অতি সাধারণ এক ভ্রমণ কাহিনি
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
সন্ধ্যেবেলাতেই বন্ধুর ফোন পেলাম। জানালেন, আগামীকাল একটু তাড়াতাড়ি উঠবেন, জানি কষ্ট হবে, কিন্তু কিছু করার নেই। সূর্য ওঠার কিছুটা পরই বের হতে পারলে রাস্তায় গরমে কষ্ট কম হবে। আর গন্তব্যে পৌঁছে মন্দির দেখতেও সুবিধা হবে।
উত্তরে জানালাম, যথা আজ্ঞা। ঠিক সময় তৈরি থাকব। চিন্তা করবেন না।
হাতের কাছে যে কটি বই ছিল সেগুলি হাতড়ে দেখছিলাম কয়েক দিন ধরেই। বীরভূমে নানুরের কাছে একটি প্রাচীন গ্রাম উচকরণ। উচকরণে রয়েছে পোড়ামাটির চারটে শিব মন্দির (প্রতিষ্ঠাকাল বঙ্গাব্দ ১১৭৫)। মাঘী পূর্ণিমায় গ্রামে চাঁদ রায়ের উৎসব হয়। চাঁদ রায়ের আট চালায় (খ্রিষ্টাব্দ ১৭৬৮) কাঠের উপর দেবদেবীর সুন্দর মুর্তি খোদাই করা রয়েছে। আঁকা রয়েছে জটায়ু-লাউসেনের কাহিনি। শুধু তাই নয় এখানে বাংলা ১১৫৬ সালের ২ আশ্বিন হৃদয়রাম সৌ 'ধর্মমঙ্গল' রচনা শেষ করেন। মনে পড়ছিল স্কুলে পড়ার সময় ধর্মমঙ্গল কাব্য বা লাউসেনের কাহিনি পড়েছিলাম। উচকরণ গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছেটা তাই চাগিয়ে উঠেছিল। বন্ধুকে জানাতেই উনিও এক কথাতেই রাজি হয়েছিলেন। শুধু সঙ্গী নয়, সারথিও বটে অর্থাৎ মোটর সাইকেল চালাবেন উনি আর আমি পিছনে বসে থাকব।
যাত্রার শুরুতেই গৃহিণী আমাদের সাবধান করেছিলেন, 'মনে রেখ বুড়ো হয়েছ। এরকম হুট করে বেরোনো এবার বন্ধ কর। হাত পা ভাঙলে আর জোড়া লাগবে না...' ইত্যাদি ইত্যাদি।
বর্ধমান-কাটোয়া রোডে নর্জা মোড় থেকে নতুনহাটের রাস্তা ধরলেন সারথি। পার হলাম অজয়। তারপর বাদশাহী রোড না ধরে বাঁ দিকে খুজুটিপাড়া হয়ে যে রাস্তা নানুর গিয়েছে সেই পথ ধরেই এগিয়ে চললাম আমরা। অজয়ের ব্রিজের ওপর উঠে বাঁ দিকে দূরে একটি বাড়ি দেখালেন দেখিয়ে তিনি বললেন, বিখ্যাত কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বাড়ি এটা। আমার মনে পড়ল কবির লেখা দুটি লাইন -
"বাড়ি আমার ভাঙ্গন ধরা অজয় নদীর বাঁকে
জল সেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে।"
দূরে তাকিয়ে দেখছিলাম সত্যিই কবির বাড়ির কাছে নদী কেমন বাঁক নিয়েছে।
পথ চলতি মানুষদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম নানুরের রাস্তায় বালিগুনি গ্রাম থেকে বাঁ দিকে যেতে হবে উচকরণ যাবার জন্য। একসময় বালিগুনি পৌঁছলাম। তারপর সেখান থেকে উচকরণ। একটি চালা ঘরের বারান্দায় কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বসেছিলেন,বাইক থেকে নেমে তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম শিব মন্দিরের অবস্থান কোথায়। মন্দির যাওয়ার রাস্তার হদিস দেওয়ার পর জানতে চাইলেন, আমরা কোথা থেকে এসেছি, আসার উদ্দেশ্যটাই বা কী এমন নানা কথা।
বাংলার গ্রামগঞ্জে অজস্র পু্রনো মন্দির অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে, ভেঙে পড়ছে, নিশ্চিহ্ন হচ্ছে প্রত্নসম্পদ। অথচ আমাদের কারো হুঁশ নেই। এই সব মন্দির দেখতে গেলেই অনেক গ্রামবাসী ধারণা করেন আমরা কোন সংবাদ মাধ্যমের পক্ষ থেকে এসেছি। মন্দিরগুলি কোন না কোন পরিবারের সম্পত্তি অথচ মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে তাঁদের চরম অনীহা প্রকাশ পায়। সে কথা তাঁদের জানালে শুনতে হয়, সরকার কোনও সাহায্য করে না। উচকরণেও একই কথা শুনতে হল। আমি বিনীত ভাবে জানালাম,বাড়ি বা সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যদি সম্পত্তি মালিকের হয়, তবে মন্দির রক্ষাও তাঁদের একই ভাবে করা উচিৎ। তাহলে সরকারের প্রশ্ন আসছে কেন? সম্পত্তির মালিক তাঁর দায়িত্ব পালন করলেই সমস্যা মিটে যায়।
ছবি নং - ১ |
ছবি নং - ২ |
সরখেল পরিবারের বাড়ির সামনে এক টুকরো জমি, সেখানেই রয়েছে পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকৃত চারটি শিব মন্দির [ছবি নং ১]। মন্দিরগুলি বড় নয়। পোড়ামাটির অলংকরণ দেখতে শুরু করেছি এমন সময় পূজারী ব্রাহ্মণ এলেন নিত্যপূজা করতে। উনি একটি মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পূজা শুরু করলেন,আমরাও আমাদের মতো দেখতে লাগলাম।
পোড়ামাটির মন্দিরে অলংকরণগুলি সাধারণত সজ্জিত থাকে প্রবেশদ্বারের খিলানের ওপরে,দ্বারের দুই পাশে ওপর থেকে নীচে সারিবদ্ধভাবে এবং খিলান শীর্ষের খানিকটা ওপরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে সাজানো। উচকরণের মন্দিরগুলির অনেক পোড়ামাটির ফলকই আজ অদৃশ্য,সেগুলি টালি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।
একেবারে ডানপাশের মন্দিরটির প্রবেশদ্বারের খিলান শীর্ষে রয়েছে রামায়ণ কাহিনির সুন্দর একটি প্যানেল। দেখানো হয়েছে রাম-লক্ষণ সহ বানর বাহিনীর সঙ্গে কুম্ভকর্ণের যুদ্ধ। বানরেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কুম্ভকর্ণ বানর ভক্ষণরত। প্যানেলের বাম দিকে রাম-লক্ষ্মণ ধনুকের সাহায্যে বাণ নিক্ষেপ করছেন। তাঁদের পিছনে রয়েছে জোড় হস্তে জাম্বুবান এবং শেষে হনুমান [ছবি নং ২]।
ছবি নং - ৩ |
ছবি নং - ৪ |
পাশের মন্দিরটির খিলানশীর্ষের প্যানেলে রয়েছে দশানন রাবণের সঙ্গে রাম-লক্ষণের যুদ্ধ [ছবি নং ৩]। রাম-লক্ষ্মণ এবং রাবণ দুপক্ষই মকরমুখী রথে চেপে যুদ্ধ করছেন। রাম-লক্ষ্মণ তীর ধনুকের সাহায্যে, অপরদিকে দশানন বর্শা এবং তলোয়ারের সাহায্যে যুদ্ধরত। প্যানেলটির নীচের অংশে (ডান দিকে) বাদকেরা ঢাক,ডগর এবং সানাই বাজিয়ে যোদ্ধাদের উৎসাহিত করছে। এছাড়া আরও কয়েকটি অসাধারণ ফলক রয়েছে এই মন্দিরে। একটিতে নববিবাহিত দম্পতি পাশা খেলছেন [ছবি নং ৪]। কারো কারো মতে এটি সদ্য বিবাহিত শিব-পার্বতীর কাহিনি। বরের চেহারা দেখে কেউ মনে করছেন এটি গৌরীদানের দৃশ্য,যা এদেশে উনবিংশ শতকে আকছার ঘটত। মন্দির উপরিভাগে সপারিষদ রামসীতা সিংহাসনে উপবিষ্ট। উপরিভাগের দুই কোণে মকরবাহনে গঙ্গাদেবী (বাম কোণে) এবং গড়গড়া টানছেন এক ব্যক্তি (ডান দিকের কোণে)। তার পাশে প্রভুভক্ত কুকুর বসে রয়েছে [ছবি নং ৫]।
ছবি নং - ৫ |
ছবি নং - ৬ |
অপর দুটি মন্দিরের একটির খিলানশীর্ষে রয়েছে দশমহাবিদ্যার কয়েকটি রূপ এবং কালী। অন্যটিতে রয়েছে লঙ্কা যুদ্ধ। এছাড়া রয়েছে মনোহরণকারী বেশ কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক, যেমন গরুড় বাহনে শ্রী বিষ্ণু,চতুর্মুখ ব্রহ্মা,নারদ,চতুর্ভুজ গৌরাঙ্গ এবং কৃষ্ণ কাহিনির বেশ কয়েকটি ফলক।
মন্দিরগুলি দেখার পর আমরা সেই আটচালার সন্ধান করতে লাগলাম যেখানে মাঘী পূর্ণিমায় চাঁদ রায়ের উৎসব হয়। সেখানে পৌঁছে বেশ হতাশ হতে হল। বইয়ে পড়েছিলাম এখানে কাঠের উপর জটায়ু লাউসেনের কাহিনি খোদাই করা রয়েছে। যে পরিবারের সম্পত্তি এই মন্দিরটি তাঁরা জানালেন,সংস্কারের ফলে (সরকারি দফতরকৃত?) অনেক কিছু নষ্ট হয়েছে। তবে মন্দিরের গর্ভগৃহ প্রবেশদ্বারে অনেক মুর্তি খোদাই করা আছে যেমন মারীচবধ,রামসীতা,দশানন রাবণ,দশাবতার,কংশবধ,কৃষ্ণ কাহিনি ইত্যাদি [ছবি নং ৬]।
উচকরণ বিভিন্ন কৃতী মানুষের জন্মস্থান। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন শম্ভূনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। অবিভক্ত বাংলার পোস্টমাস্টার ছিলেন রজনীকান্ত ভট্টাচার্য। বর্ধমান রাজ কলেজে অধ্যাপনা করতেন বীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী মশাই। বীরেনবাবু আমার পরিচিত। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার সুবাদেই এই পরিচয়। বেশ কিছুকাল আগেই অবসর গ্রহণ করেছেন। আমার ধারণা ছিল বর্তমানে উনি এই গ্রামেই বাস করছেন। ইচ্ছা ছিল ওঁর সঙ্গে দেখা করার। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম উনি বর্ধমানেই থাকেন।
ছবি নং - ৭ |
ছবি নং - ৮ |
উচকরণ থেকে বের হয়ে নানুর অভিমুখে রওনা হলাম। সারথি আমাকে হাজির করলেন দ্বিজ চণ্ডীদাসের জন্মস্থানে। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দির - চণ্ডীদাস সেবিত বিশালাক্ষী ও কয়েকটি শিব মন্দির [ছবি নং ৭]। মন্দিরগুলো দেখতে অনেকটা সময় লাগল। দুর্গা মন্দিরে আলাপ হল সেবাইত পরেশনাথ চক্রবর্তী মশাইয়ের সঙ্গে। এই মন্দিরে মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা হয়। পরেশবাবু দেবী মূর্তি তৈরি করছেন দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম সেদিন। জানালেন গত ৫০ বছর ধরে মূর্তি তৈরি করছেন। সাধারণত মৃত্তিকা কর্মীরাই দেবস্থানে এসে অথবা নিজের বাড়িতে দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করেন। এখানে সেবাইত নিজে দেবী মূর্তি তৈরি করছেন ভালবেসে। এমন ঘটনা সত্যি বিরল [ছবি নং ৮]।
সূর্যদেব মাথার ওপরে বিরাজ করছেন,রোদের তেজও বেশ বেড়েছে তাই একটি গাছের নীচে ধপ করে বসে পড়লাম। জিরিয়ে নিলাম খানিকটা। সেই সঙ্গে ভাবনা চিন্তা এরপর কোথায় যাব। ঠিক হল রাস্তায় কিছু খেয়ে নিয়ে বোলপুরের কাছে সুপুরই হবে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল। ওখানে রয়েছেন আমাদের পরিচিত কয়েকজন। তৈরি করেছেন একটি এন.জি.ও.। সমাজসেবামূলক কাজ করে চলেছেন নিরন্তর।
সুপুরেই লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিনহার আদি বাড়ি। বিশাল বাড়িটি আজ আর ভগ্নস্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়। সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন (২৪শে মার্চ ১৮৬৩ - ৪ঠা মার্চ ১৯২৮) বৃত্তি পেয়ে ইংল্যান্ডে আইন পড়তে যান। ফিরে এসে ওকালতি শুরু করেন,ব্যারিস্টার হন। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯০৮ সালে সত্যেন্দ্রপ্রসন্নকে বাংলার প্রথম অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত করেন। কয়েক বছর পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন (১৯১৫-১৬)। ১৯২০ সালে বিহার এবং ওড়িশার গভর্নর হিসাবে নিয়োজিত হন উনি। গত শতকের প্রথম ভাগে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন বাংলা দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের একজন হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন।
যে এন.জি.ও-র অফিসে আমরা সেদিন দুপুরে হাজির হয়েছিলাম, সেটি লর্ড সিনহার বাড়ি সংলগ্ন ওই পরিবারের অপর একটি বাড়িতেই অবস্থিত। এখানে গ্রামের মহিলাদের সেলাই শেখানো হয়,অল্পবয়সী আদিবাসী মেয়েদের শিক্ষাও দেওয়া হয়।
লর্ড সিনহাদের বাড়িটির ছাদ ভেঙে পড়েছে। দরজা জানালা কড়ি বরগা সব চুরি হয়ে গেছে। বড় বাড়িটার দিকে তাকাতেও খারাপ লাগে। একশো বছর আগে এই বাড়িটাই লোকজনে জমজমাট হয়ে থাকত। সকলের দৃষ্টি এদিকেই পড়ত। আর আজ এটি খন্ডহর।
ঘণ্টা দুই বিশ্রাম নিয়ে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। এবার সঙ্গী হলেন ওই সংস্থার দুজনও। আমাদের গন্তব্য সবুজবন সংলগ্ন ইটন্ডা গ্রাম। গ্রামটি অজয় নদের ধারেই অবস্থিত। উদ্দেশ্য বীরভূমের অন্যতম সুদৃশ্য টেরাকোটা অলংকৃত পোড়ামাটির জোড়বাংলা মন্দির দেখা। ইটন্ডা গ্রামটি অতি প্রাচীন, এক সময় এখানে নৌবন্দর ছিল। এই সুন্দর জনপদটি ১৭৪৫ সালে মারাঠা বর্গি আক্রমণে ধ্বংস হয়। নষ্ট হয়ে যায় অনেক কিছুই।
জোড়বাংলা কালী মন্দিরটি দেখতে শুরু করেছি সবে,এমন সময় আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। সারথি আমাদের সাবধান করে দিয়ে বললেন, 'গঙ্গাফড়িং উড়ছে,নিশ্চিত ঝড়বৃষ্টি হবে। আমাদের এখনই রওনা হতে হবে।' যেতে হবে অনেকটা পথ। সুদৃশ্য মন্দিরটা ছেড়ে চলে আসতে হল দেখা হল না,মনটা তাই খারাপ হয়ে গেল।
সামান্য কয়েক কিলোমিটার পথ আসতেই শুরু হল প্রবল ঝড় বৃষ্টি। গাছের ডালপালা ভেঙে পড়তে লাগল রাস্তায়। বৃষ্টির ধারা বাড়তেই রাস্তার ধারে একটি মাটির বাড়ি দেখে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। মোটর সাইকেল রাস্তার পাশে স্ট্যান্ড করতে করতেই প্রায় ভিজে গেলাম দুজনে। মাটির চালা ঘরটির সামনে একফালি বারান্দা। বাড়ির মালকিন তার দুটি শিশু সন্তানকে নিয়ে হাসি মুখে আমাদের আশ্রয় দিল। বারান্দায় একটি খাটিয়া পাতা রয়েছে। আমাদের আগেই অল্পবয়সী এক দম্পতি এখানে আশ্রয় নিয়েছে।
বাড়িতে দুটি ঘর। একটি ঘরে বড় ছেলেটি খেলা করছে। অন্য ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে রয়েছে মালকিন,কোলে শিশু পুত্র। শিশু পুত্রটিকে সামলাতে সামলাতে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল মেয়েটি। ওর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম অনেক কিছুই। প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। জলের ছাট এসে আমাদেরও ভিজিয়ে দিচ্ছে। স্বার্থপরের মতো বারান্দার ভিতরের দিকে চলে এসেছি আমি। এতো অসুবিধা সত্ত্বেও মেয়েটি নিজের কাজ করে চলেছে। জানাল,অজয়ের বান এলে এই অঞ্চল ডুবে যায়। সেক্ষেত্রে এদের আশ্রয় নিতে হয় কাছাকাছি কোন উঁচু অঞ্চলে বা রাস্তায়।
মেয়েটির স্বামী বাইরে রয়েছে,এই দুর্যোগে সে কখন বাড়ি ফিরতে পারবে তার ঠিক নেই। এই অবস্থায় আমরা অস্থির হয়ে পড়তাম। সেলফোন কান থেকে নামত না। অথচ এই মেয়েটির ব্যবহারে কোন অস্থিরতা দেখলাম না। ভাবি,শহরকেন্দ্রিক জীবনের সঙ্গে গ্রাম্য জীবনের কত তফাৎ! শহরকেন্দ্রিকতা আমাদের কত না পাল্টে দিয়েছে! এখন আমরা অল্পে বিচলিত হয়ে পড়ি।
ঘণ্টা খানেক প্রবল বৃষ্টির পর বৃষ্টির ধারা একটু কমতেই সারথি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কি ভিজতে পারবেন তো? তা হলে এখনই রওনা হব।'
ক্যামেরাটি পলিথিন প্যাকেটে মুড়ে ব্যাগের ভেতর রেখে আমাদের যাত্রা শুরু হল আবার। সারা রাস্তায় কম বেশি বৃষ্টি এবং ঠাণ্ডা হাওয়ায় বেগ পেতে হয়েছিল সেদিন। সারথির আঙুল অবশ হয়ে আসছিল ঠাণ্ডা হাওয়ায়। অসুবিধা হচ্ছিল মোটর সাইকেল চালাতে। আমি মোটর সাইকেল কেন সাইকেলই চালাতে পারি না, অকম্মা। সুতরাং সাহায্যের প্রশ্নই ওঠে না। তালিত রেল গেট পার হওয়ার সময় ভেজা রেল লাইনে মোটর সাইকেলের চাকা পিছলে যেতেই আমরা পড়তে পড়তে বেঁচেছিলাম। দুজনের পায়েই অল্প বিস্তর আঘাত লেগেছিল।
বাড়ি পৌঁছে শেষ হয়েছিল সেদিনের ভ্রমণ। তবে আজও ভুলতে পারিনি আশ্রয়দাত্রীর সহজ সরল ব্যবহার। প্রবল বৃষ্টির সময়ে আমাদের মত অচেনা মানুষদের সাহস যুগিয়ে বলেছিল, 'থেকে যাও না আজ রাতটা। অতটা পথ আজ আর যাবার দরকার নেই।' এই কথাটা আজও আমি শুনতে পাই,ভুলতে পারিনি সেই গলার স্বর। ভাবি,আমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা অচেনা অজানা মানুষ দেখলেই বাড়ির দরজা বন্ধ করি। আর গ্রামের সরল মানুষ এক নিমেষে পরকে আপন করে নেয়। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! এই জন্যই বারে বারে ছুটে যাই গ্রাম বাংলায়। রাস্তার ধারে বসে মুড়ি খাই। হাঁটুর ওপরে কাপড় পরা মানুষটার সঙ্গে গল্প করি। ভ্রমণের জন্য আমাকে যেতে হয় না ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া তুরস্ক, এমন কী সিমলা বা মানালিও। যতদিন গ্রাম বাংলা আছে, আছে এই মানুষগুলো, আমাকে ভাবতে হবে না এবার কোথায় যাব। কাঁধের ঝোলায় জলের বোতল আর ক্যামেরা থাকলেই হল।
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের নেশা বেড়ানো আর ছবি তোলা। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা চোখের আড়ালে চলে যাওয়া টেরাকোটার মন্দিরশিল্পকে ক্যামেরার দৃষ্টিতে পুনরুদ্ধার করাই তাঁর ভালোলাগা। পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ ও অন্যান্য বিষয়ে লেখা।