হঠাৎ দেখা ভোজপুর
অতীন চক্রবর্তী
ভ্রমণ পিপাসু মানুষ নেশার টানে ছুটে বেড়ায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে - 'হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনখানে...' কারোর সঙ্গে রয়েছে ভ্রমণসূচী - বাঁধাধরা আকর্ষণীয় নানা ট্যুরিস্ট স্পটের বিবরণ বা বিভিন্ন ভ্রমণার্থীদের অভিঞ্চতার কথা। কিন্তু এর বাইরেও আনাচে-কানাচে রয়েছে কত গোপন রত্নভান্ডার - যা বেশিরভাগ ভ্রমণ তালিকায় উপেক্ষিত। তেমন কিছুর সন্ধান পেলে কত অজানাকেই না জানা হয়ে যায়।
দৈবক্রমে এই রকম এক লুকোনো সম্পদের খোঁজ পেয়েছিলাম আমরা ডঃ গিরিজা প্রসাদের কাছ থেকে। ভূপালের সেই বিখ্যাত আপার লেকে আলাপ হয়েছিল ডঃ প্রসাদের সঙ্গে। পেশায় তিনি একজন আর্কিওলজিস্ট। কাজের জন্য প্রায়ই তাঁকে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়। মধ্যপ্রদেশের উপেক্ষিত অনেক লুপ্ত প্রাচীন শিল্পকলা-স্থাপত্যবিদ্যা-সভ্যতার খোঁজে সঙ্গীদের নিয়ে ছুটে বেড়ান বিভিন্ন ভগ্ন ধ্বংসস্তূপে। বেতোয়া নদীর দক্ষিণ কূলকে কেন্দ্র করে আশেপাশের অনেকটা অঞ্চলের নতুন কিছু প্রাচীন তথ্য সংগ্রহ করবার আশায় এদিকে আবার এসেছেন। এই বেতোয়া এককালে বৈত্রাবতী নামে পরিচিত ছিল। এইখানেই একসময়ে পরমারা বংশের রাজা ভোজ গড়ে তুলেছিলেন ভোজপুর শহরটি।
এইসব কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, "আপনারা কি ট্যুরিস্ট, এদিকে বেড়াতে এসেছেন? কোন কোন জায়গায় ঘুরলেন?"
উত্তরে জানাই, "ঠিক ট্যুরিস্ট না, সেমি-ট্যুরিস্ট বলতে পারেন। আমার কোম্পানির একটা কাজ কয়েকমাস ধরে এখানে চলছিল। আজই শেষ হল। তবে তারই ফাঁকে ফাঁকে দুজনে ঘুরে এসেছি ভীমবেটকা,পঞ্চমারী, ইন্দোর, উজ্জৈন - এইসব।"
"অথচ এখান থেকে এত কাছের ভোজপুরের কথা আপনাদের একবারও মনে পড়েনি? এই যে আমরা ভূপালের আপার লেকের পাশে দাঁড়িয়ে আছি,এর থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে এককালে গড়ে উঠেছিল ভোজপুর শহর। পরমারা বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন রাজা ভোজ। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ভোজ ছিলেন সাহিত্য, শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। এই লেকটা ছিল সেই সময় তাঁরই অতুলনীয় অবদান। তখন থেকেই এটা ভূপালের সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। সেই ১১শ শতকেই ভোজ রাজা ভোজপুর শহরকে আকর্ষণীয় করে তুলবার জন্য অনুরূপ একটি ৪০০ স্কোয়ার কিলোমিটার লেক গড়ে তুলেছিলেন সেখানে। নাম ভীমতাল। দুপাশের দুটো প্রকৃতির অবদান পাহাড়কে ব্যবহার করেছিলেন ন্যাচারাল ওয়াল হিসাবে। আর এদের মাঝে যে অংশটুকু ফাঁকা পড়েছিল তাকেই ড্যাম বানাবার উপযুক্ত অংশ হিসাবে নিয়েছিলেন। ছোট আর বড় ফাঁকা অংশটুকু যথাক্রমে ১০০ ও ৫০০ গজের মতো চওড়া হিসাবে পেয়েছিলেন। মাটির বাঁধ বানিয়ে বেলেপাথরের বড় বড় ব্লক দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল একে। এই প্রাচীন ড্যাম সম্বন্ধে জানা যায় - এই Cyclopean Dam এ কোন মর্টার ব্যবহার করা হয় নি। ১০০ গজের ফাঁকটা বন্ধ করতে ২৪ ফুট উঁচু আর ১০০ ফুট চওড়া বাঁধ বানানো হয়েছিল আর ৫০০ গজের বড় অংশটার জন্য ৪৪ ফুট উঁচু আর ৩০০ ফুট চওড়া বাঁধ, এখন থেকে হাজার বছর আহে এই রকম একটি প্রকাণ্ড আকৃতির ড্যামের কনস্ট্রাকশন সত্যি অভাবনীয়। আর তারই পাশে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন বিশ্বের উচ্চতম এক শিবলিঙ্গের মন্দির, - ভোজেশ্বর মন্দির, যাকে বলা হয় সোমনাথের আরেকটি "নামমালা" বা পরিভাষা। যদিও গর্ভগৃহের কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল,তবু ১১শ-১৩শ শতাব্দীর মন্দির স্থাপত্যের এও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নিজে না দেখলে এ শিল্পের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করা যায় না। এই ড্যাম আর মন্দিরের প্রধান অবদান যে ভোজরাজার,তিনি যে সত্যিই শিল্প, স্থাপত্য আর শিক্ষার প্যাট্রন ছিলেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা কাল ওদিকেই যাব, যদি সকাল সকাল রেডি হতে পারেন তবে আমাদের সাথে যেতে পারেন।"
"এ সুযোগ কি হাত ছাড়া করা যায় বলুন! আচ্ছা, ড্যাম বানাবার কারণ না হয় বোঝা যায়, কিন্তু রাজা ভোজ নগর থেকে দূরে হঠাৎ এই ভোজপুরের মতো অতি সাধারণ নাম না-জানা গ্রামে এত বড় শিব মন্দির বানাবার কি যুক্তি পেয়েছিলেন? এখানে কি আগেই কোনও শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?" - আমার গিন্নি ডঃ প্রসাদের কাছে জানতে চান।
"প্রাচীন যত দেবদেবীর মন্দির পাবেন, দেখবেন তাদের বেশিরভাগের সাথেই কোনও না কোনও কাহিনি-গল্প-গাঁথা জুড়ে থাকেই। হয়তো কোনও স্বপ্নাদেশ বা কোনও অলৌকিক কাহিনি এই রকম কিছু না কিছু ঘটনা জড়িয়ে থাকে এইসব মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে। তার সত্যি-মিথ্যার বিচার নিয়ে ভক্তরা কতোটুকুবা মাথা ঘামায়? আসলে কী জানেন ভক্তের ভক্তি-বিশ্বাসই প্রাধান্য পায়, যুক্তি-তর্ক তোলা থাকে ঐতিহাসিক বা গবেষকদের জন্য। এইরকমই ভোজপুরের স্থানীয় গল্প-গাঁথায় বলা হয়, রাজা ভোজের ভোজেশ্বর মন্দির স্থাপনের অনেক আগেই এখানে নাকি একটি শিব মন্দির ছিল যা পান্ডবেরা আত্মগোপনের সময় এসে বানিয়েছিলেন। অবশ্য এই রকম এক বিরাট জলাশয়কে পাশে রেখে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা শান্ত পরিবেশে যে বিশাল মন্দিরটি ভোজ রাজা গড়তে চেয়েছিলেন তা নিশ্চয় প্রশংসার দাবি রাখে। কালকে ওখানে গেলে তা আপনারাও অনুভব করবেন। এবার চলুন হোটেলে ফেরা যাক, আমাকে একটু কালকের কাজের প্রস্তুতি নিতে হবে।"
ডঃ প্রসাদের মুখে এত শোনার পর আমাদের মন চঞ্চল হয়ে উঠল ভোজেশ্বর মন্দির আর ড্যামটা দেখবার জন্য। এক দিকে ধর্ম, অপর দিকে ড্যাম আর মন্দিরের শিল্প-স্থাপত্যের আকর্ষণ। এ ছাড়া প্রকৃতির সৌন্দর্যের হাতছানি। পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ওঁদের সঙ্গে। টাটা সুমো ছুটে চলল ঘিঞ্জি শহর পেরিয়ে। যেতে যেতে এক সময় রাস্তার এক ধারে দেখে নেওয়া শ্রী মহাগণেশজী মন্দির। এরপর আবার গাড়ি ছুটে চলল ন্যাশন্যাল হাইওয়ে-১২র ওপর দিয়ে। কোলাহলমুখরিত শহরের বাইরে এসে পেয়ে গেলাম প্রকৃতির দান রম্যাণী দৃশ্যাবলী। ভোরের আলোতে আকাশ-বনরেখা-পাহাড় সব মিলে এনে দিয়েছিল এক চোখভরা-মনছোঁয়া আনন্দের খোরাক।
"আমরা কি প্রথমে ড্যাম দেখতে যাব, না কি মন্দির আগে দেখব?" - জানতে চাইলাম ডঃ প্রসাদের কাছে।
"সবই তো পাশাপাশি। তবে কি জানেন সেই অপূর্ব ড্যাম তো আজকাল আর আগের মতো নেই। হোসেন শার আদেশে এই ড্যামকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। প্রচলিত কাহিনিতে জানা যায় এর জল খালি করতে তিন মাস সময় নিয়েছিল। তবে যেটুকু দেখতে পাবেন তাতেই ভোজ রাজের প্রতি আপনাদের শ্রদ্ধা এসে যাবে। আমি কিন্তু পুরো সময় আপনাদের দিতে পারব না। আপনাদের নামিয়ে আমি আমার কাজের জায়গায় চলে যাব, বিকেলে আবার আসব আপনাদের তুলে নিতে। তবে যাবার আগে এই মন্দির তৈরি করার কাজ আরম্ভ করবার আগে এরা যে পুরো একটা মাস্টার প্ল্যান রকের ওপর নকশা খোদাই করে নিয়ে কাজে নেমেছিল সেটা দেখাতে নিয়ে যাব। এতে দেখতে পাবেন মন্দির বানাবার ডিটেলস ড্রয়িং,যা আধুনিক যুগের যে কোনও Erection Commission-এর মাস্টার প্ল্যানের সাথে তুলনীয়। এতে রয়েছে টেকনিক্যাল প্ল্যান, এলিভেশন ভিউ যাতে দেখতে পাবেন মন্দিরের প্রতিটি বিগ্রহ, স্তম্ভ, গম্বুজ, খিলান, যোণিপট্টসহ বৃহৎ শিবলিঙ্গের অবস্থানের প্রকৃত দিশা। এখন অবশ্য অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে বাকি খোদাই করা রকটা রেলিং দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে, যাতে এর উপর দিয়ে লোকেরা আর চলা ফেরা না করতে পারে।"
"অবাক হয়ে গেলাম আপনার এই কথা শুনে, - ১০-১১শ শতাব্দিতেও কত সিস্টেমেটিক ছিল ভারতের টেকনিক্যাল টিম!"
গল্পে গল্পে কখন যে ভোজপুর রোডে গাড়ি উঠে পরেছিল খেয়াল করিনি। গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, হঠাৎ নজরে এল দূরে ঢেউ-খেলানো ছোট্ট পাহাড়, যার ওপরে দেখা যাচ্ছে একটি লাল গ্রানাইটের তৈরি বিপুল স্ট্রাকচার। প্রথম দর্শনেই এর বৃহদায়তন সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ রইল না। দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে এসে থামল মন্দির থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ছোট্ট গ্রাম, কিন্তু তারি মাঝে এই মন্দিরকে ঘিরে আশেপাশে কতোগুলো দোকান জেগে রয়েছে। পুজোর সামগ্রী সেখানেই মেলে।
ডঃ প্রসাদ প্রথমেই আমাদের নিয়ে এলেন রকের ওপর খোদাই করা মাস্টার প্ল্যান দেখাতে। যে কোনও কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি এটি দেখে সেই ১১শ শতকের টেকনিক্যাল টিমকে সেলাম না জানিয়ে পারবেন না। খোলা আকাশের নীচের এই নকশা এত বছর ধরে পড়ে থেকে অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক জায়গার রেখাগুলো এখন অস্পষ্ট। চারপাশে নজরে আসবে পাথরের খাদ যা হয়ত এককালে পুরো জলে ভরা থাকত। দূরে ছোট গ্রামের মতো রয়েছে। নদীতে যে জল রয়েছে তাতেই নৌকা করে ওপারে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত রয়েছে। ওপারে গিয়ে পার্বতীগুহা অনেকে দেখতে যায়। তবে গাড়ি করে রাস্তা দিয়েও যাওয়া যায়। সামনে তাকালে দৃষ্টিগোচর হবে পশ্চিম দিকে মুখ করে দন্ডায়মান ভোজেশ্বরের সেই বিশাল মন্দিরটি। এত বড় মন্দির দেখে নয়ন জুড়িয়ে যাবে পর্যটকদের। পরে স্থানীয় একজন লোকের কাছে জানতে পেরেছিলাম মোটামুটি ১০৬ ফিট লম্বা আর ৭৭ ফিট চওড়া এই মন্দিরের সাইজ।
এরপর ডঃ প্রসাদ আমাদের মন্দিরের কাছে নিয়ে এলেন সুন্দর একটি বাগানের ভেতরের পথ দিয়ে।
"আমি আপনাদের কিছুটা দেখিয়ে দিচ্ছি। বাকিটা ডিটেলসে পরে নিজেরা দেখে নেবেন। মন্দিরের সামনের দিকটা শিল্প-কারুকার্যে ভরা বিভিন্ন মূর্তিতে সজ্জিত,যা অত্যুৎকৃষ্ট ভাস্কর্যনিদর্শনবাহী। বাকি তিনদিকে রয়েছে ব্যালকনি যা সুন্দর সব ব্র্যাকেট আর চারটি সুন্দর থাম্বার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের পেছন দিকে এই যে উঁচু মাটির টিলা বা র্যামপার্ট দেখতে পারছেন এটি এত উঁচু মন্দিরের ওপর পর্যন্ত বড় বড় পাথরের ব্লক তোলার জন্য ব্যবহার করা হত। জানা গেছে এই শিবলিঙ্গের প্ল্যাটফর্মটি বানাবার জন্য প্রায় ৭০ টন ওজনের একটি পাথরের স্ল্যাব তখনকার দিনে এর সাহায্যে ওপরে তোলা হয়েছিল। প্রাচীন ভারতের এই পদ্ধতিতে অতো উঁচুতে মাল তোলা আজ আমাদের ভাবতে অবাকই লাগে! আমাকে এবার আমাদের কাজের জায়গায় যেতে হবে। স্থানীয় লোকের সাহায্য নিয়ে বাকীটা আপনারা দেখে নিন। আবার বিকালে দেখা হবে।"
এগিয়ে চললাম প্রধান মন্দির চত্বরের দিকে। অসমাপ্ত মন্দিরের প্রতি অংশের শিল্প-কারুকার্য পর্যটকদের কাছে চির আদরিণীয়। প্রথমেই নজরে এল নন্দীর স্ট্যাচু। মুখের সামনের কিছুটা অংশ ভাঙা। মন্দিরের দিকে মুখ তুলে বসে রয়েছে। মন্দিরের প্রবেশ দরজার ফ্রেমের সাইজ মোটামুটি ১০মি উঁচু ৫মি চওড়া। দরজার দুপাশে রয়েছে দেবী গঙ্গা-যমুনার অপূর্ব খোদাই করা স্ট্যাচু। চোখে পড়ল উমা-মহেশ্বর, লক্ষ্মী-নারায়ণ, ব্রহ্মা-সাবিত্রী, রাম-সীতার খোদাই করা মূর্তিগুলো। সিঁড়ি দিয়ে গর্ভগৃহে নেমে এলে বোঝাই যায় এখানকার কাজ অসম্পূর্ণই রয়ে গিয়েছিল। রাজা এই অবস্থায় কাজ বন্ধ করেছিলেন কেন,আজও তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। এত বিশাল শিবলিঙ্গ দেখে অবাক না হয়ে থাকা যায় না। একটি মাত্র পাথরের ব্লকে তৈরি এই লিঙ্গ। যোণিপট্ট নিয়ে লিঙ্গটি ২২ফিটের মত উঁচু। তাই এখানে এসে শিবের মাথায় ফুল-বেলপাতা চড়ানো যাবে না। মন্দিরের বাইরে ঠিক সামনের দিকে ছোট মন্দিরে পুজোর ব্যবস্থা রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহের ভেতরের ছাদের কারুকার্যও দৃষ্টিনন্দন। পাথরের ওপর শিল্পীর অপূর্ব এই হাতের কাজ চিরদিন মনে থাকবে। সিলিং-এর বেশ কিছুটা অংশ ফাইবার গ্লাস দিয়ে সাজানো রয়েছে। বহু বছর আগে ছাদের বিরাট ওই অংশটা ভেঙে এসে যোণিপট্টকে দু টুকরোতে বিভক্ত করেছিল। এরপর বছরের পর বছর আকাশের দিকে খোলাই রয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য যোণিপট্টকে জুড়ে দেওয়া হয় আর ফাইবার গ্লাস দিয়ে ছাদের ভগ্ন অংশটুকু আটকানো হয়। চারটি বিশালাকৃতি স্তম্ভের ওপরে অনবদ্য শিল্প কারুকার্যে খোদিত গম্বুজটি সবারই প্রশংসা পেয়ে চলেছে আজও। ভেতরে আলোর অত আড়ম্বর নেই। তবুও দুপুরের সূর্যের আলোটুকু এই গম্বুজের ভেতর দিয়েই কিছুটা উজ্জ্বল করে রেখেছে মন্দিরের ভেতরটা।
বেরিয়ে এসে এবার চললাম নদীর দিকে। চারদিকে ছোট-বড় নানা সাইজের পাথর ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। এইসব পরিত্যক্ত ভগ্ন অনেক পাথরের ভেতর আজও দেখতে পাওয়া যায় তখনকার শিল্পীদের অসমাপ্ত খোদাই-এর কাজ। নদীর ওপর দিয়ে স্থানীয় লোকদের ছোট ছোট নৌকায় ঘুরে দেখে আসা যায় ভোজ রাজার অতুলনীয় কীর্তি সেই ড্যামের ক্ষত-বিক্ষত ভগ্নাবশেষ। চারদিকে নিস্তবদ্ধতা বিরাজ করছে। এইসব পাথরের ফাঁক দিয়ে দূরে যতটা দৃষ্টি যায় প্রকৃতির সবুজ বনরেখা মন ভরিয়ে দেয় এই ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। ভোজপুর দেখার প্রকৃত আনন্দ পাওয়া যায় বর্ষার পর। এই সময় একদিকে যেমন নদীতে জল অপর দিকে প্রকৃতিদেবী সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে সবাইকে আহ্বান করে। নৌকাতে বসে দূর থেকে মন্দিরের দৃশ্য যেন পটে আঁকা এক অপূর্ব চিত্র।
ভোজেশ্বর মন্দির ছাড়াও ভোজপুরে দেখার রয়েছে পার্বতী গুহা, জৈন মন্দির, ভোজ রাজাদের প্রাসাদের ভগ্নস্তূপ। মন্দির কমপ্লেক্স থেকে এবার আমরা বিশাল বিশাল সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। অনেকটা হেঁটে তবে রাস্তার ধারের দোকানগুলোর কাছে পৌঁছালাম। সাইনবোর্ডটা এতক্ষণে নজরে এল "১০ম শতাব্দীর শিব মন্দির" ইত্যাদি। শিব মন্দিরের উল্টোদিকে আর পশ্চিম দিকে বেতোয়া নদীর মুখোমুখি রয়েছে কালো পাথরের ছোট পাহাড়। চারপাশে সবুজে ঘেরা।
বাইরে থেকে কারো বোঝার সাধ্যি নেই যে এই পাহাড়ের ভেতর ঢাকা রয়েছে পার্বতী দেবীর মন্দির। ভোজেশ্বর মন্দির থেকে কিছুটা হেঁটেই এখানে আসা যায়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একে-বেঁকে রেলিং ঘেরা সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে। নামতে নামতে প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। সিঁড়ির ওপর থেকেই নদীর দৃশ্য চোখে পড়ে। সিঁড়ির শেষে রয়েছে পার্বতীগুহা মন্দিরের লম্বা চত্ত্বর। এক ভক্ত পরিবারই এই স্থানে থেকে দেবীর পুজোআচ্চা নিয়মমত করেন। এছাড়া এখানকার গণেশজীর মূর্তিটিও বেশ সুন্দর। পার্বতীগুহার গঠন প্রণালী এমন ভাবে করা হয়েছে যে সহজে বাইরে থেকে এখানে আক্রমণ করা যাবে না। ১১শ শতকের এই ভাস্কর্য-বিদ্যা প্রশংসার দাবি রাখে।
এরই কাছে রয়েছে ভোজ রাজাদের প্রাসাদের পরিত্যক্ত ফাউন্ডেশনটুকু। এই সুন্দর প্রাসাদকে কোনদিনই রক্ষা করে রাখার চেষ্টা করা হয়নি। বরং এখান থেকে নানাকিছু তুলে নিয়ে অনেকেই তাদের আধুনিক ঘরবাড়ি বানাতে ব্যবহার করেছে। এরপর আবার সেই দোকানগুলোর কাছে ফিরে এলাম। দূর থেকে ভোজেশ্বর মন্দিরকে দেখতে দেখতে কেন জানিনা মনে হল এই বর্গাকার মন্দিরটির সঙ্গে হিন্দু স্থাপত্য ছাড়াও বেশ মিল রয়েছে গ্রীক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পচিহ্নাদির।
একটু পরে ডঃ প্রসাদ এসে গেলেন। ওনার সঙ্গে ভোজপুরের আরেক আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য জৈন মন্দিরের দেখতে চললাম। প্রাচীনকালে ভোজপুর ছিল ভারতের সংস্কৃতি-শিল্প, প্রত্নবিদ্যা-স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সমন্বয়ের এক আদর্শ নগর। এই জৈন মন্দিরও তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে ভোজেশ্বর মন্দিরের মতো এর কাজও অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে। ২০ ফিট লম্বা চতুর্বিংশের শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের স্ট্যাচুই হোল এই মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া রয়েছে পার্শ্বনাথের মূর্তি, শ্রীমানতুঙ্গের মন্দির আর তাঁর সিদ্ধি লাভের সেই নির্বাণ রক বা সিদ্ধ শিলা। সুন্দর-পরিষ্কার আয়তক্ষেত্রাকার এই জৈন মন্দিরটির কারুনৈপুণ্যতা সত্যি দেখবারই মতো।
১০-১১শ শতকের নির্মিত ভোজপুরের এই ভোজেশ্বর মন্দির, জৈন মন্দির,বা পার্বতী গুহার নিখুঁত গঠন ও আলংকারিক শিল্প কারুকার্য সে যুগের ভাস্কর্য শিল্পের উৎকর্ষের পরিচয় আজও বহন করে চলেছে।
সূর্য প্রায় অস্তাচলে, - এবার ফেরার পালা। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন বারবার আসছে - কেন ওই সময় ভারতের এই অমূল্য কাজগুলো সমাপ্ত করা হল না! ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় ১০৬০ সালের পর পরমারার গৌরবান্বিত অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। কল্যাণী ও গুজরাটের চালুক্যরা আর কালচুরি বংশের লক্ষ্মী-কর্ণ-এর মিলিত শক্তি রাজা ভোজের রাজধানী আক্রমণ করে। সেই রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধে রাজাকে প্রাণ হারাতে হয়। হয়ত এরপরই শেষ হয়ে যায় তাঁর সমস্ত শিল্প স্বপ্ন। যতটুকু বা উনি করে গিয়েছিলেন,তাও বছরের পর বছর অযত্নে অনেকটাই হারিয়ে গেছে কালের সমাধিতলে। এখন অবশ্য মন্দিরের রক্ষার ভার রয়েছে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ওপর।
যুদ্ধে সেদিন রাজা ভোজ হারিয়েছিলেন তাঁর পার্থিব রাজমুকুটটি, কিন্তু তাঁর গৌরবময় কীর্তিভরা এই ভোজপুর মানুষের গল্প-গাঁথায় আরেক উজ্জ্বল মুকুটের মতোই শোভা পাবে চিরদিন।
অবিভক্ত ভারতের রাজশাহী জেলার নওগাঁতে জন্ম অতীন চক্রবর্তীর। সরকারি পেশা এবং ভ্রমণের নেশার টানে ঘুরেছেন ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লিখছেন। সাহিত্যক্ষেত্রে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কারও।