পায়ে পায়ে মরুর দেশে
সুদীপ্ত দত্ত
বাঙালি স্বভাবে ভ্রমণপ্রিয়। ক'টা দিন ছুটি পেলেই পাহাড় আর সমুদ্রের ডাক অগ্রাহ্য করা যেন ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এবারের শীতের ছুটিটা বরাদ্দ রেখেছিলাম ঊষর মরুভূমির জন্য। ভারতের এক কোণে পরে থাকা থর মরুভূমি বেড়ানোর জায়গা হিসেবে সবার চেয়ে যেন আলাদা। এখানে না আছে তুষারঢাকা হিমালয়ের সৌন্দর্য, না পাওয়া যায় বেলাভূমির ওপর আছড়ে পড়া নীল সমুদ্রের ঢেউ। এমনকি দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি, নদী-জলা-জঙ্গলে সাজানো রঙিন প্রকৃতি কিংবা মানুষের হাতে পরিপাটি করে বানানো শহরও এখানে নেই। পবিত্র ধর্মস্থান হিসেবেও রাজস্থানের মরু অঞ্চল বাঙালির কাছে বিশেষ পরিচিত নয়। তাই মরুভূমিতে আমার শীতের ছুটি কাটানোটা বন্ধুদের কাছে এক মজার উপকরণ হয়ে উঠেছিল।
একদিন আগে জয়পুর পৌঁছে শহরটাকে একটু ঘুরে দেখব বলে ঠিক করলাম। ঊনত্রিশ ডিসেম্বর জয়সলমীরের ক্যাম্পে রিপোর্টিং করার কথা থাকলেও পঁচিশ তারিখেই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরেছিলাম। কিন্তু বিধি বাম। শীতকালে উত্তরভারতের দূর্ভেদ্য কুয়াশায় ট্রেন লেট করল আঠেরো ঘন্টা! তবু ট্রেনটা যে বাতিল করা হয় নি এই ভেবেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলাম। জয়পুরে দুদিনের হোটেল বুক করা থাকলেও সময় পেলাম বিকেলের দিকে মাত্র পাঁচ ঘন্টা। তখন সমস্ত বিখ্যাত ফোর্টের দরজাই বন্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র শহর থেকে কিছুটা দূরে রাজস্থানী ঘরানায় সাজানো নকল গ্রাম তৈরি করা হয়েছে, সেটুকুই দেখে আসার সময় পাওয়া যাবে। হোটেল ম্যানেজার চটজলদি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। সাজানো গ্রাম চৌখি ধানিতেই রাজস্থানী সংস্কৃতির সঙ্গে কিছুটা পরিচয় করে, রাজস্থানী খাবারে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। ম্যানেজারকে বিদায় জানিয়ে রাতেই জয়সলমীরের ট্রেন ধরতে হল।
২৯ ডিসেম্বর ২০১৪
জয়সলমীরের হোটেলটা জয়পুরের মত অতটা ভালো নয়। একটু মর্নিং ওয়াক করে, স্নান সেরে সক্কাল সক্কাল বেড়িয়ে পড়াই ঠিক হবে বলে মনে হল। আসলে হোটেলটা মোটামুটি বড় হলেও খাওয়া দাওয়ায় রাজস্থানী ছাপ পেলাম না। আর আগের দিন যেভাবে মাত্র দশ মিনিট গাড়ি চাপিয়ে, এক কিলোমিটারেরও কম ঘুরিয়ে ১৫০০ টাকা নিয়ে নিয়েছিল, তাতে আমার সত্যিই খারাপ লেগেছিল। সকালে ইয়ুথ হোস্টেল ক্যাম্পে ফোন করে জানতে পেরেছিলাম, যে কোনো সময়েই এন্ট্রি নেওয়া যায়। তাই হোটেল থেকে না খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম ক্যাম্পের দিকে। চেক-আউটের সময় হোটেল ম্যানেজার আপ্যায়ন কেমন হয়েছে তা জানতে চাইল। অসন্তোষের কথা রাখঢাক না করে সোজাসুজি বলেই ফেললাম। তাতে ম্যানেজার বিশেষ লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইলেও আমার বিশেষ কিছু ভাবান্তর হল না। রুমে একটু খাওয়ার জলও দেওয়া হয় নি জেনে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার নিয়ে এল। তারপর বিনা পয়সায় ইয়ুথ হোস্টেল ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থাও করে দিল। একদিন আগে হোটেলে আসায় জয়সলমীরের সোনার কেল্লা, পটোয়া কি হাভেলি আর রাজবাড়ি দেখে নিতে পেরেছিলাম। এদিন সকালে মর্নিং ওয়াকের সময় নিরিবিলিতে গড়িসার লেকে সকালের সূর্য ওঠাও দেখে নিলাম। এখানে থেকে এটুকুই প্রাপ্তি। বর্ডার হোমগার্ড গ্রাউন্ড জয়সলমীর শহরের বাইরের দিকে, কেল্লা থেকে কিছুটা দূরে। সেখানেই ইয়ুথ হোস্টেলের তরফে ক্যাম্প করে ডেসার্ট ট্রেকিং ও ফ্যামিলি ক্যাম্পিং এর আয়োজন করা হয়েছে। ক্যাম্প শুরু হয়েছে ২১ তারিখ, চলবে জানুয়ারির ৪ তারিখ পর্যন্ত। আমার ২৯ তারিখের বুকিং থাকলেও শুনলাম এই সময়ের মধ্যে যে কোনোদিন চলে এলেই ওরা ক্যাম্পে থাকতে দেয়। আর সম্ভব হলে "অ্যাডজাস্ট" করে ট্রেকিং এর ব্যবস্থাও করে।
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বর্ডার হোমগার্ড গ্রাউন্ডে পৌঁছে গেলাম। ক্যাম্পিং এরিয়ায় ঢোকার মুখেই রেজিস্ট্রেশন ডেস্ক। সেখান থেকে আমায় ৪ নম্বর টেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হল থাকার জন্য। টেন্টটা বেশ বড়, অনায়াসে দশ-বারো জন থাকা যায়। আমার আগেই সেখানে বেশ কিছু মেম্বার পৌঁছে গেছে। ইন্দোরের সন্তোষ আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকেও ৪ নম্বর টেন্টের সদস্য করে নেওয়া হল। এক চিলতে খালি জায়গা দেখে আমার রুকস্যাকটা রাখলাম। ক্যাম্প ডিরেক্টর রতনজীর সঙ্গে দেখা করে নিয়ম-কানুনগুলো একটু জেনে নিলাম। এমনিতে খাওয়া-দাওয়া সব নিরামিষ, এছাড়া নিয়ম বলতে জল যেন অপচয় করা না হয়। ক্যাম্প এরিয়ায় একদিকে ফ্যামিলি ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রেকারদের সেদিকে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হল। এছাড়া অ্যালকোহল ও সিগারেট খাওয়া নিষেধ, এ ব্যাপারে ইয়ুথ হোস্টেল কর্তৃপক্ষ ভীষণ কড়া। ক্যাম্পিং এরিয়াটা একটু ঘুরে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল বেশ কয়েক রকম টেন্ট রয়েছে – আয়োজক ও ক্যাম্প লিডারদের জন্য এক ধরনের টেন্ট, ফ্যামিলি ক্যাম্পার্সদের আবার আলাদা ব্যবস্থা। ট্রেকারদের টেন্টেরও আবার রকমভেদ আছে – কোনটা শুধু মেয়েদের জন্য বরাদ্দ, কোনোটা ফিরতি ট্রেকারদের। কিছু টেন্টে বিছানাপত্তর রাখা আছে। মাঝে একটা বড় সামিয়ানা টাঙিয়ে মঞ্চ করা হয়েছে। আর একটা বড় টেন্টে রান্নাঘর। একটা গাছের তলায় অনেকগুলো চার্জিং পয়েন্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে, নিজের ইচ্ছেমতন মোবাইল, ক্যামেরা চার্জ দিয়ে নাও। সমস্যা হচ্ছে একই রকম মোবাইল বা ক্যামেরা চার্জার হলে ভুল হওয়ার ভীষণ সম্ভাবনা, যেমন আমার ক্যামেরার চার্জার আরেকজন ভুল করে নিয়ে চলে গেছিল! একটা গাছের তলায় একটু উঁচুতে একটা জলের ট্যাঙ্ক রাখা আছে, সেই জল আধুনিক পিউরিফায়ার দিয়ে "বিশুদ্ধ" করে বড় বড় দুটো ড্রামে ভরা হচ্ছে – ড্রামের গায়ে লেখা "Drinking Water"। আরেক দিকে একটা গাছতলায় কল লাগানো কয়েকটা ড্রামে জল রাখা আছে যেগুলো বাসন মাজা বা হাতমুখ ধোওয়ার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ড্রামের পাশেই একটা বড় সুইমিং পুল, যাতে এক ফোঁটাও জলের চিহ্ন দেখতে পেলাম না। সুইমিং পুলটা বেশ গভীর। ক্যাম্প এরিয়ার পেছন দিকে সার বেঁধে "টেন্ট" টয়লেট, ভেতর থেকে চেন টেনে দিলেই দরজা বন্ধ, আর প্রতিটি টয়লেটেই সব সময়ের জন্য জলের ব্যবস্থা আছে।
রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের কাছেই প্রথম দু'দিনের কর্মসূচী দেওয়া আছে। তাতে বেশ কয়েকঘন্টা রাখা আছে "City Visit" এর জন্য। বাঙালি স্বভাব আড্ডাবাজ। মাঝে যে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে তার নীচে বসেছে আড্ডার আসর। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। যথারীতি আড্ডার আসরটাও জমিয়ে বসিয়েছে বাঙালিরাই। আমিও বসে গেলাম সেই আসরে। ওঁরা একটা গ্রুপ করে এই ট্রেকিং-এ এসেছেন, আজ ফিরে যাচ্ছেন। একটা বাঙালি পরিবেশ পেলাম, কিন্তু তা খুবই কম সময়ের জন্য। তবে ওই গ্রুপেরই একজন, ট্রেন লেটের জন্য আটকে পড়েছে, সে এসে আমাদের গ্রুপেই যোগ দেবে বলেও জানতে পারলাম। একটু পরেই তিনি পৌঁছেও গেলেন। মৃণালদা চুঁচুড়ার ডাকাবুকো লোক। সাতচল্লিশ বছর বয়সে তাঁর অনেক ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা হয়েছে। আড্ডার আসর জমিয়ে দিতে এমন লোকের জুড়ি মেলা ভার। বন্ধুদের বিদায় জানানোর পর আমরা নিজেরাই এক অলিখিত জুটি বেঁধে ফেললাম। টেন্টের একটি ছেলেকে দেখলাম একটু একা পরে গেছে, কথা বলার বিশেষ কেউ নেই। ছেলেটা চেন্নাই থেকে এসেছে, হিন্দি এক্কেবারেই বলতে পারে না, আর বেশিরভাগ কথা বুঝতেও পারে না। তাই সকলের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারেনি। নাম জিগ্যেস করতে বলতে শুরু করল – রুশ্যেন্দ্র চন্দ্রশেখর ... মৃণালদা তাড়াতাড়ি থামিয়ে বলল, "আমি অত বড় নাম ডাকতে পারব না, ছোট করে ডাকব 'ভাই'। আচ্ছা 'ভাই' কে তামিলে কি বলে?" জবাব এল – "আন্না" (আসলে আন্না বলতে "দাদা"কে বোঝায়)। সেই থেকে রুশ্যেন্দ্র পাকাপাকিভাবে "আন্না" হয়ে গেল। দুপুরে সাড়ে বারোটায় লাঞ্চ দিয়ে দেওয়া হল। ঘিয়ে ভাজা ধবধবে সাদা আতপ চালের ভাত, সঙ্গে ডাল আর পকোড়া। আবার রুটি ও আলুর একটা তরকারিও ছিল। শেষ পাতে ঘিয়ে ভাজা এক ধরনের মিষ্টি। সবরকমই টেস্ট করে দেখলাম। রান্না বেশ ভালো। খেতে খেতেই রতনজীর কাছে জানতে পারলাম কাছাকাছি একটি ঐতিহাসিক গ্রাম আর একটা জৈন মন্দির আছে। হোমগার্ড গ্রাউন্ডের ঠিক সামনেই অস্থায়ী অটোস্ট্যান্ড তৈরি হয়েছে। তিনশ টাকায় একটা অটো বুক করে তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম স্বল্পপরিচিত সেই ট্যুরিস্ট স্পটের দিকে।
অটো এগিয়ে চলল স্যাম রোড ধরে, সোনালি বালিরাশির বুক চিরে। দুপাশে ধূ-ধূ মাঠ আর তাতে অসংখ্য কাঁটাঝোপ। আকন্দের সারি ছাড়াও ছিল আরও অনেক রকমের ক্যাকটাস। সেই কাঁটাঝোপেই নিজের খাবার খুঁজে নিতে ব্যস্ত ভেড়ার পাল। এখানকার ভেড়াগুলো তুলনামূলকভাবে কম "ফরসা", আর এদের মুখটা পুরোপুরি কালো; রূপের মধ্যেও যেন অস্বাভাবিক গরমের প্রতিফলন ফুটে উঠেছে।
কুলধরা গ্রামে যখন পৌঁছলাম তখনও ভর দুপুর। গ্রামে ঢোকার সময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে মাথাপিছু ২০ টাকা করে এন্ট্রি-ফি নেয় আর অটোর জন্য তিরিশ টাকা। একটা পরিত্যক্ত গ্রাম - গ্রামের মাঝে একটি পুরানো মন্দির আর তাকে ঘিরে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে থাকা দুয়েকটি ঘর। বাকি অঞ্চল জুড়ে গ্রামের ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরটা সোনালি পাথরের আর তার কারুকাজ খুবই সুক্ষ্ম এবং বেশ সুন্দর। মন্দিরের ছাদে উঠতে এক জায়গায় লোহার পাত বেরিয়ে থাকতে দেখে বুঝলাম মন্দির চত্ত্বরটি সংস্কার হয়েছে। সেখান থেকেই দেখলাম একটি ছোট ঘূর্ণি, বালি ওড়াতে ওড়াতে এগিয়ে আসছে, নিতান্তই ছোট বলে চিন্তার কারণ নেই, তবে এটাই হয়তো ধ্বংসাত্মক মরুঝড়ের ছোট সংস্করণ। মন্দির লাগোয়া ভাঙা বাড়ির একটিতে ছাদ পর্যন্ত ওঠা যায় কিন্তু তার সিঁড়ি বলতে দেওয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা কিছু ঝুলন্ত পাথর আর কার্ণিশের ওপর দিয়ে পেতে রাখা একফালি পাথরের টুকরো, যা পার করার সময় নীচের দিকে তাকাতেও সাহস হয় না। ছোট ছোট বাচ্চারা মাঝে মাঝেই ঘিরে ধরছে গ্রামের ইতিহাস শোনানোর জন্য। জনশ্রুতি, অত্যাচারী রাজপুত রাজা সালিম সিং এই গ্রামের মুখিয়ার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রামের লোকজন ছিল কুলীন ব্রাহ্মণ। তারা এই বিয়ে মেনে নিতে রাজি ছিল না। তাই রাতের অন্ধকারে রাজা মেয়েটিকে নিয়ে নিঃশব্দে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, আর যাওয়ার আগে অভিশাপ দিয়ে যায় যে এই গ্রামে কেউ কোনোদিন বসতি গড়তে পারবে না। পরদিন রাজা সালিম সিং এসে গ্রামে কাউকে না পেয়ে ভীষণ রেগে আশপাশের পঁচাশিটি গ্রামকেও জনশূন্য করে দেয়। সেই থেকে পুরো অঞ্চলের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই। আমার পক্ষে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না, তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও এই জনশ্রুতিই সবচেয়ে প্রচলিত। মন্দিরের খুব কাছেই সেই মুখিয়ার বাড়ি, এবং পুরো অঞ্চল ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ির ভাঙা অংশ। কেমন যেন এক ভৌতিক অনুভূতি মনকে গ্রাস করে।
কুলধরা থেকে ফেরার পথে পেলাম অমর সাগর লেক। নামেই লেক, জলের ছিঁটে-ফোঁটাও চোখে পড়ল না। কাছেই এক জৈন মন্দির। জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের এই মন্দির ১৯২৮ সালে তৈরি করেছিলেন পটোয়া হিম্মত রাম। আদি মন্দিরটি ভেঙে যাওয়ার পর পাশেই নতুন করে আবার তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। এখানেও জয়সলমীরের পটোয়া কি হাভেলির মত সোনালি পাথরের ওপর অনিন্দ্যসুন্দর কারুকাজ দেখতে পেলাম।
ক্যাম্পে ফিরে আসার পর অটোচালক এক নতুন বাহানা শুরু করল। তিনশ টাকার কথা অস্বীকার করে হঠাৎই ছ'শ টাকা দাবি করে বসল! শেষমেশ সাড়ে তিনশ টাকায় ছাড়া পাওয়া গেল। বুঝতে পারলাম, এই যাত্রায় সব জায়গায় সততার দেখা নাও মিলতে পারে। বিকেলে চায়ের পর স্লিপিং ব্যাগ আর রুকস্যাক দিয়ে দেওয়া হল। আমি শুধু রুকস্যাক নিলাম – স্লিপিং ব্যাগ আমার সঙ্গেই ছিল। পরের ক্যাম্পের জন্য স্লিপিং ব্যাগ সেখানেই পাওয়া যাবে। সাতটা বাজতে না বাজতেই ডিনার দিয়ে দিল। এরপর ক্যাম্প ফায়ারের সময়। কিন্তু ক্যাম্পের মধ্যে আগুন জ্বালা নিষেধ। তাই বাল্বের আলোতেই "ক্যাম্প ফায়ার" শুরু হল। ক্যাম্প লিডারের ছোট্ট বক্তব্যের পর কেউ গান গাইলেন, কেউ বা আবার আধুনিক হিন্দি গানের তালে নাচ করে আসর জমিয়ে দিলেন। গোয়ার আলভা ম্যাডাম লাফিং ক্লাবের মেম্বার, তিনি বিভিন্ন রকমের হাসির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করালেন। আমরা মুচকি হাসি, অট্টহাসি, দমফাটা হাসি, কান এঁটো করা হাসি, খিলখিলে হাসি আর দাঁত বের করে এক রকমের হাসির ব্যায়াম করেছিলাম। আলভা ম্যাডামও সবগুলো আমাদের হেসে দেখিয়েছিলেন! গ্রুপের সবার সঙ্গে বেশ হাসতে হাসতেই পরিচয় হয়ে গেল আর কী - আঠেরো থেকে পঁয়ষট্টি, সব বয়সের ট্রেকারই রয়েছে এই অ্যাডভেঞ্চারে।
রাতে হঠাৎই ঠাণ্ডা নেমে এল। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আর হাড়কাঁপানো শীত, টেন্টের বাইরে বের হওয়াও বেশ কঠিন মনে হল।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৪
সক্কাল সক্কাল উঠে পড়া আমার অভ্যেস। এখানেও ভোররাতে ঘুম ভেঙে গেল। চায়ের পর হাল্কা ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেরে নেওয়া হল বর্ডার হোমগার্ড গ্রাউন্ডে। এর পর ক্যাম্প পরিষ্কার করা বাধ্যতামূলক। ব্রেকফাস্টের পর বাসন ধুতে গিয়ে দেখি দুজন ভদ্রলোক মেস টিন ধুয়ে নিচ্ছেন। মেস টিন সাধারণতঃ বাঙালিরাই বেশি ব্যবহার করে বলেই আমার ধারণা। পরিষ্কার বাংলাতে জিগ্যেস করেই ফেললাম – "বাঙালি নাকি"? দুজনেই আমার দিকে খানিক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বাংলাতেই উত্তর দিলেন – "কি করে বুঝলেন"? প্রচন্ড কুয়াশায় ট্রেন লেট থাকায় রায়গঞ্জের অভিজিৎদা আর সুদীপদার আসতে আসতে একদিন দেরি হয়ে গেছে। ওঁরাও আমাদের সঙ্গেই ট্রেকিং-এ যোগ দেবেন। ব্রেকফাস্টের পর সব্বাইকে "সুইমিং পুলে" যাওয়ার জন্য ডাকা হল! ওখানেই ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম। ক্যাম্প ডিরেক্টর রতনজী আমাদের নিয়মগুলো আবারও মনে করিয়ে দিলেন। প্রত্যেককে শালীনতা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হল। ট্রেকারদের মধ্য থেকে একজন টিম লিডার ও একজন ডেপুটি লিডার বেছে নেওয়া হল। টিম লিডার সবার শেষে আসবে ও কেউ যাতে দলছুট না হয়ে যায় তার দিকে নজর রাখবে। ডেপুটি লিডার সবার ভালোমন্দের খবর রাখবে। বাঙালি হিসেবে গর্ব হল যখন রতনজী বললেন যে একমাত্র বাঙালিরাই ট্রেকিং-এ যাওয়ার আগে পড়াশোনা করে আসে! এর পর মরুভূমির বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে, সব ট্রেকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইয়ুথ হোস্টেলের নিজস্ব এক-দুই-এক-দুই-তিন স্টাইলের হাততালির মাঝে বক্তব্য শেষ করলেন। লাঞ্চের আগে কিছু সময় হাতে থাকায় আমরা আরও একবার শহরটাকে ঘুরে গড়িসার লেকের বড় বড় শুঁড়ওয়ালা মাগুর মাছ, সালিম সিং-এর হাভেলি আর পুরোনো রাজপ্রাসাদ দেখে এলাম। লাঞ্চের পর চার-পাঁচ দিন ট্রেকিং-এর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ইয়ুথ হোস্টেলের দেওয়া ছোট রুকস্যাকে ভরে, বাকি জিনিসপত্র জমা রেখে এলাম। মরুভূমির সামনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাস রেডিই ছিল। ক্যাম্পের সব্বাই আমাদের আটান্ন জনের ট্রেকিং টিমকে বিদায় জানিয়ে বাসে তুলে দিলেন।
বিকেল তিনটে নাগাদ যখন বাস ছাড়ল, তখনও দুপুর রোদের ঔজ্জ্বল্য একটুও কমেনি, তবে শীতকালের নরম রোদে ঠাণ্ডার আবেশ মেশানো এক মনোরম পরিবেশ পেলাম। পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে খারারায় বাস থেকে নেমে দেখি এক পাশে ধূ ধূ মরুভূমি আর অন্য দিকে কালো পিচে ঢাকা হাইওয়ে। দু-একটা ট্যুরিস্ট টেন্টও চোখে পড়ল। এখান থেকেই শুরু হবে পায়ে পায়ে মরুভ্রমণ। প্রথম মরুক্যাম্প এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ক্যাম্প-লিডার ভরতজী আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চললেন, আর আমরা লম্বা লাইন করে তাঁর পেছন পেছন এগোলাম। মরুভূমির সীমানার দিক হওয়ায় এখানে বেশ কিছু বড় বড় গাছ চোখে পড়ল। কিছুদূর এগোতে না এগোতেই দেখলাম পেছনের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছি। তবে ভরতজী সঙ্গে থাকায় নিশ্চিন্ত ছিলাম। একজনের মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় একটি গ্রুপ অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। পুরো লাইনের ওপর ঠিকঠাক নজর রাখতে না পারার জন্য টিম লিডার বেচারাকে মৃদু ধমকও শুনতে হল! কিছুক্ষণ পরেই খাবা বা খাম্বা ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। কোনও রাস্তা না থাকলেও ছোট ছোট মোটর ভ্যান, বালির ওপর দিয়ে খাওয়ার জিনিসপত্র নিয়ে এখানে পৌঁছতে পারে। ক্যাম্প বলতে একটা ছোট পাকা ঘর যা আসলে স্টোর রুম, আর কয়েকটি টেন্ট। ক্যাম্প লিডার ভরতজী প্রথমেই ছেলে ও মেয়েদের আলাদা টেন্টে ভাগ করে দিলেন। আর টয়লেট? "লড়কে লোগ বাঁয়ে তরফ আউর লড়কি লোগ ডাঁয়ে তরফ জাইয়েগা!" আর কোন ভাবেই যেন এর অন্যথা না হয়। তাকিয়ে দুদিকেই ফাঁকা মাঠ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না! প্রত্যেকে নিজেদের টেন্ট বেছে নিলাম। আমরা চার বাঙালী একই টেন্টে জায়গা করে নিলাম। ইয়ুথ হোস্টেলের তরফ থেকে রাতের স্লিপিং ব্যাগ দিয়ে দেওয়া হল।
খাবা জায়গাটা ঠিক মরুভূমির মধ্যে বলা যায় না, বরং কিছুটা লোকালয় ঘেঁষা। কিছুটা দূরে একটা গ্রামও আছে। কাছাকাছি কিছু চাষের জমিও আছে। সরাসরি চোখে না পড়লেও হাইওয়ে খুব বেশি দূরে নয় আর তার পাশে পর্যটকদের জন্য গড়ে ওঠা টেন্ট-হোটেল থেকে গানবাজনার আওয়াজ ভেসে আসছিল। মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া হাইটেনশন ইলেকট্রিক লাইন গভীর নীল আকাশকেও যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল। যাত্রাপথের পরের অংশ সম্পর্কে এখন থেকেই সন্দিহান হয়ে পড়লাম। বিকেলে আমরা মরুভূমির শেষ সীমানায় সূর্যাস্তের সৌন্দর্য দেখব বলে কিছুটা দূরে একটা ঢিপির দিকে এগিয়ে চললাম। ঢিপির পেছনেই চাষের জমি। বড় বড় কিছু সোলার প্যানেলে পাম্প চালিয়ে মাটির বহু নীচে জমে থাকা জল তুলে এনে চাষের কাজে লাগানো হয়। একটা বড় রিজার্ভার বানানো হয়েছে বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য, তবে তা বেশিরভাগ সময় খালিই পড়ে থাকে। ফসল তুলে এনে রাখার জন্য দুটো ছোট খড়ের ছাউনিওয়ালা পাকা খামার-ঘর বানানো হয়েছে।
কোথায় দিগন্ত, বরং দূরে ইলেকট্রিক তার আর গ্রামের সীমারেখার পেছনে কিছুটা অনাড়ম্বর ভাবেই সূর্যাস্ত হয়ে গেল। তবে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা মন ছুঁয়ে গেল। পড়ন্ত বিকেলে আবার বিনা আগুনে "ক্যাম্প ফায়ারের" ব্যবস্থা হল। তবে এখানে অনুষ্ঠানটা পরিচয়পর্ব আর অভিজিৎদার একটা সুন্দর স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির মধ্যেই শেষ হল। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার নামার আগেই ক্যাম্পে ফিরে আসতে হয়, নয়তো দিক ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
দিনের আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গেই জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা নেমে এল। "রাত" আটটার মধ্যে ডিনার রেডি। ক্যাম্পে কোন আলোর ব্যবস্থা নেই। খাওয়ার সময় সঙ্গের হেডল্যাম্পটা জ্বেলে নিলাম। রাতের খাবারে ভাত, ডাল ছাড়াও রয়েছে পুরি আর আলুর দম। পরিষ্কার রাতের আকাশে তারার ঝিকিমিকি আর উজ্বল চাঁদের আলো এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করল। দিগন্ত প্রসারিত আকাশের প্রতিটি তারাই মিটমিট করে জ্বলে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডার জন্য খুব তাড়াতাড়ি টেন্টে আশ্রয় নিতে হল। স্লিপিং ব্যাগে আশ্রয় নিতে গিয়ে দেখি তাতে সাইড চেনটা কাটা। অগত্যা জ্যাকেটের ওপর দিয়েই সেটাকে চাপিয়ে নিলাম। ভোররাতে বাইরে বেড়িয়ে দেখি আকাশ যেন আরও পরিষ্কার, প্রতিটা ছায়াপথও খালি চোখে ধরা পড়ে।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৪
ধোঁয়া, ধুলোবালিহীন পরিবেশে ভোরের সদ্য ফুটে ওঠা সূর্য অনেক নির্মল। এখানে সকাল হয় অনেক দেরিতে, প্রায় সাড়ে সাতটা। বাইরে বেড়িয়ে দেখি একটা উট বসে জাবর কাটছে, পরবর্তী গন্তব্যে ও আমাদের সাথী। উটের মালিক খেরো সিং আসলে মেষপালক। "সিজনে" উটের সওয়ারিতে কিছু আয় করে নেয়। অভ্যাসমত উটের নাম জিগ্যেস করেই ফেললাম, জবাব এল "রাজু"! এর আগে অমরনাথে প্রায় সব ঘোড়ার নামই পেয়েছিলাম রাজু, এখানে উটেরও তাই! লাঞ্চপ্যাকে ঘিয়ে ভাজা পুরি আর আলুর দম ভরে নিয়ে রেডি হলাম আজকের যাত্রা শুরুর জন্য। ভরতজী এক বিদায়ী ভাষণ দিলেন এবং "চিলিমিলি ঝিলিমিলি ধুম-ধুমাকা, হু-হা হু-হা..." এক আজব স্লোগানে আমাদের যাত্রা শুরু হল। "রাজু" উট পিঠে আমাদের খাওয়ার জল আর নিজের খাবার নিয়ে সবার সামনে গাইড হিসেবে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল! আর খেরো সিং পেছনে আমাদের দেখভাল করতে করতে তাকে অনুসরণ করল। ঘন্টা দুয়েক বালিপাথরের ওপর দিয়ে হাঁটার পর একটা বালিয়াড়ির সামনে জিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হল।এখানে দু'দিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে। একটা পাথুরে, গাড়ি চলাচলের রাস্তা অন্যটা বালিপথ। উটকে খেতে দেওয়া হল। খাওয়ার পর এক আজব কায়দায় ও জাবর কাটতে লাগল। প্রথমে সামনে থাকা একটা পিলারে গলাটা ঘষে নিচ্ছিল, তারপর একটা ঢেঁকুর তুলে খানিক্ষণ জাবর কেটে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছিল! সামনের বালিয়াড়িটার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। এই বালিয়াড়িটা আসলে পাহাড়ের ক্ষয়ে যাওয়া অংশ। যেদিক থেকে হাওয়া আসছে সেদিকে শুধুই মসৃণ বাদামী পাথর, আর হাওয়ার উল্টোদিকে শুধুই বালি। অনেকেই বালিতে ঝাঁপিয়ে, ডিগবাজি খেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর বালিপাহাড়কে পেছনে রেখে বালিপথ ধরে এগিয়ে চললাম। এখানে মরুভূমি বলতে শুধুই বালি নয়, বরং সেই বালির মাঠে ছোট ছোট শুকনো ঝোপ পুঞ্জ পুঞ্জ করে সাজানো, অনেকটা ধানক্ষেত থেকে ধান কেটে নেওয়ার পর শুকনো গোড়াগুলো পড়ে থাকার মত। আর সেই শুকনো ঝোপেই চড়ে বেড়াচ্ছে হাড়গিলে চেহারার কিছু গরু। কিছুদুর এগোতেই চোখে পড়ল একদল বুনো উট, কাঁটাঝোপের থেকেই নিজের খাবার খুঁজে নিচ্ছে। জিন পরানো, লাগাম দেওয়া উটের মত এরা পরাধীন নয়। এক ধরনের ঝোপে সাদা ছোট ছোট ফুল ফুটে রয়েছে। আর খানিক এগোতেই "রাজু" উটের আবার খিদে পেয়ে গেল। একটা কাঁটাঝোপের পাতা কাঁটা না বেছেই দিব্য খেয়ে নিল। এর মাঝেই উটমালিক রাত্রিবেলায় ৩১ ডিসেম্বরের পার্টি আয়োজন করার প্রস্তাব দিল। দশ হাজারের জায়গায় মাত্র হাজার সাতেক টাকা দিলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পাকিস্তানি গায়ক গায়িকারা আসর জমাবে। বুঝতে পারলাম আরও একবার প্রতারকের পাল্লায় পড়তে চলেছি।
একঘেয়ে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বিরক্তিই লাগছিল। পাহাড়ি পথে প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে থাকে প্রকৃতির নতুন রূপ, সেই বৈচিত্র্য এই মরুপথে কোথায়? হঠাৎ কানে ভেসে এল "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে..."। আশ্চর্য হয়ে দেখি ইন্দোরের কবিতা ম্যাডাম ক্লান্তি ভুলতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শরণাপন্ন হয়েছেন। আমরা বাঙালিরাও তার সঙ্গে গলা মেলালাম। আরও কিছুটা হাঁটার পর রাস্তার প্রকৃতির এক আমূল পরিবর্তন দেখতে পেলাম। বালির ওপর দিয়ে কষ্ট করে হেঁটে সামনে দেখি কিছুটা নীচু সমতল মরুভূমি। এতক্ষণ বালি আর ছোট-বড় ঝোপঝাড় আমাদের সঙ্গী ছিল। কিন্তু নিচের যে মরুভূমি দেখতে পেলাম সেখানে ঝোপের কোন চিহ্নই নেই। জমি অনেকটা শুকনো বালিমাটির মত, আর বেশ কিছুটা দূরে দূরে বড় বড় গাছ। ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটা ছোট ঘর একা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের অস্তিত্বের কোন লক্ষণই চোখে পড়ল না। একটা বড় গাছের ছাওয়ায় বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া গেল। ভরদুপুরের রোদ চড়া হলেও জোরালো ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য বিশেষ একটা গায়ে লাগছে না। একটা চাতালের ওপর বসে দুপুরের লাঞ্চটা সেরে নিলাম। মরুভূমির বালি জীবাণুমুক্ত। রতনজীর টিপস মতো তাই দিয়েই লাঞ্চবক্সটা মেজে নিলাম। তেলচিটে ভাবটা পুরো উধাও হয়ে গেল। খাম্বা ক্যাম্প থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে এই মরুদ্যানটির নাম "অম্বে কি বেড়ি"। একটি ছোট্ট কুয়ো আছে যার জল খালি জীবজন্তুদেরই খাওয়ানো হয়। "অম্বা"জীর নামাঙ্কিত একটা ফলকও চোখে এল। মন চাইছিল না সুন্দর মরুদ্যানটিকে ছেড়ে যেতে, কিন্তু আবার পাথুরে জমি ধরে এগিয়ে যেতে হল। দু-তিন কিলোমিটার যেতে না যেতেই আবার একটা খোলা মাঠের মাঝে গাছতলায় যাত্রাবিরতি নেওয়া হল। সঙ্গের খাওয়ার জল শেষ হয়ে এসেছিল। উটের পিঠে করে বয়ে আনা জার থেকে জলের বোতল ভরে নিলাম। জলটা কেমন যে ফেনা ফেনা। বেশ কয়েক ফোঁটা জিওলিন দিয়েও সেই জল খেতে সাহস পেলাম না। এক সময় আমরা গ্রাম্য পথ ধরলাম। সেখানে কিছু পাথরের মূর্তি আর নক্সাকাটা পিলার দাঁড় করানো দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম ক্রমশঃ শহরের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি। গোবর্ধনের ক্ষেত বলে এক জায়গায় কতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমাদের ঘিরে ধরল। বয়স্করা সাপুড়িয়া বাঁশি বাজানো শুরু করল আর মেয়েরা তার তালে তালে জিপসি নাচ নাচল। এখানে এই বাঁশি পুঙ্গি বা পাঙ্গি নামে পরিচিত। বাচ্চা ছেলেরা মোরচ্যাং নামে এক অদ্ভুত যন্ত্র বাজিয়ে শোনাল। এই ছোট্ট বাজনাটা মুখে নিয়ে বাজানো হলেও আসলে তারের যন্ত্র। ধনুকের ছিলাকে টেনে ছেড়ে দিলে যেমন শব্দ হয়, এর আওয়াজ অনেকটা সেরকম। একটু পরেই আমরা বালিঝড়ের কবলে পরলাম। কোনরকমে মাথা ঢেকে, গুটিসুটি মেরে মাটিতে বসে পরা ছাড়া উপায় ছিল না। আমাদের সৌভাগ্য যে মাঝ মরুভূমিতে ঝড়ের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়নি। একটু পরেই বালিঝড় থেমে গেল, বিস্তীর্ণ বালিরাশির ওপর এঁকে গেল সুদৃশ্য আলপনা। বিকেল হওয়ার আগেই আমরা স্যাম শহরে পরের ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। "অম্বে কি বেড়ি" থেকে এই ক্যাম্প মাত্র চার কিলোমিটার দূরে। ক্যাম্পে পৌঁছানো মাত্র ক্যাম্প লিডার ও তার ছোট্ট ছেলেটি আমাদের স্বাগত জানাল।
সাম শহরের এক ধার ঘেঁসে তৈরি হওয়া ক্যাম্পটি ইয়ুথ হোস্টেলের নিজস্ব জমির ওপর বসানো। ক্যাম্পের মাঝে একটি বাঁধানো বড় গোলাকার ঘেরা জায়গা। একপাশে আয়োজক, ক্যাম্প লিডার ও মেয়েদের টেন্ট আর রান্নাঘর। অন্যদিকে ছেলেদের টেন্ট। মেয়েদের জন্য একটি পাকা টয়লেট তৈরি হচ্ছে, যা কোনরকমে ব্যবহার করা যায়। ছেলেদের জন্য এবারও ক্যাম্প এরিয়ার বাইরে খোলা মাঠ! দুটি সাময়িক টেন্ট-টয়লেট বসানো হয়েছে বটে, তবে ঝোড়ো হাওয়ায় পর্দার আর কোনও অস্তিত্বই নেই। শহরের মধ্যে এরকম টয়লেট বিহীন ক্যাম্প দেখে সবাই একটু অসন্তুষ্টই হল। নিজেদের টেন্ট গুছিয়ে ব্যাগ পত্তর রেখে ক্যাম্প লিডারের সঙ্গে আমরা চললাম একত্রিশে ডিসেম্বরের সাম শহরের উৎসবমুখর পরিবেশকে অনুভব করতে। শহরটা পাকিস্তান বর্ডারের খুব কাছাকাছি। ভারতের শেষ সীমান্ত থেকে বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখার জন্য কাতারে কাতারে মানুষ জমা হয় এই মরুশহরে। ক্যাম্প লিডারের কথায় লাখ লাখ লোকের সমাগমে এই সময় ভারত ও পাকিস্তান যেন এক হয়ে যায়। শহরের এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ট্যুরিস্ট টেন্ট। রাত পিছু কোনোটা পাঁচ হাজার, কোনোটা দশ হাজার, কোনটা বা তারও বেশি টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। বাইরে থেকে টেন্টের আকৃতি দেওয়া হলেও ভেতরে যে কোন বড় হোটেলের বিলাসবহুল ঘরের সবরকম বন্দোবস্ত থাকে। প্রতিটি টেন্টেই বছরের শেষ রাতকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নাচ গান সহ বিভিন্ন আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে সামের মূল আকর্ষণ হল মাইলের পর মাইল বিস্তৃত নিরবিচ্ছিন্ন বালিয়াড়ি। কোনোটা শুধুই বালির ঢিবি, কোনোটা বা অর্ধচন্দ্রাকার বার্খান। প্রতিটির গায়ে হাওয়ায় আঁকা সুদৃশ্য নক্সা। তবে অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে আর উটের পায়ের ছাপে প্রকৃতির এই অসামান্য শিল্প অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়ে গেছে। পাছে নক্সাগুলো হারিয়ে যায় তাই বালির ওপর পা ফেলতেও আমাদের মায়া হচ্ছিল। অথচ লাখ লাখ পর্যটক সেই বালির ওপর নেচে, গড়িয়ে, বালি ছুঁড়ে এক অলীক আনন্দ উপভোগ করছিল। হয়তো আবার হাওয়া দিলেই নতুন এক শিল্প ফুটে উঠবে, তবু এক শিল্পের করুণ পরিণতি দেখে মনটা ভারী হয়ে উঠল। গোবর্ধনের ক্ষেতের সেই জিপসি নাচিয়ে দলটিকে এখানেও দেখতে পেলাম।
সূর্যাস্ত এখানে ভারি মনোরম, গোল থালার মত সূর্য দুষ্টু হাসি হেসে বালিয়াড়ির পেছনে টুক করে লুকিয়ে পড়ে। আকাশ সামান্য মেঘলা থাকায় একটু তাড়াতাড়িই সূর্যাস্ত হয়ে গেল। দিনের শেষে খানিক ক্লান্তই লাগছিল তাই বেশি দেরি না করে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। এসে শুনলাম উটওয়ালা সাত হাজার টাকায় রফা করলেও শেষমেশ দশ হাজারের কমে রাতের অনুষ্ঠান করতে শিল্পীরা রাজি হয়নি। তাই অতিরিক্ত টাকা দিয়েই পাকিস্তানি শিল্পীর নাচ গানের আয়োজন করা হয়েছে। আগের রাতের কষ্টকর অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি এড়াতে নিজে বেছে স্টোর রুম থেকে রাতের স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে নিলাম। রাতের খাবারটা একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নেওয়া হল। ডিনারে ঘিয়ে ভাজা ভাতের সঙ্গে নিরামিষ সবজি তো ছিলই, তবে ঘিয়ে ভাজা রুটির সাথে এক নতুন ব্যঞ্জন পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম তরকা, কিন্তু খেতে গিয়ে বুঝলাম স্বাদ একটু কষা। জিগ্যেস করে জানতে পারলাম মেথির সবজি! এদের একটা কমন রেসিপি হল কোনও খাবারকে সেদ্ধ করে জল ফেলে ঘিয়ে ভেজে নেওয়া। মেথির সবজিও সেভাবেই বানানো হয়েছে। তবে খেতে খুব খারাপ লাগে না, আর শুধু মেথি দিয়েই যে কোনো ব্যঞ্জন হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও আসে নি। শেষপাতে অবিকল পাটালি গুড়ের মত দেখতে ও খেতে এক ধরণের মিষ্টি দেওয়া হল। রেসিপি জানতে গিয়ে বোকা বনে গেলাম, বেসনকে জলে ফুটিয়ে ঘি আর চিনি দিয়ে ভেজে নিয়ে এটি তৈরি। মিষ্টিটির আঞ্চলিক নাম মোহনথাল। রান্নায় ঘি-এর ব্যবহার দেখলে মনে হয় এখানে বোধহয় তা জলের চেয়েও সস্তা। ক্যাম্প লিডারের কাছে শুনলাম, বিয়ের পর নাকি এখানে মেয়েদের পঁয়তাল্লিশ দিনে চল্লিশ কেজি ঘি খাওয়ানো হয়, এটাই রীতি! রাতে ঠাণ্ডা বাড়ছিল, পরদিন সক্কাল সক্কাল রওনা দিতে হবে, তাই রাতের জলসায় না থেকে একাই টেন্টে গিয়ে শুয়ে পরলাম। পরে শুনেছিলাম দেশ-বিদেশ থেকে পুরস্কার প্রাপ্ত পাকিস্তানি আর্টিষ্ট কিছু বলিউডি সিনেমার গান শুনিয়ে দুই ঘন্টার অনুষ্ঠান এক ঘন্টায় শেষ করে বিদায় নিয়েছেন। অনুরোধ সত্বেও নিজের দেশের গান বা আঞ্চলিক গানের একটা সুরও গাননি।
১ জানুয়ারি ২০১৫
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাইরের দিকে চেয়ে খানিক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ঘন কুয়াশায় চারদিক ঢেকে গেছে, দু-হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্যে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে - হাড়কাঁপানো শীত। হাতমুখ ধুয়ে উঠতে না উঠতেই টেন্টের পেছন থেকে শোরগোল ভেসে এল। গিয়ে দেখি বালির ওপর একটা সাপ নেতিয়ে পড়ে আছে। রাতের বেলা বেচারা খাবার খেতে বেরিয়েছিল, কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বালির ওপরই জমে গেছে। সাপটা কিন্তু মরে যায় নি, শুধু স্থবির হয়ে পরে ছিল। এক উৎসাহী ট্রেকার সাপের লেজ ধরে তুলে হাতে নিয়ে কিছু ফটো তুলে নিল। মানুষের হাতের গরম ছোঁয়ায় সাপটা মনে হয় একটু আরামই পেল।
ঘড়ির কাঁটায় আটটা বাজতে না বাজতেই ক্যাম্পের বাইরে সার বেঁধে উট এসে দাঁড়াল। এদিন প্রায় দশ কিলোমিটার উট সওয়ারি করতে হবে। এক উটে দুজন করে। আমি আর মৃণালদা একটা উটের পিঠে চেপে বসলাম। উট বসার থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় ব্যালেন্স করে তার পিঠে বসে থাকাটা সওয়ারের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। হাঁটু মুড়ে উটটা প্রথমে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, মুহূর্তের জন্য আমরা পেছনে হেলে গেলাম। সামনের দিকে ঝুঁকে ব্যালেন্স করতে যাব হঠাৎ উটটা পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হল এই বুঝি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব। উট মহাশয় অবশেষে সামনের পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। লম্বা উটের সারি যখন রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছিল তা দেখতে রীতিমত ভিড় জমে গেল। ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে পড়েছে, চারদিক কুয়াশা ঘেরা, তার মধ্যে দুদিকে দু'পা ছড়িয়ে বসে থাকতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছিল। লোকালয় পেরিয়ে উট এগিয়ে চলল গ্রামের রাস্তা ধরে। ফাঁকা মাঠ আসতেই হাওয়ার বেগ দ্বিগুণ হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল উটের পিঠে বসেই আমরাও সাপটার মত জমেই যাব। কেউ কেউ উটের পিঠ থেকে নেমে হেঁটে যাওয়াই শ্রেয় মনে করল। পথে একটা বড় গ্রাম পড়ল, ধারেকাছে কোনও নদী না থাকলেও এর নাম গঙ্গা গ্রাম, বড় একটা স্কুলও আছে। গ্রাম পেরিয়ে যখন আবার বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে চলা শুরু হল ততক্ষণে ঠাণ্ডায় শরীর অবশ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝে বালিয়াড়ির মাঝেই উটগুলোকে থামানো হল। উটের পিঠ থেকে নামতে যাওয়াও আরেক ঝঞ্ঝাট। উটের বসাটা, দাঁড়ানোর ঠিক উল্টোরকম, প্রথমে সামনের পা মুড়ে বসে পড়ে, তারপর ধীরে ধীরে পেছনের পা দুটো ভাঁজ করে নামিয়ে আনে, এক্ষেত্রে ব্যালেন্স রাখা আরও কঠিন। নামার পর পায়ে কোনো সাড় পেলাম না, দাঁড়াতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, একটা কাঁটাঝোপকে আঁকড়ে ধরেই কোন রকমে টাল সামলে নিলাম। উটওয়ালারা হাত পা সেঁকে নেওয়ার জন্য আগুন জ্বালিয়েছিল, অতিকষ্টে সেই আগুনের কাছে পৌঁছে হাত পায়ের আড়ষ্ট ভাব কাটালাম। আমাদের উটকে যে ছেলেটা গাইড করে নিয়ে যাচ্ছিল, তার নাম আবদুল, বয়স খুব বেশি হলে পনেরো-ষোল। ওকে জিগ্যেস করে জানতে পারলাম এখানে উটদের বেশ আকর্ষণীয় নাম দেওয়াই রীতি। কখনও কখনও হিন্দি সিনেমার নায়কদের নামে উটের নাম রাখা হয়। তবে আমাদের সঙ্গী উটের নাম রকেট।
যাত্রাবিরতির পর মৃণালদা আর উটের পিঠে উঠতে চাইল না, তাই আবদুল নিজেই আমার সামনে বসে গেল। বালির ওপর দিয়ে কিছুদূর যেতে না যেতেই আবার পাকা রাস্তা দেখতে পেলাম। নির্জন রাস্তায় সারাদিনে হয়তো হাতে গোনা অল্প কয়েকটা গাড়িই চলে, কিন্তু রাস্তাঘাট ঝকঝকে তকতকে, মসৃণ। উটের পিঠ থেকে যেখানে নামানো হল জায়গাটার নাম "নিম্বা ফান্টা", যার অর্থ দুই রাস্তার সংযোগস্থল। কিছু বখশিশ দিয়ে উটওয়ালাদের বিদায় জানানো হল। এখান থেকে পাকা রাস্তা ধরে আমাদের হাঁটতে হবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। চারদিকে ধু-ধু মাঠ থাকায় রাস্তাগুলো বানানো হয়েছে সরলরেখা বরাবর, অভিজিৎদার কথায় "যেন স্কেল ধরে টেনে দিয়েছে"। খানিক দূর এগোতেই চোখে পড়ল "বালিয়াড়ির চলন"। শনশনে হাওয়ায় বালির রাশি উড়ে গিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বালির ঢিবি তৈরি করছে। সেই ছবি তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে আমার ক্যামেরায় বালি ঢুকে খারাপ হয়ে গেল। দুপুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা ফিকে হয়ে গেছে। চারদিকের কাঁটাঝোপে বাসা বেঁধে থাকা পার্পল সানবার্ডের সুরেলা ডাক কানে ভেসে আসছিল।
দুপুর দু'টো নাগাদ আমরা সুদাসরী ন্যাশানাল পার্কে পৌঁছালে পরবর্তী ক্যাম্পের লিডার আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। এই পার্কটি ভারতের সবচেয়ে বড় ডেসার্ট ন্যাশনাল পার্ক। একটি কুঁড়েঘরের সামনে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। সুদাসরী পার্ক মূলত বিভিন্ন পাখির জন্য বিখ্যাত। এখানে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড, বিভিন্ন প্রজাতির ঈগল, বাজপাখি আর শকুনের বাস। এছাড়া হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি আর ডেসার্ট ফক্স তো আছেই। তবে বিশেষ সৌভাগ্য না থাকলে এতগুলো জীবের দেখা মেলে না। আমাদের ক্যাম্পটা এই পার্কের অনেকটা ভেতর দিকে। চলতে গিয়ে আবারও একবার জমির প্রকৃতির পরিবর্তন চোখে পড়ল। এখানে মাটি শক্ত পাথুরে, দূরে দিগন্তরেখায় কয়েকটা গাছের আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে এক শুকনো মাটির পথ পেলাম। পাশে একটা গরুর কঙ্কাল চোখে পড়ল। বুঝতে পারলাম, গরুটা মরে যাওয়ার পর শুকিয়ে গেছে, কিন্তু পচন ধরে নি। এখানকার আবহাওয়ায় ব্যাকটেরিয়া বাঁচতে পারে না। পার্ক থেকে আরও দু'তিন কিলোমিটার হেঁটে সুদাসরী ক্যাম্পে যখন পৌঁছলাম তখন ঝোড়ো হাওয়া বইছে। টেন্টের ভেতরটা বালিতে ভর্তি, আর চেষ্টা করেও টেন্টের পর্দা আটকে রাখা যাচ্ছে না। অনেক কষ্টে ইঁট চাপা দিয়ে টেন্ট ঠিক করে ভেতরটা পরিষ্কার করে নেওয়া হল। সুদাসরী ক্যাম্পটা ফাঁকা মাঠের মাঝখানে, তবে এই মাঠে কিছু কাঁটাঝোপের গাছপালা আছে। শুনতে পেলাম কাছেই একটা গ্রামও আছে। তবে পার্কের মধ্যে গাড়ি চলার কোনও রাস্তাই নেই। এখানেও অন্য ক্যাম্পের মতই জল ব্যবহারে বিশেষ বিধিনিষেধ আছে। এক ড্রাম জল বাসন ধুয়ে নেওয়ার জন্য, আরেক ড্রাম খাওয়ার জল। একটা গরু দেখলাম সবার অগোচরে খাওয়ার জলে মুখ দিয়ে গেল। সামনেই সুদাসরীর বালিয়াড়ি। ক্যাম্পের রাঁধুনি ছেলেটা আমাদের বালিয়াড়ি পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। ছেলেটার বাড়ি জয়সলমীরে, চোদ্দ-পনের বছর বয়সেই ওকে আয়ের পথ বেছে নিতে হয়েছে।
গাছপালার আড়াল পেরোতেই আমরা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টির দিকে। লোকচক্ষুর আড়ালে এই বালিয়াড়ির প্রত্যেকটা স্তুপ নিখুঁত ভাবে তৈরি। প্রত্যেকটা ঢিপিই নক্সাকাটা। ফুরফুরে হাওয়াই যেন এখানে শিল্পী আর বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি তার আঁকার ক্যানভাস। ছোট ঝোপ বা খড়কুটো সবই তার ছবি আঁকার তুলি আর ইচ্ছেমতন এঁকে ফেলছে সুদৃশ্য বালির আলপনা। আকাশ মেঘলা বলে আলো কিছুটা কম, ক্যামেরায় ছবি হয়তো তত ভালো আসে না, কিন্তু আলো-আঁধারির মাঝে প্রত্যেকটা ঢিবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চলমান অশরীরির মতই হাওয়ার স্রোতে হঠাৎই আবির্ভাব হয়, হাওয়ার ভাষায় ফিশফিশিয়ে ভাব বিনিময় করে, হাওয়ায় ভেসে রাতারাতি জায়গা বদল করে, আবার শেষে আপন খেয়ালে হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়। এখানকার বালিয়াড়ি অনেকটা মাটির রঙের, সাম ডিউনসের মত লালাভ সোনালি নয়, বালিও অনেক সুক্ষ্ম, হাওয়ায় সহজেই ভেসে বেড়ায়। পর্যটকের ভিড় না থাকায় বালিয়াড়ির পুরোটাই অক্ষত। কেউ কেউ বালির ঢিবির ওপর শুয়ে-বসে, কেউ বা লাফিয়ে ঝাঁপিয়েই পুরো বিকেলটা কাটিয়ে দিল। মেঘের আড়ালে আমাদের অজান্তেই কখন যেন সূর্যাস্ত হয়ে গেল।
ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পথেই হালকা বৃষ্টি শুরু হল। শুকনো মরুভুমিতে এই শীতের শুকনো আবহাওয়ায় বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হবে এতটা আমরা কেউই ভাবতে পারি নি! জানতে পারলাম ঘন কুয়াশার পর এরকম বৃষ্টি খুব স্বাভাবিক, আর তা ভুট্টা চাষের জন্য ভীষণ জরুরিও। রাতের খাবারে ভাত ছাড়াও ছিল রাজস্থানের নিজস্ব রেসিপির ডাল বাটি আর চুরমা। তৃপ্তি করে রাজস্থানী খাবারে পেট ভরালাম। ঝোড়ো হাওয়া থেমে যাওয়ার পর রাতের আকাশে একটা-দু'টো করে তারা চোখে পড়ল। জমাটি ঠাণ্ডায় কারোরই আর বিনা আগুনে ক্যাম্প ফায়ার করার এনার্জি ছিল না। সাত তাড়াতাড়ি স্লিপিং ব্যাগে আশ্রয় নিলাম।
২ জানুয়ারি ২০১৫
সকালের সোনালি রোদ টেন্টের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল। দেখলাম পরিষ্কার আকাশে কিছু সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মুম্বাই থেকে আসা প্রতীকের আজ জন্মদিন, ওকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলেই বার্থডে উইশ করা হল। পোহা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম পরের ক্যাম্পের দিকে। এখানে আমাদের গাইড ভূরে খাঁ আর তার উট 'রাজু'! আকাশ পরিষ্কার থাকায় এবার বালিয়াড়িগুলোকে অনেক উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। বালিতে হেঁটে যাওয়া ইঁদুরের পায়ের ছাপও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। সুদাসরীর বালিয়াড়ির স্থানীয় নাম "গজই মাতার" বালিয়াড়ি। কাছেই একটা জৈন মন্দির। এদিন চলার পথে বেশ কিছু স্থানীয় লোকজন চোখে পড়ল। দু'তিন কিলোমিটার যেতে না যেতেই একটা শুকনো জলাধারের পাশে বিশ্রামের জন্য ঘন্টা খানেকের বিরতি নেওয়া হল। বুঝতে পারলাম এদিন খুব বেশি দূর হাঁটতে হবে না। দুপাশে টিলার মাঝ দিয়ে এক পাথুরে পথের ছবি দেখে দুর্গম গিরিপাস বলে ভুল হতেই পারে।
কিছুদূর যেতে না যেতেই এক খোলা মাঠে বসে লাঞ্চ করে নেওয়া হল। আশপাশে বাড়িঘর না দেখতে পেলেও এটাই নাকি বর্ণা গ্রাম। পাশ দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে। মাঠের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ঝোপ জাতীয় কের বা কেইর গাছ আর তাতে অসংখ্য পাখির বাসা। মাঝে মাঝেই ইন্ডিয়ান রোলার আর কালো রবিন পাখি চোখে পড়ছিল। অটোরিক্সায় এক ভ্রাম্যমাণ দোকান বসেছে, তাতে জল, দুধ থেকে চিপসের প্যাকেট সবই পাওয়া যাচ্ছিল, তবে দাম কিছুটা বেশিই। উটকে হাইওয়ে দিয়ে ক্যাম্পের দিকে পাঠিয়ে ভূরে খাঁ আমাদের সঙ্গে চললেন মেঠো পথে। রাস্তাটা শর্টকাট হতে পারে তবে রোমাঞ্চকর। অঞ্চলটা একটা ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড়ের অংশ। বালিপথে মাঝে মাঝেই সাদা ফুলে ঢেকে যাওয়া একধরণের ঝোপ চোখে পড়ছিল। দুই পাহাড়ের মাঝে এক অগভীর খাত পেরিয়ে যেতে গিয়ে বয়স্কদের অনেকেই হাঁপিয়ে পড়লেন। আসলে ঢাল বেয়ে নেমে আসা সহজ, কিন্তু বালিপথে চড়াই বেয়ে ওঠা বেশ শক্ত। পাহাড়ের ওপরে ওঠায় মাথার ওপর টহল দেওয়া ঈগলগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখা গেল। অল্পদূর যেতেই আবার এক বালিয়াড়ির সামনে এসে উঠলাম। জায়গাটা বর্ণা ক্যাম্পের খুব কাছেই। বালির ওপর কিছু ছাপ দেখিয়ে ভূরে খাঁ জানালেন তা চিতাবাঘের পায়ের ছাপ। দুপুরের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাওয়ায় বালির ঢিবিতে কাটানোর জন্য অনেক সময় পাওয়া গেল। রোদ চড়া হওয়ায় বালিও কিছুটা গরম হয়ে উঠেছে। মৃণালদা দেখাল বালির কিছুটা তলার আস্তরণ অনেক ঠাণ্ডা। প্রচণ্ড গরমে অভিযাত্রীরা অনেক সময় বালির মধ্যে ঢুকে তাপের হাত থেকে নিজেদের বাঁচায়। এখানে কয়েকটা ক্ষয়ে মসৃণ হয়ে যাওয়া পাথর চোখে পড়ল। সাম কিংবা সুদাসরীর থেকে অনেক কম জায়গা জুড়ে এই বালিয়াড়ি, রঙ কিছুটা হলদে, লোকালয়ের কাছে হলেও নিরিবিলি। তবে সুদাসরীর কাছে এর সৌন্দর্য যেন অনেকটাই ফিকে।
দুপুরের রোদ থাকতে থাকতেই আমরা ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। বিকেলে কেউ বা বালিয়াড়িতে কেউ বা আশেপাশের গ্রামের দিকে ঘুরে এলাম। ট্রেকিং-এ এটাই শেষ ক্যাম্প, পাশের হাইরোড আর টেন্ট-হোটেলগুলো শহরের আভাস দিচ্ছিল। অভিজিৎদা টেন্টে বসেই ক্যাম্পের ছবি এঁকে ফেলল। রাতের ডিনারে পেলাম কের-সাংরি শাক, যা একান্তই রাজস্থানী খাবার। এই শুকনো মরুভূমিতে খাবারের খুবই অভাব, তাই কাঁটাঝোপ থেকেই এরা বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে নেয়। এত কম খরচে ঘোরার কথা শুনে বন্ধু সৌমিক খাবার নিয়ে সন্দেহ করে বলেছিল – "দেখবে খাওয়ার সময় লেখা থাকবে 'কাঁটা বেছে খান' আর তারপর ক্যাকটাসের চচ্চড়ি পাতে দেবে"! কিন্তু প্রতিটা রাজস্থানী রান্না আমরা যথেষ্ট তৃপ্তি করেই খেয়েছি। এদিনই ট্রেকিং-এর শেষরাত, তাই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা উপেক্ষা করেও আমরা অন্ধকারে, বিনা আগুনে 'ক্যাম্প ফায়ার' করব বলে ঠিক করলাম। কেউ তামিল কবিতা, কেউ কন্নড় গান, কেউ কমেডি শুনিয়ে, কেউ বা সাম্প্রতিক হিন্দি গানের তালে নাচ করে আসর জমিয়ে দিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সুর একসুরে মিলিয়ে "বন্দেমাতরম্" গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ হল।
৩ জানুয়ারি ২০১৫
বেশ কিছু বড় গাছ থাকায় বর্ণার সূর্য ওঠা কিছুটা আড়ালেই রয়ে গেল। একটু পরেই জয়সলমীরের বেস ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাস এসে পড়বে তাই সকালের ব্রেকফাস্ট সেরেই রুকস্যাক গুছিয়ে নিতে হল। হিমালয়ে ট্রেকিং এর তুলনায় এই ট্রেকিং অনেক সহজ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও হয়তো পাহাড়ি পথের তুলনায় কিছুটা কম। বাঙালি ট্রেকিং টিমের নিয়মশৃঙ্খলা এখানে অনুপস্থিত। আগুন না জ্বালানোর সীমাবদ্ধতা ও ভাষার প্রতিবন্ধকতায় ক্যাম্প ফায়ারও অনেক সময় স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে ওঠে না। কিন্তু মরুভূমির ঘন ঘন রূপ পরিবর্তন, রাজস্থানী সংষ্কৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখা আর ভারতের বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে পরিচয়ের অবকাশ এই ডেজার্ট ট্রেক না করা হলে ট্রেকিং-এর একটি স্বাদ যেন অপূর্ণই থেকে যায়।
'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত দত্ত খুবই বহির্মুখী প্রকৃতির, কাজের ফাঁকে ছুটি পেলেই বেড়িয়ে পড়েন নিরালার খোঁজে। নতুন জায়গার সাথে মিশে আপন করে নেন সেখানকার জীবন, সংস্কৃতি আর খাদ্যাভ্যাস। আর তারপর? পাঠকের কাছে সেই অভিজ্ঞতা সাধ্যমত তুলে ধরার চেষ্টা করন তাঁর অনভিজ্ঞ ভাষায়!