বনবিবি বেত্তান্ত
তপন পাল
(১)
২০০৭ সালে লবণহ্রদের এক অফিসে আমার সহকর্মী ছিলেন ভাস্কর রায়। এক শীতের দুপুরে অফিস পালিয়ে, আমরা দুজনে লবণহ্রদের পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রে (ই জেড সি সি) 'কারিগরের হাট' দেখতে যাই। তথায় বড় ঠাকুরের মূর্তি - অবয়বহীন মুন্ড যার মুকুট অতীব লম্বা - দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যা বাস্তুঠাকুর মতান্তরে ধর্মঠাকুর রূপে আক্ষিণ দিন (পৌষ সংক্রান্তির পরদিন) পূজিত হন ও এছাড়াও নানা জায়গায় এই ঠাকুরের স্থায়ী 'থান' দেখা যায় - বিক্রি হচ্ছিল। লোকশিল্পের উদাহরণ হিসেবে আমি যখন ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য তা কিনতে উদ্যত, তখন শ্রীমান বলেন যে, এই মূর্তি ছাদের নীচে রাখতে নেই, রাখলে অমঙ্গল। তাঁদের বারুইপুরস্থিত ভিটায় এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছেন। প্রতি বছর আক্ষিণ দিনে বনবিবি তথা বিবিমার সঙ্গেই তিনি পূজা পান। তবে বিগ্রহের অবস্থিতি গৃহে নয়, পুকুরপাড়ের এক অস্থায়ী চালায়।
আমি তখন সদ্য অমিতাভ ঘোষের 'দ্য হাংরি টাইড' পড়ে উঠেছি। বনবিবি আখ্যান তথা জোহরনামায় আমার মস্তিস্ক পরিপূর্ণ। তৎক্ষণাৎ তাকে আমি বনবিবি, শাহ জংলি, দক্ষিণ রায়, অন্নপূর্ণা, দুখে-কে নিয়ে এক বক্তৃতা দিয়ে দিই। বস্তুতঃ মক্কায় জন্মগ্রহণ করা, জন্মসূত্রে মুসলিম ও দেবলোকের একমাত্র পায়ে জুতো পরা এই দেবীর প্রতি আমার আকর্ষণ বহুদিনের। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মের লোকেরাই দেবীর পূজো করে, কিন্তু সে তো ঠেলায় পড়ে, নিরাপত্তার আশায় - আতিথ্য বিমুখ ডাঙায় জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বেরিয়ে বাঘ, সাপ, কুমীর, কামটের দাঁত থেকে বাঁচতে। দুই ধর্মাবলম্বীরা পুজো করলেও এবং ধর্মচিন্তার সমন্বয় প্রচেষ্টা সত্বেও দেবীর প্রতি দুই সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গীতে কোথাও হয়তো সূক্ষ্ম তফাৎ আছে। মুসলিমদের কাছে দেবী আল্লাহের প্রেরিত; মতান্তরে মহম্মদের কন্যা ফতিমা, ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্না। তাঁদের পুজোও লাল পতাকা ও গাঁদাফুলের মালা নির্ভর। হিন্দুদের কাছে তিনি দেবী, মাতৃস্থানীয়া, তাঁর আরাধনা বাতাসা, মঠ, লাড্ডু নির্ভর। রায়দিঘী যাওযার পথে কাশীনগর বাজারের মধ্যে মাইবিবি মন্দির বহু প্রাচীন, অনেকখানি ছড়ানো। সেখানে বা নিকটবর্তী কৃষ্ণচন্দ্রপুরে গ্রামের শেষে মাঠের ধারে বনস্পতির আলোছায়ায় নির্জন ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির যাওয়ার পথে বনবিবির থানে পুজো দেখে সে রকমটাই মনে হয়েছিল আমার।
আমার জ্ঞান দেওয়া শেষ হলে শ্রীমান সবিনয়ে জানালেন যে তাঁদের গ্রামে অদ্যাবধি হই হই করে বনবিবি তথা বিবিমার পুজা হয় এবং আমি ইচ্ছা হলে গিয়ে দেখে আসতে পারি।
এমন আমন্ত্রণ ফেরানো কঠিন। বনবিবি সম্বন্ধে যেটুকু জানা, সবটাই পুঁথিগত। গ্রামের মধ্যে গিয়ে এমত লৌকিক দেবতার পুজো স্বচক্ষে দেখা, সঙ্গে বিনামূল্যে এক শীতের দুপুরের ভ্রমণ - ফলে না গিয়ে উপায় নেই।
(২)
তদনুযায়ী আক্ষিণ দিনে বেরিয়ে পড়া গেল। ভাস্করদের বাড়ি বারুইপুর শহরের প্রান্তে বারুইপুর আমতলা সড়কের উপরে ধোপগাছি গ্রামে, কল্যাণপুর গ্রামপঞ্চায়েত অফিসের বিপরীতে। ধোপগাছি ধবল গাজির অপভ্রংশ, যিনি ছিলেন 'সাহেবদের মত ফরসা' (এলবিনো?) এক সন্তপির। তাই তাঁর নাম ধবল গাজি, তাঁর নামেই গ্রামের নাম এবং লোকবিশ্বাসে তিনিই গ্রামটির স্রষ্টা তথা রক্ষাকর্তা।
ওই সড়কের ওপরেই তাঁর মাজার। সড়কটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। পির সাহেব তাঁর বহু পূর্বেই সম্ভবতঃ প্রয়াত, কারণ রাস্তার ভূমিবিন্যাস মাজারটি অক্ষত রেখে তীব্র বাঁক নিয়েছে। গোরা বাস্তুকাররাও সম্ভবতঃ পির সাহেবের শান্তি বিঘ্নিত করতে তথা তাঁর অপ্রিয় হতে চাননি। মাজারের পাশেই বাবা পঞ্চানন্দের মন্দির। ব্যাঘ্রারূঢ়, উগ্রচন্ড এবং দাক্ষিণ্যময় এই দেবতা আমাদের পরিচিত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এবং হাওড়ার অনেক জায়গাতেই তাঁর মন্দির আছে, বা থান। থানে একটি বৃক্ষ, মূলতঃ ন্যগ্রোধ তাঁর প্রতীক, দেবতা কল্পনায় বৃক্ষকাণ্ডে ধুতি জড়িয়ে রাখা হয়।
ভাস্করদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল সে গেছে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে। তারা এলে মধ্যাহ্নভোজ। ইতিমধ্যে একজন দ্বিচক্রযানের পিছনে বসিয়ে বিবিমার প্রতিমা নিয়ে এল। খাওয়া দাওয়ার পর কাঁসর-ঘন্টা, কাঁসি-শাঁখ বাজিয়ে, প্রতিমার গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে, পুকুরপারস্থিত বাস্তুদেবতাকে প্রণাম করে, প্রতিমাকে মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু হলো, পুজো বলতে এইটুকুনই।
বাসরাস্তা ছেড়ে পিচের রাস্তা, পিচের রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা, পথিপার্শ্বে পেয়ারাবাগান, বাঁধাকপির ক্ষেত, সময়ের পদচিহ্নহীন দীর্ঘ সুপারিবীথি। যেতে যেতে দেখা গেল আরও অনেকেই প্রতিমা নিয়ে যাচ্ছেন, বড় প্রতিমা হলে তিনি যাচ্ছেন তিন চাকার সাইকেল ভ্যানে চেপে।
অনেক দূর থেকেই মাইকের আওয়াজ আসছিল - নিকটবর্তী হয়ে দেখা গেল দস্তুরমত মেলা বসে গেছে। কী নেই সেখানে - ঘুগনি, ফুচকা, লাল ডিমসেদ্ধ, রোল, সিঙাড়া, জিলিপি, কচুরি, গেরস্থালির বাসনকোসন - আরও অনেক কিছু। ক্রমে গিয়ে পড়া গেল রাধাবল্লভপুর বিবিমা স্পোর্টিং ক্লাব প্রাঙ্গণে। মস্ত বড় এক বাঁশঝাড়। তার গোড়ায় বেদি। দেখলেই বোঝা যায় সদ্য সদ্য মাটি কেটে তৈরি করা। সেখানে সার দিয়ে, নানা আকারের বিবিমাপ্রতিমা বসানো। কোথায় দেবী দণ্ডায়মানা, কোথাও ব্যাঘ্রারূঢ় দেবীর সঙ্গে সহোদর শাহ জঙ্গলি, দেবীর আদেশে যিনি শত্রু দমন করেন। কোথাও তিনি পাজামা ও নীল পাঞ্জাবি পরে বৃষারূঢ়, কোথাওবা লুঙ্গি পরিহিত। রয়েছেন মাতা শীতলা, দেবীর হাতে পর্যুদস্ত দক্ষিণরায় - জঙ্গলের অধিকর্তা তথা মোম মধুর সৃষ্টিকর্তা। মধু ও গোলপাতা আহরণকারী মৌলিদের কাছে বাঘরূপে তিনি বিপদের কারণ। তাঁর পায়ে হাঁটু অবধি ঢাকা বুটজুতো, কাঁধে বন্দুক, চেহারায় উগ্রচণ্ড। এতদিন জানা ছিল বনবিবিকে হিন্দুরা মূর্তিতে এবং মুসলমানরা হাজত করে পুজো দিয়ে থাকেন। এখানে এসে দেখা গেলো সে ভেদরেখা সুপ্ত। কে মূর্তি পুজো করছেন কে হাজত করছেন আর কে দণ্ডি খাটছেন, কে বাতাসা ছড়াচ্ছেন তা দেখে আর যাই হোক, হিন্দু মুসলমান বোঝা যায় না এবং সমগ্র অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করছেন জনৈক বেওয়া অর্থাৎ মুসলমান বিধবা।
আমার মামাবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোয় ধুনো পোড়াবার চল আছে, অর্থাৎ মহিলারা উপবাসে থেকে স্নান সেরে, নতুন কাপড় পরে, দেবীমূর্তির সামনে বসে মাথায় একটি ও দুহাতে দুটি মাটির মালসায় নারকেলের ছোবড়া দিয়ে ধুনো পোড়াবেন। সাধারণতঃ কোন কামনাপূর্তির পরই এটা করা হয়। এখানে এসে দেখা গেলো সার দিয়ে মহিলারা ধুনো পোড়াচ্ছেন, এক দল উঠে গেলে আরেকদল। স্বেচ্ছাসেবকরা মাজননীদের মাথার মালসার আগুনে ধুনোর গুঁড়ো ছিটিয়ে দিচ্ছেন লম্বালম্বি; এক চকিত অগ্নিরেখা এক মুহূর্তের জন্য, কালো ধোঁয়ায় পদচিহ্ন রেখে। কোন কোন মহিলা ধুনো পুড়িয়েই, সম্ভবত সকাল থেকে না খেয়ে থাকার জন্যে, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। অত প্রতিমা অত মানুষ অত কোলাহল - সার্থক মেলা নামটি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আক্ষিণ দিনটিতে পৌষ পার্বণের পিঠা, পাটিসাপটা, তিলখাজা, টক দই ও দেশি মদ্য অবশ্য ভক্ষ্য। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়ির পরিচারিকা আরতিপিসি ওইদিন কাজে আসতেন না, সারাদিন বাড়িতে থেকে বৃদ্ধ বাবাকে পাহারা দিতেন। ছাড়া পেলেই তাঁর বাবা রেলষ্টেশনে চলে যাবেন। প্ল্যাটফর্মের এক প্রান্তে দেশি মদের জোগানদার। কিন্তু এই মেলায়, এত দোকান এত লোকের মধ্যেও কোন মদের দোকান বা মাতাল ব্যক্তি চোখে পড়ল না।
বিবিমা মদ্যপান পছন্দ করেন না। জীবিকার দায়ে, পেটের জ্বালায় যারা সুন্দরবনের গহীনে যান, তাঁরা জানেন জীবন যেখানে কত নিষ্করুণ। প্রতি পদে কত সতর্ক থাকতে হয় এবং মুহূর্তের অন্যমনস্কতা কী বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই সমগ্র সুন্দরবনে মদ্যপান নিষিদ্ধ। বিবিমার থানেও তাই। মাতালরা গণপ্রহারের ভয়ে ওই দিন ওই দিক মাড়ায় না।
যারা ধুনো পোড়াচ্ছেন, দেখা গেল তাঁদের বেশিরভাগই সাদা শাড়ি পরা। তবে কি বিধবারাই ধুনো পোড়ান, প্রশ্ন স্বাভাবিক। কিন্তু উত্তরটি অস্বাভাবিক। শিবশংকর মিত্র ও অমিতাভ ঘোষ পড়ে আমরা জেনেছি যে পুরুষরা জঙ্গলে গেলে, গৃহে তাঁদের অনুপস্থিতিকালীন, তাঁদের স্ত্রীরা বৈধব্যবেশ ধারণ করেন। এখানেও তাই প্রথা। অনেক সধবাই ধুনো পোড়াতে এলে বৈধব্যবেশেই আসেন। ধুনো পোড়াবার আচারটি সম্ভবতঃ প্রতীকি, বৈধব্যবেশে স্বামীর প্রতীকি দাহকার্য করে ভাগ্যকে বিভ্রান্ত করার মরিয়া প্রচেষ্টা। এক প্রজন্ম আগেও তো মৃতবৎসা নারীরা ছেলের নাম রাখতেন কানা অথবা পচা, যম তাই শুনে তাদের 'খুঁতো' (দোষযুক্ত) ভেবে নেবেন না আশা করে।
না কি এটি অগ্নিপরীক্ষা? - বিশেষতঃ যেভাবে হাতে গরম অগ্নিগর্ভ মাটির মালসা ধরে রাখতে হয় । তাতে সে রকম মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। রামায়ণ থেকে ত্রিস্তান ইসল্টের মধ্যযুগীয় ফরাসি লোকগাথা, অগ্নিপরীক্ষা তো সতীত্বের চরম ও চূড়ান্ত পরীক্ষা সর্বকালে, সর্বদেশে। স্বামীর দীর্ঘকালীন বনগমন অনুপস্থিতিতে স্ত্রীটি যে নিষ্কলঙ্ক সাধ্বী ছিলেন, তাই প্রমাণ করতেই কি এতো আয়োজন ; কিন্তু জীবন যেখানে পদ্মপত্রে জলের চেয়েও চঞ্চল, ডাঙা যেখানে আতিথ্যবিমুখ, আকাশ যেখানে ঘূর্ণিক্ষুব্ধ, জল যেখানে সাপ কুমির কামটে ভরা, সেখানে বেঁচে থাকাটাই প্রতি মুহূর্তের পরম প্রাপ্তি। সেখানে এই সব ছোটখাটো ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামায়!
গ্রামের পথ ধরে, ক্ষেতের আল বেয়ে আরও অনেকখানি গেলে আন্ধারিয়া বলে একটি জায়গা। সেখানেও পুজোরই ব্যবস্থা, তবে অত হইহই নেই, কারণ মূল অনুষ্ঠানটি সন্ধ্যারাত্রে। বিশাল দুটি বনস্পতির গোড়ায় বিবিমা ও শাহ জঙ্গলির আলাদা আলাদা থান, চারিদিকে বড় বড় গাছ, নৈঃশব্দে ভরা।
এই পুজোর বৈশিষ্ট্য বনভোজন, বনভোজন পিকনিক অর্থে নয়, আক্ষরিক বনে গিয়ে ভোজন অর্থে। গ্রামীণ মহিলারা মাটিতে গর্ত করে, কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে রাখছেন। সন্ধ্যারাত্রিতে উনুন জ্বলবে। এই অনুষ্ঠানও মানসিক নির্ভর-প্রার্থনা পূরণের পর ধন্যবাদজ্ঞাপন গোত্রের। খোলা আকাশের নীচে, মাটিতে গর্ত করে জ্বালানো উনুনে, সংগৃহীত কাঠকুটো জ্বেলে, মাটির হাঁড়িতে রান্না হবে। পদ একটিই, ভাত সব্জি সহযোগে সেদ্ধ, সঙ্গে অনেকখানি লবণ। উনুনের পাশে মায়ের নামে খোলা আকাশের নীচে বসে খেতে হবে এবং আহার্যের কোন অংশই বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না- অব্যবহৃত কাঠকুটো বা হাঁড়িটিও নয় ; কারণ এসবই কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, বিবিমার। কাঁচালঙ্কা, জানা গেল এক দশক আগেও প্রবেশাধিকার পেতো না, তবে ইদানীং পেয়েছে, যদিও টমাটো অদ্যাবধি নিষিদ্ধ। খাওয়া শেষে, জায়গাটি এমনভাবে পরিস্কার করে দিতে হবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে এখানে মানুষে রেঁধে খেয়েছে। দেখে শুনে মনে হল আচারটি প্রতীকি। মৌলি অর্থাৎ যারা সুন্দরবনের গহিনে মধু বা গোলপাতা সংগ্রহ করতে যান তাদের নিরাপদে গৃহ প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী ধন্যবাদজ্ঞাপন।
(৩)
দন্ডবক্ষ ও রায়মণি নামে রাক্ষস দম্পতি সাঁইত্রিশ কোটি পিশাচ সিপাই লস্কর নিয়ে সুন্দরবন দখল করে। তাঁদেরই পুত্র দক্ষিণরায় রাজা হয়ে আরও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। বাঘের রূপ ধরে মানুষ খেতে থাকেন। সুন্দরবনের লোকবিশ্বাসে বাঘ মানুষ খায়না, দক্ষিণরায় বাঘের রূপ ধরে মানুষ খায়।
মক্কার ফকির ইব্রাহিমের প্রথমা স্ত্রী নিঃসন্তানা। সন্তানার্থে ইব্রাহিম গোলালবিবিকে বিবাহ করলেন। ওই সময় আল্লাহ স্থির করলেন বনবিবি ও শাহ জঙ্গলিকে তিনি মর্ত্যে পাঠাবেন। গোলালবিবি সন্তানসম্ভবা হলে প্রথমা স্ত্রীর প্ররোচনায় ইব্রাহিম তাঁকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে গেলেন। কারণ তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে ; তার পিতৃত্ব- ক্ষমতা প্রমাণিত। আল্লাহ করুণাময়। তিনি গোলালবিবির জন্য চারজন দাইকে পাঠালেন, সেখানেই বনবিবি আর শাহ জঙ্গলির জন্ম, বেড়ে ওঠা। সাত বছর পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইব্রাহিম দ্বিতীয়া স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাকে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। এর কিছুদিন পর, নমাজ পড়ার সময়, ভাই-বোনে দুটি টুপি পেলেন। খেলাচ্ছলে সেই টুপি মাথায় দিতেই মোজেজা (জাদু অর্থে) - তাঁরা ফিরে গেলেন জন্মস্থানে, আঠারো ভাটির দেশে। আঠারো ভাটির দেশে রাজা তখন পূর্বোক্ত দক্ষিণ রায়, বড়ই অত্যাচারী। শাহ জঙ্গলির আজানের আওয়াজ কানে যেতেই তিনি ক্ষেপে লাল। বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠালেন খোঁজ খবর নিতে। সনাতনের মুখে সব শুনে দক্ষিণ যুদ্ধযাত্রা করবেন মনস্থ করলেন। এমন সময় দক্ষিণের মা নারায়ণী বললেন মহিলার সঙ্গে পুরুষের যুদ্ধ করা শোভা পায়না - এই বলে ভূত প্রেত দত্যি দানোদের নিয়ে তিনি যুদ্ধে এলেন। যুদ্ধ হল; এবং কিমাশ্চর্য দু-জনে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। দু'জনে সুন্দরবন আধাআধি ভাগ করে নিলেন।
বনবিবি বলে সই শুন দেল দিয়া ।
সকল আঠার ভাটি লহিব বাটিয়া ।।
বনবিবির ভাগে পড়লো মনুষ্যবসত আবাদের জমি। আর দক্ষিণ রায়ের ভাগে পড়লো গহন জঙ্গল । দক্ষিণ রায় এই ভাবেই হলেন গহন জঙ্গলের দেবতা। সেখানকার প্রাণী, ভূত, দত্যিদানোদের রাজা - মানুষের প্রবেশ নিষেধ । সেখানে ঢুকলেও তার কোন চিহ্ন রেখে আসা যাবে না। দেবতা ক্রুদ্ধ হবেন। নেমে আসবে বান তুফান কুমীর-কামট বাঘ-সাপের উৎপাত। মৌলি কাঠুরেরা জঙ্গলের ওই অংশে কোনো কিছু ফেলে আসা তো দূরের কথা, এমন কী মল-মূত্র ত্যাগ করেন না, থুতুও ফেলেন না - আজও; অদ্যাবধি। এর মধ্যে প্রকৃতিবাদের অরণ্য সংরক্ষণের বার্তা কি পাই না আমরা! উনবিংশ শতকের সাহেবরা আমাদের বলবেন, তবে আমরা বুঝব যে বন কেটে বসত কোন অবস্থাতেই অরণ্যকে সমৃদ্ধ করেনা, তাকে নিঃস্ব করে! খুলনার বাগেরহাট জেলায় নির্মীয়মান রামপল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প কি সেই শিক্ষাই দেয় না আমাদের, যে অরণ্যে নিরন্তর এক 'এথনিক ক্লিনসিং'-এর কাজ চলে – বন কেটে বসত করা মানুষের ভাগেও জমি থাকে না- ক্রমেই তা চলে যেতে থাকে শিল্পপতি, হোটেল মালিক, রিসর্ট মালিকদের হাতে।
ধনা আর মনা বারিজহাটি গ্রামে বসবাসকারী দুই ভাই। পেশায় মৌলে। মনার আপত্তি সত্ত্বেও ধনা সাতটা নৌকা, লোকলস্কর নিয়ে দক্ষিণ রায়ের মহলে গেলো, সঙ্গে দুখে। কেঁদোখালির চরে গিয়ে ধনা মধু আর পায় না। তিনদিন পর ধনার স্বপ্নে দেখা দিয়ে দক্ষিণ রায় বললেন তার মানুষ চাই। ধনা মনস্থির করলো দুখে-কে চরে ছেড়ে যাবে। মধু মিলল, মোমও। কাঠ সংগ্রহে দুখে যখন জঙ্গলে, ধনার নৌকা নোঙর তুলল। বাঘবেশী দক্ষিণ রায় দুখেকে খেতে উদ্যত। দুখের মা বলে দিয়েছিলেন বিপদে পড়লে বনবিবিকে ডাকতে, দুখে তাই করল,
আমায় কে ডাকলো.... মা বলে
শোন বলি ভাই শা জঙলি
যেতে হবে কেঁদোখালি
কোন বাছার আজ বিপদ ভারী
তাইতো আমার আসন টলে।।
ডাকা মাত্র বনবিবি আর তার ভাই শাহ জঙ্গলি এসে উপস্থিত। শাহ জঙ্গলি দক্ষিণ রায়কে প্রায় পরাজিত করে করে, এমন সময় বড়াখান গাজি (কুমিরের রক্ষাকর্তা ; তাঁর আবাস মহেশতলায়, নঙ্গী রেল ষ্টেশনের অনধিক দুই কিলোমিটার পূর্বে) দুজনের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করলেন। আর দুখেকে দিলেন সাত গরুর গাড়ি বোঝাই মণি -মাণিক্য, দক্ষিণ রায় তাকে দিলেন অনেক অনেক মধু আর মোম। তারপর বনবিবি তাঁর পোষা কুমির সেকোকে বললেন দুখেকে পৌঁছে দিয়ে আসতে গ্রামে। ফিরে গিয়ে দুখে ধনার মেয়ে চম্পাবতীকে বিয়ে করে চৌধুরী উপাধি গ্রহণ করলেন।
এর মধ্যে সংহতি ও সামাজিক উত্তরণের ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয় কি?
আঠারো ভাটির মাঝে আমি সবার মা ।
মা বলি ডাকিলে কারো বিপদ থাকে না।।
(৪)
শীতের ছোট বেলা, ইতিমধ্যে পড়ে এসেছে। সবাই রাধাবল্লভপুর বিবিমা ক্লাবে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেন, না বামনগাছির ঠাকুর আসবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল বামনগাছি সন্নিহিত একটি গ্রাম এবং বামনগাজির অপভ্রংশ। বামন গাজি লোকবিশ্বাসে ধবলগাজির সহোদর খর্বকায় ভাই - তাই বামন। দুই ভাইয়ের নামে পাশাপাশি দুটি গ্রামের নামকরণ একটু অবাক করা বৈকি!
বিকাল ও সন্ধ্যার সন্ধিমুহূর্তে এক ছোট রাস্তায় দেখতে পেলাম অতি দীর্ঘ এক জনমিছিল। সামনে ঢাক, ঢোল, তারপর লাইন দিয়ে বামনগাছি গ্রামের ১২৩ জন বাসিন্দা এলেন, প্রত্যেকের মাথায় বিবিমা মূর্তি। মূর্তিগুলি ওই থানে স্থাপন করে সেদিনের মত দিন শেষ।
জানা গেল, অনুষ্ঠানটি শ'দেড়েক বছরের পুরনো। ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ পাথরপ্রতিমা ব্লকের গোবর্ধনপুরে খননকার্য চালিয়ে জানিয়েছিলেন যে, সুন্দরবনে মনুষ্য বসবাসের ইতিহাস খ্রীষ্টের সমসাময়িক। হুগলির নদীমুখ দীর্ঘকাল ধরেই বাণিজ্যিক জলপথ এবং সেই সূত্রেই মনুষ্যবাস। পর্ত্তুগিজ ও আরাকানি জলদস্যুদের সৌজন্যে তার স্মৃতি অধুনাবিলুপ্ত। ১৯১৪ তেও [ওমালি (এল এস এস ওমালি) ১৮৭৪-১৯৪১ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার সূত্রে স্মরণীয়] সাহেব জানাচ্ছেন যে, এই অঞ্চল জলাভূমি, দ্বীপ, নদী-নালা, জঙ্গল পরিপূর্ণ। ব্রিটিশরাই বাঁধ দিয়ে নদীর নোনা জল আটকে, জঙ্গল কেটে কৃষিজমির পত্তনি দেন। হিন্দু- মুসলমানের সেই সম্মিলিত বসতি স্থাপনের দিনে, নির্দয়া প্রকৃতি ও নিষ্করুণ জীবনে নিরাপত্তার কামনায় দেবীর উদ্ভব। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, আজকের ক্রমবর্ধমান বারুইপুর শহরের এত কাছে মাত্র দেড়শো বছর আগে মানুষের প্রথম ও প্রধানতম আত্মরক্ষা ছিলো ব্যাঘ্রভয় থেকে মুক্তি।
সূর্য গেলো অস্তাচলে, আঁধার ঘনালো........ ভাস্করদের বাড়িতে বসে আগের দিনের পৌষ-পার্বণের ভক্ষ্যের সদ্গতি করার সময় শুনতে পাই মাইকে ভেসে আসছে যাত্রার সংলাপ।
ভাস্করদের বাড়ি থেকে যখন বেরোচ্ছি, তাঁর মাতাঠাকুরানী বললেন, যাচ্ছিস তো পিরতলায় হাজতটা দিয়ে আয়। ও মা হিন্দুতে হাজত দেয় নাকি? দেয়, সুন্দরবনে দেয় গো।
ঘন অন্ধকারের মধ্যে পির সাহেবের মাজার ও বাবা পঞ্চানন্দের মন্দির। মাথার ওপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ। শহরের আলোকদূষণ এড়িয়ে আকাশ দেখা। তারপর বাড়ির পথ।
বস্তুতঃ এত ভালো লেগেছিল ওই দিনটি যে, তারপর বিবিমাপুজো দেখতে যাওয়াটা এক বার্ষিক অভ্যাসে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে শ্রীমতী পালও আমার সঙ্গী হন।
অনেক পরে, আমতলায় মহিষগোটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জনৈকার বাড়ি রক্ষাকালী পুজো দেখতে গিয়ে দেখেছিলাম তাঁদের ভিটায় পাশাপাশি বনবিবি, দক্ষিণরায় ও খয়েরবিবি, শঙ্কুসদৃশ ঢিবি আকারে প্রতিষ্ঠিত। ফলতা তেঁতুলতলায়, যেখানে অধুনালুপ্ত কালীঘাট ফলতা রেলপথের ফলতা ষ্টেশন ছিলো, অতিকায় তিন্তিড়িবৃক্ষের নীচে ঠিক ওই রকমটিই দেখেছি।
সূত্র -
১) অমিতাভ ঘোষ, দ্য হাঙ্গরি টাইড, পৃষ্ঠা-৮৪-৮৮, ২৯২-৯৭
২) বনবিবির জহুরানামা, মরহুম মুনশী মোহম্মদ খাতের সাহেব প্রণীত
৩) দক্ষিণ ২৪ পরগণার লৌকিক দেবদেবী,পালাগান ও সংস্কৃতি জিজ্ঞাসা, দেবব্রত নস্কর
৪) বনবিবির পালা, সুজিত কুমার মৌলি সম্পাঃ
৫) ইসলামি বাংলা সাহিত্য, সুকুমার সেন
৬) সুন্দরবন সমগ্র, শিবশঙ্কর মৈত্র
৭) সোনালি দুঃখ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গ অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা।