জন ন্যাশের খোঁজে প্রিন্সটনে

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়



গতকাল সন্ধ্যার ঠিক আগেই বজ্রবিদ্যুৎসহ বেশ ভাল বৃষ্টি হয়েছে। কয়েকটা দিন গরমে আধসেদ্ধ হওয়ার পর এই বৃষ্টির জন্য তাপের ঝাঁজটা অনেকটা কমেছিল। তার ফলে রাতে ঘুমটাও ভাল হয়েছিল। সকালের পরিবেশ বেশ মনোরম। এমন সময় স্ত্রী এসে জানালেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জন ন্যাশ মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। সঙ্গে স্ত্রী অ্যালিসিয়া ছিলেন, তিনিও মারা গেছেন। সংবাদটা পেয়ে মনে হল একটা ধাক্কা খেলাম। মনটা এক নিমেষে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি চত্ত্বরে পৌঁছে গেল। এক দশকের সামান্য কিছু আগে যখন প্রিন্সটন দেখতে গেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কেবল মনে হচ্ছিল যদি জন ন্যাশের সঙ্গে দেখা হত।
জন ন্যাশের জীবন নিয়ে যে বিখ্যাত সিনেমা হয়েছিল A Beautiful Mind, এই সিনেমাটি দেখার পর অধ্যাপক ন্যাশ সম্বন্ধে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে গেছিল। সিনেমাটি যখন প্রথম দেখি তখন আমরা থাকতাম মেরিল্যান্ডের রকভিলে। রকভিল শহরটি আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি.-র খুব কাছেই, কিছুটা উত্তরে। অন্যান্য বড় শহরের মত ওয়াশিংটন ডি.সি.-র আয়তন আর বাড়েনি। শহরের সীমানা নির্দিষ্ট করা আছে। এই সিনেমাতে রাসেল ক্রো অধ্যাপক ন্যাশের ভুমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। অভিনেতা ক্রো অধ্যাপক ন্যাশের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হয়েছেন। লিখেছেন, Stunned... my heart goes out to John and Alicia & family. An amazing partnership. Beautiful minds, beautiful hearts.
অধ্যাপক ন্যাশের জীবনের বড় অংশ প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটেছিল। সেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় দেখবার সুযোগ হঠাৎ আমাদের সামনে এসেছিল। কিভাবে সেই সুযোগ এসেছিল তার উল্লেখ করি। আমার মামার বাড়ির গ্রামের নাম নলাহাটি। বর্দ্ধমান জেলার কাটোয়ার ৭-৮ কিলোমিটার দক্ষিণে এই গ্রাম। মামার বাড়ির গ্রামের কৃতী ছাত্র শ্রীমান সুবীর দাস এই সময় নিউ জার্সির কেনডাল পার্কে থাকত। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের নিউ জার্সির শাখাটি এই কেনডাল পার্কেই অবস্থিত, সুবীরের বাড়ির একেবারে পাশে। স্ত্রী মধুরিমা এবং ফুটফুটে দুই কন্যা সহ সুবীর একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকত। আমরা রকভিলে চলে আসার পর সুবীরের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ হল। নতুন করে যোগাযোগের সুবাদে, ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে কোন কাজ থাকলে সুবীর আমাদের কাছে চলে আসত। যেহেতু আমাদের নিউ ইয়র্ক শহর দেখা হয়নি, সুবীর লোভ দেখিয়েছিল ওদের কাছে গেলে আমাদের নিউ ইয়র্ক শহর ঘুড়িয়ে দেখাবে। সুবীরের প্রস্তাবটা আমাদের কাছেও লোভনীয় বলে মনে হয়েছিল। কারণ নিজেরা নিউ ইয়র্ক শহরটা ঘুরে দেখতে গেলে থাকার জায়গার সমস্যা হবে। তাই নিউ জার্সিতে সুবীরের কাছে থেকে নিউ ইয়র্ক ঘোরা অনেক সহজ হবে। আর সঙ্গে সুবীরও থাকবে।
সুযোগ খুঁজছিলাম কখন সুবীরের কাছে যাওয়া যায়। রকভিলে থাকাকালীন 'বেথেসডা'র Uniformed Services University Medical School-এর অধ্যাপক শৈবাল দের সঙ্গে গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলাম। তাই শৈবালকে বলে দুটো দিন বাড়তি ছুটি মঞ্জুর করে নিলাম। ঠিক হল এক বৃহস্পতিবার যাত্রা শুরু করব, আর ফিরব রবিবার। তাহলে মাঝে শুক্র-শনি দুটো দিন আমাদের হাতে থাকবে ঘুরে দেখবার জন্য।
খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ওয়াশিংটন ডি.সি.-এর চায়না টাউন থেকে চিনা মালিকানাধীন বাস ছাড়ে নিউ ইয়র্ক যাবার জন্য এবং তা বেশ সস্তা। অগ্রিম টিকিট কেটে রেখেছিলাম। তাই যাত্রার দিন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চায়না টাউন চলে গিয়েছিলাম হাতে কিছুটা সময় নিয়ে। বাসে পাশাপাশি দুটি জায়গা মিলেছিল। ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে নিউ ইয়র্ক মোটামুটি ২২৫ মাইল অর্থাৎ ৩৬২ কিলোমিটার। এতটা রাস্তা যেতে অনেকটা সময় লাগার কথা। বাসের অফিস থেকে জেনেছিলাম তিন ঘণ্টা সময় লাগবে, প্রকৃতপক্ষে আমাদের আরও দেড় ঘণ্টা বেশি লেগেছিল। ওয়াশিংটন ডি.সি. শহর থেকে বের হতেই বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নিল। শহরের ভিতরে অনেক যানবাহন তাই সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। আর মাঝ রাস্তায় ঘন মেঘ করে তুমুল বৃষ্টি হল। বৃষ্টির সময় বাসের গতিবেগ অনেক কমাতে হয়েছিল।
এই বাস যাত্রার দুটি ঘটনা আমার আজও মনে আছে। এক, প্রত্যেক সিটের পাশে একটি করে পলিথিনের প্যাকেট রাখা আছে বর্জ্য ফেলার জন্য। ফলে বাসের মেঝে নোংরা হয় না। অপর ঘটনাটি মজাদার। আমাদের দুটি সিট আগে বসেছিলেন এক আমেরিকান দম্পতি। বাস চলাকালীন ভদ্রলোক খবরের কাগজ বা বই পড়ে পুরো সময়টা কাটালেন আর ভদ্রমহিলা খাতা-পেনসিল নিয়ে তার স্কেচ করে গেলেন।
সুবীর জানিয়েছিল নিউ ইয়র্কের পেন ষ্টেশন থেকে Northeast Corridor-এর ট্রেন ধরতে হবে। তাই বাস নিউইয়র্ক পৌঁছলে আমরা পেন ষ্টেশন স্টপেজে নেমে পড়লাম। পেন ষ্টেশন থেকে অন্তত ছয়-সাতটি দিকে ট্রেন লাইন চলে গেছে। আমাদের গন্তব্য নর্থইস্ট করিডরের জার্সি অ্যাভিনিউ ষ্টেশন। পেন ষ্টেশন এবং জার্সি অ্যাভিনিউ ষ্টেশনের মাঝে এগারোটি ষ্টেশন রয়েছে। দূরত্ব অনেকটাই - সময় লাগবে এক ঘণ্টার মত। এখানকার মত লোকাল ট্রেনের ভিড় ওখানে নেই। তাই ট্রেনে জায়গা পেতে কোনও অসুবিধা হলনা। মাঝে টিকিট পরিদর্শক এসে টিকিট দেখে গেলেন। চারপাশটা দেখতে দেখতে সময়টা কেটে গেল। সুবীর স্টেশনে এসেছিল আমাদের নিয়ে যেতে।
ওর বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছিল। সুতরাং সেদিন আর কোথাও আমাদের যাওয়া সম্ভব ছিল না। বরং সুবীরের স্ত্রী এবং কন্যাদের সঙ্গে আনন্দে সময়টা কেটেছিল। ঠিক হল পরদিন সকালে আমরা প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়টা ঘুরে আসব। আর শনিবার যাব নিউ ইয়র্ক শহর দেখতে।

সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পড়লাম প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় দেখব বলে। প্রিন্সটন সুবীরের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়, তবু সঙ্গে গাড়ি থাকলে সুবিধা হয়। তাই সুবীরের গাড়িতে চেপে বসলাম । সঙ্গী হল ওদের বড় কন্যা। কেনডাল পার্ক থেকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর মোটামুটি ৯ মাইল অর্থাৎ ১৪/১৫ কিলোমিটার। সকালের মিঠে রোদে এইটুকু রাস্তা পার হতে বেশি সময় লাগল না। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় রাস্তার ধারে বসত বাড়ির পাশাপাশি ছোট ছোট দোকান, সারিবদ্ধ গাছ, রাস্তায় সামান্য দু চারটে লোক – এই সব দেখে মনে হল এটা শান্তির এলাকা। যা এদেশে খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা মেলে।

বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরটি বেশ বড়, ৫০০ একরের মত জায়গা নিয়ে এর ব্যপ্তি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি শুরু হয়েছিল বেশ কিছু কাল আগে। আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটা, ১৭৪৬ সালে। তখন এর নাম ছিল 'কলেজ অফ নিউ জার্সি', আর এর বর্তমান স্থানেও নয়, নিউ জার্সির সব চেয়ে বড় শহর এলিজাবেথে। তারপর ১৭৪৭ সালে নিঅয়ার্ক [Newark] শহরে স্থানান্তরিত হয় কলেজটি। তার নয় বছর পর ১৭৫৬ সালে খুঁজে পায় স্থায়ী ঠিকানা। তবে স্থান নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে 'কলেজ অফ নিউ জার্সি'–এর নাম পাল্টাতে কেটে যায় এক শতকেরও বেশি সময়। ১৮৯৬ সালে নতুন নাম হয় প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি।

আমেরিকার রাষ্ট্রবিপ্লবের পূর্বে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয়েছে, সেটি অনেক রাস্তা পার করেছে ইতিমধ্যে - বর্তমানে বিখ্যাত আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি। এদেশের হাজার হাজার পড়ুয়া প্রতি বছর আমেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে দরখাস্ত পাঠায় ভর্তির জন্য। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে যদি কোন ফেলোশিপ জোটে, কারণ ওদেশে জীবনধারণ শুধু নয়, পড়াশোনার খরচও অত্যধিক বেশি। ছাত্র-পিছু অনুদানের অঙ্কে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ওদেশের সেরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন দেখছিলাম যদি ওখানে পড়াশুনা করার সুযোগ পেতাম! অবশ্য স্বপ্ন তো অবাস্তবই হয় - যা সত্যি হবার নয়। সাধারণত ক্যামেরাটি আমার হাতেই থাকে তাই অন্যদের ছবি তোলার সুযোগ ঘটে। এবার সুবীর আমাদের সঙ্গে থাকার সুবাদে সুবীরের কন্যার সঙ্গে আমাদের দুজনের কয়েকটা ছবি তোলা হয়ে গেছিল এই বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জন ন্যাশের মত বিখ্যাত বহু মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। Institute of Advanced Study-র লাইফ টাইম মেম্বার হন ১৯৩৩ সালে।
এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছেন বা ছিলেন ৩৭ জন নোবেল পুরস্কার প্রাপক, ১৭ জন 'ন্যাশানাল মেডেল অফ সায়েন্স' প্রাপক, ৩ জন অ্যাবেল পুরস্কার প্রাপক, ৮ জন ফিল্ডস মেডালিস্ট, ৯ জন টুরিন অ্যাওয়ার্ড প্রাপক, ৩ জন 'ন্যাশানাল হিউম্যানাটিজ মেডেল' প্রাপক এবং ২০৪ জন 'রোডস স্কলার'। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কোন মাপের তা সহজেই অনুমান করা যায় উপরের পরিসংখ্যান থেকে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন - জেমস ম্যাডিসন এবং উড্রো উইলসন। উইলসন ১৯০২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হন ১৮৭৯ সালে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর উনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে নানা কাজ করেন। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী। মজার কথা এই যে কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ঘটেছে অনেক পরে। মহিলাদের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্সে প্রথম নেওয়া হয় ১৯৬৯ সালে।

এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে মিশে রয়েছেন বিশ্বজয়ীরা, সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস। তাই এখানে আসতে পারাটাও সৌভাগ্যের। তবে আমি জন ন্যাশের দেখা পাইনি। তাতে দুঃখ নেই। সেদিনের স্মৃতিটাই অমলিন হয়ে আছে আজও।


প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক অপূর্ব-র নেশা বেড়ানো আর ছবি তোলা। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা চোখের আড়ালে চলে যাওয়া টেরাকোটার মন্দিরশিল্পকে ক্যামেরার দৃষ্টিতে পুনরুদ্ধার করাই তাঁর ভালোলাগা। পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখা।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher