বিষ্ণুর উপত্যকায়

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

~ ~ হর কি দুন ট্রেক রুট ম্যাপ ~ হর কি দুন ট্রেকের আরও ছবি ~

"আজকে চল সেই আকাশে হাঁটি
যেখানে ছায়াপথ গিয়ে মেশে
আলো পথের সঙ্গে;
যেখানে সবুজ, নীল আর সাদায়
আকণ্ঠ পান করে বসে আছে নেশাতুর দেবতার দল-
ফিরতে চাওয়াটা যেখানে একান্তই
স্বার্থপর ক্লান্তির মতো..."

২৪ এপ্রিল ২০১৫, "এবার কাণ্ড উত্তরাখণ্ডে"

যারা আমার মতো পাহাড় ভালোবাসে তাদের মনকেমন কে আটকায়? কিছুদিন ছাড়া-ছাড়াই প্রেমিকার মতো একা-একা দেখা করতে চেয়ে সে ডাক পাঠায়। সেই ডাক উপেক্ষা করে কার সাধ্যি! পাহাড়-জঙ্গলে খুব ঠাণ্ডায় তুষারপাতে কিংবা খুব বৃষ্টিতে যখন মনে হয় আমরা কত অসহায় তোমার কাছে, তখনই কোনও এক বিস্ময়ে মুগ্ধ করে দিয়ে সব দুঃখ-কষ্ট এক ঝাঁকুনিতে ভুলিয়ে দিয়ে তুমি সামনে এসে হাজির হও। তোমার রাজ্যে পৃথিবী 'গদ্যময়' নয়, সত্যিকারের 'কাব্যময়'। আর সেরকমই এক রাজ্য উত্তরাখণ্ড – দেবভূমি উত্তরাখণ্ড। যার প্রতিটা পথের বাঁকে শুনতে পাওয়া যায় অদ্ভুত এক স্বর্গীয় ধ্বনি। সেই উত্তরাখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত অপরূপ এক ভ্যালি 'হর-কি-দুন', সত্যিকারের 'স্বর্গের উপত্যকা'। দেবভূমিতে 'পদাতিক'-এর প্রথম অভিযান।
প্রতিবারের মতো এবারে ঠিক সেই উৎসাহটা আসছিল না। কোনও এক অজানা পিছুটান আটকে দিচ্ছিল। হয়তো আগামী দিনে আসতে চলা কোনও বিপদের আশঙ্কা মনকে দোলা দিচ্ছিল। হাফ-ডে অফিস সেরে রাত ৮.৩০ এর হাওড়া-দেরাদুন দুন-এক্সপ্রেস-এ উঠে পড়লাম আমি আর পদাতিকের কনিষ্ঠতম সদস্য আমার হৃদয়ের খুব কাছের বন্ধু নীলাদ্রি। আর একজন পাহাড় পাগল আর টিমের 'ট্রেক রিসার্চার' সৌনীপ উঠল ওর শহর শ্রীরামপুর থেকে ঠিক ৯ টায়। রাতের খাবার সঙ্গেই ছিল। এসি-থ্রি-টিয়ার কামরার একেবারে দরজার ধারে আমাদের সিট। সাইড আপারে শুয়ে অনেকবার দরজার গুঁতো খেতে হল আমায়। ঘুম আসছিল না। কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

২৫ এপ্রিল, "ভূমিকম্প"

সকালবেলা ঘুম ভাঙল ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে। ঘড়ির সঙ্গে টাইমটেবল মিলছে না। ট্রেন অলরেডি দু'ঘন্টা তিরিশ মিনিট লেট। আলোচনা চলছিল দুন এক্সপ্রেস তার 'লেট লতিফ' সুনাম বজায় রাখতে পারবে কি না এই নিয়ে। ট্রেন এগিয়ে চলেছে বেনারসের দিকে আর আমরা ক্যামেরা হাতে তৈরি হচ্ছি বিখ্যাত বেনারসের ঘাটের এক টুকরো ছবি তোলার জন্য, ফোনের নেটওয়ার্ক আবার থ্রিজি দেওয়া শুরু করল। ইন্টারনেট অন করতেই ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে পরপর নোটিফিকেশন আসা শুরু হল। বিধ্বংসী ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে নেপাল এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক অংশ। ফেসবুকের ওয়াল ছেয়ে গেছে পোস্টে। সবার একটাই প্রশ্ন - "ফোনে পাচ্ছি না, তোরা ঠিক আছিস"? সবাইকে কুশল সংবাদ দেওয়া শেষ হতেই গাইডকে ফোন করার চেষ্টা করতে থাকলাম। এবারের ট্যুরের ক্যাশিয়ার কাম ম্যানেজার কাম কমিউনিকেটর সব দায়িত্বই আমাকে সামলাতে হচ্ছিল। গাইড বল বাহাদুর এর সঙ্গে কথোপকথন এবং সমস্ত নিগোশিয়েশন করেছিলাম নিজেই। অনেক কষ্টে ফোনে ধরা গেল তাকে। নিজস্ব নেপালি মেশানো হিন্দিতে সে জানাল উত্তরাখণ্ড বিপন্মুক্ত। ভূমিকম্প সেখানে কোনও প্রভাব ফেলেনি। সবার বাড়ি থেকে আতঙ্কিত ফোন আসতে লাগল ফিরে আসার প্রবল আকুতি আর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল-সহ। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পনের হাজার টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া ছিল, আর আরও অনেক খরচ অলরেডি হয়েই গেছে। তিন জনে বসে ঠিক করলাম দেরাদুন নেমে আগে GMVN (Garhwal Mandal Vikash Nigam Ltd.)-এ খোঁজ নেব। ট্রেন থেকেই যতদূর সম্ভব ফোনে খোঁজ খবর নেওয়া হল। যা হয় হবে ভেবে রাতের খাবার খেয়ে একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

২৬ এপ্রিল, "রোড ট্রিপ"

সিঙ্গললাইনে ঢোকার পর থেকেই ট্রেনের গতি মন্থর। একটা সময় ৫ ঘন্টা ৩০ মিনিট লেটে চলছিল। হরিদ্বার পৌঁছালাম সকাল ৯টায়, যেটা ঢোকার কথা ছিল ভোর ৪.৩৫-এ। কখন পৌঁছাব তাই ভাবছিলাম। আদৌ ট্রেকটা করা সম্ভব হবে কি না তাই নিয়েই একরাশ ধোঁয়াশা। অনেক নাকানি-চোবানি খেয়ে ঠেলে-গুঁতিয়ে বেলা বারোটা নাগাদ ট্রেন দেরাদুন পৌঁছাল। জানুয়ারিতেই দেরাদুন এসেছিলাম। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে খোঁজ নেওয়াই ছিল। একটা ইন্ডিকা বুক করে নেওয়া হল পুরোলা পর্যন্ত। রাস্তা মুসৌরি হয়ে। দেরাদুন ছাড়িয়ে মুসৌরি রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে "টপকেশ্বর মন্দির"-এর একটু আগে এক ধাবায় লাঞ্চ সেরে দীর্ঘ সাড়ে চার ঘন্টার রোড ট্রিপ শুরু হল। বিকেল ৫.৩০ নাগাদ যখন পুরোলা পৌঁছালাম হাল্কা মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। পাহাড়ের দুঃখে আকাশেরও মুখ ভার। ওখানে গিয়ে দেখা হল আমাদের টিমের সঙ্গে। সবার পোশাক এবং চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। চারজন পোর্টার এবং আমাদের গাইড বল বাহাদুর। কোনও ভক্তি হল না। তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হতাশ হয়ে পড়লাম। হোটেলে স্যাক নামিয়ে ছাদে গেলাম। পুরোলা বেশ বড় টাউন। জনবহুল এবং ভারি ছিমছাম। নিজেদের কয়েকটা ছবি তুলে বেরোনো হল টহল দিতে। নিভে আসা আলোয় গোলাপি সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে টন্স নদীগর্ভে নেমে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম সবাই মিলে। হোটেলে ফেরার পর বাহাদুরজি এলেন র‍্যাশন কেনার ফর্দ নিয়ে। টাকা দিয়ে দিতে উনি বললেন - "জি স্যার আপলোগ চিন্তা মত করো হাম সব অ্যারেঞ্জ কর লেঙ্গে"। কী আরেঞ্জমেন্ট হল সেটা জানতে পারলাম না। রাত্রে ৫০ টাকার ভেজ মিল খেয়ে হাল্কা পায়চারি করে শুয়ে পড়লাম ১০টা নাগাদ।

২৭ এপ্রিল, "রোড টু এল-ডোরাডো"

সকাল ৯ টায় বাস ছাড়বে সাঁকরি যাওয়ার। ঘন্টা চারেকের রাস্তা। মোরি অবধি রাস্তা ভালো। তারপর খুব খারাপ। ২০১৩-র ভয়াল বন্যায় রাস্তার খুব খারাপ অবস্থা। ২০১৩-কে উত্তরাখণ্ড সরকার "দৈবী আপদা বর্ষ" বলে ঘোষণা করেছে। অনেক জায়গায় এই লেখা বোর্ড চোখে পড়ল। এর আগে কখনও পাহাড়ি রাস্তায় বাসে চড়িনি। পাহাড়ি গ্রাম্য মানুষজন, তাদের ছাগল-মুর্গি, নাক থেকে হলুদ সর্দি বেরোনো গোলাপি গালের নাকবোঁচা স্কুলের বাচ্চা, সবার সঙ্গে অদ্ভুত গন্ধ নাকে নিয়ে সে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। পুরোলা থেকে সাঁকরি বাসে ১৮০ টাকা ভাড়া। মুস্কিল হচ্ছিল এটাই যে শুধু আমরা তিন জন নয়, বাকি পাঁচজনের সমস্ত খরচও আমাদেরকেই দিতে হচ্ছিল। মোরি ছাড়ানোর কিছুক্ষণ পর বাস হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই আমাদের তিন জনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। আমার সামনের সিটে বসা ভদ্রলোক বললেন –"আপ লোগো কো নিচে উতরনা পঢ়েগা। ফরেস্ট চেকপয়েন্টমে ভেরিফিকেশন হোগা"। আমরা তিন জন আর বল বাহাদুর নেমে পড়লাম। এখান থেকে 'গোবিন্দ ন্যাশানাল পার্ক'-এর এলাকা আরম্ভ। হর-কি-দুন ভ্যালি এর মধ্যেই পড়ে। তাই পারমিশন নেবার দরকার পড়ে, সঙ্গে ট্যাক্স এবং সিকিউরিটি ডিপোজিট। আমাদের তিন জনের এবং জিনিসপত্রের জন্য ছ'দিনের ৯০০ টাকা দিতে হল। সঙ্গে ৬০০ টাকা এক্সট্রা, যেটা আবার ফেরার পথে ফেরত পাওয়া যাবে।
দুপুর একটা নাগাদ সাঁকরি পৌঁছে গেলাম। চারদিক ঝকঝক করছে রোদে। পেটে একগাদা ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। আমাদের নাইট স্টে এখান থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম তালুকায়। ওখান থেকেই পরদিন আমাদের ট্রেক আরম্ভ। তালুকা যাবার সব গাড়ি প্রায় চলে গেছে। কিছু করার নেই আপাতত, এই ভেবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। পাশের ছোট্ট একটা ঝুপড়ি হোটেলে খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। দুটো নাগাদ খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনজনে বসেছিলাম। আকাশে হঠাৎ করে এক রাজ্যের মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিল। মনে হচ্ছিল আজ আর তালুকা পৌঁছাতে পারব না। রাস্তাও খুব খারাপ শুনেছিলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা মিনি ট্রাক এসে হাজির হল। ৮০০ টাকার বিনিময়ে সে আমাদের পৌঁছে দিতে রাজি হয়ে গেল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিল। ২ কিমি মতো যাওয়ার পরে বুঝতে পারলাম রাস্তা কতটা খারাপ। ড্রাইভারের পাশেই বসেছিলাম। ইষ্টনাম জপ করতে লাগলাম যখন সামনে দেখলাম প্রায় ৬০ ডিগ্রি ঢাল বেয়ে এক সফেন ঝরনার মধ্যে দিয়ে গাড়িটাকে পেরোতে হবে। জলের স্রোত বেশ ভালোই। বেশ কায়দা করে অদ্ভুত দক্ষতায় ড্রাইভার জায়গাটা পেরিয়ে গেল। রাস্তা এমন যে হেঁটে যাওয়াই দুষ্কর, সেখানে গাড়ি চালানোতে কী পরিমাণ কলজের জোর লাগে আন্দাজ করে ড্রাইভার ছেলেটিকে কুর্নিশ করতে ইচ্ছে করল। ১২ কিলোমিটার যেতে এক ঘন্টা লেগে গেল। মনে হল যেন হাজার বাধা পেরিয়ে একরকম অ্যাডভেঞ্চার করে জল-জঙ্গল-পাহাড় পথ পেরিয়ে আমরা দেখা পেলাম আমাদের "এল ডোরাডো" 'তালুকা'র।
বিকেল ৩.৩০ নাগাদ পৌঁছে একটা ছোট্ট হোটেলে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া গেল। GMVN গেস্ট হাউসের অবস্থা খুবই খারাপ। জল বা আলোর কোনও ব্যবস্থা নেই। ফরেস্ট বাংলোতে থাকতে গেলে আগেই দেরাদুন থেকে পারমিশন করাতে হয়, এটা ওখানে পৌঁছে জানলাম। বাংলোটা খুব সুন্দর কিন্তু থাকার উপায় ছিল না। তালুকা ওই প্রান্তের শেষ মোটোরেবল গ্রাম। জনসংখ্যা খুব বেশি হলে ৫০০-৬০০ হবে। ছবির মতো সাজানো আর মাঝখানে একটা ছোট্ট বৃষ্টি-পুষ্ট পাথরঘেরা লেক। গ্রামের বাইরে একটা ঝরনা আছে। সেখান থেকেই গ্রামের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা। আমাদের ভাগ্য খারাপ ছিল। আগেরদিন রাতেই ঝড়-বৃষ্টিতে পাথর গড়িয়ে পড়ে টারবাইন দেহত্যাগ করেছিল। ভেবেছিলাম আমাদের সমস্ত ক্যামেরা আর মোবাইল তালুকায় ফুল চার্জ করে নেব। আশা-নিরাশার সঙ্গে আপোস করে শুরু হল চার্জ বাঁচানোর যুদ্ধ। মোবাইল সুইচ-অফ করে আর ক্যামেরার ব্যাটারিগুলো খুলে জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিলাম সবাই, যাতে ঠাণ্ডায় তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ না হয়ে যায়। বিকেল আর সন্ধেটা গ্রামের রাস্তায় পায়চারি করে আর কচিকাঁচাদের সঙ্গে ফোটো তুলে কেটে গেল। সন্ধেবেলা ওয়েদার ক্লিয়ার হবার পর গ্রামের বাইরের দিকে একটা টিলার ওপরে উঠে ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল। বাড়িতে সবাই জানিয়ে দিলাম এরপর চার-পাঁচ দিন কোনও কথা হবে না, আর নেটওয়ার্ক থাকবে না। বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে বুঝতে পারছিলাম। একই রকম চিন্তায় আমরাও ছিলাম খবর দিতে পারব না বলে, কিন্তু কোনও উপায় ছিল না। ঠাণ্ডা ভালোই কামড় বসাচ্ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় টর্চ জ্বেলে ফিরব ফিরব করছি তখনই নীচে নদীর গর্জ থেকে কয়েকবার টর্চ জ্বলা-নেভার একটা সিগন্যাল দিল কেউ। গতিক সুবিধের নয় বুঝে আমরা আর নিজেরা আলো না জ্বালিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটা দিলাম। হোটেলে ফিরে আমাদের কুক রনি আর মান সিং -এর বানানো অনবদ্য পরোটা, আলুর তরকারি আর আচার খেয়ে কম্বলের নরমে সেঁধিয়ে গেলাম। সৌনীপ বলল "ভাই আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শেষবারের জন্য বিছানায় শুয়ে নে, গাঁতিয়ে ঘুমো"। কী আছে কপালে কে জানে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

২৮ এপ্রিল, "জঙ্গল ক্যাম্প"

রাত তিনটে নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে বিদ্যুতের ঝলকানিসহ মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। সৌনীপ আর নীলাদ্রিও জেগে গেছিল। কীভাবে সকালবেলা বেরোনো হবে আর কীভাবে ওসলা পৌঁছোব বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের যাত্রাক্রম ঠিক করা ছিল। রেস্ট ডে মাত্র একদিন। কী যে হবে ভেবে খুব টেনশন হচ্ছিল। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন বুঝিনি। বাইরে পাখির আওয়াজে বুঝলাম ভোর হয়ে গেছে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নেমে জানালার পর্দা সরাতেই মন ভালো করা একটা আলো চোখে এসে পড়ল। দরজায় 'টক-টক' করে দু'বার টোকা পড়ল। খুলে দেখি সদাহাস্যময় রনি প্লেটে চা আর বিস্কুট নিয়ে হাজির। 'গুড মর্নিং সাব' বলে সে জানিয়ে গেল ব্রেকফাস্ট তৈরি হচ্ছে। খেয়ে বেরোনো হবে আটটা নাগাদ। ৮.১৫ নাগাদ জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। আজকের গন্তব্য ১৪ কিলোমিটার দূরের গ্রাম ওসলা। প্রথম দিনের হাঁটা হিসেবে অনেকটাই। এই সু্যোগে একটু ট্রেক আইটিনিরারিটা বলে নেওয়া যাক।
 তালুকা --> ওসলা/সীমা (নাইট স্টে) [১৪ কিমি]
 ওসলা/সীমা --> হর-কি-দুন (নাইট স্টে) [১২ কিমি]
 হর-কি-দুন --> যমদ্বার গ্লেসিয়ার---হর-কি-দুন (নাইট স্টে) [৪+৪=৮ কিমি যাতায়াত]
 হর-কি-দুন --> দেবসু থ্যাচ (নাইট স্টে) [১০-১২ কিমি]
 দেবসু থ্যাচ --> রুইনসারা লেক (নাইট স্টে) [১৩ কিমি]
 রুইনসারা লেক --> ওসলা/সীমা (নাইট স্টে) [১২-১৪ কিমি]
 ওসলা/সীমা --> তালুকা [১৪ কিমি]


হাঁটা পথ শুরু বন-বাংলোর পাশ দিয়ে। একটা পাথরে বাঁধানো, ভিজে স্যাঁতসেতে, একরাশ গোবরে ভর্তি ঢালু রাস্তা নীচে নদীর গর্ভে নেমে গেছে। এই টন্স নদীর পাশ দিয়েই যেতে হবে আমাদের। টন্সের সংস্কৃত নাম তমসা, যদিও এই নামটা আর ব্যবহৃত হয় না। মোরি থেকেই সে আমাদের সঙ্গ দিয়ে চলেছে। রোদ উঠে হাঁটার আগ্রহটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘন পাইন বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। সদ্য গজানো কচি সবুজ পাইন পাতার গন্ধ নাকে আসছিল। এক কিলোমিটার মতো যাওয়ার পর চড়াই শুরু হল। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে প্রায় হাজার খানেক পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়ার পাল।
ওদেরকে রাস্তা করে দিতে বেশ কিছুটা সময় গেল। কোনওমতে পাশ কাটিয়ে এগোতে থাকলাম নদীর পাশ বরাবর। ছায়ায় বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল, কিন্তু রোদে হাঁটলেই ঘাম হচ্ছিল। সোয়েটার খুলে ঢুকিয়ে নিলাম সঙ্গের ন্যাপস্যাকে। ৬-৭ কিমি মতো আন্দাজ যাওয়ার পর একটা ছোট্ট অস্থায়ী ঝুপড়ি চায়ের দোকান নজরে এল। বল বাহাদুর সহ আমাদের বাকি টিম ওখানে বসে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ করে মেঘ করে এসেছিল খুব, হাওয়াও দিচ্ছিল বেশ ঠাণ্ডা। জ্যাকেটটা বের করে পরে নিলাম। সবে যখন আবার হাঁটা শুরু করেছি, দু'-একটা বরফ ঠাণ্ডা জলের ফোঁটা গা ছুঁয়ে গেল। মান সিং কে দাঁড় করিয়ে স্যাক খুলে রেনকোটগুলো বের করে নিলাম। এরকম ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হবে ভাবতে পারিনি। কিছুটা এগোনোর পরে সামনে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। সামনে ধ্বস নেমে পুরো রাস্তা ধুয়ে চলে গেছে। বৃষ্টি আর বরফগলা জল হু-হু করে বয়ে চলেছে। আর পার হবার জন্য রয়েছে জলের তোড়ে ভেসে আসা একটা বিশাল বড় এবড়ো-খেবড়ো গাছের গুঁড়ি। ভয় করতে লাগল। বৃষ্টিতে পিছল হয়ে আছে গুঁড়িটা। কম-সে-কম ১২ ফুট পেরোতে হবে। বৃষ্টি আর হাওয়াতে অবস্থা আরও সঙ্গিন করে তুলেছে। এরকম অবস্থায় সাধারণত একজন এক্সপার্ট টিম মেম্বার রোপ নিয়ে পেরিয়ে গিয়ে উল্টোদিকে অ্যাংকর করে এবং দড়ি ধরে আস্তে আস্তে পেরোতে হয়। আমাদের গাইড এবং অন্য টিম মেম্বাররা অনেক আগেই পেরিয়ে চলে গেছিল। দড়ি-টড়িরও কোনও ব্যবস্থা নেই। অগত্যা নিজেদের অভিজ্ঞতার ওপর আস্থা রেখে আস্তে আস্তে পেরিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় না দেখে তাই করলাম একে একে। উল্টোদিকে পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম সকলে। তখনও জানতাম না সামনে আছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। ২০-৩০ মিটার যাওয়ার পর একটা বড় পাথরের বাঁক ঘুরতেই দেখি নীলাদ্রি সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাত দেখিয়ে থামতে বলছে। বৃষ্টি পড়ছে বেশ জোরে। চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। সামনে তাকিয়ে রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। একটা ঝুরো লুজ পাথরে ভর্তি ধসে যাওয়া জায়গা সোজা উঠে গেছে প্রায় ৭০০ ঢালে। সেখান দিয়ে নেমে আসছে একরাশ বৃষ্টির জল। পাশে পড়ে আছে একগাদা মৃত গাছের কঙ্কাল। সাইডে কোনও পাথরের দেওয়ালও নেই যে ধরা যাবে। এভাবে উঠতে হবে কম করে ২০-৩০ ফুট। ঠিক হল জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে একে একে সাবধানে ওঠা হবে ৩-৪ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে। সবার আগে নীলাদ্রি, তারপর আমি, শেষে সৌনীপ। একে অপরের ফুটস্টেপ অনুসরণ করে উঠতে শুরু করলাম। জুতোয় জল ঢুকতে শুরু করেছিল। কোনমতে পা বাঁচিয়ে জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম কোনও বিপদ ছাড়াই।
জানতাম সামনেই ২ কিমির মধ্যেই গাংগর গ্রাম। সেরকম কিছু হলে সেখানেই নাইট-স্টে করতে হবে। একটু এগোতেই গ্রামের সীমা দেখা গেল। কয়েকজন পুরুষ-মহিলা ওই বৃষ্টির মধ্যেই ধাপ-চাষে ব্যস্ত। কী কঠিন এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা। বৃষ্টি আর হাওয়ায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমরা রীতিমতো দৌড়াচ্ছিলাম একটু শেডের আশায়। মিনিট পনেরোর মধ্যেই গ্রামের পাশের রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। বৃষ্টির বেগ কমে এসেছিল। বলবাহাদুর এবং বাকি টিমের কোনও দেখা নেই। বুঝতে পারলাম ওরা এগিয়ে গেছে। আমরাও কয়েক মিনিট রেস্ট নিয়ে জল আর চকলেট খেয়ে রওনা দিলাম। নীলাদ্রি এগিয়ে গিয়েছিল। ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। চিন্তাও হচ্ছিল। ওকে ধরার জন্য আমরা না থেমে একটানা যতটা জোরে পারি হাঁটতে লাগলাম। প্রায় আধঘন্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর অনেকটা উৎরাই এসে পড়ল। সামনেই জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছিল। সবুজ ঘাসের সমতল রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা দূরেই একটা বিশাল পাইন গাছের নীচে নীলাদ্রির মিলিটারি ছোপওলা ছাই রঙের স্যাক আর আমাদের লাগেজ দেখা গেল। ওখানে পৌঁছাতেই দেখি রাস্তা থেকে বাঁ দিকে একটা ছোট্ট ঘাসের মাঠ নেমে গেছে। সেখানেই আমাদের টেন্ট লাগানো হচ্ছে। নদীর আওয়াজে কান পাতা দায়, কিন্তু জায়গাটার অপূর্ব অবস্থান সব ক্লান্তি দূর করে দিল। পাশে সফেন সাদা সুপিন বয়ে চলেছে।'তমসা' আমাদের ছেড়ে গেছে গাংগর-এর অনেক আগেই। সামনে অনেক দূরে পড়ন্ত রোদের আলোয় ঝকঝক করছে হর-কি-দুন পিক। মনে মনে ভাবলাম 'এই তাহলে আমাদের প্রথম জঙ্গল ক্যাম্প'।
আকাশ কালো শ্লেটের মতো হয়ে আছে। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই আবহাওয়ার কী চরম বৈপরীত্য। মাঝে মাঝে কিছু সাদা মেঘ চক দিয়ে যেন আলপনা এঁকে গেছে। টেন্ট লাগানো হতে না হতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। সবাই দৌড়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ভিজে জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিলাম। ঠাণ্ডায় কিছু করার ছিল না। সবাই স্লিপিং ব্যাগের ভিতর ঢুকে গেলাম। এর মধ্যেই দেখি রনি গরম গরম এলাচ দেওয়া চা দিয়ে গেল। বৃষ্টি কমতেই আশপাশটা ঘুরে দেখার লোভটা সামলানো বড় দায় হল। ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুটা দূরে রাস্তার পাশে একটা ট্রেল নেমে গেছে নদীর মাঝে একটা বিশাল বড় চ্যাপ্টা পাথরের দিকে। চারদিকে জলস্রোতের শব্দ। প্রকৃতির কোলে এমন থিয়েটার পেলে কার ফিরে যেতে মন চায়? সামনে অনেক দূরে মেঘ কেটে গিয়ে রোদের খেলা শুরু হয়ে গেছে সাদা তুষার-শৃঙ্গের মাথায়। ওদিকে আবার গরম ম্যাগি খাবার ডাক পড়েছে। যাবার পথে যতটা পারা গেল কাঠ আর পাইনের ফল জোগাড় করে নিলাম তিনজনে।এই ফলগুলোয় প্রচুর আঠালো তরল আছে যেটা ভীষণ ভালো জ্বালানি। আগুনের আলো আর টর্চ ছাড়া কোন আলো নেই। অন্ধকার হতেই বন যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। অদ্ভুত এক সশব্দ নিস্তব্ধতা আমাদের ঘিরে ধরল। এমন গভীর জঙ্গলে কোনওদিন রাত কাটাইনি। গতবারের মৈনাম শীর্ষের রাত্রিবাস এত গভীর জঙ্গলে ছিল না। আগুনের পাশে বসে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রনি আর মান সিং-এর বানানো গরম খিচুড়ি আর আলুভাজা খেতে খেতে সঙ্গে বলবাহাদুরের বিভিন্ন এক্সপিডিশনের গল্প একেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে উঠল।

২৯ এপ্রিল, "চন্দ্রালোকে হর-কি-দুন"

মানুষের জীবনে এমন কিছু কিছু দিন আসে যেগুলো তার বেঁচে থাকাকে নতুন মানে দিয়ে যায়। সবাই যখন বলে কেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে ট্রেকে যাই, চুপ করে থাকি, চোখের সামনে এইসব দিনগুলো ভেসে ওঠে। সব অনুভূতিকে তুচ্ছ করে দিয়ে শুধু তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা তিনজন আর বলবাহাদুর বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের আজকের গন্তব্য একেবারে হর-কি-দুন ভ্যালি। ওসলা হয়ে ঘুরে যেতে হবে। এদিকটার মধ্যে ওখানেই একমাত্র টেলিফোন বুথ আছে। আগামী তিন-চার দিন বাড়িতে খবর দেওয়া যাবে না। তাই ফোন করার জন্য বাড়তি তিন কিলোমিটার হাঁটার কষ্ট স্বীকার করতেই হত। নীলাদ্রি আগেই পৌঁছে গেছিল। আমি আর সৌনীপ যখন ওসলার সেই ফোনবুথে পৌঁছোলাম নীলাদ্রি বাড়িতে ফোন করে ফেলেছে। আমরাও একে একে সেরে নিলাম। মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে বেশ শান্তি হল। কয়েকটা কচি-কাঁচাকে একগাদা লজেন্স বিলি করে আমরা আবার রওনা দিলাম।
এই যমুনা উপত্যকা, বিশেষ করে ফতে পর্বত অঞ্চলে কৌরবদের উপাসনা করা হত। মজার ব্যাপার এই যে উপাসনার পদ্ধতি ছিল জ্যেষ্ঠ কৌরবের মূর্তিতে পাদুকা ছুঁড়ে মারা। একটু এগোতেই চোখে পড়ল পৃথিবীর একমাত্র দুর্যোধনের মন্দির। পুরোটাই কাঠ আর পাথরের কারুকার্যে ভর্তি। বড় ইচ্ছে ছিল মুর্তিটা দেখার কিন্তু দরজা খোলা না থাকায় বলে দেখতে পেলাম না। শোনা যায় এই অঞ্চলে রাজা ভোগ দত্তেরও একটি মন্দির আছে যিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবদের সাহায্য করেছিলেন। আসার সময় ফেলে আসা নেটওয়ার-এর ওপরের দিকে আছে অঙ্গরাজ কর্ণের কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির। যদিও কোনটাই আমাদের দেখা হল না।
চারদিক ঝলমল করছে রোদে। ছবি তোলার সাবজেক্ট প্রচুর অথচ সময় আর ব্যাটারি দুটোই সীমিত। আমার আর সৌনীপের যখন হুঁশ ফিরল তখন আর নীলাদ্রি বা বলবাহাদুর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। একটা বড় ঝরনা পেরোনোর সময় নীচে দূরে সীমা গ্রাম দেখা গেল। ওখানে দাঁড়িয়ে জলের বোতলগুলো ভরে নেওয়া হল। একটু এগোতেই অনেক দূরে ওদের দেখতে পেলাম একটা সমতল সবুজ ঘাসের ময়দান পেরিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা পিঁপড়ের মতো লাগছিল নীলাদ্রিকে। সেই সবুজ ময়দানে পৌঁছে দেখি একটু দূরেই সোজা উঠে গেছে পথ। অনেকটা চড়াই পেরিয়ে সামনে একটা ছোট্ট ঝরনার পাশে একটা কাঠের ঝুপড়ি নজরে এল। দেখি বলবাহাদুর বসে গপ্প জুড়েছে একমাত্র দোকানির সঙ্গে। কিন্তু নিলুর (নীলাদ্রির ডাকনাম) কোন পাত্তা নেই। কাছে যেতেই বলবাহাদুর চা করতে বলল। অভিযোগ করতে লাগল নিলুর নামে। "আরে উসকো ম্যাইনে কিতনা টোকা কে ইতনি জলদি মত ভাগো। সামনে ঘনা জঙ্গল হে, ভালু ভি হে, রস্তা খো সকতা হে, শুনা নহি"। আমাদের চিন্তা হতে লাগল। তবে মনে মনে ভাবলাম ও আমাদের প্রোটোকল জানে, নিশ্চয়ই কোথাও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। খুব খিদে পাচ্ছিল। সৌনীপ আর আমি ম্যাগি খেয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে টিমের বাকিরা এসে পড়ায় তারাও চা খাওয়ার জন্য বসল। আমি, সৌনীপ আর বাহাদুরজি এগোতে শুরু করলাম। সামনে ঊর্ধ্বশ্বাস চড়াই। কিছুটা এগোতেই দেখলাম নিলু একটা পাথরের ধাপে বসে আছে। নিশ্চিন্ত হলাম। দূরে Trek The Himalaya-র নীল তাঁবুর ক্যাম্প চোখে পড়ল।
মিনিট পঁয়তাল্লিশ একটানা হাঁটার পর একটা সমতল এলাকা চোখে পড়ল। সবুজ ঘাসে ভর্তি সেই মাঠে সোনা রোদে পিঠ এলিয়ে দিলাম সবাই। আমাদের পোর্টাররা ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত। সামনে অন্তহীন চড়াই যেটার চোখে দেখা সীমানা শেষ হয়েছে অনেক দূরে পাহাড়ের বাঁকে। বলবাহাদুর বলল এখনও ঘন্টা তিনেক লাগবে ক্যাম্পিং সাইটে পৌঁছোতে। ১০-১৫ মিনিট বসে আবার চড়াই শুরু হল। আমাদের সঙ্গীরা ওদের সঙ্গে থাকা রুটি আর ছোলার তরকারি খেয়ে লম্বা পায়ে প্রায় ছুট দিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই লোকগুলোর বুঝি চার-পাঁচটা ফুসফুস, দমে এদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব।
পশ্চিমের আকাশ কালো করে আসছে দূরে। সংকেত ভালো নয় বুঝে আমরাও যথাসাধ্য জোরে হাঁটছি। এক বিষম ঢালু উৎরাই নেমে বাঁক ঘুরতেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল তিনজনের। সামনে এক বিশাল গ্লেসিয়ার নেমে গেছে অন্তত ২০০০ ফুট খাদে। ঝুরো বরফ নয়, এ হল শক্ত আইস। পেরোতে হবে প্রায় ৫০ মিটার পথ। আগে লোকজন যাওয়াতে একটা ট্রেল হয়ে আছে ঠিকই কিন্তু তাতে ধুলো-কাদা মেখে পথ আরও পিচ্ছিল। আমাদের হাঁটার স্টিক ছিল না। ঠিক হল একে একে পেরোনো হবে। সবার প্রথমে সৌনীপ পেরিয়ে গেল আর নিলু ভিডিওতে ধরে রাখল সেটা। এরপর আমার পালা। একটা ছোটো ডাল ভেঙে নিলাম যাতে স্লিপ করলে অ্যাংকর করতে পারি। গোড়ালি ঠুকে ঠুকে গ্রিপ বানিয়ে এগোতে থাকলাম। কোন অসুবিধে হল না। নীলাদ্রিও নির্বিঘ্নে পেরিয়ে এল। দু'পা হাঁটতেই দেখি অসুবিধে হচ্ছে। জুতোর দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরে গেল। সোলের অর্ধেক খুলে গেছে। ফেভিকুইক সঙ্গে থাকলেও সেটা রাখা রুকস্যাকে, যেটা আবার পোর্টাররা নিয়ে দৌড়েছে। এবারের রাস্তা যেন ভালো হয় এই প্রার্থনা করতে করতে কোনওমতে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগোতে লাগলাম।একটু পরেই রাস্তা প্রায় সমতল হয়ে এল। সবুজ বুগিয়াল, বরফের চাদর আর কাঁটাঝোপের খপ্পর এড়িয়ে এগোতে থাকলাম তিনমূর্তি।
যখন পা আর চলছে না, বৃষ্টি প্রায় ধরে ফেলব ফেলব করছে কিছুটা দূরেই আমাদের তাঁবু দেখা গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শেষ ১০০ মিটার কোনক্রমে পা টেনে টেনে তাঁবুতে ঢুকলাম। রনি ততক্ষণে এলাচ দেওয়া গরম চা নিয়ে হাজির। চা খেয়ে মিনিট দশেক বসতেই বৃষ্টি আর তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। এমন গোল গোল পুঁতির মতো বরফপাত আমার জীবনে প্রথম। তাঁবু ফাঁক করে দেখলাম। বেশিক্ষণ পারা গেল না, ঠাণ্ডা হাওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের ক্যাম্প ৩৫০০ মিটার উচ্চতায়, কিছুটা হলেও হাই অল্টিটিউডের ক্লান্তি শরীরকে চেপে ধরছিল। তাঁবুর ভিতর স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, আর কিলোমিটার খানেক দূরেই সেই অপরূপ উপত্যকা, যার জন্য এতদূর থেকে আসা।
ঘন্টা খানেক তুষারপাত চলার পর যখন থামল বাইরের প্রকৃতির অনেক বদল ঘটে গেছে। সবুজ সমতল ময়দান প্রায় পুরোটাই ঢেকে গেছে বরফে। ভীষণ ঠাণ্ডা একটা উত্তুরে হাওয়া কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হাতের কাছে যেটুকু কাঠ পাওয়া যায় আমি রনি আর তেজ বাহাদুর তা দিয়েই আগুন জ্বালাতে শুরু করে দিলাম। মান সিং চা বানাচ্ছিল আর বাকিরা গেছিল সামনের জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে আনতে।
সন্ধে নেমে গেছে। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। দেখে বোঝার উপায় নেই একটু আগে এত কিছু হয়ে গেল। শরীরের যে দিকটা আগুনের সামনে ছিল সেদিকটা গরম হচ্ছিল আর উল্টোদিকটা ঠাণ্ডা। রুটি সেঁকার মতো নিজেদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আগুনে সেঁকে নিচ্ছিলাম। একটু পরেই একাদশীর চাঁদ দেখা দিল স্বর্গারোহিণী পিক-এর পিছন থেকে। চার দিন পরেই বুদ্ধ পূর্ণিমা। দিগন্ত-বিস্তৃত তুষার রাজ্যে সে এক অলীক অকল্পনীয় বাক্যহীন করে দেওয়া দৃশ্য। চারিদিকে গগনচুম্বী গিরিশীর্ষের মাথায় গলন্ত জ্যোৎস্না এক নীলাভ-রূপোলি আলোয় চারিদিক ভরিয়ে তুলেছে। সৌনীপ ছুটল ওর ট্রাইপড নিয়ে ছবি তুলতে। মৈনাম-এর স্মৃতি মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু এখানকার শোভা আরও জীবন্ত, আরও হাতের নাগালে, আরও বিস্তৃত, আরও হৃদয় স্তব্ধ করে দেওয়া। এই অসীম নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে এই সীমাহীন একাকিত্ব মনের সমস্ত উৎকণ্ঠাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। শুধু এই নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসছিল বনবিড়ালের ফ্যাঁসফেঁসে ডাক। বল বাহাদুর চেঁচিয়ে আমাদের আগুনের কাছে আসতে বলল। রুইনসারা যাওয়া হবে কিনা সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এবারে তুষারপাতের পরিমাণ অনেক বেশি। আজও হল। আমরা একটা দোটানায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে ভেবে ঠিক করব এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আগুনের আলোয় গোল করে বসে ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ আর পিঁয়াজ সহযোগে ডিনার সেরে ৯.৩০ নাগাদ স্লিপিং ব্যাগের তলায় আশ্রয় নিলাম। মনে হল যদি আমার কোনও প্রেমিকা থাকত আর তাকে এই চন্দ্রোদয় দেখাতে পারতাম! হয়তো পথ হাঁটার ক্লান্তিই প্রেমিকার হয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে দেরি করল না।

৩০ এপ্রিল, "মহাপ্রস্থানের পথে"...

ঘুম ভাঙল ভোর সাড়ে পাঁচটায়। আজ অনেকটা হাঁটা আছে। প্রথমে হর-কি-দুন দেখে ক্যাম্পে ফেরা আর তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে যতটা পারা যায় নেমে চলা। চা খেয়ে সকালের কাজকর্ম সেরে নিলাম জলদি জলদি। অনুভব করলাম শরীরের খোলা অংশে ঠাণ্ডা যেন কামড় বসাচ্ছে শ্বদন্ত বের করে। আজ আমরা হাঁটব সেই স্বর্গারোহিণীর পথে। এই পথেই একে একে দেহত্যাগ করেন চার পাণ্ডব এবং দ্রৌপদী। আর একটি স্বর্গারোহিণী পিক আছে সতোপন্থ তাল এর পথে। কোন পথ যে সেই মহাভারতের যুগের যুধিষ্ঠিরের স্বর্গযাত্রার সিঁড়ি, জানা নেই। আমরা তিনজন, বলবাহাদুর আর রনি বেরিয়ে পড়লাম হর-কি-দুন উপত্যকার উদ্দ্যেশ্যে। যাত্রা শুরু হল ব্রেকফাস্টে সিমুই-এর পায়েস দিয়ে মিষ্টিমুখ করে।
এই পুরো উপত্যকা গোবিন্দ ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে অবস্থিত। ১৯৫৫ সালে এর সূচনা হয় এক অভয়ারণ্য হিসেবে এবং নামকরণ করা হয় উত্তরপ্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী পন্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ এর নামে। ৯৫৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়ানো এই অরণ্যের বিস্তৃতি নেতওয়াড় (১৪৩৯ মি) থেকে বন্দরপূচ্ছ শিখর (৬৩২৫ মি) পর্যন্ত। সবুজ তৃণভূমি (বুগিয়াল), পাইন, ওক, দেওদার, ব্লু-পাইন, সিলভার বার্চ, রডোডেন্ড্রন, ভূর্জপত্র ইত্যাদির গভীর জঙ্গল, তুষারশুভ্র শিখর, হিমালয়ের কালো এবং বাদামি ভালুক, তুষারচিতা, বনবিড়াল, ভারাল, হরিণ এবং আরও অনেক পশু-পক্ষীর আবাসস্থল এই বনভূমিকে ন্যাশানাল পার্ক এর মর্যাদা দেওয়া হয় ১৯৯০ সালে।
রাত্রে পড়া তুষারে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ওদিকে সকালের সূর্য আমাদের গায়ে এক উষ্ণতার চাদর চাপিয়ে দিচ্ছিল। প্রায় এক কিমি মতো চলার পর দেখলাম সুপিন-এর অববাহিকায় সুন্দর এক ফাঁকা ময়দানের মতো ক্যাম্পসাইটে এক স্বনামধন্য ট্রেকিং গ্রুপের রঙিন সিঙ্গল ডোমটেন্ট-এর সারি। সাদা ময়দানে একটুকরো রামধনুর মতো ছবি এঁকে গেছে তাঁবুগুলো। আমরা ওদের সামনে যেতেই এক ভদ্রলোক (সম্ভবত ট্রেক লিডার) বেশ দম্ভ এবং তাচ্ছিল্যভরে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কারা, কোন জায়গা থেকে আসছি, কোন ট্রেকিং টিমের সঙ্গে, বরফে হাঁটার স্টিক আনিনি কেন, কেন এত ওভারকনফিডেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন করার ভঙ্গিমায় অদ্ভুত এক তাচ্ছিল্য প্রকাশ পাচ্ছিল। ভদ্রলোক অনেকক্ষণ আমাদের লক্ষ্য করলেন। মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিল। আমরা অর্ধেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই এগিয়ে গেলাম। সুপিন নদীর পাশে পাশে মিনিট দশেক হাঁটার পরেই সামনে তার তুষার রাজ্যের মনোমুগ্ধকর শুভ্রতা নিয়ে হাজির হল সেই স্বর্গীয় উপত্যকা। সব রাগ-দুঃখ-মান-অভিমান-কষ্ট এক লহমায় উধাও হয়ে গিয়ে এক অপরিসীম নিশ্চুপ আহ্লাদি শান্তি মনকে স্তব্ধ করে দিল। সামনে এক অপার বিস্ময় নিয়ে হিমালয় তার বুক পেতে অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। বরফের মধ্যে পা ডুবিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে।

৩০ এপ্রিল, "মহাপ্রস্থানের পথে"...যমদ্বারে...

সাদার রাজ্যে এক টুকরো রঙিন প্রজাপতির মতো সবুজ ছাদ আর হলুদ দেওয়ালের ফরেস্ট বাংলো একা দাঁড়িয়ে। সামনে যেন হাতের নাগালে স্বর্গারোহিণী, বন্দরপুচ্ছ, কালা পর্বত, হর-কি-দুন। নীচে বয়ে চলেছে সুপিন নদী আর তার পাশ দিয়ে দূর দিগন্তে মিশে গেছে যমদ্বার গ্লেসিয়ার। আমাদের ইচ্ছে ছিল ঘুরে আসার। কিন্তু ওই গভীর বরফাবৃত নির্জন প্রান্তরে পা রাখার সাহস হল না। সামনে এক উঁচু টিলা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তার ওপরে জমে রাজ্যের বরফ। আইস অ্যাক্স দিয়ে রনি স্টেপ কাটার চেষ্টা করছিল, না পেরে কোনওমতে হাত-পা সব লাগিয়ে একগাদা বরফ মেখে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। ওর এটাই প্রথম স্নো-ক্লাইম্বিং, আমাদেরও। একটু উঠেই বেচারা হড়কে নেমে গেল। এরপর আমি আইস অ্যাক্সটা নিয়ে ইউ-টিউবে দেখা ক্লাইম্বিং ভিডিওগুলোর জ্ঞান কাজে লাগিয়ে স্টেপ বানিয়ে উঠে পড়লাম আস্তে আস্তে। উচ্চতা বেশি ছিল না, বড়জোর ৩০ ফুট হবে, অসুবিধে হল না। একে একে সবাই উঠে এল। অবাক বিস্ময়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যে । William Wordsworth এর "Yarrow Visited" এর একটা স্তবক এখানে হয়তো কবিতার অভাব পূর্ণ করে দেবে-

"Yet why?
— a silvery current flows
With uncontrolled meanderings;
Nor have these eyes by greener hills
Been soothed, in all my wanderings.
And, through her depths, Saint Mary's Lake
Is visibly delighted;
For not a feature of those hills
Is in the mirror slighted."

অনেকক্ষণ ওখানে কাটালাম আমরা, অনেক ছবি তোলা হল। নেমে যেতে কারোরই বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু রোজকার মতো আজকের আকাশও আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য মুখ ভার করতে শুরু করেছিল। আর সময় দিতে না পারার মন খারাপ সঙ্গে নিয়ে দ্রুত পায়ে তুষাররাজ্যকে বিদায় জানাতে হল। ক্যাম্পে ফিরে এলাম ১০টা নাগাদ। লাঞ্চ তৈরি ছিল। আলুর তরকারি, ডাল আর ভাত গরম গরম খেয়ে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে স্যাক গুছিয়ে আমরা তিনজন আর বাহাদুরজি বেরিয়ে পড়লাম। বাকিরাও টেন্ট গুটিয়ে পিছনে আসার জন্য তৈরি হতে লাগল। আজ আমাদের গন্তব্য আগের দিনের দেখা ট্রেক দি হিমালয় এর ক্যাম্পসাইট-২। আমরা রুইনসারা লেক যাচ্ছি না এটা কাল রাতেই ঠিক করা হয়ে গেছিল। রাস্তার অবস্থা ভালো নয় এবং তার সঙ্গে হওয়া অতিরিক্ত তুষারপাত শেষ কয়েক কিলোমিটারের রাস্তা ভীষণ কঠিন করে দিয়েছে। তাছাড়া ভূমিকম্পের পর বাড়িতেও চিন্তা বেড়ে যাওয়ায় আমরা ট্রেক শর্ট করে দেওয়ায় একমত হলাম।
রাস্তা চেনা, তাই আর দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে বাধা নেই। আকাশ ক্রমশ কালো হয়ে আসছিল। হাওয়াতেও হাল্কা কাঁপুনি টের পাওয়া যেতে লাগল বেলা বাড়তেই। ঘন্টা তিনেক এক নাগাড়ে হাঁটার পর আমরা যখন ক্যাম্পের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে গেছি, ভিজিবিলিটি খুব কমে এল। নীলাদ্রি জোরে হেঁটে আমাদের গাইডদের সঙ্গে ক্যাম্পে পৌঁছে গেছিল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল। মাটির রাস্তা কাদা কাদা আর পিচ্ছিল হয়ে পড়ায় তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে সৌনীপ আর আমি দুজনেই বারকয়েক পিছলে গেলাম। দূরে কেদারকণ্ঠ পিক এর মাথায় স্নো-ফল দেখা যাচ্ছিল। টেন্ট-এ ঢোকার দশ পনের মিনিটের মধ্যেই ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি আর তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। কনকনে ঠাণ্ডায় স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে তিনজনে গায়ে গায়ে সেঁটে বসলাম। কিচেন টেন্ট পাশেই ছিল। কোনওমতে চেন খুলে রনি গরম এলাচ দেওয়া চা সাপ্লাই দিতে যেন ধড়ে প্রাণ এল। এক ফাঁকে টেন্টের চেন অল্প ফাঁক করে দেখতে পেলাম বাইরে পুরো হোয়াইট-আউট, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না।
ঝড়-বৃষ্টি-তুষারপাত ঘণ্টা খানেক চলল। থামল যখন প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। সবুজ ময়দানের ওপর সাদার ছোপ পড়েছে। শেষ বিকেলের রোদে জুতো খুলে পাথরের ওপর বসলাম আমরা তিনজন আর বাহাদুরজি। নীচের বন থেকে শুকনো কাঠ এনে জড়ো করেছে রনি আর তেজ বাহাদুর। মান সিং গরম ম্যাগি আর কফি দিয়ে গেল। দূরে কেদারকন্ঠের মাথায় আর-এক পশলা ধবধবে সাদা বরফের প্রলেপ পড়েছে। বাহাদুরজি বললেন যে তাঁর প্রিয় ক্লায়েন্ট সবসময় বাঙালিরা। ওঁর দীর্ঘ চল্লিশ বছরের পর্বতারোহণ জীবনের ফেভারিট বাঙালিদের অনেক গল্প শোনালেন। তার মধ্যে ওঁর প্রিয় বন্ধু সোনারপুরের কালীবাবুর সঙ্গে ব্ল্যাক পিক অভিযানে গিয়ে তাঁর বাঁ পায়ে হওয়া ফ্রস্ট বাইটের গল্প এবং তারপর প্লাস্টিক সার্জারির দাগ দেখে সত্যিই মনে শ্রদ্ধা জাগল এই প্রবীণ গ্রাম্য মানুষটার প্রতি।
শেষ বিকেলের তুলোমোছা গোলাপি আলো নিভে যেতেই হই-হই করে ছুটে এল পাগল ঠাণ্ডা হাওয়া। আগুনের পাশে গোল করে দাঁড়িয়ে আড্ডা চলল বেশ কিছুক্ষণ। রনি বলল ও মুম্বাইয়ে তাজ হোটেলের বয়-এর কাজ করত। মিথ্যে অভিযোগে ওর চাকরি চলে যায়। তারপর ফিরে আসে নিজের গ্রামে আর বাহাদুরজি'র দলে ভিড়ে যায়। রোগা লম্বা রনিকে দেখলে বোঝা যায় না ওর শরীরে কী শক্তি এবং টেনাসিটি। শহরপ্রিয় আধুনিক তরুণের বন পাহাড় আর জঙ্গুলে জীবনযাপনের এ এক অন্য সংঘর্ষের মনখারাপ করা গল্প। রনি রুটি বানাতে চলে যাওয়ার পর আমরাও তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম। স্লিপিং ব্যাগে আধশোয়া হয়ে গল্প চলতে থাকল। রুটি আর আলু-টম্যাটোর তরকারি দিয়ে উপাদেয় ডিনার সারার পর তিনজনে একটু হাঁটতে বেরোলাম। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। বাসন ধুতে ধুতে মান সিং বলল "আজ কি রাত ভয়ানক হোগি, তুফান আয়েগা।" কী করে বুঝলেন জানতে চাওয়ায় শুধু আলতো হেসে বলল, "পতা হে"।
রাত তখন প্রায় সাড়ে ৯টা বাজে, প্রচন্ড বিদ্যুতের ঝলকানি আর বাজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। প্রচন্ড ঠাণ্ডায় শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে। বাইরে শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়ায় তাঁবু থরথর করে কাঁপছে, আর তার ভিতরে আমরা। বৃষ্টি আর বরফ একসঙ্গে ঝাপ্টা মারছে তাঁবুর আউটার লাইনিং-এ। নীলাদ্রি জেগে, পাশ থেকে বলল "মনে হয় আজ আমরা গেলাম মায়ের ভোগে। তাঁবু উড়ে গেলে আর কিছুই করার থাকবে না"। এদিকে যে ছেলে রোজ রাতে একটা-দুটোর সময় উঠে বলছিল বাইরে ছবি তুলতে যাবে, তার কোন বিকার নেই। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সৌনীপ। আমরা মনে মনে ইষ্টনাম জপতে লাগলাম। এদিকে হাওয়ার বেগ বাড়ছে। ঘোর অনিচ্ছেতেও আমি আর নীলাদ্রি উঠে আমাদের যত ভারি জিনিস, রুকস্যাক এসব দিয়ে তাঁবুর ধারে ধারে দিয়ে দিলাম যাতে একটু হলেও সাপোর্ট পাওয়া যায়। হঠাৎ শুনি বাইরে থেকে মান সিং আর রনির আওয়াজ, "আপলোগ ঠিক হে না সাব"? ধন্য এদের কর্তব্য পরায়ণতা। এই হাড় জমিয়ে দেওয়া তুষার ঝড়ের মাঝখানেও ওরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। বাইরে বেরিয়ে তাঁবুর অ্যাংকর ঠিক করে দিচ্ছে যাতে তাঁবু উড়ে না যায়। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় চোখ ভিজে এল। এই স্বল্প-চেনা মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল।

১ মার্চ, "এই পথ যদি না শেষ হয়"...

যখন ঘুম ভাঙল আকাশ জাগতে শুরু করেছে। জুতো পরতে গিয়ে দেখি ফিতেগুলো ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে গেছে। যে জল-কাদা মাখা রাস্তা দিয়ে কাল নেমেছি আজ সেটা সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা। আশেপাশের সব চূড়া পুরোপুরি বরফাবৃত। আজ প্রায় ২০ কিমি ট্রেক আছে। এখান থেকে সীমা হয়ে প্রথম দিনের ক্যাম্প পেরিয়ে একেবারে সোজা তালুকা। পুরো রাস্তাটা একবার চোখ বুজে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। নাঃ, এতটা হাঁটা কি সম্ভব একদিনে? তারপর আবার সম্ভব হলে গাড়িতে ফিরতে হবে মোরি অবধি। দেখা যাক। সকালের কাজকর্ম সেরে আগে সৌনীপের ডিরেকশন অনুযায়ী গ্রুপ ফোটোসেশন খতম করে ফেলা হল। তারপর পরোটা আর ছোলার তরকারি দিয়ে জলযোগ সেরে ঠিক ৬.৩৫-এ হাঁটা শুরু হল।
আজ শুরু থেকেই ঠিক ছিল পা চালাতে হবে যতটা সম্ভব। নামার সময় চলার গতি এমনিই একটু বেশি থাকে, আর কষ্টটাও তুলনামুলক ভাবে কম হয়। ঘন্টা দুয়েক একটানা হাঁটার পর দূরে সীমা গ্রামের ব্রিজ দেখা গেল। বাহাদুরজি ওখানেই একটা পাথরের ওপর বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা আসার সময় যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেটা ওসলা হয়ে। বাঁ দিকে একটা রাস্তা খাড়াই নেমে গেছে সীমা ব্রিজের দিকে। আমাদের গন্তব্য ওই দিকেই। সময় বাঁচাতে হবে। বাহাদুরজি রাস্তা দেখিয়েই হাঁটা লাগালেন এই বলে যে এখনও অনেক পথ বাকি, জলদি হাঁটুন। আমাদের তখন তেষ্টায় গলা কাঠ। পাশের ঝরনা থেকে জল ভরে জিওলিন মিশিয়ে নেওয়া হল আর যেটুকু জল ছিল সেটুকু ঢকঢক করে খেয়ে ফেলা হল।
এরপর সেই একই পথে নেমে চলা বিরামহীন। মাঝখানে এক ফাঁকা ময়দানের মতো চত্ত্বরে বসে সকালের বানানো রুটি আর ছোলাসেদ্ধ দিয়ে লাঞ্চ সারা আর আবার জুতোর সোল খুলে যাওয়া ছাড়া বলার মতো কোন ঘটনা ঘটল না। অনেক কষ্টে পা টেনে টেনে আড়াইটে নাগাদ পৌঁছোলাম তালুকা। গ্রামের এক অত্যুৎসাহী ভদ্রলোক জানালেন এই মাত্র সাঁকরি যাওয়ার শেষ জিপ বেরিয়ে গেল। আমাদের নাকি উনি আসতে দেখেছিলেন, কিন্তু আমরা ফিরব কিনা জানতেন না বলে জিপটাকে আটকাননি। এটা জেনে আমার মাথা রাগে জ্বলতে শুরু করল। কি আর করা অপেক্ষা ছাড়া। এদিকে আমরা আসার সময় যে লজটায় ছিলাম সেটা এবং GMVN গেস্ট হাউস দুটোই ভর্তি, থাকার কোন জায়গা নেই। সাঁকরি হয়ে মোরি আমাদের পৌঁছোতেই হবে নাহলে রাতে তাঁবু খাটিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্য ভালো তিনটে নাগাদ একটা জিপ এল সাঁকরি থেকে। সে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে আমাদের সবাইকে মোরি পর্যন্ত ছেড়ে দিতে রাজি হল। অগত্যা তাতেই সায় দিতে হল। পাঁচটা নাগাদ মোরি পৌঁছে গেলাম। বাহাদুরজি বললেন হাতে সময় আছে। আমরা পুরোলা ফেরার চেষ্টা করে দেখতে পারি। মোরি জায়গাটা একেবারেই আধা-মফস্বল টাইপ। খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না। রাজি হয়ে গেলাম। একটা শেয়ার জিপ পাওয়া গেল। অনেক কষ্টে চাপাচাপি করে বসে সাড়ে সাতটা নাগাদ পুরোলা এসে পড়লাম। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আর কিছু বাকি ছিল না। ভাল হোটেলের নরম বিছানায় শুয়ে দিব্যি ঘুম হল। এরপর ফিরে চলা হরিদ্বার হয়ে প্রিয় শহর কলকাতায়। নেপাল-সিকিম-উত্তরাখণ্ড পাড়ি জমিয়ে এরপর কোনদিকে? সেটার সিক্রেটটা নাহয় পরেরবারের জন্য তোলা থাক।

[পুনশ্চঃ সমস্ত তথ্য উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ, স্থানীয় বাসিন্দা এবং ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত। সকলের কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। সমস্ত ছবি আমাদের নিজেদের তোলা এবং "পদাতিক" গ্রুপের তরফ থেকে দেওয়া - সৌজন্যে সুদীপ, নিলাদ্রি, সৌনীপ এবং অভিষেক।]

~ ~ হর কি দুন ট্রেক রুট ম্যাপ ~ হর কি দুন ট্রেকের আরও ছবি ~

জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় মুখ্যালয়ে জুনিয়ার টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (কেমিক্যাল) পদে কর্মরত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রসায়নে স্নাতক এবং এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড সয়েল সায়েন্স-এ স্নাতোকোত্তর । কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। পাহাড় পাগল, হিমালয় প্রেমী। "পদাতিক" নামক চার জনের ছোট্ট ট্রেকিং দলের সদস্য। "বছরে একটা ট্রেক-এ না গেলে বছরটাই মাটি" তত্ত্বে বিশ্বাসী। ভ্রমনকাহিনি ছাড়াও কবিতা লেখা ও পড়া নেশা। অল্প-বিস্তর ছবি আঁকা আর ছবি তোলা প্যাশন।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher