আমার দেখা চিন

শ্যামলেন্দুবিকাশ সরকার

 

~ চিনের আরও ছবি ~

সেপ্টেম্বরের একরাতে স্ত্রী অনুসহ আমরা ক'জন কলকাতা থেকে বিমানে চেপে আড়াই ঘন্টায় পৌঁছলাম চিনের ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে। ঘড়িতে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে পাঁচটা। পর্যটন ও ফুল রপ্তানীর সুবাদে কুনমিং চিনের অন্যতম শহর। তিনতলা বিশাল ঝকঝকে বিমানবন্দর। ছবির মতো সাজানো দোকানপাট। প্রচুর বিমান দাঁড়ানো দেখে বিমানবন্দরের ব্যস্ততা বোঝা যায়। অভিবাসন পর্ব সেরে বেরিয়েই গাইড টিনার সঙ্গে দেখা। চিনা গাইডরা নিজেদের খটমট নামের পরিবর্তে বিদেশি পর্যটকদের জন্য সহজ নামে পরিচয় দেয় - টিনা আমাদের গাইডের এমনই পরিবর্তিত সহজ নাম। চলনসই গোছের ইংরেজিতে সে শুভেচ্ছা বিনিময় করল সবার সঙ্গে। পাশের কাউন্টারে কিছু ডলার ভাঙিয়ে চিনা মুদ্রা ইউয়ান সংগ্রহ করলাম। বাতানুকূল বাস অপেক্ষা করছিল বাইরে। আমরা উঠতেই মসৃণ প্রশস্ত পুষ্পশোভিত পথে এগিয়ে চলল বাস। পথে ম্যাকডোনাল্ডসে বিরতি প্রাতরাশের জন্য। বেলা বারোটার আগে হোটেলে চেক-ইন হবেনা, তাই বাস সরাসরি পৌঁছল প্রকৃতির বিস্ময় স্টোন ফরেস্টে। টিকিট কেটে ব্যাটারি চালিত দু-কোচের গাড়ি চেপে চললাম ইউনেস্কোর ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত স্টোন ফরেস্টের অভ্যন্তরে। গাড়ি চলছে ধীরগতিতে, মাঝেমধ্যে বিরতিসহ। ফরেস্টের গাইড বা গাড়িচালক অধিকাংশই মহিলা। প্রায় সকলের মাথায় মুকুটের মত টুপি যার দুপাশে দুটো শিং রয়েছে। এই শিং নিয়ে এক মজার (!) গল্প শোনাল গাইড। কয়েক দশক আগেও কোনো পুরুষ কোনো কুমারী চালিকার শিং স্পর্শ করলে প্রথানুসারে পুরুষটি চালিকাকে বিয়ে করতে বাধ্য হত। আজ পুরনো প্রথা উঠে গেলেও সাজগোজের অঙ্গ হিসাবে শিং রয়ে গেছে। স্টোন ফরেস্টে সার দিয়ে দাঁড়ানো পাথরগুলো কয়েক লক্ষ বছরের পুরনো। দীর্ঘকাল ধরে ঝড়-জলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে চুনাপাথরের একাধিক টিলা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে নানা আকৃতি ধারণ করেছে। দণ্ডায়মান পাথরগুলির কিছু উল্লম্বভাবে, কিছু অনুভূমিকভাবে বহু খণ্ডে বিভক্ত। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রস্তরসজ্জার উপরিভাগ মানুষ, হাতি, ভালুক ইত্যাদির দেহাংশ বলে মনে হয়। কোনোটাকে মনে হয় উদ্ভিদের ফসিল। কিছু পাথরখণ্ডের ভারসাম্য অবাক করার মত। প্রচুর গাছপালা রয়েছে গোটা এলাকা জুড়ে। ফরেস্টের অভ্যন্তরে একটা সুন্দর সরোবর দেখে শেষপর্বে কিছুটা পায়ে হেঁটে ঘুরলাম। প্রকৃতির হাতে তৈরি কিছু গুহা, তোরণ চোখে পড়ল হাঁটাপথে। ঘন্টাদুয়েকে কয়েকশো বর্গকিলোমিটার জুড়ে প্রকৃতিসৃষ্ট পাথরের উদ্যান দেখে চললাম স্থানীয় ফুলের বাজারে।

কুনমিংয়ের জগদ্বিখ্যাত ফুলের বাজার দেখে তাক লেগে যায়। বিশাল বিশাল বাজারে ছোটো-বড় অসংখ্য ফুলের দোকানে থরে থরে সাজানো কতধরণের ও কতরকমের যে ফুলের সজ্জা, তা দেখে শেষ করা যায় না। রংবেরংয়ের টাটকা ও শুকনো ফুলের বাহারও দেখার মত। ফুলের বীজ, চারা সবই পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। চিনের ফুল রপ্তানির ৭০ শতাংশ কুনমিংয়ের দখলে। পুব থেকে পশ্চিম - পৃথিবীর সর্বত্র কুনমিংয়ের ফুলের সমাদর রয়েছে। এখানকার পথে-ঘাটে, দোকান-বাজারে সর্বত্র ফুলের প্রাচুর্য এর সত্যতা প্রমাণ করে।
বিকেলের গন্তব্য কুনমিংয়ের আরেক দ্রষ্টব্য বিশ্ব কৃষি-পুষ্প প্রদর্শনী উদ্যান। টিনার সাহায্যে ট্যাক্সি ধরে ১৬ ইউয়ানের বিনিময়ে পৌঁছে গেলাম উদ্যানে। ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দে এখানে বিশ্ব কৃষি- পুষ্প মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাগানে আড়াই হাজারের বেশি প্রজাতির ২০ লক্ষাধিক ফুলের চারা, ফুল-ফলের গাছ ও অন্য নানা ধরনের গাছ রয়েছে যার ১১২টি বিরল প্রজাতির। ১০০ ইউয়ানের টিকিট কেটে প্রবেশ করতেই অভ্যর্থনা জানাল ফুলে ভরা এক সুবিশাল সাইকা বৃক্ষ। হাজার হাজার পুষ্প চারা সাজিয়ে গড়া কয়েক মিটার ব্যাসের সচল পুষ্প ঘড়িটি বাগানের এক আকর্ষণ। লক্ষ লক্ষ পুষ্প চারা দিয়ে তৈরি একাধিক কেয়ারী রয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে। চিন তথা বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার বৃক্ষ প্রদর্শনের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক অঞ্চল। গ্রীনহাউসে চোখধাঁধানো কয়েকশো প্রজাতির পাতাবাহার, ক্যাকটাস আর অর্কিড ছাড়াও রয়েছে প্রদর্শনীকক্ষ। বাগানের নানাস্থানে বেঞ্চিতে বিশ্রাম বা গল্পে রত অনেকে। একপ্রান্তে লেকের কাছাকাছি ড্রাগনাকৃতি গাছ আর সবজি বিভাগে অদ্ভুত ও বিশাল আকৃতির লাউ-কুমড়োও নজর কাড়ে দর্শকের।
বাগান থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরতে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হল। হোটেলের ইংরেজি কার্ড কোনো চালক পড়তে পারছেনা আর চালক যা বলছে আমার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পনের মিনিটে সাতটা ট্যাক্সি এল আর চলে গেল, ক্রমশঃ অধীর হয়ে পড়ছি। এমন সময়ে বিপদতারণ হয়ে দেখা দিলেন এক প্রবাসী ভারতীয়। ১০ বছর কুনমিংবাসী মিশ্রজি হোটেলের কার্ড পড়ে এক ট্যাক্সিচালককে ডেকে বুঝিয়ে বলায় সে আমাদের নিয়ে চলল হোটেল অভিমুখে। তবে বিভ্রাটের এখানেই শেষ নয়। রাস্তা জ্যাম থাকায় ঘুরপথে চলল ট্যাক্সি। প্রায় দ্বিগুণ পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম হোটেলে। এবার ভাড়া নিয়ে বিভ্রান্তি। চালকের কথা আমি বুঝিনা, আমার কথা চালক বোঝেনা। পাঁচ-সাত মিনিট পর ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ঢুকলাম হোটেলে। ভাগ্যক্রমে টিনা তখন রিসেপশনে বসেছিল। তাকে ডেকে নিয়ে বাইরে ট্যাক্সির কাছে হাজির হলাম। টিনার মধ্যস্থতায় ভাড়া মিটিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ইংরেজি-অচল চিনে বহিরাগতদের কী বিড়ম্বনা হতে পারে, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম সেদিন!

পরদিন সকাল আটটায় বিমানে চেপে কুনমিং ছাড়লাম। এগারটায় সুবিশাল ঝকঝকে সাংহাই বিমানবন্দরে পৌঁছে স্থানীয় গাইড জুডির সঙ্গে সরাসরি হোটেলে চেক-ইন। দুপুরে ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ভালই খেলাম। খাওয়ার পর ঘন্টা দুয়েক ধরে চলল স্থানীয় বাজারে কেনাকাটা পর্ব। বিকেলে হুয়াংপো নদীর পাড়ে পৌঁছে দেখি দেশবিদেশের প্রচুর মানুষ বায়ুসেবনে রত। কিছুক্ষণ তাদের পাশাপাশি পায়চারি করার ফাঁকে রাতের ক্রুজের টিকিট কেনা হল। আটটা থেকে ন'টা তিনতলা লঞ্চে চেপে রাতের সাংহাই দেখব আমরা। সার দিয়ে লঞ্চ জেটি। নয় নম্বর জেটি থেকে লঞ্চে উঠে দুপাড়ে চোখ ফেরালাম। দুদিকেই গগনচুম্বী অট্টালিকা, হোটেল, শপিং মল - সবই আলোকোদ্ভাসিত। আলাদাভাবে নজর কাড়ছিল ৪৬৮ মিটার উঁচু ওরিয়েন্টাল পার্ল টিভি টাওয়ার আর ৪২০ মিটার উঁচু জিনমাও টাওয়ার। নদীর দুপাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে, বসে উপভোগ করছিল শহরের আলোকসজ্জা ও চলমান সুসজ্জিত লঞ্চের আরোহীদের উচ্ছ্বাস। বৈভবের ছটায় ভরা লক্ষ লক্ষ ওয়াটের আলো শুধু সাংহাইয়ের নয়, গোটা চিনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিজ্ঞাপন। ক্রুজ সেরে ভারতীয় রেস্তোরাঁয় সুন্দর নৈশাহারের পর ফিরলাম হোটেলে।

সকালে হোটেলের জানালা দিয়ে চাইতে হুয়াংপো নদীর ওপর চওড়া সুফি সেতু চোখে পড়ল। সাতসকালে তার ওপর দিয়ে চলেছে হাজার হাজার গাড়ি। সাংহাইয়ের জনসংখ্যা এক কোটি সত্তর লক্ষ। বাস, ট্যাক্সি, মেট্রোরেল আর সাইকেল মুখ্য যানবাহন। সাড়ে আটটায় চললাম ৯০ কিলোমিটার দূরের উদ্যাননগরী সুঝৌ। পথের দুপাশে নতুন বসতি, চাষের জমি আর অনেক ছোটোবড় কারখানা। নির্মীয়মান বহুতল আর কারখানার সংখ্যাও কম নয়। তিনতলা-চারতলা রাস্তাও চোখে পড়ল কয়েক জায়গায়। চিনে ইংরেজির চলন না থাকায় ভাঙ্গাভাঙ্গা ইংরেজিতে এলাকার বর্ণনা দিচ্ছিল জুডি। সুবিশাল চিনদেশে বহু ভাষা চালু থাকলেও ম্যান্ডারিন এদেশের প্রধান ভাষা। দশটায় পৌঁছলাম পুরনো নগরী সুঝৌ। বেশকিছু প্রাচীন সুসজ্জিত বাগানবাড়ি রয়েছে এখানে। তার মধ্যে লায়ন গ্রোভ এবং মাস্টার অব নেটস - এই দুটো দেখলাম আমরা। কয়েক একরজোড়া বাগানবাড়িগুলোয় নকশাদার কাঠের বাড়িঘর, বাগান আর ছোট জলাশয় রয়েছে। অলঙ্কৃত কাঠের ঘরের পুরনো আসবাব ছাড়াও বাগানের কিছু মূর্তি, কৃত্রিম পাহাড়, জলাশয়ের শালুক ও রঙিন মাছ দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেখা সেরে পশ্চিমি রেস্তোরাঁয় আহার করে বাসে চাপলাম।
সুঝৌ দেখে সাংহাই ফেরার পথে সিল্ক কারখানা পড়ল। সেখানে গুটি থেকে রেশম ও বস্ত্র তৈরির খুঁটিনাটি দেখাল কারখানার কর্মীরা। সামনের কাউন্টারে বিক্রি হচ্ছিল সিল্কের থান, চাদর, লেপ ও আরো অনেক কিছু। তবে লেপের ন্যূণতম দাম ১৫,০০০ টাকা শুনে কেবল দেখার আনন্দটুকু পাথেয় করে ফিরতে হল।
সাংহাই ফিরে সোজা উঠলাম লংইয়াংলু মেট্রো স্টেশনের ওপরে। এখান থেকে পুডং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ম্যাগলেভ (ম্যাগনেটিক এলিভেটেড) ট্রেন যায় যার সর্বাধিক গতি ঘন্টায় ৪৩০ কিলোমিটার। দুপুরে এটি সর্বোচ্চ গতিতে চললেও অন্যসময় এটির গতিবেগ ৩০০ কিলোমিটারের আশেপাশে রাখা হয়। পাঁচ মিনিটেই ট্রেন ঢুকল প্ল্যাটফর্মে। ট্রেনে দুটি ভিআইপি আর চারটি ইকনমি কোচ। ফিরতি টিকিট আগেই কাটা ছিল, ট্রেনের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলতে চেপে বসলাম ইকনমি কোচে। কোচের অর্ধেক সিট খালি। গোটা ট্রেনটা বাতানুকূল করা। ভিআইপি কোচে মাত্র দুজনকে উঠতে দেখলাম। কয়েক মিনিটেই ট্রেন ছাড়ল। কামরার সিলিংয়ের নীচে ডিসপ্লে বোর্ড গাড়ির গতি দেখাচ্ছে। দুমিনিটের মাথায় গাড়ির সর্বোচ্চ গতি দাঁড়াল ঘন্টায় ৩০১ কিলোমিটার। এই দুরন্ত গতিতেও কোনো ঝাঁকুনি নেই, চোখ বন্ধ করলে বোঝার উপায় নেই ট্রেন চলছে। প্রচণ্ড চৌম্বকশক্তি গোটা ট্রেনটিকে লাইন থেকে সামান্য উঁচুতে রেখে কার্যত উড়িয়ে নিয়ে যায়, তাই এর গতি এত মসৃণ। দুপাশে বসতি, ক্ষেত, কলকারখানা পেরিয়ে ৩০ কিলোমিটার দূরের পুডং পৌঁছলাম মাত্র সাত মিনিটে। প্ল্যাটফর্মে মিনিট তিন-চার ঘুরে ওই ট্রেনেই ফিরলাম লংইয়াংলু। আটটায় নৈশাহার পর্বশেষে ন'টায় বাস পৌঁছে দিল হোটেলে। এখানকার অ্যাকোয়ারিয়ামটি জগদ্বিখ্যাত, ভেবেছিলাম সফরসূচীর ফাঁকে সময় বের করে ওটি দেখে নেব। গাইড জানাল সেটা মোটেই সম্ভব নয়, অগত্যা সে আশা ত্যাগ করতে হল।
পরদিন সকালে চললাম জেড বুদ্ধের মঠ দেখতে। ভিড়ে ঠাসা নানজিং রোড দিয়ে বাস চলেছে। এটি সাংহাইয়ের অন্যতম বাজার এলাকা, বিত্তবান পর্যটকেরা বেশিরভাগ এখানেই থাকে। তবে যাবার পথে হাইওয়ের দুধারে বহুতলের পাশাপাশি বৈপরীত্যের নিদর্শনস্বরূপ প্রচুর টালির বাড়ি চোখে পড়ল। আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মঠে। পতাকা, থাঙ্কা দিয়ে সাজানো মঠে ভিন্ন ভঙ্গিমার দুটি অপূর্ব সুন্দর জেড পাথরের বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। ফুলফল আর অন্যান্য গাছে ভরা বাগান রয়েছে মঠ ঘিরে। বাগানের মূল আকর্ষণ অবশ্য বেশকিছু সুপরিকল্পিত বনসাই যা দেখে তাক লেগে যায়।

এদিনের দ্বিপ্রাহরিক আহার ভারতীয় রেস্তোরাঁ শিবা-য়। চিনে অধিকাংশ ভারতীয় রেস্তোরাঁর রান্না ভারতীয় ঘরানার আর বেশ সুস্বাদু। সেখানে ভারতীয় পোষাকপরা চিনা ছেলেমেয়েদের সাথে দুচারজন ভারতীয় কর্মীও রয়েছে। এগুলির অধিকাংশেরই মালিক প্রবাসী উত্তর বা পশ্চিম ভারতীয়রা।
আহারান্তে প্যাকেটজাত নৈশাহার নিয়ে পৌঁছলাম সাংহাই রেলস্টেশন, গন্তব্য শিআন। সুন্দর, সুবিশাল স্টেশনে তিনটি প্রবেশপথ চোখে পড়ল। মেটাল ডিটেক্টর পেরিয়ে যাবতীয় লাগেজ স্ক্যান মেশিনে দেওয়া হল। প্রতি গেটে পাঁচটি করে স্ক্যান মেশিন রয়েছে। স্টেশনের ভিতরে নিরাপত্তাকর্মীরা সদাসতর্ক। পরীক্ষাপর্ব মিটিয়ে চললাম ৯/১০ নম্বর লাউঞ্জের উদ্দেশ্যে যার লাগোয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে আমাদের ট্রেন ১৫টা ৫৩য় ছাড়বে। সেখানে পৌঁছে দেখি গিজগিজ করছে লোক, তবে বসার জায়গাও রয়েছে প্রচুর। খাদ্য-পানীয় আর মনোহারি দ্রব্যের কিছু দোকান রয়েছে লাউঞ্জে। একটু পরে আমাদের টি-১৩৮ নম্বর ট্রেনের খবর হল। ডিসপ্লে বোর্ডে চিনা ভাষার মাঝে মাঝে ইংরেজিতে ট্রেনের বিবরণ দেওয়া হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের গেট খুলবে ট্রেন ছাড়ার আধঘন্টা আগে। সঠিক সময়ে গেট খুলতেই টিকিট দেখিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা রাখলাম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সামনেই আমাদের ৬ নম্বর কোচ। প্ল্যাটফর্ম ও ট্রেনের মধ্যে সংযোগকারী স্টিলের পাত বেয়ে ট্রেনে পা রাখলাম। কোচে বাইশটি ক্যুপেতে তিনটি করে মোট ছেষট্টিটি বার্থ রয়েছে। সাইড বার্থ নেই, বদলে প্রতি ক্যুপের সামনে জানালা ঘেঁষে দুটি করে ফোল্ডিং সিট রয়েছে বহির্দৃশ্য উপভোগের জন্য। ট্রেন ছাড়তেই অ্যাটেন্ডেন্ট দরজা লক করে দিল। পরবর্তী স্টেশনগুলিতে সেই প্রয়োজনমত দরজা খুলবে বা বন্ধ করবে। ষোল ঘন্টার পথ। জানালায় চোখ রেখে দেখছি মাঠ, গ্রাম, নগর কলকারখানা পেরিয়ে চলেছি একে একে। সন্ধ্যায় শুনলাম রাত দশটায় আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে। তাই ন'টার মধ্যে খাওয়া সেরে নিলাম। আলো নিভতে শুয়ে পড়লাম বটে, তবে নীচের বার্থে চন্দনদার নাক ডাকায় নিদ্রাদেবী এলেন অনেক দেরিতে।
ঘুম ভাঙতে মুখ ধুয়ে ট্রেনের গরম জলে চা তৈরি করে খেলাম। একটু পরেই হকারের আনাগোনা শুরু হল। ইউনিফর্ম পরা হকারের পণ্যতালিকায় মনোহারী দ্রব্য, খাবার, খেলনা ছাড়াও অনেক কিছু রয়েছে। মাঝেমাঝে রেলের সাফাইকর্মী মেঝে ঝাঁট দিয়ে যাচ্ছে। মাঝরাতে এরকমই এক কর্মী গ্লাভস পরে আমাদের জুতোগুলো গুছিয়ে রাখছিল। অনুর সেই সময় আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। ও আমাকে সাবধানে জাগিয়ে লোকটিকে জুতোচোর ভেবে নীচের দিকে ইশারা করে। আমি নিঃশব্দে নীচে তাকিয়ে থাকি। লোকটি সবার জুতো গুছিয়ে দরজা টেনে দিয়ে চলে যাওয়ার পর আমরা আর হাসি চাপতে পারিনি। ঘন্টা দেড়েক লেট করে সাড়ে ন'টায় ট্রেন পৌঁছল শিআন। বেশ বড়সড় স্টেশন হলেও পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে। গাইড মাইকেল (পরিবর্তিত নাম)-এর সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে দেখা হল। পার্কিং এলাকা এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে। রিক্সাভ্যানে মাল চাপিয়ে মাইকেলের সাথে শহরের প্রাচীন দেওয়াল বরাবর এটুকু পথ হেঁটে বাসে উঠলাম। স্টেশন এলাকার বাইরে অবশ্য শহরটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
শিআন কথাটির অর্থ পশ্চিমের শান্তি। শহরের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষ। এখানের দ্রষ্টব্য হিউয়েন সাংয়ের স্মৃতিধন্য বিগ ওয়াইল্ড গুজ প্যাগোডা। দণ্ডায়মান হিউয়েন সাংয়ের মূর্তি ছাড়িয়ে প্রবেশপথ। বিশাল চত্বরের মধ্যে সুসজ্জিত নবনির্মিত মঠে বুদ্ধ ছাড়াও বেশকিছু অন্যান্য মূর্তি রয়েছে। পাথর ও কাঠে খোদাই করে হিউয়েন সাংয়ের জীবনগাথা প্রদর্শিত হয়েছে একটি কক্ষে। প্রাঙ্গনজুড়ে প্রচুর ফুল ও ফলের গাছ বসানো। কয়েকস্থানে দর্শকদের বিশ্রামের জন্য বেঞ্চি তৈরি করা। অনেকে সেখানে গল্প বা আলোচনায় ব্যস্ত। বহু গাছ ছেঁটে নানা আকৃতিতে গড়া। নতুন মঠের পিছনে রয়েছে ৬৫২ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত মিনারাকৃতি সাততলা মূল প্যাগোডা। বহুবছর এই প্যাগোডায় অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেছেন হিউয়েন সাং। এখানেই রক্ষিত আছে তাঁর স্বহস্তে লিখিত ও সংগৃহীত নানা পুঁথি আর ত্রিপিটকের লিপি। আপাততঃ বন্ধ থাকায় সেই অমূল্য সম্পদ অদেখাই রয়ে গেল। মঠ দেখে লাঞ্চ সারতে চারটে বাজল। দলের কয়েকজন তাং নাচ দেখতে চাওয়ায় তাদের অনুষ্ঠানস্থলে নামিয়ে হোটেলে পৌঁছলাম ছ'টা নাগাদ। হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে কাছাকাছি রাতের ব্যস্ত শিআনের পথে ঘুরে এলাম ঘন্টাখানেক। ন'টায় নৈশাহার সেরে ঘুম।
চিনা হোটেলগুলির আতিথেয়তা সত্যিই প্রশংসনীয়। সাড়ে আটটায় প্রাতরাশ সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। বৃষ্টি পড়ছে বলে ছাতা, জ্যাকেট সঙ্গে নিতে হল। দশটার পর বাস নিয়ে চলল শিআন-এর প্রাচীন নগরপ্রাচীর দর্শনে। শহরকে সুরক্ষিত রাখতে তাং রাজারা (শাসনকাল ৬১৮-৯০৭ খৃষ্টাব্দ) প্রায় একশ বছর ধরে এই প্রাচীরবলয় নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে মিং রাজত্বে (শাসনকাল ১৩৬৮-১৬৪৪ খৃষ্টাব্দ) একে আরো সুদৃঢ় করে গড়ে তোলা হয়। ১২ মিটার উঁচু প্রাচীরের ভিত ১৫ থেকে ১৮ মিটার চওড়া। প্রাচীরশীর্ষ ১২ থেকে ১৪ মিটার চওড়া। প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরে ১২০ মিটার অন্তর আটানব্বইটি কারুকার্যশোভিত সুবিশাল কক্ষ রয়েছে রক্ষীদের জন্য। কথিত আছে নির্মাণকালে প্রাচীরের দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে তীর নিক্ষেপ করা হত প্রাচীরে। তীর বিদ্ধ হলে সেই অংশ ভেঙে নতুন করে গাঁথা হত। গোটা প্রাচীরে চারটি তোরণদ্বার রয়েছে - পূবে চাংলে (অর্থাৎ পরমানন্দ), পশ্চিমে আনদিং (সম্প্রীতি ও শান্তি), দক্ষিণে ইয়ংনিং (চিরশান্তি) আর উত্তরে আনয়ুআন (চিরসম্প্রীতি)। প্রাচীরের ওপরে স্থানে স্থানে পুরনো ঘন্টা, কামান, আসবাব ইত্যাদি সাজানো রয়েছে। স্থানীয় ও বিদেশি বহু মানুষ প্রাচীরের ওপরে ভ্রমণরত। ইদানীং প্রাচীরের ওপর প্রতিবছর সাইকেল রেস, দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীরের গা ঘেঁষে মাঝে মাঝে পার্ক রয়েছে অবসর ও বিনোদনের জন্য। ছোট থেকে বড় নানা বয়সের মানুষ ভিড় জমিয়েছে সেগুলিতে।
প্রাচীরদর্শন সেরে চললাম টেরাকোটা মিউজিয়াম। পথে এক ওয়ার্কশপে টেরাকোটা মূর্তির ইতিবৃত্ত জানা গেল। উত্তর চিনের এক আগ্নেয়গিরির বিশেষ মাটি মূর্তি নির্মানে ব্যবহৃত হত। আজও সেই একই মাটি দিয়ে শিল্পীরা টেরাকোটা মূর্তি গড়েন। বিভিন্ন ধরণের মূর্তির মধ্যে প্রাচীন চিনা রক্ষীদের মূর্তি সর্বাধিক জনপ্রিয়। তবে দুষ্প্রাপ্য মাটি আর জটিল নির্মাণশৈলীর কারণে মূর্তির দাম সাধারণের সাধ্যাতীত।
ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত শিআন-এর পুরাকীর্তি টেরাকোটা মিউজিয়ামের পুরোটাই মাটির নীচে অবস্থিত। বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে পাঁচটি পিট যার মধ্যে তিনটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। তিনটির মধ্যে প্রথম পিটে খননকার্য শেষ হয়েছে। এখানে প্রাপ্ত হাজারখানেক সশস্ত্র রক্ষী ও অশ্বের অবস্থা বেশ ভাল, সেগুলি অনেকটা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে যদিও অধিকাংশ অস্ত্র কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বেশকিছু রক্ষী ও অশ্বের মূর্তি নীচ থেকে ভূপৃষ্ঠে তুলে রাখা। পিট এলাকাটি রেলিং দিয়ে ঘেরা। রেলিং ঘিরে দেশিবিদেশি কয়েকহাজার মানুষের ভিড়। মূর্তিগুলি দেখার পাশাপাশি ছবি তুলতে ব্যস্ত প্রায় সকলে। প্রায় ২২০০ বছর ধরে মাটির নীচে পাড়ে থাকা মূর্তিগুলির শিল্পশৈলী দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হতে হয়। প্রায় আধঘন্টা চোখভরে দেখে আর কিছু মূর্তি লেন্সবন্দী করে চললাম দ্বিতীয় ও তৃতীয় পিটের উদ্দেশ্যে। এদুটি পিটে আস্ত মূর্তি কম থাকলেও অসংখ্য ভাঙা মূর্তি রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
পুরাতত্ত্বে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা খননের পাশাপাশি প্রাপ্ত ভাঙা মূর্তিগুলি মেরামতে ব্যস্ত। তবে পোষাকের আভিজাত্যে এই দুই পিটের রক্ষীরা প্রথম পিটের রক্ষীদের তুলনায় উচ্চতর পদমর্যাদার বলে মনে হয়। তিনটে পিট ঘোরার পর মনে হল এক মহাযঞ্চ চলেছে সমগ্র এলাকাজুড়ে। ১৯৭৬-এ জনৈক স্থানীয় চাষী এর সন্ধান পান আর সঙ্গে সঙ্গে খনন শুরু করে চিনের পুরাকীর্তি বিভাগ। তিন বছর পর ১৯৭৯-তে এটি সর্বপ্রথম জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পাশের সংগ্রহশালায় খননে প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, পশুপক্ষী আর তৈজসপত্রের বিপুল সম্ভারও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক।
মিউজিয়ামের ভূগর্ভে দণ্ডায়মান হাজার হাজার রক্ষী আর অশ্বের মূর্তিগুলির একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দেখে বিস্ময়ের সীমা থাকেনা। কোনও মূর্তির সাথে অন্য কোনও মূর্তির হুবহু মিল নেই, প্রতিটি মূর্তির চেহারা অনন্য। কথিত আছে সম্রাট কিন শি হুয়াং (শাসনকাল ২২১ থেকে ২০৭ খৃষ্টপূর্বাব্দ)-এর ইচ্ছা ছিল তাঁর মৃত্যুর পর ৮০০০ দেহরক্ষী তাঁর মরদেহ পাহারা দেবে। এজন্য তাঁর জীবদ্দশায় রক্ষীবাহিনীর প্রত্যেকের সশস্ত্র মূর্তি তৈরি করা হয় অশ্বাদিসহ। সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁর দেহ ঘিরে অস্ত্রবাহনসহ রক্ষীদের মূর্তি দাঁড় করিয়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ভূগর্ভে সদৃঢ় ভিত আর পার্টিশন দেওয়াল গড়া হয়েছিল মূর্তিগুলি সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে।
অবিস্ময়রণীয় এই কীর্তি দুঘন্টার বেশি সময় ধরে ঘুরে দেখেও যেন আশ মিটলনা। বাইরে জমজমাট দোকানপাট দেখে মনে হচ্ছে মেলা বসেছে মিউজিয়ামের প্রবেশচত্ত্বরে। প্রচুর দেশিবিদেশি পর্যটক ঘুরছে এলাকাজুড়ে। রংবেরংয়ের নানান আকৃতির সুন্দর সুন্দর চিনা ঘুড়ি উড়ছে আকাশে, তার দর্শকও কম নয়। সবুজ ময়দানে চিনা ঘুড়িবাজদের এক একজনের লাটাই থেকে দশ-পনেরটা ঘুড়ি উড়ছে একই সূতোয়।
টেরাকোটা মিউজিয়াম দেখে বাসে চেপে চললাম শিআন রেলস্টেশনের দিকে। গন্তব্য বেজিং। পথে ডিনার প্যাক সংগ্রহ করে নেওয়া হল। ছ'টা নাগাদ স্টেশনে পৌঁছে টিকিট দেখিয়ে লাগেজ স্ক্যান করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমাদের জেড-২০ নম্বর ট্রেন রাত ৮টা ১৬-য় ছাড়বে। প্রথমদিকে বেজিংয়ের ট্রেনের লাউঞ্জ ফাঁকা থাকলেও পরে ভিড় বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল। শয়ে শয়ে লোক দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষায়। ট্রেন ছাড়ার আধঘন্টা আগে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের গেট খুলতে বানের জলের মতো যাত্রীকুল আছড়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। ভিড় কমতে আমরাও প্ল্যাটফর্মে ঢুকে ধীরেসুস্থে নির্দিষ্ট কোচে চেপে বসলাম। এই ট্রেনটি শিআন থেকে সরাসরি বেজিং যাবে এগার ঘন্টায়। আমাদের কোচে বারোটা ক্যুপ, প্রতি ক্যুপে মুখোমুখি দুটো করে চারটে বার্থ। ক্যুপে বেসিনের গায়ে তোয়ালে-সাবান-শ্যাম্পু-ব্রাশ-পেস্ট সব মজুত রয়েছে। সুন্দর সাজানো ক্যুপ বেশ ভাল লাগল।

সকাল সাতটা কুড়িতে বেজিং পৌঁছল ট্রেন। গাইড হ্যারি প্ল্যাটফর্মে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে হাজির। বাস অপেক্ষা করছিল স্টেশনের বাইরে। মালপত্র নিয়ে বাসে উঠতেই হ্যারি আমাদের নিয়ে চলল বিশ্বের বৃহত্তম স্কোয়ার তিয়ানআনমেন-এর দিকে। সাড়ে আটটায় সেখানে পৌঁছে দেখি ইতিমধ্যেই নানান দেশের হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছেন স্কোয়ার চত্ত্বরে। ছোটবড় নানা দলে বিভক্ত হয়ে ঘুরছে সবাই। ভিড় ঠেলে এগোলাম মাও সে তুং-এর সমাধিসৌধের কাছে। হতাশ হলাম সৌধের দ্বার বন্ধ দেখে। সচরাচর সপ্তাহে দুদিন খোলা হয় এটি, তাও পূর্বনির্দিষ্ট নয় দিনগুলি। এত কাছে এসেও মাওয়ের সমাধি দেখতে না পেয়ে ভীষণ খারাপ লাগল। অগত্যা চিনের সংসদ ভবন গ্রেট হল অফ দি পিপল আর সুউচ্চ বেলেপাথরের শহীদস্মারক পেরিয়ে চললাম এখানকার বড় আকর্ষণ নিষিদ্ধনগরীর পানে। বিশাল স্কোয়ারে প্রচুর ফুলের কেয়ারি এলাকার সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চিনের পথেঘাটে সর্বত্র দেখছি ফুলের গাছ, ফুলের কেয়ারি। এত পুষ্পপ্রেম আর কোথাও চোখে পড়েনি।
সুন্দর সুবিশাল স্কোয়ারে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে হাজির হলাম নিষিদ্ধনগরীর দোরগোড়ায়। টিকিট আগেই কাটা ছিল। দুপাশে ফুলের বাগান আর ঝরনার মাঝখান দিয়ে নিষিদ্ধনগরীর এদিকের প্রবেশপথ তিয়ান-আন-মেন গেট। গেটের মাথায় শোভা পাচ্ছে মাও সে তুং-এর বহুবর্ণ চিত্র। দ্বার পেরিয়ে প্রবেশ করলাম নগরীর অভ্যন্তরে। মিং রাজাদের আমলে ১৪২০ খ্রীষ্টাব্দে এই নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়। জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় পরবর্তীকালে এই প্রাসাদনগরীর নাম হয়ে ওঠে নিষিদ্ধনগরী। ১৫৭০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজার শাসনকেন্দ্র ছিল এখানে। প্রশস্ত পরিখা ও সুউচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত নগরীর প্রথম পর্যায়ে রয়েছে বহির্প্রাঙ্গণ। এর পর পর্যায়ক্রমে রয়েছে রাজকর্মচারীদের আবাসন, রাজার মন্ত্রণাগৃহ আর একেবারে অভ্যন্তরে রাজার বাসগৃহ। প্রতিটি পর্যায়ে প্রবেশের জন্য রয়েছে উঁচু প্রাচীরের মাঝে নির্মিত সুদৃঢ় প্রবেশদ্বার। প্রতিটি দ্বারের আলাদা নাম রয়েছে - যেমন মেরিডিয়ান গেট, গেট অফ ডিভাইন মাইট ইত্যাদি। প্রাসাদের প্রধান কক্ষ আর বিশ্রামগৃহগুলিরও পৃথক পৃথক নাম রয়েছে - যেমন হল অফ সুপ্রিম হারমনি, ঝোংগে হল, হল অফ প্রিজারভিং হারমনি, প্যাভিলিয়ন অফ টেন থাউজ্যান্ড স্প্রিং, প্যাভিলিয়ন অফ ফ্লোটিং গ্রিন ইত্যাদি। সাত লক্ষ বর্গমিটারের অধিক এলাকাজোড়া নগরীতে সেকালে রাজপরিবার, রক্ষী ছাড়াও মন্ত্রী - সভাসদ - রাজকর্মচারীসহ কয়েক হাজার মানুষের বাস ছিল। প্রতিটি বাসগৃহ, সভাকক্ষ ও বিশ্রামাগার অপূর্ব নির্মাণশৈলী ও শিল্পকলায় সমৃদ্ধ। প্যাগোডাকৃতি ছাদগুলির কোনোটা দোচালা, কোনোটা চারচালা। বেশকিছু প্রাচীন আসবাব ও তৈজসপত্র সংরক্ষিত হয়েছে বিভিন্ন কক্ষে ও প্রাসাদের প্রাঙ্গণজুড়ে। মিং রাজাদের এই বিস্ময়কর কীর্তি তার বিশালত্ব আর অতুলনীয় গঠনশৈলীর জন্য ঠাঁই পেয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব পুরাকীর্তির তালিকায়।

ঘন্টাতিনেক ধরে নিষিদ্ধনগরী দেখার পর বাস পৌঁছে দিল হোটেলে। স্নানান্তে আজকের লাঞ্চ চিনা রেস্তোরাঁয়। ফলের রস, চাউমিন আর ফিশফ্রাই মিলিয়ে মন্দ খেলাম না। লাঞ্চের পর রওনা হলাম চিনা রাজাদের গ্রীষ্মাবাস সামার প্যালেস দেখতে। দুপাশে পাহাড়ঘেরা লেকের পাড়ে অবস্থিত সামার প্যালেসের নির্মাণকাজ ১৭৫০ খৃষ্টাব্দে সম্পূর্ণ হয়। চিং রাজাদের আমলে এটি প্রমোদকানন হিসাবে তৈরি হলেও পরবর্তীকালে একে চিনা রাজাদের গ্রীষ্মাবাসে পরিণত করা হয়। বিগত দুশতকের মধ্যে প্রাসাদটি দুবার ধ্বংস হলেও দুবারই প্রাসাদ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। বিশাল দরজা পেরিয়ে প্রাসাদে ঢুকতেই এক বিরাট আকারের একটি ব্রোঞ্জের পাত্র চোখে পড়ল। এটি ধূপদানি হিসাবে ব্যবহৃত হত সেকালে। এরপর ড্রাগন ও ফিনিক্সের মূর্তিখচিত হলঘর পেরিয়ে এলাম প্রাসাদ লাগোয়া লেকের পাড়ে। প্রাসাদের কিছু সাজানো কক্ষ দর্শকের নজর কাড়ে। লেকে নৌকায় চেপে ঘুরছে অনেক পর্যটক আর পাড়ঘেঁষা পদ্মবনে ভাসছে প্রচুর পদ্মের পাতা ও চাক।
সন্ধ্যায় গেলাম চায়না ন্যাশনাল অ্যাক্রোবেটিক ট্রুপ-এর সুবিখ্যাত চিনা অ্যাক্রোবেটিক শো দেখতে। সওয়া সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলল সাবলীল অথচ উত্তেজনাপূর্ণ ও রোমহর্ষক নানা ধরণের ব্যালান্সিংসহ ছন্দোবদ্ধ ক্রীড়াপ্রদর্শনী। কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীর সমন্বয়ে গঠিত দলের প্রতিটি সদস্যের উপস্থাপনা ছিল দমবন্ধ করে দেখার মতো।
পরদিন সকালে চিনের মহাপ্রাচীর (চিনা ভাষায় চ্যাং চেং) যাওয়ার পথে পড়ল জেড মিউজিয়াম। এটি জেড পাথরের শিল্পকীর্তির এক প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র। ধূসর ও সবুজবর্ণের জেড পাথরের মূর্তি, পশুপাখী, অলঙ্কার সবই অপূর্ব। দামও মানানসইরকম আকাশছোঁয়া। তাই সংগ্রহের বদলে স্মৃতি হিসাবে লেন্সবন্দী করে রাখলাম কিছু শিল্পকীর্তি। পুনরায় বাসে চেপে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম চিনের মহাপ্রাচীর - এর দুয়ারে পৌঁছলাম পৌনে এগারটায়। চলমান বাস থেকে দেখা আবছা মহাপ্রাচীরের মহিমান্বিত রূপ ধরা পড়ল বাস থেকে নামতেই। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম দুপাশে বিস্তৃত সুউচ্চ প্রাচীরের দিকে। ঘোর কাটল গাইডের ডাকে। ফুলগাছে সাজানো চত্ত্বরের ওপারে পাথরের খিলানাকৃতি দ্বার ডিঙিয়ে এগোলাম প্রাচীরপানে।
প্রথমে হুন ও পরে মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করতে বিভিন্ন চীনসম্রাট রাজ্যের উত্তরে পাথর, ইঁট ও মাটি দিয়ে একাধিক দীর্ঘ প্রাচীর তৈরি করেন। তাদের মধ্যে চিনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং সর্বপ্রথম ২১৪ খৃস্টপূর্বাব্দে রাজ্যের উত্তর সীমান্ত বরাবর এই প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেন। প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীর তৈরিতে লেগে যায় কয়েক দশক। পরবর্তীকালে হান এবং তারও পরে মিং রাজত্বকালে এর দক্ষিণে নতুন করে পৃথক পৃথক মহাপ্রাচীর গড়ে তোলা হয়। আজকের মহাপ্রাচীরটি মিং রাজত্বে নির্মিত এবং পূব-পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৩০০ কিলোমিটার। প্রাচীরে প্রায় ২৫০০০ পর্যবেক্ষণচৌকি রয়েছে। প্রাচীরের গড় উচ্চতা ৮ মিটার আর প্রস্থ প্রায় ৫ মিটার আর এর ওপরে দুপাশে সুরক্ষাপ্রাচীর গড়া। বিভিন্ন রাজার আমলে প্রাচীর নির্মাণ চলেছে সুদীর্ঘকাল ধরে আর নির্মাণকালে প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক যা মহাপ্রাচীরের গরিমাকে অনেকটা ম্লান করেছে।
মহাপ্রাচীরে ওঠার জন্য অনেক স্থানে সিঁড়ি রয়েছে। আমরা এসেছি সেরকম একটা জায়গা জুয়ংগুয়ান পাস। এখানে ডান ও বাম দুদিকেই সিঁড়ি উঠে গেছে প্রাচীরের শীর্ষ পর্যন্ত। বামদিকের সিঁড়ি বেশি খাড়া হওয়ায় ডাইনের সিঁড়ি ধরলাম। বয়সের কারণে গুটিগুটি পায়ে উঠছি আমি আর অনু। লক্ষ্য চূড়ায় অবস্থিত প্রহরীকক্ষে পৌঁছনো। সিঁড়ির দুপাশের লোহার রেলিং বা দেওয়াল ধরে উঠছি। নানা দেশের শয়েশয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা উঠছে, নামছে সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়িতে মাঝেমাঝে প্রশস্ত ল্যান্ডিং রয়েছে। অনেকে বিশ্রাম নিচ্ছে সেখানে। আমরা ল্যান্ডিং ছাড়া সিঁড়িতেও দাঁড়াচ্ছি মাঝেমধ্যে। আধঘন্টা পর নীচের দিকে তাকাতে মনে হল অর্ধেকটা উঠে এসেছি এরমধ্যে। মনে একটু বল পেলাম। আবার থেমেথেমে ওঠা। আরো মিনিট কুড়ি পর চাইলাম ওপরে। এবার মনে হল আর মাত্র সিকিভাগ বাকী। অনুকে ক্লান্ত দেখে এবার একটু লম্বা বিরতি নিলাম। এখানে এক বয়স্ক জাপানী দম্পতির সঙ্গে সহাস্য শুভেচ্ছাবিনিময় হল। শেষপর্বে ওঠার পথে কিছুটা পরপর দাঁড়াচ্ছি আমরা। অবশেষে প্রশস্ত প্রাচীরচত্ত্বরে পৌঁছে দোকানপাট ছাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম প্রাচীরের মাথায় অবস্থিত প্রহরীকক্ষের সামনে। ঘড়িতে তখন বারটা কুড়ি। অর্থাৎ এক ঘন্টার কিছু বেশি সময় লেগেছে পুরোটা উঠতে। ওপরে পৌঁছে মনটা অপার আনন্দে ভরে গেল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ক্রমে প্রহরীকক্ষের পিছনের চাতালে দাঁড়িয়ে নীচে তাকালাম। চোখে পড়ল ঝোপঝাড়, মাঠ, রেললাইন। উল্টোদিকের প্রাচীরচূড়া ঝাপসা দেখাচ্ছে এপার থেকে। প্রহরীকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে দুপাশে চোখ ফেরালাম যতদূর প্রাচীর দেখা যায়। নীচের গাড়ি, লোকজন দেখাচ্ছে পুতুলের মত। এভাবে মিনিট দশ-পনেরো কাটল প্রাচীরশীর্ষে।
ওঠার পর এবার নামা। সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ উঁচু হওয়ায় সেটাও কম কষ্টকর নয়। ভারসাম্য হারালে বা পা পিছলে গেলে শ'খানেক ফুট নীচে গড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। সাবধানে নামতে লাগলাম। নামার পথেও শুভেচ্ছাবিনিময় হল কিছু ভিনদেশি পর্যটকের সাথে। স্থানীয় সাফাইকর্মীরা সদাতৎপর সিঁড়ির পরিচ্ছন্নতা রক্ষায়। দেড়টা নাগাদ নীচে নেমে চাইলাম ওপরদিকে। আরেকবার চোখভরে দেখলাম দুপাশের মহাপ্রাচীর।
নীচের পুষ্পশোভিত প্রাঙ্গণ আর দোকানপাট ছাড়িয়ে বাসে উঠলাম। পিছনে রইল মানবজাতির অবিস্মরনীয় কীর্তি চিনের মহাপ্রাচীর। পথে ভারতীয় লাঞ্চ সেরে অলিম্পিক স্টেডিয়াম বার্ডস নেস্ট দেখে উপস্থিত হলাম ভেষজ চা-কেন্দ্রে। এখানে অতিথিদের সুসজ্জিত কক্ষে বসিয়ে নানাধরণের ভেষজ চায়ের গুণাগুণ বর্ণনার সাথে সাথে চা পান করানো হয় প্রত্যেককে। জুঁই, গোলাপ, লিচু ইত্যাদির গন্ধ ও স্বাদের চা পান করলেও কোনোটাই তেমন মনে ধরলনা। তাছাড়া দামও আকাশছোঁয়া - আট থেকে দশ হাজার টাকা প্রতি কিলো। অগত্যা চা আস্বাদন করেই এখানকার পর্ব সারা হল। রাতে ভারতীয় ডিনারের সাথে বাড়তি পাওনা ডাইনিং হলের মঞ্চে হিন্দি গানের সাথে ঘাঘরা-চোলি পরিহিত চিনা নর্তকীর ভারতীয় ফিল্মী নাচ। খাওয়া শেষের আগেই বৃষ্টি শুরু হল আর তাড়া করে চলল হোটেল পর্যন্ত।

সকালে প্রাতরাশ সেরে চললাম বেজিং চিড়িয়াখানা। হ্যারি ট্যাক্সি ডেকে আমাদের গন্তব্য বুঝিয়ে দিল চালককে। দুপাশে পুষ্পশোভিত পথবেয়ে পৌনে আটটায় পৌঁছলাম চিড়িয়াখানা। জনপ্রতি ১৫ ইউয়ানের টিকিট। ভিতরে ঢুকেই পান্ডার ঘর। এরজন্য আলাদা প্রবেশমূল্য ৫ ইউয়ান করে। দুটি ঘেরা খাঁচায় তিনটি করে ছ'টি পান্ডা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে ওপর থেকে জল স্প্রে করা হচ্ছে পান্ডার আস্তানাকে আর্দ্র ও ঠাণ্ডা রাখতে। শিশুদের অতিপ্রিয় সাদাকালো নিরীহ প্রাণীগুলির চালচলন ভারী মজার। ওদের মধ্যে খুনসুটি লেগেই আছে। বাঁশের কচি পাতা চিবাচ্ছে কেউ কেউ। চিনের পাহাড়ের বাসিন্দা এই প্রাণীদের চোরাশিকারীরা হত্যা করে ওদের সুন্দর চামড়ার লোভে যা অত্যন্ত চড়া দামে বিকোয় দেশবিদেশের চোরাবাজারে। সম্প্রতি চিনে পান্ডা ধরা, রাখা, বিক্রি বা হত্যার অপরাধে প্রাণদন্ডের বিধি চালু হয়েছে। এতে অনেকটাই কমেছে পান্ডার চোরাশিকার।
পান্ডাদর্শন সেরে চললাম অন্যান্য প্রাণী দেখতে। প্রচুর পাখি, বিভিন্ন জাতের বানর, বাঘ-সিংহ, কুমীর ছাড়াও অনেক প্রাণী রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে। একটা বড় ঝরনা আর কয়েকটি জলাশয় চোখে পড়ল। সুন্দর সাজানো চিড়িয়াখানায় রয়েছে একটি বিশাল অ্যাকোয়ারিয়াম। পথে অনেককে সেটির ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলে সকলেই দুর্বোধ্য চিনা ভাষায় কী বলল বুঝলাম না। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পৌঁছে গেলাম অ্যাকোরিয়ামে। তবে আবার সমস্যা দেখা দিল। এর প্রবেশমূল্য ১১০ ইউয়ান জনপ্রতি। অত ইউয়ান সঙ্গে না থাকায় ডলার দিয়ে টিকিট চাইলাম। কাউন্টার থেকে জবাব এল - ডলার নো, ইউয়ান। বুঝলাম ডলার দিয়ে টিকিট কাটা যাবেনা। দুঃখিত মনে ফিরে চললাম। পাথর বিছানো পরিচ্ছন্ন পথ ধরে এগোলাম পেঙ্গুইনের ঘরের খোঁজে। ভাষা সমস্যা এবারও প্রকট হয়ে দেখা দিল। যাই হোক ডিসপ্লে বোর্ড দেখে আর কিছুটা বিবেচনাশক্তি প্রয়োগ করে অবশেষে পৌঁছলাম পেঙ্গুইনের ঘরে। দুদিক কাঁচে ঘেরা প্রায় ৪০ ফুট লম্বা ৩০ ফুট চওড়া এলাকায় কৃত্রিম বরফ আর স্বচ্ছ জলে ঘুরছে, সাঁতার কাটছে পনেরো-কুড়িটা ছোট প্রজাতির সাদাকালো পেঙ্গুইন। বরফে ওদের হাঁটাচলা ভারী মজার। কাঁচের দেওয়াল থাকায় জলের নীচে ওদের ডুবসাঁতারও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আমাদের মাঝে এক খুদে দর্শক তো ওদের কান্ড দেখে লাফালাফি শুরু করে দিল। মিনিট পনেরোয় পেঙ্গুইন দেখা সাঙ্গ করে হোটেলে ফিরলাম।
লাঞ্চ সেরে ফাঁকা সময়টা কাটালাম পথপরিক্রমায়। ফুটপাথের একধারে সারসার সাইকেল দাঁড় করানো। ট্রাম,বাস, কার, ট্যাক্সি, অটো চলেছে ঝকঝকে ছয় লেনের মসৃণ রাস্তায়। তিনচাকার একটা ছোট কার পার্কিং করা রাস্তার পাশে। দোকানপাট, শপিংমলে বেশ ভিড়। অধিকাংশ মানুষ ব্যস্ত যে যার কাজে। পাশের একটা বাজারে ঢুকছি, হঠাৎ এক চিনা মহিলা অনুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর অনুর শাড়ির সামনে, পিছনে নাড়াচাড়া করতে করতে হাত-পা নেড়ে চ্যাং চুং করে কী যেন বলতে লাগল। মহিলার অঙ্গভঙ্গী দেখে মনে হল এতবড় শাড়িটা কিভাবে পরা হয়েছে সেটাই বোধহয় সে বুঝতে চাইছে। দেখেবুঝে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে সে হাঁটা দিল অন্যপথে আর আমরা বাজারে ঢুকলাম। মাঝারি আকারের বাজারে জামাকাপড়, ফল, সবজি, ঘরকন্নার জিনিসপত্র সবই বিকোচ্ছে। পরিচিত আলু-লাউ-বেগুনের সঙ্গে নানাধরণের নতুন সবজি আর ফল দেখলাম বাজারে। বেরোনোর পথে দেখি এক দোকানে বিশালকায় ধোসা বানাচ্ছে ক্রমাগত। ডিম-মাংস-সবজি আর সসের পুর দেওয়া ধোসা বিকোচ্ছে খুব। বুঝলাম এটি ধোসার চিনা সংস্করণ। ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে জ্যান্ত রুই, কাঁকড়া আর মাঝারি সাইজের চিংড়ি। তাজা চিংড়ি দেখে জিভে জল এসে যাচ্ছিল। এইসব দেখতে দেখতে ফেরার সময় হয়ে এল।
হোটেলে ফিরে লাগেজ বাসে তুলে চললাম বেজিং বিমানবন্দর। অনেক আনন্দ আর স্মৃতিকে সঙ্গী করে সেখান থেকে কুনমিং হয়ে রাতে পৌঁছলাম কলকাতা।

~ চিনের আরও ছবি ~

সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন অফিসার শ্যামলেন্দুবিকাশ সরকারের নেশা ইতিহাস ও প্রকৃতির টানে দেশবিদেশ ভ্রমণ। ভালো লাগে পুরনো গান শুনতে, বই পড়তে আর মাঝেমধ্যে লেখালেখিও।


 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher