বাংলার অজপাড়া এক গাঁয়ে

রফিকুল ইসলাম সাগর



সকাল সোয়া দশটা। মহাখালী বাস টার্মিনাল এসে দশ মিনিটের জন্য বাস মিস করলাম। মাসুল গুণতে হল দেড় ঘন্টা। পরের বাস বেলা সাড়ে এগারটায়। ততক্ষণ টার্মিনালের ভেতরেই অপেক্ষা। সময় কাটল খুবই অস্থিরতায়। এর মধ্যে কতবার যে ওয়েটিং রুমের সিট থেকে উঠে বাসের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়েছি তার হিসেব নেই। এগারটা বেজে কুড়ি মিনিট। একজন এসে বলল, 'সিলেট এগারটা ত্রিশের যাত্রীরা আমার সাথে আসেন'। ওঠার পর ঠিক সময়েই বাস ছাড়ল অবশ্য।
ভৈরব পর্যন্ত যানজটবিহীন আরামেই যাচ্ছিলাম। অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যামের কারণে ভৈরব দূর্জয় মোড় থেকে ব্রিজ পার করতে দশ মিনিটের পথ প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লেগে গেল। এবার বি-বাড়িয়া বিশ্বরোড পৌঁছলে বাস থেকে নেমে চার'শ টাকায় ভাড়া করা সিএনজি অটোরিক্সায় উঠলাম। আগামী গন্তব্য ফান্দাউক। প্রায় দশ মিনিটের পথ এগিয়ে সড়কের পাশেই বাঁদিকে একটি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ক্যাম্প চোখে পড়ল। অটোরিক্সা চালক জানালেন, এটা বাংলাদেশের ছ'টি বড় বিজিবি ক্যাম্পের একটি।
দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা অটো সরাইল পেরিয়ে যাওয়ার সময় সড়কের দু'পাশে দেখতে পেলাম দূরদূরান্ত পর্যন্ত পানি আর পানি। থৈ থৈ পানির বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ট্রলার আর নৌকা। ডিঙি নৌকায় জেলেরা মাছ ধরছে। আশেপাশে ঘর-বাড়ি চোখে পড়ল না। প্রচণ্ড বাতাস। যাকে বলে প্রাণ জুড়োনো বাতাস। অটোরিক্সার প্লাস্টিকের বডিতে বাতাসের আঘাত করার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। চুলগুলো বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। মুখটা একটু বাইরে বার করে বাতাসের স্বাদ পুরোপুরি গ্রহণ করলাম। আহ! এসব অনুভূতির জন্যই মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে যায় - কথাগুলো মনে এল। ততক্ষণে ফান্দাউক পৌঁছে গেছি। ভাড়া মিটিয়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম। খানিক এগোতে সামনেই বাঁশের সাঁকো। ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পেরিয়ে আবার তার জন্য টোল পরিশোধ করতে হল জনপ্রতি পাঁচ টাকা! সাঁকোটির হাল দেখে মনে হল, টোলের টাকা সাঁকোটি মেরামতের কাজে ব্যবহার হয় না। এখানে টোল আদায় শুধুমাত্র ধান্দাবাজি। এ ব্যবসা অবশ্য আর বেশিদিন চলবেনা - পাশেই দেখতে পেলাম সেতু নির্মাণের কাজ অর্ধেকেরও বেশি হয়ে গেছে। শেষ হলে এই পথে সরাসরি বাস চলবে।
বিখ্যাত ফান্দাউক বাজারের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নজর পড়ল একটা মিষ্টির দোকানের ভিতরে। রসমালাই দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। বেশ ভিড়। ভেতরে বসার জায়গা পেলাম না। দাঁড়িয়েই একবাটি রস মালাই খেয়ে আরো দু কেজি প্যাকেটে দিতে বললাম। ঢাকার থেকে ঢের সস্তা। আরো দু'কেজি অন্য মিষ্টিও কিনে নিলাম। মিনিট পাঁচেক হেঁটে এবার ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সায় বামৈ পর্যন্ত গেলাম। পঁচিশ মিনিটের মতো সময় লাগল। এখনও অবশ্য কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছাইনি।
সকাল সোয়া দশটা। মহাখালী বাস টার্মিনাল এসে দশ মিনিটের জন্য বাস মিস করলাম। মাসুল গুণতে হল দেড় ঘন্টা। পরের বাস বেলা সাড়ে এগারটায়। ততক্ষণ টার্মিনালের ভেতরেই অপেক্ষা। সময় কাটল খুবই অস্থিরতায়। এর মধ্যে কতবার যে ওয়েটিং রুমের সিট থেকে উঠে বাসের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়েছি তার হিসেব নেই। এগারটা বেজে কুড়ি মিনিট। একজন এসে বলল, 'সিলেট এগারটা ত্রিশের যাত্রীরা আমার সাথে আসেন'। ওঠার পর ঠিক সময়েই বাস ছাড়ল অবশ্য।
ভৈরব পর্যন্ত যানজটবিহীন আরামেই যাচ্ছিলাম। অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যামের কারণে ভৈরব দূর্জয় মোড় থেকে ব্রিজ পার করতে দশ মিনিটের পথ প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লেগে গেল। এবার বি-বাড়িয়া বিশ্বরোড পৌঁছলে বাস থেকে নেমে চার'শ টাকায় ভাড়া করা সিএনজি অটোরিক্সায় উঠলাম। আগামী গন্তব্য ফান্দাউক। প্রায় দশ মিনিটের পথ এগিয়ে সড়কের পাশেই বাঁদিকে একটি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ক্যাম্প চোখে পড়ল। অটোরিক্সা চালক জানালেন, এটা বাংলাদেশের ছ'টি বড় বিজিবি ক্যাম্পের একটি।
দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা অটো সরাইল পেরিয়ে যাওয়ার সময় সড়কের দু'পাশে দেখতে পেলাম দূরদূরান্ত পর্যন্ত পানি আর পানি। থৈ থৈ পানির বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ট্রলার আর নৌকা। ডিঙি নৌকায় জেলেরা মাছ ধরছে। আশেপাশে ঘর-বাড়ি চোখে পড়ল না। প্রচণ্ড বাতাস। যাকে বলে প্রাণ জুড়োনো বাতাস। অটোরিক্সার প্লাস্টিকের বডিতে বাতাসের আঘাত করার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। চুলগুলো বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। মুখটা একটু বাইরে বার করে বাতাসের স্বাদ পুরোপুরি গ্রহণ করলাম। আহ! এসব অনুভূতির জন্যই মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে যায় - কথাগুলো মনে এল। ততক্ষণে ফান্দাউক পৌঁছে গেছি। ভাড়া মিটিয়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম। খানিক এগোতে সামনেই বাঁশের সাঁকো। ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পেরিয়ে আবার তার জন্য টোল পরিশোধ করতে হল জনপ্রতি পাঁচ টাকা! সাঁকোটির হাল দেখে মনে হল, টোলের টাকা সাঁকোটি মেরামতের কাজে ব্যবহার হয় না। এখানে টোল আদায় শুধুমাত্র ধান্দাবাজি ব্যবসা। এ ব্যবসা অবশ্য আর বেশিদিন চলবেনা - পাশেই দেখতে পেলাম সেতু নির্মাণের কাজ অর্ধেকেরও বেশি হয়ে গেছে। শেষ হলে এই পথে সরাসরি বাস চলবে।
বিখ্যাত ফান্দাউক বাজারের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নজর পড়ল একটা মিষ্টির দোকানের ভিতরে। রসমালাই দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। বেশ ভিড়। ভেতরে বসার জায়গা পেলাম না। দাঁড়িয়েই একবাটি রস মালাই খেয়ে আরো দু কেজি প্যাকেটে দিতে বললাম। ঢাকার থেকে ঢের সস্তা। আরো দু'কেজি অন্য মিষ্টিও কিনে নিলাম। মিনিট পাঁচেক হেঁটে এবার ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সায় বামৈ পর্যন্ত গেলাম। পঁচিশ মিনিটের মতো সময় লাগল। এখনও অবশ্য কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছাইনি।

"বাকিটা পথ যেতে হবে 'বামৈ নাউ ঘাট' থেকে ইঞ্জিন চালিত কাঠের নৌকায় চড়ে (নৌকার স্থানীয় নাম 'নাউ')। ঘাটে পাঁচ-ছ'টি নৌকা দেখতে পেলাম। দেখতে প্রায় একই রকমের সবকটা। আকারে খুব বড় না। ঘরের মতো চারদিক বন্ধ। ওপরে টিনের চাল। সামনে পিছনে দরজার মতো ফাঁকা দুটি প্রবেশ পথ। দু'পাশে তিন-চারটি জানালা। শিশু ও মহিলারা বসেছে ঘরের ভিতর। পুরুষরা টিনের চালের ওপর। অন্যদের মতো আমিও বসলাম চালের ওপরেই। একে একে সংখ্যায় আমার ধারণার বেশি যাত্রী উঠলো। তারপরেও মাঝি আরও যাত্রী নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝির সঙ্গে নৌকার হেলপার একটি শিশু। শিশুটি একটু পরপর উচ্চস্বরে ডাকছে, 'জিরু ন ন ন ন ন ন ন্ডা'। নৌকোটা টলমল করতে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম, যদি ডুবে যায় এই ভেবে। আর তখনই নৌকার মাঝি যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, 'নাউ গড়াইতাছে! সামনে পিছে মিল্লা বও'। আরো ক'জন যাত্রী উঠল নৌকায়। অতঃপর ঘাট থেকে একজন নাউ ছাড়ার নির্দেশ দিল। ইঞ্জিন স্টার্ট করে নাউ নিয়ে এগিয়ে চলল মাঝি। অধিক যাত্রীর ভারে নৌকা প্রায় ডোবে-ডোবে অবস্থা। আমার মনে আতঙ্ক! এমনভাবে যাতায়াত করা এখানের মানুষের কাছে হয়তো স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু আমি ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছিলাম না।
বেলা প্রায় শেষের দিকে। পশ্চিমের আকাশের একাংশে একটু আগুনের রঙের মতো লালচে দাগ। কেমন জানি একটা নিস্তব্ধতার মাঝে ব্যাঙের ডাক আর নৌকার ইঞ্জিন ঘোরার শব্দ। এর সঙ্গে সূর্যটা যেন ডুব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেমন জানি ঝিম-ম-ম অনুভূতির মাঝে হারালাম। সমস্ত শরীরে বাতাসের আঘাত গোটা দিনের সব ক্লান্তি তাড়িয়ে দিচ্ছিল। আলো তখনও পুরোপুরি অন্ধকারে হারায়নি। বিদ্যুতের ভোল্টেজ একেবারেই কম থাকলে একটা বাল্বের আলো যেমন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায় ঠিক তেমনি সূর্যের আলোর নিভু নিভু ভাব। হঠাৎ সূর্যটা হারিয়ে গিয়ে চারিদিকে অন্ধকার নামিয়ে গেল। প্রতিদিন ঠিক একইভাবে সূর্য আসা-যাওয়া করে। পার্থক্য শুধু আগেরদিন সূর্যডুবির এ দৃশ্য দেখেছিলাম ঢাকার আকাশে। ঘড়ির কাঁটা সেকেন্ড তারপর মিনিট এভাবে এগোচ্ছে। এরই মাঝে সেই শিশুটি এসে ভাড়া চাইল, মাথাপিছু দশ টাকা। ততক্ষণে 'জিরুন্ডা' গ্রামের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে গেছি, আর হয়তো মিনিট দশ।

নৌকায় থাকা যাত্রীদের প্রস্তুতি দেখে বুঝতে বাকি রইল না, জিরুন্ডা এসে গেছি। আধঘন্টা কেটে গেছে এরমধ্যেই। ঘাটে পৌঁছাবার আগেই ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন মাঝি। চিকন মাপের বাঁশ হাতে নিয়ে এবার তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাঁশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে নৌকা ঘাটে ভেড়ালেন। ভেবেছিলাম এখানেই নামতে হবে। মাহমুদ ভাই বললেন, এ ঘাটে নামব না। একজন মহিলা ও শিশুকে নামিয়ে আবার ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন মাঝি। দু'মিনিট পর একইভাবে আরেক ঘাটে ভেড়ানো হলো নৌকা। এখানেও নামল ক'জন। এভাবে চারটি ঘাট পর অবশেষে পৌঁছলাম জিরুন্ডা গ্রামে। লোকাল বাসে চড়েছি, লোকাল ট্রেনে চড়েছি, জীবনে এই প্রথম লোকাল নৌকায় চড়লাম। ঘাটে ঘাটে যাত্রী নামানো দেখার অভিজ্ঞতা প্রথম বলে হয়তো দারুণ মনে হল। যেই নৌকাটিতে করে এখানে এলাম এটি নাকি ছিল এ পথের লাস্ট ট্রিপ। সকাল পর্যন্ত আর কোনও নৌকা চলবে না। কোনও কারণবশত যদি কেউ বামৈ থেকে রওনা দিতে দেরি হয়ে যায় তাহলে জিরুন্ডা ফিরতে তার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। রাতে ডাকাতির সম্ভাবনা আছে বলে নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে। রাতযাপন করলাম এক নিকট আত্বীয়ের বাড়িতে - পনেরদিন আগেও নাকি এটি পুরোপুরি পানিবন্দী ছিল। রাত পেরিয়ে সকাল বেলা গ্রামের পুরোপুরি রূপ ধরা দেয় আমার দৃষ্টিতে। যে রূপ রাতের আঁধারে ছিল অস্পষ্ট। আশপাশ ঘুরে দেখলাম এখনো অনেক বাড়ি পানির মাঝে উঁকি দিয়ে আছে।
জিরুন্ডা গ্রামের নাম অনেক পাঠকই সম্ভবত এর আগে কোনদিন শোনেননি। আমি এ গ্রামের নাম প্রথম শুনি বছর তিনেক আগে। সেই তখন একবার এসেছিলাম, মাঝে পাঁচ-ছয় মাস আগে আরেকবার। জিরুন্ডা নামক গ্রামটি হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত, লাখাই থানার অন্তর্ভুক্ত। জিরুন্ডা এবং তার আশেপাশের আরও কয়েকটি গ্রাম - মানপুর, সন্তোষপুর, কৃষ্ণপুর ও রাধানগর – এদের অজপাড়াগাঁ বলা চলে। গ্রামগুলোর বছরে দুই রূপ - জুলাই থেকে অক্টোবর বর্ষাকালীন একরূপ, আর বাকি মাসগুলোতে আবার অন্য রূপ। পূর্বে দু'বার যখন এসেছিলাম অনেকেই আমাকে বর্ষাকালে বেড়াতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বর্ষাকালে নৌকা একেবারে ঘরের দরজার সামনে আসবে, এমন কথা বলেছিল কেউ কেউ। সব মিলিয়ে এবার আমন্ত্রণে সাড়া দিতে পেরেছিলাম। বামৈ থেকে যখন নৌকায় উঠলাম তখন আগের দেখা অনেক কিছুই মেলাতে পারছিলাম না। না পারাটাই স্বাভাবিক। জোয়ারের পানিতে পথ-ঘাট, মাঠ, ধানের ফসল, খাল-বিল, ঝিল সব মিলে মিশে একাকার। নৌকায় কয়েকজন জানায়, এখন তবু জোয়ারের পানি নামতে শুরু করেছে। এবারের বন্যায় নাকি গত কয়েক বছরের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়েও দ্বিগুণ পানিতে ডুবেছিল। কিছু কিছু জায়গায় এখন পানি না থাকলেও, কিছুদিন আগেও নাকি পানিতে ডুবে ছিল, এমন কথাই বলাবলি করছিলেন গ্রামের ক'জন প্রবীণ।
জিরুন্ডাসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষরা যোগাযোগসহ আধুনিক অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিছুই প্রায় পাওয়া যায় না গ্রামে। বাজার আনতে যেতে হয় বামৈ নয়তো ফান্দাউক। সদরে বা রাজধানীতে যেতে হলে আগে যেতে হবে বামৈ। সেখান থেকে রাজধানী যাওয়ার বাস ছাড়ে দিনে দু'টি। তাও আবার লক্কর-ঝক্কর লোকাল বাস। গ্রামে পথচলার রাস্তা যতটুকু আছে তা না-থাকার মতোই। রিক্সায় চড়ে কিছুটা পথ যাওয়া গেলেও বেশ কয়েকবার যাত্রীকে নেমে হেঁটে সামনে গিয়ে আবার উঠতে হয়। হিসেব কষলে দেখা যায়, রিক্সায় বসে থাকার চেয়ে হেঁটেই বেশি পথ আসা হয়েছে। আর তাই দূরত্বের ব্যবধানটা অনেক বেশি হলেও, দীর্ঘ সময় লাগলেও প্রয়োজনে গ্রামের মানুষেরা পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করেন। গোটা কয়েক গ্রাম মিলিয়ে রিক্সার সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা। বরং বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকলেও সব মিলিয়ে এখানকার মানুষজনের বর্ষাকালেই চলাচলে সুবিধা – নৌকাতে – যখন খাল-বিল-পথ-মাঠ-ক্ষেত সব মিলেমিশে একাকার।

ঘড়ির কাঁটায় বেলা এগারটা। জিরুন্ডা গাঁয়ের নাউ ঘাটে বসে নৌকায় ওঠার জন্য অপেক্ষা। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর কিনতে বামৈ যেতে হবে। পনের মিনিট অপেক্ষা করে নৌকা পেলাম। গতরাতের মতো চালের ওপর উঠে বসলাম। রোদের তাপ একটু বেশিই মনে হল। পাশাপাশি একের পর এক ঘাট থেকে নৌকায় যাত্রী উঠছে। এই ঘুরপাকে কেটে গেল আধ ঘন্টার বেশি সময়। অথচ আধ কিলোমিটার পথও এগোতে পারিনি। এক পর্যায়ে খুব বিরক্ত লাগছিল। রোদের তাপ আরো বেশি মনে হচ্ছিল। কয়েকজন রোদ থেকে নিজেকে আড়াল করতে ছাতা মেলে ধরেছে মাথার ওপর। তাদেরকে এমন ঘাপটি মেরে বসে থাকতে দেখে নিজেকে বড় অসহায় মনে হল। দেখলাম, বুড়ো মাঝিটাও একটা ছাতা মেলল। আমাকে ডাকল, তার পাশে আসার জন্য। আমার হাতে ছাতাটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন - তারপর আমার পাশে বসলেন। থৈ থৈ পানির বুকে ভাসছে নৌকা। মাঝি একটা লোহার হ্যান্ডেলের মাধ্যমে নৌকাটিকে ডানে-বায়ে নিয়ন্ত্রণ করছে - আমি আমাদের দুজনের মাথায় ছাতা ধরে! বুড়ো মাঝি একটু পরপর একটা করে বিড়ি জ্বালিয়ে ফুঁকছে। কিছু বলতে পারলাম না, রোদে পোড়ার চেয়ে বিড়ির ধোঁয়া বেশি উত্তম বলে তখন মনে হল।
জোয়ারের পানিতে গ্রামের মানুষের মাছ ধরার দৃশ্য আমার কাছে এক প্রকারের উত্সবের মত লাগে যাকে বলা যেতে পারে সিজনাল মাছ ধরার উত্সব। নৌকায় বসে দেখলাম এখানে-সেখানে অনেকেই সিটকি জাল পেতে বসেছে। আবার কেউ কেউ উড়াইন্যা জাল ব্যবহারে মাছ ধরছে। এছাড়া নৌকা থেকে জাল ফেলে ও বর্শি পেতেও মাছ ধরতে অনেকে ব্যস্ত। দেখে মনে হল, মাছের চেয়ে মাছ ধরার মানুষের সংখ্যা বেশি। বামৈ ঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগবে আর দু'তিন মিনিট। এ পথে অনেকগুলো মাছ ধরার জাল পাতা। আর তাই মাঝি খুব সতর্কভাবে নৌকা এগিয়ে নিচ্ছিল। ইঞ্জিন বন্ধ করে মাঝি এবার বাঁশ হাতে নিল। নৌকার ইঞ্জিনের পাখায় জাল আটকে গেলে ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নৌকা থেকে নেমে ঘাটে গতদিনের তুলনায় মানুষের আনাগোনা একেবারেই দেখলাম না।
আধঘন্টা পর আবার ঘাটে এসে সেই নৌকাটিতেই উঠলাম জিরুন্ডা যাওয়ার জন্য। যাত্রী সংখ্যা কম থাকলেও মাঝি আমাদের নিয়ে নৌকা ছাড়ল। একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর একজন মহিলা যাত্রী মাঝিকে ভেতর থেকে বলল, নৌকা ঘাটে ভেড়াতে। এ ঘাট থেকে তার লোক উঠবে। নৌকা ঘাটে ভিড়লে মহিলাটি জোরে চিত্কার করল, আফা - আফা (আপা) বলে। চিত্কারে পাশেই একটি বাড়ি থেকে শিশু-কোলে বয়স্ক একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। তাঁর কথায় বোঝা যাচ্ছিল, তিনি এখন যাবেন না, পরে আসবেন। আমাদের সবাইকে নৌকায় অপেক্ষা করিয়ে দুই বোনের আলোচনা চলছে..। আমার খুব বিরক্তি লাগছিল। মাঝির মুখের দিক তাকিয়ে বুঝলাম উনিও বিরক্ত। তাদের দীর্ঘ আলাপচারি ফুরোলে নৌকা ছাড়ল। যাত্রী কম হলেও নামানোর সময় এক-এক ঘাটে এক-একজন করে নামছে। গতদিন যাত্রী বেশি থাকলেও এতগুলো স্টপেজ দেয়নি। আমি যে ঘাটে নামব সেটি এল একেবারে শেষে। নেমে কোমর টনটন করছে দেখে শরীরটা একটু নাড়াচাড়া করে নিলাম।

জিরুন্ডা ফিরে দুপুরের খাওয়া শেষে বেড়াতে বেরোলাম। কাঁচা মাটির পথে হেঁটে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম আমার দিকে গ্রামের মানুষগুলোর কেমন জানি ভিন্ন দৃষ্টি। যেন বড় মাপের কোনো তারকা! মহিলারা বাড়ির উঠোনে আমাকে দেখতে ভিড় করেছে। লজ্জায় মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে উঁকি দিয়ে দেখছে। যেদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, সবাই আমাকে নিয়েই যেন কথা বলাবলি করছিল। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর এমন কাণ্ডে এক পর্যায়ে নিজেও লজ্জা পেতে শুরু করল। কয়েকপা এগিয়ে একসঙ্গে অসংখ্য গজারী গাছ দেখতে পেলাম। সেখান থেকে ভেসে আসছে পাখিদের জোরালো কিচির-মিচির। সামনে এগিয়ে দেখি গাছগুলোর ডালে ডালে দলে দলে চড়ুই পাখির ঝাঁক। মনে হল গোটা গাঁয়ের সব চড়ুই পাখি যেন এখানে জোট বেঁধেছে। কিচির-মিচির শব্দে কান ঝালাপালা করা অবস্থা। এরপর হাঁটতে হাঁটতে যেখানে গিয়ে থামলাম জোয়ারের পানি পথ ছুঁই-ছুঁই। আরেকটু সামনে কদম ফেললে আমার পা ভিজে যায় পানিতে। তাকিয়ে দেখি, কচুরীপানার ভেলা ভেসে যাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা-বক মাছ খুঁজছে, আবার কোনটি মাছ পেয়ে উড়াল দিয়ে চম্পট হচ্ছে। প্রকৃতির এমন দৃশ্য মন ভালো করে দেয় নিমেষেই। এসব কিছুর মাঝেই কাটালাম পাঁচদিন।
গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোকে ছেড়ে ব্যস্ত শহরে যখন ফিরব বিদায়বেলায় নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল এসেছিল।


মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন কোর্সে পাঠরত রফিকুলের বাড়ি বাংলাদেশের ঢাকায়। পড়াশোনার পাশাপাশি বেড়ানো আর ভ্রমণ সাংবাদিকতা তাঁর পছন্দের বিষয়।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher