হংকং-এর দিনগুলি রাতগুলি

শ্রাবণী ব্যানার্জি

~ হংকং-এর আরও ছবি ~

'এন্টার দ্য ড্রাগন' সিনেমাটা দেখার পর থেকে হংকং বললে শুধু ক্যারাটে সম্রাট ব্রুস লি-র চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসে উঠত। তাই বেশ কিছু বছর আগে যখন স্বামীর কাজের সূত্রে আমাকে কিছুদিন হংকং-এ কাটাতে হয়, তখন প্রথম অনুভব করি কোনও একটি দেশকে ভালোভাবে জানতে হলে কিছুদিন সেখানে বাস করা কতটা জরুরী। ট্যুরিষ্ট হিসাবে কয়েকদিনের জন্যে কোথাও গেলে সেখানকার দর্শনীয় স্থানগুলি দেখা হয় বটে, কিন্তু সেই দেশটাকে ভালোভাবে জানা হয় না। তাই আমার এই লেখাটা সেই অর্থে ভ্রমণ কাহিনি নয়, এটা অনেকটা আমার চোখে হংকংকে দেখার কিছু টুকরো টুকরো বিবরণ।
হংকং যাওয়ার আগে শুধু এইটুকুই জানতাম যে আমরা 'ক্লিয়ার ওয়াটার' বলে একটা জায়গায় থাকতে যাচ্ছি এবং সেখানে থাকার জন্য আমাদের ফার্নিশড্ ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। এয়ারপোর্ট থেকে সমুদ্রের ওপর বিশাল ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি যত এগোতে লাগল, বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এত উঁচু উঁচু বাড়ি আর আলো ঝলমলে শহর আমি খুব বেশি দেখিনি। এ যেন অনেকটা আমেরিকার লাসভেগাস্-এর আলো আর নিউ ইয়র্কের উঁচু বাড়ির একত্র সমাবেশ।
দক্ষিণ চিন সাগরের ধারে এই শহরটি পৃথিবীর বহু বড় বড় শহরকেই টেক্কা দিতে পারে। হংকং শব্দটির মানে হল 'সুগন্ধ বন্দর'। এখান থেকে নাকি সুগন্ধী ধূপকাঠি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি করা হত। চিনের থেকে লিজ নিয়ে ব্রিটিশরা আসার আগে এখানে মাছের ভেড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মূল দ্বীপ হংকং ছাড়াও কাউলুন পেনিনসুলা আর নিউ টেরিটোরি মিলিয়ে প্রায় দুশোটার ওপর ছোট ছোট পাহাড় আর দ্বীপ নিয়েই এখনকার হংকং। প্রায় দেড়শো বছর থাকার পর ঊনিশশো সাতানব্বই সালে ব্রিটিশরা চলে গেলে হংকং-এর অনেক বাসিন্দাই চিনের আওতায় থাকতে ভয় পায়। তাই নিজেদের দেশ ছেড়ে কানাডা বা অষ্ট্রেলিয়ার মত ব্রিটিশ কমনওয়েলথ দেশগুলিতে চলে যায়। ফলস্বরূপ আজও লোকে মজা করে কানাডার 'ভ্যাংকুভার' শহরকে 'হংকুভার' বলে ডাকে।

অবশেষে আমাদের গাড়ি হংকং-এর নিউ টেরিটোরির 'ক্লিয়ার ওয়াটার বে' নামক জায়গাটিতে এসে পৌঁছাল। সেখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি পাহাড় ও সমুদ্রে ঘেরা 'হংকং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির' মত এত সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু সবথেকে অবাক হয়ে গেলাম ফ্ল্যাটের সাইজ দেখে। হংকং-এর মত জায়গায় শুনেছিলাম লোকে প্রায় পায়রার খুপরিতে বাস করে সেখানে দুহাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কল্পনাতীত। প্রথমে আমাকে অনেকেই বলেছিলেন প্রতিদিন জানালা দিয়ে পাহাড় আর সমুদ্র দেখতে দেখতে আমি নাকি ক্লান্ত হয়ে যাব। সৌভাগ্যবশত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমি আজ পর্যন্ত ক্লান্ত হইনি। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মত ধাপে ধাপে পাহাড় থেকে সমুদ্রের দিকে নেমে গেছে। সমুদ্রের ধারেই প্রকাণ্ড স্যুইমিং পুল আর বিশাল খেলার মাঠ। ইউনিভার্সিটির মধ্যে বিরাট ফুড কোর্ট এবং তাকে ঘিরে বেশ কিছু রেষ্টুরেন্ট, মিনি সুপার মার্কেট। এমন কী একটি ম্যাকডোনাল্ডস্ও বিদ্যমান! সেই প্রথম আমি ম্যাকডোনাল্ডে ভাত বিক্রি হতে দেখি। এরা যেহেতু চপস্টিক দিয়ে খায় তাই ম্যাকডোনাল্ডের ভাতও একটু আঠা আঠা দলা পাকানো যাতে কাঠি দিয়ে তুলতে সুবিধা হয়।
ইউনিভার্সিটিতে দেখলাম বেশিরভাগ চিনা প্রফেসর হলেও বেশ কিছু আমেরিকান ও ভারতীয় প্রফেসরও আছেন। কেউ আমাদের মত এক বছরের জন্য এসেছেন আর কেউ বা বহুবছর ধরেই আছেন। এদের মধ্যে কয়েকটি বাঙালি পরিবার থাকায় আমাদের সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। মাঝে মধ্যেই রেষ্টুরেন্টে খেতে বেরোতাম। তার মধ্যেই একজন এদেশের খাওয়া দাওয়া সম্বন্ধে একটু সতর্ক করে দিলেন। বললেন "মনে রেখ, এদের কাছে টেবিল চেয়ার ও প্লেন বাদ দিয়ে যাদেরই পা ও পাখা আছে সবই খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে পড়ে, তাই না জেনে ঝপ করে কোন খাবারের অর্ডার দিওনা"। সেদিনের সতর্ক বাণী হংকং-এ থাকাকালীন আমার প্রচণ্ড কাজে লেগেছিল। একদিন এক রেষ্টুরেন্টে গিয়ে দেখি একজন একটি লাল রং-এর পুডিং বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছেন, দেখে আমারও জিভে জল এল। আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করাতে জানলাম, উনি ব্লাড পুডিং খাচ্ছেন। মনে মনে ভাবলাম, হট ডগ খাবার সময় তো গরম কুকুর খাই না তাই বোধ হয় লাল রং-এর জন্য এর নাম ব্লাড পুডিং। কিন্তু তিনি হাত মুখ নাড়িয়ে বললেন এটা সত্যি সত্যিই রক্ত দিয়ে তৈরি পুডিং। সঙ্গে সঙ্গেই আমি চেয়ারটিকে উল্টিয়ে ওনার দিকে অভদ্রের মত পেছন ফিরে বসলাম এবং বলা বাহুল্য ঠিক কোন জন্তুর রক্ত দিয়ে সেটি তৈরি হয়েছিল জিজ্ঞাসা করার মত মানসিকতা আমার ছিল না। দেখলাম এরা খেতে বসে শুরুতেই শুধু মুখে মাছ মাংসগুলো খেয়ে নেয় তারপর সবশেষে শুকনো দলাপাকানো ভাত দিয়ে পেটের ফাঁকফোঁকরগুলো ভরিয়ে নেয়। আমাদের মত ছ্যাঁচড়া চচ্চড়ি দিয়ে পেট ভরিয়ে শেষে পোলাও কালিয়ার জন্য অপেক্ষা করে না। ডিমসাম খাবারটি দেখলাম হংকং-এ খুবই চলে। সকালে প্রাতরাশ থেকে আরম্ভ করে বিকেলের জলখাবারের মধ্যে ডিমসাম-এর ছড়াছড়ি। ভেতরে মাংসের বা চিংড়ি মাছের পুর দেওয়া ভাপানো পিঠের মত এই ডিমসাম-এর মানে হল 'যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়'।

আমাদের ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জ্যুডিথ বলে একটি চিনা মেয়ের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওর সঙ্গে একদিন ফিস মার্কেটে মাছ কিনতে গিয়ে গন্ধে প্রায় অন্নপ্রাশনের ভাত ওঠার মত অবস্থা। দেখলাম মুরগীর মাংসের সঙ্গে পাশে ব্যাং-ও বিক্রি হচ্ছে। একজন প্রফেসর বললেন, স্নেক মার্কেটে লোক সাপের রক্ত খেতে যায় তাতে নাকি শরীরের বল বৃদ্ধি হয়! এছাড়া গোটা পাখির রোষ্ট, ছোট ছোট গোটা শুয়োর, বড় বড় কচ্ছপ এবং বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার ফুটপাথের প্রায় প্রতিটি রেষ্টুরেন্টেই ঝুলতে দেখা যায়। সব দেখে শুনে শরীরটা এতটাই ঝিমঝিম করত যে বুঝলাম মাটির দিকে তাকিয়েই রাস্তায় হাঁটাটাই বাঞ্ছনীয়। নেহাৎ বেআইনী বলে কুকুর বেড়াল ঝুলতে দেখি নি, তবে শুনেছিলাম বানরে এদের কোনও আপত্তি নেই।
