হঠাৎ ইচ্ছার নৃসিংহনাথে
সুদীপ চ্যাটার্জি
কথায় আছে না পায়ের তলায় সরষে, আমাদেরও আসলে তাই। মানসকাকু হঠাৎ বললেন নৃসিংহনাথ যাবি? আমরাও তৎক্ষণাৎ রাজি। আমরা বলতে অবশ্য সাকুল্যে আমি আর অনুপম। ট্রেনে রোজ যাতায়াত করার সুবাদে পরিচয়। প্রায় জনা পনের রোজ যাতায়াত করি। নিজেদের মধ্যে প্রায়শই বেড়ানো নিয়ে আলোচনা হয়। এরকমই একদিন মানসকাকুর ওই কথা আর আমাদের নৃসিংহনাথ ভ্রমণের পরিকল্পনা। এই ছোট্ট ভ্রমণে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তারই কিছুটা আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব বলেই এই লেখা। সাহিত্য কতটা পাবেন জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি যে একটি স্বল্প পরিচিত স্থানের সঙ্গে পরিচয় করাতে চেষ্টা করব।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা হয়, পরিকল্পনা হয় জোরদার, শেষে পরি উড়ে চলে যায় আর কল্পনা পড়ে থাকে। ভাগ্যের ব্যাপার এই ক্ষেত্রে সেইরকম হোল না। পরিকল্পনা হওয়ার তিন দিনের মাথায় ২২ জানুয়ারি হাওড়া স্টেশনে সম্বলপুর স্পেশাল ট্রেনের তাৎক্ষনিক রিজার্ভেশন করে আমাদের যাত্রা শুরু। পরদিন ন'টা নাগাদ সম্বলপুর পৌঁছলাম। স্টেশনের বাইরে নৃসিংহনাথ কীভাবে যাওয়া যায় তা জিজ্ঞেস করে একটা অটোতে করে আইন্থাপালি বাসস্ট্যান্ডে এলাম। চল্লিশ টাকা ভাড়া নিল। বাসস্ট্যান্ডে এসে কিন্তু জানা গেল সরাসরি নৃসিংহনাথ যাওয়ার বাস এখন আর নেই। একজন শুভানুধ্যায়ী বললেন আপনারা এখান থেকে বড়গড় চলে যান। সেখান থেকে পাইকমাল যাওয়ার বাস পাবেন আর পাইকমাল থেকে নৃসিংহনাথ মাত্র ৪ কিমি।
অগত্যা আমারা ওই ভদ্রলোকের কথামতো বড়গড়গামী বাসে চড়ে বসলাম। সম্বলপুর থেকে বড়গড়-এর দূরত্ব ৪৫ কিমি-র কাছাকাছি। এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট মত সময় লাগলো। আমাদের বাসের কন্ডাকটর পাইকমাল-এর বাসে বসার ব্যবস্থা করে দিল। বাস কিছুক্ষণ পরে ছাড়বে তাই প্রথমে ইডলি দিয়ে ডান হাতের কাজটা সেরে নিয়ে কাছেপিঠে একটু ঘুরে নিলাম। এটিএম থেকে কিছু টাকা তুলে নিয়ে স্ট্যান্ডে ফিরে দেখি বাস ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পথে খাওয়ার জন্য পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদি কিনতে হয়েছে কারণ বড়গড় থেকে পাইকমাল-এর দূরত্ব প্রায় ১২০ কি.মি। মোটামুটি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টার মতো যাত্রা। মাথাপিছু ভাড়া ৭০ টাকা। শেষের এক ঘন্টা পথ অতি মনোরম। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট পাহাড়, হালকা জঙ্গল, তার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের বাস। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ পাইকমালে এসে পৌঁছলাম। ছোটোখাটো কয়েকটা দোকান ঘর আর কিছু বাড়ি নিয়ে পাইকমাল জনপদ। এখান থেকে অটো নিয়ে গন্ধমাদন পাহাড়ের ঢালে নৃসিংহনাথ মন্দিরে পৌঁছে গেলাম।
এবার একটু ইতিহাসের কথা বলে নিই। আনুমানিক ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে পাত্নাগড়ের রাজা বৈজল সিং দেব এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করেন। ৪৫ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগটি বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার-এর জন্য সংরক্ষিত। দ্বিতীয় অংশটি বরাদ্দ হয়েছে মদনমোহন-এর জন্য। পর্যটক হিউয়ান সাং-এর সময়ে এই এলাকাটি বৌদ্ধ সাধনার একটি পীঠস্থান ছিল। এখন যদিও তার চিহ্ন চোখে পড়ে না।
ফিরে আসি বর্তমানে। প্রাকৃতিক পরিবেশ অসাধারণ সুন্দর বললেও বোধহয় কম বলা হয়। গন্ধমাদন তার অনুচরদের নিয়ে সবুজ বৃক্ষের পোশাক পরে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই বোধহয় এই অঞ্চলের সঙ্গে হনুমানের কোন যোগাযোগ থেকে থাকবে। অজস্র বাঁদর ঘোরাঘুরি করছে চারপাশে। তবে এরা মানুষের কোন ক্ষতি করে না। আর এই গন্ধমাদনের কোলেই ঠাঁই পেয়েছে সুপ্রাচীন নৃসিংহনাথ মন্দির। মন্দিরের গা দিয়ে কলকল করে বয়ে চলেছে একটি পাহাড়ি ঝরনা। মন্দিরে খোঁজ নিয়ে জানলাম গন্ধমাদনের বুক চিরে ছুটে চলা এই দুরন্ত বালিকাটির নাম পাপহারিণী। এখানে থাকার জায়গা বলতে সাকুল্যে দুটি - মন্দির কমিটির ধর্মশালা ছাড়াও ওটিডিসি-র একটি পান্থনিবাস। পান্থনিবাসটির অবস্থান বেশ সুন্দর জায়গায়। আমাদের ভ্রমণ শুরু হয়েছিল হঠাৎই, তাই থাকবার কোন জায়গা ঠিক না করেই পথ চলাও শুরু হয়েছিল। পান্থনিবাসের সামনে দেখি অনেক মানুষজনের ভিড়। ম্যারাপ বেঁধে ভোজপর্ব চলছে। দেখেশুনে বুঝলাম বিয়েবাড়ি। আমরা এদিকে ভাবছি এতটা এসে আবার না ফিরে যেতে হয় থাকবার জায়গার অভাবে। মানস কাকু গিয়ে খোঁজ নিয়ে এল অনুষ্ঠান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর ঘর পরিষ্কার করে আমাদের দেওয়া হবে। এরমধ্যে অনুপম বিয়েবাড়ির এক কর্তা ব্যক্তির সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে দেখি আমাদেরও ডাকছে। অনুপমের খাতিরে আমাদেরও বিয়েবাড়ির বেশকিছু মিষ্টি খাওয়া হল।
ডাবল বেডের ঘরগুলো বেশ বড় এবং পরিষ্কার-পরিছন্ন। এইরকম একটি ঘর আমাদের জন্য বরাদ্দ হল। নৃসিংহনাথে রাত্রিবাস করে খুব কম সংখ্যক মানুষ, তাই শান্ত, নিঃস্তব্ধ পরিবেশে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা যায় খুব ভালোভাবে। রাতের আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় নক্ষত্রলোকের পুরোটাই চোখের সামনে এসে হাজির হয়েছে। ইতিমধ্যে অনুপম খবর নিয়ে এসেছে মন্দিরে বিনামূল্যে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ গেলাম মন্দিরে। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। মন্দিরের ঠিক সামনের চাতালে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশে ঝর্নার কলধ্বনি, টিমটিমে আলো, ঠাণ্ডা বাতাসের কামড় সব মিলিয়ে এক অসাধারণ পরিবেশে গরম গরম ভাত, ডাল, তরকারি আর পায়েস সহযোগে আহার এখনও মুখে লেগে আছে।
রা্ত্র্রিবেলায় পান্থনিবাসে ফিরে কেয়ারটেকারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল মন্দির থেকে কিলোমিটার পাঁচেক হেঁটে গেলে একটি জলপ্রপাত আছে, নাম কপিলধারা। পরদিন সকাল সাতটার মধ্যে বেরোলাম পান্থনিবাস থেকে। চারদিকে ছোট ছোট জঙ্গলময় পাহাড়ে সোনালি রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে। এক শান্ত পরিবেশে মন্দিরে এলাম, এখান থেকেই আমাদের কপিলধারার যাত্রা শুরু হবে। মন্দির থেকে বেশ কিছু সিঁড়ি ভাঙার পর ঝরনাধারা পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ বরাবর এগিয়ে চললাম। আমাদের বাঁ পাশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রকৃতির আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদের আভা গায়ে একটা উষ্ণতার আমেজ নিয়ে আসছে। শেষের কিছুটা ছাড়া পুরো পথ জুড়েই হালকা চড়াই। প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর আমাদের কাঙ্খিত স্থানে এসে পৌঁছলাম। প্রায় ৪০-৫০ ফুট উচ্চতা থেকে ধাপে ধাপে নেমে আসছে কপিলধারা। শীতকাল বলে জল কিছুটা কম। আমরা ওই কনকনে ঠাণ্ডা জলের মধ্যে নেমে পড়লাম প্রবল শীত অতিক্রম করে। সেই নিস্তব্ধ নির্জন শান্ত প্রকৃতির কোলে বসে থাকার অনাবিল আনন্দের স্বাদ যে নিজে প্রত্যক্ষ ভাবে উপলব্ধি না করেছে তাকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
স্থানমাহাত্ম্যের গুণে কিনা জানি না, মনটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এক গভীর ভাবরাজ্যে প্রবেশ করল। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল শহুরে কোলাহলে অভ্যস্ত এই হৃদয়। পাখির কলতান আর ঝিল্লির রব ছাড়া আর কোন শব্দই আমাদের কানে প্রবেশ করছে না। বসে বসে ভাবছিলাম সেই সমস্ত মানুষদের কথা যারা কয়েকশো বছর আগে এই স্থানগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন মন্দির করার জন্য বা সেই বৌদ্ধরা, যারা সাধনা করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই নির্জন স্থান। মনে মনে তাঁদের পছন্দের তারিফ না করে পারি না।
ঝরনার বাঁদিক দিয়ে পায়েচলা একটা রাস্তা চলে গেছে আরও ওপরে। আমরা ওই রাস্তা ধরে ঝরনাটার মাথায় পৌঁছে গেলাম। সে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধ পরিবেশ। কিছুক্ষণ এই নিস্তব্ধতাকে উপভোগ করার পর ফিরে চললাম পান্থশালার উদ্দেশ্যে। পৌঁছে দুপুরের আহার সেরে বেড়িয়ে পড়লাম সম্বলপুরের দিকে। সম্বলপুর থেকে আমরা হুমা মন্দির আর মহানদীর বুকে হিরাকুদ ড্যাম দেখতে যাব। পাইকমাল থেকে সরাসরি বাসে সন্ধ্যের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সম্বলপুর।
পরদিন সকালে আবার আইন্থাপালি বাসস্টান্ড থেকে লোকাল রুটের বাস ধরে হুমার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি। বাস মন্দিরের ২ কিমি আগে বড় রাস্তায় নামিয়ে দিল। গ্রামের মেঠো পথ ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে। মহানদীর তীরে বেশকিছুটা হেলে পড়া একটি শিব মন্দির। এমনকি ভিতরের শিব লিঙ্গটিও মন্দিরের মতোই বাঁকা। বইতে ইতালিতে পিসার হেলানো মিনারের কথা পড়েছি কিন্ত এই মহানদীর তীরে ওড়িষার এক প্রত্যন্ত গ্রামেও যে হেলানো মন্দির আছে তার খবর কটা মানুষ রাখে?
মহানদীর তীরে মন্দিরের ঘাটে অসংখ্য বড় বড় মাছ ঘোরে। এখানে মাছ মারা বা খাওয়া নিষেধ। মাছেদের খাওয়ানোর জন্য খাবার কিনতে পাওয়া যায়, অনেকে দেখলাম মাছেদের লাড্ডু বা খই খাওয়াচ্ছে। নদীর মাঝে ছোট একটি পাথরের টিলা আছে। একটি বিরাট কালীমূর্তি আছে সেখানে। মন্দিরের ঘাট থেকে নৌকা করে যাওয়া যায়। নদীর বুক থেকে হুমা মন্দিরটিকে খুব সুন্দর লাগে। হুমা থেকে ফিরে গেলাম হিরাকুদ ড্যাম দেখতে। আইন্থাপালি বাসস্টান্ড থেকে ১৫ কিমি দূরত্ব। নিয়মিত অটো চলাচল করে। প্রায় ৭৫০ বর্গ কিমি এলাকা নিয়ে বিস্তৃত হিরাকুদ বাঁধের কৃত্রিম হ্রদ। একদিকে গান্ধী মিনার এবং অপরদিকে নেহরু মিনার থেকে হ্রদটির শোভা দেখা যায়। দুটি মিনারের দূরত্ব ৫ কিমি। টিকিট কেটে উঠে পড়লাম নেহরু মিনারে। পড়ন্ত বিকেলের রোদে হ্রদের শোভা ফটোফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো।
সুযোগ পেয়ে চলে গেলাম ঘন্টেশ্বরী মন্দির দেখতে। আইন্থাপালি থেকে গোশালা হয়ে রাস্তা চলে গেছে বাঁ হাতে। প্রায় ১২ কিমি গেলে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। গোশালা থেকে শেয়ার জিপ পাওয়া যায় তবে মন্দিরের ২ কিমি আগে নামিয়ে দেবে। অবশ্য জীপ চালককে কিছু বেশি দিলে ওরাই বাকি রাস্তাটুকু নিয়ে যাবে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশ দিয়ে কিছুটা হেঁটে গেলে ঘন্টেশ্বরী মন্দির। পুরো মন্দির জুড়েই অজস্র ঘন্টা ঝুলছে। সবাই মানত করে ঘন্টা বেঁধে দিয়ে যায় মন্দিরটিতে। হাওয়ার বেগে ঘন্টাগুলো বাজতে থাকলে বেশ লাগে শুনতে। বৈশাখ মাসে এখানে বেশ বড় মেলা বসে। তখন অনেক লোকসমাগম হয়। মহানদীর পাশে অজস্র ঘণ্টার টুং টুং, ঢং ঢং শব্দ পরিবেশটাকে মাতিয়ে তোলে।
এরপর ফেরার পালা। এবার আর ভাগ্য অত সহায় নয়। তাৎক্ষণিক সংরক্ষণ করা গেল না। অগত্যা ট্রেনের সাধারণ কামরাই ভরসা। এক রাতের ব্যাপার। কিছু খাবার নিয়ে উঠে পড়লাম। এই হঠাৎ ভ্রমণে গিয়ে যে অনাবিল আনন্দের স্বাদ পেলাম তাই আলোচনা করতে করতেই রাত কেটে গেল। খেয়াল হতে দেখি কখন যেন হাওড়া এসে গেছে।
বেড়াতে ভালবাসেন সুদীপ চ্যাটার্জি, সেই সঙ্গে ভ্রমণ সংক্রান্ত বই এবং পত্রপত্রিকা পড়তেও সমান আগ্রহী। ইন্টারনেটে নিয়মিত 'আমাদের ছুটি' পড়তে পড়তেই হঠাৎ করে লেখার ইচ্ছা জেগে ওঠে। তাই এই ছোট্ট প্রয়াস। ঘষেমেজে চেষ্টা করতে করতে লিখেই ফেলা আস্ত একটা ভ্রমণ কাহিনি। এটি ২০১১ সালের ঘোরার অভিজ্ঞতা। ওড়িষার স্বল্প পরিচিত একটি জায়গার বেড়ানোর কথা।