বন্য আফ্রিকায়
অরীন্দ্র দে
~ আফ্রিকার আরও ছবি ~
আমাদের ছোটবেলায় ধর্মতলার সিনেমা হলগুলোতে শুধু ইংরেজি সিনেমাই দেখানো হত। সম্ভবত সেইজন্যেই আমবাঙালি ওই হলগুলোয় ঢুকতে কিঞ্চিৎ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। আমার সাহেবি মনোভাবাপন্ন বাবার সঙ্গে 'টুথ এন্ড ক্ল' বলে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। তখন থেকেই আফ্রিকা, বিশেষত পূর্ব আফ্রিকা আমার স্বপ্নের দেশ। বানিজ্যের ছাত্র হিসেবে জানি পূর্ব আফ্রিকা মানেই দারিদ্র্য, দুর্নীতি, ভঙ্গুর আইন শৃঙ্খলা। তবু এ সবের মধ্যেই, বাঁচার আনন্দে, কৃষি আর পর্যটনকে ধরে বেঁচে থাকা। কেনিয়া বা মোজাম্বিকে চলতে ফিরতে রাস্তা ঘাটে যখন তখন ছিনতাই হবার প্রভূত সম্ভাবনা, সম্ভাবনা পুলিশের হাতে পর্যটকদের হেনস্থা হওয়ার। স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রায় কেমন যেন একটা হচ্ছে হবে, হলেও হয়, না হলেও ক্ষতি নেই ভাব। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে দরকার বিনিয়োগ, কিন্তু কেই বা তা আনে!
তবু...... আমরা দশজনে পথে, অথবা আকাশেও বলতে পারেন - গন্তব্য কেনিয়ার নাকুরু হ্রদ, মাসাইমারা আর আম্বসেলি, আর তানজানিয়ার ঙ্গুরুগুরু।
১০ অগস্ট ২০১৩, মুম্বাই থেকে নাইরোবি। পৌঁছেই সটান নাকুরু হ্রদ, মোটে পাঁচ ঘণ্টার পথ। উদ্দেশ্য ফ্লেমিঙ্গো, পেলিক্যান, স্টর্ক, বক আর গণ্ডার, সিংহ, মোষ, বেবুন দেখা। অবস্থিতি পার্কের মধ্যের একমাত্র হোটেলে, নাকুরু গেস্ট হাউসে। সেখান থেকে মাসাইমারা, আমাদের মূল দ্রষ্টব্য। নারোক শহর পেরিয়ে মোটে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার পথ। সেখানে দেড় দিনের দুর্দান্ত সাফারি। আমাদের জঙ্গলের ধারণার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মেলে না, প্রায় ফাঁকা মাঠ, মধ্যে মধ্যে মাথা তুলে জেগে থাকা দুয়েকটি গাছ; তাও সে আমাদের চেনা মহীরুহসদৃশ নয়। তবু চোখ জুড়োয়। মাসাই উপজাতি এই জঙ্গলের মালিক, আর সেই থেকেই মাসাইমারা নাম। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাসাইদের গ্রাম। মাসাইদের সমৃদ্ধি তথা সামাজিক অবস্থান নির্ভর করে কার কটা গরু তাই দেখে। বন্যপ্রাণও ছড়িয়ে ছিটিয়ে - অজস্র। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি অবস্থা! সিংহ-চিতা-মোষ-বেবুন-বাইসন-জেব্রা-জিরাফ-জলহস্তী-উটপাখি... আর পাখির তো কোন সীমা পরিসীমা নেই।
এর মধ্যেই একজন তো ডেকে নিয়ে গিয়ে গায়ে পড়ে ব্ল্যাক মাম্বা (Dendroaspis polylepis), বিশ্বের দীর্ঘতম বিষধর প্রজাতির সাপ, দেখিয়ে দিল। আমাদেরটা ফুট সাতেকের ছিল, তবে নাকি এর চেয়েও লম্বা হয়। আর নাম ব্ল্যাক মাম্বা হলেও এর রং মোটেই কালো নয়, বরং সবজেটে বাদামি বললে কাছাকাছি আসে। এর মুখগহ্বর আলকাতরার মত কালো, আর তাই থেকেই এই নাম।
তবে এখানকার প্রধান আকর্ষণ পশুপক্ষীর মাইগ্রেশন। দলে দলে প্রাণীরা তানজানিয়ার দিক থেকে এসে মারা নদী পেরিয়ে এই জঙ্গলে ঢোকে; একমাস পরে ওইপথেই ফিরে যায়। তাই জুলাই অগস্ট এই অরণ্যে দর্শনার্থীদের জন্য মধুমাস। শীতকাল শেষ, তবু সকাল সন্ধ্যা হিমঠাণ্ডা, বাতাসে কাঁপুনি। আর দুপুরগুলোয় সূর্যের অকৃপণ দাক্ষিণ্য যেন জ্বালিয়ে দেয় মাঠঘাট। দুরাত সেখানে কাটিয়ে আম্বোসেলি, দশ ঘণ্টার পথ। সেখানেও দুরাত, কিবো সাফারি ক্যাম্পে;পটভূমিতে হেমিংওয়ের মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো। আম্বোসেলির খ্যাতি প্রধানত হাতিতে, সঙ্গে চিতা, জিরাফ আর উটপাখি। আফ্রিকার হাতি (African bush elephant, Loxodonta Africana) আমাদের ভারতীয় হাতি (Asiatic elephant: Elephas maximus) র চেয়ে আকারে বড় এবং দুর্বিনীত, এরা পোষ মানে না। কপাল ভালো থাকলে হোটেলে বসেই হস্তীদর্শন হতে পারে, নচেৎ জঙ্গলের মধ্যে টিলার ওপরে ভিউপয়েন্টে।
শেষ গন্তব্য তানজানিয়ার ঙ্গুরুগুরু, নাইরোবি থেকে তিন ঘণ্টায় নামাঙ্গা, সীমান্ত পেরিয়ে গাড়ি বদলিয়ে ঙ্গুরুগুরু আরও চার ঘণ্টার পথ। Ngorongoro Conservation Area (NCA) ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। তার মধ্যে দিয়েই সাফারির গমনপথ। ফ্লেমিঙ্গো,সিংহ, উটপাখি, হায়না অধ্যুষিত। আমরা ছিলাম ওয়াইল্ড লাইফ লজ-এ, জ্বালামুখের গায়েই। সেখান থেকে নাইরোবি হয়ে মুম্বাই, স্মৃতির ঝুড়ি বয়ে।
~ আফ্রিকার আরও ছবি ~
ভ্রমণ শুধুমাত্র নেশা বা ভালোলাগা নয়, ওইটাই জীবন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মী অরীন্দ্র দে-র কাছে। ভালোবাসেন পাহাড়ে চড়তেও। একাধিক হাই অল্টিচ্যুড ট্রেকের অভিজ্ঞতা রয়েছে। মাউন্ট ভাগিরথী-(২) সফল অভিযানটির সদস্য ছিলেন। ছবি তুলতে ভালোবাসেন। স্বপ্ন দেখেন জীবনে একটারাত অন্তত স্পেস স্টেশনে কাটানোর।