হংকং যাওয়ার পর থেকেই আমার ছেলে খুব সর্দ্দি কাশিতে ভুগছিল। একদিন জ্যুডিথ এসে বলল, ছেলের জন্য ও কিছুটা গরম স্যুপ পাঠিয়ে দিচ্ছে যেটা খেলে নাকি নিমেষের মধ্যে সর্দ্দি-কাশি সব সেরে যাবে। স্যুপটি কুমীরের মাংসের তৈরি শুনে বললাম, "আমার ছেলে কিছুদিন আগেই ভেজিটেরিয়ান হয়ে গেছে তাই ওসব কিছুই আর খায় না"। উত্তরে জ্যুডিথ বলল, "তোমার ছেলেকে তো কালই আমি ইউনিভার্সিটির ম্যাকডোনাল্ডে চিকেন স্যান্ডুউইচ খেতে দেখেছি"। মনে মনে প্রমাদ গুনে বললাম "আমার ছেলে চিকেন ইটিং ভেজিটেরিয়ান"। সেটা শুনে মুখটাকে একটু বেজার করে বেচারী জ্যুডিথ তার ফ্ল্যাটে ফিরে গেল। একদিন কাগজে পড়লাম যারা হাঁপানিতে কষ্ট পাচ্ছেন তাঁরা যদি প্রতিদিন খালি পেটে গোটা পঞ্চাশেক কাঠ পিঁপড়ে ধরে খেতে পারেন তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাই যেদিন আমাদের এক বন্ধু রেষ্টুরেন্টে 'অ্যান্ট ক্লাইম্বিং হিল' বলে একটি খাবারের অর্ডার দিচ্ছিলেন, সেদিন আমার ফ্যাকাসে মুখ দেখে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন — নুডুলস এর মধ্যে ঢোকানো এগুলো পিঁপড়ের মত দেখতে মাংসের দানা সত্যিকারের পিঁপড়ে নয়, আমি নির্ভয়ে খেতে পারি। সেই কারণে 'ওয়াইফ কেকের' অর্ডার দিলেও আমর গলা কাঁপেনি, কারণ ধরেই নিয়েছিলাম এরা নিশ্চয়ই বউদের মেরে কেক বানায় নি। চালকুমড়ো ও বাদাম দিয়ে বানানো এই 'ওয়াইফ কেক' হংকং-এর খুব জনপ্রিয় খাবার।

ইউনিভার্সিটির মিনি সুপার মার্কেটে ঢুকে প্রথম দিনের সেই অভিজ্ঞতা আজও ভুলতে পারিনি। দোকানে ঢুকে বিশাল লাইন দেখে ভাবলাম খাবার কিনতে হলে নিদেন পক্ষে একঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে হবে, তাই বাড়ি গিয়ে আবার কয়েক ঘন্টা বাদে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি সেই লাইন আরও বেড়েছে বই কমেনি। অগত্যা আমিও ওই বিশাল লাইনের পেছনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম মাত্র মিনিট দশেকের মধ্যেই কাউন্টারের কাছে চলে এসেছি। সেই প্রথম হংকং এর লোকেদের কাজের স্পিড সম্বন্ধে আমার চোখ খুলে গেল। দুটি মেয়ে কাউন্টারে বসে আছে আছে যেন এক একজন এক একটি রোবট। তারা হাসেও না বা আমেরিকার মত শুভেচ্ছাও জানায় না কিন্তু কাজের স্পিড দেখলে বোধহয় রোবটও লজ্জা পাবে। তখনও আমি হংকং-এর টাকায় রপ্ত হইনি তাই গুণে দিতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। আমাকে ঠেলে পাশে সরিয়ে দিয়ে গুণতে বলল, পরের কাষ্টমার দাঁড়িয়ে আছে। সে দিন থেকে ভয়ে সামান্য এক প্যাকেট বিস্কুট কিনলেও একশো হংকং ডলার ওদের হাতে ধরিয়ে দিতাম এবং যা ফেরৎ দিতো নির্ব্বিকারে নিয়ে চলে আসতাম, সামনে দাঁড়িয়ে টাকা গোনার মত সাহস আর ছিল না। হংকং-এ এই লাইন মেনে চলার ব্যাপারটা চিনের অন্যান্য শহরের থেকে ব্যতিক্রম এখানে কেউ লাইন কাট্ করে না অর্থাৎ আমাদের দেশের ভাষায় বুদ্ধি খরচ করে ঠেলাঠেলি করে বেলাইনে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে না। এদের যন্ত্রের মত স্পিড ও নিয়মানুবর্ত্তিতা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
দেড়শো বছর ধরে ইংরেজরা হংকং-এ থাকলেও দেখলাম এদের ইংরেজির অবস্থা খুবই খারাপ। ইংরেজিতে ইউনিভার্সিটি বললেও ট্যাক্সিওয়ালা বোঝে না তাই একজনকে দিয়ে ওদের ভাষায় 'ফোগেদাইহো' কথাটা লিখিয়ে নিয়েছিলাম অর্থাৎ 'হংকং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি'। ভারতবর্ষের প্রতিটি লোক ইংরেজি বলতে না পারলেও ইউনিভার্সিটি বললে অধিকাংশ শহুরে লোকই দেখিয়ে দিতে পারেন। আসলে এরা পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষা বা সংস্কৃতি শিখতে রাজি নয় বলেই মনে হল। মনে করে দুনিয়ার লোককে তাদের ভাষা বা তাদের আচার অনুষ্ঠান শিখতে হবে। এটাই বোধহয় এদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য।
এক বাঙালি ভদ্রলোক বললেন, উনি মাছ কিনতে গিয়ে পরিষ্কার বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন। এদেশের মানুষের কাছে বাংলা ইংরেজি সবই সমান। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে সপ্তাহে একবার যে লোকটি ট্রাকে সবজি নিয়ে আসত, তার সঙ্গে মুখাভিনয় করতে করতে এতটাই পোক্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, তখন বোধহয় যোগেশ দত্তকেও হার মানাতে পারতাম। প্রতিবেশীর টব থেকে কিছুটা ধনেপাতা ছিঁড়ে লোকটার নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দিতাম এবং সেও হাতটাকে সামনের দিকে লাফ মারার মত করে বুঝিয়ে দিত যে পরের সপ্তাহে আনবে। এছাড়া কানের কাছে হায় হায় করার মত সারাক্ষণ 'হায়া' শব্দটা শুনতে পেতাম। জ্যুডিথকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, হায়া শব্দটার আলাদা কোন মানে নেই, কোন টোনে বলা হচ্ছে মানেটা তার ওপর নির্ভরশীল। কেউ যদি সাদামাটা ভাবে বলে 'হায়া' তার মানে হল "আচ্ছা ঠিক আছে"। কেউ যদি চোখটাকে কপালে তুলে বলে হাই অ! তার অর্থ হল ওমা কী আশ্চর্য্য! আর একনাগাড়ে 'হায়া হায়া হায়া' বলার মানে হল তাড়াতাড়ি কর তাড়াতাড়ি। হংকং-এর লোকেদের দেখলাম মেনল্যান্ড চায়নার লোকজন থেকে জিনিষপত্র সবকিছুর ব্যাপারেই একটা নাক সিঁটকোনো স্বভাব আছে। এরা নিজেদেরকে চিন দেশের চিনাদের থেকে উন্নত বলে মনে করে। একবার দোকানে ইস্ত্রি কিনতে গিয়েও কিছুটা বুঝেছিলাম। দুটো ইস্ত্রি সামনে রেখে বাঁদিকেরটাতে হাত দিয়ে বলল "চায়না নো গুড নো গুড" আর ডানদিকেরটা দেখিয়ে বলল "ফিলিপস্ ইউরোপ ভেরি ভেরি গুড"।
আমার ছেলেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ির পাশে ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্ত্তি করে দিয়েছলাম। যদিও সেখানে ব্রিটেন বা অন্যান্য দেশের বাচ্চাদের থেকে চিনের বাচ্চারাই বেশি পড়ত, কিন্তু টিচাররা সবাই ইংরেজ হওয়াতে সবারই ইংরেজি উচ্চারণ পরিস্কার ছিল। হংকং-এর লোকেরা এমনিতে ক্যান্টনিজ ভাষাতে কথা বললেও এখন চিনের সাথে এক হয়ে যাওয়ায় সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে চিনের জাতীয় ভাষা মান্দারিন শিখতে হয়। আমার ছেলে এক বছরে মান্দারিন ভাষা যা শিখেছিলো তা না বলাই ভালো। পরে অবশ্য শুনলাম ছবি আঁকার মত হরফ-ওলা এই ভাষা শিখতে নিদেন পক্ষে পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লাগে।

হংকং-এ থাকাকালীন স্থানীয় কিছু কিছু ফেষ্টিভাল দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রথম দেখলাম হেমন্তকালের মুন কেক ফেষ্টিভাল। এই সময় ভালো শস্য হয় বলে চাঁদকে পুজো করে এবং চতুর্দিক চিনে লন্ঠন দিয়ে সাজায়। রাস্তাতে কাগজের তৈরি প্রচুর ড্রাগন ও সিংহদেরও নাচতে দেখা যায়। খাবার হিসাবে অবশ্যই ময়দা আর পদ্মফুলের বীজ দিয়ে বানানো বিভিন্ন সাইজের মুন কেক থাকে। তবে সবথেকে ঝলমলে হল এদের বসন্তকালের চাইনিজ নিউ ইয়ার। এ যেন আমাদের দেশের দুর্গা পুজো ও কালী পুজোর একত্র সমাবেশ। প্রত্যেকেই নতুন জামা কেনে এবং কাছের লোকজনকে ভালো ভালো উপহার দেয়। আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হয়। এছাড়া বাজি পোড়ানো বা রাস্তায় কাগজের সিংহের নাচ তো আছেই। তবে সবথেকে মজা পেয়েছিলাম ওদের 'কিংমিং' ফেষ্টিভাল দেখে। হংকং আইল্যান্ডে আমাদের এক বাঙালি বন্ধুর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দেখি দরজার মুখেই প্রচুর টাকা পোড়ানো হচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "এখানে কি জাল টাকার কারবার হয় নাকি"? ভদ্রলোক হেসে বললেন, আরে না না এটা তো 'কিংমিং' ফেষ্টিভাল। আজকের দিনে এরা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নকল টাকা, কাগজের তৈরি জামা কাপড় এমন কি কাগজ দিয়ে বানানো প্রমান সাইজের গাড়িও পোড়ায়, যাতে পরপারে গিয়ে জামা কাপড়, টাকা পয়সা বা এর ওর বাড়িতে যাতায়াতের জন্য কোন কষ্ট পেতে না হয়"। কিছুক্ষণ বাদে রাস্তায় নেবে দেখি প্রচুর লোক বাক্স সমেত সার্ট টাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পোড়াবে বলে। দোকানে দোকানে বিক্রি হচ্ছে কাগজের তৈরি কম্পিউটার, সিডি প্লেয়ার, মায় সেল ফোন পর্যন্ত। জিজ্ঞাসা করতে একজন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, মর্ত্যে থাকাকালীন যারা আধুনিক টেকনোলজিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, এই কম্পিউটার ও সেলফোন তাঁদের উদ্দেশ্যে পোড়ানো হবে যাতে ওপরে গিয়েও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারেন। আঁৎকে উঠে মনে মনে প্রার্থনা করলাম, নিদেনপক্ষে সেল ফোনটিকে ওনারা যেন পরলোকেই সীমাবদ্ধ রাখেন। এমনিতেই ইহলোকে সেলফোনের অত্যাচারে পথ চলা দায় তাতে আবার আমাদের পূর্ব্বপুরুষরাও যদি আমাদের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ রাখতে আরম্ভ করেন, তাহলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। হংকং আইল্যান্ডে সেই বাঙালি বন্ধুর ফ্ল্যাটের সাইজ দেখেও তাজ্জব হয়ে গেলাম। ঘরগুলো এতটাই ছোট যে খাট থেকে হনুমানের মত একটা লাফ দিতে পারলেই সরাসরি বাথটবে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেদিন নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে মনে হল যেন গড়ের মাঠে ঢুকলাম।
মাঝে মধ্যেই হংকং-এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরতে যেতাম। সেই ভাবেই একদিন হংকং সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রেনে আধঘন্টার মধ্যেই 'ল্যানটাও আইল্যান্ড' পৌঁছে গেলাম। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল চতুর্দিকে পাহাড়ের মধ্যে বিরাট উঁচুতে বসানো একটি বুদ্ধমূর্তি। শোনা যায় এই চৌত্রিশ মিটার উঁচু ব্রোঞ্জের মূর্তিটা পৃথিবীর সবথেকে বড় বসা বুদ্ধমূর্তি। চতুর্দিকে মেঘে ঢাকা ফাঁকা ফাঁকা পাহাড়ি জায়গাটা দেখলে কে বলবে এটা হংকং শহরের এত কাছে। হংকং-এর সব থেকে বড় ট্যুরিষ্ট স্পট হল ভিক্টোরিয়া পিক। ছোট পাহাড়, ট্রামে চূড়োতে উঠলে পুরো হংকং শহরটা চোখের সামনে ঝলমল করে ওঠে। এই তল্লাটেই হংকং-এর সব বড়লোকেদের বাসস্থান। কী দিনে বা কী রাতে এই ভিক্টোরিয়া পিক থেকে হংকং শহরটি দেখলে কেউ নিরাশ হবেন না।

আর একটি বিখ্যাত রাস্তা হল নেথান রোড। যদিও পুরো হংকংটাই নিওন লাইটের কল্যাণে প্রচণ্ড আলো ঝলমলে তবুও তার মধ্যে নেথান রোডটি চোখের মত। এটিই কাউলুনের সবথেকে বড় রাস্তা - সিম সা চয় থেকে মংককের দিকে চলে গেছে। সারা রাতই রাস্তাটা এতটা জমজমাটি যে মনে হয় সারাক্ষণই এরা পার্টির আনন্দে নাচছে। রাস্তার দুধারে অজস্র রেষ্টুরেন্ট এবং তারা সবাই বলে যাচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে সুস্বাদু খাবারটা তাদের দোকানেই তৈরি হয়। কাছেই চুংকিং ম্যানসনে দেখলাম প্রচুর সর্দারজী ঘুরে বেড়াচ্ছে। সতেরো তলা এই মেনসনে যত ভারতীয়দের দোকান আছে বোধহয় সারা হংকং-এ আর কোথাও নেই। ডাল, মশলাপাতি থেকে মাছের ঝোল সবই এখানে পাওয়া যায়। এছাড়াও সামনেই রাজ্যের পাইরেটেড সিডি, নকল রোলেক্স ঘড়ি সবই বিক্রী হচ্ছে, দেখলাম সব দুনম্বরীই সমান নয় তার মধ্যেও মান ও দামের তারতম্য আছে। যেমন রোলেক্স ঘড়ি ফুটপাথে দশ ডলার থেকে দুশো ডলার পর্যন্ত সবরকম চেহারা ও দামেই ঘোরা ফেরা করে। দামী দুনম্বরী রোলেক্স কিনতে গেলে ওরা ক্যাটালগ ধরিয়ে দেয় পছন্দ করার জন্য তারপর সপ্তাহ দুয়েক সময় নেয় সেটাকে বানাতে। ভেতরের মূল ঘড়ির যন্ত্রাংশ জাপানিজ আর বাইরেটা রোলেক্সের নকল। পুলিশ মঝেমধ্যেই এসব দোকান রেইড করে বটে কিন্তু তা 'সমুদ্রে বালির বাঁধ'। এই নেথান রোডের ওপর বিখ্যাত পেনিনসুলা হোটেলে একদিন হাই টি খেতে গেলাম। পঞ্চাশ আমেরিকান ডলার দিয়ে ঠাণ্ডা স্যান্ডউইচ আর চা খেয়ে ভাবলাম টাকাটা পুরোটাই জলে গেল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল এই হোটেলের ভেতর ঢোকাটাই একটা এক্সপেরিয়েন্স। পৃথিবীতে কোথাও একসঙ্গে এত রোলস্ রয়েস্ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি। হোটেলের বাথরুমে ঢুকেও প্রায় মাথা ঘোরার অবস্থা হল। বাথরুমের ভেতরে দামী দামী ক্রিষ্টালের ঝাড়লন্ঠন টাঙানো ও সোফা পাতা। এছাড়া ওয়াশবেসিনের সামনে নামী কোম্পানীর সাবান কোলন সবই এতটাই সুন্দরভাবে সাজানো যে দেখে মনে হল লোকে শোবার ঘর ফেলে টয়লেটেই বাস করবে। তাই সেদিনকে খাওয়ার দিক থেকে না হলেও অন্যান্য দিক থেকে আমার হাই টির টাকাটা উসুল হয়ে গিয়েছিল!
হংকং-এ প্রায় সবার হাতেই 'অক্টোপাস' কার্ড। এই একটা কার্ড দিয়েই সবকিছু চালানো যায়। বাস, ট্রেন, রেষ্টুরেন্ট থেকে আরম্ভ করে সুপার মার্কেট প্রায় সব জায়গাতেই এই কার্ড নেয়। টাকা কমে গেলে আবার ভরে নিলেই কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। এই কার্ড পকেটে রেখেই আমরা সারা হংকং ঘুরতাম। মাঝে মধ্যেই রাত্রে ভিক্টোরিয়া হারবারে হাঁটতে যেতাম যেখানে জগৎ বিখ্যাত ক্যারাটে সম্রাট ব্রুস লি-র স্ট্যাচু ছাড়াও জলের ধারে অজস্র রেষ্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যেতে দারুণ লাগত। এছাড়াও বারবার আমরা স্টার ফেরিতে চাপতাম। যদিও ভিক্টোরিয়া হারবার এপার ওপার করতে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লাগত না তবুও জলের মধ্যে থেকে আলো ঝলমলে হংকং শহরটাকে দেখতে এতটাই সুন্দর লাগত যে মনে হত বার বার স্টার ফেরিতেই ফিরে আসি।
একবার রবিবারে হংকং সেন্ট্রালে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। প্রতি রবিবার হংকং-এ বাড়ির কাজের লোকেদের ছুটির দিন। এই সব মেয়েরা বেশিরভাগই ফিলিপিনস থেকে হংকং-এ লোকের বাড়িতে কাজ করতে আসে। প্রতি রবিবার এরা নিজের দেশের লোকেদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে হংকং সেন্ট্রালে চলে যায়। দেখলাম পায়রার মত ঝাঁকে ঝাঁকে খাবার হাতে এরা রাস্তাঘাটে, পার্কে সতরঞ্চি পেতে বসে আছে। ঠিক যেন পিকনিকের পরিবেশ।

একদিন কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে হংকং-এর কাছে সেনজেন লে একটা জায়গাতে বেড়াতে গেলাম। চোদ্দশ সালে মিং ডাইনাস্টির সময় থেকেই ক্ষেতখামার নালাতে ভরা জায়গাটিকে লোকে সেনজেন বলে ডাকতে শুরু করে। সেনজেন কথার মানে হল 'গভীর নালা'। এখন অবশ্য সেটা আর বোঝার উপায় নেই কারণ ক্ষেতখামার-নালার বদলে হাইটেক কোম্পানি আর উঁচু উঁচু বাড়িতেই ভর্তি। সাফারি পার্ক ছাড়াও এখানে সবথেকে বড় আকর্ষণ হল 'উইনডোজ অফ দ্য ওয়ার্লড'। এখানে সারা পৃথিবীর দ্রষ্টব্য জিনিসগুলিকে ছোট ছোট করে তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু সাধারণ লোকের পক্ষে অতটাকা খরচ করে সারা পৃথিবী ঘোরা সম্ভব নয় তাই ইজিপ্টের পিরামিড, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, থেকে আরম্ভ করে ভারতবর্ষের তাজমহলের নকল সবই এখানে রাখা আছে। যদিও অনেকেই বলবেন এ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো তবুও বলব সাধারণ মানুষদের একটা আন্দাজ দেওয়ার জন্য আইডিয়াটা সত্যিই সুন্দর। সবথেকে অবাক লাগল এখানে রেস্টুরেন্টগুলোর চা ঢালার কায়দা দেখে। বহু দূর থেকে বিশাল নলের মধ্যে দিয়ে সবার টেবিলে কাপে চা ঢেলে দিচ্ছে অথচ কোথাও এতটুকু ছলকে পড়ছে না।
আমার ছেলে রোলার কোস্টারে চাপতে ভালোবাসত বলে আমরা 'ওশান পার্কে' একটা বাৎসরিক টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। সামুদ্রিক জন্তু জানোয়ার বা ডলফিন শো ছাড়া এখানকার মূল আকর্ষণ হল থিমপার্ক। এই দুশো একরের পার্কটি পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝখানে করা হয়েছে তাই কেবল কার নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। আমি হার্টফেল করার ভয়ে কোন রাইডেই চাপিনি তবে 'অ্যাবিস'-এ চেপে আমার ছেলেও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। প্রায় পঁচিশ তলা উঁচু টাওয়ার থেকে ঢিলের মত শুণ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর ঠিক মাটি ছোঁয়ার আগেই খপ করে একটা পাটাতন দিয়ে মানুষগুলোকে ধরে নেয়। একেই রাইডটা পাহাড়ের ওপরে তাতে ঠিক নীচেই সমুদ্র থাকায় মনে হয় যেন কেউ কাউকে পাহাড় থেকে ঠেলে সমুদ্রের দিকে ফেলে দিচ্ছে। এক কথায় এটি পয়সা খরচ করে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়!
হংকং-এ দেখতাম লোকে খুব 'রিপালস বে'তে রিলাক্স করতে যায়। এদেশে মাইলের পর মাইল সীবিচ বলে কিছু নেই সবই পাহাড়ের মধ্যে মধ্যে টুকরো টুকরো বিচ। এই 'রিপালস বে'তে দেখতাম নর-নারী নির্বিশেষে যৎসামান্য পোষাক পরে সমুদ্রের ধারে সূর্যস্নান করছে। হংকং-এর স্ট্যানলি মার্কেট আর একটি দর্শণীয় জায়গা, যারা বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক জীবজন্তু খেতে ভালোবাসেন বা সস্তাতে ডজন ধরে জিনিষপত্র কিনতে চান স্ট্যানলি মার্কেট তাদের কাছে স্বর্গ।
হংকং-এর লোকজনের কাছে আতঙ্কের ব্যাপার 'টাইফুন' বা সামুদ্রিক ঝড়। টাইফুনের ওয়ার্নিং পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের বারান্দা থেকে সবকিছু সরিয়ে নিতে হত। আমার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের এক আমেরিকান মহিলাকে 'মিস টাইফুন' বলে ডাকতাম। টাইফুন শব্দটা একবার কানে গেলেই উনি হাঁ হাঁ করে ছুটে আসতেন এবং তারপর লোকজনকে পাকড়ে ঘন্টাখানেক টাইফুনের ওপর জ্ঞান দিতেন। তার ফলে আমরা সত্যিকারের টাইফুনের থেকেও ওনার সামনে টাইফুন শব্দটা উচ্চারণ করতে বেশি ভয় পেতাম। হংকং-এ থাকাকালীন সাংঘাতিক টাইফুন দেখার অভিজ্ঞতা একবারই হয়েছিল। একদিন ঝড়ের মধ্যে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি দোতলা বাড়ির সমান ঢেউ যেন আমাদের বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে। যেহেতু জানতাম নিরাপদে অনেক উঁচুতে ফ্ল্যাটে বসে আছি তাই সেদিনের উদ্দাম ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য উপভোগ করতে কোনও অসুবিধা হয় নি।
আমি সবাইকে বলি যদি শহর দেখতে হয় তাহলে সবারই একবার হংকং যাওয়া উচিত। এদের রোবটের মত চালচলন আর ভাবলেশহীন মুখ দেখে প্রথমটা একটু দমে গেলেও দেখা যাবে এখানে সব কিছুই ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে। কাজ করতে গিয়ে গালগল্প করে সময় নষ্ট করে না। এদের ব্যবহার যেমন খটখটে, কাজকর্মও ততোধিক চটপটে। অত লোক নিয়েও শহরটিতে প্রায় ট্রাফিক জ্যাম নেই বললেই হয়। রাস্তা পারাপার বেশিরভাগ সময়েই মাটির নীচ দিয়ে হয়ে থাকে যাকে এরা বলে 'সাবওয়ে'। ট্রেন ও বাসের ব্যবস্থা এতটাই ভালো যে গাড়ি থাকাটাই যেন বিড়ম্বনা। পুলিশি ব্যবস্থা এতটাই জোরালো যে রাস্তাঘাটে ক্রাইমের সংখ্যা খুবই কম। প্রকাণ্ড উঁচু উঁচু বাড়িগুলো যেন আকাশের দিকে হাত বাড়িয়েই আছে আর তারই মাঝে মাঝে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। বাড়ির তলাতেই ট্রেন, সুপারমার্কেট, মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার, পোষ্টঅফিস এমন কী অজস্র ছোটখাটো খাবারের দোকান। কেউ যদি চায় দিনের পর দিন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ না রেখেও দৈনন্দিন জীবন দিব্যি চালিয়ে যেতে পারে। স্থান সঙ্কুলানের জন্য বহু বাড়ির ছাদেই খেলার মাঠ, স্যুইমিং পুল বা টেনিস কোর্ট চোখে পড়ে। হংকং-এর লোকজন হেসে হাত মুখ নাড়িয়ে গল্প না করলেও এদের নিয়মানুবর্ত্তিতা চোখে পড়ার মতন। বাস ট্রেন এতটাই সময়ে চলে যে একটু দুলকি চালে রাস্তা দিয়ে হাঁটলে বাস মিস হয়ে যাবার সম্ভাবনা। রাস্তায় ডবলডেকার বাস আর লোকজনের ইংরেজদের মতন নিয়মনিষ্ঠ চালচলনের জন্য অনেকেই হংকংকে 'প্রাচ্যের লন্ডন' আখ্যা দিয়ে থাকেন। এক কথায় পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝে চোখ ঝলসানো নিওন লাইটে মোড়া হংকং যেন এক টুকরো বৈদূর্য্য মণি।

~ হংকং-এর আরও ছবি ~

শ্রাবণী ব্যানার্জির জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীত ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে সারা বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।


 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher