সাতকোশিয়ার অরণ্যে

পল্লব চক্রবর্তী

- তাহলে আমরা যাচ্ছি কোথায়?
- খুব দূরে নয়, কাছাকাছি বলতে পারিস... এখান থেকে কটক, সেখান থেকে আঙ্গুল আর তার থেকে একটু দূরে সাতকোশিয়া টাইগার রিজার্ভ-এর টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প।
- কি আছে সেখানে?
- ওহ! তুই বুঝি বুদ্ধদেব গুহ'র 'ঋজুদার সাথে পুরুনাকোটে' পড়িসনি ? তাহলে জানতিস ওখানে আছে পাহাড়, বন, জঙ্গল - এক কালে অনেক বাঘ ছিল, এখনও বোধহয় দুটো-চারটে আছে, আর এ সবের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে দারুণ সুন্দর এক নদী।
সময়টা নভেম্বরের শেষ দিক। বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ। দ্রুত নেমে আসা সন্ধ্যায় তিন বন্ধু – আমি, রাজীব আর অর্জুন অফিসের পর আড্ডা দিচ্ছিলাম আর তিন চার দিনের ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায় তাই নিয়ে আলোচনায় মেতে ছিলাম। হঠাৎ করে মাথায় এল সাতকোশিয়ার কথা। কিন্তু সাতকোশিয়া যাওয়ার হ্যাপা বিস্তর। প্রথমে যেতে হবে আঙ্গুল, সেখানে আবার একটাই সাপ্তাহিক ট্রেন যায় হাওড়া থেকে। না হলে কটক কিংবা ভুবনেশ্বর নেমে চেঞ্জ করে যেতে হবে।
তবে কিনা কথাতেই আছে উঠল বাই তো কটক যাই...আমরাও রাতের ট্রেন ধরে ভোররাতে নামলাম কটক। সেখান থেকে আর এক ট্রেন ধরে আঙ্গুল। কটক থেকে আঙ্গুল যাওয়ার রেলপথটি ভারি সুন্দর। দুপাশে অনুচ্চ পাহাড় শ্রেণী আর জঙ্গল, তারই মাঝে মাঝে অলস ভাবে শুয়ে থাকা নির্জন প্ল্যাটফর্ম। আঙ্গুল-এ নেমে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর পৌঁছনো গেল সাতকোশিয়া ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিসন এর ইকো ট্যুরিজম সেলের অফিসে। টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প-এর বুকিং সারতে গিয়ে বুকিং খাতায় উঁকি মেরে দেখি এবছর আমরাই প্রথম ট্যুরিস্ট। এখানেই দেখা হল বোলেরো গাড়ির ড্রাইভার কাম গাইড সুনীল সাহুর সঙ্গে। ঠিক হল আগামী কয়েকদিন সুনীলই হবে আমাদের সাথী, সেই আমাদের সব ভালো করে ঘুরিয়ে দেখাবে।
আঙ্গুল শহর পেরনোর একটু পরই শুরু হল পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা প্রায় জনমানবহীন পথ ধরে আমাদের এগিয়ে চলা। দুপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে পেরিয়ে গেলাম প্রায় ষাট কিলোমিটার রাস্তা। মাঝে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের চেকপোস্টে একটু বিরতি, কাগজপত্র সব দেখিয়ে আর প্রবেশ মূল্য দিয়ে আবার গাড়িতে বসলাম। আর বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ি যখন থামল, মনে হল বিরাট এক পোস্টারের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি - আশেপাশে পাহাড়, মাঝখানে খোলা জায়গায় সারি সারি তাঁবুতে ট্যুরিস্টদের থাকার জায়গা আর ঠিক সামনে দুপাশে পাহাড়কে সাক্ষী রেখে বয়ে চলেছে শান্ত, নিস্তরঙ্গ মহানদী। জল তার নীলচে সবুজ। আমাদের তিন জনের মুখ থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে এল – "অসাধারণ"। মনে হল এত বেড়াতে গেছি কিন্তু এরকম জায়গায় আগে কখনও আসিনি।

গোটা দশ-বারো টেন্ট থাকার জন্য। টেন্টের ভিতরে বেশ অনেকখানি জায়গা, সব মিলিয়ে ব্যবস্থা মোটের ওপর ভালোই। তবে সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল এই দারুণ সুন্দর জায়গায় আমরাই একমাত্র ট্যুরিস্ট। দুচোখ ভরে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। ক্যাম্পের ম্যানেজারবাবুকে দুপুরের খাওয়ার কথা বলতে,তিনি একটু নির্লিপ্ত মুখে জানালেন - এখন তো আর কিছু খাবার পাওয়া যাবে না, আপনারা যে আসবেন আমরা খবর পাইনি। কি সর্বনেশে কথা! সকাল থেকে পেটে চা, বিস্কুট ছাড়া আর কোনও দানাপানি পড়েনি। শেষে এই জনমানবহীন জায়গায় উপবাসে কাটাতে হবে নাকি ? খিদেটা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আমাদের করুণ মুখ দেখে বোধহয় তাঁর একটু মায়া হল, বললেন তাহলে একটু অপেক্ষা করুন ডাল ভাত আলুভাজা আর ডিমের অমলেট করে দিচ্ছি। আমরা সমস্বরে বললাম - বেশ তাই হোক, খিদের মুখে এতো অমৃত। একটু দূরে একটা নারকোল পাতায় ছাওয়া গোল ঘরে খাওয়ার আয়োজন। বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে যখন উঠলাম তখন বিকেল হয়ে এসেছে।
এরপর নদীর সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকা। নীল নদী, সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশের দিকে চেয়ে কখন যে সময় কেটে যায়...। মনে হয় এ নদীর দিকে তাকিয়ে অনন্ত সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। এভাবে কখন পড়ে আসে বেলা... মহানদীর নীলচে সবুজ জল ক্রমশ গাঢ় নীল হতে থাকে। প্রায় নির্জন, নিস্তব্ধ সেই সন্ধ্যায় আমরা মহানদীর বুকে এদিক ওদিক খানিকটা হেঁটে আসি। এরপর সব পাখির ঘরে ফেরার সময় হয়, এ নদীও ফুরিয়ে ফেলে জীবনের সব লেনদেন, অতঃপর থাকে শুধু অন্ধকার...।

সন্ধ্যা হতেই জাঁকিয়ে বসলো ঠাণ্ডা আর নির্জনতা। চা আর পকোড়ার সাথে জমে উঠল আমাদের তিন বন্ধুর আড্ডা। মাথার ওপর বাঁকা চাঁদ আর ঝিঁঝিঁর একটানা ডাকে কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। নিজেদের মনে হলো বহির্জগত থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন - এখানে খবরের কাগজ নেই, টিভি নেই ,এমনকি মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। এরই মাঝে আসে খাওয়ার ডাক। মহানদী থেকে ধরা টাটকা কালবোশ মাছের ঝোল দিয়ে চমৎকার খাওয়া সেরে একটু সকাল সকালই শুয়ে পড়লাম।
পরদিন ভোর ভোর উঠে পড়তে হল। ম্যানেজার বাবু আগে থেকে নৌকা ঠিক করে রেখেছিলেন। সকাল সকাল বার হলে নাকি মহানদীর চড়াতে শীতের সকালে রোদ পোহানো কুমীরের দেখা মেলে। আমরা ভেসে পড়লাম নীল নদীর বুকে, ভোরের হিমেল হাওয়া আর মিঠে রোদ্দুর গায়ে মেখে। সত্যিই 'শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি'। চোখ আমাদের রোদে চিক চিক করে ওঠা বালুচরের দিকে, এই বুঝি কুমীর দেখা যায়। কত নাম জানা - না-জানা পাখি দেখে ফেললাম, দেখলাম কচ্ছপও - কিন্তু এ যাত্রায় আর কুমীরের দেখা মিলল না। তাতে অবশ্য আমাদের বিন্দুমাত্র আক্ষেপ ছিল না। ঘণ্টা দুয়েকের নৌ-সফরের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করার মতো। চোখ জুড়িয়ে দেয় মাথার উপর ঘন নীল আকাশ আর দুই পাড়ের সবুজ পাহাড়।

ফিরে এসে নদীর ধারে খড়ে ছাওয়া ঘরে বসে চারপাশ দেখতে দেখতে লুচি আর ঘুগনি দিয়ে অসাধারণ ব্রেকফাস্ট সেরে গেলাম সুনীলের গাড়িতে করে জঙ্গলে ঘুরতে। ফেরার পথে সুনীল একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হাঁটিয়ে আমাদের নিয়ে গেল নাম না জানা ছোট এক পাহাড়ি নদীর কাছে। শান্ত, নিস্তব্ধ এই বনের মধ্যে উপল রাশির উপর দিয়ে সশব্দে বয়ে চলা নদী বোধহয় এক সময় হারিয়ে গিয়েছে মহানদীর বুকে। টলটলে স্বচ্ছ জল দেখে নেমে পড়লাম নদীতে। জঙ্গলের মধ্যে যে এত চমৎকার ভাবে স্নান সেরে নিতে পারব তা ভাবতে পারিনি।
নেচারক্যাম্পে ফিরে মহানদী থেকে ধরা টাটকা মাছের ঝোল ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম। রোদ পড়লে ক্যাম্পেরই এক কর্মচারী আমাদের নিয়ে বেড়াতে বেরোলেন। পড়ন্ত বিকেলে মহানদীর তীর ধরে বেশ ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চিতা সহ কী কী বন্য জন্তু দেখেছেন, তার গল্প করতে করতে আমাদের নিয়ে গেলেন পুরনো নেচার ক্যাম্পের জায়গায়। পুরনো নেচার ক্যাম্পটি ছিল একেবারে মহানদীর বুকে চড়ায়। তবে সেটি সাতকোশিয়া টাইগার রিজার্ভের কোর এরিয়ার মধ্যে পড়ায় বর্তমানে নদীর পাড়ে উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ পরিবেশ। কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল কাল ফিরে যেতে হবে ভেবে। আবার সেই গতানুগতিক জীবন...। নদীর বুকে দুই পাহাড়ের মাঝে চিরকাল মনে রাখার মতো সূর্যাস্ত দেখে প্রায় অন্ধকারে গা ছমছম করা পরিবেশের মধ্যে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম, তখন মাথার ওপর বাঁকা চাঁদ উঠেছে।


পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক পল্লব চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাণিজ্য কর দফতরের আধিকারিক। ভালোবাসেন নানা ধরণের বই পড়তে। নেশা ব্যাগ ঘাড়ে করে পরিবারের কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে কাছে বা দূরের ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়া। বেশি পছন্দের পাহাড় আর বন। এক সময় দার্জিলিং-এ চাকরি করেছেন বেশ কিছু দিন। সেই থেকে পাহাড়ের সঙ্গে মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়া।


 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher