দাঁতনে -বুদ্ধদন্তের খোঁজে

তপন পাল

(১)

মন যাই যাই। পর পর পাঁচদিন ছুটি মার্চের শেষে, আর আমি ঘরে বসে বসে ডুগডুগি বাজাব তা তো হতে পারে না। দূরে কোথাও না হোক অন্তত কাছেপিঠে, এই ধর দিঘা। এই অবধি গিয়েই থামতে হল, কারণ অর্ধাঙ্গিনীর প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, বছরে কতবার দিঘা যেতে হয়? এ প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না। নিরুত্তর রইলাম।
আপত্তির প্রথমতম ও প্রধানতম কারণ - গ্রীষ্ম। যেন ভারতবর্ষে গ্রীষ্ম এই প্রথমবার এল। তাছাড়া দোলের দিন বিমানবন্দর থেকে পুত্রকে আনতে হবে, ওদিন ড্রাইভার পাওয়া যাবে না। তারপর আজ এই কাল ওই তো লেগেই আছে। তাহলে কোথায় যাওয়া যেতে পারে, স্বল্প দূরত্বের মধ্যে, সকালে বেরিয়ে বিকেলে ফেরা যাবে এমন কোনও জায়গা?
ভেবেচিন্তে একটা জায়গার কথা মনে পড়ল - দাঁতনের বৌদ্ধ বিহার-এর ধ্বংসাবশেষ ও তার সাম্প্রতিক উৎখননস্থান। খবরের কাগজে মধ্যে-মধ্যেই পড়ছিলাম। অনেকদিন ধরে যাব যাবও করছিলাম। কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠছিল না, প্রধানত সঠিক পথনির্দেশের অভাবে। তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে শেষে একাকী বেরিয়ে পড়া গেল শনিবার ছাব্বিশে। সকাল সকাল বেরিয়ে খড়্গপুর। সেখান থেকে ৯-২৫ এর ৬৮০২১ খড়্গপুর বালেশ্বর মেমু ধরে হিজলি, বেনাপুর, নারায়ণগড়, বাখরাবাদ, বেলদা হয়ে, কেলেঘাই ব্রহ্মচারী পেরিয়ে, সোয়া দশটায় নেকুরসেনি। ষ্টেশনটি ছোট, সারাদিনে কয়েকজোড়া রেলগাড়ি মোটে থামে। তিনটে প্ল্যাটফর্ম, চারটে লাইন, আর সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে মস্ত মস্ত গাছ। এই শেষ বসন্তে সেখানে লাল আর হলুদের যুদ্ধ চলছে যেন। মধ্যস্থতা করার জন্য তারই মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ সাদা। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

(২)

দাঁতনের ইতিহাস বর্ণাঢ্য। একদা এ অঞ্চল ছিল ওড়িশার গণপতি রাজাদের করদ রাজ্য হিজলি রাজের অন্তর্গত। জগন্নাথ সড়কের ওপরে হওয়ায় তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে সবসময় জমজমাট। কলকাতা-পুরী জগন্নাথ সড়ক ১৭০০ সাল থেকেই মোটামুটি রূপ নিতে থাকে। ১৮২৫-এ গিয়ে এর নাম হয় ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড, কিন্তু পুরনো নাম চলতেই থাকে। রাস্তার দুধারে গজিয়ে উঠতে থাকে তীর্থযাত্রীদের পরিষেবা প্রদানকারী ব্যবস্থাদি – ধর্মশালা, সরাইখানা, দিঘি, সেতু, ঘাট। চৈতন্যদেব, নানক, কবির এই পথ দিয়েই জগন্নাথ দর্শনে গিয়েছিলেন। মারাঠারা, পরে ইংরেজ, রক্ষনাবেক্ষণের জন্য এই পথে টোল বসায়। ১৮৯৭-এ পুরী রেলস্টেশন চালু হলে এই পথ গুরুত্ব হারায়। তবু সড়কের ধ্বংসাবশেষ উৎসাহীর চোখে আজও ধরা দেয় - ৫১০ কিলোমিটার পথের মধ্যে ১৬৮ কিলোমিটার পথ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়। ১৭৭১-এ ব্রিটিশ খাজনার খতিয়ানে দেখছি দাঁতন সরকার জলেশ্বর-এর এক পরগনা। মোগলমারির বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত ২০০২-এ, কিন্তু মৌখিক ইতিহাস দাবি করে যে দাঁতন নামের উৎসমুখ দন্ত, কারণ ওই মহাবিহারে শাক্যমুনির দন্ত রক্ষিত হয়েছিল।
পদসেতু পেরিয়ে বাইরে। জাতীয় সড়ক, মতান্তরে জগন্নাথ সড়ক তথা ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড পাশ দিয়েই। কোনরকম যানবাহনের দেখা যখন মিললই না, হাঁটা ছাড়া আর গতি কি! আর হাঁটতে আমার কোন আপত্তি কোনকালেই নেই। বাঁয়ে জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা হেঁটে মোগলমারি মোড়। সেখান থেকে ডাইনে ঘুরে গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে মোটামুটি তিনশো মিটার হাঁটলেই বৌদ্ধ বিহারের সাম্প্রতিক উৎখননস্থান। উৎখননের কাজ চলছে।

(৩)

আমাদের মধ্যে যারা সুবোধ ঘোষের কিংবদন্তীর দেশে পড়েছি,তাদের সখিসেনার সঙ্গে পরিচয় আছে। সুবোধবাবু দেখে যেতে পারলেন না, পাঠশালার সেই ঢিবিতে খোঁড়াখুঁড়ি করে পরবর্তী প্রজন্ম খুঁজে পেয়েছে খ্রীষ্টিয় ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত চালু থাকা এক বৌদ্ধ মহাবিহার, এক জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। লোকায়ত কৌম জনবিশ্বাস ও মৌখিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতার এক অনন্য অভিজ্ঞান।
মহাবিহারটির উৎখনন ও প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্যই আন্তর্জালে প্রাপ্তব্য। আমি শুধু এইটুকুন বলে থামি যে ওখানে দাঁড়িয়ে আমি এই ভেবে শিহরিত হচ্ছিলাম যে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, তের শতক আগে এইখানেই দাঁড়িয়ে এক শ্রমণ উচ্চারণ করেছিলেন 'পনতিপতত ভেরামানি সিকখাপদম সমাদিয়ামি' - আমি জীবন বিনষ্ট না করিবার অঙ্গীকারবদ্ধ।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় উৎখননের কাজ চলছে। একটু খুঁটিয়ে দেখলে পুরনো ইটের স্তরবিন্যাস নজরে আসে। মস্তিষ্কে আসে চিত্রকল্প, অনেক অনেক বছর আগে, ধরণী যখন তরুণী ছিলেন, এই প্রাঙ্গণ ছিল ভিক্ষু শ্রমণ অধ্যুষিত এক জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র, দীপালোকে আলোকিত, ত্রিশরণ মন্ত্রে মুখরিত। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি - আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম। ধম্মং শরণং গচ্ছামি - আমি ধর্মের শরণ নিলাম। সংঘং শরণং গচ্ছামি - আমি সংঘের শরণ নিলাম।:বুদ্ধ যিনি আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন, (অমিতাভ) বা বোধিলাভ করেছেন। আক্ষরিক অর্থে "বুদ্ধ" বলতে একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত,উদ্বোধিত,জ্ঞানী,জাগরিত মানুষকে বোঝায়। ধম্ম অর্থাৎ বুদ্ধের শিক্ষা,অর্থাৎ যে সাধনা অভ্যাস দ্বারা সত্য লাভ হয়,হয় আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ বিকাশ। সংঘ, যেখানে পূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য ধর্মের সাধনা সম্যকভাবে করা যায় তাই সংঘ।

বৌদ্ধধর্মে আমার আকাদেমিক উৎসাহ অনেকদিনের। তার একটি সম্ভাব্য কারণ আমার ছোটবেলা কেটেছে দূরপ্রাচ্যে, মন্দিরের বদলে প্যাগোডা দেখে, শিব অথবা কালীমূর্তির বদলে বুদ্ধমূর্তি দেখে, পরবর্তীকালে কলেজ গমনকালে বুদ্ধের দুঃখশূন্য এক জগতের স্বপ্ন আমাকে বড় টেনেছিল। ঈশ্বরের অস্তিত্ব অথবা অনস্তিত্ব বিষয়ে শাক্যমুনির নীরবতা, মধ্যপন্থা অবলম্বন নির্দেশ, কৃতকর্ম পর্যালোচনা......আমার মনে হয়েছিল বৌদ্ধধর্ম যথার্থভাবে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষের ধর্ম, যে মানুষ তার কৃতকর্মের দায় অচেনা অদেখা কোন ঈশ্বরের ওপর চাপায় না, প্রাপ্তবয়ষ্ক প্রাপ্তমনষ্ক সাবালকের মত নিজে বহন করে। বয়স বাড়লে আত্মবিশ্বাস কমে আসে, কোন কাজ করে ঠিক করলাম না ভুল করলাম সন্দিগ্ধতা চেপে বসে, কৃতকর্মের দায় দুর্ভার মনে হয়, তখন আঁকড়ে ধরার মত একটা অবলম্বন দরকার হয়।
বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য, নির্বাণলাভ। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া, বিলুপ্তি,বিলয়,অবসান। এই সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের চারটি উপদেশ পালিঃ চত্বারি আর্য্য সত্যানি। তিনি অষ্টবিধ উপায়ের মাধ্যমে মধ্যপন্থা(পালি ভাষায় মজঝিম পটিপদা) অবলম্বনের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন,মানুষ যখন অহরহ বিভিন্ন দুঃখের শৃঙ্খলে আবদ্ধ,তখন দুঃখ মুক্তি বা নির্বাণের পথ না খুঁজে তত্ত্বালোচনা মুর্খতা। তাই অতীন্দ্রিয় জগত,ঈশ্বর,আত্মার অমরত্ব ইত্যাদির চেয়ে তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে মানুষের দুঃখমুক্তি বা নির্বাণ লাভের পন্থা উদ্ঘাটনে অধিকতর আগ্রহী।

ঘুরে ফিরে দেখা হল। এবার কিছু ছবি তোলা দরকার, নইলে লোকে বলবে কি? কিন্তু ছবি তুলতে গিয়ে দেখা গেল চারিদিকে ছবি তুলবেন না বিজ্ঞপ্তি। একজনকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম দাদা দুটো ছবি তুলব? তিনি ডিরেক্টরকে দেখিয়ে দিলেন। ডিরেক্টর সাহেব টুপি পরে গাছের ছায়ায় বসেছিলেন। কাছে গিয়ে সবিনয়ে অনুমতি চাইলাম। বিস্তর জেরার পর আমার পরিচয় নিয়ে নিঃসংশয় হয়ে তিনি শুধু যে অনুমতি দিলেন তাই নয়, লোকজন ডেকে তালা খুলিয়ে গ্যালারি ও জাদুঘর দেখিয়ে দিলেন। সর্বোপরি, স্থানটির ইতিহাস, উৎখননের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও উৎখননে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে অনেক কথা বললেন। তাঁকে আমার নমস্কার। উৎখননে পাওয়া গেছে পোড়ামাটির বাসন, পোড়ামাটির সিল, গুপ্ত-পরবর্তী যুগের ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ ধাতব সিল, নিবেদনস্তুপ (votive), সোনার মুকুট... এইসব।

(৪)

ইতোমধ্যে ডিরেক্টর সাহেবের বদান্যতায় একটি টোটো গাড়ি জুটেছে। সারথিটি গাড়ি রেখে সানকিতে ঘুগনি মুড়ি খাচ্ছিলেন, তাঁকে বলা হলো আমার পরবর্তী গন্তব্য। ১। শরশঙ্খ দিঘি। রাজা শশাঙ্কের খনিত বলে জনবিশ্বাস। পিতামহ ভীষ্ম নাকি এখানেই শরশয্যায় পতিত হয়েছিলেন। ২। কুরুমবেরা দুর্গ। ওড়িশার সূর্যবংশীয় গণপতি রাজাদের নির্মিত। ১৪৩৮ – ১৪৬৯। ৩। মনোহরপুর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। ১৫২৮ সালে নির্মিত বলে জনশ্রুতি।
কিন্তু সারথিটি কিঞ্চিৎ বেয়াড়া। তাঁকে যতই বোঝাই যে আমি ভবঘুরে বাউন্ডুলে লোক, বাড়ি ফেরার কোন তাড়া নেই, দরকার হলে রাতে স্টেশনে শুয়ে থাকব, ততই সে আমাকে ১-৫৩ র বালেশ্বর খড়গপুর মেমুগাড়িটি ধরাতে চায়। পরে বোঝা গেল, তাঁর গাড়িটি নির্বাচনের কাজে নেওয়া হয়েছে; তার মধ্যেই সে আমাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি...। কিন্তু কি আর করা! শরশঙ্খ দিঘি বা কুরুমবেরা দুর্গ এযাত্রায় যাওয়া হল না। পরিবর্তে সারথি মহোদয়ের প্রবল উৎসাহ কাঁকড়াজিৎ গ্রামের সদ্যপ্রতিষ্ঠিত মহাপ্রভু মন্দির দেখাতে। যতই বলি নবনির্মিত মন্দির আমাকে টানেনা, অন্তত শতাব্দীপ্রাচীন না হলে মন্দির আমার কাছে মন্দিরই নয়, বাণিজ্যস্থল; তবু সে নাছোড়। চোখ বড়-বড় করে গল্প শোনায় ছোট পর্দার কোন অভিনেতা একবার এতদঞ্চলে শুটিংয়ে এসে জুতো না খুলে ওই মন্দিরে ঢুকেছিলেন, ব্যস! পরদিন থেকে তাঁর গলা ভেঙে দ। রুটি রুজি বন্ধ। আবার এসে মহাপ্রভুর কাছে ক্ষমা টমা চেয়ে তবে শান্তি, স্বর ফিরল, রুটি রুজিও। সতত ক্ষমাশীল মহাপ্রভু, যিনি জগাই মাধাইকে কলসির কানার বদলে প্রেম দিতে পারেন, তিনি যে এত আত্মম্ভরী ও অসূয়াপ্রবণ হতে পারেন না, তা বোঝানো গেল না। বাঙালি চিরকালই উগ্রচণ্ডা কাঁচাখেগো দেবতার থানে নৈবেদ্য চড়াতে ভালোবাসে কিনা! শীতলা, কালী, পঞ্চানন্দ... ।

তা মস্ত মন্দিরটি দেখা হল শেষ পর্যন্ত। ফেরার পথে মনোহরপুর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে এটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। অনাবাদী বনস্পতিবহুল জমির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে দুটি অতিকায় (আনুমানিক ৩০' x ৫' x ২') স্তম্ভ। দেখে বোঝা যায় বৃটিশ পুর্ববর্তী যুগের, pilaster ধাঁচের নয় এগুলি, বরং বর্তুলাকার। ১৬৩৪ সালে জন (ইস্ট ইন্ডিয়া) কোম্পানি বাংলায় ব্যবসা করার অধিকার পায়। ১৬৯০ এ কলকাতায় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন, ১৭৫৭-য় পলাশী। স্বাভাবিকভাবেই দুর্গনির্মাণ ওই সময়কালের সম্ভাব্যতার বাইরে। ফলে যখন শুনলাম দুর্গের নির্মাণকাল ১৫২৪, অবিশ্বাস হয়নি। গৃহস্বামীর অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি তোলা হল। সন্নিহিত ভবনটিতে বর্তমানে লোকজন বাস করেন। ঐতিহ্যের ষষ্ঠীপূজা করে শরিকির অংশে অংশে নতুন নির্মাণ। সহৃদয় পরিবারটি বাড়িটির পুরনো অংশের ঘরগুলি ঘুরে দেখতে দিলেন, ছবি তুলব না এই শর্তে।
তখন দুপুর। রোদ বেশ চড়া, অলস মধ্যাহ্নে পুকুরের জলে কাঁপন উঠছে, পায়ের নীচে শুকনো পাতা মড়মড় করে ভাঙছে, বুকে হেঁটে চলে যাচ্ছে গিরগিটি, উড়ছে প্রজাপতি, একটা বেজি জিজ্ঞাসু্ চোখে আমাকে দেখে নাবাল জমিতে নেমে গেলো। নেপথ্যে একটা কোকিলের ডাক এই বসন্তে বেশ জুতসই হত – কিন্তু কৃষিকাজে জৈব সারের প্রচলন বাড়ায় গ্রামাঞ্চলে এখন জৈব বর্জ্য বস্তুত নেই। ফলে কাকেরা দেশান্তরী, কোকিলের মত ফলাহারী পক্ষীও, পরভৃত পরভৃৎ সম্পর্কে, আজ শহরবাসী। খেতে না পাই সেও ভাল, বংশরক্ষা তো হবে!

যারা এই দুর্গ বানিয়েছিলেন তাঁদের দূরদৃষ্টি কি এই সম্ভাব্যতা ছুঁয়েছিলো যে পাঁচ শতক পরে কালস্রোতে ভেসে যাবে বজ্রসুকঠিন রাজশক্তি, শুধু এক অকালপক্ক পল্লবগ্রাহী অলস দুপুরে সরীসৃপসান্নিধ্যে ঘুরে বেড়াবে একা একা!

(৫)

এবারে ফেরার পালা, কারণ বালেশ্বর খড়্গপুর মেমুগাড়িটি নেকুরসেনিতে আসে ১-৫৩য়। স্টেশনে টিকিট কাটতে গিয়ে আরেক বিস্ময়। হাতে পেলাম এক টুকরো ইতিহাস। ওই স্টেশনে থেকে অদ্যাবধি Edmondson Ticket দেওয়া হয়। গন্তব্যের নামে শুধু বাউড়িয়ার বদলে বাউড়িয়া জংশন। সেই কবে কোন কালে সাহেবরা ভেবেছিলেন সেতু বানিয়ে বাউড়িয়ার সঙ্গে যুক্ত করবেন বজবজকে। সেই স্বপ্নের উত্তারাধিকার টিকিটে বাউড়িয়া জংশন। নেকুরসেনিতে থেকে বাউড়িয়ার ১৩৮ কিলোমিটার পথের ভ্রমণদক্ষিণা তিরিশ টাকা। স্টেশনে কেউ কোথাও নেই। শুধু এক খালাসি না থেমে চলে যাওয়া রেলগাড়িগুলিকে সবুজ পতাকা দেখান।
মেমুগাড়ি এল। চড়ে বসা গেল। এমনকি জানালার ধারে সিটও পাওয়া গেলো।খড়্গপুরে নেমে মধ্যাহ্নভোজ। তারপর চারটের এমু। বাড়ি সাতটায়।

গ্রন্থঋণঃ
১। কিংবদন্তীর দেশে, সুবোধ ঘোষ। কলিকাতা নিউ এজ পাবলিশার্স। ১৯৬১
২। Dictionary of Historical Places. Bengal. 1757 -1947. Department of History, Jadavpur University. PRIMUS BOOKS
৩। Hanh, Thich Nhat (1991)। Old Path White Clouds: walking in the footsteps of the Buddha। Parallax Press। পৃ: 157–161। আইএসবিএন 0-938077-26-0।

পুনশ্চ:
পথনির্দেশটুকু দিয়ে দায়িত্ব সারি। আমি বাউন্ডুলে লোক, গিয়েছিলাম খড়্গপুর থেকে ৯-২৫ এর মেমু ধরে। নেকুরসেনিতে নেমে পদব্রজে। তবে রোদ্দুর আছে, আছে বৃষ্টি। শহুরে ভ্রাতা-ভগিনীদের শুনি অনেকেরই হাঁটুতে ব্যথা, তাই বলি কি সকাল ছটায় হাওড়া থেকে ধৌলি ধরে বেলদায় নামুন, কারণ নেকুরসেনিতে কোন যানবাহন পাওয়া যায় না। বেলদায় থাকার মত হোটেলও পাবেন। ওখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে দেখে নিতে পারেন কাকরাজিতের মহাপ্রভু মন্দির, মনোহরপুরের দূর্গের ধ্বংসাবশেষ,শরশঙ্খের দিঘি, সুবর্ণরেখার সূর্যাস্ত।
ফেরাও ওই ধৌলিতেই। বা ইচ্ছা হলে একরাত থেকে পরদিন ফিরতে পারেন।

পশ্চিমবঙ্গ অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে। 'আমাদের ছুটি'-র জন্যই তাঁর কলম ধরা।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher