বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী-প্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য পুরনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকার পাতায়।

 

[১৮৭২-এর ৯ সেপ্টেম্বর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জানকীনাথ ঘোষাল ও স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠ কন্যা সরলার জন্ম হয়। বেথুন স্কুল থেকে এনট্রান্স ও পরে বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে তিনি বি.এ. পাস করেন। ছোটবেলাতেই সাহিত্য ও সঙ্গীত সাধনায় হাতেখড়ি। বিদ্যালয়ে পাঠকালেই তাঁর রচনা 'সখা' ও 'বালক' পত্রিকায় প্রকাশিত হত। এর কিছু পরে 'ভারতী'-তে তাঁর রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। পরবর্তীতে তিনি 'ভারতী' পত্রিকা সম্পাদনাও করেন দীর্ঘকাল। ১৯০৪ সালে সরলা দেবী বাংলার নানা জায়গায় "বীরাষ্টমী ব্রত" চালু করেন। সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতালাভের প্রচেষ্টার অনুগামীদের অন্যতম প্রেরণাস্থল ছিল বীরাষ্টমী উৎসব। স্বদেশি দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহার প্রচার উদ্দেশ্যে তিনি এই সময় 'লক্ষীর ভাণ্ডার' নামে একটি প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন।
"বন্দেমাতরম" সংগীতের প্রথম দুই পদে সুর-সংযোজনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বাকী কথাগুলিতে সুর বসিয়েছিলেন সরলা দেবী। ১৯০৫-এ বারাণসীতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে "বন্দেমাতরম" গেয়ে আলোড়ন ফেলেন তিনি। তাঁর রচিত সঙ্গীতগুলি 'শতগান' (১৯০০) ও 'গীত-ত্রিংশতি' (১৯৪৫) বইতে সংকলিত হয়। বাড়ির অমত সত্ত্বেও অল্প কিছুদিনের জন্য সরলা দেবী মহীশূরের মহারানী স্কুলের শিক্ষিকার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯০৫-এই পঞ্জাবের বিখ্যাত আইনজ্ঞ, জাতীয়তাবাদী নেতা ও সমাজ সংস্কারক পণ্ডিত রামভূজ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি ১৯০৭-এ লাহোর থেকে 'হিন্দুস্থান' নামে একটি উর্দু সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পাঞ্জাবে বসবাসকালে স্বাদেশিকতা প্রচার ও সমাজসেবার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারেও তিনি বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯১০-এ এলাহাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সরলা দেবী একটি নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনের উদ্যোগেই সুপ্রসিদ্ধ "ভারত-স্ত্রী মহামণ্ডল" প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯১৯ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত রামভূজ জেলেই অসুস্থ হয়ে মারা যান ১৯২৩ সালে। স্বামীর মৃত্যুর পর সরলা দেবী কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৩০ সালে বয়স্কা মহিলাদের প্রবেশিকা অবধি শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন "ভারত-স্ত্রী-শিক্ষাসদন"।
১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট কলকাতায় এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু ঘটে। তাঁর আত্মজীবনী 'জীবনের ঝরাপাতা' (১৯৪৫) বাংলা স্মৃতি-সাহিত্যে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ১২৯৮ থেকে ১৩৩৯ এই চার দশক ধরে সরলা দেবী ভারতী, ভারতবর্ষ ইত্যাদি পত্রিকায় ভ্রমণ কাহিনি লিখতেন। লেখার প্রতি ছত্রে তাঁর রসবোধ পাঠককে মুগ্ধ করে।

অশ্বপৃষ্ঠে

সরলা দেবী চৌধুরাণী


দার্জ্জিলিঙ থেকে রঙ্গিৎ যাবার অভিপ্রায়, তিনজনের তিনটী ঘোড়ার আবশ্যক। এখন ঘোড়া পাওয়া যায় কোথায়? – সেইটেই কিছু সমস্যা। সায়েব বাড়ীর কথাটা একবার বিচারে আনা গিয়েছিল, কিন্তু মনের সে আর্জিটি বেশী দূর পেশ হতে না হতেই তাকে চট্‌পট্‌ ডিস্‌মিস করে দেওয়া গেল; - সায়েব বাড়ির ঘোড়ায় আমাদের পোষাবেনা। মূল্য বাহুল্যের জন্যে? ছোঃ – সে কথা যেন স্বপ্নেও কারো মনে না হয়, - ইতর পয়সার জন্যে কি আমরা কেয়ার করি? কিন্তু দেশানুরাগ তখন আমাদের মনে বড় প্রবল হয়ে উঠেছিল, তাই ঠিক করা গেল সাহেবকে টাকা দিয়ে দিশী লোককে বঞ্চিত করা হবে না।
যাব আমরা তিনটী; সে তিন জনের পরস্পরের সম্বন্ধ ব্যক্ত করা অনাবশ্যক, শুধু বয়সের তারতম্যানুসারে বলা যাক্‌ একজন আমার বয়োজ্যেষ্ঠ, একজন বয়ঃকনিষ্ঠ ও আমি স্বয়ং। আমাদের দলের আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা এবিষয়ে বড় গা কর্‌তেন না, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বা আগের বছর রঙ্গিৎ ঘুরে এসেছেন, কারো বা অতখানি সখ নেই, কিম্বা থাক্‌লেও তার খাতিরে অতখানি শক্তিক্ষয়ের প্রবৃত্তি নেই। তাই তাঁহাদের সহানুভূতির উত্তাপের কোলে আমাদের শিশুসংকল্পটি লালিত হয়নি। একেত পয়সার খাঁকতি – থুড়ি! দেশানুরাগ! তার উপর আবার দলের উৎসাহের অভাব – নিতান্ত প্রতিকূল অবস্থায় আমাদের সংকল্প মানুষ হতে লাগল। শ্রীমান মৎকনিষ্ঠ প্রতিদিন একবার করে দার্জ্জিলিঙ সহরের অলিগলি ঘুরে আসেন কোথাও যদি কোন খোট্টা ঘোড়াওয়ালাকে আমাদের দেশানুরাগের পাত্র হতে সম্মত করে আস্‌তে পারেন; কিন্তু তাঁর সাধুসংকল্পে অকৃতকার্য্য হয়ে প্রতি সন্ধ্যায় নিরাশ হৃদয়ে বাড়ী ফিরে আসেন।
শ্রীযুৎ মদগ্রজ, - সদানন্দ ইতি প্রসিদ্ধ – একরকম উদাসভাবে বাড়ীতে বসে কাল কাটান, যেন সব ফাঁকা ফাঁকা, কি যেন চান, কি যেন পাননা, যেন তারিণী বামুনের রান্না মুখে আর রোচে না, যেন গফুরের হাতের গরম কাট্‌লেট অনেককাল আস্বাদন হয়নি – যেন রঙ্গিৎ বড় বহুদূরে, নিতান্ত আয়ত্তের বাইরে। শর্ম্মা কিঞ্চিৎ সংযত আগ্রহের সঙ্গে শ্রীমানের পথ চেয়ে বসে থাকেন। এইরকম ত আমাদের তিনজনের অবস্থা, এমন সময় একদিন সন্ধ্যেবেলায় তাঁর নিত্যপর্য্যটন থেকে ফিরে এসে ভায়া বললেন, "ঘোড়া যোগাড় করে এসেছি, তিনটে ঘোড়া একদিনের জন্যে বার টাকায় রফা হয়েছে; কাল ভোরে আস্‌বে, আজ রাত্তিরেই সব গুছিয়ে গাছিয়ে রাখ।" আমাদের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। একেত ভায়ার যোগাড়, তার উপর বার টাকার রফা! অসম্ভব সস্তা – আমরা সকলে হেসেই উড়িয়ে দিলুম – "তোর কথায় অমনি ঘোড়া এল, নিশ্চয় তোর সঙ্গে ঠাট্টা করেছে। সে বারম্বার আমাদের আশ্বস্ত কর্ত্তে লাগল, তখন কতক বিশ্বস্ত কতক সন্দিহান চিত্তে যাত্রার আয়োজনে মনোনিবেশ করা গেল। আমাদের এসম্বন্ধীয় আশা নিরাশা, সুখদুঃখ কিন্তু দলের অন্যান্য লোকদের স্পর্শও করেনা, তাঁরা আমাদের চাঞ্চল্যে তিলমাত্র বিচলিত না হয়ে সমান অবিশ্বাস ও সমান ঔদাস্যের সঙ্গে প্লেটের উপর হোসেঙ্গি কাবাবের সাতটি করে কাটি একে একে নিঃশেষিত মাংস করলেন। উৎসাহে আগ্রহে আমাদের সে রাত্রি প্রায় অনশনে কাট্‌ল। তার পরদিন ভোরে আমরা বিছানা থেকে উঠ্‌বার আগেই বাইরে অল্প সোরসরাব পড়ে গেল। চাকররা এ ওকে জাগায়, সে তাকে ডাকে। একজন দরজা খুলে ঘরে এসে আমাদের জাগিয়ে দিয়ে বল্লে, "বাবুরা উঠুন, ঘোড়া এসেছে।" তখনও বাবুদের ভালরকম চেতনা হয়নি, তখনও চোখে নিদ্রা এবং মনে বিস্মৃতি আছে, কিন্তু যেমন উচ্চারণ হল "ঘোড়া এসেছে," অমনি সে বৈদ্যুতী প্রভাবে বাবুদের সুপ্তস্নায়ু সব সজাগ হয়ে উঠ্‌ল, বাবুরা তড়াক্ করে বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে সাজসজ্জা কর্ত্তে লাগ্‌লেন। বাইরে আসা গেল। অল্প অল্প আলোতে জিনশুদ্ধ তিনটী ঘোড়া দেখ্‌তে পেলুম, একটী লাল ও দুটী সাদা; সইসরা লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে, লাগামের লোহার টুক্‌রো দাঁতের মধ্যে করে ঘোড়ারা শব্দ কর্‌ছে, আর মধ্যে মধ্যে পাথরে খুর ঠোকারও শব্দ হচ্ছে। সেদিন ভোরের বেলায় পাহাড়ের উপর এই দুটী শব্দ আমাদের কানে যে কত মধুর লেগেছিল তা আর কি বল্‌ব। আর একটু ফরসা হয়ে এলে ঘোড়ায় চড়্‌বার উপক্রম করা গেল। সে উপক্রমণিকা কিছু সময়সাপেক্ষ, এবং তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আবশ্যক। আমাদের মধ্যে অশ্বারোহণে আমিই যৎকিঞ্চিৎ পারদর্শী, ভায়াও মন্দ নন, কিন্তু শ্রীযুৎ সদানন্দ সম্বন্ধে ও বিশেষণটা সুপ্রযুক্ত হয় না। হপ্তাতিনেক পূর্ব্বে আমাদের একবার সিঞ্চল প্রয়াণের প্রস্তাব হয়, তখন তিনি কি যান অবলম্বনে সেখানে যাত্রা কর্‌বেন সে বিষয়ে অনেক আলোচনা উপস্থিত হয়। তিনি লম্বায় সাড়ে চার হাত, আর ওজনে আড়াই মন; তাঁর বিপুল আঁটসাঁট দেহটীর পক্ষে দাণ্ডি নিতান্ত অল্পপরিসর। তা না হলেও তিনি দাণ্ডি চড়্‌তে নারাজ, কেননা সংস্কার আছে রোগী ছাড়া আর কোন পুরুষের দাণ্ডিওয়ালার কাঁধে চাপাটা নিতান্ত লজ্জাকর দৃশ্য, আর তাঁর মতন জোয়ানকে রোগী বলে চালান করাও কিছু শক্ত – কিছু, কিঞ্চিৎ। এদিকে পাহাড়ী ঘোড়াতেও হয়ত তাঁকে মানাবে না, সম্ভবতঃ তাঁর সবুট পদদ্বয় জননী ধরণীকে স্পর্শ করে থাক্‌বে। যদি বা বড় ঘোড়া পাওয়া যায় তাহলেও বিপদ, কেননা অশ্বারোহণে তিনি ষোল আনা অনভ্যস্ত এবং বার আনা অসম্মত। অবশেষে হেঁটে পাড়ি দেওয়াই তাঁর মত হল। তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে এসংকল্প থেকে নিবৃত্ত করবার বিশেষ চেষ্টা কর্‌লে। শেষকালে এই সাব্যস্ত হল যে তাঁর জন্যেও একটা ঘোড়া অর্ডার দেওয়া যাক, কপাল ঠুকে তিনিত চড়ে বস্‌বেন তারপর যা থাকে বিধাতার মনে। তার পরদিন ঘোড়া এল, আর সবাই চড়্‌লে, তিনি কিছুতেই আমাদের সুমুখে চড়্‌তে রাজী নন। আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে অপেক্ষা কর্ত্তে লাগ্‌লুম, তাঁর ঘোড়ায় চড়ার বিষম চেষ্টা চল্‌তে লাগ্‌ল। অনেকক্ষণ বাদে খবর পাওয়া গেল তিনি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছেন, তখন আমরা স্ব স্ব অশ্ব ছুটিয়ে দিলুম।

আমি বোধ হয় সবচেয়ে এগিয়ে ছিলুম, একবার পিছনে চেয়ে দেখি আমাদের দলের আর কাউকে দেখ্‌তে পাচ্ছিনে। ঠিক পথে যাচ্ছি কি না একটু সন্দেহ হওয়াতে রাশ টেনে নিয়ে অন্যদের প্রতীক্ষা কর্ত্তে লাগ্‌লুম। খানিক পরে দেখি অদূরে একজন অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে আস্‌ছে। আমি ঠাওরালুম মৎকনিষ্ঠ; তার পিছনে দ্বিতীয় ঘোড়া না দেখে নিঃসন্দেহে স্থির কর্‌লুম, শ্রীসদানন্দ তবে সওয়ার হয়ে আর বেশীদূর অগ্রসর হননি, বাড়ীর উঠোনেই বোধ হয় দুচার কদম চলেই ঘোড়সওয়ারের স্বাদটা মেরে নিয়েছেন, আর বেশীর জন্যে লালায়িত হননি। মনে মনে বিলক্ষণ আমোদ অনুভব করা গেল, এবং বাড়ী গিয়ে তাঁকে এ বিষয়ে যৎপরোনাস্তি পীড়ন করে আরো আমোদের আশা রাখলুম। দেখ্‌তে দেখ্‌তে উক্ত অশ্বারোহী আমার নিকটবর্ত্তী হলেন। গুঁতো, কিল, লাথি এবং উৎসাহবর্দ্ধক নানারূপ শব্দ ঘোড়ার উপর অজস্রধারে প্রয়োগ কর্ত্তে কর্ত্তে, আমার প্রতি দৃক্‌পাত মাত্র না করে তিনি আমায় ছাড়িয়ে চলে গেলেন। বিস্ময়ের উপর বিস্ময়! সেই কিললাথিবর্ষী নির্ভীক অশ্বারোহী পুরুষ আর কেউ নয় – শ্রীযুক্ত সদানন্দ দেবশর্ম্মা! তারপর তাঁকে ধরে ওঠা আমার প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠ্‌ল, এমনি সবেগে, সাবেগে তিনি ঠাণ্ডা পাহাড়ী টাট্যু ছুটিয়ে চলেছেন। সেদিন বাড়ী ফিরে এসে তাঁর উৎসাহের সীমা নেই। ঘোড়ায় চড়া এমন সহজ! তিনি রোজ একটা করে ঘোড়া ভাড়া করে সমস্ত দার্জ্জিলিং পর্য্যটন করে বেড়াবেন। কিন্তু তার পরদিন সকালবেলায় গায়ের ব্যথায় যখন বিছানা থেকে উঠ্‌তে পারেন না, তখন তাঁর উৎসাহ আঠার আনা নিবে গেল। আর অনেক কাল ধরে ঘোড়ায় চড়ার নাম করেননি। কিন্তু তারপর যখন ক্রমে গায়ে ব্যথা মরে এল, তার স্মৃতিও মরে এল, এবং পুনর্ব্বার অশ্বারোহণের দুঃসাহস মনে প্রবল হয়ে উঠ্‌তে লাগ্‌ল। লাথি গুঁতো ও তালুতে জিহবার সংস্পর্শজাত বিবিধ শব্দের জোরে তিনি ফের অশ্বারোহণের ভরসা রেখেছিলেন, কিন্তু তার উপক্রমণিকার পালাটা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন। পাহাড়ী ঘোড়ায় একবার উঠেপড়ে, জিনের সঙ্গে সম্বন্ধ হয়ে টাট্যুটির শান্তপ্রকৃতিতে বিশ্বাস জন্মে গেলে আর ভয় নেই, কিন্তু সেই ওঠার, সেই প্রথম আত্মসমর্পনের পর্ব্বটাই গোলযোগে। বুঝি বা এতদিনের বড় যত্নের আশা স্ফুটোন্মুখে বিসর্জ্জন দিতে হয়, রঙ্গিৎ দেখার সাধ নিতান্তই বিলোপ কর্ত্তে হয়। তাঁর পূর্ব্বের নৈরাশ্য, পূর্ব্বের ভয়, পূর্ব্বের দ্বিধা, সব ফিরে এল। এক একবার রেকাবে পা অগ্রসর করেন, আবার নামিয়ে নেন; একবার ঘোড়ার ডাইনে যান, একবার বাঁয়ে আসেন, কোনদিক থেকেই কিছু সুবিধা করে উঠ্‌তে পারেন না,- বিভীষিকা দুধারেই সমান ওজনের। প্রায় আধঘন্টাটাক এই রকমে কেটে গেল, ক্রমে রোদ উঠ্‌বার উপক্রম হল, আমরা অস্থির হয়ে উঠ্‌লুম, অবশেষে অনেক কষ্টে অনেক সাধ্যসাধ্যনায়, অনেক অনুনয়বিনয়ে, অনেক উত্তেজনাতাড়নায় তিনি বুকে খুব খানিকটা সাহস বেঁধে ফস্ করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বস্‌লেন। ইতিমধ্যে আমাদের দলের সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই দর্শকবৃন্দের মুগ্ধদৃষ্টি পশ্চাতে রেখে আমরা তিনটী অশ্বারোহীপ্রবর যাত্রা কর্‌লুম।
তখনও রাস্তায় বেশী লোকের আবির্ভাব হয়নি। কেবল দুটী একটী ইংরেজ আকন্ঠ বিপুল আল্‌ষ্টারবৃত হয়ে ঊষাভ্রমণে বেরিয়েছে। মল্‌রোড জনশূন্য। সেই প্রশস্ত পার্ব্বত্যপ্রাঙ্গণ অল্পক্ষণের জন্য ছুটী পেয়েছে, স্তরন্যস্ত অভ্রভেদী পর্ব্বতমালা সম্মুখে রেখে, ক্ষণকালের জন্যে নিজের নিস্তব্ধ হৃদয়ের গভীরতায় সে নিমগ্ন হয়ে রয়েছে, স্নিগ্ধশীতল প্রাতঃসমীরণ তাকে সস্নেহে বীজন কর্‌ছে। আমরা ভুটিয়াবস্তির রাস্তা ধরে চলতে লাগ্‌লুম। সেদিন প্রভাতে যাত্রারম্ভে আমাদের মনে কত আনন্দ, শিশুর মত পথে যা দেখ্‌ছি তাই ভাল লাগ্‌ছে। যখন অল্প অল্প অন্ধকারে বড় বড় গাছের তলা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি, তখন সেই অন্ধকার, সেই গাঢ় ছায়াই আনন্দে মায়ায় মনকে সিক্ত কর্‌ছে – যেন এখানেই আমাদের খেলাঘর, যেন সত্যিই আমরা শিশু। যখন অল্পে অল্পে অন্ধকার দূর হয়ে আলোর উন্মেষ হচ্ছে সে আলোও কত বিস্ময় আন্‌ছে, তার মৃদু উত্তাপে শরীরে কেমন স্নিগ্ধতা সঞ্চারণ কর্‌ছে। সেদিন মনে হতে লাগ্‌ল আমরা রোজ কেন ভোরে উঠিনে, ভোরের এত উপভোগ্য সামগ্রী হেলায় হারাই কেন।
খানিকটা পথ অগ্রসর হয়ে একজন ভুটিয়া গোয়ালার সঙ্গে দেখা হল। সে যেন সেই পাহাড়ের প্রত্যুষের একটা অঙ্গ। যেদিন সিঞ্চল গিয়েছিলুম সেদিনও দেখেছিলুম, ভুটিয়া গোয়ালারা সূর্য্যোদয়ের আগেই সর্ব্বোচ্চ শিখরে যেখানে অনেকটা প্রশস্ত সমতল ভূমি আছে সেখানে গরুদের চরাতে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের শুভ্রমুখ আর প্রত্যূষের তীক্ষ্ণ শীতনিবারণোপযোগী গায়ের কাপড়ে যেন তাদের শুভ্র, তীক্ষ্ণ শীতল ঊষারই একটা অংশ বলে বোধ হয়। গোয়ালা তার বাঁশের নল থেকে আমাদের দুধ ঢেলে দিলে, আমরা বাস্কেট থেকে গেলাস বের করে সেই কাঁচাদুধ নিয়ে খেলুম। বেশ স্বাদ! পথে নগদা পয়সা দিয়ে নিজের হাতে দুধ কেনা! কেমন রোম্যান্টিক! বাড়ী গিয়ে কেমন গল্প করা যাবে! এই আমাদের প্রথম ঘটনা।
তারপরে আমরা মাইলষ্টোন দেখে দেখে চল্‌তে লাগ্‌লুম। পাহাড়ের গায়ে কোন অদৃষ্টপূর্ব্ব ফুল দেখ্‌লেই তুলি, কোথাও বা ছাতা বাড়িয়ে লতা টেনে আনি, কোথাও শৈবাল জড় করি, কোথাও ফার্ণ, কোথাও স্ট্রবেরি এই রকম করে করে আমরা অগ্রসর হতে লাগ্‌লুম। একটা খোলা জায়গায় এসে পড়্‌লে সূর্য্যটা যখন হঠাৎ ঠিক কপালের উপর কিরণ বর্ষণ কর্ত্তে লাগ্‌ল, আর তার তাপটা কিছু বেশী প্রখর বোধ হতে লাগ্‌ল, তখন যেন একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করা গেল। কিন্তু সেদিন – কিম্বা একটু সঠিক করে বল্‌তে গেলে, সেবেলা – আমাদের দুনিয়ার কিছুরই উপর অসন্তোষ নেই, তাই সূর্য্যের অত্যাচার বেশ ধৈর্য্যের সঙ্গে সহ্য করা গেল। ক্রমে বেলা বাড়্‌তে লাগ্‌ল, ক্ষুধার উদ্রেক হতে লাগ্‌ল, কিন্তু আমরা ঠিক করলুম রঙ্গিৎ না পৌঁছিয়ে মহাপ্রাণীকে তুষ্ট করা হবে না, পথে খেলে আর্দ্ধেক মজাই মাটী।
দার্জ্জিলিঙ সাত হাজার ফিট উঁচু, আর রঙ্গিৎ মোটে হাজার ফিট – এই ছ হাজার ফিট আমাদের নামতে হবে – আর এই উৎরাইটা ১১ মাইলের পথ। এখানে ঘোড়া ছোটাবারও যো নেই তা হ'লে ঠোকর খেয়ে ঘোড়া ও আরোহী দুজনেই পড়ে যাবে, - তাই আস্তে আস্তে যেতে হ'চ্ছিল। ফেরবার সময় চড়াই হবে তখন ঘোড়া ছুটিয়ে সময় সংক্ষেপ করা যাবে স্থির ছিল। এদিকে রোদ্দুরে এতটা পথ হাঁট্‌তে হাঁট্‌তে ঘোড়ারাও পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছে, বিশেষতঃ আমার বয়োজ্যেষ্ঠের অশ্বটী। যদিও তিনি তাঁর ঘোড়াকে বাঁচাবার জন্যে এক ফন্দি বের করেছিলেন। একটা ঘোড়া ক্রমান্বয়ে ১১ মাইল ধরে তাঁকে বহন কর্‌লে ফির্‌তি বেলায় নিতান্ত অসমর্থ হয়ে পড়্‌বে বলে তিনি ঠিক করেছিলেন মাঝে মাঝে ভায়ার সঙ্গে ঘোড়া বদ্‌লাবেন। তা হলে দুটোর মধ্যে পরিশ্রম ভাগাভাগি হলে কারোই তেমন বেশী কষ্ট হবে না কিন্তু এতে যে হিতে বিপরীত হবে তা কে জান্‌ত। যা হোক সে কথা পরে বল্‌ব। - তাই রাস্তার মাঝে থেকে থেকে তিনি তাঁর ঘোড়া থেকে অবতীর্ণ হয়ে ভায়ার ঘোড়ায় চড়েন এবং ভায়া তাঁর খিন্ন ঘোড়াটির ভারলাঘব করেন। গরমে ঘোড়াদের পিপাসা অত্যন্ত বৃদ্ধি হয়েছে, এখন থেকে পথে ঝরণা পেলেই তারা আপনা হতে আরোহীকে সেই দিকে নিয়ে গিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে ঝরণায় মুখ দিয়ে জল খায়।

নীচে নাম্‌তে নাম্‌তে ক্রমে অনেক চা ক্ষেত দেখা দিলে, বহুসংখ্যক কুলি ক্ষেতে কাজ কর্‌ছে – অধিকাংশই মেয়ে – আর একটা মস্ত শোলাহ্যাট পরা ঘোড়ায় চড়া সাহেব ছড়ি হাতে তাদের তদারক কর্‌ছে। সাহেবের বাঙ্গলা কাছেই, আমরা তার গা দিয়ে গেলুম। আমরা যত নীচে নাব্‌ছি ততই গরম বাড়্‌ছে, গাছ পালাও ক্রমে বদ্‌লাচ্ছে। দার্জ্জিলিঙের শীতে যে সব ফল মূল জন্মাতে পারে না, এখানে তার চাষ হয়। প্রথমেই আমরা কলাগাছ লক্ষ্য কর্‌লুম, কেমন স্নিগ্ধ সবুজ রঙ, অনেককালের পর একে দৃষ্টিগোচর করে বেশ মিঠে লাগল। আরও নীচের উপত্যকা থেকে অনেকরকম শাকশবজি, ধান চাল সব দার্জ্জিলিঙের হাটে বিক্রির জন্যে আস্‌ছে। তদুপযোগী ঘোড়ার উপর বস্তা চাপিয়ে বিক্রেতারা ক্রমাগত আনাগোনা কর্‌ছে। আমরা চলেছি – পথশেষ হবার কোন লক্ষণ নেই, আমাদের যেন সে প্রত্যাশাও নেই। সত্যিই যে একসময় পথ ফুরোবে, আমরা একটা গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছব, পথ চল্‌তে চল্‌তে এটা যেন সম্পূর্ণ ধারণা হয় না। হঠাৎ এক জায়গায় একটা ভয়ঙ্কর গর্জ্জন কানে এল – যেন দশ বারটা ট্রেন একত্রে সোঁ সোঁ করে ছুটেছে। আমরা ভারি বিস্মিত হয়ে গেলুম, এখানে ট্রেন কি করে এল? আমরা কি একেবারে সিলিগুড়িতে এসে পৌঁছেচি? সইসদের কাছে শুনলুম তা নয় – ও রঙ্গিতের শব্দ। রঙ্গিতের শব্দ! পাহাড়ে নদী যে কেমন তা আগে জান্‌তুম না, তাই নদীর ও রকম গর্জ্জন শুনে ভারি অদ্ভুত ঠেকল। প্রথমটা সইসটার কথায় পুরো বিশ্বাস হল না, কিন্তু যখন একটা গাছের ফাঁকে একবার রঙ্গীতের ক্ষীণ শুভ্ররেখা দেখতে পেলুম, আর শব্দের দিকও সেই দিকেই নির্দ্ধারণ কর্‌লুম তখন আর সন্দেহ রইল না। তখন আমাদের ভারি উৎসাহ হল। বাঁকে বাঁকে কখন সেই রেখাটি দেখ্‌তে পাব তার জন্যে ভয়ানক আগ্রহান্বিত হয়ে উঠ্‌লুম। ইতিমধ্যে সেই তন্বী রেখাটির কল্লোলধ্বনি, তার গম্ভীর নির্ঘোষ আমাদের মন অধিকার কর্ত্তে লাগ্‌ল। যেমন যুদ্ধঘোটক দূর থেকে রণবৃংহিতি শুনে সেই দিকে কাণ পেতে চঞ্চল হয়ে উঠে, তার সমস্ত স্নায়ু তাকে সেই দিকে প্রধাবনে উন্মুখ করে আমাদেরও মন সেই রকম হতে লাগল। মনে হল যেন রঙ্গিৎ আমাদের ডাক্‌ছে, আমরা তাকে দেখ্‌বার জন্যে যেমন অস্থির হয়েছিলুম, সেও আমাদের পাবার জন্যে তেমনি ব্যগ্র হয়েছে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দেখ্‌তে পেলেই তরঙ্গবাহু তুলে বল্‌ছে "আয়! আয়! আয়! ওরে কাছে আয়, চলে আয়, ছুটে আয়।" আমরা বড় বিস্মিত হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে তার আহবান শুন্‌তে লাগ্‌লুম। তার গুরুনাদে প্রাণ আকৃষ্ট হল অথচ একটা অজানিত ভয়ে যেন স্তম্ভিতও হল! কিন্তু সে উন্মাদ আহবানের আকর্ষণী শক্তি আর সব রকম ভাবকে ছাড়িয়ে উঠ্‌ল, আমরাও উন্মাদ আগ্রহে, উন্মাদ আনন্দে অগ্রসর হতে লাগ্‌লুম। কতদূর থেকে তার আহবান শুনতে পেয়ে ছিলুম, কিন্তু তার কাছে – একেবারে নদী কিনারায় পৌঁছতে কত বিলম্ব হল। সে ক্ষীণ রেখে ক্রমে প্রশস্ত হতে লাগ্‌ল, কিন্তু তখনও যেন মাটীর উপর হাত দুই তিন চওড়া খানিকটা পারা ভাস্‌ছে, ক্রমে আরও প্রশস্ত ও স্পষ্টতর হল, ক্রমে খুব ভাল করে দেখা গেল, ক্রমে সবটা দেখা গেল তবু তার ধারে গিয়ে পৌঁছতে পাচ্ছিনে, পথ যেন দ্রৌপদীর বস্ত্রের মত ক্রমাগতই বেড়ে যাচ্ছে।
যাহোক্‌ সে বস্ত্রের শেষ না থাক্‌ পথের শেষ ক্রমে দেখা গেল, আমাদের ঈপ্সিত লাভ হল, রঙ্গিতের তীরে এসে দাঁড়ালুম, - সে যে ছবি চোখের সুমুখে খুলে গেল। দেখলুম রাশি রাশি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ডের উপর দিয়ে তরঙ্গিনী ফেনিয়ে ফুঁসিয়ে লাফিয়ে গর্জ্জিয়ে চলেছে। প্রস্তর রাশি মূক প্রহরীর মত তার পথ রোধ করে রয়েছে। সুন্দরী অভিমানিনীর কত আঘাত, কত লাঞ্ছনা, কত তিরস্কার, - সব তারা ঘাড় পেতে সয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তবু কর্ত্তব্যে অটল, - এতটুকু স্থানভ্রষ্ট হচ্ছে না, তরঙ্গিনী মহা রাগভরে তাদের মাথার উপর দিয়ে লাফিয়ে ছিটকিয়ে বেরিয়ে পড়্‌ছে।
এও নদী, গঙ্গাও নদী, কিন্তু দুয়ে কত প্রভেদ – গঙ্গা যেমন প্রৌঢ়া শান্তি, এ যেন শুধু তরুণ ঝাঁঝ, কেবলি ঝাঁঝ। এই জলপ্রবাহের তীরে দাঁড়িয়ে কে বল্‌তে সাহস কর্‌বে এ শুধু জড় অচেতন পদার্থমাত্র, এর প্রাণ নেই, চেতনা নেই, আত্মা নাই। যে চেতনা যে আবেগ, যে অভিমান এই দুটো বাষ্প মিশ্রণের প্রতি কণা বিদীর্ণ করে প্রকাশিত হচ্ছে পঞ্চভূতের সমষ্টিতে তার তুলনা কোথায়? এই যে ফেণকুণ্ডলা, ভীষণ নির্ঘোষময়ী কুপিতা সুন্দরী তটিনী এর তুল্য প্রাণময়ী কোন মানবীকে দেখা গেছে? যে মৌন পাষাণখণ্ড তার বিশাল বক্ষের উপর কল্লোলিনীর সমস্ত অত্যাচার অবিকৃত ধৈর্য্যের সঙ্গে বহন কর্‌ছে তার ভিতরেও চৈতন্যের প্রচ্ছন্ন সঞ্চার কে না উপলব্ধি কর্‌বে? আমরা পুলকিতহৃদয়ে, অনন্যমনে এই দৃশ্য দেখ্‌তে লাগ্‌লুম।

আমরা প্রথমে মন্দ গতিতে পরে ক্রমশঃ গতি বাড়িয়ে আলো ও ছায়ার ভিতর দিয়ে চল্‌তে লাগলুম! তখনও রোদ পড়েনি, কিন্তু রোদের প্রখরতাও তেমন নেই। ঘোড়া ছোটাতে সইসরা পিছনে পড়ে গেল, আমরা তাদের জন্যে অপেক্ষা না করে মাইল ষ্টোন অনুসরণ করে চলতে লাগলুম। কিন্তু এ বেলা যেন এক একটা মাইলকে ওবেলার চেয়ে ঢের বেশী লম্বা মনে হতে লাগ্‌ল – প্রায় আধঘন্টায় একটি করে মাইল অতিক্রম কর্ত্তে লাগ্‌লুম – তাহলে এগার মাইল কতক্ষণে পৌঁছব, তাছাড়া মল্‌রোড থেকে আমাদের বাড়ী পর্য্যন্তও প্রায় আর দেড় মাইল হবে! সূর্য্য দেখ্‌তে দেখ্‌তে অস্তে গেল, চা-ক্ষেতের সাহেব কুলিদের ছুটি দিয়ে বাড়ীমুখো ফির্‌লে, পাল পাল বস্তার ঘোড়া আমাদের পথ রোধ কর্ত্তে লাগ্‌ল, - তাদের মালিকরা সঙ্গে সঙ্গেই আছে। একজায়গায় একজন যুবক টী প্ল্যান্টার আমাদের পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, তার দুটী ছোট ছোট কুকুর তার সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে চলেছে। একটা বাঁক ফিরতে কুকুরদুটী অনেকগুল বস্তার ঘোড়ার মাঝে পড়ে গেল, যে দিকে যাবে সেই দিকেই ঘোড়ার পায়ে মাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা, প্ল্যান্টার তার নিজের ঘোড়া থেকে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে একটা কুকুরকে কোলে তুলে নিলে, অন্যটাকে উঠাতে পার্‌লেনা। ঘোড়ার হিন্দুস্থানী মালিককে হিন্দিতে নরম কথায় কুকুরটাকে তার কোলের উপর উঠিয়ে দিতে বল্লে। মেড়ুয়াবাদীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই। আমার এমন রাগ ধর্‌ল, ছোট কুকুরটী অতগুল ঘোড়ার পায়ের মধ্যে পড়ে ভয়েই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, কোন্‌দিকে নড়্‌বে কি কর্‌বে ভেবে পাচ্ছেনা, তার বিপদও সমূহ, আর কাটখোট্টা মানুষটা দিব্যি নিশ্চিন্তভাবে তাই দেখ্‌ছে, একটু হাত বাড়িয়ে কুকুরটাকে প্ল্যান্টারের কোলে তুলে দেবে তা না। আমি তার ব্যবহার দেখে কিছু রূঢ়ভাষায় তাকে সাহেবের কুকুর বাঁচাতে বল্লুম, তখন সে শুনলে। প্ল্যান্টার ত আমার প্রতি ভারি কৃতজ্ঞ, আমি ঘোড়াওয়ালাকে আমার বক্তব্য বলে এবং সেটা পালন হচ্ছে দেখেই ভিড়ের মধ্যে থেকে নিজের ঘোড়া বের করে নিয়ে, খোলা জায়গায় খানিকটা ছুটিয়ে নিয়ে গিয়েছিলুম। খানিক পরে দেখি প্ল্যান্টার তার ঘোড়া ছুটিয়ে আমাকে ধর্‌বার চেষ্টা কর্‌ছে, আমার কাছে এসে নিতান্ত মিষ্ট ভাষায় তার কৃতজ্ঞতা জানালে – আমিই তার কুকুরকে বাঁচিয়েছি – ইত্যাদি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এত সামান্য কাজের জন্যে এত ধন্যবাদ পেয়ে আমি নিতান্ত অপ্রতিভ হয়ে তার নগণ্যতার সাপক্ষে দু এক কথা বল্‌তে চেষ্টা কর্‌লুম। তার পরে তার সঙ্গে "Good bye" করে আমি অগ্রবর্ত্তী হলুম, সে তার বাঙ্গলাভিমুখে ঘোড়া ফেরালে।
এদিকে যে একটী বিষম গোলযোগ বেধেছে সে কথা এতক্ষণ বল্‌তে অবসর পাইনি। শ্রীযুক্ত সদানন্দের ঘোড়া আর চল্‌তে পারে না, প্রথমে তার পেটী ছিঁড়ে গেল, সেই প্ল্যান্টারের সাহায্যে তিনি সেটা কতকটা দোরস্ত করে নিলেন, কিন্তু তাঁর দেহভার বহন কর্ত্তে সে এখন আর নিতান্তই অক্ষম। তিনি আবার ভায়ার ঘোড়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে অদলবদলের চেষ্টায় ছিলেন, কিন্তু সে এবারে কিছুতেই রাজী হয় না – সে বলে "আস্‌বার সময় মাঝে মাঝে তোমাকে বওয়াতেই আমার ঘোড়া হয়রাণ হয়ে গেছে, এখন আবার তা কর্‌লে এও আর এক পা নড়্‌তে পার্‌বে না।" কাজে কাজেই তাঁকে নিজের ঘোড়ার উপরই সম্পূর্ণ নির্ভর কর্ত্তে হল। প্রথম মাইল দুই তিন আমরা ঘোড়া ছুটিয়ে ছিলুম, কিন্তু আর ছোটাতে পার্‌ছিনে, বেচারারা বড় শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আমি সবচেয়ে লঘুভার, তাই আমার ঘোড়ার অবস্থা তবু ভাল, কিন্তু তাহলেও রাস্তাটা আগাগোড়া চড়াই, তাই সে বেচারিও দু চার পা করে উঠেই ধুঁকে পড়্‌ছে, আমি তখন তাকে খানিকক্ষণ দাঁড় করিয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে, তার প্রতি অনুকম্পাসূচক দুটো মিষ্টি কথা বলে ফের অগ্রসর হচ্ছি। দু একবার এই রকম কর্‌বার পর আমার মাথায় হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল, আমার এই নিরীহ আচরণে প্রভু সদানন্দের ক্রোধবহ্নি হঠাৎ ভয়ানক প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠ্‌ল। তাঁর ঘোড়ার অবস্থা নিতান্ত করুণরসাত্মক, তারই উপর আবার তার প্রভুর কিলটা চাপড়টাও চল্‌ছে, কিন্তু তাতেও কিছু ফলোদয় হচ্ছে না – সদানন্দের মনের তখন নিতান্ত ঝালাপালা অবস্থা, সেই সময় ঘোড়ার সঙ্গে আমার মিষ্টালাপটা তাঁর কি রকম অসহ্য হয়ে উঠ্‌ল। কল্পনা কর একটা মুক্ত পার্ব্বত্য প্রান্তর, তার থাকে থাকে রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে, তারই একটীর উপর তিনটী বিদেশী বিপন্ন অশ্বারোহী যুবক, একজন মহাক্রুদ্ধ, একজন মহাহাস্যপরায়ণ আর একজন নির্ব্বিবাদী, নিশ্চেষ্ট। প্রভু যত আমার উপর রাগ করেন আমার হাসির লহরী তত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, আমি তাঁকে তত বোঝাতে চেষ্টা পাই আমি কি অপরাধটা কর্‌লুম? আমার ঘোড়াকে কেন আমি মায়া কর্‌ছি, তাকে কেন জিরোতে দিচ্ছি – সেইটেই আমার অপরাধ। কিন্তু আমার ঘোড়ার প্রতি অনুকম্পার সঙ্গে তাঁর ঘোড়ার চলৎশক্তিরহিত্ত্বের যে কোথায় যোগ আমি সেটা কিছুতেই ধর্ত্তে পার্‌লুম না। আমি দ্বিতীয় নম্বর অপরাধ এই করেছিলুম যে একটা খোট্টা ঘোড়াওয়ালার সঙ্গে পথে আলাপ পরিচয় কর্‌ছিলুম; সে কোথা থেকে আস্‌ছে, কদ্দুর যাবে, পাহাড়ে কবছর আছে, কিসের চাষ করে, কেমন পোষায়, এবম্বিধ অনেক প্রশ্ন কর্‌ছিলু্‌ম, এবং অবিশ্যি আমাদের সম্বন্ধে তারও কতক কতক কৌতুহল নিবৃত্ত কর্ত্তে হয়েছিল। মদগ্রজের বিশ্বাস সে লোকটা ঘোর মাতাল, আমরা কিন্তু তাতে মাতালের কোন লক্ষণ দেখ্‌তে পাইনি। আবার এক সময়ে হঠাৎ তাঁর মনে হল আমরা পথ হারিয়েছি, আস্‌বার সময় যে পথ দিয়ে এসেছিলুম এ সে পথ নয়। এ যে সেই পথ সে বিষয়ে আমার তিল মাত্র সন্দেহ ছিল না, তবু তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্যে রাস্তায় একজন ভুটিয়াকে দেখ্‌তে পেয়ে তাকে পথ জিজ্ঞাসা কর্‌লুম। সে জায়গাটাতে দুটো শাখা রাস্তা বেরিয়েছে, ভুটিয়া আমাদের দার্জ্জিলিংয়ের আসল রাস্তাটা দেখিয়ে দিলে। আমিও জান্‌তুম যে সেই আসল রাস্তা, - আমার পথের দৃশ্য বেশ মনে ছিল – কিন্তু সদানন্দ ঠাকুরের কিছুতেই ভুটিয়ার কথায় বিশ্বাস হয় না, তিনি আমাকে বল্‌তে লাগলেন " তোমার যেমন কাণ্ড, ওকে রাস্তা জিজ্ঞেস কর্ত্তে গেছ, ওরা সব চোর, ও নিশ্চয় একটা মন্দ রাস্তা বলে দিয়েছে, ওদের আড্ডায় নিয়ে গিয়ে, আমাদের মেরে ফেল্‌বার চেষ্টা।" তিনি কিছুতেই সে রাস্তায় যাবেন না। অথচ আমাদের দুজনের স্থির বিশ্বাস ঐটেই ঠিক রাস্তা, বরঞ্চ অন্য রাস্তায় গেলেই পথ হারাব, তাই ভুটিয়ানির্দ্দিষ্ট পথে যাওয়াই আমাদের দৃঢ়সংকল্প। শেষকালে তিনি কি করেন, আমাদের জেদ দেখে অগত্যা তাঁকে আমাদের সঙ্গ নিতে হল, কিন্তু বরাবর বল্‌তে বল্‌তে চল্‌লেন "কক্ষণো এ রাস্তা দিয়ে আমরা সকালে আসিনি, ও নিশ্চয় চোর, আমাদের ভুল রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে।"
ইতিমধ্যে চাঁদ উঠেছে, অত্যন্ত পরিষ্কার জ্যোৎস্না, কিন্তু কখন যে দিনের আলো চলে গেল, চাঁদের আলো তার স্থান নিলে আমরা কিছু জান্‌তে পারিনি, আমাদের বাইরের প্রকৃতির যে পরিবর্ত্তন হয়েছে তা অনুভব করিনি। জ্যোৎস্নায় সেই পার্ব্বত্য প্রকৃতির যে কেমন শোভা হয়েছিল তা দেখ্‌বার আমাদের তিলমাত্র অবকাশ ছিল না, সদানন্দের মেজাজ বিগ্‌ড়ে যাওয়াতে আমরা এমনি বিব্রত হয়ে ছিলুম। সেই সময়টা ভুটিয়াদের ঘরে ঘরে দশহারা উৎসব, তারা তখন ভয়ানক মাতাল হয়ে থাকে শোনা ছিল, তাই ভুটিয়া বস্তির নিকটবর্ত্তী হবার সময় সদানন্দের সশঙ্কিতাবস্থার কথা আর কহতব্য নয়। প্রত্যেক কুটীরটা অতিক্রম কর্‌ছেন আর মনে কর্‌ছেন একটা ফাঁড়া কাট্‌ল। হঠাৎ একটা বাড়ী থেকে একটা লম্বা, ঝোলা, কাল কাপড়পরা ভুটিয়া বেরিয়ে এল, মাটিতে তার ছায়া ভয়ানক দীর্ঘ দেখাতে লাগ্‌ল, সদানন্দ প্রতি মুহূর্তে মনে কর্ত্তে লাগ্‌লেন বুঝি আমাদের সর্ব্বস্ব অপহরণ করার জন্যে সে আমাদের গলায় কুক্‌রি বসিয়ে দেয়। তাঁর ভয় আমাদের মনেও কিছু সংক্রামক হল। কিন্তু সে ভুটিয়া নিঃশব্দে আমাদের প্রতি একদৃষ্টে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আমরাও নিঃশব্দে ধীরে ধীরে নিতান্ত স্বচ্ছন্দতার ভান করে ঘোড়া চালাতে লাগ্‌লুম। এবার দার্জ্জিলিঙের আলো দেখ্‌তে পাচ্ছি কিন্তু দার্জ্জিলিঙ এখনও দূরে। এদিকে মাইল কতক আগে সদানন্দের ঘোড়ার পেটি ফের ছিঁড়ে গেছে, তার পিঠে সাজ আর শক্ত করে বসান যায় না। ঘোড়া তাঁকে বহন না করে তাঁকে ঘোড়াকে বহন করে আন্‌তে হচ্ছে। হরি হরি, যে প্রভাতে রঙ্গিৎ যাত্রা করেছিলুম সে কি আজকেকারই প্রভাত! সে যেন কত দিনকার স্বপ্ন-কথার মত মনে হচ্ছে, - সে আনন্দ, আমাদের তিনটী সহযাত্রীর সে সদ্ভাব এখন কতদূরে। তাঁর ঘোড়া নিয়ে যত বেগ পেতে হচ্ছে, সদানন্দ আমাদের উপর ততই চট্‌ছেন, যেন আমাদের দোষেই তাঁকে এই বিপদগ্রস্ত হতে হয়েছে। তাঁর স্থায়ী অপ্রসন্নতায় শেষাশেষি আমারও হাস্যোচ্ছ্বাস বন্ধ হল, বাড়ী পৌঁছিয়ে এই অপ্রসন্ন খিটখিটে সঙ্গীটির সঙ্গ ঝেড়ে ফেল্‌বার জন্যে মন উচাটন হল। মলরোড পাওয়া গেল, হাঁফছেড়ে বাঁচ্‌লুম! তারপরে বাড়ী পৌঁছন আর বেশী ক্ষণের কথা নয়। আমরা ভোরের নিস্তব্ধতার মধ্যে গিয়েছিলুম, রাত্রের নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে ফিরে এলুম। ছটী শ্রান্ত পথক্লিষ্ট প্রাণী, - তিনটী মানুষ ও তিনটী অশ্ব, বাড়ীর উঠোনে এসে দাঁড়ালুম। আমাদের অন্যান্য সঙ্গীরা আমাদের ফির্‌তে এত বিলম্ব দেখে উৎকন্ঠিত চিত্তে আমাদের প্রতীক্ষা করে সকলেই দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের দর্শনপ্রাপ্তিমাত্রে সব ভাবনা দূর হল। আমরাও ঘোড়ার থেকে নেমে বাড়ীর চৌকাঠ ডিঙ্গোতেই যেন আমাদের সব পথশ্রম কেটে গেল, আর আমাদের পরস্পরের প্রতি মনের গ্লানিও এক নিঃশ্বাসে ছুটে গেল। তখন গল্প করার মহাধূম!
তার পরদিন ভোরে উঠে দেখি আমাদের দুটী সঙ্গী নিরুদ্দেশ – এঁরাই আমাদের রঙ্গিৎ যাওয়ার বিষয়ে বিশেষ নিরুৎসাহ করেছিলেন। সন্ধান নিয়ে জানলুম আমরা সকালে যাত্রা করা অবধি এঁদেরও যাবার ইচ্ছা এমন বলবতী হয়ে উঠেছিল যে সেই দিনের মধ্যেই বাহনের বন্দোবস্ত ঠিক করে, তারপর দিন ভোরে চুপি চুপি যাত্রা করেছেন। আমাদের লুকিয়ে যাওয়ার অর্থ আমাদের চমৎকৃত করা। এঁরা বাস্তবিক আমাদের হারিয়েছিলেন – রঙ্গিতে স্নান করেছিলেন। তাঁরা যখন ফিরে এসে সে গল্প কর্‌লেন তখন তাঁদের জান্‌তে দিলুম না যে আমরা সেটাকে বিশেষ একটা কিছু কীর্ত্তি মনে কর্‌ছি, কিন্তু মনে মনে দুঃখে অনুতাপে মরে রইলুম। কিন্তু সে শুধু আমরা দুটী – আমি ও কনিষ্ঠ। শ্রীশ্রীসদানন্দ মহাপ্রভুর তখন এসব সেন্টিমেন্টের অবসর ছিল না, তাঁকে তখন আর এক খবরে বিশেষ কাবু করেছে, - তাঁর অশ্বরাজ কিছু দানা উদরস্থ কর্‌ছে না, তার আশু পঞ্চত্ব-প্রাপ্তির সমস্ত লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, ঘোড়াওয়ালা চারটাকার বদলে নাকি শখানেক টাকা দাবী কর্‌বে! প্রভুর চক্ষুস্থির! আমরা পরম আমোদিত!!

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ জাতীয় গ্রন্থাগার

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher