ভারতের হৃদয়ের খোঁজে
সৌমিত্র বিশ্বাস
মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের 'হিন্দুস্তান কা দিল দেখো'-র আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্থির করলাম এবার মালওয়া বা মালব্য অঞ্চলে ঘুরে আসি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এক শনিবার সন্ধ্যায় আমরা কত্তা-গিন্নি দিল্লি থেকে ইন্দোর পৌঁছেছি বিমানপথে – দেবী অহল্যাবাই হোলকার নামাঙ্কিত নতুন ঝকঝকে বিমানবন্দর। ইন্দোর মধ্যপ্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্নায়ুকেন্দ্র। একদিকে পীতমপুর আর অন্যদিকে দেওয়াস জুড়ে ব্যস্ত শিল্পাঞ্চল, বহু লোকের কর্মসংস্থান! মধ্যপ্রদেশে শিক্ষারও প্রাণকেন্দ্র ইন্দোর – সুপ্রসিদ্ধ দেবী অহল্যাবাই হোলকার বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'টি ক্যাম্পাস ছাড়াও শহর ও শহরের উপকন্ঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলি মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার ও ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভারতে ইন্দোরই একমাত্র শহর যেখানে আই.আই.টি. ও আই.আই.এম. উভয়ই রয়েছে। চারদিকে নতুন তৈরি টাউনশিপ, শপিং মল, হোটেল, নামী ব্র্যান্ডের শো-রুম ও মাল্টিপ্লেক্স-এর ছড়াছড়ি – বেশ চনমনে, প্রাণবন্ত এক শহর!
রবিবার সকালে ইন্দোর দর্শনে বেরিয়ে প্রথম গন্তব্য 'রাজওয়াড়া' - মালওয়ার পেশোয়া, হোলকারদের রাজপ্রাসাদ। ১৭৬৬ সালে পেশোয়া মলহার রাও হোলকার এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সাততলা উঁচু প্রাসাদের বিশালাকায় প্রথমাংশ বেশ সম্ভ্রমের সঞ্চার করে মনে। পাথর দিয়ে প্রথম তিনতলা মোগল ও কাঠের ব্যবহারে পরের চারতলা মারাঠা বাস্তুকলার অনুসরণে তৈরি। অধুনা প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে মধ্যপ্রদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ – মাথাপিছু দশটাকা প্রবেশমূল্য, ক্যামেরার জন্য আরও পঁচিশ টাকা। সুউচ্চ কাঠের প্রবেশদ্বার দিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম এক বিস্তৃত অঙ্গণে। অঙ্গণ পার করে চোখে পড়ল প্রাসাদের দক্ষিণাংশ – একতলায় একটি গণেশ মন্দির, ওপরতলায় বিরাট সভাঘরে পেশোয়ার দরবার, আবিষ্কার করি সভাঘরের বাইরের দেওয়ালে তিনটি কারুকার্যময় মার্বেলের 'ঝরোখা'। সুচারু ভাবে সংরক্ষিত সভাঘরটি সত্যিই রাজকীয়। দোতলায় একদিকে একটি ছোট মিউজিয়াম - দেওয়ালে টাঙানো হোলকার বংশের সব পেশোয়াদের প্রতিকৃতি, ইন্দোর স্টেটের পুরনো মুদ্রা, বিদেশ থেকে পাওয়া নানারকমের উপহার সামগ্রীর সমাহার।
রাজওয়াড়া থেকে বেরিয়ে ব্যস্ত দোকানপাট ও বাজার ছাড়িয়ে গেলাম 'কাঁচ মন্দির' - এক প্রাচীন কারুকার্যময় ভবনের একটি অংশে মন্দিরটি। জৈন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনার মন্দিরে মহাবীরের মর্মর মূর্তি, দেখি মন্দিরের মেঝে, সিলিং, দেওয়াল, স্তম্ভ সব রঙিন কাঁচের টুকরো দিয়ে তৈরি সুন্দর সব নকশায় শোভিত। মন্দিরে ছবি তোলা নিষেধ, রঙিন কাঁচের অভিনব নকশা ক্যামেরা-বন্দির আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে একটু মনক্ষুণ্ণ হয়ে বেরিয়ে আসি আমরা, এগিয়ে চলি পরবর্তী গন্তব্যের পথে।
শহরের প্রায় কেন্দ্রে হোলকারদের লালবাগ প্রাসাদ। মহারাজ শিবাজি রাও হোলকার-এর রাজত্ত্বকালে (১৮৮৬-১৯০৩) শুরু হয় প্রাসাদটির নির্মাণ; ১৯২১ সালে নির্মাণ কার্য শেষ করেন তাঁর পুত্র ও উত্তরসূরি মহারাজ টুকোজি রাও হোলকার (রাজত্বকাল ১৯০৩-১৯২৬)। রাজওয়াড়ার মতই লালবাগ প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সামলায় মধ্যপ্রদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ। এখানেও মাথাপিছু দশটাকা প্রবেশমূল্য, ক্যামেরার জন্য আরও পঁচিশ টাকা – তবে সরকারি টিকেট বিক্রেতা জানায় ছবি তোলা যাবে কিন্তু প্রাসাদের বাইরে, প্রাসাদ সংলগ্ন বাগিচায়। একটু অখুশি হয়েই প্রাসাদের বাগানে এগিয়ে যাই – সযত্নে লালিত বাগানটির কিন্তু প্রশংসা করতেই হয় – চারিদিকে স্নিগ্ধ ছায়াঘন মহীরুহের দল, নারীমূর্তির ভাস্কর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এসবের ছবি তুলে কেটে যায় কিছুটা সময়। চোখে পড়ে বাগানের একপাশে একটি টিনের চালার নীচে অবহেলিত মহারানী ভিক্টোরিয়ার মর্মর মূর্তি। প্রবেশদ্বারে ক্যামেরা ও মোবাইল জমা দিয়ে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পাই। প্রাসাদের বাস্তুকলা আমাদের চমৎকৃত করে - রেনেসাঁস, প্যালাডিয়ান ও বারোক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি প্রাসাদ নিয়ে যায় আমাদের মধ্যযুগীয় ইউরোপে। প্রাসাদে ডোরিক, আয়োনিয়ান ও কোরিন্থিয়ান স্তম্ভের ব্যবহার – দেওয়ালে এবং সিলিঙে গ্রিক ও লাতিন পুরাণ চরিত্রের চিত্রায়ন ও ভাস্কর্য। লম্বা লম্বা জানালায় নকশাদার পর্দা, ঝুলন্ত বিশাল ঝাড়বাতি ও দেওয়ালে বড় বড় বেলজিয়ান আয়না। বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ বদান্যতাপুষ্ট হোলকার নেটিভ স্টেটের বৈভবের চূড়ান্ত নিদর্শন!
পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরেই আমরা বেরিয়ে পড়ি প্রাচীন মালওয়ার রাজধানী মান্ডুর পথে। চার লেনের প্রশস্ত জাতীয় রাজপথ নম্বর ৫৯ ধরে আমাদের গাড়ি চলে দ্রুতবেগে – প্রায় ৯৫ কিমি পথ দুঘন্টায় পেরিয়ে এসে পৌঁছই মান্ডু দুর্গের প্রবেশদ্বারে। ইতিহাসের পাতা ওলটালে মান্ডু বা মান্ডবের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সপ্তম শতাব্দীতে। একাদশ শতাব্দীতে শক্তিশালী পারমার রাজপুত রাজা ভোজ মালওয়ার রাজধানী ধার থেকে আসেন মান্ডুতে। সমুদ্রতট থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু তিনপাশে বিন্ধ্যপর্বতের অতি দুর্গম গিরিবর্ত্ম 'কোখরা খো' আর একদিকে নিমাড়ের সমতল, এইরকম জায়গায় এক নিশ্ছিদ্র দুর্গ নির্মাণের জন্য রাজা ভোজ বেছে নেন মান্ডুকে। ৮২ কিমি পরিধি জুড়ে তৈরি হয় দুর্গের প্রাচীর – রাজা ভোজের তৈরি মান্ডবগড়ে বসতি হয় নয় লক্ষ লোকের।
১৩০৫ সালে তৎকালীন পারমার রাজাকে হারিয়ে দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি মান্ডু দখল করে নেন। এর প্রায় একশ বছর পরে, ১৪০১ সালে দিল্লীর তুঘলকি শাসনের টালমাটাল অবস্থায়, মালওয়ার আফগান গভর্নর, দিলওয়ার খান ঘুরি মালওয়াকে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন – ধার থেকে মান্ডুতে স্থানান্তরিত হয় মালওয়ার রাজধানী। মান্ডুর নামকরণ হয়, 'শাহিদাবাদ' বা আনন্দনগরী! ১৪০৬ সালে দিলওয়ার খানকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেন তাঁর ছেলে, অলপ খান। তিনি হোশঙ্গ শাহ নাম নিয়ে রাজত্ব করেন ২৬ বছর। হোশঙ্গ শাহের ছেলে মহম্মদ শাহ বছর চারেক রাজত্ব করার পরে ১৪৩৬ সালে তাঁকে বিষ দিয়ে মেরে তাঁরই সেনাপতি মামুদ শাহ খিলজি মান্ডুতে প্রতিষ্ঠা করেন খিলজি বংশের রাজত্ব।
মান্ডুর অলিতে গলিতে ও প্রাসাদের আনাচে কানাচে সিংহাসন দখলে পিতৃহত্যা, ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব এবং বিশ্বাসঘাতকতার করুণ উপাখ্যান ফেলে গভীর দীর্ঘশ্বাস!
আমাদের গাড়ি মান্ডু দুর্গের আলমগির দরওয়াজা, ভাঙ্গি দরওয়াজা ও দিল্লি দরওয়াজা পার হয়ে জনপদে প্রবেশ করে। অগ্রিম বুক করে রাখা মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের 'মালওয়া রিট্রিট'-এ একটি এসি ঘর পেয়ে যাই সহজেই। দোতলা ছোট হোটেলটি বেশ ছিমছাম – হোটেলের সামনে অনেকখানি খোলা জায়গায় পাতাবাহার গাছ, কেয়ারি করা ফুলের বাগান ও গাড়ি পার্কিং-এর বন্দোবস্ত। রিসেপশন সংলগ্ন ক্যাফেটেরিয়াতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমাদের ঘরের পেছনে ব্যালকনি থেকে দেখতে পাই 'কোখরা খো'র গহন খাদ। তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেরিয়ে পড়ি মান্ডুর পুরাতত্ত্ব দর্শনে।
মান্ডুর পুরাতত্ত্ব নিদর্শনগুলি তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত – আশরফি মহল, জামি মসজিদ ও হোশঙ্গ শাহের সমাধি নিয়ে সবচেয়ে পুরনো 'ভিলেজ ক্লাস্টার' মান্ডু শহরের মধ্যিখানে। সেখান থেকে প্রায় এক কিমি দূরে 'রয়্যাল ক্লাস্টার' বা শাহী পরিসরে বিখ্যাত জাহাজ মহল, হিন্দোলা মহল ও জল মহল। আর 'ভিলেজ ক্লাস্টার' থেকে প্রায় ৬ কিমি দূরে রেওয়া কুন্ড, বাজ বাহাদুরের প্রাসাদ ও রানী রূপমতীর প্যাভিলিয়ন।
হাতে অনেক সময় – আদ্ধেক দিন বরাদ্দ করলাম 'ভিলেজ ক্লাস্টার'-এর জন্য। মান্ডুর সবগুলি সৌধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (ASI) সংস্থার হাতে। 'ভিলেজ ক্লাস্টার'-এর সবকটি সৌধের জন্য প্রবেশমূল্য মাথাপিছু পাঁচটাকা, স্টিল ক্যামেরায় ছবি তুলতে কোনও পয়সা লাগেনা। গেট দিয়ে ঢুকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি চড়ে এক বিরাট চত্বর পার হয়ে আমরা পৌঁছই সার সার স্তম্ভ দেওয়া জামি মসজিদের প্রধান প্রার্থনাসভায়। প্রার্থনাসভার কেন্দ্রে রাজার বসার জন্য এক উঁচু বেদী মসজিদের পরিবেশে কেমন যেন বেমানান। পুরো মসজিদটি লাল রঙের বেলে পাথরের তৈরি। জামি মসজিদের পেছনের অংশে হোশঙ্গ শাহের মকবারা – এটি ভারতের প্রথম মর্মর সৌধ, তাজমহলের প্রায় ২০০ বছর আগে তৈরি। রাজস্থানের মকরানা থেকে আনা উচ্চমানের মার্বেলের ব্যবহার হয়েছিল এর নির্মাণে। হোশঙ্গ শাহ মৃত্যুর অনেক আগেই নিজের মকবারা তৈরি শুরু করেছিলেন – পিতৃহন্তা শাসক নিজের পুত্রের ওপর ভরসা করতে পারেননি বোধহয়! তাজমহল নির্মাণের সময় সম্রাট শাজাহান তাঁর স্থপতিশিল্পীদের মান্ডুতে পাঠিয়েছিলেন হোশঙ্গ শাহের মকবারার নকশা অনুধাবন করতে। আমাদের গাইড জানালেন হোশঙ্গ শাহের নশ্বর দেহ নাকি শেষঅবধি মান্ডুতে সমাধিস্থই হয়নি, তাঁর আসল সমাধি আছে ইটার্সির কাছে হোশঙ্গাবাদে! জামি মসজিদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তা পার হই আমরা আশরফি মহলের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছু অধ্যয়ন কক্ষ, ছাত্রদের অনেকগুলি বাসস্থান নিয়ে একটি বড় মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন মহম্মদ খিলজি আশরফি মহলে, পরে এটি রূপান্তরিত হয় সমাধিস্থল হিসাবে। দোতলায় মূল অংশটির ছাদ ভেঙে পড়েছে বহুদিন আগে, সেখানে দেখি মহম্মদ খিলজি আর তাঁর পরিবারবর্গের সমাধি। চারপাশে স্তূপীকৃত করে রাখা অনেক কারুকাজময় ধ্বংসাবশেষ।
দিনের শেষে পৌঁছালাম লোহানি কেভস-এর পাশে 'সানসেট পয়েন্টে' –পাহাড়ের গায়ে গায়ে অনেকগুলি ছোট গুহা, তাদের সামনে দিয়ে এক পাহাড়ি নালা তিরতির করে বয়ে চলেছে। সুদূরে, বিন্ধ্যপর্বতের গহন খাদের শেষে, সমতলের দিকচক্রবালে ধীরে অস্তগামী সূর্য - আকাশে তখন নানারঙের হোলিখেলা আর দলে দলে পাখির সকলরবে বাসায় প্রত্যাবর্তন।
মান্ডুর আশে পাশে যত্রতত্র চোখে পড়বে বাওবাব গাছ – এ গাছের গুঁড়ির ব্যাস বিশাল (২৫-৩৫ ফিট, ফেব্রুয়ারি মাসে পাতাহীন ন্যাড়া ডালপালা দেখলে মনে হয় গাছটিকে কেউ উল্টো করে পুঁতে দিয়েছে।ডালপালা তো নয়, যেন মাটির নীচের শেকড়বাকড়! কিন্তু বাওবাব তো প্রধানত আফ্রিকার গাছ,মান্ডুতে এল কি করে? বই পড়ে জানতে পারি, মহম্মদ খিলজির তেত্রিশ বছর রাজত্বে মালওয়ারের প্রভূত উন্নতি হয়, বিস্তৃত হয় মালওয়া রাজ্য। শিক্ষা প্রসারেও মহম্মদ খিলজি ছিলেন খুব সচেষ্ট। পশ্চিম এশিয়া, আরব, মিশর ও আরও আফ্রিকার দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে মালওয়ারের। সেসব দেশের রাষ্ট্রদূতেদের সৌজন্যে বাওবাব ফল ও বীজ পৌঁছয় মান্ডুতে – প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো গাছগুলি কত না ইতিহাসের সাক্ষী!
পরদিন আমরা চলি 'শাহি পরিসর' বা সুলতানদের প্রাসাদ। এখানে ASI-এর রক্ষণাবেক্ষণের ও সৌন্দর্যায়নের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। ১৪৬৯ সালে মহম্মদ খিলজির মৃত্যুতে তাঁর ছেলে গিয়াসুদ্দিন খিলজি মালওয়ার সুলতান হন – তিনি ঊনচল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। গিয়াসুদ্দিন ছিলেন বড়ই বিচিত্র স্বভাবের – যুদ্ধবিগ্রহের পথ মাড়াননি তিনি, ধর্মনিরপেক্ষ, মদ্যপানে অনাসক্তি। কিন্তু নারীসঙ্গে তাঁর জুড়ি পাওয়া ভার; জাহাজ মহল প্রাসাদ তৈরি করে গিয়াসুদ্দিন বসিয়েছিলেন এক বিরাট হারেম - দেশ-বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল পনেরশো বেগম! জাহাজ মহলের দুইদিকে দু'টি লেক, মঞ্জ তালাও আর কপূর তালাও, জলভরা লেকে যেন জাহাজ ভাসছে। ওই মঞ্জ আর কপূর তালাও-এর জলে মেশান হত সুগন্ধী ভেষজ দ্রব্যাদি – নিয়মিত সাঁতার দিতেন বেগমরা ওই লেকের জলে, এতে তাঁদের চুল কালো ও শরীর সুঠাম থাকত। জাহাজ মহলে দুই দেওয়ালের ভেতরে জল সরবরাহ করা হত, মহলে ফুলের আকারে অনেক ছোট ছোট জলাধার – মধ্যভারতের গ্রীষ্মে বাতানুকূল পরিবেশ সৃষ্টির অভিনব প্রচেষ্টা! জাহাজ মহলের ছাদ থেকে পুরো শাহী পরিসরের দৃশ্য বড়ই মনোরম।
পায়ে পায়ে পৌঁছে যাই হিন্দোলা মহলে – এখানে গিয়াসুদ্দিন সভা করতেন, লোকেদের দর্শন দিতেন। হিন্দোলা মহলের নীচ দিয়ে চলে গেছে অনেক গোপন সুড়ঙ্গ পথ, তাদের কোনওটা গেছে একেবারে মান্ডু শহরের বাইরে, কোনওটার মধ্য দিয়ে রূপমতীর পালকি চড়ে বাজবাহাদুরের প্রাসাদ অবধি যাওয়ার ব্যবস্থা! একটি সুইমিং পুলের নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত। দেখেশুনে মনে হল গিয়াসুদ্দিন প্রাণভয়ে ভীত ছিলেন বেশ। মাটির তলায় অত সুড়ঙ্গ, তাই হিন্দোলা মহলের কোনও ভিত নেই। মহল তৈরি হয়েছে সারি সারি খিলান দিয়ে, খিলান ও মহলের দেওয়াল মাটির কাছে খুব মোটা, কাত হয়ে উঠেছে - ধীরে ধীরে পাতলা হয়েছে ওপরে গিয়ে। বৃষ্টি পড়লে মনে হয় মহলটি যেন দুলছে – তাই হিন্দোলা মহল!
আরও একটু এগিয়ে দেখি বেগমদের হামাম – বাদশাহী স্নানঘর, গোলাপ জলের বাথটাব থেকে ঝাঁঝরি দিয়ে বেরোনো স্টীম দিয়ে সওনার এলাহি ব্যবস্থা। চারপাশে রানীমহল, জলমহল ও অন্যান্য অনেক ছোট প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। দেখি চম্পা বাউরি – প্রাসাদের জন্য পেয় জলের সুগভীর উৎস। ছবি তুলে রাখি শাহী পরিসরের বাস্তুকলার নিদর্শনের। জাহাজ মহলের সামনের বাগানে দু'জনে বসে ভাবি কাল ধীরে গ্রাস করে সব ঐশ্বর্য, বৈভব ও ঔদ্ধত্ত – সাক্ষী রয়ে যায় নীরব পাথরের প্রাসাদ।
মান্ডু-তে আমাদের অন্তিম দ্রষ্টব্য – রূপমতীর প্যাভিলিয়ন। ইতিহাস বলছে ১৫৪২ সালে মালওয়া জয় করেন শের শাহ সুরি; মালওয়ার শাসনভার শের শাহ অর্পণ করেন তাঁর সেনাপতি শুজাত খাঁয়ের হাতে। বারো বছর পর শুজাত খাঁ মারা গেলে তাঁর ছেলেদের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতা দখলের লড়াই। ভাইদের হারিয়ে মিঞা বায়াজিদ ১৫৫৫ সালে মালওয়ার সিংহাসন দখল করে নিজের নাম পালটে রাখলেন বাজ বাহাদুর। মান্ডুর আশে পাশে শিকার করতে করতে বাজ বাহাদুর পৌঁছন ধর্মপুরীতে। সেখানে রূপমতীর অপূর্ব কন্ঠে রাগ বসন্ত শুনে অভিভূত হয়ে পড়েন বাজ বাহাদুর, রূপমতীকে নিয়ে যেতে চান মান্ডুতে। অপরূপ সুন্দরী রাজপুত কন্যা রূপমতী মান্ডু যেতে রাজী হন একটি শর্তে – তিনি যেন মান্ডু থেকে রোজ নর্মদা দর্শন করতে পারেন। কথিত আছে যে প্রায় রাতারাতি বাজ বাহাদুর তৈরি করান মান্ডুর সবচেয়ে উঁচু জায়গায় রূপমতীর প্যাভিলিয়ন, যেখান থেকে নর্মদা চোখে পড়ে সহজেই। তার অনতিদূরেই বাজবাহাদুরের নিজের প্রাসাদ। প্রায় ৭-৮ কিমি দূরে 'শাহী পরিসর' থেকে পালকি চড়ে রূপমতী আসতেন রোজ নর্মদা দর্শনে। সঙ্গীত চর্চার মাধ্যমে বাজবাহাদুর ও রূপমতীর মধ্যে হ'ল গভীর প্রেম। দুজনেই সঙ্গীত সাধনায় একাত্ম হতেন। এত সুন্দর প্রণয়কাহিনির পরিণতি কিন্তু বিয়োগান্তক। ১৫৬১ সালে সম্রাট আকবর প্রেরিত সেনাপতি আদম খাঁ মান্ডু আক্রমণ করলে বাজবাহাদুর যুদ্ধে হার স্বীকার করে পালিয়ে যান। আর আদম খাঁয়ের কাছে অবমাননার ভয়ে রূপমতী বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।
অনেকটা চড়াই উঠে ও তারপর বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছই রূপমতীর প্যাভিলিয়নে, দূরে দেখা যায় নর্মদার স্রোত। বিন্ধ্যপর্বতের কোলে মান্ডু উত্তরাবর্তের শেষ সীমা - মান্ডুর দক্ষিণে নর্মদার দিকে দাক্ষিণাত্যের সমতল সুদূর বিস্তৃত ও বড়ই সুদৃশ্য। নীচে নেমে বাজবাহাদুরের প্রাসাদ ঘুরে দেখি। একটি বেশ বড় সুইমিং পুল প্রাসাদের কেন্দ্রে – সেখানে জল আসত কি করে? আমাদের গাইড জানায় নীচের রেওয়া কুন্ড থেকে 'ফেরিস হুইল' ঘুরিয়ে জল উঠত প্রাসাদের সুইমিং পুলে!
গাইড আমাদের থামতে বলে রাস্তার ধারে, দেখায় দূরে দাই-কি-মহল আর দাই-কি-বহেন-কি-মহল, রাজা-রাজড়াদের ধাত্রীদের বাড়ী। গাইড চেঁচিয়ে বলে, 'হ্যালো', পরিষ্কার শুনি প্রতিধ্বনি, হ্যালো! একটু সরে গিয়ে বলে, 'হ্যালো...' প্রতিধ্বনি ফিরে আসে দু'বার, হ্যালো-হ্যালো... এ নাকি মান্ডুর ইকো পয়েন্ট!
সেদিন শিবরাত্রি - গাইড আমাদের নিয়ে চলে নীলকণ্ঠ মন্দিরে। প্রায় পঞ্চাশ ধাপ সিঁড়ি নেমে পৌঁছই মন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দিরের এক প্রান্তে গভীর গিরিখাদ। মন্দিরটি আদতে ছিল মোগল সৈন্যদের বিশ্রামাগার, দেওয়ালে খুঁজে পাই আরবী লিপি – সম্রাট আকবর সেখানে শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পাহাড়ের ফাটল থেকে ক্রমাগত জল পড়ে যাচ্ছে শিবলিঙ্গের মাথায়। শিবরাত্রির পুজোয় অনেক স্থানীয় দর্শনার্থীদের ভিড় – মহিলারা এসেছেন দলে দলে, মন্দিরের চারপাশে বসে নিজেরাই মাটির শিব গড়ে, নাচগান করে পুজো উদযাপন; বেশ একটা সুন্দর উৎসবের পরিবেশ।
শেষ হল আমাদের মান্ডু ভ্রমণ – আনন্দনগরীকে বিদায় জানিয়ে আমরা নর্মদাতীরে শিবতীর্থ ওঙ্কারশ্বরের পথ ধরি।
পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সৌমিত্রের ছেলেবেলা কেটেছে কলকাতা ও খড়গপুর-এ; শিক্ষালাভ আই আই টি-খড়্গপুর ও আই আই এম-কলকাতায়। অধুনা নয়াদিল্লি নিবাসী, ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকে কর্মরত। কর্মসূত্রে পৃথিবীর বহু দেশে ভ্রমণ। লেখালিখি করছেন অনেকদিনই – বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধই বেশি, কিছু ভ্রমণকাহিনি – তবে এর আগে সবই ইংরেজিতে। বিশেষ শখ ফোটোগ্রাফি।