বাদল দিনে

তপন পাল



বর্ষা এলে কী হয়?
বর্ষা এলে অনেক কিছুই হয়। মাঠে আমন চাষ শুরু হয়। ব্যাঙ আর কবিদের আনন্দ হয়, গঙ্গায় ইলিশ মাছের আগমন হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এর সঙ্গে আরেকটা ব্যাপারও হয়। ভ্রমণপিয়াসী স্বল্পসাধ্যের মানুষ, যাদের গরম এড়াতে খারদুংলা-নুব্রা নিদেনপক্ষে দেরাদুন-মুসৌরি যাওয়ার মত সময় বা সাধ্য নেই, তারা পুরো গরমকালটা ঘরে বসে থাকে, দেওয়ালে পাহাড় বা জঙ্গলের ওয়াল পেপার সাঁটে। তারপর বৃষ্টি নামলে…
আমার পাহাড়ে গেলে ভয় করে, জঙ্গলে গেলে বিরক্ত লাগে। আর পাহাড় বা জঙ্গল কোনটাই তো আর কোলকাতার ধারে কাছে নেই। সে যাওয়ার হ্যাপাও অনেক। রেলগাড়ির টিকিট কাটো চার মাস আগে, থাকার জায়গা নিশ্চিত করো দু মাস আগে…… তারপর যাওয়ার দিন এলে হয়তো দেখলে যে এতদিনে অফিস তোমার গুরুত্ব বুঝেছে। বুঝেছে যে অফিস চলছে তুমি আছো বলেই, তুমি থাকা সত্ত্বেও নয়। তাই ছুটি হবে না। তখন এদিকও গেল, ও কূলও।
তবে আমি যে পাহাড় জঙ্গল দেখি না তা নয়। পাহাড় জঙ্গল দেখার ইচ্ছা হলেই চলে যাই ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা ব্যস্ত জংশন স্টেশন — দমদম জংশনে। সেখান থেকে চক্ররেলের একটি রেলগাড়ি ধরে কোলকাতা, প্রিন্সেপ ঘাট হয়ে মাঝেরহাট। দমদম জংশন থেকে গাড়ি ছাড়লেই মাটির অতিকায় ঢিবি, বনস্পতিকুল …. আমার পাহাড় জঙ্গল দর্শন হয়ে যায়। গরিবের রাংতাই সোনা… তাই না!
পাহাড় ও জঙ্গল, যুগপৎ দুই-ই স্বল্পব্যয়ে দেখে ওঠার একটা ভালো পন্থা হাওড়া থেকে দশটায় ঘাটশিলা মেমু ধরা। পৌনে দুটোয় ঘাটশিলা, পনের মিনিট বিরতি দিয়ে এই রেলগাড়িতেই প্রত্যাবর্তন, হাওড়া ছটা বাইশে। কানা দামোদর, দামোদর, রূপনারায়ণ পেরিয়ে খড়গপুর। তারপর অজস্র রেললাইন। নিমপুরা ইয়ার্ড — কোনও রেললাইন নীচে নেমে যায় তো কেউ উঠে যায় ওপরে। কেলেঘাই কংসাবতী পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম। তারপর থেকে ভূচিত্র বদলায়। মাটির রং বদলে লাল। কাজলা গাং, দুলুং নদী পেরিয়ে গিধনি, তারপর কানি মোহুলি। স্টেশনটি নামটির মতনই সুন্দর; নীচু প্ল্যাটফর্ম বিলীন হয়ে গেছে দিগন্তে - জঙ্গল টাঁড় পেরিয়ে। অনেকখানি দূরে দূরে ছবির মত এক একটি স্টেশন। চাকুলিয়া স্টেশনটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২৬ মিটার ওপরে - নিজেকে যেন পর্বতারোহী মনে হতে থাকে, মনে হয় বাতাসে অক্সিজেন লঘু হয়ে এসেছে। কোকপাড়া আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ধলভূমগড় পেরিয়েই ঘাটশিলা। ফেরা ওই পথে।
আমার ভালো লাগে জল। নদী নালা, খাল বিল সাগর দিঘি। জল দেখতে হলে বর্ষার চেয়ে ভালো সময় কখন আছে? কর্মসূত্রে আমাকে দামোদর ও রূপনারায়ণের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে হয়। সেই সূত্রে গড়চুমুক বা বোয়ালিয়া, গাদিয়াড়া বা মহিষরেখা, ধান্যখোরি বা কোলাঘাট জলভাত। এবার যেতে হবে খোদ গঙ্গায়, মানে হুগলিতে আর কী।

রবিবার সকালে এক প্রস্থ বৃষ্টি, দুপুরে আবার এক প্রস্থের তোড়জোড় হতেই ফোন পাড়ার এক অটোচালককে। কি গো রিজার্ভে যাবে নাকি? শ্রীমানকে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। প্রায়ই তিনি আমার মাতাঠাকুরানিকে ও স্ত্রীকে মন্দির, ডাক্তারখানা ইত্যাদি অতিশয় দায়িত্ব সহকারে ঘুরিয়ে আনেন। দরদস্তুর করারও কিছু নেই। আমি জানি শ্রীমান বেশি চাইবেন না — শ্রীমানও জানেন কাকা কম দেবে না।
দশ মিনিটের মধ্যে দ্বারে উপনীত স্বতশ্চলশকট। যাত্রী আমি একা। বেড়াতে যেতে একাই ভাল। কারণ সেখানে আমাকে অন্যের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করতে হয় না। আমার হয়তো ইচ্ছে হল সৈকতে বসে বৃষ্টি দেখব। কিন্তু সঙ্গীটির যদি ঠাণ্ডার ধাত থাকে, সে বলবে হোটেলের বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে। বেড়াতে এসেও অন্যের কথা শুনে চলতে হলে বেড়াতে যাওয়ার দরকার কী — অফিসে বসে থাকলেই হয়!
এছাড়াও একটা গূঢ় কারণ আছে, পাঁচকান না করাই ভালো। তবে তোমরা তো আমার নিজের লোক, তোমাদের বলতে অসুবিধা নেই। ছুটির দিনে আমি কাছাকাছি যাই, বর্ধমান অথবা দীঘা, বোলপুর অথবা ঝাড়গ্রাম, বা শুধু রেলগাড়ি চাপার ইচ্ছে হলে বরাবিল বা বালাসোর, রাঁচি অথবা রামপুরহাট, ঘাটশিলা বা কাটোয়া। এমত ভ্রমণে আগে সঙ্গী থাকত। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সঙ্গী বদলে যায়, গন্তব্য বদলে যায়, কিন্তু যেটা বদলায় না সেটা হলো সঙ্গীর স্বভাব — সাতসকালে, হাওড়া পৌঁছেই তার হা হতোস্মি আক্ষেপ, এই যা, ব্যাগ বদলেছি তো, কার্ড ফার্ড সব ফেলে এসেছি বাপ্পাদা…।
অটোয় বজবজ, চড়িয়াল। বাঁয়ে, বিড়লা মোড়; ডাইনে ক্যালসিয়াম মোড়। ফের বাঁয়ে, ডোঙ্গরিয়া। ফের ডাইনে, দক্ষিণে চব্বিশ পরগনা জেলার বিস্তীর্ণ পশ্চাদভূমি পেরিয়ে এসে পড়া গেল রায়পুর। বেপাড়ার অটো তাদের এলাকায় ঢুকেছে ভেবে স্থানীয় অটোভ্রাতারা রে রে করে তেড়ে এসেছিলেন। তারপর যখন দেখলেন যে এটি তথাকথিত রিজার্ভ এবং নেহাতই এক বুড়োহাবড়া জল দেখতে এসেছে, তখন বিস্তর ক্ষমা-টমা চেয়ে চা খাইয়ে দিলেন। তারপর আমার অটো চালককে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে কী সব বললেন।

"ওরা তোমাকে কী বললো গো"? জবাবে যা শোনা গেল তা নিদারুণ। এই রাস্তায় একটি জনপ্রিয় সুইসাইড পয়েন্ট আছে। সেখনে সড়ক সমীপবর্তী নদী অতিশয় গভীর এবং জল ঘূর্ণায়মান। আত্মহত্যাকারীদের শুধু পা পিছলে দেওয়ার অপেক্ষা। নদী কপ্ করে গিলে খাবে তোমাকে। তারপর দেহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ তো আর কোলকাতা শহরের সভ্য বাবুলোক নয় যে জলে দেহ ভাসতে দেখলে পুলিশে খবর দেবে, এরা বরং পাড়ে দেহ লেগে আছে দেখলে বাঁশ দিয়ে মাঝগঙ্গায় ঠেলে দেবে, ভাঁটায় তুমি সুন্দরবনে।
শুভাকাঙ্খীরা আমার অটোওলাকে বলেছেন কাকাকে কোন অবস্থাতেই গাড়ি থেকে নামতে দিও না; আর আমাকে সাপের ভয় দেখিয়ে সতর্ক করেছেন। "কাকা গাড়ি থেকে নামবেন না, যতই পায়ে বুট জুতো থাক।"
আমার শৈশবে এখনকার শহর-শহরতলি ছিল আদ্যন্ত গ্রাম। সেইভাবে বেড়ে ওঠার সুবাদে সাপ নিয়ে আমার সতর্কতা আছে, আগ্রহও আছে, কিন্তু আতঙ্ক নেই। আমি সাপ চিনি, কারণ জীববৈচিত্র্য আমাকে বই পড়ে জানতে হয়নি – জীবনই শিখিয়েছে। আর সেই জন্যেই জানি সাপ নিয়ে মানুষের যত ভুল ধারণা তত আর অন্য কোন প্রাণী সম্বন্ধে নেই। ওল্ড টেস্টামেন্টের নন্দন কানন থেকে মহাভারতে আস্তিকের সর্পযজ্ঞ - সাপ সবার কাছেই শত্রু - তাকে দেখলেই মারতে যেতে হয় - যদিও দেশের আইনে যে কোন প্রজাতির সাপ মারাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তবু দুশ্চিন্তা যায় না। অটোভ্রাতারা আমাকে আত্মহত্যাপ্রবণ মনে করলেন কেন? আমার চেহারায় কি তবে বিষাদের গাঢ় ছাপ লেগে আছে সর্বত্র! বাজারের মধ্যে দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরেই নদী যেন ঝাপটা দিয়ে তোমার বুকের ভেতরে - এই ভরা বর্ষায় তার রূপই অন্য।

রায়পুর থেকে বুড়ুল, এই সাড়ে সাত কিলোমিটার সুসংস্কৃত রাস্তা নদীর একদম গা বেয়ে - জোয়ারের জল উঠে আসা সান্নিধ্যে। এই রাস্তার দুপাশে অনেক বাগানবাড়ি, শীতের সপ্তাহান্তে এবং চলতি দিনেও বনভোজন সাথীদের ভাড়া দেওয়া হয়। এছাড়া রাস্তার ধারের খোলা জমিতেও অনেকে বনভোজন করেন। এবং প্রায়শই সেই জমির দখল নিয়ে বনভোজন সাথীদের মধ্যে হাতাহাতি বেধে যায়। বিগত শীতে আমি ও শ্রীমতী পাল এরকম একটি বনভোজন থেকে ফেরার সময় ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম। দুটি অপ্রকৃতিস্থ বনভোজনকারী যূথের হাতাহাতি শেষ পর্যন্ত ছুরি মারামারির স্তরে পৌঁছায় এবং আরক্ষাবাহিনী এসে পড়েন।

বারবার যাতায়াতের সূত্রে একটি বাগানবাড়ি কিঞ্চিৎ পরিচিত। শীতকালে অনেকবার পিকনিক করে গেছি। এখন সব শুনশান। তবু একবার দরজায় ধাক্কা দিই। তত্ত্বাবধায়ক ব্যক্তিটি দরজা খুলে দেন। "কি গো একটু বসা যাবে"। "তা তো যাবে কিন্তু দাদা বসবেন কোথায়"। সত্যিই তো। শীতে নদীর একদম ধারে যে মাটির বাঁধের ওপর বসি তা এখন জলের তলায়। অগত্যা ঘরের বারান্দায়। মরশুমি ফুলের ঋতু শেষ, বৃষ্টির জল পেয়ে চারিদিকে লকলক করে বেড়ে উঠেছে আগাছা। বারান্দায় বসি, চা আসে, দেখতে পাই অনর্গল নৌকার সারি, কেউ পালতোলা, কেউ ডিঙি। রঙিন পাল তুলে ভরা নদীর বুকে বড় বড় নৌকা - জোরে বাতাস দিচ্ছে। আকাশে মেঘ।
এখন রাস্তা শুনশান, কেউ কোথাও নেই। বাগানবাড়িগুলির প্রাঙ্গণে জল আর রাস্তার ধারের খোলা যে জমিগুলিতে বনভোজন হয় জলের তলায়। গুল্মলতাদি নববর্ষা সিঞ্চনে এতখানিই আকুলিত যে বেড়ে এসে রাস্তা ছেয়ে ফেলেছে। বোঝা গেল সাপের ভয় খুব একটা অমূলক নয়। একটি অতি নিরীহ প্রজাতির ফুট পাঁচেকের দাঁড়াশ (Rat Snake : Ptyas mucosa) বেচারা রাস্তা পেরতে গিয়ে অটো দেখে এমন ভয় পেল যে আমারই লজ্জা করছিল। বোঝাই গেল যে গর্তে জল ঢুকে পড়ায় সে বিপন্ন। আর দেখা হলো এক ঘরচিতি (Common wolf Snake: Lycodon avlicus) দম্পতির সঙ্গে। একেবারেই নিশাচর এই প্রজাতির যুগলটি কোন আনন্দে বা সাহসে যে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির মাঝে ডিগবাজি খেতে এলেন, বোঝা গেল না। পায়ে বর্ষার উঁচু জুতো, জিনসের প্যান্ট। বিপদের আশঙ্কা একেবারেই নেই। তাই নেমে একটু ভালো করে দেখা গেল। নির্বিষ, নিরীহ এই সাপটি নিয়ে বাঙালির ভুল ধারণার শেষ নেই। ইনি নাকি গৃহস্থের বিছানায় ঢুকে বসে থাকেন। নিদ্রিত ব্যক্তির মস্তকে নৈশকালে দংশন করেন, তাগা বাঁধা যায় না, ডাক্তার বদ্যি ওঝা কবরেজ, হাসপাতাল করার সময় থাকে না। ভোর হবার আগেই মৃত্যু। এর প্রধান কারণ প্রজাতিটি ভীষণ দর্শন। এদের মাথা চওড়া, ঘাড়ের চেয়ে বড়। তাই এর ইংরাজী নাম Wolt Snake, তদুপরি অনেকেই একে তীব্র বিষধর কালাচ (Common Krait : Bungarus cearuleus) -এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। দুজনেই নিশাচর, দুজনেরই ঘাড়ের চেয়ে মাথা বড়; কিন্তু কালাচ যেখানে চকচকে কালোর উপর সরু সাদাটে হলুদ দাগ, ঘরচিতি সেখানে চকচকে বাদামির ওপর চওড়া হলুদ দাগ। ঘরচিতির আর একটি গুণ এরা অতি ভিতু ও প্রায়শ মস্ত ভীতিপ্রদ হাঁ করে কামড়াতে আসে। তবে গোলানোটাই স্বাভাবিক। সূর্যাস্তের পর জ্যান্ত, মরা অথবা রবারের, যে কোন সাপ দেখলেই লোক আঁতকে ওঠে। আর অল্প আলোয় বা প্রায়ান্ধকারে, কালো আর গাঢ় বাদামি রঙের তফাৎ চোখে না পড়াই স্বাভাবিক।
তবে ঘরচিতি বলেই নামলাম। কালাচ, দক্ষিণ ২৪ পরগণায় যার আদরের নাম শিয়রচাঁদা, হলে কি আর নামতাম, যতই জুতো থাক আর প্যান্ট থাক। তথ্যের খাতিরে জানাই কালাচের এক মিলিগ্রাম বিষ পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে যথেষ্ট এবং এক একটি কামড়ে কালাচ ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ ঢালতে পারে। দংশিত ব্যক্তি অনেকক্ষেত্রেই বুঝতেই পারেন না তাঁকে কিছুতে কামড়াল এবং ঘুমের মধ্যেই মারা যান। তবে মা কালীর দিব্যি, সর্পদম্পতিটিকে আমি বিন্দুমাত্র বিব্রত করিনি। সম্ভবত আমার উপস্থিতি এঁরা টেরও পাননি। নদীতীরে ক্রীড়ারত নিরীহ সর্পদম্পতির বিরক্তির উদ্রেক করে সর্পমুখে 'মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম শাশ্বতীসমা/ যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধি কামমোহিতম' জাতীয় অং বং শোনার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
বুড়ুল একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ, বাস টার্মিনাস, কলেজ, ওপারে গড়চুমুক যাওয়ার ফেরি সব নিয়ে জমজমাট ব্যবস্থা। ঘাটটিও বেশ জমকালো। রায়পুর-বুড়ুল রাস্তার নিসর্গ অবলোকনের পর আমাদের গন্তব্য ফলতা।

বুড়ুল ঘাট থেকে ফলতা যাওয়ার প্রথাগত রাস্তা বিস্তর এঁকেবেঁকে নৈনান রোড ধরে সহরার হাট হয়ে। সহরার হাট, আগ্রহী পাঠক জানেন, পূর্বতন ম্যাকলিয়ড কোম্পানির ১৯৫৭ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাঝেরহাট থেকে ফলতা পর্যন্ত চলাচলকারী কালীঘাট-ফলতা রেলপথের শেষের আগের স্টেশন।
কিন্তু আমরা ওই রাস্তা ধরে যাব কেন! আমরা তো নদী দেখতে এসেছি - আর কে না জানে অটো হচ্ছে আলোর মতন, হাসির মতন, কুসুমগন্ধরাশির মতন সর্বত্রগতি, সর্বত্রগামী। তাই এই দশ কিলোমিটার রাস্তাও আমরা নদী পার্শ্ববর্তী রাস্তা ধরে যাওয়াই স্থির করি। রাস্তার চেহারা দেখে মনে হলো এইগুলিই সরকারী ভাষার 'এক্সজ-জমিনদারি বান্ডস'। নদী এখানে উত্তাল, সঙ্গে প্রায় উল্টে ফেলার মত হাওয়া। নদী ধরে যতই এগিয়ে যাই চোখে পড়ে শীতকালে বনভোজন করার বাগানবাড়ি, কোলকাতা বন্দর অছির অফিস, নদীর জলের গভীরতা মাপা বুককাঠি।
একজন রেল ইতিহাস উৎসাহী হিসাবে জানি, ঐ রেলপথের ফলতা স্টেশনটি ছিলো তেঁতুলতলায়, নদীর ধারের এক অতিকায় তিন্তিড়ি বৃক্ষের নীচে। স্টেশন হারিয়ে গেছে - কারণ বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। তিন্তিড়ি বৃক্ষটি অদ্যপি পূর্ণ গরিমায় দন্ডায়মান। তার নীচে শঙ্কু আকৃতির তিন ঢিবি; লৌকিক দেবতা বিবিমা, দক্ষিণ রায় ও খয়েরবিবির থান। অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, জবরদখলি জমির ওপর গড়ে ওঠা কতিপয় ঘরের পুরনো ইঁট দেখে সেই দিনের কর্মব্যস্ত স্টেশনের ছবি মনে মনে এঁকে নিতে হবে। কোন রেল সামগ্রী, সিগন্যাল, রেললাইনের টুকরো, টুকরো বসার বেঞ্চি… কিচ্ছুটি নেই।

স্টেশনটি ওখানে হলেও টার্মিনাসটি ছিলো প্রায় ২০০ মিটার এগিয়ে, এখন যেখানে ৮৩ নম্বর বাসস্ট্যান্ড দাঁড়িয়ে। কামরাগুলিকে তেঁতুলতলায় ছেড়ে ৩০ ইঞ্চির ন্যারো গেজ ইঞ্জিনটি সেখানে যেত। সেখানে জল কয়লা নেওয়ার পর টার্নটেবিলে তাকে ঘোরানো হত। (এখনকার বিদ্যুৎ বা ডিজেলচালিত রেলইঞ্জিন দুদিকেই সমদক্ষতায় চলতে পারে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন এই সুখের সময় দেখেনি। তার নির্দিষ্ট সামনের দিক ও পিছনের দিক ছিল। একদিকের যাত্রা শেষ হলে তাকে টার্নটেবিলে উঠিয়ে মুখ ঘোরাতে হত। তবেই সে বিপরীত দিকের যাত্রা শুরু করতে পারতো) রেলের কোয়ার্টার ও অফিস নিশ্চিহ্ন; তার জমি বর্তমানে কোলকাতা বন্দর অছির দখলে। চঞ্চলা নদীর এত কাছে রেললাইন ছিল ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। জোয়ারের জল উপচে এসে রেললাইন ডুবিয়ে দিত না! তবে কীই বা আর করা যাবে। আসতে আমার কিঞ্চিৎ, মাত্র ষাট বছর দেরি হয়ে গেছে। রেললাইন বিলুপ্ত, স্টেশন নিশ্চিহ্ন, শুধু নদী বয়ে চলেছে একই নির্লিপ্ততায়। নিকটবর্তী কয়েকটি ঘরের ভিত অতি চওড়া- ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। পাশেই পুকুর। ঐ পুকুরের জল বাষ্পীয় ইঞ্জিন খেত।

ফলতা থেকে নূরপুর-রায়চক হয়ে ডায়মন্ডহারবার। এক শীর্ণ অটোর পক্ষে অনেকখানি রাস্তা। কিন্তু নদী সান্নিধ্য সেও উপভোগ করছিল।
প্রায় দু দশক আগে, পুত্র তখন দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তাদের ইংরাজি পাঠ্যপুস্তকে মানবশরীরের নানা প্রত্যঙ্গের নাম কি ভাবে জড়পদার্থের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয় তা নিয়ে একটি অনুশীলনী ছিলো- যথা face of a clock, leg of a chair, hands of a watch ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মধ্যে ছিলো mouth of a river। দেখা গেলো বস্তুটি কি, তা শ্রীমানের মাথায় ঢুকছে না। বই গুটিয়ে বাস ধরে তৎক্ষণাৎ ডায়মন্ডহারবার। বিস্তৃতা নদী, নৌকারাজি, উড্ডীয়মান জাতীয় পতাকা, ভগ্নপ্রায়দুর্গ, পরপারের ছায়ামাখা নিসর্গ - দেখে শ্রীমান তো মহাখুশি। তারপর ফেরার পথে মাছের আড়ৎ - বিকটদর্শন ও বিচিত্রদর্শন সামুদ্রিক মাছের সমাহার।

ডায়মন্ডহারবারের মূল আকর্ষণ কিন্তু নদী নয়। ভরা বর্ষায়, রাস্তার ধারে, ডায়মন্ডহারবারে যেখানে সেখানে গজিয়ে ওঠে ভাতের হোটেল। তার পদ একটিই, ভাত ও ইলিশ। নেহাতই সাদামাটা চালের ভাত, সঙ্গে ইলিশের যা চাও তাই। তেল, ভাপা, ঝাল, ঝোল, অম্বল মায় পাতুরি অবধি। নেহাতই ঝোপড়ি, খেতে খেতে তোমার মাথায় ছাদ ফুঁড়ে বৃষ্টির জলও পড়তে পারে দু এক ফোঁটা। কিন্তু তাতে রাগ করলে চলবে না। এইরকমই এক ভোজনালয়ে বিলম্বিত মধ্যাহ্নভোজ। তারপর সারথিটি কোন কথা না বলে নদীতীরের পার্কের বেঞ্চে লম্বা হল। দেখাদেখি আমিও।
ওপরে আকাশ, ডাইনে বনস্পতি, বাঁয়ে নদী, নীচে ভূমি - ঘুম না এসে পারে? বেশিক্ষণ নয়, মিনিট পঁয়তাল্লিশ। তারপর চা।
ফেরার পথে আর নদীতীর নয়, ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আমতলা মোড়। বাঁয়ে ঘুরে চড়িয়াল-বজবজ হয়ে বাড়ি।
বাড়ির সামনে অটো থেকে নামার সময় সারথিটির সস্নেহ মন্তব্য- "কাকা এটা তুমি ঠিক করলে না - কাকিমাকে তোমার নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।"


পশ্চিমবঙ্গ অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher