অন্যস্বাদের উত্তরবাংলা
সৈকত গুপ্ত
পায়ের তলায় সর্ষে – এই প্রবাদটা বাঙালির ক্ষেত্রে বহুবার ব্যবহৃত। বেড়ানোর অদম্য ইচ্ছে আর নতুনকে জানার আনন্দে আমরা বেড়িয়ে পড়ি মাঝে মাঝেই। কখনও বা আগে থেকে টিকিট কেটে, প্ল্যান করে আবার কখনও বা একেবারে শেষ মুহূর্তে। এবারের বেড়ানোটা বেশ কিছুটা আকস্মিক ভাবেই হল, প্রস্তাব এল আর সাত-পাঁচ না ভেবেই হ্যাঁ-ও বলে দেওয়া হল। কথায় বলে বিধি বাম, তাই চার-পাঁচ দিন আগে থেকে শুরু হল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যে-সে নয়, একেবারে ভূমিকম্প - নেপালে মারা গেল অগুন্তি মানুষ আর তার প্রভাব এসে পড়ল সুদূর কলকাতাতেও। এপ্রিলের দুপুরে বেশ অনুভব করা গেল সেই কম্পন আর সঙ্গে পরবর্তী কটা দিনও। সংশয় নেমে এল আপাতত নিরাপদ সমতলে, আদৌ যাওয়া হবে তো? একে একে যোগ হতে থাকল নানা খবর, কিছু ভুল, কিছু গুজব। তবু একটা আশঙ্কা তো থেকেই যায়। নেপালে হাজার হাজার মানুষ সব হারিয়েছে, কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মিরিক আর পেলিং সংলগ্ন জায়গাতে আর আমাদের গন্তব্যও সেই দার্জিলিং জেলার কার্শিয়ং আর কালিম্পং। একটু যে চিন্তায় ছিলাম না, তা বলব না। কিন্তু মনে একটা বিশ্বাসও ছিল যে কিছু হবে না।
ঠিক ছিল যে চিরাচরিত জায়গাগুলোতে থাকব না। তাই, কার্শিয়ং-এ না থেকে মকাইবাড়ি চা বাগান আর কালিম্পং এর জায়গায় সিলারি গাঁও। একটু অন্যরকম জীবনের স্বাদ পেতে এই আয়োজন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গন্তব্য সোজা মকাইবাড়ি চা বাগান। সুকনা হয়ে গাড়ি চলছে রোহিণীর দিকে, দু'পাশে যথারীতি সেই অবর্ণনীয় সৌন্দর্য যা ভাষায় প্রকাশ করা বেশ কঠিন। গভীর জঙ্গল আর তার পেছনে পাহাড়ের সারি কেন যে বারবার সবাইকে টেনে নিয়ে আসে, সেটা এখানে এলে বেশ বোঝা যায়। টয় ট্রেন এখন নতুন করে চলছে, তারও দেখা পাওয়া গেল অচিরেই। আপন মনে নিজের গতিতে সে ছুটে চলেছে রাস্তার একপাশ দিয়ে। নতুন রং করা কামরা আর সেই আগের মতন ইঞ্জিন যেন একটু বেশি গতি পেয়েছে এবারে। বিদেশি অতিথিরা আজও এই হেরিটেজ ট্রেন এর ওপর ভরসা করে কার্শিয়ং আর দার্জিলিং যায়। সময় হয়ত একটু বেশি নেয়, কিন্তু "এ স্বাদের ভাগ হবে না"। দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম রোহিণী, এখানে কিছু না খেলে আরও ওপরে উঠতে বেশ কষ্ট হবে। পাহাড়ে যাব অথচ মোমো খাবো না, সেটা তো হয় না, সঙ্গে বেশ গরম গরম এক কাপ চা। মনটা খুশিতে ভরে গেল। একবার মাথা উঁচু করে দেখে নিলাম কোন রাস্তা দিয়ে আমরা কার্শিয়ং হয়ে মকাইবাড়ি যাব। দেখেই বুঝলাম, বেশ উচ্চতা আছে। আনন্দ আরও বেড়ে গেল।
সুকনা ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে যখন আজ সকালে আসছিলাম তার যে দৃশ্য আর এখন রোহিণী হয়ে কার্শিয়ং-এর যে রাস্তা, তার নিসর্গ একটু আলাদা। পাহাড় অনেক কাছে এখানে, রঙ আর চরিত্র দুটিরই বদল হয়েছে। যোগ হয়েছে সবুজ চা বাগান যা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। যে কথা বলছিলাম, ফিরে আসি কার্শিয়ং-এর পথে। চলতে চলতে কখন যে ঢুকে পড়েছি শহরে, খেয়ালই নেই। টনক নড়ল ডানদিকে টয় ট্রেনের লোকো শেড আর বাঁদিকে কার্শিয়ং স্টেশনকে দেখে। নড়েচড়ে বসল সবাই, অনেকটা এসে গেছি, আর একটুখানি রাস্তা। স্টেশনকে বাঁ পাশে রেখে চললাম মকাইবাড়ির পথে। চোখে পড়ল আকাশবাণীর কার্শিয়ং স্টেশন। কলকাতাতে অনেকবার রেডিও অফিসে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছে, এখানে সে সুযোগ নেই। আরও একটা জিনিস চোখ এড়াল না, স্থানীয় নেপালিরা ছাড়াও অনেক খ্রীস্টধর্মাবলম্বী মানুষ এখানে বসবাস করেন। রাস্তার পাশে বেশ কিছু অন্তিমশয্যা সেটাই জানান দেয়। মকাইবাড়ি চলে এলাম, এবার ঘর খোঁজার পালা।
মকাইবাড়িতে কোন হোটেল নেই। এখানকার কিছু মানুষ তাদের নিজেদের বাড়িতে অতিথিদের রাখেন। খেতেও দেন ভালোমন্দ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক নামী-অনামী হোটেলে রাত কাটিয়েছি, কিন্তু বেড়াতে এসে কারো বাড়িতে এভাবে থাকা জীবনে প্রথম। সঙ্গে যারা ছিল তারা অনেকেই আগে এই সুখরস আস্বাদন করেছেন, আমার মত কিছু মানুষের কাছে এটা বাড়তি পাওনা। চোদ্দ জন আছি আমরা, তাই তিন-চারটি বাড়ি তো লাগবেই আর সেটা করতে বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। স্থানীয় মানুষেরা খুব সুন্দর আয়োজন করে রেখেছেন অতিথিদের জন্য, না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। পরিপাটি করে সাজানো ঘর, স্নান-খাওয়ার জন্য উষ্ণ জল আর ডাকলেই হাসিমুখ দর্শন – আর কি চাই বাঙালির বেড়াতে এসে? পাহাড়ি বৃষ্টিও ওয়েলকাম জানাল আমাদের এরই মাঝে।
দুপুরের খাওয়া শেষ, একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মকাইবাড়িকে জানতে। এমনিতে খুব একটা বড় জায়গা নয়, তবে মকাইবাড়ি মানেই বিস্তৃত সবুজ চা বাগান। যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকেই পাহাড়ি ঢালে বেড়ে ওঠা চা গাছ। পাথুরে রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকটা নেমে পৌঁছে গেলাম অনেকটা নীচে। স্থানীয় নেপালি মহিলারা চা তুলে পিঠে বাঁধা ঝুড়িতে ফেলতে ব্যস্ত। কী অদ্ভুত নিপুণতায় একে একে জমা হচ্ছে দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ি। শুনলাম, এই চা বাগান বহু বছরের ঐতিহ্যশালী আর সবচেয়ে পুরনোও বটে। ১৮৫৯ সালে গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জি ৪৬০০ ফিট ওপরে কার্শিয়ং এর বুকে এই ১৫৭৫ একরের চা বাগান শুরু করেন। স্বাদে আর গন্ধে অতুলনীয় এই চা দেশে বিদেশে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অধিকার করে আছে। একে একে এই চা বাগানের হাল ধরেন তারাপদ ব্যানার্জি এবং পশুপতিনাথ ব্যানার্জি । কিন্তু, মকাইবাড়ি টি এস্টেট আজ আর ব্যানার্জিদের একার নয়, অনেক টালবাহানার পর বর্তমান বংশধর স্বরাজ (রাজা) ব্যানার্জি এই চা বাগানের বেশিরভাগটাই (৯০%) লক্ষ্মী গ্রুপকে বিক্রি করে দিয়েছেন, যদিও আমৃত্যু তিনি এখানকার ডিরেক্টর পদে আসীন থাকবেন। দেখা হল তাঁর সঙ্গেও, রোজকারের অভ্যেস মত আজও এসেছিলেন নিজের হাতে সব তদারক করতে আর ফিরেও গেলেন রাজারই মত, ঘোড়ায় চড়ে।
মকাইবাড়ির মুকুটে একে একে যোগ হয়েছে অনেক পালক। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক আর ২০১৪-র ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে এই চা ভারতকে বিশ্বের মানচিত্রে এক নতুন পরিচিতি এনে দিয়েছে। জাপান, ইংল্যান্ড, আমেরিকাতে এই চায়ের কদরই আলাদা। গতবছর, কেজি প্রতি ১,১১,০০০ টাকায় নিলাম হয়েছে মকাইবাড়ির চা যা এক সর্বকালীন ইতিহাস। আমাদের ভীর সাংভি, ফ্রান্সের লুসানে আর বিবিসি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছে মকাইবাড়িকে নিয়ে, টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও এসেছে মকাইবাড়ি চা বাগান। অন্যান্য বাগানে শুধুই চা গাছ থাকে, কিন্তু মকাইবাড়ি চা বাগান প্রাকৃতিক জঙ্গল আর চা গাছের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। একটা জিনিস দেখে আর জেনে খুব ভাল লাগলো, ২০০৭ সালে তৈরি হওয়া মকাইবাড়ি কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার। স্থানীয় নেপালি মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি হওয়া এই সেন্টারে ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার শেখে, মহিলারা শেখেন চায়ের বাক্স বানানো আর প্রিন্টিং এর কাজ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সবরকম সহযোগিতা করে এই কমিউনিটি সেন্টার। চা বাগান তো দেখা হল, কী করে চা পাতা তুলতে হয় তার ট্রেনিংও পাওয়া গেল কিন্তু এই চা পাতা কী ভাবে আমাদের রোজকার জীবনে সকালবেলা কাপে করে আসে সেটা জানতে গেলে যেতে হবে পাশের ফ্যাকট্রিতে। মকাইবাড়ি টি ফ্যাকট্রি। আমরা বাইরের লোক তাই মাথা, পা, মুখ সব ঢেকে ঢুকলাম এক নতুন স্বর্গরাজ্যে। দোতলা এই ফ্যাকট্রি শুধু "চা" ময়। এক অপূর্ব গন্ধের মাদকতা সঙ্গে যন্ত্রের অবিরাম চলন, দুটো মিলে মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি। বাগান থেকে তুলে আনা চা পাতা একের পর এক মেশিনে চলে যাচ্ছে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রসেসিং এর জন্য। কর্মীরা নিখুঁতভাবে একই কাজ করে চলেছেন বছরের পর বছর। শেষ ধাপে পাওয়া গেল সেই চা যা বাক্সবন্দী হয়ে পৌঁছে যায় আমাদের সবার বাড়িতে। ফ্যাকট্রির গেটের ঠিক পাশেই আছে চা কেনার দোকান। যাদের ইচ্ছে কিনে নিতে পারেন বিভিন্ন মানের চা, তবে হ্যাঁ, মকাইবাড়ির চা কিন্তু বেশ দামি।
ভোরবেলা সূর্যোদয় দেখা যেকোনো পাহাড়ি জায়গায় এক সুন্দর অভিজ্ঞতা, মকাইবাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। সকালে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে কখন দেখা যাবে টকটকে লাল থালা। দেখাও গেল, ছবিও উঠল দেদার। ভোরের নরম আলো গায়ে মেখে বসে থাকতে কার না ভাল লাগে, কিন্তু এই সকালটাই এবারের মতো মকাইবাড়িতে আমাদের শেষ সকাল। পরের গন্তব্য কালিম্পং। তার আগে একটু হেঁটে নীচের দিকে নেমে শনি মাতার মন্দির আর আরও নীচে বালুসান নদী, সঙ্গে মিরিক শহরের আভাসও পাওয়া গেল। ফিরে আসা যে যার ঘরে, একটু পরেই গাড়ি আসবে। সারাদিনের প্ল্যান, কালিম্পং হয়ে সিলারি গাঁও পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। ছেড়ে চলে যেতে হবে এই হোম স্টেগুলো, যাদের মালিকরা এই দুদিন আমাদের সব আবদার মেনে নিয়েছেন। বাঙালি অতিথি দেখে চিকেনের থেকে মাছ বেশি খাইয়েছেন, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে্ন রাতে আমাদের খাওয়া শেষ হওয়া অব্দি আর হাসিমুখে সম্মানের সঙ্গে "খাদা" দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন আমাদের। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা, মন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু মুহূর্ত যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কিংবা কী ভাবে তুলে ধরব ছোট ছোট পাহাড়ি ছেলেমেয়েগুলোর অনাবিল হাসি যখন তারা সবাই নতুন জামা কাপড় পেল? একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের জন্য নিয়ে এসেছিল অনেক খেলনা, বই, খাতা, পেন আর জামাকাপড়। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ছোট ছোট শিশুদের উৎসুক চোখ জানান দিচ্ছিল এক নির্মল আনন্দ, কেমন করে আমরাও যেন ফিরে পেলাম সেই সোনালী অতীতের দিনগুলো। এই অনুভূতি ভাষা পায় না, শুধু মনের মণিকোঠায় কোহিনূরের মতো জ্বলজ্বল করে।
মকাইবাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করলাম কালিম্পং এর উদ্দেশ্যে। কার্শিয়ং বাজার ছাড়িয়ে গাড়ি চলল পাহাড়ি পথে। আজ বিশেষ দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা, তাই রাস্তার ধার দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ চলেছেন নিকটবর্তী গুম্ফাতে। দুপাশে অবর্ণনীয় কিছু সৌন্দর্য, কোথাও অনেক গভীরে ক্ষুদ্র জনপদ আবার কোথাও সাদা মেঘের নরম আস্তরণ। পাহাড়ের এই এক মজা, টুকরো টুকরো মেঘ এসে কখন যে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে, টেরও পাওয়া যায় না। কুয়াশার মতো মেঘ ভেদ করে গাড়ি চলেছে। সোনাদা পেরিয়ে ঘুমকে পাশে রেখে আমাদের গাড়ি কালিম্পং-এর রাস্তায়। দুপুরের খাবার আজ রাস্তায় খেতে হবে, তাই লেপচু বাজারে ডাল, ভাত আর মাংস খেয়ে নিলাম। আবার পথ চলা।
প্রথম যেখানে গিয়ে থামলাম, দেখি বড় করে গেটের ওপরে লেখা আছে Eagle's Crag। এটাই কার্শিয়ং এর উচ্চতম স্থান, এখান থেকে খুব সুন্দর দেখা যায় তিস্তা নদী আর বিস্তীর্ণ উপত্যকা। কথিত আছে, আকাশপথে বিমান যাওয়া আসার সময় পাখির সঙ্গে অনেক সময় ধাক্কা লাগত বলে এখানে স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশরা কিছু ঈগল পাখি রেখেছিল যাদের কাজ ছিল বাকি সব পাখিদের মেরে বিমানের রাস্তা পরিস্কার রাখা। এর সমর্থনে কোন যুক্তি খুঁজে না পেলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের এমনই ধারনা। যদিও অনেকে বলেন ঈগল পাখি অনেক উঁচু থেকে সবকিছু দেখতে পায় আর এই স্থানটিও কার্শিয়ং এর সবচেয়ে উঁচু স্থান, তাই এর নাম Eagle's Crag। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, এই নামে ইংল্যান্ডে একটি দর্শনীয় পাহাড়ের সারি আছে, তার থেকেও এর নামকরণ করা হলে অবাক হব না। যাই হোক, এখানেই আছে কার্শিয়ং-এর সবচেয়ে বড় জলাধার, কারণ সহজেই অনুমেয়, উচ্চতা। খুব সুন্দর করে সাজানো এই বাগানের একদিকে আছে গোর্খাদের স্মৃতিসৌধ। শান্ত একটা জায়গা, ওয়াচ টাওয়ার থেকে অনেক দূর অব্দি দেখা যায় যদি না মেঘ বা কুয়াশা থাকে। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আমরা চললাম পরের গন্তব্যের দিকে।
জায়গাটার নাম গিদ্দাপাহাড়, যেখান থেকে কার্শিয়ং আর তার আশেপাশের অনেকটা জায়গা খুব ভালোভাবে দেখা যায়। একটা ভিউ পয়েন্ট বানানো আছে, সেখান থেকে পাহাড়ি রাস্তা আর নীচের চা বাগানের ছবি সত্যিই মনোরম। এই গিদ্দাপাহাড়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের বাড়ি। আসলে ১৯২২ সালে শরৎচন্দ্র বোস এই বাড়িটি কেনেন এক ব্রিটিশ সাহেব রাউলিং লেসিলেস ওয়ার্ড-এর থেকে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পদধূলি পাওয়া এই বাড়ি শরৎচন্দ্র এবং সুভাষের খুব প্রিয় ছিল। টানা দু'বছর শরৎ বোস এই বাড়িতে ব্রিটিশদের দ্বারা অন্তরীণ ছিলেন। সুভাষও এই বাড়িতে বন্দীদশা কাটিয়েছেন দীর্ঘ ছ'মাস। এই ছ'মাসে তিনি লিখেছিলেন অন্তত ছাব্বিশটা চিঠি যার মধ্যে এগারটা ছিল স্ত্রী এমিলি শেঙ্কেল-কে লেখা। এমিলিও নেতাজিকে দশটি চিঠি লিখেছিলেন, এই বাড়ি সেই সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে। এই বাড়িতে বসেই নেতাজি লেখেন সেই বিখ্যাত ভাষণ যা তিনি হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতি হয়ে পাঠ করেছিলেন। Netaji Institute of Asian Studies এখানে গড়ে তুলেছে এক অনন্য সংগ্রহশালা। নেতাজি, এমিলি আর কন্যা অনিতার অনেক ছবি, অসংখ্য চিঠি, ব্যবহৃত আসবাব আজও একইভাবে রাখা আছে। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের এক আঁতুড়ঘর এই বাড়ি। ছেড়ে আসতে মন চায় না, বারবার ছুঁতে চায় সেই মানুষটাকে যিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন।
পরবর্তী গন্তব্যস্থল পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ভূতুড়ে স্থান, ডাও হিলস। লোকমুখে শোনা, গা ছমছমে এই ঘন পাইনের অরণ্যে প্রায়শই দেখা যায় এক মুণ্ডহীন বালককে, আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হাড়িয়ে যায় গভীর জঙ্গলে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে খুঁজে দেখবেন। অনেকেই নাকি দেখেছে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুজনের ঠিক পাশে পাশে তৃতীয়জনকে যে আবার অদৃশ্য হয়ে গেছে আপন খেয়ালে। বিশাল গভীর এক খাদ আছে, সেখান থেকে উঠে আসা মানুষের গোঙানি অনেককেই ভয় পাইয়ে দেয়। নানান মানুষকে খুন করে নাকি ওই খাদে ফেলে দেওয়া হয়েছে অতীতে। স্থানীয় কাঠুরেরা আজও সন্ধ্যের পর কেউ ডাও হিলস-এ থাকে না, তাদের ধারণা পাশের স্কুলে ভূত থাকে। লাগোয়া চার্চ আর মিউজিয়াম স্থাপত্যশৈলীর এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তবে বলে রাখা ভাল, বহুদূর গিয়েও আমরা ভূতের দেখা পাইনি, বরং দেখেছি হরিণের আঁতুড়ঘর। অনেক ছোট ছোট হরিণ একটা ঘেরা জায়গাতে সঙ্গে তাদের মা। ডাও হিলসে এটাই বোধহয় সবচেয়ে ভাল পাওনা।
কালিম্পং যাওয়ার পথে এবার পড়ল ডেলো পাহাড়। মনোরম পরিবেশ, সুন্দর করে সাজানো একটা রিসর্ট আর অনেকখানি ছড়ানো সবুজ। বেশ কিছুটা উঁচু থেকে খুব ভাল প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় যদি আকাশ পরিস্কার থাকে। তিস্তা নদী বয়ে চলেছে আপন বেগে। চাইলে কেউ এখানে প্যারাগ্লাইডিং করে আকাশে উড়ে থাকতে পারে অনেকক্ষণ। বিকেল অতিক্রম করে গেছে, না দাঁড়িয়ে চলতে থাকলাম। এবার তো আমরা কালিম্পং-এ থাকব না, যাব কালিম্পং থেকেও বেশ খানিকটা ওপরে সিলারি গাঁও। সিলারি গাঁওতে ঢোকার মুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো এক অসমান পাথুরে রাস্তা। বন দপ্তর রাস্তা করেনি চোরাশিকারীরা গাছ কেটে নিয়ে চলে যাবে বলে, তাই একের পর এক পাথরে সাজানো রাস্তা। চলতি ভাষায় এর নাম Dancing Road। এক ঘণ্টার এই বন্ধুর পথ আমাদের অনেকদিন মনে থাকবে, যদিও সব শারীরিক কষ্ট লাঘব হয়ে গেল সিলারি গাঁওতে পৌঁছে। প্রকৃতি যে এমন বরণডালা নিয়ে অপেক্ষা করছিল, সেটা সম্ভবত কেউই জানতাম না।
আগেই বলেছি, আজ পূর্ণিমা। তাই সিলারি গাঁও থেকে চাঁদকে একটু স্পেশাল তো লাগবেই। এখানে পা দিতেই যেটা খুব ভাল লাগলো, তা হল এক অদ্ভুত নীরবতা। আমাদের কয়েকজনের কথাবার্তার আওয়াজ ছাড়া সত্যিই বড় শান্ত একটা জায়গা। দূরে পাহাড়ের সারি, জ্যোৎস্না মাখা সন্ধ্যায় গান হল একে একে – "আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে", "জাগরণে যায় বিভাবরী" ইত্যাদি। পরিবেশটা এক লহমায় অনেকটা পালটে গেল। চায়ের কাপ হাতে সবার দৃষ্টি তখন চারদিকের প্রতিটি কোণায়, একটা কোন মুহূর্তও যেন চোখের পলক ফেলার আগে মিলিয়ে না যায়। কখন যে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল, কেউ বুঝতেই পারলাম না। এমনিতেই পাহাড়ি মানুষরা তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, এখানে যার আতিথ্যে আছি তিনিও ব্যতিক্রম নন। তবু অপেক্ষা করলেন শহুরে এই মানুষগুলোর জন্য। বেশ ভালো থাকার জায়গা, সাকুল্যে ছ'টি ঘর, কিন্তু বেশ সুন্দর আর ছিমছাম। আয়োজনের বাহুল্য নেই, ঠিক যেটুকু লাগতে পারে তাই আছে। সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘার সারি এই অঞ্চলের মূল আকর্ষণ। এর টানেই এতটা পথ কষ্ট করে আসা।
সকালে উঠে মন খারাপের পালা। পাহাড়ি সূর্য ধীরে ধীরে উঠে জানিয়ে দিল আজ শেষ দিন। একটু পরে গাড়ি আসবে, এই মায়াময় সৌন্দর্য ছেড়ে ফিরতে হবে বাস্তবের সমতলে। তার আগে ঠিক হল, ঘুরে আসা হবে এই সিলারি গাঁও এর সবচেয়ে উঁচু জায়গা, রামিতে ভিউ পয়েন্ট। গাড়ি যাবে না, পায়ে হেঁটে এক ঘণ্টায় পৌঁছান গেল। দুপাশে জঙ্গল আর তার মাঝে সরু একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা। জোঁকের আধিক্য বেশ, কয়েকজন তাদের শিকারও হল। সদ্য বৃষ্টি হওয়া সেই রাস্তা সাবধানে পেরিয়ে অবশেষে এলাম মূল জায়গায়। এতটাই উঁচু যে চারপাশের সব কিছু প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামায় দেখা দিচ্ছে। উঁচু পাথরের ওপর উঠে দাঁড়ালে কোন শৃঙ্গজয়ের অনুভূতি হচ্ছে। ঠাণ্ডা একটা পরিবেশ, তিস্তা নদীর অসংখ্য বাঁক এক অন্য রূপ দিয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ফিরে আসতে মন চায় না। তাও আসতে হল ফিরে। ব্যাগ গুছিয়ে এবার গাড়িতে ওঠার পালা। ও ভালো কথা, একটা জিনিস তো বলাই হয়নি। সকালের এই পুরো সিলারি গাঁও থেকে রামিতে হয়ে আবার ফিরে আসার জন্যে আমরা গাইড পেয়েছিলাম। একজন নয়, পাঁচ পাঁচজন। আমাদের সাথে তারা শুধু যায়ই নি, রাস্তা চেনানোর ফাঁকে ফাঁকে নিজেরাও খুব আনন্দ করেছে। খেয়াল রেখেছে আমরা পিছিয়ে পড়লাম কিনা, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে যদি কেউ পিছিয়ে পরে তার জন্য। এই সারমেয়কুল যেভাবে আমাদের নিয়ে গেল আর ফিরিয়ে আনল, সত্যিই এক কথায় তা অভাবনীয়। প্রভুভক্তের নিদর্শন তারা অনেকই রাখে, কিন্তু বিদেশ বিভূঁইতে কিছু অচেনা মানুষের জন্য তাদের এই স্বার্থত্যাগ সত্যিই কৃতিত্বের দাবি রাখে। আর হয়তো কোনোদিনই দেখা হবে না ওই পাঁচজনের সাথে, কিন্তু যতদিন কোথাও বেড়াতে যাব, বেশ কিছুটা রাস্তা যখন পায়ে হাঁটব, মনে পড়বে এই পাঁচ সঙ্গীর কথা।
পেশায় কনটেন্ট ডেভেলাপার সৈকত গুপ্ত ভালোবাসেন বেড়াতে।