অলৌকিক রাতে কুয়াশাভেজা মৈনাম-লা
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
"Do not go where the path may lead, go instead where there is no path and leave a trail" -Ralph Waldo Emerson
একটি বিপত্তি এবং...
যাত্রার শুরুতেই হোঁচট খেলাম। রাত ৮.৩০-এর কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস-এর এস-৭ কামরায় ওঠার সময়েই বিপদ। নীলাদ্রির রুকস্যাকের হাল্কা টোকায় আমার চারচোখের দুটো, অর্থাৎ আমার সাধের চশমা ট্রেনের তলায়। স্পেয়ার আনিনি। ট্রেন ছাড়তে মাত্র আধঘন্টা বাকি। আশেপাশে সবাই হা-হুতাশ করলেও সাহায্য কেউ করছে না। টর্চ জ্বেলে দেখা গেল মৃত্যু ঘটেনি তার, কিন্তু তিন-চারটে বড় বড় ইঁদুর ওটার ওপর দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে। শেষমেষ আমার সবসময়ের লাইফ-সেভার নীলাদ্রির দ্বারস্থ হলাম। জুতো-মোজা খুলে পা নামিয়ে আঙুলের ফাঁকে গলিয়ে বেশ কায়দায় তুলে আনল জিনিসটা। কোনোমতে চশমাটা হস্তান্তর করেই বলল-"বাপরে কী বড়ো বড়ো ইঁদুর, আর-একটু হলে আমায় খেয়েই ফেলছিল"। ট্রেনের হর্ন বেজে ছাড়ার সাথে সাথেই মনে মনে "দুগগা দুগগা" বলে হাতজোড় করে পেন্নাম ঠুকলাম, যাত্রা শুরু।
যবনিকা উত্তোলন...
পদাতিকের এক গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার সুদীপের সামনেই বিয়ে। তার হবু ম্যাডাম আমাদের একরকম থ্রেট দিয়েই রেখেছিল যেন এই বছর ট্রেক-এর নামও না উচ্চারণ করে ও, তাহলে মার আমরা খাব! অগত্যা বড় কোনো ট্রেকের প্ল্যান পরিত্যাগ করে ছোট অথচ অফবিট কোনো কিছুর কথা ভাবা হচ্ছিল। ২০১৩-এর নর্থ সিকিম ট্যুরের সময়েই ভেবেছিলাম "মৈনাম-লা" ট্রেকের কথা। কিন্তু সেবার ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হওয়ায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার ভেবেই মনটা নেচে উঠল। একটু পড়াশোনা, একটু খবর জোগাড় এবং ইস্ট সিকিমের মনোরম শহর রাবংলায় এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের হলিডে হোম বুকিং সেরে বেড়িয়ে পড়া গেল অক্টোবরের শেষ হপ্তায়। পদাতিক অপূর্ণই থেকে গেল সুদীপকে ছাড়া। মনখারাপকে সঙ্গে করে প্রিয় কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখ আবার নতুন করে দেখার পাগল নেশায় আমি, সৌনিপ আর নীলাদ্রি বেরিয়ে পড়লাম শিয়ালদা স্টেশনকে বিদায় জানিয়ে।
সূর্যোদয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা...
দুরন্ত গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। হাল্কা ঠাণ্ডায় চাদর মুড়ি দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। ট্রেন সবে কিষানগঞ্জ পেরিয়েছে, সৌনিপ বলল-"কাকারা (ওর পেটেন্ট সম্বোধন) জানলা দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখ... 'কাঞ্চা' (কাঞ্চনজঙ্ঘার আদুরে ভার্সন) মুখ বাড়িয়েছে...এখান থেকেই"। হুড়মুড় করে মিডল বার্থ থেকে নেমে জানালায় প্রায় চোখ ঠেকিয়ে দেখলাম...সত্যি, ওই দূরে দেখা যাচ্ছে তাকে! আবছা কুয়াশায় আর আবছা কমলা-গোলাপি আলোয় ঢাকা, কিন্তু বেশ চেনা যায়। মন ভালো করা এক বুক আশা নিয়ে শিডিউলড টাইমের মাত্র আধঘন্টা পরে এনজেপি পৌঁছালাম। সব গাড়িওলারা পিঠে রুকস্যাক দেখে ধরে নিল আমরা গোয়েচালা ট্রেক করতে ইয়ুকসাম যাব। রাবংলা যেতে চাই শুনে কেউ রাজি হল না। একজন হিতাকাঙ্ক্ষী বললেন -"আপনারা তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড চলে যান। ওখান থেকে বাস পেয়ে যাবেন''। তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডে এসে জানা গেল বাস ছাড়বে বটে, কিন্তু দুপুর একটায়। কী আর করা, বাধ্য হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র ট্যাক্সিটাকেই রিজার্ভ করতে হল। পকেট কাঁদলেও উপায় নেই। অগত্যা ভগবান ভরোসে - দীর্ঘ পথযাত্রা শুরু।
চার হিন্দু দেব ও এক 'অ্যাংরি বুদ্ধা'...
আমাদের ড্রাইভার দাদা বেশ খোশমেজাজি। আমরা মৈনাম ট্রেক-এ যাচ্ছি শুনে একটু আশ্চর্য হলেন। বললেন ওটা একটু অফবিট আর নভেম্বরটা একেবারেই অফ সিজন। আমাদের যা গাড়িভাড়া ঠিক হয়েছিল, বললেন তার থেকে ৫০০ টাকা বেশি দিলেই আমাদের সাইড ট্যুর করিয়ে একেবারে হোটেলে পৌঁছে দেবেন। আমরাও রাজি হয়ে গেলাম। রাবং থেকে ২৫ কিমি মতো আগে নামচিতে একটা নতুন মন্দির কমপ্লেক্স আছে। চারধাম মন্দির। জন প্রতি পঞ্চাশ টাকার টিকিট। বিশাল জায়গা জুড়ে বদ্রীনাথ ধাম, দ্বারকানাথ ধাম, পুরীধাম এবং রামেশ্বরম এর মন্দিরগুলির রেপ্লিকা। তার মধ্যে দেবতারাও একই ভাবে অধিষ্ঠিত এবং পূজিত হয়ে চলেছেন প্রতিদিন। কিরাতবেশী মহাদেব যেন দ্বাররক্ষী হয়ে সবাইকে আগলে রেখেছেন। এক আঙ্গিনায় হিন্দু পুরাণের চার-চারটি বিশাল অধ্যায় সত্যিই দেখার এবং মন ভালো করে দেওয়ার মতো।
ওখান থেকে বেরিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের রেশ কাটতে না কাটতেই পৌঁছে গেলাম সমদ্রুপ্তসে মনাস্ট্রিতে। গেটে তিরিশ টাকা করে তিনটে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতেই লম্বা একফালি পিচরাস্তা স্বাগত জানাল, পাশে একটানা রঙিন প্রজাপতির মতো প্রেয়ার ফ্ল্যাগ সঙ্গে নিয়ে। মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা ছোট পাহাড়ের মাথায় দেখা পাওয়া গেল তাঁর। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু (১২০ ফুট) গুরু রিমপোচে বা পদ্মসম্ভবের মূর্তি এই সমদ্রুপ্তসে-তেই। এই মূর্তি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে 'অ্যাংরি বুদ্ধা' নামে পরিচিত। সেই বিশালত্বের সামনে নিজেদেরকে বড়োই ক্ষুদ্র এবং দীন মনে হচ্ছিল। যথাসম্ভব পোজ দিয়ে একগাদা ছবি টবি তুলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ রাতের আশ্রয় রাবং-এ পৌঁছে গেলাম।
দুশমন দুঃসংবাদ...
পুরোনো দিনের হিন্দি ভূতের সিনেমার চৌকিদারদের মতো হনুমান টুপি আর কম্বলের চাদরমোড়া এক বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের স্বাগত জানালেন তাঁর হোটেলে। আমরা এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বুক করেছিলাম বলে সস্তাতেই পেয়েছিলাম। সারাদিনের ক্লান্তির পর ভালো ঘর পেয়ে মনটা খুশ হয়ে গেল। একটু ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতে ভদ্রলোক বললেন আপনাদের মৈনাম ট্রেকের গাইড এসে গেছে, কথা বলে নিন। গাইডকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ। ক্লাস নাইনে পড়া সূরজ ও তার ক্লাসমেট নাকি আমাদের গাইড! বলল কমপক্ষে ২০০০ টাকা দিতে হবে এবং খাওয়ার খরচও। পাহাড়-জঙ্গলে ট্রেক সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আইডিয়া তাদের আছে বলে মনে হল না। আরোও বলল মৈনাম পিক-এ কেউ রাত্রিবাস করে না। রাত্রে থাকার কোনও জায়গা নাকি নেই। আমরা টেন্ট নিয়ে যাইনি। মহা বিপদেই পড়া গেল। সূরজ এও বলল যে একদিনেই উঠে নেমে আসা ছাড়া নাকি কোনও উপায় নেই। আর ওখান থেকে ভালেদুঙ্গা সানরাইজ পয়েন্টও যাওয়া যাবেনা। ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা কী করব ভেবে জানাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়লাম।
মনটা ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল। যে জন্য আসা সেটাই হবেনা! আমাদের পরেরদিন এই ট্রেক শুরু করার প্ল্যান ছিল। তাই হোটেল বুকিংও ছিল না। মালিক বেশি টাকা চেয়ে বসলেন ওই একই রুমের জন্য। অন্য বাঙালি হোটেল দেখতে গিয়ে নীলাদ্রি আর সৌনিপ মির্যাকল করে ফেলল। হোটেল পাওয়া গেল। আর তার সঙ্গে পাওয়া গেল গাইড মনি গিরি-কেও। মাত্র ১৭০০ টাকায় সে রাত্রে থাকার জন্য রাজি হয়ে গেল। আমরা ঠিক করলাম একদিন অ্যাক্লেমাটাইজ করে পরের দিন রওনা দেব। বাকি সন্ধেটা আড্ডা মেরে, হাল্কা পথ পরিক্রমা করে, চিপস আর কফি খেতে খেতে টিভিতে আই.এস.এল-এর আটলাটিকো দি' কলকাতার খেলা দেখে কেটে গেল।
রাবংলার অভিষেক...
আমাদের গুগল কাকু সৌনিপ বেশ পড়াশোনা করেই এসেছিল আশেপাশে দেখার কী কী জায়গা আছে সেগুলো নিয়ে। কচুরি-তরকারি আর জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারার পর ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে সাইড ট্যুর নিয়ে দরাদরি চলছিল। দামে পোষাচ্ছিল না বলে পিছিয়ে আসছিলাম বারবার। হঠাৎ একটা অল্টোর দিকে নজর গেল। ঝাঁ চকচকে। বেশ ফ্যাশনেবল এবং বড় বড় করে নাম লেখা "অভিষেক"। আমরা হাসাহাসি করছিলাম। নীলাদ্রি বলল, "ওই দ্যাখ তোর নিজের টাক্সি থাকতেও আমাদের নিয়ে যাচ্ছিস না"? তখন গাড়ির মালিক মূর্তিমান অভিষেক সামনে হাজির। সত্যিই অন্যদের ভাড়া কম চাইতে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথম গন্তব্য "টেমি টি গার্ডেন"। ওখানে পৌঁছে কয়েকটা ছবি তুলেই আবার হই হই করে ছোটা হল "বুদ্ধ পার্কের দিকে"। ঠিক হল আগে "বুদ্ধ পার্ক"-কে ফেলে রেখে "রালং মনাস্ট্রি" যাব। ফেরার পথে ওখানে ঢোকা হবে।
রালং-এ পৌঁছে মনটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। মূল শহর থেকে ৭ কিমি দূরে এই মনাস্ট্রি। বলা হয় তিব্বতি বৌদ্ধদের 'কাগয়্যু সম্প্রদায়' এই মনাস্ট্রি তৈরি করান পনেরোশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। এই মঠ প্রাচীন বৌদ্ধ চিত্রকলা এবং থাংকার জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এখানে "পাং লাবসল" নামে একটি উৎসবে কাঞ্চনজঙ্ঘার পুজো করা হয়। আমরা মূল প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে হতবাক হয়ে প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন দেখলাম। এতই মনমুগ্ধকর সেই চিত্রকলা যে ছবি তোলার কথা কারো মনেও রইল না।
বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশ কালো করে এসেছে। নীল-ছাই আর কালচে আকাশের প্রেক্ষাপটে একঝাঁক লালচে-মেরুন জোব্বা পরা তরুণ লামা পাঁচিলের উপরে বসে। অসাধারণ দৃশ্য। আমাদের বন্ধু ড্রাইভার অভিষেক হাঁক দিল। রওনা দিলাম বুদ্ধ পার্কের দিকে। বুদ্ধ পার্কের আর-এক নাম "তথাগত সাল (Tathagata Tsal)"। ২০০৬ সালে এই পার্ক বানানোর কাজ শুরু করে সিকিম সরকার। ২০১৩ সালের ২৫ মার্চ গৌতম বুদ্ধের ২৫৫০-তম আবির্ভাব দিবসের দিন দলাই লামা এর শুভ উদ্বোধন করেন। পার্কের মূল আকর্ষণ ১৩০ ফুট উঁচু গৌতম বুদ্ধের ধ্যানী মূর্তি। অসাধারণ এই পার্কের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। ছবি তুলে আশ মিটছিল না। কিন্তু পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছিল আর আকাশের অবস্থাও ভালো ঠেকছিল না। অগত্যা হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ। বিকেল বেলা বেরোনো হল হাঁটতে। পাশের কিউরিয়ো শপ থেকে টুকিটাকি জিনিস আর মৈনাম-লা এর ভগ্ন মনাস্ট্রিতে জ্বালানোর জন্য ধূপ আর প্রেয়ার ফ্ল্যাগ কিনে হোটেলে ফিরলাম। দূরে মৈনাম-লা দেখা যাচ্ছিল। কুয়াশা আর মেঘে মাখামাখি হয়ে থাকা গহীন বনের ওপর একটু ফাঁকা জায়গা। বাকিদের মনে কী হচ্ছিল জানি না, আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম। ওই জনমানবহীন জঙ্গলে এই বীভৎস ঠাণ্ডায় আমরা কি রাত্রিবাস করতে পারব!
মন রে...নাহয় পকেটে খুচরো পাথর রাখলাম...
উত্তেজনায় রাতে ঘুম হয়নি কারোরই। সকালে উঠে দরকারি কাজকর্ম সেরে লাঞ্চ প্যাক করে তৈরি হয়ে গেলাম আটটার মধ্যেই। আধ ঘন্টার মধ্যে গাইড মণি গিরি-কে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। একশো টাকার বিনিময়ে সে আমাদের পৌঁছে দেবে মৈনাম স্যাংচুয়ারির গেট পর্যন্ত। মিনিট দশেকে পৌঁছে গেলাম। ভিতরে ঢুকেই পিকচার পোস্টকার্ডের মতো ছোট্ট সাদা রঙের বন দফতরের অফিস চোখে পড়ল। তিন জনের ট্রেক ফি এবং ক্যামেরা ফি মিলে দিতে হল ২১০ টাকা। রাতে থাকব বলে টেন্টের চার্জ আরো একশো টাকা (দুটো টেন্টের জন্য)। আমাদের টেন্ট ছিল না, তাও মিথ্যে বলতে হল। নইলে থাকার অনুমতি মিলত না। ঘড়ি দেখে সকাল পৌনে ন'টায় পা বাড়ালাম গভীর জঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
"মৈনাম" কথার আক্ষরিক অর্থ "ভেষজ উদ্ভিদের গুপ্তধন"। এই বিশাল ৩৫ বর্গ কিলোমিটারের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে স্যাংচুয়ারির মর্যাদা দেওয়া হয় ১৯৮৭ সালে। এই স্যাংচুয়ারিতে বিভিন্ন ধরনের আয়ুর্বেদিক বনৌষধির ভান্ডার মজুত আছে। পাহাড়ি চিতা, ভালুক, রেড পান্ডা, হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির বাঁদর এবং হিমালয়ান ফেজ্যান্টের বসবাসস্থল এই পাহাড়। বর্ষাকালে ভীষণ জোঁকের উৎপাত থাকে এই জঙ্গলে। মৈনাম শীর্ষ স্যাংচুয়ারির গেট থেকে প্রায় ১৩ কিমি পথ। আধঘন্টাটাক এগোনোর পরেই পায়ে চলা রাস্তা প্রায় উধাও হয়ে গেল। মনি বলল আরও মোটামুটি ৫-৬ কিমি হেসেখেলে মোবাইলের টাওয়ার থাকবে। ও আমাদের সামনের একটা রাস্তা দিয়ে ঘুরে আসতে বলল, আর নিজে জঙ্গলের মধ্যেকার এক সুতীব্র বিপদসংকুল শর্টকার্ট চড়াই বেছে নিয়ে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যাপারটা একেবারেই ভালো না লাগলেও আমাদের কিছু বলার সুযোগই ছিল না। অগত্যা ওর বলা প্রায় না বোঝা যাওয়া কাঁটাভরা জঙ্গুলে পথে এগোতে লাগলাম। কাল রাতে ঘুমানোর সময় মোবাইলে শোনা চন্দ্রবিন্দুর গানের একটা লাইন মাথায় ঘুরছিল -"মন রে...নাহয় পকেটে খুচরো পাথর রাখলাম..."।
জোঁকে-জঙ্গলে...
বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছিল। ঘন গভীর সদ্য কুয়াশা ভেজা স্যাঁতসেঁতে জঙ্গলের বুনো গন্ধ নাকে টেনে এগিয়ে চলেছি কাঁটা ঝোপের দুর্নিবার আলিঙ্গন উপেক্ষা করে। মাঝে মাঝে ছবি তোলা, ভিডিও তোলা আর জল-চকোলেট খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু করে বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছিলাম আমরা। মনি গিরির টিকিটিও দেখা যাচ্ছেনা। একটা সময় নিশ্চিত মনে হতে লাগল আমরা পথ হারিয়েছি। মোবাইলের টাওয়ারে একটা মাত্র দাগ আসছে যাচ্ছে। ফোনে পাওয়া গেল ওকে অনেক চেষ্টার পর। যা হয় হোক ভেবে এগিয়ে যেতে যেতে ওর নাম ধরে পালা করে জোরে চিৎকার করতে থাকলাম। হঠাৎ নীলাদ্রি কাঁধ খামচে দাঁড় করাল। আমার বাঁ হাতের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছেন যিনি তাঁর অস্তিত্ব মোটেই টের পাইনি। মৈনাম পাহাড়ের কুখ্যাত রক্তচোষা জোঁক বাবাজি। কে জানে বাবা আরও কত ভিতরে ঢুকে আছে এই ভাবতে ভাবতে কিছুটা এগোতেই মনি বাবুর দেখা মিলল।
হারাধনের চারটি ছেলে, রইল বাকি দুই...
মনি নেপালি ছাড়া বোঝে না ভালো। হিন্দির অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা ওকে অনেক কষ্টে বোঝাতে পারলাম যে আমরা চাই ও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুক। কিছুটা রাস্তা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলল। কিন্তু কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। কিছুক্ষণ বাদেই জঙ্গলের ভিতর আবার হারিয়ে গেল। একটা এমন জায়গায় তিনজনে এসে পৌঁছলাম যেখানে দুটো শর্টকাট ছিল। কোনটায় যাওয়া উচিত ঠিক করতে না পেরে দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলাম। ঠিক হল সৌনিপ একটা রুট স্কাউট করবে আরেকটা আমি আর নীলাদ্রি। মিনিট পনেরোর মধ্যে রাস্তা খুঁজে না পাওয়া গেলে আবার এখানেই দেখা করব। আইডিয়াটা বিপজ্জনক হলেও কিছু করার ছিল না। কিছুটা চড়াই পেরোতেই একটা পাথর বিছানো চওড়া রাস্তা খুঁজে পেয়ে গেলাম। ওখানে দাঁড়িয়ে সৌনিপের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু ওর আর পাত্তা নেই। মিনিট কুড়ি হয়ে গেল। ফোনেও ওকে ধরতে পারছিলাম না। টাওয়ারই ছিল না। নীলাদ্রিকে বললাম তুই এখানেই থাক আমি এগিয়ে দেখি। রুকস্যাকটা নামিয়ে একটু এগোতেই দেখলাম একটা গাছ গোড়া থেকে ভেঙে রাস্তার উপর পড়ে আছে। সৌনিপের নাম ধরে জোরে চিৎকার করতে করতে এগোতে থাকলাম। খানিকটা এগোতেই সাড়া পাওয়া গেলো। ও ভেবেছিল রাস্তা শেষ ভেবে আমরা পুরোনো জায়গায় ফিরে গেছি। হারাধনের এক ছেলেকে তো পাওয়া গেল। আর-একজন কই? সৌনিপের কাছে ফিরতে দেখি মনিবাবু বসে গল্প জুড়েছেন। আর কতক্ষণ বাকি জিজ্ঞেস করতে বলল-"জি আভি ভি এক ঘন্টা লাগেগা"। খিদেয় পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। ঠিক হল রাতের আশ্রয়ে পৌঁছেই খাওয়া হবে।
রহস্যময় ভগ্নস্তূপ এবং পৈশাচিক বুদ্ধ...
টানা ছ'ঘন্টা হাঁটার পর আকাশ যখন মেঘে ঢাকতে শুরু করেছে, দু-চার ফোঁটা বরফ ঠাণ্ডা জলের টুকরো মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে, দূরে দেখতে পেলাম আমাদের রাত্রিবাসের আস্তানাটাকে। সাদা রঙের একটা ভেঙে পড়া একতলা সিমেন্টের ঘর। যার গায়ে অজস্র কাঠ পোড়ার দাগ। একটু ভয়ই পেলাম। এই মারাত্মক ঠাণ্ডায় এই জানালা-দরজা ভাঙা পাহাড়ের ঢালে নুয়ে পড়া বাড়িটায় সারারাত কাটাতে হবে? আমরা ভেবেছিলাম মৈনাম পিক-এ অবস্থিত ভগ্ন মনাস্ট্রিতে রাত কাটাব। ইন্টারনেটে পড়া ব্লগে ডিটেলিং-এর অভাব অজানা বিপদের আশঙ্কা এনে দিল। কেন টেন্ট আনলাম না এইসব ভাবতে ভাবতে ঘরটায় ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে অনেকটা ভালো লাগল। মেঝেয় খড় এর ওপর টিন পাতা। তাতে একটা ম্যাট্রেসও পাতা আছে। আমাদের নিজেদের ম্যাট্রেসগুলো পেতে স্যাকগুলো নামিয়ে রাখলাম। মনি গেল কাঠ জোগাড় করতে। বিকেল হয়ে আসছে, ঠাণ্ডাও বাড়ছে। ৫-৬° সেলসিয়াস মতো হবে। খুব খিদে পাচ্ছিল। হোটেল থেকে বানিয়ে আনা রুটি তরকারি এক থালাতেই খেতে শুরু করলাম। একটু পর দেখি মনি হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বলল-"আপলোগ ভাই হেঁ ক্যা?" আমরা বললাম "নেহি, হম দোস্ত হেঁ"। অবিশ্বাসী চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফের বলল-"আপ লোগো মে বহুত প্রেম হ্যায়, এক থালি সে খা রহে হো"। এই অযাচিত কমপ্লিমেন্ট পেয়ে আমরা হাসতে শুরু করলাম।
খাওয়ার পর আমরা ভাঙা মনাস্ট্রির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এবার আর মনি আমাদের সঙ্গে এল না, জিনিসপত্র পাহারা দেওয়া আর আগুন জ্বালানোর জন্য থেকে গেল। ঘন্টাখানেকের তীব্র চড়াই পেরিয়ে যখন মনাস্ট্রির সামনে গিয়ে পড়লাম দিনের আলো কমে এসেছে। সামনে গিয়ে গাটা কেমন ছমছম করে উঠল। কেউ কোত্থাও নেই। একদম পাহাড়ের মাথায়। ঠিক পায়ের নীচে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। দরজায় তালা নেই। হাতল টেনে খুলতেই একঝাঁক অন্ধকার গ্রাস করে নিল। টর্চ আনিনি। ভিতরে ঢুকে চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগল। সামনে সোনালি অ্যাংরি বুদ্ধা গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তি। হাতে স্বর্ণাভদণ্ডে গাঁথা নরমুন্ড। মুখে এক পৈশাচিক অভিব্যক্তি। সত্যি ভয় পাওয়ানোর মতো। সামনে থাকা দেশলাই দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। আলো খুব কমে এসেছে। ঝটপট কয়েকটা গ্রুপ ফোটো তুলে দ্রুত নামতে শুরু করলাম। সন্ধে হয়ে আসছে। মেঘ আর কুয়াশা জড়াজড়ি করে আস্তে আস্তে কনিফারের বড়ো বড়ো গাছগুলোকেও ঢেকে ফেলছে। ভাল্লুকের পাল্লায় যাতে না পড়তে হয় তাই জোরে জোরে কথা বলতে বলতে নামতে লাগলাম। মনে মনে একটাই কথা ঘুরছিল। এই ঠাণ্ডায় যেন বৃষ্টিতে না ভিজতে হয়।
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...
আগুনের ধোঁয়া দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। আমরাও ফেরার সময় যতটা পারলাম কাঠ নিয়ে এলাম সঙ্গে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। সারাদিন ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। প্রায় ১৮ কিমি হেঁটে ফেলেছিলাম সারাদিনে। শরীরটা হঠাৎ করে বেশ খারাপ লাগতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম অ্যাসিডিটি হয়ে গেছে। বমি পাচ্ছিল। সঙ্গে ওষুধ ছিলই। স্লিপিং ব্যাগটা পাতারও শক্তি ছিল না। সৌনিপ আর নীলাদ্রি পেতে দিল। আসলে আমাদের জল খুব কম খাওয়া হয়েছিল। মনি বাবু নিজের লাগেজ ছাড়া কিছু বইতে রাজি হননি। তিনজনে ছ'লিটারের বেশি জল ক্যারি করতে পারিনি। তার মধ্যেও ও ভাগ বসিয়েছিল। মৈনাম পাহাড়ে জলের কোনো সোর্স নেই। ছ'লিটার জলে চারজনের দু'দিন চালানো ভীষণ মুস্কিল। নিজেকে বলতে থাকলাম চুপ করে ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকি ঠিক হয়ে যাবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম। স্লিপিং ব্যাগের ভিতরটা গরমই হতে চাইছিলনা। মনি ঘরের মধ্যেও একটা আগুন জ্বেলে দিল। উষ্ণতার চেয়ে ধোঁয়াই হচ্ছিল বেশি। হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গায়ে হাল্কা টোকা খেয়ে তন্দ্রা ভাঙল। "কাকা জেগে আছিস? শরীর ঠিক লাগলে একবার বাইরে চল"।
শরীর অনেকটা সুস্থ লাগছিল। জুতোটা গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি আগুন নিভু নিভু। একটা গনগনে লাল আভা বেরিয়ে আসছে শুধু। চারিদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শুক্লা দ্বাদশীর প্রায় পূর্ণ জ্যোৎস্নায় এক অপূর্ব মায়াময় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, পান্ডিম, কুম্ভকর্ণ এবং আরও কিছু চিনতে না পারা শৃঙ্গ। অলৌকিক সেই দৃশ্য এই পার্থিব জগতের থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেল আমাদের। প্রতি পূর্ণিমা রাত্রে এই অলৌকিক দৃশ্যের অভিনয় হয়ে চলেছে এই প্রত্যন্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে। আর এই সময়, এই কুয়াশার চাদর গায়ে মেখে, হাত পা অসাড় করা ঠাণ্ডায় এই গভীর জঙ্গলে সেই অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যের অনুভূতি বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। কিছুতেই সেই দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করা গেল না। অত ভালো ক্যামেরা আমাদের ছিল না। তাই মনের ক্যামেরাতেই সারাজীবনের মত ধরে রাখলাম। এই পান্ডববর্জিত পাহাড়শীর্ষে রাত কাটানোটা ভীষণ সার্থক মনে হল।
ভোরের ভালেদুঙ্গা...
ভোর পৌনে পাঁচটায় ঘুম ভাঙল। অবশ্য বলা ভালো আর শুয়ে থাকা গেল না। আমার জীবনে কাটানো সবথেকে কষ্টকর রাতের একটা ছিল ওই রাতটা। পাশ ফিরলেই ঠাণ্ডা ভিজে স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালটায় হাত ঠেকে যাচ্ছিল। আগুন নিভে গিয়ে ধোঁয়ায় ভরে গেছিল ঘরটা। একটা বরফ-শীতল ছুরির মতো হাওয়া স্লিপিং ব্যাগের ভিতরেও কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। যেদিকে ফিরে শুই উল্টোদিক জমে ঠাণ্ডা বরফ হয়ে যায়। ভোরের ফিকে আলোয় যেন প্রকৃতি অন্যরকম মমতায় আমাদের ডাক দিল। কাল রাতে রুপো-গলা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছি। আজ ভোরের আলোয় সোনায় মোড়া দেখতে হবে। ঠিক পাঁচটা বেজে দশ মিনিটে প্রায় ১.৫ কিমি দূরের ভালেদুঙ্গা টপ-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী ওখানে পুজো দিলে মনকামনা পূর্ণ হয়। আমরাও পুজোর জন্য ধূপকাঠি আর প্রেয়ার ফ্ল্যাগ নিয়ে নিলাম। দেখি মনি তার ভোজালিটা কোমরে গুঁজছে। কী হবে এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বলল-"জি সুবহ কো না ভালু নিকলতা হে খানা ঢুঁন্ডনে। ভালু আয়া তো কাট দেগা"। মনির ওই পাঁচ ফুটের রোগা শরীরে কী করে 'ভালু কো কাটেগা' ভাবতে ভাবতে এগোতে থাকলাম।
সকালের "ফ্রেশ লেগস" এর জোরে পৌনে ছ'টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ভালেদুঙ্গা টপ-এ। দূরে মেঘের ফাঁকে ভোরের সূর্য সবে ঊঁকি দিতে শুরু করেছে। উল্টোদিকে গোলাপি আভা লাগছে কাঞ্চা'র গায়ে। ঠিক লাজে রাঙা নতুন বউয়ের মতো। ধীরে ধীরে সূর্যদেব তাঁর প্রকাশ ছড়াতে শুরু করলেন। সোনা-গলা রোদ্দুর মেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে অভিবাদন জানাল কাঞ্চা ও তার সঙ্গীরা। ধূপ জ্বালিয়ে আর ঘন্টা নাড়িয়ে পুজো সম্পন্ন করলাম নিজেরাই। প্রেয়ার ফ্ল্যাগও বাঁধা হল। পাহাড় চূড়ার বাধাহীন অনাবিল হাওয়া আমাদের হয়ে ওর মধ্যে লিখে রাখা মন্ত্র ছড়িয়ে দিল দশ দিকে। এবার ফেরার পালা। মনি আগেই ফিরে গিয়েছিল জিনিসপত্র গোছাতে। কয়েকটা গ্রুপ ফোটো তুললাম ক্যামেরায় স্ট্যান্ড লাগিয়ে। তারপর নামতে লাগলাম কাঁচামিঠে রোদ গায়ে মেখে।
বেগুনি অর্কিড...
সোনায় মোড়া শৃঙ্গরাজি দেখে মন ভরে গিয়েছিল। কালকের রাতের যত কষ্ট-অস্বস্তি দূর হয়ে গিয়ে নতুন উৎসাহ নিয়ে নামতে লাগলাম। উতরাই-এর পথে চলা অনেক কম কষ্টের এবং সাবলীল। সকালবেলার কাঁচা সবুজের গন্ধ নাকে নিয়ে অনেকটা পথ নেমে এসে একটা বানানো শেড-এর নীচে আশ্রয় নিলাম। মণি ততক্ষণে পগার পার। ওর নাকি আর-একটা বুকিং আছে। নীলাদ্রির অনেকক্ষণ ধরে শরীরটা খারাপ লাগছিল। তিনজনে বসে রেস্ট নিলাম কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঘুরে গেল কেমন। অদ্ভুত একটা গন্ধ বেশ কিছুক্ষণ ধরেই পাচ্ছিলাম। ভালো করে তাকাতেই দেখা গেল তাকে। বেগুনি রঙের অর্কিড। বড়ো কয়েকটা কনিফারের গায়ে ভর্তি হয়ে ফুটে আছে ফুলগুলো। একটু সময় লাগল ধাতস্থ হতে। জল খেয়ে আবার হাঁটা দিলাম। ট্রেক শেষ করে যখন ফরেস্ট গেটে পৌঁছালাম তখন বাজে সাড়ে এগারোটা। আসার সময় ভেবেছিলাম এবারের ট্রেকটা বড়োই ছোট আর নিরামিষ। হেলাফেলা করেছিলাম হয়তো কিছুটা। হিমালয় আমাদের ভুল ভেঙে দিল। তার কোনো সন্তানই যে প্রতিভাহীন এবং কম অহংকারী নয় সেটা বুঝতে পারলাম। দু'দিনের প্রায় ৩৬ কিলোমিটার চড়াই উৎরাই বৃথা যায়নি। মনের মণিকোঠায় আলাদাই জায়গা করে নিল সে।
ফেরা তবু ফেরা নয়...
সিকিমের মন-কেমন গন্ধ, মন রঙিন করে দেওয়া প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, সবুজের হাতছানি আর বুদ্ধের চরণ ছেড়ে তিস্তাকে পাশে রেখে কলকাতা ফেরার পালা এসে গেল। ট্রেক পরবর্তী দিন রাবং-এ কাটিয়ে আমরা নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছালাম তারও পরদিন। রাতের দার্জিলিং মেল-এ একজন সুন্দরী ডক্টর-এর সঙ্গে গল্প আর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে করতে ভোরবেলায় পৌঁছে গেলাম শিয়ালদা স্টেশনে। ফিরলাম বটে কিন্তু পরবর্তী ট্রেকের প্ল্যানটাও ছকা হয়ে রইল। পদাতিকের নতুন অ্যাডভেঞ্চার, এবার লক্ষ্য উত্তরাখণ্ড।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় মুখ্যালয়ে জুনিয়ার টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (কেমিক্যাল) পদে কর্মরত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রসায়নে স্নাতক এবং এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড সয়েল সায়েন্স-এ স্নাতোকোত্তর । কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। পাহাড় পাগল, হিমালয় প্রেমী। "পদাতিক" নামক চার জনের ছোট্ট ট্রেকিং দলের সদস্য। "বছরে একটা ট্রেক-এ না গেলে বছরটাই মাটি" তত্ত্বে বিশ্বাসী। ভ্রমনকাহিনি ছাড়াও কবিতা লেখা ও পড়া নেশা। অল্প-বিস্তর ছবি আঁকা আর ছবি তোলা প্যাশন।