রাই সনে রাই সন্দর্শনে

অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

 

নীলচে ধুসর পাহাড়ের আউটলাইন, জঙ্গলের সোঁদা গন্ধ, থেকে থেকেই মন্দিরের পূজারীর ঘন্টা, সব মিলিয়ে উধাও হওয়া মনটা আর আমরা। সান্দাকফু ছাড়াও এ রাজ্যের অসংখ্য ট্রেকিং রুটের একটির যাত্রী। উদ্যোগী অনুজপ্রতিম তমাল। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোয় যার অগাধ আস্থা। সঙ্গে ধুনোর গন্ধ তার ভালো অর্ধেক অমৃতা। আর পঞ্চবর্ষীয়া কুর্চি। পরিচয় জানাতে পারলে কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই। আলিপুরদুয়ারে সপরিবার অভ্যর্থনা পার্টি। অতিথি অবশ্যই ভালো আর খারাপ অর্ধেক সমন্বিত এই প্রতিবেদক।
ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে ট্রেকিং!!! উত্তরটা ভবিষ্যতের গর্ভেই ছেড়ে রাখলাম।
সান্তারাবাড়ি মোটরযানের শেষ ঠিকানা। এরপর চরণযুগলই ভরসা। যাত্রাপথের একটা আগাম আভাস দেওয়া যাক। সান্তারাবাড়ি থেকে বক্সা, চুনাভাটি, লামনা, আদমা, কালিপোখরি হয়ে সেই যেখানে রাই থেকে ছিলেন। পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কোনো সমর্থন নেই কিন্তু নামকরণে আছে। রাই মিয়া টুঙ। রাই যেখানে ছিলেন। আমরা চিনি রায়-মা-টাঙ নামে। নামে কিছু কিছু যায় আসে বৈকি।
শাল, অর্জুনে ছাওয়া পথের চরিত্র পরিবর্তন হতে থাকে দ্রুত। উচ্চতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। চাপ, চেপ্টি, চিলুনি, চিপরাশিরা ঘনিয়ে আসে দুপাশ থেকে। গায়ে হাত বুলিয়ে যায় ব্লু মরমোন, প্যান্জি, কমন বাটারফ্লাইয়ের দল। আবহকে ঘন করে নিরন্তর ঘন্টির আওয়াজ। আসলে যা ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া কিছু নয়। হঠাৎ হাল্কা মেঘ আলিঙ্গনবদ্ধ করে মাঝে মাঝেই। সতর্ক পদক্ষেপে সাড়ে চারজনের ছোট্ট দলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বাড়াতে থাকে।
পাহাড়ি বাঁকের চমকে হঠাৎ লুকোচুরিতে ডিমা, বক্সা, জয়ন্তী নদীদের ঝাঁকি দর্শন। সঙ্গীনী চোদ্দ বছরের পুরনো স্ত্রী প্রকৃতির ব্যাকড্রপে অচেনা নারী। যার দিকে অপাঙ্গে চাইতে মন চায়, হাঁটার ছলে ছুঁতে চায় হাত, ফিসফিসিয়ে জানতে চাইতে ইচ্ছে করে, কষ্ট হচ্ছে কি না।
বক্সা টাইগার রিজার্ভের মধ্যে দিয়ে হলেও বন্যপ্রাণ চোখে পরেনি। তারই অভাব মেটাচ্ছে কুর্চি। হরিণীর মতো চপল চরণে দিব্বি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তার দ্রুত চলা। অবশ্যই বাবা তমালের সতর্ক তত্ত্বাবধানে।

দুহাজার দুশো ফিট উচ্চতায় বক্সা গ্রাম। প্রথম রাতের ঠিকানা। ঠিক উল্টোদিকে দুহাজার আটশো চুয়াল্লিশ ফিট উচ্চতায় বক্সা দুর্গ। বেলা শেষের আলো আঁধারিতে আরও বেশি ইতিহাস জর্জরিত। রহস্যময়তার অমোঘ আহ্বান। পা ও-দিকে যেতে উত্সুক হলেও তমালের পিছুটানে নিয়ন্ত্রিত। সাপ খোপ আছে, দিনের আলোয় যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অগত্যা তমালের কেঠো ডেরায় কেজো পায়েদের সে-দিনের মতন বিশ্রাম।
কলকাকলিতে ভোর না হতেই শয্যাত্যাগ। বাইরে বের হতেই পাখির বদলে চোখে পড়ল একদল কচিকাঁচা। সবাই স্থানীয়। প্রবল উত্সাহের কারণ দুটি। কুর্চির আগমন। আর সামনে খাটানো তাঁবু। আমাদের সঙ্গে যাবে। পরের দিন তাঁবুতেই রাত্রিবাস। তাই পাঁচ সকালেই তমাল লেগে পড়েছে সব ঠিকঠাক আছে কিনা পরখ করে নিতে।
এত কলতানে চোখ নেই দুই সখীর। নরম আলোয় ভিজতে ভিজতে অনাবিল হাস্য রসে মশগুল তারা। পেশায় মাস্টারনি অমৃতার পেশাগত মুখোশ হারিয়েছে বক্সার জঙ্গলে। সঙ্গে রাতারাতি পাহাড়ি হয়ে ওঠা আমার ঘরণি।
বক্সা দুর্গ নিয়ে এত লেখা হয়েছে তাই এ লেখার ভার নাই বা বাড়ালাম। গ্রামের আশপাশে প্রকৃতির পরশে প্রাকৃতিক ফোটোশ্যুটে বের হলাম সদলবলে। বন্ধু তমাল এ বার দার্শনিক তথা পথপ্রদর্শকও। নানান রঙবেরঙের প্রজাপতির চরিত্র ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে অবলীলায়। আমার কাজ শাটার টেপা।

আলাপ হল তিন প্রজাতির তিন মাকড়শার সঙ্গেও। প্রথমেই নেফিলা। সবুজ, হলুদ আর লালের ফোঁটায় কি তার রূপের বাহার। জানা গেল কোনো এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় নাকি ট্যারেন্টুলা। কিঞ্চিৎ অ্যারাকনোফোবিক আমার ভাল অর্ধেক আমাদের এই মাকড়শা প্রীতিতে যারপরনাই বিরক্ত এবং আতঙ্কিত। এরপরেই আলাপ করা গেল ব্ল্যাক স্পাইডারদের সঙ্গে। তবে প্রেমে পড়ে গেলাম চশমা পরা মাকড়শা দেখে। স্প্রীং-এর মতন পা। সাদা মুখে কালো চশমা সদৃশ দাগ। পরিচিত নাম সিগনেচার স্পাইডার। বৈজ্ঞানিক নাম অ্যার্গিওপি অ্যানিসুজা।
প্রাতঃরাশ শেষ করার আগেই দল আরও ভারী হল। আমার এক চিত্রগ্রাহক ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু সস্ত্রীক হাজির। আমারই নেমসেক। অরিন্দম এবং পারমিতা। দল অবশ্য আরও ভারী হল। অসীম, বিজয় আর বিনয়ের কল্যাণে। এরা সকলেই ভূমিপুত্র তথা তমালভক্ত। আমাদের পোর্টারের অভাব মেটানো এবং, না, সেটা যথাসময়ে প্রকাশ্য।

সমগ্র যাত্রাপথে ছোটবড় মিলিয়ে মোট বাইশটি পাহাড় পার হতে হবে। তবে সেটা কখন ঘটেছিল বোঝা যায়নি। গোটা পাঁচেকের হিসেব কষে উঠতে পেরে ছিলাম। যাত্রাপথের আশি শতাংশই বক্সা টাইগার রিজার্ভের ভিতর দিয়ে। যার অনেকটাই কোর এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত।
দুর্গের ঠিক উল্টোপথে ক্রমাগত চড়াইয়ে বক্সা গ্রাম অতিক্রম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুপাশের ঝোপঝাড় নিবিড় হতে থাকে। আবার ঘনিয়ে আসে মেঘ। ঝাপসা হয় চারিপাশ। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় ঠাণ্ডা হিমেল পরশ। নির্বাক যাত্রীরা প্রকৃতিতে বুঁদ হয়েই ঘনিষ্ঠ হয় চলনে। হঠাৎ কিছু টুপফোঁটাদের আসা এবং আরও দ্রুততায় যাওয়া। তমালের সাথে কয়েক পা এগিয়ে ছিলাম। নারীকণ্ঠের চিত্কার পা টেনে ধরে।
সমস্যা বিশেষ কিছু না। জোঁক। তার যেমন রঙের বাহার তেমনই আকৃতির বৈচিত্র্য। তমালের নির্দেশে জোঁক নিবারণী ব্যবস্থা। প্যান্টকে প্রায় হাঁটুর কাছে গুটিয়ে নিয়ে প্রচলিত মশক নিবারণী মলম পায়ে লাগানো হল। তার যে এমন জোঁক প্রতিরোধী ক্ষমতা জানা ছিল না। যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি।

অনুভবে প্রথম পাহাড়ের মাথায়। শতাধিক বছর প্রাচীন নির্মাণ। দুর্গ পাহারা দেওয়ার দুর্গম এক ওয়াচ টাওয়ার। এরকম আরও তিনটি আছে উল্টোদিকের পর্বতচূড়ায়। এর পরের পথ ভারী বিপজ্জনক। একদিকে দেওয়াল সদৃশ পাহাড়, অন্যদিকে খাড়া খাদ। ভয়ঙ্কর সুন্দরের মানে আরও একবার হৃদয়ঙ্গম হল। সঙ্গে নাছোড়বান্দা ঘ্যানঘ্যানে জোঁকের দল। তখনও কামড় দিতে পারেনি অবশ্য। বোধহয় ঔষধিগুণেই।
দিনের প্রথম বিরতি। গ্রামের নাম চুনাভাটি। পালা আহারের। পালা মহিলাদের প্রকৃতি অনুষঙ্গের। পালা ছবির মতন ছিমছাম পার্বত্য গ্রামটির সৌন্দর্য উপভোগের। গ্রামের একপ্রান্তে নির্জন এক গুম্ফা একাকিত্বে মগ্ন। যত ছোটই হোক গাম্ভীর্যে আবহে ভক্তিরস। যতদূর চোখ যায় হঠাৎ জমাটবদ্ধ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন পাহাড়ের সারি। তার মাঝে কুমারীর আঁকাবাঁকা সিঁথির মতন চিকচিকে ডিমা। দেখা হবেই তার সাথে পথের কোনো অচেনা বাঁকে। মেঘেদের মিনারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাত্রীদের অবয়বে যেন আবছা ধোঁয়াশা। সময় থমকে যায়।
ছোট্ট এক পশলা বৃষ্টি শেষে আবার পথে। পাকদণ্ডি। পায়ে পায়ে সৃষ্টি সে পথের। কোথাও বেশ খাড়াই। শহুরে ফুসফুস আর্তনাদ করে। রেহাই চায়। কুর্চির সাবলীল গতি দেখে আবার শহুরে ভন্ডামির মুখোশেই মুখ ঢাকে। আর গণ্ডগোলটা বাঁধে তখনই। কুর্চির আর্তনাদে চমকে ওঠে প্রকৃতি। থমকে যাই আমরা। ককিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। সঙ্গে বাবা আছে। কাছে যেতে রহস্য পরিষ্কার হয়।
কখন বা একটা জোঁক ধরে ছিল কুঁচকির কাছে। রক্ত খেয়ে পড়েও গেছে অনেকক্ষণ। হঠাৎ সেই রক্তাক্ত দৃশ্যে চোখ পড়তেই বিপত্তি। কিছুটা সময় দাঁড়ানো হল। দুধ খাওয়ানো হল কুর্চিকে। দেখে নেওয়া হল রক্ত বন্ধ হয়েছে কী না। সবার আগে সেই তাড়া লাগালো। চরৈবেতি, চরৈবেতি।
বারে বারে অরিন্দম আর পারমিতা পিছিয়ে পড়ায় তমাল বিরক্ত হচ্ছিল। ওদের সদ্য বিবাহ হওয়ার প্রসঙ্গ মনে করিয়ে শান্তি ফেরায় অমৃতা। কপোত কপোতী যথা উচ্চ পাহাড়চুড়ে ওদের প্রেমের কাবাবে হাড্ডি হতে ঘোরতর আপত্তি জানায় দুই মহিলাই। অগত্যা।
প্রকৃতি প্রেমেই দুধের স্বাধ মেটাই তমাল আর আমি। কয়েক পা এগোতেই মুগ্ধতা গ্রাস করে। নিচে চঞ্চলা পাহাড়ি তন্বী কিশোরীর মতন এক ঝরনা নেচে নেচে যায়। আহ্বান করে আলিঙ্গনে যেতে। তমাল জানায় ওর বাহুলগ্না হয়েই রাত্রিবাস। তাঁবু পড়বে ওখানেই। নিরন্তর ছন্দের সাহচর্যে থাকার এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। উত্তেজনা জড়িয়ে ধরে।

লামনা। ঝরনার নাম। তার পাশেই চারটি তাঁবু। তাঁবু ঘিরে জ্বলে ওঠে আগুনের প্রাকার। ভালুক জল খেতে আসতে পারে। ভোজবাজির মতন অসীমের হাতে হাজির স্প্যানিশ গিটার। ঝরনার তালে আর অসীমের সুরে জমে ওঠে ক্যাম্প ফায়ার। এক অবর্ণনীয় সাঙ্গীতিক সন্ধ্যা। হঠাৎ কয়েকজন মানুষের আগমন। কাছেই আদমা গাঁয়ের বাসিন্দা। তমালের পরিচিত। রঙ লাগে প্রাকৃতিক জলসায়। দেশি মুরগি কাঠের আগুনে গনগনে। সঙ্গে পাহাড়ি তরল অনুষঙ্গ। গানের তাল, কাঠ ফাটার আওয়াজ, ঝরনার সুর আর ঝিঁঝিঁর ঐকতান। পারফেক্ট কোলাজ। রাত বাড়ে। গ্রামবাসী ঘরে ফেরে। সুর নেতিয়ে পড়ে। আগুন স্তিমিত হয়। বাড়ে নিঃঝুম পাহাড়ি রাতের শব্দ। মিইয়ে পড়া আলোয় হঠাৎ নতুন করে প্রেমে পড়ি ঘরনীর। তার চোখেমুখে খেলা করে আলোছায়ার আহ্বান। অচেনা লাগে। যেন শতযোজন দূরের অচেনা নারী। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে মাখনের পেলবতা। শিথিলতা নামে ধমনীতে, চেতনায়। কালো কম্বলে বুকে তুলে নেয় হিমালয়।
উপত্যকার তিনদিক ঘেরা পাহাড়ের মাথায় আবির হয় গোলাপি। গোলাপি হয় গলানো সোনা। গান শোনায় পাখি। আগের রাতের রহস্যময়তা হারিয়ে নতুন প্রাণ জাগে শরীরে। ঝরনার জলে শরীরের প্রতিটি কোষের ক্লেদ মুক্তি ঘটে। গরম বাটি ভর্তি নুডলস ফেরে হাতে হাতে। অনেক দূরের পথ। পেটের সঙ্গে কোনো আপস নয়।
পাহাড়ে সুস্থ থাকার নিয়ম। ড্রিঙ্ক মোর, পিস মোর। গত দেড় দিনে মাঝে মধ্যেই গ্রাম থাকায় দ্বিতীয়টা নিয়ে মহিলাদের সমস্যা ছিল না বিশেষ। আজ রায়মাটাঙ অবধি কোনো গ্রাম নেই। তাই অমৃতা আর তার সখীর জন্য মাঝমধ্যেই প্রহরীর ভূমিকায় তমাল বা আমি। অরিন্দম অবশ্য সুযোগ নেয়নি। পারমিতার দায়িত্ব একাই সামলেছে। শুধু প্রকৃতি অনুষঙ্গই নয়, যেখানে যেখানে হাত বাড়ানোর প্রয়োজন পথ পাড় করতে সেখানেও। আর বিজয় বেচারা মুষড়ে পড়েছে এখানেই। প্রথমদিন থেকেই শিভ্যালরির একক ধারক এবং বাহক বিজয়। যে কোনো দুর্গম পথের হদিশ মিলতেই ভাবিজানেদের জন্য জান হাজির তার। হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র সখা। খালি পারমিতা ভাবির জন্য কিছু করতে না পারায় বেজায় মন খারাপ। সে জন্যই কি না জানি না, আমার ভাল অর্ধেককে একটি সমস্যাসঙ্কুল ঝরনা, যা পাথরে পা ফেলে পার হতে হয়, পার করাতে গিয়ে নিজেই সখাত সলিলে। আমার রাই!!! জীবনে আমার তোয়াক্কাই করেননি, তো বিজয় কোন ছাড়…. বেচারা বিজয়। শিভ্যালরির সাইড এফেক্ট।

পথের বাঁকে হঠাৎ দেখা। ভাবিনি সম্ভব হবে কোনোদিন…. সুন্দরী ডিমা। বার বার লুকোচুরি খেলেছে আবেগ নিয়ে। এখন ছোঁওয়া দিয়ে যায়। বুঝিনি আসলে সাবধান বাণী। সামনে বিপদ। সত্যিই তাই। এক লহমায় ডিমার নিম্নগমন। আমাদের উর্দ্ধ। কমবেশি হাজার দেড়েক ফিটের ব্যবধান। আর সেখানেই নাকি পথ নাই ওগো পথ নাই! না, ভুল বললাম। আছে। কিন্তু ওটা কি পথ! খাড়া স্লেট পাথরের মতন মসৃণ পাহাড়ি দেওয়াল। অন্যদিকে একেবারে নিচে চিকচিকে ডিমা। রাস্তা! ছয় ইঞ্চির এক ফালি পাথর প্রায় পঞ্চাশ মিটার। বেশিও হতে পারে। টিকটিকির মতন দেওয়ালে আটকে শুধু টো এর উপর ভর করে পার হতে হবে। আমি চিন্তিত আমার রাইকে নিয়ে। (প্রসঙ্গত তাঁর নাম রাই বলে যেন না ভাবেন পাঠককুল)। তাঁর প্রথম ট্রেকিং। না তিনি অবশ্য বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। তমাল আর বিজয়ের হাত না ধরেই, শুধু ভরসা করেই পার হলেন। আমি কী করছিলাম? পতন হলে ভাগ্যবান আর না হলে ফোটোগ্রাফার…..শাটার টিপছিলাম।
সবুজে জড়ানো পাহাড়ি পথে নিরন্তর চলে যাওয়া। বিরক্তি বা ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। মাঝে মাঝে খানিক জিড়েন। জলপান। আবার চলা। হঠাৎ রুদ্ধ হল গতি। সামনে পাহাড়। বেশ খাড়াই। তমাল জানালো আমাদের শেষ চড়াই। কিন্তু পথ কই? যে পথ দেখালো তমাল, সবার চোখ কপালে। এতো বৃষ্টি দিনের ঝরনা। এখন শুকনো। কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। অগত্যা। প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশের চেষ্টায় আজানুলম্বিত জিহ্বা আর ফুসফুসের হাহাকারকে সঙ্গী করে পর্বতারোহণ সম্পন্ন হল।

পাহাড়ের উপরটা ফ্ল্যাট। সুন্দর চাষ জমি। সবুজ ভুট্টা চারায় চোখের আরাম। আমাদেরও। শুকনো আহারে মধ্যাহ্নভোজন। কিছুটা বিশ্রাম তার পর আবার চলা। বাকি পথটা পুরোটাই গহীন অরণ্য। তবে ওঠা নেই, নামা। অরিন্দম-পারমিতা অসীম আর বিনয়ের সঙ্গে রওনা দিয়েছে। আমরাও সঙ্গী হতে যাচ্ছিলাম। বাধ সাধল কুর্চি। প্রকৃতির সাথে তার বেশ বড়সড় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। খানিক অপেক্ষা করার পর তমাল তাড়া দিল। অনেক দূরের পথ অতএব আমি আর আইভি (আমার গৃহিণী) যেন এগিয়ে পড়ি। ভালই হল। জঙ্গলপথে এতক্ষণে মিলব মোরা দোঁহে। টুকরো-টাকরা ছবি তোলা, একটু থামা একটু চলা, জঙ্গলের গল্প বলা। বেশ একটা রোমান্টিকতার ছোঁয়া। ভাল লাগা। নিজেদের নতুন করে পাওয়া। হঠাৎ বাঁদিক থেকে একটা আওয়াজ। বার্কিং ডিয়ার ভেবে সামান্য চোখ চালিয়ে হাল ছাড়লাম। এই জঙ্গলে শহুরে চোখে খুঁজে না পাওয়ারই কথা। একটু পরে আবার সেই ডাক। পিছন থেকে। তারপর আবার। এ বার উত্স ডানদিক। প্রায় একই সাথে বাঁ দিকেও। শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত। এক হাতে স্ত্রীর হাতটা ধরে গতি বাড়ালাম চলার। ক্রমশই আমাদের বুনো কুকুরের দল ঘিরছে বুঝতে বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। যত এগোই ডাকগুলো ততই কাছে আসে। ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড ডগস। বনের রাজাও এড়িয়ে চলে, আমরা তো কোন ছাড়। সামনে অসীমদের টিকিও নেই। পিছনে তমালরা ঠিক কত দূরে জানা নেই তাও। রীতিমতন বিপন্ন বোধ করতে শুরু করলাম। ডাক এত কাছে যে কোনো মুহুর্তে সাক্ষাৎ মিলতে পারে শমনের। হঠাৎ সামনে নদী খাত। ছুটে নামলাম দুজনে। অল্প জল। মুখে হাসি ফুটলো। না এ জলে রোখবার পাত্র সারমেয়কুল নয়। জলে বোঁটকা গন্ধ। কাছাকাছি হাতির পালের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। বুনো কুকুর শুধু হাতির পালকেই সমঝে চলে। সাক্ষাৎ গণেশের আশীর্বাদ। কুকুরের ডাকও বন্ধ। ধীরে সুস্থে নদী পার হলাম।
সামনেই একটা পাথরে বসা পারমিতা। পাশে অরিন্দম। দুজনের মুখ শুকিয়ে আমসি। বেজায় ভয় পেয়েছে। জানা গেল, হাতির পাল সদ্য গেছে। ওদের সামনে দিয়েই। সেই দেখে পায়ের জোর হারিয়েছে দুজনে। অসীমরা ঢের আগেই চলে গেছে। না, বুনো কুকুরের হদিশ ওরা পায়নি বলেই মনে হল। ওদের আতঙ্ক যাতে না বাড়ে তাই তখনই সে কাহিনি আর শোনালাম না। বরং পড়ন্ত আলোয় জঙ্গলপথে পা চালালাম চারজনে। পৌঁছতে হবে রায়মাটাঙ। যথা সম্ভব দ্রত।
রাইয়ের সঙ্গে রাইয়ের দেশে পৌঁছতে লেগেছিল আরও ঘন্টা খানেক। তবে নির্বিঘ্নই ছিল বাকি পথ।


বর্তমানে আনন্দবাজার পত্রিকার মুম্বই এডিশনে মুক্ত সাংবাদিক রূপে যুক্ত অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের পরিচিতি মূলত টেলিভিশন জার্নালিস্ট হিসেবেই। এর আগে ‘আকাশ বাংলা’, ‘কলকাতা টিভি’, ‘তারা নিউজ’, ‘চ্যানেল টেন’ ইত্যাদি বিভিন্ন চ্যানেলে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘদিন। ভ্রমণ এবং বন্যপ্রাণ বিষয়ক কাজ নিয়েই মেতে আছেন ইদানীং। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলের জন্য তৈরি করেছেন একাধিক ট্রাভেলগ। পুরস্কারও মিলেছে ডকুমেন্টারি ছবি করে।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher