-->
বেড়ানোর মতই বইপড়ার আদতও বাঙালির চেনা সখ – তা ছাপা হোক বা ই-বুক। পুরোনো এই ভ্রমণ কাহিনিগুলির নস্টালজিয়া তাতে এনে দেয় একটা অন্যরকম আমেজ। আজকের ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি লেখক-পাঠকেরা অনেকেই শতাব্দী প্রাচীন সেইসব লেখাগুলি পড়ার সুযোগ পাননি। 'আমাদের ছুটি'-র পাঠকদের জন্য এবার পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে অথবা পুরোনো বইয়ের কিছু কিছু নির্বাচিত অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পত্রিকার পাতায়।
[সামাজিক ন্যায় ও নারীর সমানাধিকারের দাবিতে সোচ্চার 'A Vindication of the Rights of Woman'-এর ইংরেজ লেখিকা মেরি ওলস্টোনক্রাফট (Mary Wollstonecraft)। তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে (১৭৫৯-১৭৯৭) নানা ঘাতপ্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েছিলেন মেরি। ১৭৯২-তে ফরাসী বিপ্লবের রূপ সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করতে ফ্রান্সে গিয়ে আমেরিকান ব্যবসায়ী ও অভিযাত্রী গিলবার্ট ইমলের সঙ্গে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। জন্ম হয় কন্যা ফ্যানির। অস্থির ফ্রান্স থেকে দেশে ফেরার কিছুকাল পরেই মেরিকে যেতে হয় স্ক্যান্ডিনেভিয়া ইমলের ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে। 'Letters Written During a Short Residence in Sweden, Norway, and Denmark' ১৭৯৫ সালে তাঁর এই যাত্রারই অত্যন্ত ব্যক্তিগত এক বিবরণী – আজ থেকে দুশো বছরেরও বেশি আগে এক নারীর একলা বেরোনোর কথা। একাকী এই ভ্রমণ নিজের চারপাশের জগতের সঙ্গে এবং তাঁর ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলতে ওলস্টোনক্রাফটকে সাহায্য করেছিল। ফ্যানিকে তিনি রেখে এসেছিলেন গিলবার্টের কাছে। ভ্রমণকালীন এই চিঠিগুলিও তিনি গিলবার্টকেই লিখতেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়া ভ্রমণের পরপরেই গিলবার্ট মেরিকে ছেড়ে চলে যান। পরে মেরি বিবাহ করেন খ্যাতনামা লেখক উইলিয়াম গডউইনকে। এই বিবাহ সুখের হলেও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাঁদের সন্তান মেরির জন্মের দশ দিনের মাথায় মৃত্যু হয় মেরি ওলস্টোনক্রাফটের। কন্যা মেরি বড় হয়ে কবি পার্সি বেইশি শেলিকে বিবাহ করেন। ওই একই বছর আত্মহত্যা করেন ফ্যানি। মেরি শেলির বিখ্যাত উপন্যাস 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন'।]
নরওয়ের দিনগুলি
(সুইডেন, নরওয়ে এবং ডেনমার্কে স্বল্পকালীন বাসের সময় লেখা চিঠি থেকে)
মেরি ওলস্টোনক্রাফট
সমুদ্র ছিল উত্তাল, কিন্তু আমার সারেংটিও ছিল অভিজ্ঞ, মনে তাই বিপদের কোনও আশঙ্কাই ছিল না। শুনেছিলাম কখনোসখনো ঢেউ-এর টানে নৌকা বেশি গভীরে চলে গেলে হারিয়ে যায়। তবে কিনা বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে চুলচেরা হিসেবনিকেশ আমি খুব কম সময়ই করে থাকি - চোখের সামনে যে সব ঝামেলা জ্বলজ্বল করছে রোজের জন্য সেগুলোই যথেষ্ট!
আমাদের নৌকাটাকে নিয়ে যেতে হচ্ছিল দ্বীপপুঞ্জ আর বিরাট বিরাট পাথরের পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে, তটভূমিকে যথাসম্ভব চোখের আড়াল না হতে দিয়ে, যদিও মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল শুধুই কুয়াশার সীমারেখা টানা আছে জলের প্রান্তে। সারেং আশ্বাস দিয়েছিল, নরওয়ে উপকূলের অজস্র পোতাশ্রয়ই খুব নিরাপদ, সবসময় পাহারাদার নৌকার নজরদারি থাকে। এও জানলাম যে সুইডেনের দিকটা কিন্তু খুবই বিপজ্জনক; ভিনদেশি নৌকাকে সৈকতের আশেপাশে ওঁত পেতে থাকা ডুবো পাহাড়গুলোকে এড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত অভিজ্ঞ সাহায্য বেশিরভাগ সময়েই পাওয়া যায় না।
এখানে জোয়ার-ভাঁটা নেই, ক্যাট্টেগাট-এও তাই, আর আমার কাছে যেটা প্রাসঙ্গিক মনে হল, কোনও বেলাভূমিও নেই। হয়ত এটা আগেই খেয়াল করেছিলাম, কিন্তু ভেবে দেখিনি, এখন লক্ষ্য করলাম ঢেউগুলো এক নাগাড়ে রিক্ত পাথরের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, পিছিয়ে যাওয়ার মত অবকাশই থাকছেনা যাতে তলানিটুকু থিতিয়ে শক্ত হতে পারে।
বাতাস অনুকূলই ছিল, কিন্তু আমাদের গতিপথ ঘোরাতে হল লারভিক-এ প্রবেশের জন্য, বিকেল তিনটে নাগাদ পৌঁছালাম সেখানে। পরিষ্কার, সুন্দর শহর, প্রচুর লোহার কাঠামো, সেগুলো প্রাণসঞ্চার করেছে এখানে।
নরওয়ের বাসিন্দারা ঘন ঘন পর্যটকদের দেখা পায়না তাই তারা খুব কৌতূহলী হয়ে থাকে কে এসেছে আর কেন এসেছে তা জানতে – এতটাই কৌতূহলী যে আমি প্রায় প্ররোচিতই হয়ে গিয়েছিলাম ডাঃ ফ্রাঙ্কলিনের মতো - তাঁর আমেরিকা ভ্রমণের সময়, সেখানকার লোকও এইরকমই বাড়াবাড়ি কৌতূহলী ছিল - একটা কাগজে লোকজন যাতে পরিদর্শন করতে পারে এমনভাবে নিজের নাম, ঠিকানা, কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাব, কী উদ্দেশ্যে ইত্যাদি লিখে রাখতে। তবে এই তীব্র কৌতূহলে যদি আমি উত্যক্ত হয়েও থাকি, লোকজনের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার আমাকে খুশি করেছে। একজন মহিলা, একা একা এসেছে, ব্যাপারটাতে তাদের আগ্রহ হয়েছিল। আর ঠিক জানিওনা যে, ক্লান্তি-অবসন্নতার জন্য আমাকে অদ্ভুতগোছের পলকা-দুর্বল দেখাচ্ছিল কিনা; কিন্তু লোকেরা আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিল, জিজ্ঞাসা করছিল আমার কিছু চাই কিনা, যেন ওদের ভয় হচ্ছিল যে আমার চোট লাগতে পারে, আর চাইছিল আমাকে রক্ষা করতে। আমার জন্য জাগরুক এই সহানুভূতি, অচেনা একটা দেশে আকাশ থেকে ঝরে পড়ার মত, ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল আমাকে। যদি আমার মনটা তিক্ত না হয়ে থাকত নানা কারণে – অতিরিক্ত চিন্তায় – ভাবতে ভাবতে প্রায় পাগলামির মত – বুকের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা একটা হালকা বিষণ্ণতার জন্য, প্রথমবার মেয়েকে ছেড়ে আসায় - তাহলে যতটা অনুভব করতাম, তার থেকে অনেক বেশি আপ্লুত হয়েছিলাম।
তুমি তো জানো আমি নিজেও নারী বলে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাটা বেশি – মায়ের স্বাভাবিক স্নেহ ও দুশ্চিন্তার থেকে আমার অনুভবটা আরও গভীর, বিশেষ করে যখন মনে হয় মেয়েদের পরমুখাপেক্ষিতা এবং দমিত অবস্থার কথা। আতঙ্ক হয় এই ভেবে যে ও হয়তো বাধ্য হবে নীতির কাছে নিজের হৃদয়াবেগকে বলি দিতে, বা হৃদয়ের কাছে নীতিকে। কাঁপা হাতে আমি চর্চা করব সংবেদনশীলতার, যতনে সাজাবো কোমল প্রবৃত্তিগুলোকে, পাছে গোলাপকে সতেজতার আভা দিতে গিয়ে আমি কাঁটাগুলোতে না শান দিয়ে ফেলি আর সেগুলো ক্ষতবিক্ষত করে আমারই সাগ্রহে আগলে রাখা হৃদয়টাকে – ওর মনকে উন্মোচিত করতে ভয় লাগে আমার, পাছে তাতে ও অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে এই জগতের, যেখানে ওকে বাস করতে হবে – হে অসহায়া নারী! হায় কী অদৃষ্ট তোমার!
কিন্তু কোথায় যেন ছিলাম? আসলে তোমাকে এটাই বলতে চাইছিলাম সাদামাটা মানুষগুলোর দয়ালু ব্যবহার আমার মধ্যে এমনই প্রভাব ফেলেছিল যে তা আমার সংবেদনশীলতাকে আরও কষ্টকর করে তুলেছিল। আমি চাইছিলাম একটা ঘর পেতে, আমার একার জন্য, কারণ ওদের যত্নুআত্তি, আর পীড়াদায়ক পর্যবেক্ষণ আমাকে প্রচণ্ডভাবে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। তবু, যখন ওরা ডিম নিয়ে আসছিল আমার জন্য, কফি বানিয়ে দিচ্ছিল, বেশ বুঝতে পারছিলাম ওদের এই আতিথেয়তার আন্তরিকতাকে আহত না করে চলে যাওয়া সম্ভব নয়।
এখানে এটাই রীতি যে গৃহকর্তা ও কর্ত্রী অতিথিদের এমনভাবে অভ্যর্থনা জানাবেন যেন তারাই বাড়ির মালিক বা মালকিন।
আরেকদিকে আমার পোশাকআষাক মহিলাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল; আমার শুধু মনে পড়ছিল ছেঁদো অহঙ্কারের কথা যার জন্য অনেক মহিলাই অপরিচিতদের এই পর্যবেক্ষণে এতটাই গর্বিত হয়ে ওঠেন যে তাদের আশ্চর্য হওয়াটাকে খুব অযৌক্তিকভাবেই মুগ্ধতা ভেবে বসেন। এই ভুলটা করতে এঁরা মুখিয়ে থাকেন; যখন বিদেশে গেলে লোকজন এঁদের পথচলার দিকে তাকিয়ে থাকে; যদিও অধিকাংশ সময়েই আকর্ষণের কারণ হয়তো টুপির কায়দা কিম্বা গাউনের বৈশিষ্ট্য, তা পরবর্তীকালে এঁদের আত্মশ্লাঘার অসাধারণ কল্পসৌধকে পুষ্ট করে।
সঙ্গে কোনও ঘোড়ার গাড়ি আনিনি, আশা করেছিলাম যেখানে পৌঁছাব সেখানে এমন কারোর সঙ্গে দেখা হবে যে চটপট একটা জোগাড় করে দিতে পারবে। ফলতঃ আমাকে আটকা পড়তে হল, আর সরাইখানার ভদ্রজনেরা তাদের চেনাজানা সক্কলের কাছে খোঁজ পাঠালেন একটা গাড়ির জন্য। শেষ অবধি একটা লড়ঝড়ে ক্যাব্রিওলে পাওয়া গেল, সঙ্গে আধা মাতাল একটা চালক, তাল বুঝে একটা ভালো দাঁও মারার জন্য সে উদগ্রীব। আমার সঙ্গে ছিলেন জাহাজের এক ড্যানিশ ক্যাপ্টেন ও তাঁর মেট। প্রথমজনকে চাপতে হবে ঘোড়ার পিঠে, আর তিনি ব্যাপারটাতে বিশেষ পটু নন, দ্বিতীয়জন বসবেন আমার সঙ্গে। চালক পিছনে বসল ঘোড়াদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আর আমাদের কাঁধের ওপর দিয়ে সবেগে চাবুক ঘোরাতে লাগল। নিজের হাত থেকে রাশ আলগা করার কষ্ট সে করবে না। নিশ্চয় আমাদের সৃষ্টিছাড়া কিছু একটা দেখতে লাগছিল, তাই যখন চোখে পড়ল দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে থাকা একটা দলের মধ্যে ভদ্রলোকের মতো চেহারার একজনকে আমি নিজের মধ্যে গুটিয়ে না গিয়ে পারলাম না। সপাং সপাং করে মহিলা ও শিশুদের একসঙ্গে ডাকতে থাকার জন্য আমি হয়তো চালকের থেকে চাবুকটা নিয়ে ভেঙেই ফেলতাম, কিন্তু যাঁর কথা এক্ষুনি বললাম তাঁর মুখে তাৎপর্যপূর্ণ একটি হাসি দেখে, আমি তুমুল হাসিতে ফেটে পড়লাম, আর উনিও যোগ দিলেন তাতে, - এবং আমরা বেগে উড়ে চললাম। কথাটা কিন্তু লেখার অলঙ্কার নয়; আমরা সত্যিই অনেকক্ষণ ধরে পূর্ণগতিতে ছুটে গেছিলাম, ঘোড়াগুলো খুবই ভালো জাতের ছিল; এর চেয়ে ভালো ঘোড়া আমি আগে কখনও দেখিনি - নরওয়ের এই ডাকের ঘোড়াদের মত; ইংল্যান্ডের ঘোড়ার থেকে শক্তপোক্ত গড়নের, দেখলেই মনে হবে ভালো খাবারদাবার পায়, আর সহজে ক্লান্তও হয়না।
জেনেছিলাম যে আমাকে নরওয়ের সবচেয়ে উর্বর আর শ্রেষ্ঠ কৃষিঅঞ্চলটা পেরোতে হবে। দূরত্বটা তিন মাইল নরওয়ের মাপে, সুইডেনের মাপের হিসেবের চেয়ে বড়। রাস্তাগুলো ভারি চমৎকার; কৃষকরাই বাধ্যতামূলকভাবে রাস্তা সারিয়েসুরিয়ে রাখে; আমরা যে গ্রামাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গেলাম তার হাল ইংল্যান্ড ছাড়ার পর থেকে এখনো অবধি যা দেখেছি তার থেকে ঢের ভালো। যদিও এখানে যথেষ্ট পরিমাণেই পাহাড়, উপত্যকা আর টিলা আছে, যাতে এলাকাটা সমতল এমন কোনও ধারণা মাথায় না ঢোকে, কিংবা ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সে যে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় সেসবের। সে সম্ভাবনা দূর করে জলভূমিগুলোও, নদী আর হ্রদ, তার পরেই গর্বিতভাবে আমার হৃদয় জয় করে নেয় সমুদ্র; রাস্তা প্রায়ই ছুটে চলেছে উঁচু উঁচু বনের ভেতর দিয়ে, যেগুলো প্রাকৃতিক শোভাকে ফুটিয়ে তুলেছে, অবশ্য ততোটা রোমান্টিক নয় যেমনটা আমি কিছুদিন আগেই উপভোগ করেছিলাম।
টন্সবার্গে পৌঁছাতে বেশ দেরি হল; একটি পরিচ্ছন্ন সরাইখানার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে স্বস্তি পেলাম। পরদিন সকালে, ১৭ জুলাই, যাঁদের সঙ্গে কাজের প্রয়োজনে এসেছি সেই ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম টন্সবার্গেই আমাকে তিন সপ্তাহ কাটাতে হবে। বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসিনি বলে দুঃখ হল খুব।
সরাইখানাটা শান্ত, আমার ঘরটাও এত আরামদায়ক, সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, রঙ্গালয়ের মতো আশপাশ ঘিরে আছে বনভূমি, ইচ্ছা করছিল ওখানেই থেকে যাই, যদিও গোটা বাড়িটায় কেউই ইংরেজি বা ফরাসি জানেনা। পুরপ্রধান, আমার বন্ধু, অবশ্য একজন অল্প ইংরেজিজানা তরুণীকে পাঠিয়েছিলেন, আর সে রাজি হল দিনে দুবার এসে আমার খোঁজ নিতে, কী লাগবে না লাগবে জেনে নিয়ে সে কথা গৃহকর্ত্রীকে জানানোর জন্য।
স্থানীয় ভাষা না জানাটা ছিল একটা চমৎকার অজুহাত আমার একা একা খাওয়ার জন্য, আর আমি ওদের খানিক বাধ্য করেছিলাম যে সেটা যাতে বেশ দেরি করেই করা যায়; সুইডেনে তাড়াতাড়ি খাওয়া সারতে গিয়ে আমার পুরো দিনটাই ভণ্ডুল হয়ে যেত। ওখানে সেটা বদলাতে পারতামও না, যে পরিবারটিতে অতিথি হিসেবে ছিলাম তাদের খরচাপাতিতে প্রভাব না ফেলে; প্রয়োজনেই বাধ্য হয়েছিলাম একটি সাধারণ পরিবারের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে, সরাইখানায় থাকাটা এতটাই অসুবিধেজনক ছিল।
নরওয়েবাসের সময় ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম নিজের সময়টা নিজের মতো করে কাটানোর। আমি ঠিকই করেছিলাম যে এমনভাবে কাটাব যাতে ওদের সুন্দর গ্রীষ্মটাকে যথাসম্ভব উপভোগ করতে পারি; - স্বল্পকালীন, ঠিকই, কিন্তু "মধুর"।
এখানকার কর্কশ জলবায়ুতে শীত কাটাতে হয়নি আমাকে; তাই এটা ঠিক উল্টো অনুভূতি না, কিন্তু মরসুমের সত্যিকারের সৌন্দর্য এই গ্রীষ্মকে আমার কাছে এখনও অবধি যা দেখেছি তাদের সবার সেরা করে তুলেছিল। উত্তুরে আর পুবের হাওয়া থেকে আড়ালে, কোনওকিছুই যার থেকে স্বাস্থ্যকর হতে পারেনা, পশ্চিমী বায়ুর সেই নরম তাজা অনুভব। সন্ধ্যায় সেটাও পড়ে আসে; পপলারের পাতাগুলোর কাঁপুনি থেমে যায়, আর শান্ত প্রকৃতি যেন চন্দ্রালোকে উষ্ণ হয়ে ওঠে, এটা একটা আরামদায়ক রূপ নেয় এখানে; আর রোদ্দুর থাকতে থাকতেই এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয়ে গেলে জুনিপার জঙ্গলের ঝোপঝাড় ছড়িয়ে দেয় বন্য সুবাস, তার সঙ্গে মিশে থাকে হাজার হাজার নাম না জানা সৌরভ, তা স্পর্শ করে হৃদয়কে, স্মৃতিতে এঁকে দেয় এমন এক ছবি যা কল্পনার কাছে মহার্ঘ হয়ে থাকবে চিরকাল।
প্রকৃতি হৃদয়াবেগের ধাত্রী - রুচির আসল উৎস - তবু কী দুর্গতি, আর উল্লাসই না হয় অপরূপ আর মহিমান্বিত কিছুকে দ্রুত প্রত্যক্ষ করলে - যখন পর্যবেক্ষণ করা হয় সজীব প্রকৃতিকে, যখন প্রতিটি রমণীয় অনুভব আর আবেগ উত্তেজিত করে সংবেদনশীল সহমর্মিতাকে, আর সমন্বিত হৃদয় ডুবে যায় বিষণ্ণতায়, বা মেতে ওঠে উচ্ছ্বাসে, তন্ত্রীতে ছোঁয়া লাগার সঙ্গে সঙ্গে, এলোমেলো বাতাসে বীণার তারে আলোড়নের মত। কিন্তু কী বিপজ্জনক এইসব অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়া অস্তিত্বের এরকম অসম্পূর্ণ দশায়, আবার কী কঠিন এগুলোকে নির্মূল করে ফেলা কারণ মানবাত্মার প্রতি অনুরাগ, ব্যক্তিবিশেষের প্রতি তীব্র আবেগ সবই আসলে সেই প্রেমেরই উন্মোচন যা ব্যাপ্ত করে থাকে যা কিছু মহান আর সুন্দর তাকে।
যখন উষ্ণ হৃদয় কোন কিছুতে প্রভাবিত হয়েছে, তাকে মুছে ফেলা উচিত নয়। আবেগ পরিণত হয় অনুভূতিতে, আর কল্পনা সতত পরিবর্তনশীল অনুভবগুলোকে স্থায়ী করে তোলে, সস্নেহে সেইসব স্মৃতিচারণ করার মাধ্যমে। একটা তৃপ্তির রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছাড়া যে দৃশ্যগুলো দেখেছি, তাদের কথা আমি ভাবতে পারি না, ভোলা যাবেনা কখনও সেগুলোকে, যে রূপ আমি অনুভব করেছি প্রতিটি স্নায়ুতে, তা আর কোনোদিনই পাবনা। সমাধিস্থ করা হয়েছে এক প্রিয় বন্ধুকে, আমার যৌবনের বন্ধু, তবু সে আমার সঙ্গেই আছে, আর আমি তার নরম মিষ্টি কূজন শুনতে পাই ঘরের কোণে গরম চুল্লির পাশে গেলে। নিয়তি আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছে আরেকজনের থেকে, যার চোখের আগুন, শিশুসুলভ স্নিগ্ধতায় নম্র, এখনও আমার হৃদয়কে উষ্ণ করে তোলে; এমনকী যখন এই প্রকাণ্ড খাড়াই পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, এক প্রশান্ত আবেগে মগ্ন হয় আমার অন্তরাত্মা। আর হেসো না, যদি বলি যে, ভোরের গোলাপি আভা আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে সঞ্চারের কথা, তা আমার অনুভূতিগুলোকে কখনোই সেভাবে মথিত করবে না, যদি না আমার সন্তানের গালদুটোতে তার পুনরাবির্ভাব হয়। ওর মিষ্টি লজ্জারুণ মুখকে আমি এখনও বুকে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখতে পারি, আর ও তো এখনও এটা জিজ্ঞেস করার পক্ষে ছোটই যে কান্না পায় কেন, এতটাই একইরকমভাবে আনন্দে আর বেদনায়?
আর লিখতে পারছিনা এখন। কাল বলব টন্সবার্গের কথা।
অনুবাদ – 'আমাদের ছুটি'