--> :: Amader Chhuti : : স্মৃতির ভ্রমণ

বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য মাঝেমধ্যে পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হবে পত্রিকার পাতায়।

 

[শিশু-কিশোরদের জন্য প্রথম বাংলা মাসিক পত্রিকা 'সখা'-র প্রতিষ্ঠাতা প্রমদাচরণ সেন ১৮৫৯ সালের ১৮ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি কৈশোর থেকেই যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে। সংস্কৃত ও ইংরেজির পাশাপাশি লাতিন ও ফ্রেঞ্চ ভাষাতেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। খুব অল্প বয়সেই কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন। প্রথমে নাকিপুর এন্ট্রান্স স্কুলে প্রধান শিক্ষক ও পরে কলকাতার সিটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। লেখক হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। 'মহৎ জীবনের আখ্যায়িকাবলী', 'চিন্তাশতক' ও 'সাথী' নামে তিনটি বই লেখেন। তাঁর লেখা 'ভীমের কপাল' (১৮৮৩) বাংলায় প্রথম কিশোর-পাঠ্য উপন্যাস।সিটি স্কুলে শিক্ষকতার সময়ই শিশুদের জন্য পত্রিকা চালু করার পরিকল্পনা করেন । ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে 'সখা'র আত্মপ্রকাশ ঘটে। পত্রিকা প্রকাশনার জন্য অসম্ভব পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তবু অজানাকে জানার স্বপ্ন পূরণের আশায় তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করেন। অবশেষে দাদা ও বন্ধুদের চেষ্টায় অর্থসঙ্কুলান হলেও বিলেতে রওনা দেওয়ার ঠিক আগেই ক্ষয়রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দয়ালু প্রমদাচরণ রুগ্ন অবস্থাতেও শিশু,গরীব ও অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। অবশেষে বছরখানেক রোগভোগের পর ২১ জুন ১৮৮৫ সালে খুলনায় মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে প্রমদাচরণ মারা যান।
তাঁর মৃত্যুর পরও দীর্ঘকাল বিভিন্নজনের সম্পাদনায় 'সখা' প্রকাশিত হতে থাকে এবং বাংলা শিশু সাহিত্যে নিজের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যায়। বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যেও 'সখা' পত্রিকার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তবে প্রমদাচরণের লেখা একটিমাত্র ভ্রমণকাহিনিই 'সখা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল পত্রাকারে।]


সম্পাদকের পত্র

প্রমদাচরণ সেন

তোমাদের সখা-সম্পাদক কিছুকালের জন্য বিদেশে গিয়াছেন; তিনি সেখান হইতে তোমাদিগকে যে পত্র লিখিয়াছেন তাহা প্রকাশ করিলাম।

প্রথম পত্র

আমার প্রিয় বালক-বালিকাগণ!
আমার বড় ইচ্ছা হইতেছে, এখন যেখানে আছি সেখানে ও তাহার চারিদিকে যত সুন্দর সুন্দর জিনিষ দেখিতে পাইতেছি তাহার কথা তোমাদিগকে বলি। পরমেশ্বর কত কত আশ্চর্য সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছেন, তাহা যাহারা দেশ বিদেশে বেড়ায় তাহা যত ভাল বুঝিতে পারে, এমন আর কে পারে? এই জন্য যাঁরা পাহাড় পর্বত, নদী সাগর, সরোবর, হ্রদ, অগ্নির গিরি এবং বরফের গিরি, লবণের খণি এবং কয়লার খণি, প্রভৃতি দেখিয়া বেড়ান, তাহাদিগকে আমার বড়ই 'হিংসা' হয়। অনেক দিন হইতে মনে মনে ইচ্ছা ছিল দেশে দেশে ঘুরিব, কিন্তু এতদিন সে ইচ্ছা কাজে আসে নাই, এখন একটু একটু করিয়া বেড়াইতে আরম্ভ করিয়া এইখানে আসিয়াছি, কিন্তু আর যে বেশী দূর যাইতে পারিব, তাহা বোধ হয় না। ইহাই আমার বড় দুঃখের কারণ। তোমরা বোধ হয় জান যে, যে ব্যক্তি রসগোল্লার স্বাদ একবার পাইয়াছে, সে সর্বদাই তাহা খাইতে চায়, আর জন্মেও ভুলে না; আমারও তাই হইয়াছে। এইখানে আসিয়া চারিদিকের সুন্দর শোভা ও চমৎকার শ্রী দেখিয়া আমি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছি, এখন ক্রমাগত এইরূপ দেশে ছুটিয়া বেড়াইতে ইচ্ছা করিতেছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকিলে কি হয়, কাজে আটকাইতেছে। তাই আমার কষ্ট। তোমার বড় ক্ষুধা হইয়াছে, সেই সময় তোমার চারিদিকে ভাল ভাল রসগোল্লা সাজাইয়া যদি তোমার হাত পা কেহ বাঁধিয়া রাখে, তাহা হইলে তোমার যেমন কষ্ট, আমারও তাহাই হইয়াছে। আমি চারিদিকের সুন্দর শোভার বাহার বুঝিতে পারিয়াছি, অথচ ছুটিয়া গিয়া সেই শোভার নিকট বসিতে পারিতেছি না, এই আমার কষ্টের কারণ।
দুর্গাপূজার ছুটির সময় আমি কলকাতা হইতে বাহির হই। এই আমার প্রথম পশ্চিমদিকে যাত্রা। তোমাদের মধ্যে যারা পশ্চিমে থাকে, তারা হয়ত মনে মনে হাসিবে, কিন্তু আমি পশ্চিমে বর্ধমানের এদিকে আর আসি নাই, কাজেই যতটুকু আসিয়াছি, তাহাতেই মনে হইতেছে ভয়ানক পশ্চিমে আসিয়া পড়িয়াছি। এই স্থানটীর জলবায়ু খুব ভাল, চারিদিকেই ছোট বড় পাহাড়, দেখিতে বড়ই সুন্দর। আমি যে বাড়ীতে থাকি তাহার বারান্দা এবং উঠান হইতে গাঢ় ঘনমেঘের ন্যায় পরেশনাথ পাহাড় দেখা যায়। এইখানে আসিয়া প্রথমেই দুটী বিষয় আমার চক্ষে লাগিল; প্রথমতঃ থাকিবার স্থান, দ্বিতীয়তঃ খাদ্য দ্রব্য। এখানে প্রায় সমস্ত বাড়ীতেই খোলার চাল, কোটাবাড়ী পাওয়া শক্ত—এপর্য্যন্ত মোটে তিনটী কোটাবাড়ী দেখিয়াছি, - একটা জমীদারের বাড়ী আর দুটো দোকান। খোলার বাড়ী গুলিতে জানালা প্রায় নাই, প্রথমে মনে হইল বুঝি বড় শীত বলিয়া জানালা রাখেনা, কিন্তু শেষে শুনিলাম, তাহা নহে। "সিন্ধুক্‌কা মাফিক ঘর" অর্থাৎ সিন্দুকের মত চারিদিকে আটা সাটা ঘরই এখানকার লোকের মনের মত। জানালা রাখিতে বলিলে, তাহারা চটিয়া যায়, বলে—" বাতাসই যদি খাবে, তবে মাঠে যাও না কেন?" এইতো ঘরের দশা। তার পর খাদ্য দ্রব্যের কথা কিছু বলি। এদেশে ভয়ানক কাঁকর। ভাত, ডাল, তরকারি, সমস্ত জিনিষেই কে জানে কেমন করিয়া কাঁকর মিশিয়া থাকে; -কেবল দুধটা খুব ভাল ও খুব শস্তা। তরকারির মধ্যে কেবল ঝিঙ্গে ও লাউ, আর কিছু পাওয়া শক্ত। একটী বন্ধু আমার চাকরকে একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, "তোমাদের এখানে পটল পাওয়া যায় না?" সে উত্তর করিল "পরোল? সেই বেগুনের মত? মিলে!" বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন "চিচিঙ্গে পাওয়া যায়?" চাকর খানিকক্ষণ ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া তাকাইয়া থাকিয়া বলিল "বাবু! ও আংরেজী বাত হাম নেহি সমঝ্‌তা হ্যায়" অর্থাৎ ও "ইংরেজী কথা আমি বুঝি না"!!
এখানকার যিনি জমীদার তাঁহাকে টিকাইত বলে। তাঁহার বাড়ীতে দুর্গাপূজা হয়। এখানকার কুমারেরা প্রতিমা প্রস্তুত করিতে পারে না, টিকাইতের বাড়ীর দুর্গা প্রতিমা আমাদের ওদিককার একজন কুমার আসিয়া তৈয়ার করিয়া দিয়া গিয়াছে, সুতরাং আমাদের দেশের প্রতিমায় ও এখানকার প্রতিমায় কোন তফাৎ নাই। তবে পূজার রকমে একটু তফাৎ দেখিলাম। আমাদের যেমন তিন দিন পূজা হয়, এখানে সেরূপ না হইয়া নবমীর দিন পূজা হইল। সেই দিন মস্ত মেলা বসিয়াছিল, এবং দুই তিন দল সাঁওতাল মেয়ে অনেকক্ষণ ধরিয়া নাচিয়াছিল। আমি সাঁওতালদের নাচ দেখিতে গেলাম। গিয়া দেখিলাম সাঁওতাল পুরুষেরা কেহ বাঁশি বাজাইতেছে, কেহ 'মাদোল' নামক মৃদঙ্গের মত একরূপ যন্ত্র বাজাইতেছে, আর দলে দলে মেয়েরা হাত ধরাধরি করিয়া গুন্ গুন্ শব্দে গান করিতে করিতে মাদোলের তালে তালে নাচিতেছে। আমাদের দেশের কোমোর-দোলান বিশ্রী নাচের চেয়ে সাঁওতালদের নাচ অনেক ভাল। এই সাঁওতালদের সম্বন্ধে আর কিছু কথা বলিবার আছে, তাহা পরে বলিতেছি।
মেলাতে সাঁওতাল নাচ দেখিয়া আমরা কিছু উত্তরে পদ্ম-ঝিল দেখিতে গেলাম। সেই ঝিলটীতে রাশি রাশি পদ্ম ফুল ফুটিয়া থাকে। যাইবার সময় পথে এক যায়গায় ভয়ানক ভিড় দেখিয়া সেখানে দাঁড়াইলাম। কিন্তু গিয়া যাহা দেখিলাম, তাহা বলিতে কান্না পায়। দেখিলাম একটা প্রকাণ্ড মাঠের এক পাশে একটা সাদা ছাগল বাঁধা রহিয়াছে, আর এক পাশ হইতে বাবুরা 'বাজি' রাখিয়া বন্দুক চালাইতেছেন, কে ছাগলটাকে গুলি করিয়া মারিতে পারে। শুনিলাম যাহার গুলিতে ছাগল মরিবে, টিকাইত তাহাকে পুরস্কার দিবেন। হায়! হায়! মুর্খদের কি দুর্বুদ্ধি! আর নাইবা হবে কেন! যাদের "দারু" অর্থাৎ মদ না হইলে দিন চলে না, যাহাদিগকে মদ ছাড়িতে বলিলে, উল্‌টে, বলিয়া ফেলে "আপ কলম্ ছোড়িয়ে, তব হামলোগ্ দারু ছোড়েঙ্গে" অর্থাৎ "আপনি লেখাপড়া ছাড়ুন, তবে আমরা মদ ছাড়িব", যাহারা জুয়া খেলিয়া সমস্ত টাকাকড়ি নষ্ট করিতে বসিয়াছে তবুও সে পাপখেলা ছাড়িবে না, যাদের স্ত্রীপুরুষের দশহাজারের মধ্যে দশজন ধার্ম্মিক লোক পাওয়া যায় না, তাদের আর কত হবে! যাহাহউক, আমরা আর সেখানে দাঁড়াইলাম না, পদ্মঝিলের সুন্দর শোভা দেখিয়া এই ভাবিতে ভাবিতে ঘরে ফিরিলাম যে, এখানকার সৃষ্টির মধ্যে সবই সুন্দর, কেবল মানুষই খারাপ।
সাঁওতালদের কথা বলিতেছিলাম, সাঁওতালেরা এর চাইতে অনেক ভাল। তাহারা অসভ্য বটে, বনে জঙ্গলে থাকে বটে, কিন্তু তাহারা কাহাকেও ঠকাইতে জানে না, চুরি বা মিথ্যা কথার কোন ধার ধারে না, এবং অকারণে কাহাকেও ক্লেশ দিতে ইচ্ছা করে না। আজ কাল গাঁয়ের কাছে যারা থাকে, তাহারা দেখিয়া দেখিয়া দু পাঁচ জন ঠকামি শিখিয়াছে বটে, কিন্তু যেখানে ইহারা আপন মনে নিজের দলে, সভ্য লোকদের সীমার বাহিরে আপনাদের 'মাঝি' অর্থাৎ দলের কর্ত্তার অধীনে বাস করে, সেখানে ইহারা বড়ই ভাল লোক। আমি এক দিন এই স্থানের নিকটে এক যায়গায় পথ চলিতে চলিতে তৃষ্ণা হওয়ায়, কাছে একজন সাঁওতাল ক্ষেত চষিতেছে দেখিয়া তাহার নিকট জল চাহিয়াছিলাম, কিন্তু সে সাঁওতাল আমাদের লোকের নিকটে থাকিয়া কিছু সভ্য হইয়াছে, কাজেই ক্ষেতের কাজ ছাড়িয়া যাইতে চাহিল না। আমি বলিলাম "বাপু! আমার তৃষ্ণায় প্রাণ যাইতেছে, একটু 'পাণি' দিতে পার।" সে লোকটা কেউ মেউ করিয়া কি বলিল কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, কেবল গুটী দুই কথা বুঝিলাম—"কুঁইয়া? কুঁইয়া? হুইরে খাব্‌রিয়া" অর্থাৎ "পাতকুয়া ওই খাব্‌রা অর্থাৎ খোলার বাড়ীর কাছে আছে।" সভ্য সাঁওতাল জল দিল না, কিন্তু অসভ্য সাঁওতালের কথা বলি শুন। আমি পরেশনাথ পাহাড়ে যাইতেছিলাম, পথে তৃষ্ণা হওয়াতে একটা জঙ্গুলে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকিয়া গেলাম। ছোট রাস্তা, দুপাশে বড় বড় কালকাশুন্দের গাছ। তাহার মধ্য দিয়া চলিতে চলিতে এক সাঁওতালকে পাইলাম। সে একটী ছেলেকে সঙ্গে লইয়া গরু চরাইতে যাইতেছিল। আমি জল চাহিবা মাত্র ছেলেটীকে গরুর সঙ্গে পাঠাইয়া দিয়া বড় সাঁওতাল নিজে বাড়ীতে গেল এবং পরিষ্কার মাজা ঘটিতে করিয়া আমাকে অতি সুমিষ্ট ঠাণ্ডা জল আনিয়া দিল।
আমাদের দেশের স্ত্রীলোকেরা যেমন পুরুষ মানুষ দেখিলে লজ্জায় কোন্ কোণে পলাইবে, তাহার ঠিক থাকে না, সাঁওতাল মেয়েদের সেরূপ ভাব নহে। তাহারা নিঃসঙ্কোচে রাস্তা দিয়া ছেলেদের মাই খাওয়াইতে খাওয়াইতে চলিয়া যাইতেছে, কাহারও ভয় নাই। খুব গভীর জঙ্গলে যে সব সাঁওতাল থাকে, তাহাদের পুরুষ মেয়ে কেউ কাপড় পরে না, কেবল কোমরে পাতা সেলাই করিয়া জড়ায়। কিন্তু আমি এ পর্যন্ত যত সাঁওতাল দেখিয়াছি, তার মধ্যে পুরুষদের কাপড়ের কৌপিন এবং মেয়েদের প্রায় আমাদের মত বড় কাপড় এবং রূপার গয়না, মল, নথ, ইত্যাদি দেখিয়াছি।
আমার একটী বন্ধুর নিকট শুনিলাম অসভ্য সাঁওতাল যায়গা জমি লইয়া আমাদের মত মকদ্দমা মাম্‌লা করেনা, জমীদার বেশী টাকা খাজানা চাহিলে সে স্থান ছাড়িয়া চলিয়া যায়, এবং বনের মধ্যে আপনাদের 'মাঝি'র অধীনে অল্পেতেই সন্তুষ্ট হইয়া বাস করে। সাঁওতাল যে ঠকাইতে জানেনা, ইহা আমার কোন বন্ধু পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন। কোন জিনিষের জন্য আগের দিন পয়সা দিলে, পরের দিন যে সেই দামের জিনিষ ঘরে বসিয়া পাইবে, এবিষয়ে তোমরা সভ্য জনকে, চতুর লোককে বিশ্বাস করিতে পার আর নাই পার, অসভ্য সাঁওতালকে বিশ্বাস করিতে পার। সাঁওতাল যে মিথ্যা কথা কহিতে জানে না, তাহার একটা গল্প শুন। একবার এক সাঁওতাল অন্য একজন লোককে মারিয়া ফেলে। ইংরাজের রাজ্যে কি খুন করিয়া বাঁচিবার যো আছে? সাঁওতালকে ধরিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে হাজির করা হইল। একজন মোক্তার (সভ্য লোক কি না!) প্রাণপণে সাঁওতালকে শিখাইলেন, "বলিস আমি খুন করি নাই।" সাঁওতাল বলিল "আচ্ছা।" সকলি ঠিক। ম্যাজিষ্ট্রেট সাঁওতালী ভাষায় জিজ্ঞাসা করাইলেন "তুমি অমুককে মারিয়াছ কেন?" সাঁওতাল বলিল "আমার এই এই ক্ষতি করিয়াছিল, মারিব নাতো কি?"
এবারকার এই পত্র বড় মস্ত হইয়া পড়িয়াছে, আজ এইখানেই শেষ করি। আগামীবারে, কয়লার খণি, শ্লেটপাথরের নদী বা জল প্রপাত, এবং পরেশনাথ পাহাড়ের কথা বলিব। দেখিবার বিষয়, জানিবার বিষয় অনেক আছে, কিন্তু যাহারা এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে পরমেশ্বরের আশ্চর্য্য দয়ার আশ্চর্য্য কাণ্ড বুঝিতে না পারে তাদের বেড়ানই মিথ্যা, তাদের চোখ কাণ কেবল বোঝার মতন, তাহারা চক্ষু থাকিতেও দেখে না এবং কাণ থাকিতেও শোনে না।

     পচম্বা, গিরিধি।

তোমাদের শুভাকাঙ্খী                  

সম্পাদক                     


দ্বিতীয় পত্র


সখা সম্পাদকের দ্বিতীয় পত্র আমরা আহ্লাদের সহিত প্রকাশ করিলাম।
আমার প্রিয় বালক বালিকাগণ।–- যাহা দেখি সবই যদি খুলিয়া বলিতে পারি তাহা হইলে আর দুঃখ থাকে না, কিন্তু আমার সে সাধ্য নাই। বড় হইয়া নিজে যদি কখনও দেশ বিদেশে বেড়াইতে পার এবং ভাল চোখে চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে পার, তবেই বুঝিতে পারিবে পরমেশ্বরের সৃষ্টি কত সুন্দর, কত মধুর, কত চমৎকার। আমি যেখানে আছি এখান হইতে এক ক্রোশ দূরে কয়লার খণি আছে, খণি কাহাকে বলে জান? এক একটা যায়গার অনেক দূর পর্যন্ত মাটীর নীচে কয়লা পাওয়া যায়, এই কয়লাতে সমস্ত বাষ্পীয় যন্ত্র অর্থাৎ কল চলে। লোকে মাটীর নীচে গর্ত করিয়া, মাটীর নীচ দিয়াই বরাবর পথ করিয়া কয়লা তুলিবার বন্দোবস্ত করে, ইহারই নাম খণি বা খাদ, মাটীর অনেক নীচ পর্যন্ত কয়লা থাকে এই জন্য দুতলা, তিনতলা, চারতলা, এই রকম তলা আছে। কোন কোন খণিতে অনেক তলা আছে, শুনিতে পাওয়া যায়। আমরা যেটাতে গিয়াছিলাম, সেটা ছোট তাহাতে দুতলা বই নাই।
আমি ঘোড়ায় চড়িয়া খণি দেখিতে গিয়াছিলাম। খনিতে নামিবার রাস্তা ক্রমে ঢালু হইয়া নীচে গিয়াছে সূতরাং বেশ হাটিয়া যাওয়া যায়, নামিবার দরজাটায় একটু আলো আছে বটে; কিন্তু মধ্যে আলো জ্বালিয়া যাইতে হয়।
আমাদের সঙ্গে কয়লার খণির একজন লোক আলোক ধরিয়া যাইতেছিল, সুতরাং আমরা নির্ভয়ে যাইতে লাগিলাম, দুপাশে কয়লার দেওয়াল। উপরে কয়লার ছাদ আঁটা, নীচে কয়লার রাস্তাঃ- আমরা এইরূপ স্থানে এইরূপ পথে সাবধানে যাইতে লাগিলাম। কিন্তু একটা বিপদে পড়িলাম, খণির মধ্যে তো বাতাস যাইবার পথ নাই, সুতরাং তোমরা বুঝিতেই পার সেখানকার বাতাস লোকের নিশ্বাসে নিশ্বাসে কত ভারী হইতে পারে, আমার কিছু কষ্ট হইতে লাগিল। আর দুতলায় নামিতে ইচ্ছা করিলাম না। সঙ্গের আলোধারী লোককে বলিলাম "বাপু আমাদিগকে বাহিরে লইয়া চল। আর নীচে যাইব না।" কিন্তু বাহির হইবার রাস্তা ত সহজ নয়, দেখিতে দেখিতে চলিতে চলিতে অনেক পথ গেলে তবে বাহির হইবার রাস্তা পাওয়া গেল। কিন্তু ইতি মধ্যে কি কি দেখিলাম তাহা বলি। খনির অনেক যায়গাতেই সোজা হইয়া চলিয়া যাওয়া যায়, কিন্তু কোথাও কোথাও কুঁজো হইয়া পথ চলিতে হয়। আমরা কখনও কুঁজো হইয়া কখনও সোজা হইয়া চলিতে চলিতে দেখিলাম, মজুরেরা কয়লা কাটিয়া বাহির করিতেছে। তাহাদের কাছে একটা আলো ও হাতে এক-এক খানা মাটী খোঁড়া কুড়াল, মজুরদের মধ্যে দু একজন স্ত্রীলোক এবং অনেক বালক দেখিলাম। সেখানে সাদা কালো নাই। সবই কালো দেখিলাম। অনেক সুশ্রী ছেলে কয়লাতে এমনি কালো হইয়া গিয়াছে যে ঠিক যেন চূণাগলির কালো পোষাক পরা ফিরিঙ্গী। যেখানে কয়লা কাটা হইতেছে তাহার নিকটে সরু রাস্তা, তাহাতে কয়লা টানিবার জন্য রেল ফেলা। কয়লা কাটা হইলে বড় বড় লোহার বা টিনের বালতিতে বোঝাই করিয়া, রেলের উপরে খোলা ঠেলা গাড়ীতে সরাইয়া দেয়; সেখান হইতে অল্প ঠেলিয়া দিলেই কয়লার গাড়ী, যেখানে উঠিবার রাস্তা, সেই পর্যন্ত চলিয়া আসে, কখনও বা লোকে ঠেলিয়া সে পর্যন্ত লইয়া যায়। উঠিবার রাস্তা সিঁড়ির মতন মনে করিতেছ বুঝি? না, না, তা নয়। আমরা এখন যেখানে পৌছিলাম সেখানে গিয়া দেখিলাম উপরের সূর্যের আলো দেখা যাইতেছে। এবং উপর হইতে লম্বা একটা লোহার শিকল নামিতেছে, এই শিকলের শেষ ভাগটায় তিনটা মুখ; এই তিনটা মুখ বালতির চারিদিকের তিনটা কড়ার সঙ্গে যুড়িয়া দেওয়া হইল, আর সঙ্কেত করিবা মাত্র বালতি কয়লা শুদ্ধ উঠিয়া চলিয়া গেল। আবার বালতি ফিরিয়া আসিল। এই বারে আমরা তাহাতে দাঁড়াইয়া শক্ত করিয়া শিকল ধরিলাম। পাশের লোকেরা উপর দিকে তাকাইয়া চীৎকার করিয়া বলিল, "আস্তে মানুষ বালতি", আর অমনি আমরা আস্তে আস্তে উপরে উঠিয়া গেলাম। কোথায় নামিয়া ছিলাম আর কোথায় আসিয়া উঠিলাম, চাহিয়া দেখি একটা বাষ্পীয় যন্ত্র কপিকলে করিয়া আমাদিগকে টানিয়া তুলিয়াছে এবং আমরা যেখান দিয়া নামিয়াছিলাম তাহা হইতে বহুদূরে আসিয়া উঠিয়াছি।
কয়লার খণিতে বিস্তর টাকা লাভ হয়, কিন্তু আমাদের দেশের লোকের সেদিকে মতি নাই। যত কয়লার খণি, হয় গবর্ণমেণ্টের না হয় রেলওয়ে কোম্পানীর না হয় অন্য কোন ইংরেজ কোম্পানীর। আমরা যে খণি দেখিতে গিয়াছিলাম সে জায়গাটা এখানকার টিকাইতের ছিল। কিন্তু তিনি নিজে বুদ্ধি খরচ করিয়া কিছু করিতে না পারিয়া নয় লক্ষ টাকা মূল্যে তাহা বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন, আর এখন কত নয় লক্ষ টাকা তাহা হইতে লাভ হইবে কে জানে?
বিনা পরিশ্রমে বিনা যত্নে, বিনা কষ্টে কি কখনও কোন কাজ হয়? খণি হইতে কয়লা উঠাইতে অত্যন্ত পরিশ্রম করিতে হয়। কখনও কখনও মজুরদের হাত পা ভাঙ্গিয়া যায়। অন্ধকারে সামান্য আলোতে কাজ করা সহজেই বুঝিতে পার কত বিপদের সম্ভাবনা। আবার ইহা ছাড়া খণিতে আর একটা মহা বিপদের ভয় আছে। খণির মধ্যে বাতাস ঢুকিতে পারে না, পূর্বেই বলিয়াছি বাতাস ঢুকিতে না পারায় মধ্যের বাতাস খারাপ হইয়া গিয়া লোকের নানারূপ ব্যারাম হইয়া থাকে এবং মধ্যের খারাপ হাওয়া কখন কখনও প্রদীপের আলো লাগিয়া জ্বলিয়া ওঠে; তখন মজুরদের প্রাণে বাঁচা শক্ত। যদিও এই শেষের লিখিত বিপদ বারণ করিবার জন্য আজকাল "অভয় প্রদীপ" নামে একরকম নূতন আলোর সৃষ্টি হইয়াছে, কিন্তু আমরা এই খণিতে তাহার একটীরও বন্দোবস্ত দেখিলাম না।
এখন শ্লেট পাথরের নদীর কথা কিছু বলিব। এই নদী আমার থাকিবার যায়গা হইতে আধ মাইলের অধিক হইবে না; সুতরাং আমি হাঁটিয়াই গেলাম। নদী বলিলে যদি তোমাদের গঙ্গা বা অন্য কোন নদীর কথা মনে হয়, তাহা হইলে আমি নদী না বলিয়া অন্য কিছু বলি, কেননা আমি যাহা দেখিয়াছিলাম তাহার উপর দিয়া পথ গিয়াছে, এবং গরু, মহিষ, গাড়ী, ঘোড়া, তাহার উপর দিয়াই যাইতেছে উপরে এক হাত কি দেড় হাত বালি। তাহার নীচে চমৎকার শ্লেট পাথর, আমরা দেখিলাম নদীর যে ভারে ঊপর দিয়া পথ হইয়াছে সেখানে ঝির ঝির করিয়া একটু একটু জল আসিতেছে, আরও নীচে আসিয়া তাহার সহিত এইরূপ দশ জায়গা হইতে দশটী ছোট ছোট জলের স্রোত আসিয়া মিশিয়াছে এবং সকল গুলি এক হইয়া একটু তেজের সহিত পাথর ডিঙ্গাইয়া কুল কুল শব্দে নীচে চলিয়া যাইতেছে। আমরা এইখানে একটা পাথরের উপরে বসিলাম, এবং সেই স্থানের সুন্দর শব্দ শুনিতে শুনিতে মনে মনে মহাসুখী হইতে লাগিলাম। এখানে জলের তেজে বালি দাঁড়াইতে পারে না, কেবল কালো পাথরের উপর দিয়া সাদা জল সূর্যের কিরণে চিক্ চিক্ করিতে করিতে চলিয়াছে। শ্লেট পাথরগুলি এমন সুন্দর ভাবে সাজান, তাহা আর কি বলিব? কোন যায়গাটা ত্রিকোণ, কোন যায়গাটা অর্ধচন্দ্রের মত, কোন যায়গাটা চারিকোণ, এইরূপ নানারূপ সুন্দর ভাবে সাজান রহিয়াছে। শ্লেট পাথরে সুন্দর লেখা যায়, আমি এক খণ্ড পাথর লইয়া বড় একটা পাতের উপর লিখিলাম "ইশ্বরের কি দয়া!" আর তাহার উপর দিয়া শীতল জল ঝির ঝির করিয়া যেন সেই লেখা দেখিতে দেখিতে নামিয়া চলিল।
একবার ইচ্ছা হইল, এই সকল জল কোথা হইতে আসিতেছে তাহা খুঁজিয়া দেখি। এই ভাবিয়া পাথরের নুড়ি কুড়াইতে কুড়াইতে নদীর যেদিক হইতে জল আসিতেছে সেই দিকে চলিলাম। অনেক দূর গেলাম, কিন্তু সেখানে হায়েনার গায়ের যেমন গন্ধ সেইরূপ গন্ধ বাহির হইতে লাগিল। আমরা সেই "বোটকা" গন্ধে ভয় পাইয়া, আর যাইতে সাহস করিলাম না। আর একটু গেলেই হয়ত এখন যে সকল কথা লিখিতেছি তাহা আর লিখিবার লোক থাকিত না। আমরা বিলম্ব না করিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম।
আরো অনেক কথা বলিবার রহিল; বারান্তরে তোমাদিগকে জানাইব।

তোমাদের শুভাকাঙ্খী                  

সম্পাদক                     


তৃতীয়় পত্র

পরেশনাথ মন্দির


পরেশনাথ পাহাড় জৈন নামক লোকদিগের একটা বড় তীর্থ স্থান। এইখানে অগ্রহায়ণ হইতে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত্য অনেক জৈন যাত্রীর ভিড় হয়। জৈনেরা পরেশনাথকে পরম দেবতা মনে করে, এবং জীবহত্যা অর্থাৎ কোন প্রাণীকে মারা বা ক্লেশ দেওয়াকে অত্যন্ত অন্যায় ভাবিয়া থাকে! পরেশনাথ পাহাড় গিরিধি হইতে নয় ক্রোশ দক্ষিণে। ইহার মধ্যে এক স্থানে 'বরাকর' নামক একটী নদী আছে। রাস্তার দুদিকে ছোট ছোট পাহাড় দেখিতে দেখিতে আমরা বিনা ক্লেশে বরাকর পর্য্যন্ত আসিলাম। সেখানে আহারাদি করা গেল। এইখানে "রাজবালা ধর্ম্মশালা" নামে জৈনদের একটী মন্দির আছে। আমরা এই ধর্ম্মশালা দেখিয়া নদী পার হইলাম, এ সময়ে বরাকর নদীতে এক হাটু বা কিছু অধিক মাত্র জল থাকে; সুতরাং আমরা সহজেই নদী পার হইয়া গেলাম।
রাস্তায় ভয়ানক রদ্দুরে ছাতা মাথায় দিয়াও কিছু ক্লেশ পাইতে হইল; যাহা হউক বিকালবেলা পাহাড়ের নীচে পৌঁছিলাম।
পাহাড়ের নীচের স্থানের নাম মধুবন। শুনিয়াছি ধ্রুব মধুবনে তপস্যা করিয়াছিলেন। এই সেই মধুবন কিনা, তাহা জানিতে পারিলাম না। আমাদিগের কোন বন্ধু আমাদের জন্য মধুবনের এক জৈন মন্দিরের বা কুঠির অধ্যক্ষকে আগেই এক পত্র লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, সুতরাং আমাদিগকে গিয়া বিশেষ কষ্ট পাইতে হইল না। মধুবনে অনেকগুলি জৈন মন্দির। কুঠির অধ্যক্ষ মহাশয় আমাদিগকে সকল গুলিই যত্নের সহিত দেখাইলেন। আমরা তাঁহাদের ধর্ম্মের নিয়ম মান্য করিয়া দরজায় যুতা, ছাতা, লাঠি প্রভৃতি রাখিয়া গেলাম। এই মন্দিরগুলি নির্ম্মান করিতে যে কত শত টাকা খরচ হইয়াছে, তাহার সীমা কি? অনেক মন্দিরই আগাগোড়া পাথরের তৈয়ারী। সকলগুলির মধ্যেই মেজে মার্ব্বেল পাথরে মোড়া এবং মূর্ত্তিগুলি নানারূপ সুন্দর অলঙ্কারে সাজান ও চমৎকার আসনে জরির কাজ করা শামিয়ানার নীচে বসান। পরেশনাথ প্রধান দেবতা; ইহা ছাড়া আরও তেইশ জন অবতার আছেন, এই কথা কুঠির অধ্যক্ষের মুখে শুনিলাম। প্রত্যেক মন্দিরের দরজায় একজন বা দুজন করিয়া দ্বারবানদেবতা আছেন। তাঁহাদের আকার নাই, পাথরের এক একটা লম্বা খণ্ড, তাতেই সিন্দূর-মাখান।
পরেশনাথ পাহাড় প্রায় তিন হাজার হাত উচ্চ। রোগা লোকের সাধ্য কি, হাটিয়া উঠে। আমরা ডুলিতে গিয়াছিলাম। সকল যায়গায় রাস্তা নাই। উপরে সাহেবদের জন্য একটা ঘর আছে, সেই পর্যন্ত ভাল রাস্তা, তাহার ওদিকে আর রাস্তা নাই; কেবল পাথরের উপর দিয়া একটু একটু পরিস্কার করা। পাহাড় বলিলে কি তোমাদের কেবল পাথরের ঢিবি মনে হয়? তাহা নহে,পাহাড়ের উপরে যে কত রকম গাছ জন্মিয়াছে,তাহার সীমা কি? আমি এই সকল গাছের মধ্যে বাঁশগাছ, কলাগাছ এবং হলুদগাছ,ইহাই চিনিতে পারিলাম।ইহা ছাড়া ছোট ছোট অগছা হইতে শাল সুন্দরীর মত বড় বড় গাছ যে কত আছে,তাহা গণিয়া উঠা যায় না।
একবার একটী ইংরাজ স্ত্রীলোক বলিয়াছিলেন "এদেশের পাখীগুলি কেবল দেখিতেই সুন্দর,কিন্তু গান করিতে পারে না,খালি ক্যাচ্‌ম্যাচ্‌ করে।" যদি তিনি এই পাহাড়ে আসিতেন,তাহা হইলে তাঁহার এই বিশ্বাস চলিয়া যাইত!আমার পথ চলিতে চলিতে বোধ হইল যেন স্বর্গে যাইতেছি। একদিকে ঝর্ ঝর্ করিয়া ঝরণার জল পড়িতেছে,একদিকে শোঁ শোঁ করিয়া গাছের মধ্যে বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে শীতল বাতাস বহিয়া চলিয়াছে,একদিকে পাখীগুলি টুউ, টুইট্,টুউ টুইট্ শব্দে কি সুমধুর গানই ধরিয়াছে,এদিকে রাস্তার দুপাশে দুর্গাঝাঁপ বা ফার্ণ জাতীয় গাছ সকল যেন সুন্দর সবুজ মক্মলের মত আপনাদের সুশ্রীরূপ পথের লোককে দেখাইতেছে – এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া আমার ইচ্ছা হইল একবার সেইখানে লাফাইয়া পড়ি এবং এই সুন্দর সৃষ্টি যাঁর সেই পরম পিতা পরমেশ্বরের নামে চিরদিনের মত ডুবিয়া যাই।
কিন্তু কি আশ্চর্য্য!যে শোভা দেখিয়া আমার মন গলিয়া গেল,সেই শোভা দেখিয়াও কোন লোকের মনে খারাপ ভাব থাকে!পথের মাঝখানে যাত্রীদের বিশ্রামের জন্য একটা ছোট ঘর আছে। তাহার কাছে গোঁ গোঁ শোঁ শোঁ শব্দে জল পড়িতেছে,পাখীগুলি যেন তাহারই শব্দে তাল রাখিয়া গান করিতেছে,আর চারিদিকে গাছের শীতল ছায়া যেন পরিশ্রান্ত যাত্রীকে কোলে টানিয়া লইতেছে। এই শোভা,এই বাহারের মধ্যে যাহার ভগবানকে মনে পড়ে না,সে কি দুর্ভাগা!আমি দেখিয়া লজ্জায় মরিয়া গেলাম,আমাদেরই কতকগুলি ছেলে (হাতের লেখায় বুঝিলাম বয়স বেশী নয়)এই বিশ্রামঘরের দেয়ালে বিশ্রী ছবি এবং বাঙ্গালাতে বিশ্রী কথা সকল লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছে। হতভাগা ছেলেদের ইহাতেও সাধ মেটে নাই,আবার তাহার সঙ্গে নিজেদের নাম ও বাড়ীর ঠিকানা পর্য্যন্ত লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন!দিগ্গজ পন্ডিতদের কাহারও বাড়ি ছুতোর পাড়া কাহারও বাড়ী কালেজ স্ট্রীট,কাহারও উহারই নিকটে। আমি বাঙ্গালী – বাঙ্গালীর ছেলে বিদেশে আসিয়া এমন কাণ্ড করিয়া গিয়াছে দেখিয়া আমার লজ্জা ও ঘৃণা দুই হইতে লাগিল। তখন নিজের লজ্জা নিজেই ঢাকিবার জন্য সেই সকল খারাপ ছবি ও লেখা মুছিয়া ফেলিতে লাগিলাম। সকলই মুছিয়া ফেলিলাম কেবল খুব উপরে একটা লেখা হাতে পাইলাম না। দুরাত্মাদের খারাপ স্বভাবের একটা চিহ্ন সেই পবিত্র স্থানে থাকিয়া গেল।
একটা পাহাড় ডিঙ্গাইয়া বড় পাহাড়টাতে উঠিতে হয়। বড় পাহাড়ের রাস্তা যে কি ভয়ানক,তাহা বলিতে পারিনা। কোন কোন স্থানে পাহাড়ের এক ধার দিয়া রাস্তা গিয়াছে, সেখান হইতে মাটী পর্য্যন্ত এক-ঢালু,তাকাইলে মাথা ঘোরে;কোন স্থানে দুপাশে বড় বড় ঘাস ও ভাঁটুইবন,তাহার মধ্য দিয়া সাপের ভয় অগ্রাহ্য করিয়া চলিতে হয়;আবার কোথাও বা উপরে উঠিতে ডুলির তলায় ক্রমাগত পাথর ঠেকিতে থাকে, ঘা খাইয়া শরীরে বেদনা হইয়া প্রাণ যায়। এই ভাবে,কতক আহ্লাদে কতক ভয়ে আমরা উপরে উঠিলাম। আঃ – সেখানকার কি শোভা! এক এক ঝল্কা বাতাস গায়ে লাগে আর বোধ হয় যেন শরীর পাতলা হইয়া গেল। উপরে চাহিয়া দেখিলাম, আকাশ নীল – গাঢ় নীল। নীচে ওরূপ নীলাকাশ প্রায়ই দেখা যায় না। চারিদিকে তাকাইয়া দেখিলাম কুয়াসার ন্যায় বাতাসে মেঘগুলি ভাসিয়া বেড়াইতেছে,আমরা মেঘের সীমা ছাড়িয়া উপরে উঠিয়া ফেলিয়াছি! বাতাসে বেশ একটু শীত লাগে,কিন্তু তাহাতে বড়ই আরাম হইতে লাগিল। চারিদিকে তাকাইয়া দেখিলাম ছোট পাহাড়টাকে একটা বনের মত,বড় বড় গাছগুলিকে ঘাসের মত এবং অন্যান্য স্থানগুলিকে রং করা ছবির মত দেখাইতেছে।
উপরে অনেকগুলি মন্দির আছে,কিন্তু সেগুলি মধুবনের মন্দিরের ন্যায় বড় বা সুন্দর নহে। সর্ব্বাপেক্ষা বড় যে মন্দিরটা,আমরা তাহারই নিকটে স্নানাহার করিলাম। সঙ্গে তেল ছিল না,কি করি,খানিকটা ঘি মাখিয়া ঝরণার জলে স্নান করিলাম। সে যে কি আরাম,তাহা আর কি বলিব। পূর্ব্বকালের মুনিঋষিদের কথা মনে হইতে লাগিল। সাধে কি তাঁহারা পাহাড় পর্ব্বতে গিয়া তপস্যা করিতেন! একজন ইংরাজ বলিয়াছেন "প্রকৃতি অর্থাৎ স্বাভাবিক সৌন্দর্য হইতে প্রকৃতির ঈশ্বর যিনি তাঁহাকে সহজেই পাওয়া যায়।" আমার একজন বন্ধু বলিয়াছিলেন, "আঃ – এই রকম যায়গায় দুচারজন মনের মত লোক লইয়া থাকিতে পারিলে বড়ই সুখ হয়।" আমি বলি – "যেখানে গেলে চারিদিকের শোভা দেখিয়া ঈশ্বরকে যেন সাক্ষাৎ দেখা যায়,সেখানে আর কোন মনের মত লোকের আবশ্যক কি? সহরের সভ্যতার 'সরগরমে' ঝল্সিয়া মরার অপেক্ষা এমন সুন্দর স্থানে,ভগবানের সৃষ্টির বাহারে আপনাকে ঘেরিয়া,তাঁহার নাম করিয়া অসভ্যের মত একলা দিনশেষ করাও ভাল।"
ইহার পর আরও কোন কোন স্থান দেখিয়া আমরা নামিয়া আসিলাম।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস
প্রথম পত্রদুটি 'সখা' পত্রিকার় ১৮৮৪ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর সংখ্যায় এবং তৃতীয় পত্রটি ১৮৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

[মূল লেখার বানান ও বিন্যাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। - সম্পাদক]

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher