বাঙালি মধ্যবিত্তের আমেরিকা দর্শন
সুস্মিতা রায়
~ শিকাগোর আরও ছবি ~
বেড়ানো বলতে প্রথমেই ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কথা মনে পড়ে। প্রত্যেক বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর, বাবা আমাদের ভাই-বোনদের নিয়ে চিড়িয়াখানা যেতেন। সবাই মিলে সারাদিন চিড়িয়াখানায় ঘোরা, সঙ্গে নিয়ে যাওয়া খাবার দাবার মাঠে বসে খাওয়া— এটা আমার কাছে যেন এক উৎসবের মেজাজ এনে দিত।
এছাড়া বাবা তাঁর স্বল্প ক্ষমতার মধ্যেও, আমাদের নিয়ে পুরী গেছেন। পরে দাদার সঙ্গে বাবা-মা, আমি ও ছোটভাই দিল্লি, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, দেরাদুন, হরিদ্বার, মুসৌরি ঘোরার সুযোগও পেয়েছি। বিয়ের পর সংসারে জড়িয়ে পড়ে বেড়াতে যাবার সুযোগ না আসলেও, পরবর্তীকালে নিজস্ব ব্যবসা সূত্রে নেপাল, হায়দ্রাবাদ গেছি। জায়গাগুলুও নৈসর্গিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে। কিন্তু এহেন আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমার কপালেও বিদেশ ভ্রমণ লেখা আছে!
আমাদের একমাত্র সন্তান কর্মসূত্রে আমেরিকার শিকাগো শহরে প্রতিষ্ঠিত। যেদিন ছেলে জানাল যে সে আমাদের ওর কাছে গরমের সময় নিয়ে যেতে চায় তাই পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থা ও অন্যান্য প্রস্তুতি করতে - একদিকে যেমন ভীষণ আনন্দ হল, ভয়ও কম করতে লাগল না। সতের-আঠার ঘন্টার বিমান যাত্রা, সঙ্গে ভাষা সমস্যা।
অবশেষে ৩১শে মে, ২০১৪ তারিখে আমরা নেতাজি সুভাষ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গিয়ে হাজির হলাম। এখান থেকে দিল্লি গিয়ে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করে, সরাসরি শিকাগো (আমেরিকান উচ্চারণে চিকাগো)। ছেলের সঙ্গে তিন বছর পরে দেখা হবে, তাই অনেক কিছুই সঙ্গে নিয়ে যাবার ইচ্ছা থাকলেও, নিয়মকানুনের বাধায় অধিকাংশই সম্ভব হল না।
রাত আটটা পনের মিনিটে আমাদের নিয়ে নির্দিষ্ট উড়োজাহাজ দিল্লির উদ্দেশ্যে উড়ে গেল। দু'ঘন্টার পথ - রাত দশটার কিছু পরে দিল্লি পৌঁছলাম। এখান থেকে শিকাগোর বিমান রাত একটায় ছাড়ার কথা, তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই।
প্রায় তিন ঘন্টা সময় কিভাবে কাটাব, এতটা পথ একনাগাড়ে বিমানে কাটাতে কোনও অসুবিধায় পড়বো কী না, ভাবতে ভাবতেই বিমান ছাড়ার সময় এসে গেল। রাত একটার কিছু পরে আবার আকাশে পাড়ি দিলাম। শুরু হল দীর্ঘ পনের ঘন্টার বিমান যাত্রা। আমরা পয়লা জুন এখানকার রাতে, অর্থাৎ ওদেশের সকালে শিকাগো পৌঁছবো। জানলার ধারে বসা নিয়ে এই বুড়ো বয়সেও একপ্রস্থ মন কষাকষির পর, অলিখিত মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হল —যাওয়ার সময় আমার স্বামী জানলার ধারে বসে যাবে, ফেরার পথে আমি। মাঝখানের সিটে বসলাম। সামনে সিনেমা বা ছবি দেখা, ও গান বাজনা শোনার ভাল ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অভাগা যেখানে যায়...। আমার সিটের জন্য নির্দিষ্ট যন্ত্রটি হয় মৃত, নাহলে গভীর কোমায় আচ্ছন্ন।
বিমানসেবিকা খাবার নিয়ে হাজির। খাওয়া দাওয়া সেরে চোখ বুজলাম। ভূমি থেকে কত ওপরে আছি জানি না। মনে হচ্ছে বিমানটা মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছে। মনের মধ্যে নানা উৎকন্ঠা — কখন পৌঁছবো, দীর্ঘ তিন বছর পরে ছেলের সঙ্গে দেখা হবে, নিরাপদে পৌঁছবো তো? কিন্তু সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আমাদের নিয়ে বিমান নিরাপদেই শিকাগো বিমান বন্দরে এসে অবতরণ করলো। মালপত্র ফেরত পেতে অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল। এবার শুরু হল চেকিং পর্ব, তার সাথে হাতের ছাপ নেওয়া, সঙ্গে কী কী মাল আছে — বিশেষ করে "আম" আছে কী না, ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদ। সব মিটিয়ে তবে বাইরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল।
বাইরে বেরিয়েই দেখলাম ছেলে-বউমা দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। কতদিন পরে দেখলাম, মনটা আনন্দে ভরে গেল। নতুন দেশ দেখতে এসেছি না ছেলে-বউকে, ঠিক করতে আরও কিছু সময় গেল। সকালের রোদে ঝকঝকে সুন্দর এলাকা দিয়ে গিয়ে, ওর আরও সুন্দর গাড়িটায় বসে মনে হল, ছোট্টবেলা থেকে অনেক দুঃখ-কষ্টের জীবনযুদ্ধে আমি আজ জয়ী। আমার পাশে আমার প্রধান সেনাপতি, আমার একমাত্র সন্তান।
ছেলেই গাড়ির বাঁদিকে বসে গাড়ি চালাচ্ছে। এখানে ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালাবার রীতি। গাড়ির সব আরোহীকেই সিটবেল্ট বেঁধে বসতে হয়। ওদের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে ঘন্টা আধেক সময় লাগলো। সামনেই সবুজ লন, টেনিসকোর্ট, সুইমিংপুল। আর এই সামান্য পথে, সামান্য সময়ে যেটা লক্ষ্য করলাম, এখানে কেউ কাউকে ওভারটেক করে না, পুলিশ সদা সতর্ক, সবাই খুব নিয়মনিষ্ঠ, রাস্তায় প্লাস্টিক-পলিথিন তো দূরের কথা একটা কাগজের টুকরো পর্যন্ত কোথাও পড়ে নেই। পরিবর্তে রাস্তার দু'ধারে সবুজ গাছ আর ফুলের সমারোহ। নোংরা আবর্জনা, পলিথিন ব্যাগ, বর্জ্যপদার্থের স্তুপ দেখতে না পেয়ে, মনটা নিজের দেশ ও দেশের মানুষগুলোর জন্য হু হু করে উঠলো। যাহোক, বাড়ি পৌঁছে ছেলে আমাদের ভাল করে বিশ্রাম নিতে বলল। সত্যিই আমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন, বিমানযাত্রায় যে এত ক্লান্তি আসে জানা ছিল না।
বিকেলে বেরোলাম। সুন্দর রাস্তাগুলোয় আমাদের এখানকার মতো কোন দোকান নেই, শুধু বিশাল বিশাল শপিং মল। ছবির মতো প্রতিটা বাড়ির গঠন শৈলী প্রায় একইরকম, সামনে লন ও ফুলের গাছ। ছেলে বলল, শিকাগো শহরে নিয়ে যাবে। ওখানে নাকি অনেক কিছু দেখার আছে। লং জার্নির মধ্যে মিশিগান। সেখানে একদিন থাকতে হবে। তবে সবথেকে খুশি হলাম শুনে যে ওদেশের স্বাধীনতা দিবস, অর্থাৎ ৪ জুলাই নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখাতে নিয়ে যাবে।
শিকাগো শহর দেখতে যাওয়ার দিন ছেলের গাড়িতে করে নিকটবর্তী একটা স্টেশনে গিয়ে, সেখান থেকে শিকাগোর ডাউনটাউনের "ইউনিয়ন" স্টেশনে এলাম। এই ডাউনটাউন-ই শহরের মুখ্য ব্যবসায়িক স্থল। ছেলে সঙ্গে সোয়েটার নিতে বলেছিল, কিন্তু বেরোবার সময় সেটা খেয়াল হয়নি। এদিকে এখানে এত ঠান্ডা হাওয়া, যে জমে যাবার উপক্রম। দোষটা আমার, তাই চুপ করে মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া গতি নেই। গোটা শিকাগোটাকেই মিশিগান হ্রদ ঘিরে রেখেছে। নামেই লেক, আসলে সেটা সমুদ্রের মতোই বিশাল। তবে শুনলাম হ্রদের জল সমুদ্রের মতো লোনা নয়, মিষ্টি জলের হ্রদ। শিকাগো মেট্রোপলিটান অঞ্চলের আশি শতাংশের বেশি মানুষ এই জলই ব্যবহার করেন। এবার উঠলাম দোতলা ট্রেনে। সুন্দর বসার ব্যবস্থা, বসার আসনও ততোধিক সুন্দর। কেউ দাঁড়িয়ে নেই - খুবই আরামদায়ক যাত্রা।
শিকাগোতে দেখতে গেলাম শেড অ্যাকোয়ারিয়াম (Shed Aquarium)। বিশাল জায়গা জুড়ে এই অ্যাকোয়ারিয়ামে বিভিন্ন রকম মাছ, জেলিফিশ, ডলফিন, পেঙ্গুইন ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রায় পঁচিশ হাজার মাছ আছে। এটা একসময় পৃথিবীর বৃহত্তম ইন্ডোর অ্যাকোয়ারিয়াম হিসাবে স্বীকৃত ছিল - প্রায় ৫০,০০,০০০ গ্যালন জল ধারণ করার ক্ষমতা আছে। শিকাগোর মিউজিয়াম ক্যাম্পাস, অ্যাডলার প্ল্যানেটোরিয়াম ও প্রাকৃতিক ইতিহাসের ফিল্ড মিউজিয়াম এর চারপাশটা ঘিরে রেখেছে। একটা শো দেখলাম, যেখানে বাজনার তালে তালে ডলফিন, পেঙ্গুইনরা লাফ দিয়ে দিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করছে। খুব ভাল লাগল।
এরপর একটা চিনা রেস্তোঁরায় লাঞ্চ করতে গিয়ে এতক্ষণের সব আনন্দ এক নিমেষে উবে গেল। শুনলাম চায়না টাউন থেকে একজন ওখানে গিয়ে রেস্তোঁরাটা খুলেছে। প্রতিটা খাবারের দামকে টাকার হিসাবে আনতে ষাট-বাষট্টি দিয়ে গুণ করে বুঝলাম, কোনটাই খাওয়া উচিত নয়। এক কাপ কফি ভারতের হিসেবে চারশ' টাকা দিয়ে কেনার কথা ভেবে আতঙ্কে হৃদরোগ হবার উপক্রম। আমার অবস্থা দেখে ছেলে হেসে ফেলে বললো, ওখানকার হিসেব করতে যেও না। মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমার ওনার অবশ্য মাথা খারাপের কোন লক্ষণ চোখে পড়ল না। অন্যান্য খাবারের সঙ্গে আমাদের এখানকার তিন টাকা ভাঁড় চায়ের মতো পরিমাণের কফির কাপে দিব্বি তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিল। তবে অস্বীকার করব না, প্রতিটা খাবার সত্যিই খুব সুস্বাদু।
এবার উইলস টাওয়ার (Willis Tower) দেখার পালা। শিকাগো শহরে সমস্ত বিল্ডিংই বিশাল বিশাল উঁচু। কিন্তু এদের মাঝে একশ' আট তলা, ১৪৫১ ফুট উচ্চতার (৪৪২ মিটার) টাওয়ারটা দেখে সেই "এক পায় দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে" মনে পড়ে গেল। সবথেকে অবাক হলাম এই জেনে যে ফজলুর রহমান খান নামে একজন বাংলাদেশি স্থপতি নাকি এই বিল্ডিংটা নির্মাণ করেছেন। ভিতরে ঢুকে টিকিট কাটার জন্য লাইন দিতে হল - বেশ ভিড়। টিকিট নিয়ে লিফটে উঠলাম। এক-একবারে দশতলা উঠে লিফট থামছে। একেবারে ওপরে গিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা হল। গোটা শিকাগো শহরটাকে একঝলকে দেখা যায়। বিশেষ করে একটা জায়গায় ওপর, নীচ ও চারপাশ কাচের হওয়ায় - সবদিকই পরিষ্কার দেখা যায়। সবাই ফটো তুলছে। আমরা চারজনও অনেক ফটো তুললাম বটে, তবে এখন বলতে লজ্জা নেই, তখন কাচ খুলে বা ভেঙ্গে গেলে কী হতে পারে ভেবে আতঙ্কে ছবি তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে পারি নি। ভয়মিশ্রিত বিচিত্র এই অভিজ্ঞতার কথা ভুলবার নয়।
ফেরার সময় বাসে উঠলাম - ওঠার সময়েই টিকিট কেটে নিতে হয়। বাসটা আগা-গোড়া কাচ দিয়ে ঘেরা, ফলে চারিদিক পরিষ্কার দেখা যায়। দাঁড়িয়ে যাবার কোনও ব্যবস্থা নেই। মনে হল কলকাতার বাসে চাপা আর এখানকার বাসে চাপার মধ্যে কত তফাৎ, এখানে সবকিছু কত নিয়মমাফিক।
আমেরিকানরা খুব উন্নাসিক হয় বলে শুনেছিলাম। একটু দূরত্ব বজায় রেখে চললেও, ওদের ভদ্রতা, সহবত ও সৌজন্যবোধ দেখে অবাক হতে হয়। মেয়েদের ওরা খুব সম্মান করে। বাচ্চাগুলো ফুলের মতো সুন্দর, কিন্তু ছেলে প্রথমেই সাবধান করে দিয়ে বলেছিল— ওদের দূর থেকেই দেখো, গায়ে হাত দিয়ে যেন আদর করতে যেও না।
ঠিক হল শুক্রবার বিকেলে মিশিগান যাব। মিশিগান একটা রাজ্য, আমরা মিশিগান-এর উত্তরভাগে, আপার পেনিনসুলা অঞ্চলে যাব। রাতটা সেখানে হোটেলে কাটিয়ে, পরদিন ম্যাকিনো দ্বীপে (Mackinac Island) যাওয়া হবে। আমাদের বাড়ি থেকে মিশিগান চার-পাঁচ ঘন্টার পথ।
গাড়িতে চড়ে লং জার্নির কথা এতদিন শুধু "এখনো তারে চোখে দেখিনি শুধু বাঁশি শুনেছি" র মতো শুনেই এসেছি, সুযোগ হয়নি। সুপ্ত বাসনা মনের গভীরে বাসা বেঁধেই ছিল। আজ ছেলের সৌজন্যে সেই বাসনাও চরিতার্থ হতে চলেছে! যদিও আমাদের শারীরিক কষ্ট ও অসুবিধা হবার সম্ভাবনা নিয়ে ছেলের উদ্বেগের সীমা ছিল না, আমি কিন্তু মানসিক ভাবে প্রস্তুত।
নির্দিষ্ট দিনে বেড়িয়ে পড়লাম। সুন্দর সুন্দর গান শুনতে শুনতে, সবুজ প্রকৃতির মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছি। এখানে সামারে অন্ধকার হতে প্রায় রাত ন'টা বেজে যায়। সন্ধ্যা সাতটাতেও ঝকঝকে রোদ থাকে। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এল। জার্নিটা দারুণ ভাবে উপভোগ করছিলাম, আর ছেলের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে ভাবছিলাম — এই কী আমার সেই ছেলে, যে সারাদিন কথায় কথায় বায়না করে ভ্যাঁভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিত? এই তো সেদিনও নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিয়ে জামা, প্যান্ট, জুতো, মোজা পরিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতাম। আনন্দে চোখে জল এসে গেল। ছেলে আজ কথায় কথায় যতই বলুক — বয়সটা একটা সংখ্যা মাত্র, মনে হল জীবনের অনেকগুলো দিন কেটে গেল।
হোটেলে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট খাবার ছিল, তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। আগামীকাল সকাল সকাল বেরতে হবে।
সকালে বেরোলাম দ্বীপ দেখতে। শুনলাম এটি নাকি পর্যটকদের কাছে ভীষণ ভাবে সমাদৃত। সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, যানবাহন বলতে শুধু ঘোড়ার গাড়ি ও সাইকেল। অবশ্য পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা যেতেই পারে। যাহোক, লঞ্চে করে নির্দিষ্ট দ্বীপে গিয়ে হাজির হলাম। স্বপ্নেও ভাবিনি যে একটা জায়গায় এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চারদিকে শুধু সবুজ। ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম। চারিদিকে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, বাড়িগুলো সব পুরোনো রীতির, নানারকম ফুলের সম্ভার, সুন্দর আবহাওয়া। সব মিলিয়ে এক অপরূপ নিসর্গ, আর তারই মাঝখান দিয়ে ঘোড়ার খুরের মৃদু শব্দ তুলে আমরা এগোলাম। ঘোড়াগুলোও দেখার মতো। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অঞ্চলে যেমন কঙ্কালসার ঘোড়া, গাড়ি টেনে নিয়ে যায়, একটাও সেরকম নয়। যেমন চকচকে চেহারা, তেমনি টগবগে চলার ধরণ। এখানে "ফাজ" নামে একরকম ক্যাডবেরি জাতীয় মিষ্টির অনেক দোকান চোখে পড়লো। খেতে ভারি সুন্দর।
ফেরার পথে একটা ঝরনা দেখতে গেলাম। গাড়ি রেখে অনেকটা পথ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হল। চুরানব্বইটা সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে যেতে হবে। আমার হাঁটুর সমস্যা থাকায়, ইচ্ছা থাকলেও অনেক দূর থেকেই দেখতে বাধ্য হলাম। এই ক'দিন এদেশে এসে ভেবেছিলাম, এখানে আর সবকিছু থাকলেও মশা নেই। কিন্তু একটা জায়গায় যে কত মশার বাস হতে পারে, এখানে না আসলে অজানাই থেকে যেত। মনে পড়ল ছেলেবেলায় পড়া – "মশায়, দেশান্তরি করলে আমায় কেশনগরী মশায়।" একটুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়াবার উপায় নেই। অনেকেই দেখলাম মসকুইটো নেট দিয়ে মুখ ঢেকে এসেছে। তাদের হয়তো পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। যাইহোক, মশা তাড়িয়ে, কামড় খেয়ে, কোনমতে কাটালাম। ছেলে মশার কামড় উপেক্ষা করেই বেশ কিছু ফটোও তুলল।
মিশিগান-এ আর একটা দেখার মতো জিনিস হল পিকচারড রক (Pictured Rock) নামে একটা জায়গা। লঞ্চে করে যাওয়ার সময় আপার ডেকে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে লোয়ার ডেকে নেমে আসতে বাধ্য হলাম। লঞ্চটা আমাদের বিভিন্ন রকম রকের ধারে নিয়ে যাচ্ছিল। খুবই সুন্দর, কিন্তু ওপর থেকেই বেশি ভাল দেখা যায় ও ফটো তোলা যায়। তাই আবার আপার ডেকেই উঠে এলাম। ঝকঝকে রোদ জলে এসে পড়েছে, তার সঙ্গে ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া, এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
ফেরার পথে উইসকনসিন (Wisconsin), বিভিন্ন ফার্ম হাউস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বাসায় ফিরে এলাম।
এবার নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখার পালা। তিনটি প্রপাত নিয়ে এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত। বড় থেকে ছোট ক্রমান্বয়ে ওগুলোর নাম— হর্স সু ফলস (Horse shoe falls), আমেরিকান ফলস (The American falls) ও ব্রাইডাল ভেল ফলস (The Bridel Veil Falls ।)। এটি উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় ও পৃথিবীর অন্যতম প্রশস্ত জলপ্রপাত।
৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। ওইদিন নায়াগ্রা জলপ্রপাতে নানারকম আতসবাজির খেলা দেখানো হয়। তাই ছেলে অনেক আগে থেকেই ওই দিনটায় নায়াগ্রা যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তিন তারিখ বিকেলে রওনা হলাম। ছেলের গাড়িতে প্রায় পাঁচ-ছয় ঘন্টা পাড়ি দিয়ে রাত কাটানোর জন্য একটা হোটেলে উঠলাম। পরদিন আবার যাত্রা করে, দুপুরবেলা পৌঁছে, হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, বেড়িয়ে পড়লাম।
দূর থেকে উত্তাল জলরাশির শব্দে চমকে গেলাম। নায়াগ্রা জলপ্রপাত আমেরিকা আর কানাডার মাঝে অবস্থিত। প্রপাতের কাছে এসে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বিশাল জায়গা জুড়ে সাদা জলরাশি উদ্দাম গতিতে অতল গভীরে লাফিয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল, কানাডার দিক থেকে নায়াগ্রার ওপর রঙিন আলোর মেলায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শুনলাম রাত দশটার পরে বাজি পোড়ানো শুরু হবে। উঃ! কী যে ভিড় বলে বোঝানো যাবে না। চারদিকে লোকের ভিড়ে হাঁটার উপায় পর্যন্ত নেই।
প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টা ওই ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরে, শুরু হল আতসবাজির খেলা। দেখে মনে হল এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সার্থক, এরজন্য পাঁচ ঘন্টা কেন, পনের ঘন্টাও দাঁড়িয়ে থাকা যায়। সে যে কী দৃশ্য, মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। ওই উত্তাল জলরাশির মধ্যে যখন নানা রঙের আলো পড়ছিল, তার সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। অতক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, শেষে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
পরেরদিনের গন্তব্য নায়াগ্রা ভিজিটর সেন্টার। এখানে দর্শনীয় স্থানগুলোর জন্য পাস সংগ্রহ করতে হবে। এর জন্য অনেকক্ষণ লাইন দিতেও হল। উঠলাম "মেইড অফ দ্য মিষ্ট" বোটে। প্রত্যেককে নীল রঙের ফিনফিনে জ্যাকেট পরতে হল। বোট এগিয়ে চলল। সামনে আমেরিকান ফলস, বিশাল উঁচু থেকে ভীষণ শব্দে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সারা শরীর জলের ছাটে ভিজে যাচ্ছে। বোট থেকে নেমে, ঘোর কাটতে অনেক সময় নিল।
নায়াগ্রার আর এক আকর্ষণ, বলা ভালো সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, "কেভ অফ দ্য উইন্ড"। এখানে যাওয়ার জন্য সকলকে হলুদ রঙের স্বচ্ছ রেন কোট, আর স্যান্ডাল দেওয়া হয়েছিল। নায়াগ্রা নদীর সমতল থেকে লাল রঙের কাঠের সিঁড়ি এঁকেবেঁকে উপরের দিকে উঠে গেছে। ঐ সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে প্রথমে বেশ ভয়ভয় করছিল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই, ক্রমশঃ বেড়ে চলা জলস্রোতের তীব্রতা অনুভব করতে পারছিলাম। শুনলাম পৃথিবীর আর কোথাও কোন জলপ্রপাতের এত ঘনিষ্ঠ হয়ে স্রোতবেগ, জলোচ্ছাস অনুভব করার সুযোগ নেই। তীব্র জলোচ্ছাসে আকাশ বাতাস পুরো বাষ্পীয় ওড়নায় যেন আবৃত। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। বেশ কিছুক্ষণ এই সৌন্দর্য দু'চোখ ভরে শুষে নিয়ে ফিরে এলাম।
আমাদের ফেরার টিকিট আগষ্ট মাসের দুই তারিখে। কাজেই নায়াগ্রা দেখে ফেরার পরও আমাদের হাতে অনেক সময় ছিল। কাছাকাছি অনেক জায়গাই ঘুরলাম। একটি দক্ষিণ ভারতীয় ও একটি গুজরাটি মন্দির আছে। বিরাট এলাকা নিয়ে মন্দির দুটো তৈরি। অনেকটা বড় সুন্দর সবুজ লন আর ফুলের বাগান। এখানে প্রচুর গুজরাটি ও দক্ষিণ ভারতীয় বসবাস করেন। গুজরাটি মন্দিরটায় সন্ধ্যারতি দেখলাম। মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী সামনের সারিতে পুরুষ ও পিছনের সারিতে মহিলারা বসেন। আরতি দেখে ওদের ক্যান্টিনে অনেকদিন পরে পরমানন্দে সিঙ্গাড়া ও ধোকলা খেলাম। একদিন গেলাম একটা বাংলাদেশি মার্কেটে বাজার করতে। দেখি আশপাশে সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলছে। ছেলে আমাদের পছন্দের ইলিশ, কই, পারশে, বোয়াল ইত্যাদি অনেক প্রকার মাছ কিনল। আবার একবার যাট-বাষট্টি দিয়ে গুণ করে ভাবছি, এদেশের লোকগুলো কীভাবে বেঁচে আছে? মাছ কিনতেই চার হাজার টাকার ওপর চলে গেল। ফিরে আসার আগে আরেকবার শিকাগো শহরে গেলাম। ওখানে মিলেনিয়াম পার্ক আছে। সেখানে উল্লেখযোগ্য দেখার জিনিস বিন (Bean), যাকে নাকি শিকাগোর ট্রেড মার্ক বলা হয়। ড্রপ অফ মার্কারি (Drop of Mercury) তে সব কিছুর প্রতিবিম্ব দেখা যায়। ভীষণ সুন্দর। তাছাড়া সামারে প্রতি শনি-রবিবার, মিশিগান লেকের ওপর ফায়ারওয়ার্কস হয়। আতসবাজির আলোয় চারিদিক রঙিন হয়ে যাচ্ছিল। খুব ভালো লাগল।
আসলে আমেরিকানরা ওদেশের গরমের সময়টা দারুণভাবে উপভোগ করে। শীতে তো শিকাগোয় বরফ পড়ে। গরমের সময় সবাই উইকএন্ডে বেড়িয়ে পড়ে। তখন অনেকক্ষণ অবধি সূর্যালোক থাকে, আর ওরা যতটা পারে রোদটাকে গায়ে লাগাতে ভালবাসে। সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে বয়স্কদের দেখে। কী সাঙ্ঘাতিক এনার্জি। কেউ কেউ আবার দৌড়াচ্ছে। ওরা সত্যিই জীবনটাকে উপভোগ করতে জানে। আমার ছেলে তো সবসময় আমাকে বলত— "তোমরা সারাক্ষণ পায়ে ব্যথা বল, এদের দেখে শেখ"।
যাহোক, দেখতে দেখতে আগষ্ট মাসের দুই তারিখ, অর্থাৎ ফেরার দিনটা চলে এল।
দুটো মাস যে কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে এতদূর চলে আসা যে কতখানি বেদনাদায়ক, তা কোনও বাবা-মা ছাড়া আর কে অনুভব করতে পারবে?
তবে ও যে দেশে আছে, সেখানে খুবই ভাল আছে, এটাই একমাত্র সান্ত্বনা। ছেলে বলল,"মন খারাপ কোরো না, প্রতি সামারে তোমরা এখানে চলে এস।" এবারের মত আমেরিকা সফর সাঙ্গ করে, ধীরে ধীরে উড়োজাহাজে উঠে নিজেদের সিটে গিয়ে বসলাম।
~ শিকাগোর আরও ছবি ~
সুস্মিতা রায়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাওড়া জেলায়। কর্মসুত্রে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ডিরেক্টর। নেশা বই পড়া ও গান শোনা। বিদেশ ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই প্রথম কলম ধরা।