ইটাচুনার রাজকাহিনি
সঞ্চিতা পাল
খোকা ঘুমলো, পাড়া জুড়লো
বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?
আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা।১৭৪০ সাল।সরফরাজ খাঁকে হত্যা করে আলিবর্দি খাঁ বাংলার নবাব হয়েছেন।সরফরাজের শ্যালক রুস্তম জঙ্গ ছিলেন ওড়িশার নায়েব নাজিম।তিনি ভগ্নিপতি হত্যার প্রতিশোধ নিতে আলিবর্দিকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু বালেশ্বরের কাছে এক যুদ্ধে রুস্তম আলিবর্দির কাছে পরাজিত হন।ওড়িশার মসনদে বসলেন আলিবর্দির ভাগ্নে। বিজয়ী আলিবর্দি খুশিমনে রওনা দিলেন মুর্শিদাবাদে নিজের রাজধানীতে।এদিকে রুস্তম জঙ্গও নিজের রাজত্ব ফিরে পেতে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন। এবার আর একা নন। নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজি ভোঁসলের সাহায্য প্রার্থী হলেন রুস্তম। মারাঠা শক্তির সহায়তায় ফের ওড়িশার নায়েব নাজিম হলেন রুস্তম জঙ্গ।
বাংলা-বিহার-ওড়িশার আকাশে দেখা দিল দুর্যোগের কালো মেঘ। মারাঠারা বুঝে নিল সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলার বুকে রয়েছে অশেষ সম্পদ।তা লুটে নেওয়াও খুব সহজ। এর পর থেকেই নিয়মিত মারাঠা বর্গির হানা শুরু হল বাংলায়।ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে হুগলি জেলায় চুঁচুঁড়া, সপ্তগ্রাম, আরামবাগ, পান্ডুয়া ইত্যাদি অঞ্চল তছনছ করে দিয়েছিল বর্গিরা। তবে কয়েকটি অঞ্চলে বর্গিরা হারও মেনেছিল। যেমন বাঁশবেড়িয়ায়।আর একটি বাধা বর্গিরা টপকাতে পারেনি, সেটি হল গঙ্গা। পাঞ্চেত দিয়ে ঢুকে তারা যাবতীয় অত্যাচার চালাত গঙ্গার এপারেই। ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বর্গিদের এই অত্যাচার চলে। শেষ পর্যন্ত বাংলার নবাব ও মারাঠাদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পর শান্তি ফিরে আসে বাংলায়।
এই বর্গিদের একটা অংশ থেকে গিয়েছিল এই উর্বরভূমিতে। পরে হুগলি জেলার সেই গ্রামের নামকরণ হয় বর্গিডাঙা। ইটাচুনার পাশের গ্রামটাই হল বর্গিডাঙা। সেখানে রাধামাধব কুন্দন নামে এক বর্গিসেনা বসবাস শুরু করেন। কেন রাধামাধব বাংলায় থেকে গেলেন তা জানা যায় না। এই রাধামাধব কুন্দনই হলেন ইটাচুনার কুন্ডু পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা।কুন্দন পদবী ধীরে ধীরে বাংলার মানুষের মুখে হয়ে যায় কুন্ডু। তবে এই কুন্ডু আমাদের বাংলার কুন্ডু নয়। যাইহোক,রাধামাধব সেখানে চাষবাস শুরু করে থিতু হলেন। রাধামাধবেরই এক বংশধর স্বপ্নে দেখেন,কাছেই ইটাচুনা গ্রামে অবহেলিত হয়ে পড়ে রয়েছেন তাঁদের ইষ্টদেবতা শ্রীধর জিউ। বিগ্রহ উদ্ধার করে তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে সেই মন্দিরকেই কেন্দ্র করে তৈরি হল বাড়ি।রাধামাধবের এক বংশধর সাফল্যরাম ১৭৬৬ সালে রাজবাড়িটি গড়ে তুলেছিলেন। অন্যান্য জায়গা থেকে বিভিন্ন পেশার লোকজন এসে গড়ে ওঠে ইটাচুনা গ্রাম।
এ তো গেল অতীতের কথা। এবার বর্তমানে ফিরি। খন্যান স্টেশনে হাওড়া-বর্ধমান লোকাল ট্রেনটা থামল সকাল সোয়া নটায়। স্টেশন থেকে বেরিয়ে টোটো করে মিনিট বারো যেতেই পৌঁছে গেলাম ইটাচুনা রাজবাড়ি।বাড়ির সিংহদরজায় দারোয়ান আছে। আমাদের দেখে দারোয়ান অফিসে গিয়ে বসতে বললেন। ম্যানেজার সঞ্জয়বাবু পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখাবেন। তবে তাঁর আসতে একটু দেরি আছে। বনেদিয়ানায় ভরপুর রিসেপশনটা।
সুরকি ও ঘেঁস দিয়ে পাতলা ইটে গাঁথা বিরাট দোতলা বাড়ি। দেওয়ালগুলো প্রায় ২০ ইঞ্চি পুরু। সিংহদরজা পেরিয়ে ভিতরবাড়িতে ঢুকতে গেলে আগে থেকে বুকিং থাকতে হবে। তা না হলে, নো এনট্রি। ফটকটা প্রায় দুমানুষ সমান উঁচু। শাল ও সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি। তার ওপর লোহার কিলক গোঁজা। সঞ্জয় বাবু আসতেই আমরা ঢুকে এলাম বাড়ির ভিতরে। বিশাল উঠোন পেরিয়ে শ্রীধর জিউয়ের মন্দির। উঠোনের পাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম রাজবাড়ির অন্দরমহলে। চারপাশে ঘর দিয়ে ঘেরা মাঝে উঠোন। নীচের তলার ঘরগুলো আগে ছিল বাড়ির কাজের লোকেদের। বাড়ির নানা কোণে অসংখ্য সিঁড়ি। যেন ভুলভুলাইয়া, একা কেউ চিনে বেরিয়ে আসতে পারবে না। দোতলার ঘরগুলো বর্তমানে গেস্টরুম করা হয়েছে। বাড়ির পিছনে বাগান আর পুকুর। নির্মাণশৈলীতেও রয়েছে প্রাচীনত্ত্বের ছোঁয়া। বেশিরভাগটাই অবশ্য ইউরোপীয়ান স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি।
বাড়ির মাথায় খোদাই লেখা দেখে বোঝা যায় যে,১৭৬৬ সালে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারপরও দুবার বাড়িটি পুননির্মিত হয়েছিল। একবার ১৮৯৬ সালে নারায়ণ কুন্ডুর আমলে,আর একবার বিজয়নারায়ণ কুন্ডুর আমলে।এই বিজয়নারায়ণ কুন্ডুই পরিবারের সবচাইতে সফল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজের বুদ্ধি ও যোগ্যতা বলে ইংরেজ আমলে ব্যবসা করে সাফল্য পান। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ঠিকাদারির কাজ করতেন বিজয়নারায়ণ। সঞ্জয়বাবুর কথায়,অসম বা বিহারের কোনো একটা দিকে রেললাইন পাতার সময় মাটি খুঁড়ে প্রচুর ধনসম্পদ পান তিনি। এই ধনসম্পদ দিয়েই বাড়িটি পুননির্মাণ করেন। শোনা যায়,তাঁর আমলেই কুন্ডু বাড়ি বিখ্যাত হয়ে ওঠে।তিনি রায় বাহাদুর উপাধিও পেয়েছিলেন।
রাজবাড়ির গল্প শুনতে শুনতে,অলিন্দে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম ছাতের সিঁড়ির কাছে। সিঁড়িটা অদ্ভুত। অনেকটা লম্বা, টানা সিঁড়ি। ছাতটাও বিশাল। গাছে ঘেরা। ছাতের পাঁচিলও প্রায় এক মানুষ লম্বা। ছাত থেকে চারপাশের সবুজ গ্রাম দেখতে বেশ লাগে। পুরো রাজবাড়িটা মোট আঠারো বিঘা জমির ওপর নির্মিত। দশ বিঘা জমিতে শুধু বাড়িটাই। বাকিটায় বাগান, পুকুর গোলা ইত্যাদি। বেশ কিছুটা সময় ছাতে কাটিয়ে নিচে নেমে এলাম।
বাড়ির পিছনে সুন্দর বাগান আর একটা পুকুর। আগে পুকুরটা রাজবাড়ির লোকেদের স্নানের কাজে ব্যবহার হত। সম্প্রতি বাগানে দুটি কটেজ করা হয়েছে,হোম-স্টে হিসাবে। পুকুরে বিকেলে মাছ ধরারও ব্যবস্থা আছে। পুরোনো গাছগুলো দেখলে বোঝা যায়, তারা ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। বাগান ঘুরে আমরা আবার শ্রীধর জিউয়ের মন্দিরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। ম্যানেজার বাবু বললেন, চলুন সংগ্রহশালা আর বৈঠকখানা ঘর দেখে আসি। ওপরে দোতলার বারান্দার পাশে রাজবাড়ির সংগ্রহশালা। সেখানে রাজবাড়ির ব্যবহৃত বাসন-কোসন, পূজার পাত্র, বিবিদের পান-সামগ্রী, প্রথম এ.কে. ৪৭ রাইফেলের মডেল, চাবুক ইত্যাদি সাজানো রয়েছে। আর রয়েছে বড়লাটের উপহারের স্বরূপ বিজয়নারায়ণকে দেওয়া তলোয়ার। সেখানে আছে একটা সিন্দুকও। বর্তমান মালিক ধ্রুবনারায়ণ কুন্ডুর আমলে বাড়ির গোপন সুড়ঙ্গ পথ থেকে এই লোহার সিন্দুকটি উদ্ধার করা হয়। খানকতক কড়ি,তামার পয়সা ছাড়া আর কিছুই মেলেনি সিন্দুক থেকে। রাজবাড়ির বৈঠকখানা ঘরটি বিশাল। পুরোনো আসবাব,টানাপাখা,পুরোনো কার্পেট,মার্বেলের টেবিল দিয়ে সাজানো ঘরটি। অনেকের মতে,এটি নাকি রাজবাড়ির নাচঘর ছিল। এই বৈঠকখানা ঘরেই আছে সুড়ঙ্গ পথটা। ঘরের দুদিকের দুটি দেওয়ালের পিছনেই আছে সুড়ঙ্গ পথ। একটি পথ গেছে নীচের অফিসঘরে আর একটি গেছে খন্যান রেলস্টেশনের কাছে।
রাজবাড়ির মন্দির নিয়েও একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আছে। কুন্ডুবাড়িতে কোনোদিনই শ্রীধর ছাড়া অন্য কোনও দেবদেবীর পুজো হয়নি। দিনে চারবার পুজো হয় শ্রীধরের।বিজয়নারায়ণের স্ত্রী স্বামীর কাছে অনুযোগ করে বলেন,শুধু শ্রীধরের পুজো হবে কেন? অন্যান্য দেব-দেবীরও পুজো হবে। স্ত্রীর অভিমানের কথা শুনে বিজয়নারায়ণ বাড়ির উল্টোদিকেই গড়ে তোলেন একটি শিবমন্দির। মন্দিরটি এখনও রয়েছে। তবে তার এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। অদ্ভূত এক শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। শিব এখানে গোঁফওয়ালা।বসার ভঙ্গিটিও নতুনত্ব। ডান হাঁটু তুলে মাটিতে বসে আছেন দেবাদিদেব। মন্দিরটির নির্মাণশৈলীও তখনকার সময় বাংলায় যে রকম শিবমন্দির দেখা যায়,তার মতো নয়। সম্পূর্ণ অন্য। কিন্তু বাড়ির মেয়েদের শিবমূর্তি চাই না - শিবলিঙ্গ চাই। এই শুনে বিজয়নারায়ণ কাশীতে এক ব্যক্তিকে শিবলিঙ্গ আনতে পাঠালেন। দিনের পর দিন কেটে গেল তিনি আর শিবলিঙ্গ নিয়ে ফিরে এলেন না।তারপর থেকেই মন্দিরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কোনোদিনও সেখানে পুজো হয়নি।
ঘড়িতে বেলা বারোটার ঘন্টা পড়ল। রাজবাড়িটা ঘুরে দেখতে দেখতে প্রায় দুঘন্টা কখন কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ঘরে ফিরে স্নান করে ফ্রেশ হতেই ডাক পড়ল লাঞ্চের। একদম রাজবাড়ির খাবার। এখানে থাকলে নিজেকে রাজা বলে মনে হবেই। আতিথেয়তায় কোনো খামতি নেই এদের। ঘরগুলোর নামেতেও বনেদিয়ানা। বড়বৌদি, ছোটবৌদি, পিসিমা, ভাইপো, ভাইঝি, ছোড়দি ইত্যাদি। রাজপরিবারের যারা যারা যে ঘরে থাকতেন, তাঁদের নামেই এই ঘরগুলো। সন্ধ্যায় শ্রীধরের আরতি দেখলে মন প্রসন্ন হয়ে যায়। দোলপূর্ণিমা ও জন্মাষ্টমীর দিন বড় পুজো হয় শ্রীধরকে ঘিরে। দোলের আগের দিন পালকিতে করে শ্রীধরকে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়।তারপর সন্ধ্যাবেলা নদীর ধারে হয় চাঁচর।
মাথার ওপর আধফালি চাঁদ। সকালের ব্যস্ততা নেই।অদ্ভূত নীরবতা চারিদিকে। দূরে বাঁশিওয়ালার মন কেমন করা বাঁশির ডাকটা বলছে, নিজের ঘরে ফিরতে হবে।
চন্দননগরের বাসিন্দা ইতিহাসের স্নাতকোত্তর সঞ্চিতা পাল ভালবাসেন বেড়াতে। শখ ফোটোগ্রাফি। ক্যামেরা হাতে কাছে-দূরে বেড়িয়ে পড়েন মন চাইলেই। পথের পশুদের সেবা করতেও ভালোবাসেন।