ভ্রমণ তো বানিয়ে তোলা গল্পকথা নয়, মানুষের সত্যিকারের জীবনকাহিনি। আর তাই ভ্রমণ কাহিনি মনে শুধু আনন্দই এনে দেয় না, চোখের জল অথবা প্রতিবাদের ভাষাও জাগিয়ে দিতে পারে। ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্ট্রির সহায়ক বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম ছাড়াও ভ্রমণ কাহিনির বড় পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপেও। তেমনই কিছু 'অন্য ভ্রমণ' কথা।

 

শান্তিনিকেতন থেকে ধাত্রীদেবতার সন্ধানে

শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ


রেললাইনটা পার হয়েও দেখছি ব্যাপারটা থামেনি। ভেবেছিলাম প্রান্তিক যখন পেরিয়ে গেলাম তখন নিশ্চয় আর এমন দেখবনা। ভাবনাটাই ভুল ছিল। রাস্তাটা রেললাইন পার হয়ে বাঁ দিকে বেঁকে চলেছে আমার গন্তব্যের দিকে। যাওয়ার পথের দু'ধারের মাঠে বিভাজন এখন আর আলে থেমে নেই। আগে থেমে যেত। একটা খেতের সঙ্গে অন্য একটা খেতের তফাত বোঝাতে লাগে আল। সেই সরু আল এখনও আছে। তবে ক'দিন থাকবে তা বলা ভারি মুশকিল। বিভাজন রেখা কাঁটাতারের বেড়া, যেন একেকটা সীমান্ত একেক দেশের। প্রান্তিকের দিকটা ভরে উঠেছে ফার্ম হাউস, আবাসন আর বেসরকারি ইস্কুল-কলেজে। বেশ একটা নগরায়ণ চলছে। সেই নগরায়ণের মূল ভোক্তা কলকাতা এবং বিদেশের বাঙালিরা। তাঁরা বাড়তি সম্পদ ব্যয় করে বাড়ি কিনে রাখছেন, বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করছেন, পারলে কেউ কেউ জমি কিনছেন রিসর্ট বানাতে। কলকাতা এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে যাঁরা নানা শান্তিনিকেতনী উৎসবে বেড়াতে যান তাঁরা স-গাড়ি সেখানে ডেরা ফেলেন। হোটেলে বাউল আসে গান শোনাতে, তাঁরা সংস্কৃতি করেন।
এই শান্তিনিকেতনটা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই। দুটো স্পষ্ট বিভাজন হয়ে গিয়েছে। একদিকে পুরোনো শান্তিনিকেতনী ও অন্যদিকে নবীন শান্তিনিকেতনী। এই দুই বিভাজনে বেশ একটা দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। সেই ক্রমশ বেড়ে চলার নজির় দেখছি আমার চলার পথের দু'ধারে। কংকালীতলা অব্দিও ধানের খেতে পড়ে আছে সিমেন্টের খাম্বা। তাতে কাঁটাতার দিয়ে এলাকা চিহ্নিত করা আছে। চাষের জমি পাল্টে যাচ্ছে বাস্তু জমিতে। এখানে কয়েকটা কূট প্রশ্ন উঠে আসে। মানুষকে তো থাকতে হবে। তাহলে জমি যদি না পাওয়া যায় থাকবে কী করে! অতএব লোকসংখ্যা বাড়লে জমির চরিত্রও বদলাবে স্বাভাবিকভাবেই। এই অবদি যদি ভাবনাটাকে ধরা যায় তাহলে ভুল খুব বেশি কিছু নেই। কিন্তু যদি অন্য দিকটা একটু দেখা যায় তাহলেই নজরে আসবে সমস্যাটা। এই যে এত এত বাড়ি হচ্ছে এখানে নিয়মিত থাকছেন ক'জন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকছেন না। মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাচ্ছেন। এমন অবস্থা কিন্তু পুরোনো শান্তিনিকেতনীদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। তাঁদের নবীন প্রজন্ম এখন কার্যোপলক্ষে বাইরে বাইরে থাকেন। সেখানে অনেকেই নিজেদের বাসস্থান করে ফেলেছেন। শান্তিনিকেতনের বাড়িকে কেউ বানিয়েছেন গেস্ট হাউস, কেউ রেখে দিয়েছেন নিজেদের ও বন্ধুদের বেড়াতে যাবার সুবিধের জন্য।

সম্পদ যদি কারও বাড়তি থাকে তাহলে সে এটা করবেই। অধিকাংশই হয়তো বলবেন যে এতে ভুল কী আছে! চলতি জীবনের চলতি নিয়মের দিক থেকে কোনো ভুল নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে জায়গাটার নাম শান্তিনিকেতন। বোলপুরকে যিনি নিছক বোলপুর থেকে শান্তিনিকেতন বানিয়েছেন তাঁর দিক থেকে দেখলে বোধহয় কিছু সমস্যা দেখা দেবে। কিন্তু কথা হচ্ছে সবই যখন তাঁর নামে তাহলে দেখব নাই বা কেন! গীতিকবিতা লিখে নোবেল পেয়ে গেলেন যখন সেখানেই থেমে গেলে পারতেন। থামলেন না। তার বদলে সেই অর্থের সমস্তটা ব্যয় করলেন তাঁর আশ্রম গড়ে তুলতে। নোবেল জয়ের অনেক আগে থেকেই এই প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। তাকেই আরেকটু বড় আকার দিতে শুরু করলেন সেই অর্থে। দেবেন্দ্রনাথের গড়া 'শান্তিনিকেতন' বাড়িটা একটা অঞ্চলের চিহ্ন হয়ে দাঁড়াল যে তার পেছনে রয়েছে ওই অমানুষিক প্রচেষ্টা। ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম থেকে শুরু করে পরবর্তী বিশ্বভারতী পর্ব অবধি নিজের প্রায় সমস্তটাই ঢেলেছেন এখানে রবীন্দ্রনাথ। নিজে ও বন্ধুবান্ধব থাকবেন বলে ঢালেননি। শিক্ষা ও চেতনা ও সংস্কৃতি বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। তাতেই ক্ষান্ত হননি। গড়ে তুলেছিলেন শ্রীনিকেতন-ও। কৃষি ও হস্তশিল্প এবং ক্ষুদ্রশিল্প বিকাশের ভাবনা ছিল।
জীবনের শেষ শ্রমবিন্দুটাও ব্যয় করেছেন দেশের কাজ করতে। দেশ গড়ার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। অসুস্থ শরীর নিয়ে ভারতের শহরে শহরে বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান করেছেন। যা দেখে গান্ধীকেও বলতে হয়েছে এই বয়সে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে গুরুদেব এ কাজ করে বেড়াচ্ছেন এ লজ্জার বিষয়! বিড়লাকে বলেছেন সাহায্য করার জন্য। কিন্তু দেশের লোক বোধহয় লজ্জা পায় না। পেলে যাঁরা শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভূমির গরিমায় সম্পদ সঞ্চয় করে চলেছেন, সম্পদ ব্যয় করছেন নিজেদের ভাল থাকার আশায় তাঁরাও বোধহয় দেশ-দশ নিয়ে আরেকটু ভাবতেন। বাড়ির নাম শুধু খেয়া, বলাকা, সোনার হরিণ রাখলেই যে রবীন্দ্রচর্চা হয়না তা বুঝতেন।

যদি বুঝতেন তাহলে কৃষকের জমিকে বাস্তুতে রূপান্তরিত করার আগে ভাবতেন কী হল কৃষকের যে এমন করে নিজের সামান্য সম্পদটুকুও বেচে দিতে হচ্ছে তাকে! যে পথ দিয়ে চলেছিলাম সেখানে জমির পর জমি রুক্ষ। জল ওঠে না। এমনকী শ্যালোর থেকেও ৩০০-৩৫০ ফুটেও জল ওঠে না। মাটির নীচের জলভাণ্ডার এখন ৫০০ ফুটের বেশি নেমে গিয়েছে। এ অবস্থায় পাম্প চালালে সে জ্বলে নষ্ট হয়ে যাবে। জল এত কম উঠবে যে বিদ্যুৎ শেষত তাকেই পোড়াবে। এ পরিসংখ্যান আশেপাশের গ্রামের থেকে পাওয়া। সরকারি শিলমোহর নেই, কিন্তু যার জমি তার দুঃখ আছে এতে। জলভাণ্ডার গড়া, বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, এ সমস্ত নিয়ে কেউই ভাবেননি। নদী সেচের কথা কহতব্যই নয়। নদী সেচ এক কাহিনি হয়ে থেকে গিয়েছে। দুবার চাষ তো পরের কথা, একবারই হতে চায় না। ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই শুকোচ্ছে। বর্ষার জলে চাষের আশ করেও লাভ নেই। মানুষেরই লোভ উষ্ণায়ণ হয়ে আছড়ে পড়েছে। তাই চাষার করার কিছু নেই। জমির পর জমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে বাস্তুজমিতে।

যাচ্ছিলাম লাভপুরের পথে। তারাশঙ্করের দালানকোঠা দেখার বাসনায়। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন থেকে তারাশঙ্করের সাধনার দিকে চলেছিলাম। যেতে যেতে ভাবছিলাম এঁদের লেখার কথা। নিখিলেশ জমিদার। ঘরে বাইরে উপন্যাসের সময়কাল স্বদেশী আমল, বঙ্গভঙ্গের সময়কাল। বিলিতি দ্রব্য পোড়ানো হচ্ছে নিয়ম করে। সন্দীপ, ঘোরতর স্বদেশী নেতা, একেই মহান কাজ বলে চিহ্নিত করে আশেপাশের সকলকে উদ্বেল করে তুলেছে। এমনকী নিখিলেশের ঘরণী বিমলাকেও সে তার জালেই আটকাতে পেরেছে। যাবার পথে কেবল মনে পড়ছিল নিখিলেশের কথা। এ এক এমন সময় বেঁচে আছি যে সব কথা মনে পড়ার কথাও বটে। নিখিলেশের কথার এক জায়গায় নিখিলেশ বলছে, 'এরা মনে করে আমি খুব হিসাবি, আমি কৃপণ। আমার স্বদেশী কারবারের হিসাবের খাতাটা এদের খুলে দেখাতে ইচ্ছা করে। আর, সেই-যে একদিন মাতৃভূমিতে ফসলের উন্নতি করতে বসেছিলুম তার ইতিহাস এরা বুঝি জানে না! ক' বছর ধরে জাভা মরিশাস থেকে আখ আনিয়ে চাষ করালুম; সরকারি কৃষিবিভাগের কর্তৃপক্ষের পরামর্শে যত রকমের কর্ষণ বর্ষণ হতে পারে তার কিছুই বাকি রাখি নি, অবশেষে তার থেকে ফসলটা কী হল? সে আমার এলাকার চাষিদের চাপা অট্টহাস্য। আজও সেটা চাপা রয়ে গেছে। তার পরে সরকারি কৃষিপত্রিকা তর্জমা করে যখন ওদের কাছে জাপানি সিম কিম্বা বিদেশী কাপাসের চাষের কথা বলতে গেছি তখন দেখতে পেয়েছি সে পুরোনো চাপা হাসি আর চাপা থাকে না। দেশে তখন দেশসেবকদের কোনো সাড়াশব্দ ছিল না, বন্দেমাতরং মন্ত্র তখন নীরব। আর সেই-যে আমার কলের জাহাজ-- দূর হোক সে-সব কথা তুলে লাভ কী? দেশহিতের যে আগুন ওরা জ্বালালে তাতে আমারই কুশপুত্তলি দগ্ধ হয়ে যদি থামে তবে তো রক্ষা।

শিলাইদহে এককালে চাষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিলিতি পন্থায়। সে চাষের কাহিনিই উঠে এসেছে এখানে। সে চাষে কাজ হয়নি। হয়েছিল পরের বার স্থানীয় চাষী দিয়ে করা চাষে। কলের জাহাজ করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তার পরিণতিও আমাদের জানা। শেষমেশ বিলিতি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগীতা ছাড়াও কর্মচারীরাই ডুবিয়েছিল সব। নিখিলেশের বিলিতি বর্জনে আপত্তি ছিল না, ছিল তার ঘটা-পটায়। নিখিলেশের দেশের কাজে আপত্তি ছিল না, ছিল দেশকে মাতৃকল্পনায় পুজো করে তার সর্বনাশ করার কাজে। দেশ যদি মা হয় তাহলে সে দেশ তো হিন্দুর দেশ, মুসলমানের হবে না। মুসলমানের তো পৌত্তলিকতায় আপত্তি। শুধু তাই না, পল্লীসমাজকে নিজের হাতের তালুর মতন চিনতে পারার যে গুণ নিখিলেশ দেখিয়েছিল, যে সংস্কারমুক্তি দেখিয়েছিল সে তো আশ্চর্য্য! তার জমিদারীর মুসলমানেরা গো-হত্যা করাকে ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুর মতনই অপছন্দ করতো। কিন্তু বিলিতি দ্রব্যের ধ্বংস যে তাদের অর্থনীতির ধ্বংস ডাকছিল, তাদের কাপড়ের ব্যবসা বন্ধ করে অবাঙালীদের কলের কাপড় মোটা দামে কেনার রাস্তা করছিল, সে তো তাদের নজর এড়ায়নি। শুরু হল গো-হত্যা। তখন হিন্দুদের মাথাদের নিখিলেশ বলেছিল ধৈর্য্য ধরতে। প্রতিক্রিয়ায় যা হচ্ছে তা থেমে যাবে সময়ে। কিন্তু ইংরেজি পড়া ছোকরা তো এ ভাবনার শরিক না। তাকে নিখিলেশ একটি চমৎকার কথা বলেছিল। দেশকে, পল্লীকে সে যদি না জানতো তাহলে এ কথা বলা চলতো না। বলেছিল, "আমি বললুম, এ দেশে মহিষও দুধ দেয় মহিষেও চাষ করে, কিন্তু তার কাটামুণ্ড মাথায় নিয়ে সর্বাঙ্গে রক্ত মেখে যখন উঠোনময় নৃত্য করে বেড়াই তখন ধর্মের দোহাই দিয়ে মুসলমানের সঙ্গে ঝগড়া করলে ধর্ম মনে মনে হাসেন, কেবল ঝগড়াটাই প্রবল হয়ে ওঠে। কেবল গোরুই যদি অবধ্য হয় আর মোষ যদি অবধ্য না হয় তবে ওটা ধর্ম নয়, ওটা অন্ধ সংস্কার।"
রবীন্দ্রনাথ জানতেন। মুরগীর পোলট্রি, মৌমাছি চাষ, ডেয়ারির পাশাপাশি হাঁসের চাষও শুরু করেছিলেন। এলমহার্স্টের সময় বোলপুরের গ্রামে গ্রামে ষাঁড় দেওয়া হয়েছে গরু উৎপাদনের জন্য। কালে কালে কো-অপারেটিভ হয়েছে। আখ, তিল, অন্যান্য শাকসব্জীর চাষও শুরু করেছিলেন। আজকেও শুখার মরসুমে সেই চাষ কিছু দেখছিলাম প্রান্তিক ছাড়িয়ে, লাভপুরের পথে। নিখিলেশ তাই তার পল্লীকে জানতো। সে জানা যে কত সত্য জানা তা আজ-ও আমি দেখতে পাই। সে জানা যে কত ব্যাথার জানা তা জানতে আমার বাকী নেই। 'ঘরে-বাইরে' তে রবীন্দ্রনাথ আঁকছেন পঞ্চুর জীবনকে। নিখিলেশের বয়ানে সে জীবন আমরা পড়ি - "পঞ্চু আমার মাস্টারমশায়ের একজন ভক্ত। কেমন করে এর সংসার চলে তা আমি জানি। রোজ ভোরে উঠে একটা চাঙারিতে করে পান দোক্তা রঙিন সুতো আয়না চিরুনি প্রভৃতি চাষার মেয়েদের লোভনীয় জিনিস নিয়ে হাঁটু-জল ভেঙে বিল পেরিয়ে সে নমঃশূদ্রদের পাড়ায় যায়; সেখানে এই জিনিসগুলোর বদলে মেয়েদের কাছ থেকে ধান পায়। তাতে পয়সার চেয়ে কিছু বেশি পেয়ে থাকে। যেদিন সকাল সকাল ফিরতে পারে সেদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বাতাসাওয়ালার দোকানে বাতাসা কাটতে যায়। সেখান থেকে ফিরে বাড়ি এসে শাঁখা তৈরি করতে বসে-- তাতে প্রায় রাত দুপুর হয়ে যায়। এমন বিষম পরিশ্রম করেও বছরের মধ্যে কেবল কয়েক মাস ছেলেপুলে নিয়ে দু-বেলা দু-মুঠো খাওয়া চলে। তার আহারের নিয়ম এই যে, খেতে বসেই সে একঘটি জল খেয়ে পেট ভরায়, আর তার খাদ্যের মস্ত একটা অংশ হচ্ছে সস্তা দামের বীজে-কলা। বছরে অন্তত চার মাস তার এক বেলার বেশি খাওয়া জোটে না।"

এই যে জীবন, এই পল্লীগ্রামের জীবন! বদলেছে বিস্তর এমন কথা বললে অন্যায় হবে। হ্যাঁ, জব কার্ড এসেছে। একশো দিনের প্রকল্পের খেলা। কথা ছিল এর বিনিময়ে দেশের জন্য সম্পদ সঞ্চিত হবে। হল কত? হিসেব নিতে গেলে এক অদ্ভূত জানার সম্মুখীন হতে হয়। বোলপুরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল আগের দিন। তিনি বলছিলেন যে তিনি তাঁর একটি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। দিয়েছেন এই জব কার্ডের সৌজন্যে। মজুর মাটি কাটার জন্য চাইছেন ঘন্টায় তিনশো টাকা। বলছেন যে দিতে পারবেন বলে মনে হয় না! এই মজুররা দলানুগত। একটি অঞ্চলের যতজন বিপিএল তালিকায় আছেন তাঁদের জব কার্ড চলে যাচ্ছে নেতার হাতে। নেতা টাকা তুলছেন, বিলি করছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই যা পাওয়ার কথা কয়েকজন পাচ্ছে তার থেকে বেশি। আর অনেকেই কম পাচ্ছে। কিন্তু নিয়মিত পাচ্ছে। সুতরাং তার মদ এবং আনুষঙ্গিকের খরচ উঠে যাচ্ছে। সে আর কাজ করতে যাচ্ছে না। মাঠের পর মাঠজুড়ে তাই এখন যন্ত্রে ধান কাটার কাজ চলছে। ভাববেন না এ শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথা। এ আমি বিহার কী প্রতিবেশী ঝাড়খন্ডেও দেখে-শুনে এসেছি। শ্রমবিমুখতার এই যে উৎসব শুরু হয়েছে এর শেষ হবে ওই শ্রমিককেই হত্যা করে।
এই যে দলকেন্দ্রিক তথা নেতাকেন্দ্রিক পল্লীজীবন সেও তো আজকের কথা নয়! সে কথা অনেককাল আগেই বলে গিয়েছেন তারাশঙ্কর। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, যাঁর বাড়ি যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে চলেছিলাম লাভপুরের পথে, তিনি তো অনেককাল আগেই এ ছবি একরকম এঁকে গিয়েছেন 'গণদেবতা'য়। গ্রামের জমিদার চৌধুরীদের হাত থেকে ভূসম্পত্তি চলে গেল ছিরু পাল বা শ্রীহরি পালের হাতে। ছিরু পালের সম্পর্কে যা বলছেন সে কথা যে গ্রামে গ্রামে জেলায় জেলায় আজ কতজনের সম্পর্কে খাটে তা বলাই বাহুল্য - "ছিরু বা শ্রীহরি পালই এই দুইখানা গ্রামের নূতন সম্পদশালী ব্যক্তি। এ অঞ্চলের মধ্যে বিশিষ্ট ধনী যাহারা, ছিরু ধন-সম্পদে তাহাদের কাহারও চেয়ে কম নয় — এই কথাই লোকে অনুমান করে। লোকার চেহারা প্রকাণ্ড; প্রকৃতিতে ইতর এবং দুর্ধর্ষ ব্যক্তি। সম্পদের জন্য যে প্রতিষ্ঠা সমাজ মানুষকে দেয়, সে প্রতিষ্ঠা ঠিক ঐ কারণেই ছিরুর নাই। অভদ্র, ক্রোধী, গোঁয়ার, চরিত্রহীন, ধনী ছিরু পালকে লোকে বাহিরে সহ্য করিলেও মনে মনে ঘৃণা করে, ভয় করিলেও সম্পদোচিত সম্মান কেহ দেয় না।"
সামান্য চাষ-আবাদ থেকে গোমস্তা, গোমস্তা থেকে জমিদার হয়েছে সে। এই যে স্বল্পবিত্তের উচ্চ আসনে এসে বসে পড়া তাতে মহৎ কিছু ঘটেনি। উচ্চবিত্তের আসনে বসে সে উচ্চবিত্তের শিক্ষা-সংস্কারের দেখনদারি পালিশটুকু ছাড়া এক প্রকাণ্ড এক ক্ষমতার স্পর্ধার তামাশায় পরিণত হয়েছে। তেমনি অনিরুদ্ধ কর্মকার যখন চণ্ডীমণ্ডপ থেকে ভোগ উঠিয়ে নিয়ে যায় তখনও আর কেউ প্রতিবাদ করে না। দেবু ঘোষ চেষ্টা করেও উপায় পায় না। আবার এই অনিরুদ্ধ কর্মকার শহরে গিয়ে দোকান দেবে। তার অর্থের প্রয়োজন। গ্রামে সে অপ্রতুল। তাকে আর ধমকেও সামলানো যাবে না। এও এক রূপান্তর বটে। নীচের মহল চলাচল করছে। তার উপর যে শোষণ হয়ে এসেছে তার জাল কেটে সে বেরোতে চাইছে। কিন্তু বেরিয়ে সে সামগ্রিকভাবে নীচের মহলের কোন্‌ উপকার সাধন করবে? যা করবে তা তো তার নিজের জন্য শুধু। এ সব হচ্ছে এমন এক সময় যখন যুদ্ধের ঘনঘটা শেষ।
"আঃ, সেই তেরশো একুশ সালে যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছিল, যুদ্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে পঁচিশ সালে; আজ তেরশো উনত্রিশ সাল — আজও বাজারের আগুন নিবিল না। কঙ্কণার বাবুরা ধূলামুঠা সোনার দরে বেচিয়া কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আনিতেছে আর কালীপুরের জমি কিনিতেছে মোটা দামে। ধূলা বৈকি! মা কাটিয়া কয়লা ওঠে — সেই কয়লা বেচিয়া তো তাহাদের পয়সা। যে-কয়লার মন ছিল তিন আনা, চোদ্দ পয়সা, আজ সেই কয়লার দর কিনা চোদ্দ আনা। গোদের ওপর বিষফোড়ার মত — এই বাজারে আবার প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েতি ঘুচাইয়া ট্যাক্স বাড়াইয়া বসাইল ইউনিয়ন বোর্ড। বাবুরা সব বোর্ডের মেম্বর সাজিয়া দণ্ডমুণ্ডের মালিক হইয়া বসিল — আর দাও তোমরা এখন ট্যাক্স!"

দ্বারকা চৌধুরীর এই বিশ্লেষণে তার স্বার্থ থাকলেও গ্রামীণ পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার এই পরিবর্তনও সুদূরপ্রসারী। মূল্যবৃদ্ধির এই আগুণ ঘরকে ঘর পোড়াচ্ছে। অনিরুদ্ধর শহরে যেতে চাওয়ার নেপথ্যে এই অর্থের প্রচণ্ড অনটনের কাহিনীও আছে। গ্রামের চণ্ডীমন্ডপটির আর সে দিন নেই। ওখানে বরং কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক হলে লোক হাতজোড় করে বসে থাকবে। দেবু ঘোষ যতই পুরোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কথা ভাবুক না কেন তার রাস্তা আর নেই আজ। কিন্তু নতুন সময় কেমন হচ্ছে? তার কথাও একরকম বলেছে 'গণদেবতা'।
"চণ্ডীমণ্ডপটা এবার ছাওয়ানো হয় নাই, বর্ষায় এবার ওটা পড়িয়া যাইবে। গ্রামের লোক ছাওয়ায় নাই, শ্রীহরিও হাত দেয় নাই। শ্রীহরি ওটা ভাঙিতে চায়। এবার দুর্গাপূজার পর সর্বশুদ্ধা ত্রয়োদশীর দিন সে ওখানে দেউল তুলিবে, পাকা নাটমন্দির গড়িবে। চণ্ডীমণ্ডপ এখন সত্যসত্যই শ্রীহরির। শ্রীহরিই এখন এ গ্রামের জমিদার। শিবকালীপুরের জমিদারি সে-ই কিনিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপ তাহার নিজস্ব। ইহার মধ্যে অনাচ্ছাদিত চণ্ডীমণ্ডপের দেওয়ালগুলি বৈশাখের ঝড়ে, কাদায় ভরিয়া গিয়াছে। কত পুরাতন দিনের বসুধারার চিহ্নগুলির একও আর দেখা যায় না।"
সমস্ত প্রাচীন যখন ভাঙলো তখন নবীনকে গড়ার জন্য কোনো দিশা ছিল না। দেবু ঘোষ, জমির মাপজোকের বিরোধে জেল খেটে এসে গ্রামে নায়ক হল বটে, কিন্তু সে সংস্কারক না। তার উচ্চাশা আছে। সেও ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য হতে চায়, প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন দেখে। তার আদর্শ এক অলীক আদর্শ। সে আদর্শ দিয়ে পাতুলাল মুচি, তারা নাপিত, গিরিশ ছুতারদের চলবে না। যতই চণ্ডীমণ্ডপ আর গ্রামের সদ্‌গোপ মাতব্বর চাষারা স্থিতাবস্থা চেয়ে থাকুক সে আর আসার না। কিন্তু যা আসবে তার জন্যও যে কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

তারাশঙ্করের দালানকোঠা 'ধাত্রীদেবতা'র দিকে লাভপুরের সিমেন্টের গলি দিয়ে এগোতে এগোতে ভাবছিলাম সেই কথা। পঞ্চায়েত বদলালো। ভূমি সংস্কারের ঢাক বেজে বেজে ক্লান্ত হল। তবু জব কার্ডের রমরমা। তবু সেই দল তথা নেতাতন্ত্রই একমাত্র অগতির গতি। জমিদার-মহাজনের জায়গা নিয়েছে নেতা। সে জ্বালিয়ে দিতে বললে ঘর জ্বলবে, রাখলে লোক থাকবে। কিন্তু তাতে দেশের কি হল? যে দেশের এখনো শতকরা আশীভাগ জমির সঙ্গে সম্পর্কিত সেই দেশের এই মানুষগুলোর এ কেমন উন্নয়ন হল? এর জন্য কি শুধু সরকার দায়ী? সরকারেরা দায়ী? আমরা দায়ী নই? আমরা যারা শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যাই, পল্লীপ্রকৃতির শোভাতে আহা-উহু করি, বাড়ি বানাই, বার্ধক্যের হিসেব নিকেশ করি বৃদ্ধাশ্রমে থাকারা তারা কি পল্লীকে সত্যি চিনতে চেয়েছিলাম? চেয়েছিলাম তার বেদনাকে বুঝতে, জানতে, তার উপায়সাধন করতে? আমরা কি শহরের উত্তেজনায় মনে রেখেছিলাম যে আমাদের আত্মীয়টি পড়ে আছে পল্লীর রূপে সামান্য দূরে?
যেতে যেতে মনে হলে যেন এক প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজেডির মতন ব্যাপার। সকলেই আমরা জানি ও মানি যে দেশের আর কিছু হবার নেই। তার ঋণ, তার দারিদ্র তার চিরস্থায়ী শোভা। এমন জমিদারি ব্রিটিশেও বানাতে পারেনি। অমোঘ নিয়তির মতন সকলেই আমরা মেনে নিয়েছি এ সব। গ্রামে গ্রামে যে সবুজ এখনো কিছু দৃশ্যমান তার গায়ে যে প্রতিদিনের রক্তের ছিটে লেগে থাকে, খবরের কাগজ আর টেলিভিশনে সে ছিটে দেখে আমরা তাক করি কার দিকে বন্দুক ঘোরাবো তার! কোন দলকে বলবো, কোন দলের হয়ে বলবো সে ভাবনা গুছিয়ে নিই। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়াই না। যদি আজ দল, নেতা এ সমস্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপ হয়ে থাকে তাহলে তাকে হতে দিয়েছি আমরা। দেশের শাসন ও সংস্কারের সামান্যতম কাজটুকু থেকেও নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে তাকেই দিয়েছি সমস্ত ভার। নিজেদের জীবনের আহ্লাদ থেকে এক মুহূর্তও মুখ সরাতে অক্ষম বলে এ দায় আমরা নিতে পারিনি। ঘরে-বাইরেও তাই যখন আগুন লেগেছে তখনও গণদেবতা জাগেননি। সে আগুন আর জাগরণের কাহিনিকারদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলাম। এসেছিলাম আগুন ধরার আগেই তাকে নেভানোর প্রচেষ্টার কারিগরের দেশে। ভেবে দেখলাম তিনিও একা, তারাশঙ্করও একা। এ দেশের ধাত্রীদেবতা শান্তিনিকেতনের সন্ধান না পেয়েই চলে গিয়েছেন। আমরা তাঁকে যেতে দিয়েছি।

আপাদমস্তক সৃজনশীল মানুষ শুদ্ধসত্ব-র লেখনীর অবাধ বিচরণ গদ্য, কবিতা, নাটক, সঙ্গীত, সাংবাদিকতা – সৃষ্টির নানান আঙিনাতেই। কাগজের পাতায়, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের পর্দায় বা পর্দার আড়ালে, আন্তর্জালের অলিগলিতে সর্বত্রই রেখেছেন তাঁর সৃষ্টিশীলতার সাক্ষর। তাঁর অন্যরকম ভাবনায় উঠে এসেছে মহাভারতের নতুন রূপ। প্রকৃতির বুকে নিয়ে গিয়েছেন মগ্ন এক নাট্য আয়োজনকে, নাট্যশিক্ষা প্রসারের জন্য আয়োজন করেছেন লোকনাট্যশিক্ষার থিয়েটার ট্যুরিজম। ভ্রমণ আর জীবনের রঙ্গমঞ্চকে মিলিয়ে দিয়েছেন এভাবেই । আসলে বেঁচে থাকা আর সৃষ্টিশীলতা তাঁর অভিধানে সম অর্থ বহন করে।

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher