর ঘরভাড়াও দু-তিন গুণ বেশি দিতে হবে। আমরা নিজেদের আনা খাবার খেয়েছিলাম না জেনেই, তার বদলে বাড়তি ভাড়া দিতেই হল শেষমেশ।
কাল আটটায় হাঁটা শুরু হল। প্রথমে জঙ্গলে ঘেরা অত্যন্ত ভেজা ভেজা পিচ্ছিল মাটি-পাথরে মেশানো পথ দিয়ে (পথ না বলে অণুপথ বললে ঠিক হবে) প্রায় ১৫০০ মিটার নামা। গন্তব্য কিমরংখোলা। প্রত্যেকেই একবার না একবার পা হড়কালাম। এত তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে হাঁটু কাঁপতে লাগল। রাজ বলতে লাগল-"পতা হে, ইস জঙ্গল মে আত্মা হে, ভূত হে, রাত কো উও লোগ নাম লেকে বুলাতা হে, আউর জো লোগ গয়া উও ওয়াপস নাহি আয়া"। ওর কথা শুনে হাসলেও শুনসান জঙ্গলে পাতা পড়ার শব্দে একটু মনটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। কিমরং খোলাতে ('খোলা' মানে নেপালিতে নদী) জল বেশি নেই। বড় বড় বোল্ডার আর গুঁড়ো সাদা বালি। জলের ওপর কাঠের পুল। নদী পেরিয়ে আবার শুরু হল চড়াই। কিছুটা উঠেই লাঞ্চ ব্রেকে থামলাম সবুজ লনের ওপর রঙিন ছাতা আর টেবিল-চেয়ার পাতা একটা ছোট্ট মনোরম রেস্টুরেন্টে। জায়গাটার নাম কিমরংদাড়া। ছবি তোলা হল বেশ কিছু। স্যাকটা নামানোয় কাঁধগুলো প্রাণ ভরে আশীর্বাদ দিল। লেমন জুস খেয়ে চাঙ্গা হলাম। লাঞ্চে গরম ভেজ চাউমিন। কিছুক্ষণ বসার পরই রাজ তাড়া দিতে লাগল। আমাদের নাইট-স্টে ছোমরং-এ। আমার হাঁটু কান্নাকাটি শুরু করল একটু পরেই। অনেক 'সিঁড়ি' ভেঙ্গে ক্লান্ত হয়ে রাজকে বলতেই হল থামার জন্য। একপ্রস্থ চকোলেট আর জল খেয়ে আবার হাঁটা শুরু। বিকেল গড়িয়ে সূর্য যখন বিদায় নিচ্ছে মচ্ছপুচ্ছারের পিছনে, আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। আর এনার্জি ছিল না। গরম জলে স্নান করে একটু ফ্রেশ লাগল। ডিনার হলে খেতে খেতে আগামী কয়েকদিনের জন্য শেষবারের মত ফ্রি-তে মোবাইল আর ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ করে নিলাম সবাই। শুয়ে পড়ার আগে রাজ এল। বলল, খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। ওকে ওষুধ দিতে হল। ঠিক হল আমরা আর খাবার-দাবার বেশি বইব না। লাগেজ কমাতে হবে, এরপর রাস্তা বেশ কঠিন এবং রিস্কি। সোয়েটার, জ্যাকেট, স্লিপিং ব্যাগ, টাকাপয়সা, ওষুধ আর সামান্য দরকারি কিছু জিনিস ছাড়া সবই হোটেলে রেখে যাওয়ার জন্য প্যাক করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
"আর সিঁড়ি নেই - মিষ্টি গ্রাম ছোমরং"
ভোরবেলা সৌনীপ সবার আগে বাইরে বেরিয়ে আবার ফিরে এসে ঝপ করে ক্যামেরাটা বগলদাবা করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল - "কুঁড়েমি না করে বাইরে আয়, এ জিনিস বারবার দেখতে পাবি না"। জ্যাকেটটা চাপিয়ে বাইরে বেরোতে দেখলাম সত্যি-ই। ঘান্দ্রুক-এ যেমন দেখেছিলাম এখানে মচ্ছপুচ্ছারে তার চেয়ে আরও আকর্ষণীয়, আরও জীবন্ত, আরও মায়াবী। এ দৃশ্য দেখার জন্য কষ্ট করাই যায়।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমাদের এক্সট্রা লাগেজ হোটেল মালিকের জিম্মায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের আগামী গন্তব্য 'দেওরালি'র উদ্দেশ্যে। তখনও জানতাম না সামনে কি অপেক্ষা করে আছে। বেরিয়ে পরেছিলাম সকাল সাতটায়। দেওরালি-র হাইট ৩০০০ মিটার মত। আমরা ছিলাম ২০০০ মিটারের আশেপাশে। এই ১০০০ মিটার চড়াইয়ে পেরোতে হবে অনেকগুলো গ্রাম। প্রথম কিছুক্ষণ কয়েক হাজার সিঁড়ি নামা আর ওঠা। তারপর হাল্কা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সমতল রাস্তা পেরিয়ে লোয়ার সিনুয়া। আবার সিঁড়ি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যদিও রাজ বলেছিল আর নাকি সিঁড়ি নেই। সরু রাস্তায় একপাল খচ্চর-কে পাশ কাটাতে গিয়ে বুঝলাম কেন বাঙালিরা ওদের জাতটাকে গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে। রুকস্যাকটা একটার গায়ে ঠেকেছিল। অমনি ব্যাটা পিছনের পা দিয়ে দিলে লাথি কষিয়ে। পিঠে স্যাক থাকায় জোর বাঁচলাম, লাগেনি। আপার সিনুয়ায় পৌঁছে আবার লেমন জুস খাওয়া হল। এই জিনিসটা আমরা সব জায়গায় পাচ্ছিলাম। আর খেয়েও নিচ্ছিলাম কারণ খুব এনার্জি দিচ্ছিল।
আরও প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর পৌঁছলাম "বাম্বু"-তে। কয়েকটা হোটেল আর বাড়ি নিয়ে ঘেরা ছোট্ট জনপদ। জঙ্গলের ভিতর আর মানব সভ্যতার নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার প্রবেশদ্বার। আমাদের চারজনের দলটা দুটো ছোট দলে ভেঙে গেছিল আমারই জন্য। পায়ের অসহ্য ব্যথার জন্য জোরে হাঁটতে পারছিলাম না। তাই সুদীপ আর নীলাদ্রি এগিয়ে যাচ্ছিল রাজ-এর সাথে তাল মিলিয়ে। আমি আর সৌনীপ ছিলাম পিছনে। বাম্বু থেকেও ওরাই আগে রওনা দিল। আমরাও মিনিট পনেরো বসে আবার চলতে শুরু করলাম। অত্যন্ত ঘন বাঁশ এবং অন্যান্য পাহাড়ি গাছে ভরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে সত্যিই আমরা দুজন একা আর কেউ নেই। আধঘন্টা হেঁটেও কাউকে দেখতে পেলাম না। কারণ বেশীরভাগ ট্রেকারই বাম্বুতে থেকে গেছিল। আর যারা আর এগোবে ঠিক করেছে তারাও অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছে। আমরা দম নেওয়ার জন্য থামছিলাম মাঝে মাঝে। ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে চকোলেট আর জল খাওয়া চলছিল আর মোবাইলে "অন্নপূর্ণাস্তোত্রম" বাজাচ্ছিল সৌনীপ। হঠাৎ করে দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসছে নিলাদ্রি। আমাদের দেখে ও যেন প্রাণ ফিরে পেল। জল খেয়ে বলল - "রাজ আর সুদীপ তো দৌড়চ্ছে। আমি একটু আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তা দুটো ভাগ হয়ে গেছে। কোনটা ধরব না বুঝে রাজকে ফোন করতে ও বলল যে তুমি ভুল রাস্তায় এসেছ। এখন তুমি ফিরে যাও আর বাকিদের জন্য ওয়েট কর। ফিরেই আসছিলাম। হঠাৎ আট-দশটা পাহাড়ি বাঁদর গাছের ডাল থেকে নেমে ঘিরে ধরেছিল। কোনমতে পালিয়ে এসেছি।" তিনজনে এবার একসঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তা চিনতেও অসুবিধে হল না।
২.৩০ নাগাদ পৌঁছলাম দোভান। লাঞ্চ করলাম 'স্মোকি' ভেজ ফ্রায়েড রাইস দিয়ে। রাজ তাড়া দিতে লাগল - "ক্যা ইয়ার, জলদি করো। আভি বহুত চলনা হে। মারো মারো, খিঁচো খিঁচো, ভাগো ভাগো"। এটা ছিল ওর পেটেণ্ট ডায়লগ, যেটা আমরা গোটা ট্রেক-এ অগুন্তি বার শুনেছি। মেঘ করে আসছিল। আমাদের ক্লান্তিও ছিল খুব।
"হিমালয়ায় হাড়-হিম"
দেওরালি যে পৌঁছতে পারবনা সেটা বুঝতেই পারছিলাম, কিন্তু রাজের সঙ্গে সুদীপও একমত। ৪০-৪৫ মিনিট হাঁটার পরেই আকাশ একেবারে কালো করে এল। মুখে-চোখে অনুভব করতে লাগলাম ঝিরঝিরে কুয়াশা মাখা বৃষ্টি। ঠাণ্ডাও বাড়ছে। পা আর চলছে না। অতিকষ্টে মনের সমস্ত জোর লাগিয়ে যখন "হিমালয়া" পৌঁছলাম অন্ধকার আর গাঢ় কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক। দৃশ্যমানতা একেবারে নেই বললেই চলে। একটাই রুম পাওয়া গেলো চারজনের জন্য। প্রচণ্ড ক্লান্তিতেও বাইরের শেড দেওয়া খাওয়ার টেবিলে বসে চা খেতে খেতে গল্প হতে লাগল এক জার্মান ভদ্রলোকের সাথে। নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি, তবে ব্রাউন রঙের লম্বা দাড়ির জন্য আমি নাম দিয়েছিলাম 'গুটেনবার্গ'। এখানে এসে বোঝা গেল রাজবাবুর ফিটনেসের কারণ, বেশ ভাল জাতের "ভোলে বাবার প্রসাদ"-অর্থাৎ গাঁজা। গুটেনবার্গ মহাশয়ও ওই জিনিসের সিগারেট বানিয়ে অক্লেশে ওর দলে ভিড়ে গেলেন। একটু পরেই ডিনার করে শুয়ে পড়লাম। গল্প করতে করতে আওয়াজের ডেসিবেলটা বোধহয় বেড়ে গিয়েছিল। পাশের রুম থেকে গুটেনবার্গ আওয়াজ দিল "জেন্টলমেন লেটস কল ইট আ নাইট, গুড নাইট"। আমরাও লজ্জায় চুপ মেরে নিজেদের স্লিপিং ব্যাগের চেন টেনে কম্বল মুড়ি দিলাম। সেই রাতটা তখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কনকনে ঠাণ্ডার রাত ছিল। কাঁচের জানলায় জমে ওঠা বাষ্পের ওপর ডিনার হলের ফিকে সাদা আলোটা প্রতিফলিত হচ্ছিল। অন্ধকার যেন প্রেতের মত ওঁত পেতে বসে আছে। যেটুকু চোখ ফাঁক করে দেখতে পাচ্ছিলাম, তাতে পাশ ফিরে কম্বল মুড়ি দেওয়াটাই শান্তির মনে হল।
"স্বপ্নপূরণ"
২৯ নভেম্বর ২০১৩, সেই স্বপ্নকে কাছে পাওয়ার দিন। সকাল ৬.৩০-য় ট্রেক শুরু হল হাল্কা ব্রেকফাস্টের পর। আজকের গন্তব্য "অ্যামেজিং অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প"। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শুরু হল পথচলা। আস্তে আস্তে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছলাম "হিঙ্কো" গুহায়। এটি একটি প্রাকৃতিক গুহা পর্যটকদের বিশ্রাম করার জন্য।
এর পরেই ভীষণ বিপদজনক এক ঝরনার গভীর খাত পেরোতে হল ঝুরঝুরে মাটি-পাথর মেশানো প্রায় ৮০০ ঢাল বেয়ে নড়বড়ে কাঠের সেতু দিয়ে। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে ট্রি-লাইন এর। হাজার বছরের পুরনো আদিম গাছের জায়গা নিচ্ছে শুকনো গুল্ম আর ফিকে হলুদ বুনো ঘাস। আকাশ নীল। সামনে ডান দিকে দেখা যাচ্ছে গর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মচ্ছপুচ্ছারে। দূরে হাতছানি দিচ্ছে দুই বোন অন্নপূর্ণা-১ আর গঙ্গাপূর্ণা। মোদীখোলার খাত ধরে হেঁটে চলেছি আমরা।
দেওরালি পৌঁছে সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ শেষ হল। এখানেই শেষ নমস্তে টেলিকম-এর নেটওয়ার্ক ধরে। এরপর শুধুই স্যাটেলাইট ফোন। আরও ঘন্টাখানেক ওই পাথুরে অববাহিকা ধরে চলার পর ১২.১৫ নাগাদ পৌঁছলাম "মচ্ছপুচ্ছারে বেস ক্যাম্প"-এ।
এখানে এসে মনে হচ্ছিল মচ্ছপুচ্ছারে কত কাছে। একে আমরা সেই পোখরা থেকে অনুসরণ করে আসছি। এই সেই পিক যেখানে কেউ কোনদিন চড়াই করার সাহস দেখায়নি। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, এই পাহাড় শৃঙ্গের কোন চড়াই অভিযান না হলেও এর বেস ক্যাম্প আছে। "আজকেই আমাদের অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প গিয়ে ফিরে আসতে হবে"। সুদীপ বলল। "ওখানে কাল রাতে -১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, আমরা থাকতে পারব না। এফেক্টিভ টেম্পারেচার আরও কম হবে"।
"সৌনীপের ভাষায় - অন্নপূর্ণার অ্যাম্ফিথিয়েটারে"
লাঞ্চ করে দুপুর ১.১০-এ বেরনো হল সেই জায়গার উদ্দেশ্যে, যার জন্য এত কষ্টস্বীকার। এখানেই করলাম সেই মারাত্মক ভুল যার খেসারত আমার প্রাণ দিয়েও দিতে হতে পারতো। এমবিসি থেকে বেরনোর ১৫ মিনিটের মধ্যেই দিগন্ত জুড়ে দেখা দিল অন্নপূর্ণা দক্ষিণ শৃঙ্গের উত্তর দিকটা। আর পিছনের দিকে মচ্ছপুচ্ছারে আর বারাসিঙ্গা। অন্নপূর্ণা সাউথ শৃঙ্গজয়ের দিক থেকে এভারেষ্টের থেকেও বিপদজনক। ৮০০০ মিটারের বেশি উচ্চতার শৃঙ্গের মধ্যে সারা পৃথিবীতে এর স্থান দশম, কিন্তু শীর্ষে আরোহণের দিক দিয়ে এর মৃত্যুহার সবথেকে বেশি (৩৮%, এভারেষ্টের চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি)। এই ভয়ঙ্কর সুন্দর মাতৃরূপের দিকে মুগ্ধ হয়ে পুতুলের মত আকর্ষিত হয়ে এগিয়ে চললাম। সৌনীপ এই ট্রেকটা নিয়ে সবচেয়ে উত্তেজিত ছিল। ও সবার আগে প্রায় দৌড়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল ওর স্বপ্নের কাছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর সবচেয়ে কাছে ছিল সুদীপ। "আমার খুব ঘুম পাচ্ছে" সৌনীপের এই কথা শুনে আমাদের বুঝতে বাকি রইল না এই ৪০০০ মিটার উচ্চতায় ওর অক্সিজেনের অভাব হয়ে হাই অল্টিটিউড সিকনেসের দিকে ব্যাপারটা এগোচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ওকে ডেরিফাইলিন ট্যাবলেট আর বমি ভাব কমার ওষুধ অনডেম খাইয়ে দিলাম। একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে আর একটু জল খেয়ে ও আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে গেল মিনিট পনেরোর মধ্যে। বিকেল ৩.৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছালাম দেবী "অন্নপূর্ণার প্রাঙ্গণতলে"। চারিদিকে তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘিরে একের পর এক নামকরা ৭০০০-৮০০০ মিটারের শৃঙ্গ - অন্নপূর্ণা-১,২ সাউথ, মেন, গঙ্গাপূর্ণা, ধৌলাগিরি, টেন্ট পিক, গনেশ হিমাল, হিউনচুলি, মচ্ছপুচ্ছারে, বারাসিঙ্গা আর নাম না জানা অনেক শৃঙ্গ। স্বপ্নপূরণের সেই মুহূর্তে আমাদের সবার চোখে জল, আনন্দাশ্রু। এই মুহূর্ত আমাদের এই চারজনের সারা জীবনের সঙ্গী।
"হাইপোথার্মিয়া"
আধঘন্টা মিনিট ধরে অনেক ছবি তুলেও সাধ মিটছিল না। কিন্তু ফিরতে হবে। পাহাড়ে ছেলেখেলা যে চলে না সেটা বোঝার সময় আসছিল। খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসছে সন্ধ্যে। রাজ আমাদের ছেড়ে আগেই নেমে গেছে। সুদীপ আর নিলাদ্রিও নামছে খুব জলদি। আমার আহত পা ভুগিয়েই চলেছে। সঙ্গী সেই পাহাড় পাগল সৌনীপ। বুঝতে পারছি তাপমাত্রা কমছে খুব দ্রুত। দূরে যে জায়গাগুলোয় ঘাস দেখা যাচ্ছিল আসার সময় এখন সেগুলো বরফে সাদা। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দিচ্ছে। টুপি ভেদ করে কান বরফ। নাকের ডগা, গাল অনভূতিহীন হয়ে আসছে, জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে কথা বলতে গেলে। বুঝতে পারছিলাম বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছি বাকিদের কথা না শুনে। সবাই ফেদার জ্যাকেট পরেছিল, এক আমি ছাড়া, কারণ আমার জ্যাকেটটা বড় আর পরলে হাঁটতে কষ্ট হবে ভেবেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম যদি কোনভাবে ক্যাম্পে জলদি ফিরতে না পারি হাইপোথার্মিয়া অনিবার্য, আর তাহলে এই নির্জন প্রান্তরে মৃত্যু ছাড়া গতি নেই। অসম্ভব মনের জোরে কোনমতে অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে এমবিসি ফিরলাম।
রুমে ঢুকে জুতো খুলেই সোজা স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকলাম। নীলাদ্রি স্যাক থেকে আমার ফেদার জ্যাকেটটা বের করে দিল। যে সাধারণ জ্যাকেটটা পরেছিলাম ওটার ওপরেই চাপালাম। এর পরে স্লিপিং ব্যাগ ও তার ওপরে কম্বল চড়িয়েও কাঁপুনি থামছিল না। গরম জল দিয়ে মধু আর প্যারাসিটামল খেলাম। নীলাদ্রি হাতে পায়ে সর্ষের তেল মালিশ করে দিতে লাগল। ১৫-২০ মিনিট পরেও যখন কিছুই হচ্ছেনা ওরা বাধ্য হয়ে রাজকে জানাল। সব গাইড এবং পোর্টাররাই একসঙ্গে থাকে। একটা স্প্যানিশ কাপল ছিল পাশের রুমে। তাদের যে গাইড সে এক বাটি গার্লিক স্যুপ করে এনে দিল। সেটা খাবার ৫-১০ মিনিটের মধ্যেই ম্যাজিকের মত সব হাওয়া। সুস্থ হতেই তার দুহাত জড়িয়ে সবাই ধন্যবাদ জানালাম। আমার বন্ধুরা আর ওই নাম না জানা নেপালি গাইড, ওদের জন্যই আজ আমি এই লেখাটা লিখতে পারছি। রাতে স্যুপ, রুটি-তরকারি আর ডিমের অমলেট দিয়ে ডিনার সেরে গল্প করতে লাগলাম ওই স্প্যানিশ কাপল-এর সঙ্গে। দুঃখ হচ্ছিল এই ভেবে যে কেন আমাদের দেশের একটা পতাকা আনলাম না। অনেক দেশেরই পতাকা টাঙানো ছিল এমবিসিতে, ভারতেরই শুধু ছিলনা। শুতে যাবার আগে সবাই বাড়িতে একবার করে ফোন করলাম স্যাটেলাইট ফোন থেকে, প্রতি মিনিট ১৫০ নেপালি টাকার বিনিময়ে।
"শিবের জটা এবং অলৌকিক ভোর"
পরদিন সকালের কথাটাও মনে থাকবে সারাজীবন। ভোরবেলা ৫টা নাগাদ ঘুম ভাঙ্গতে দেখি সুদীপ আর সৌনীপ অলরেডি ক্যামেরা আর ট্রাইপড নিয়ে বাইরের খোলা চাতালে বেরিয়ে পড়েছে। স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরোতেই মনে হল যেন জমে গেলাম। ফেদার জ্যাকেট, টুপি, গ্লাভস সব স্লিপিং ব্যাগের পায়ের দিকে নিয়ে শুয়েছিলাম যাতে গরম থাকে। তাড়াতাড়ি বের করে পরতে পরতেই বাইরে ছুটলাম ক্যামেরা নিয়ে। অসম্ভব ঠাণ্ডায় শরীর কুঁকড়ে গেলো। বেরিয়ে দেখি ঝরনার জল আসছিল যে পাইপ দিয়ে সেটা পড়ন্ত জলধারা এবং বালতি সমেত শক্ত বরফে পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পের ছেলেরা লাথি মেরেও বালতিটাকে এক চুলও নড়াতে পারছেনা। আকাশে তখনও হাল্কা নীলচে অন্ধকার। মচ্ছপুচ্ছারের ডান দিকে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে, ঠিক যেন শিবের জটায় আটকে আছে। তাপমাত্রা -১০ থেকে -১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মত হবে। ফর্সা হচ্ছে পূর্ব দিগন্ত।
লালচে থেকে গোলাপি হয়ে উজ্জ্বল সোনালি আলোয় যখন ধুয়ে যাচ্ছে অন্নপূর্ণা সাউথের শীর্ষ, মনে হল, এই ভোর কখনোই এই পৃথিবীর নয়। অপার্থিব, আলৌকিক এক দৃশ্য সমস্ত অনুভূতিকে গ্রাস করে নিল। বর্তমানে ফিরলাম অনেক পর ব্রেকফাস্ট টেবিলে, দুটো সেদ্ধ ডিমের দাম যখন দিতে হল ৪২০ নেপালি টাকা।
"বনবাদাড়ে মেজকাকা"
এবার নামার পালা। অনেকটা পথ একদিনে নামতে হবে। গন্তব্য একেবারে ছোমরং। হাঁটু জবাব দিয়েছিল আমার। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। এক পা ফেলতেই মনে হচ্ছিল বসে পরি। বেস ক্যাম্পের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎই দেখতে পেলাম একটা শক্ত বাঁশের লাঠি পড়ে আছে। মা অন্নপূর্ণার দান। ওটা হাতে পেতেই অনেকটা সাপোর্ট পেলাম। কতবার যে বললাম আর পারছি না, একটু দাঁড়াও আমার জন্য তার ঠিক নেই। শেষে সুদীপ আমার হাঁটু নিয়ে কাতরানি দেখে আমার নামই দিয়ে দিল "মেজকাকা"। "মেজকাকা"র কতরকম টোনের যে উচ্চারণ বাকি ট্রেকে আমায় সহ্য করতে হল তার কোন হিসেব নেই। ভলিনি স্প্রেটা জ্যাকেটের পকেটেই ছিল। নী-ক্যাপ নামিয়ে স্প্রে লাগাতে থাকলাম মাঝে মধ্যে। সমতল রাস্তায় দেওরালি অবধি ফিরতে অতটা কষ্ট হলনা। মাঝখানে দেখলাম একটা রাশিয়ান গ্রুপের বেশ লম্বা চওড়া ছেলে স্লিং-এ ডানহাত ঝুলিয়ে ফিরছে। কী হল জিজ্ঞেস করায় জানলাম পা পিছলে পাথরের খাঁজে হাত ঢুকে গিয়ে কবজি ভেঙেছে। ঠিক করলাম রাজ যতই "মারো মারো, ভাগো ভাগো, খিঁচো খিঁচো" বলুক আমরা সাবধানে আস্তে আস্তেই নামব, তাড়াহুড়ো করব না।
বাকী রাস্তায় সেই একই ডাউন ট্রেল। বাম্বু পৌঁছে লাঞ্চ করে আবার পথচলা। বিকেল যখন ৫টা আমরা, মানে আমি আর সৌনীপ পৌঁছলাম আপার সিনুয়া। আমাদের থাকার কথা লোয়ার সিনুয়াতে। যেটা এখনও কম সে কম ২৫ মিনিটের হাঁটা। এদিকে আলো একেবারেই কমে এসেছে। সুদীপরা এগিয়ে গেছে। ফোনেও পাচ্ছি না। যা হয় হোক ভেবে নামতে শুরু করলাম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। পাশে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ। অদ্ভুত সব ডাক, সরসর করে পাতার আওয়াজ, সব মিলিয়ে ভয় পাওয়ার মত। আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না নীচের হোটেলের আলো ছাড়া। টর্চ জ্বালিয়ে এগোতে থাকলাম দুজনে। হঠাৎ সামনে থেকে টর্চের আলো- "আরে ইয়ার তুম লোগো নে তো ডরা হি দিয়া। চলো, আ যাও। মে তুম লোগো কো ঢুন্ডনে কে লিকে আয়া"। সত্যি সেদিন রাজকে দেখে খুব স্বস্তি পেয়েছিলাম।
"আই থট ইউ উড বি ফিফটিন অর সিক্সটিন"
পরদিন সকাল ৮ টায় নামা শুরু হল ঝিনুডাণ্ডার উদ্দেশ্যে। পথে ছোমরঙে লাঞ্চ সেরে আমাদের বাকি জিনিসপত্র ফেরত নিয়ে নামতে লাগলাম আমরা। দুপুর ৩ টে নাগাদ পৌঁছে গেলাম ঝিনু-তে। রাজ বলল এখানে একটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে, সেখানে স্নান করলে ট্রেকের সব ক্লান্তি নাকি ধুয়েমুছে সাফ। কিন্তু ওটায় পৌঁছাতে আরও আধ ঘন্টা ট্রেক ডাউন করতে হত। আমরা আর রাজি হলাম না। রাজ একাই গেল।
ট্রেকের শেষ দিনের সকালে মনে হল আজই ফিরে যাব পোখরায়, এই অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য্যকে পিছনে ফেলে রেখে। গত কয়েকদিনের মত ব্রেকফাস্ট করে সকাল সকাল বেরনো হল। মাঝ দুপুরে লাঞ্চ করে আরও ঘন্টাখানেক হাঁটার পর আমরা সয়ুলির বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে ট্রেক শেষ করলাম। মাঝে লাঞ্চের সময় একজন ফরাসি ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়েছিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শেষ ধাপটা নামতেই উনি হাততালি দিয়ে উঠলেন। কাছে এসে হ্যাণ্ডশেক করে আমাদের কন্গ্র্যাচুলেট করে বললেন "উই শুড বাউ আউয়ার হেড, অ্যান্ড ডু নমস্তে টু মাদার আন্নপূর্ণা ফর গিভিং আস দি অপারটুনিটি, অ্যান্ড লেটিং আস কমপ্লিট দি ট্রেক উইদাউট এনি ইনজুরিস"। ভদ্রলোকের নামটা মনে নেই। কিন্তু উনি মহাভারত আর রামায়ণ পড়েছেন বললেন, আর এটা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে আমার বয়স ২৫ এবং আমি ভারত সরকারের একজন কর্মচারী। উনি বল্লেন-"আর ইউ সিরিয়াস? আই থট ইউ উড বি ফিফটিন অর ... "। দুজনেই হাসতে লাগলাম। এরপর ফেরার পালা। একটা জিপ ভাড়া করে আমরা চলে এলাম নয়াপুল পর্যন্ত। দেবীকে ফোন করাই ছিল। উনি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পোখরায় আমাদের আগের হোটেলেই বুকিং ছিল। রুমে ঢুকে আর কেউ কথা বলতে পারছিলামনা। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমরা ট্রেক শেষ করে ফিরে গেছি।
"সূর্যোদয়ের সাক্ষী"
এরপর আরও একদিন পোখরায় ছিলাম। পরেরদিন ভোর ৪.৩০ -এ আমি, সুদীপ আর সৌনীপ দেবী-র পাঠানো গাড়িতে গেলাম পোখরার অন্যতম দর্শণীয় ভিউপয়েন্ট বৌদ্ধস্তূপে। ওই উচ্চতা থেকে পোখরা শহরটাকে আলোকবিন্দু দিয়ে সাজান আলোকবর্তিকা বলে মনে হচ্ছিল। অদ্ভুত একটা সূর্যোদয় দেখলাম সেদিন। পাহাড়ের পিছন দিয়ে মেঘের ভিতর থেকে একফালি গোলাপি আলোর আভাস, আর তারপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটু একটু করে বৃত্তাকার অগ্নিগোলকে পরিণত হওয়া। প্রকৃতির সৃষ্টির এই অপূর্ব নিদর্শন আর কখনও এই জীবনে হয়ত দেখতে পাবনা এইভাবে। উত্তরে তখন রাঙা হয়ে উঠেছে মচ্ছপুচ্ছারের সামনের দিক। অনেকে বললেন খুব লক্ষ করলে নাকি এদিক থেকে একটা বসে থাকা বাঘের অবয়ব দেখা যায়। আমি যদিও অতটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। দূরে দেখা যাচ্ছিল হিমালয়ের আরেক বিখ্যাত শৃঙ্গ নীলগিরিকে। বাকি দিনটা কাটল ফেওয়া লেকের ধারে ছবি তুলে আর খুচখাচ শপিং করে। আমাদের নাম দিয়ে অন্নপূর্ণার লোগো দেওয়া চারটে টিশার্ট বানিয়ে সেগুলো পরে ছবিও তুলে ফেললাম।
"যাচ্ছি কিন্তু ফিরব বলেই"
৪ ডিসেম্বর ২০১৩, বাড়ি ফেরার পালা। পোখরাকে "ফেরি ভিটৌলা" (নেপালি তে আবার দেখা হবে) বলে রওয়ানা দিলাম বীরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সোজা হাইওয়ে এর পিছনের দিকে বিদায় জানাতে মা অন্নপূর্ণা অনেকক্ষণ আমাদের সঙ্গ দিলেন। কয়েক ঘন্টা পর পথের বাঁকে হারিয়ে যেতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো, যদিও অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছি ভেবে আনন্দও হচ্ছিল। বিকেল বিকেল বীরগঞ্জে পৌঁছে নেপালি টাকাকে ভারতীয় টাকায় চেঞ্জ করলাম। আবার টাঙ্গা করে ধুলোর মধ্যে বর্ডার ক্রস। মাঝখানে এক ব্যাটা ঘোড়া দিব্বি গাছপালা ভেবে আমার স্লিপিং ব্যাগটা চেবাতে শুরু করেছিল। যখন কেড়ে নিতে পারলাম দেখলাম চেবাতে না পারলেও ভালো করে লালা মাখাতে সে কসুর করেনি। স্টেশনের কাছেই হোটেল নেওয়া হল। পরদিন সকাল ন'টায় ট্রেনে উঠলাম। সেই মিথিলা এক্সপ্রেস। এক বয়স্ক বাঙালি গ্রুপের সঙ্গে একদিনের হৈচৈ ট্রেনজার্নি শেষে পরদিন ফিরে এলাম প্রিয় শহর কলকাতায়।
[বিঃদ্রঃ তথ্যসূত্র - ইন্টারনেট এবং আমার প্রিয় বন্ধু সৌনীপের ব্লগ www.amazingannapurna.blogspot.in, সমস্ত ছবি আমাদের নিজেদের তোলা এবং "পদাতিক" গ্রুপের তরফ থেকে দেওয়া - সৌজন্যে, সুদীপ, নিলাদ্রি, সৌনীপ এবং অভিষেক।]
~ অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প ট্রেক রুট ম্যাপ ~ অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প ট্রেকের আরও ছবি ~
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় মুখ্যালয়ে জুনিয়ার টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (কেমিক্যাল) পদে কর্মরত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রসায়নে স্নাতক এবং এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড সয়েল সায়েন্স-এ স্নাতোকোত্তর । কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। পাহাড় পাগল, হিমালয় প্রেমী। "পদাতিক" নামক চার জনের ছোট্ট ট্রেকিং দলের সদস্য। "বছরে একটা ট্রেক-এ না গেলে বছরটাই মাটি" তত্ত্বে বিশ্বাসী। ভ্রমনকাহিনি ছাড়াও কবিতা লেখা ও পড়া নেশা। অল্প-বিস্তর ছবি আঁকা আর ছবি তোলা প্যাশন।