আরশিনগরে
সেথায় পড়শি বসত করে
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলেম না এই নজরে...
মায়ের কাছে আমন্ত্রণ এসেছিল বাংলায় বর্তমান বাউল-ফকির গোষ্ঠীকে সসম্মানে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যিনি প্রায় নিঃশব্দে লড়ে যাচ্ছেন, সেই অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা-এর কাছ থেকে, বাউল-ফকির সম্মেলনে যাওয়ার জন্য। ১৯৮২ সালে বীরভূমে জাব্বারের ন'জন শিষ্যকে হত্যার পাশাপাশি নদীয়া-মুর্শিদাবাদে বাউল-ফকিরদের গান করা ও ধর্মীয় বিধান না-মানার অপরাধে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, একঘরে করা, চুল কেটে দেওয়া, ফতোয়া জারি করা হতে থাকে। অনেক বাউল-ফকির পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এইসময়ে শক্তিনাথ ঝা মৌলবাদের বিরুদ্ধে বাউল-ফকিরদের সংগঠিত করতে প্রতিষ্ঠা করেন বাউল ফকির সঙ্ঘের - ''মানুষ ভজি,মানুষ খুঁজি, মানুষকে করেছি সার।'' এটা ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা। তবে দুই বাংলাতেই বাউল-ফকিরদের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস আরও দীর্ঘকালের। আর এখন নিয়ত চেষ্টা চলছে এই সঙ্ঘের ভেতরে ভাঙন ধরানোর, নানাভাবে। এই সব কিছুর ভেতর দিয়ে চলতে চলতেই বিস্তীর্ণ চর সীমান্তের উন্মুক্ত প্রান্তর পেরিয়ে পদ্মা নদীর ওপারের বাংলা থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভারত-বাংলা সীমান্ত গ্রাম মনসাতলা জলঙ্গিতে বাউল ফকির সঙ্ঘের তেত্রিশতম সম্মেলন – ডিসেম্বরের ১৯ আর ২০ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মানুষেরই আগ্রহে, সহায়তায়।
১৯ তারিখ বিকেলে পৌঁছলাম সেই ঠিকানায় - মালিক ভরসা আশ্রমে। প্রতিষ্ঠাতা সদা হাস্যময় উদার মনের হামিদ ফকির নিজের আশ্রমকে 'সর্বধর্ম সমন্বয় সেবা আস্তানা' বলতে ভালবাসেন । সর্বজন এখানে সর্বদা স্বাগত। আশ্রমের একেবারে গা ঘেঁষে বাঁশ পুঁতে তাতে দড়ি বেঁধে বেশ কিছুটা জায়গা ঘেরা হয়েছে। মাথার ওপরে কাপড় ঢাকা। ছোট্ট মঞ্চ সাজানো কাপড়ের তৈরি রঙিন রঙিন দোতারায়। ঘেরা জায়গার ভেতরে খালি গা, মধ্যবয়সী শীর্ণকায় এক ফকির বড় করে কাঠের আগুন জ্বালিয়েছেন আর নিভে যাওয়ার উপক্রম হলেই তুষ, ধুনো ঢেলে দিচ্ছেন। পাশেই বেশ কয়েকজন ফকির কল্কেতে গাঁজা পুরে টান দিচ্ছেন। আইজুল ফকির নিজে নিরক্ষর, কোনোদিন মাদ্রাসায় পড়েননি বলে আক্ষেপ করেন, তবে তাঁর আশা ছেলেরা লেখাপড়া শিখে গীতা, কোরান পড়ে আইজুলের উপলব্ধিকে নিজেরাই যাচাই করে নিতে পারবে। অনুষ্ঠানের জায়গায় চট পাতা খড়ের বিছানা,পর্যাপ্ত লেপ কম্বল এবং তার পাশে ধিকি ধিকি আগুনের উত্তাপ - পরম আত্মীয়তা-ভালবাসার উষ্ণতা যেন।
শক্তিবাবুর এবং অন্য কয়েকজন বক্তার কিছু কথা বেশ লাগল। বাউল এবং ফকির এই দুই গোষ্ঠীকে আমরা সাধারণত আলাদা বলেই ধরে নিই। অর্থাৎ কী না বাউল হল হিন্দু এবং ফকির মানে মুসলমান। অথচ বাউল-ফকিরদের জীবন এবং যাপনের মূল কথা কিন্তু মানুষ এবং ভালোবাসা। যে সব কিছু ত্যাগ করেছে, সেই হল ফকির। লালন যেমন নিজেকে বিভিন্ন জায়গায় ফকির বলে উল্লেখ করেছেন। ফলে যারা কার্যক্ষেত্রে নিজেকে বাউল বা ফকির যে কোনো একটা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে কিছু সুবিধা পেতে চান, তারা আসলে কোনোটাই নন। জাতিভেদ, ধর্মভেদ এই সবের বিরুদ্ধেই এই বাউল-ফকির আন্দোলন। যা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে আরও-ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
শক্তিবাবু বললেন, তাঁদের সামর্থ্য কম, রান্নার আয়োজন সামান্য। রান্না করেছেন ওখানকারই এক গ্রামের মানুষজন। মুসলিম এই গ্রামের মানুষেরা বংশানুক্রমে নিরামিষ খান। মাছ, মাংস, ডিমের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। অথচ অনেক বৈষ্ণবও আছেন যাঁরা গান শুনতে এসে এঁদের হাতে রান্না বলে খান না।
আরেক জনের একটা কথাও বেশ লাগল। তিনি বললেন, বাউল বা ফকির আসলে একটা জীবনযাপন।
মৃদু নরম আলোয় চায়ের দোকানের খাটিয়ায় বসে চিনি ছাড়া লিকার চা আর বিস্কুট খেয়ে গান শুনতে বসলাম। স্যামুয়েল মণ্ডল, লাল মহম্মদ, লালচাঁদ ফকির এবং আরও অনেক নাম না জানা শিল্পীর কন্ঠ ভাসে বাতাসে। কারোর গান মনকে স্পর্শ করে, কারোর বা শুধুই গলার জোর কানে অথবা প্রাণে ব্যথা দেয়। "বলে বলে মানুষ কে কি সাধু করা যায়?" - দীপঙ্কর ফকির শোনালেন জীবনের এক সার কথা। বাঁশি আর ঢোলের সংগতও যথাযথ। অনেকেই গান শুরুর আগে স্মৃতিচারণ করছিলেন, কেমন করে তাঁদের একঘরে করা হয়েছে, আরও নানাভাবে সামাজিক হেনস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ যে পায়ের তলায় শক্ত মাটি এনে দিয়েছে সেকথাও বললেন বারবার। যে গানটা সবচেয়ে প্রাণে গেল সেটা যিনি গাইলেন তিনি আপাত বাউল-ফকির নন, কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা, লেখালেখি করেন, গানটা তাঁর নিজেরই লেখা। নিজেকে খোঁজার কথা বললেন তাঁর গানে, নাম মনে পড়ে - মল্লিকা।
রাত বাড়ছে ক্রমশঃ, ঠাণ্ডাও। গান আর আলাপচারিতার ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে সদ্য ভাজা গরম পেঁয়াজি আর ধোঁয়া ওঠা কফি – একটু উষ্ণতার খোঁজে।
ভিড়ের মাঝে ক্যামেরা হাতে ঘুরি – এ ভূমিকায় আমি নিতান্ত আনকোরা। এও মুশকিল, কেউ বা অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা করে, কেউ বা বিরক্ত হয়ে বসে পড়তে বলে। আসলে ছবি তোলা অনেকটা ঈশ্বরসাধনার মতোই – পারিপার্শ্বিকই তোমার লক্ষ্য বস্তু, অথচ তাকে ধরতে গেলে তাকেই আগে উপেক্ষা করতে হয়। বাহ্য রূপটিকে অগ্রাহ্য করলে তবেই অন্তরের চেহারা ধরা পড়ে।
রাত বারোটা নাগাদ খেতে গেলাম। মাটিতে ভাঁজ করা চাদরে বসে থার্মোকলের থালা পেতে সারি দিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা। গরম ভাত, ডাল আর বেগুন, আলু, শিম ইত্যাদি দিয়ে একটা ঘ্যাঁট তরকারি – দিব্য লাগল – চেয়ে চেয়ে তরকারি খাই। মনে পড়ছিল ছোটবেলায় শোনা পূর্ণদাস বাউলের গানের কলি – "আমি মরছি ঘুরে সেই দুকানের সহজ ঠিকানা, যেথায় আল্লা হরি রাম কালী গণ এক থালাতে খায় খানা..."
ভোর চারটের দিকে গাইলেন আইজুল ফকির। বড় ভালো গান করেন আইজুল। তাঁর গানের সঙ্গেই আলো ফুটল, চারদিকে তখন ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা। ক্রমশঃ কুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রকাশ্য হল সকাল। মাটির রাস্তার দু'দিকে বিস্তৃত সর্ষে ক্ষেত তখন দিকদিগন্ত আলো করে আছে। চার কিলোমিটার মতো মাঠ আর ক্ষেত পেরোলেই পদ্মা। ওপারে বাংলাদেশ। সেই ওপারে আমার দেশের বাড়ি ছিল – মাঝে মাঝেই 'কোমলগান্ধার' মনে পড়ে আজকাল। শুধু সে সুরের প্রেক্ষাপট বদলে বদলে যায়। ঘটনা একই থাকে। এক মানুষকে হত্যা করে আরেক মানুষ, নানা নামে – হিন্দু, মুসলমান, নাস্তিক...।
অথচ, ওদিকে লালন আপন মনেই গেয়ে যান - আসবার কালে কি জাত ছিলে/ এসে তুমি কি জাত নিলে/ কি জাত হবে যাবার কালে/ সে কথা ভেবে বলো না...।
মঞ্চের ওপরে নিচে নানা ভঙ্গিমায় মানুষ আর মানুষ – কমলা রঙের পাগড়ি আর জোব্বা পরা সাদা চুলের ফকির মানুষটির হাতে বিড়ি – গান শুনতে শুনতেই সুখটান, সাদা কাপড়ের প্রৌঢ়া ভাবের ঘোরে খানিক ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকেন দর্শকের ভিড়ের মাঝেই জায়গা করে নিয়ে, গাছের আড়ালে নিবিষ্ট মনে বসে গানের তাল ঠোকেন যে মাজা মাজা শ্যামল রঙের ফকির, যার চুলের এলোমেলো লম্বা জটা নেমেছে কোমর অবধি, ক্যামেরা হাতে আমাকে দেখে তাঁর চোখেও জিজ্ঞাসু চাহনি। পাশ দিয়ে চোখ চলে যায় নিপুণভাবে নিকোনো আশ্রমের মাটির দাওয়ায়। সামনে গাছগাছালি।
দু'পাশে হলুদ রঙের মাঠ, মাঝের কাঁচা পথ বেয়ে আজান আর সুজানের হাত ধরে হেঁটে আসছেন আমার সত্তোরোর্ধ মা।
আর আমি ক্যামেরার ফ্রেমে সেই চিরন্তন মানুষরতনের অন্বেষণ করে যাই – কখনও যদি ধরা দেয়।
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে, ঘরের পাশে আরশিনগর সেথা এক পড়শি বসত করে …
আজান-এর সঙ্গে গল্প করছিলাম ছাদে। হঠাৎ দেখি ওর সঙ্গিনী সুজান ন্যাড়া ছাদের পাড় থেকে উঠে আসছে। হাতে এক গুচ্ছ সর্ষেফুল। বিলিয়ে দিল আমাদের একটু একটু করে। কিন্তু কেমন করে ছাদ থেকে মাঠে গেল এবং ফিরে এল বুঝলাম না – পাইপ বেয়ে না গাছ! জিজ্ঞাসা করিনি। নীচে নেমে ফুলটা মাথায় গুঁজে নিলাম।
ইংরেজিতে 'হোম' শব্দটা যে নৈকট্যভাব বহন করে বাংলা 'ঘর' শব্দটা দিয়ে কি সেটা বোঝানো যায়? ভাবছিলাম। বাসা-র সঙ্গে আসলে ভালোবাসার একটা খাসা সম্বন্ধ আছে। গান শুনতে গিয়ে শীতের এক সকাল পর্যন্ত যে ঘরে অথবা বাসায় অথবা বাড়িতে ছিলাম সেখানে ইনাসুদ্দিন, মল্লিকা, ইন্দ্রনীল, সত্যম, সংঘমিত্রা, আজান, সুজান এমন চোদ্দ-পনেরো জন একসঙ্গে একরাত্তির-সকাল গান শোনায় আর গল্প-আড্ডা-আধঘুমে কেটে গেল। এদের মধ্যে কেউবা শিক্ষক, কেউ গবেষক, কেউবা আকাশবাণী মুর্শিদাবাদে কাজ করেন। সত্যম আর ইন্দ্রনীলের বাহন একটা বাইক, তার কেরিয়ারে দু'একটা জামা-কাপড়, প্রয়োজনীয় টুকিটাকি, শীতের সময় বাড়তি একটা কম্বল আর সবসময় পোঁটলায় বাঁধা ছাতু। দুই বন্ধু অনেকটা সময়ই থাকেন পথে পথে, মেলায়-আখড়ায়। রাতে আমাদের সকলের জন্য বারবার করে উঠে দরজা খোলা-বন্ধ করছিলেন নুরুল হুদা, বাড়িটি যাঁর। সকালবেলায় থালায় থালায় মুড়ি এল, গরম চা আর বিস্কুট। ভিড় সরতে মায়ের সঙ্গে ভাব জমাতে বাড়ির বউটি হাজির হল। মাকে তার বোনের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাবে, এই ইচ্ছে। গাড়ি এসে গিয়েছিল, তাই রীতিমতো খিদে আর খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মাছের ঝোলভাতটা খাওয়া হলনা অনেক অনুরোধেও। ভাবছিলাম, ইস্, ঘন্টাখানেক আগে বলত যদি...। খুব সাধারণ মানুষের মধ্যে গেলে বোঝা যায়, মানুষ মানুষকে স্বভাবগতভাবে ভালোবাসে। সে ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত। না-ভালোবাসা অথবা বিভেদ সমাজের দ্বারা আরোপিত।
যাঁরা এই বাউল-ফকির গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন তাঁদের সবাই কতটা সেইভাবে এই ভালোবাসার অনুভব আত্মস্থ করেছেন বা তা নিয়ে ভাবেন তাতে সন্দেহ আছে। তবু তাঁদের হাত ধরেই বয়ে চলুক মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টার এই গানের এবং প্রাণের পরম্পরা। ধর্মীয় বিভেদ আর সন্ত্রাসের দিনে কিছু মানুষ তবু ভালোবাসার কথা শোনাক।
"মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষের সনে" – ফেরার পথে এগোই।
গান কতটা প্রাণে গেল জানিনা, তবে মানুষ দেখলাম। ওইজন্যই তো ভ্রমণ – নিজেকে জানা আর অন্যকে দেখা।
"আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না, এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা..."।
(তথ্যসহায়তা – দেব দাস)
'আমাদের ছুটি' –র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত নেশায় লেখক, ভ্রামণিক, ভ্রমণসাহিত্য গবেষক। প্রকাশিত বই - 'অবলা বসুর ভ্রমণকথা' (সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত)।