অ্যাজটেকদের দেশে
শ্রাবণী বন্দোপাধ্যায়
মার্কিনমুল্লুকে নিউজার্সিতে বসে এক এক সময় মনে হয় শীতকালটা যেন আর কিছুতেই কাটতে চাইছে না। জানলা দিয়ে তুষারপাত দেখতে দেখতে তাদেরকে শ্বেতশুভ্র বা পবিত্র যে নামেই ভূষিত করিনা কেন মনটা কিন্তু পাখা মেলে চলে যায় কোনও একটি গরমের দেশে বা সমুদ্র সৈকতে। এইভাবেই চিন্তা করতে করতে মনে পড়ে গেল বহুযুগ আগে দেখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী মেক্সিকো দেশটির কথা। মেক্সিকো যাওয়ার চিন্তা করছি শুনেই এক শুভাকাঙ্খী বন্ধু টেলিফোনেই তেড়ে উঠে বললেন — 'বলি তোমরা কর্তাগিন্নি কি সারাক্ষণ পায়ে চাকা লাগিয়েই আছ? ওখানে তো শুনি চতুর্দিকেই কিডন্যাপিং, খু্ন, ডাকাতি আর ড্রাগের কারবার।' আহা কথাগুলি যেন কর্ণকূহরে কেউ রহস্য রোমাঞ্চের মধু ঢেলে দিল। চোখের সামনে ভেসে উঠল মার্ক টোয়েন বর্ণিত নেটিভ ডাকাত ইনজুন্ জো-এর মুখচ্ছবি। যে কিনা এই বয়সেও রঘু ডাকাত পড়ে আনন্দ পায় তাকে দাবিয়ে রাখা অত সহজ নয়, তাই পুরনো স্মৃতির ধুলো ঝাড়তে কিছুদিন আগে আবার সেই মেক্সিকোর পথেই রওনা হলাম।
আজ যাকে আমরা 'মেক্সিকো সিটি' বলে জানি একসময় তার নাম ছিল 'টেনোশটিটলান'। বারো হাজার বছর আগে যখন এশিয়া ও আমেরিকা উত্তরে বেরিং প্রণালীর কাছে যুক্ত ছিল, সেই সময়ে এশিয়ার মঙ্গোলিয়া অঞ্চল থেকে দলে দলে লোক শিকারের পিছু পিছু ধাওয়া করে আজকের উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে কেউ যাযাবরই থেকে যায় আবার কোনও কোনও সম্প্রদায় ভুট্টা বা বীনের চাষ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করে। এইভাবেই তিনটি সভ্যতার জন্ম হয়- আজকের গুয়েতেমালা অঞ্চলে 'মায়া', পেরুতে 'ইনকা' ও মেক্সিকোতে 'অ্যাজটেক'। প্রচলিত উপকথা বলে, সূর্যদেবতা অ্যাজটেকদের স্বপ্ন দিয়ে বলেছিলেন — 'পথে চলতে চলতে যেখানে দেখবে একটি ঈগল পাখি মুখে সাপ ঝুলিয়ে কাঁটা ঝোঁপের ওপর বসে আছে ঠিক সেখানেই তোমরা রাজ্য স্থাপনা করবে। আজকের মেক্সিকোর ফ্ল্যাগের মধ্যিখানে সেই ছবিটিকেই আমরা দেখতে পাই। চতুর্দিকে জলাভূমির মধ্যে একটি দ্বীপের ওপর ঈগলটিকে দেখে তারা জায়গাটির নাম দেয় 'টেনোশটিটলান' অর্থাৎ ওদের ভাষায় কাঁটা ঝোঁপের বাসস্থান।
অ্যাজটেকদের শেষ রাজা 'মনটেজুমা' নাকি স্বপ্ন দেখেছিলেন সাদা বা ফর্সা রং-এর 'কেটজালকোটেল' নামে এক ভগবান এসে তাদের ভালো করবেন। ক্রিস্টোফার কলম্বাস চোদ্দশো বিরানব্বই-এ এই নতুন মহাদেশটি আবিষ্কার করার কিছু বছর পর যখন স্পেন থেকে 'হারনান্ কোর্টেজ' তিনটি জাহাজ ভর্ত্তি অস্ত্রসস্ত্র ও দলবল নিয়ে এই জায়গাগুলি দখল করতে আসে তখন রাজা 'মনটেজুমা' তাকে সেই ভগবান ঠাউরে সোনাদানা ও দামী দামী উপহার দিয়ে সসম্মানে আপ্যায়ণ করেন।
অ্যাজটেকরা কোনওরকম লোহার যন্ত্রপাতি ছাড়াই সতেরো কিলোমিটার জুড়ে বাঁধ দিয়ে, ব্রিজ বানিয়ে এবং চতুর্দিকে নৌকা নিয়ে যাতায়াতের জন্য বড় বড় খাল কেটে এই জলাভূমিটিকে এতটাই সুন্দর করে সাজিয়েছিল যে প্রথম দর্শনেই স্প্যানিয়ার্ডরা এই শহরটিকে দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে যায়। তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায় সেই সময়ে এই শহরে আড়াই লক্ষ লোক বাস করত। অ্যাজটেকরাই প্রথম মেয়েদের লেখাপড়ার দিকে জোর দেয় এবং তাদের জন্য স্কুল খোলে। বিভিন্ন ভেষজ লতাপাতাকে চিকিৎসার কাজে লাগানোর জন্য তাদের নানা গবেষণাগার ছিল। শুধু তাই নয় আজকে যে ইটালিয়ানদের একদিনও টমেটো ছাড়া চলে না সেটিও এই অ্যাজটেকদেরই অবদান।
কোর্টেজ-এর বড় বড় জাহাজগুলি দেখে এই সরল মানুষগুলি মনে করেছিল ভগবান তার সঙ্গে কিছু দ্বীপও ভাসিয়ে নিয়ে এসেছেন এবং ঘোড়াগুলি ভগবানদের বাহন অর্থাৎ একটু বড় মাপের হরিণ। অবশেষে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে যতই যুদ্ধ করুক না কেন কামানের সামনে তীর-ধনুকের বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব নয়, তাই কিছুদিনের মধ্যেই অ্যাজটেকরা বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। স্থানীয় মানুষগুলির ওপর অকথ্য শারীরিক অত্যাচার চালিয়ে ও খুনের ভয় দেখিয়ে স্প্যানিয়ার্ডরা জোর করে তাদের খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করে। এই ভাবেই পনেরশো একুশ সালে অ্যাজটেক সভ্যতা পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেয়।
বিকেল চারটের আগেই মেক্সিকো সিটিতে ঢুকে গেলাম আর সৌভাগ্যবশত যে হোটেলটি নেওয়া হয়েছিল তা 'সোকালো' নামে খ্যাত বিরাট ঐতিহাসিক স্কোয়ারটির পাশেই। মস্কোর রেড স্কোয়ার বা বেজিং-এর তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের মত মাথা-ঘোরানো না হলেও এটিও আয়তনে কিছু কম যায় না। দেখি দলে দলে বাচ্চা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আর কেউ-কেউবা শুধুই খেলে বেড়াচ্ছে। চার্চ, ন্যাশনাল প্যালেস, নামী-দামী রেষ্টুরেন্ট ও অ্যাজটেক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ঘেরা এই স্কোয়ারটিই মেক্সিকো সিটির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই দেশের বেশির ভাগ লোকজন নেটিভ হলেও অন্য দু'রকমের চেহারাও চোখে পড়ে। একটি ছোট গ্রুপ যারা এখনও খাঁটি ইউরোপীয়ান অর্থাৎ সাদা চামড়া আর একটি হল দুটির মিশ্রণে একটি দোআঁশলা গ্রুপ যাদের অনেককেই দেখতে আবার ভারতীয়দের মত। অতীতেও দেখেছি লোকজন আমাকে মেক্সিকান ভেবে স্প্যানিশে কথা শুরু করে দিত তাই এবারে 'ওলা' (হ্যালো), গ্রাসিয়াস্ (ধন্যবাদ)-এর সঙ্গে 'আমি আপনাদের ভাষা জানিনা'-টাও ঝাড়া মুখস্থ করে গিয়েছিলাম। এই সোকালোর খুব কাছেই 'বেলে আর্তে' মিউজিয়াম যেখানে ছবির প্রদর্শনী ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। প্রথমদিন সন্ধ্যাবেলাতেই আমরা সেখানে মেক্সিকান ফোকডান্স দেখতে গেলাম। ছেলেরা কেউ দেখি অ্যাজটেক স্টাইলে কোমরে ছাল জড়িয়ে মোষের শিং বাজিয়ে যাচ্ছে আর মেয়েরা কেউ-কেউ স্প্যানিশ স্টাইলে রংবেরং-এর ঘাঘরা পড়ে নেচে যাচ্ছে। এক কথায় দুটি সংস্কৃতির একটা খিচুড়ি ভার্সান।
পরের দিন তিরিশ মাইল দূরে 'টিয়োটি উয়াকান' অর্থাৎ ঈশ্বরদের জন্মস্থান নামে একটি জায়গাতে সান ও মুন পিরামিড দেখতে গেলাম। প্রায় দুহাজার বছর আগে নির্মিত এই পিরামিডগুলি ঠিক কোন ট্রাইবের লোকেরা বানিয়েছিল তা আজ কেউ জানে না। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখানে প্রচুর মৃতদেহ পেয়েছেন যার থেকে ধারণা করা হয় যে দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে এরা নরবলি দিত। সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে উঠতে থাকলে তেষট্টি মিটার পর্যন্ত ওঠা যায়। শোনা যায় অতীতে এটি এক জমজমাট বড় জায়গা ছিল যেখানে প্রায় দেড়লক্ষ লোক বাস করত। কেন বা কি কারণে তারা এই জায়গাটিকে ছেড়ে চলে যায় তা আজও রহস্য।
সেদিন সন্ধেবেলা মেক্সিকো সিটিতে ফিরে সোকালোর আশেপাশে লোকজনকে রাস্তাতেই যেভাবে নাচগান করতে আর খেতে দেখলাম তাতে মনে হল মেক্সিকানরা বেশ ফুর্ত্তিতেই আছে। সেখানেই একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় রেষ্টুরেন্টে 'এনচেলাডা'-র অর্ডার দিয়ে যে পদার্থটি পেলাম সেটি হল টমেটো সস্ ও চিজের ওপর ভাসমান কিছুটা ফালি করে কাটা অর্দ্ধ-কাঁচা মাংস। পান চিবানোর মত সেটিকে কিছুক্ষণ চিবানো গেলেও গলাদ্ধকরণ করা অসম্ভব। কি ভাগ্যি তার সাথে অ্যাজটেক স্যুপটির অর্ডার দিয়েছিলাম তাই সে যাত্রায় জোর বেঁচে গেলাম! নামটি ছাড়া আমেরিকার এনচালাডার সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই। এমনকি অ্যাজটেক নাম দিয়ে যে স্যুপটি সারা মেক্সিকো জুড়ে বিক্রি হয় তাদের প্রত্যেকেরই স্বাদ-গন্ধ সম্পূর্ণ আলাদা, কমন শুধু একটাই - ওপরে কিছু ভাসমান ভুট্টার রুটির ছেঁড়া টুকরো।
পরের দিন সোকালোতে ন্যাশনাল প্যালেস আর টেম্পলো মেয়র দেখতে গেলাম। এখানেই অ্যাজটেক রাজা মনটেজুমার বিশাল প্রাসাদ ছিল যাকে স্প্যানিয়ার্ডরা ধুলিস্যাৎ করে তারই ইট পাথর দিয়ে এই প্যালেসটিকে বানায়। কয়েকটি ঘর দর্শকদের জন্য খোলা থাকলেও বেশিরভাগটাই এখন সরকারি অফিস। এর পাশেই টেম্পলো মেয়র, যে অ্যাজটেক মন্দিরটিকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা কিছুটা মাটি খুঁড়ে বার করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথমেই চোখে পড়ল একটি পাথরের সাপ যা কিনা প্রায় পুরো মন্দিরটাকেই পেঁচিয়ে রেখেছে আর চাতালের মধ্যিখানে একটি অর্দ্ধশোয়া মনুষ্যমূর্তি। এরা সাপ, বৃষ্টি ও সূর্যের পুজো ছাড়াও ভুট্টা গাছের পূজা করত - আজও সেটিই তাদের প্রধান খাদ্য। স্প্যানিয়ার্ডদের কাছে সাপ ছিল অত্যন্ত অশুভ, তাই এই নেটিভ মানুষগুলির মাথা থেকে সাপ দেবতাকে তাড়াতে তাদের প্রচন্ড বেগ পেতে হয়। এখনও মেক্সিকোতে বহু ট্রাইব সাপ ও বৃষ্টি দেবতাদেরই পূজা করে। খেয়াল করে দেখবেন বিদেশি আর্যরা ভারতবর্ষে এসে তাদের দেবতাদের যতই জয়গান করুক না কেন এখনও ভারতবর্ষে ইন্দ্র-বরুণের বিরাট কদর নেই, লোকজন সেই ঘেঁটু-মনসার পুজোই চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হোটেলের ডোরম্যানটিকে জিজ্ঞাসা করতে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলল, সে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এসেছে। সেখানে তারা বাড়িতে নিজেদের ভাষাতেই কথা বলে এবং বৃষ্টির দেবতা ছাড়াও তাদের আরও অনেক দেবতার পুজো করতে হয় কারণ তারা প্রত্যেকেই ডিভোটেড খ্রিস্টান। অবাক হয়ে বললাম— তাহলে তোমরা জেসাসকে ডাকো কখন? সে অম্লান বদনে বলল— 'ওর পুজো তো শুধু ডিসেম্বরে হয় যখন মেক্সিকো সিটি খুব সুন্দর করে আলো দিয়ে সাজানো হয় আর আমাদের ট্রাইবরা মুখে রং মেখে উঁচু কাঠের খুঁটি থেকে কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলে ও নেচে খ্রিস্টমাস সেলিব্রেট করে।' জানিনা কেন কথাটা শুনে বাংলার চড়কের মেলার কথা মনে পড়ে গেল।
পরেরদিন সকালে মাথা-খোলা ডবল ডেকার বাসে চেপে মেক্সিকোসিটি ঘুরতে ঘুরতে একসময় 'চাপোটিপেক্' পার্কের স্টপে নেমে পড়লাম। সতেরোশো একর জুড়ে ফুল, লেক ও বিভিন্ন স্ট্যাচু দিয়ে সাজানো এই সুন্দর পার্কটি অ্যাজটেকদের কাছে খুব পবিত্র জায়গা ছিল। এখানেই একটি জায়গায় বিরাট বড় মহাত্মা গান্ধীর স্ট্যাচু আছে। দুটি মেয়ে পার্কে যথারীতি আমাকে মেক্সিকান মনে করে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে এল তাই অগত্যা পূর্ব-মুখস্থ লাইনটি গড় গড় করে আউড়ে গেলাম— 'নো আবলো এসপ্যানিয়ল'। তাতে ফল হল বিপরীত, স্প্যানিশ ভাষাতেই আমার মুখে আমি স্প্যানিশ জানি না শুনে তারা হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল আর আমিও সেই সুযোগে হাঁটা দিলাম। এই পার্কেই একটি পাহাড়ের ওপর স্প্যানিয়ার্ডরা 'চাপোটিপেক্' ক্যাসেলটিকে বানায় যেখান থেকে পুরো মেক্সিকো শহরটাই পরিস্কার দেখা যায়।
মেক্সিকো শহর থেকে প্লেনে মাত্র একঘন্টা দুরে প্রশান্ত মহাসাগরের ধারে আকাপুলকো যেখানে আমরা দিন তিনেকের জন্য গিয়েছিলাম। পাহাড় ও সমুদ্র মিলিয়ে এই সৈকতটি বড় সুন্দর তাতে আবার দূরে তাল ও নারকেল গাছের সারি। দেখলাম ভারতবর্ষের রেলস্টেশনে 'চায়ে গরম' 'চায়ে গরম'-এর মত হাঁক দিয়ে লোকজন 'তামালে' বিক্রি করছে। ছোট ছোট ভুট্টার রুটির মধ্যে বীন ও মাংসের পুর দিলে হয় নোনতা তামালে আর ভেতরে মিষ্টির পুর দিয়ে করলে মিষ্টি তামালে অর্থাৎ কখনও মাংসের রোল আর কখনও বা পাটিসাপটা। সমুদ্রের ধারে কেউ পুঁতির মালা বিক্রি করছে আর কেউ বা আমেরিকার সিকি ভাগ টাকায় ট্যুরিষ্টদের মাসাজ করে যাচ্ছে। তাদের গরিব বাচ্চারা ট্যুরিষ্টদের ফেলে দেওয়া কোল্ড ড্রিংকস-এর বোতলে বালি ও সমুদ্রের জল ভরে মহা ফুর্তিতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিব্যি খেলে বেড়াচ্ছে যা দেখে মনে হল লেটেস্ট ভিডিও গেম হাতে নিঃসঙ্গ বড়লোক বাচ্চাদের থেকে এরা ঢের বেশি আনন্দে আছে। গরিব হবার আর একটা পজিটিভ দিকও দেখে এলাম— এখানে মায়েরা পয়সার অভাবে কোল্ডড্রিংকস-এর বদলে বাচ্চাদের তুলনায় সস্তার ডাবের জল খাওয়াচ্ছে।
আকাপুলকো থেকে ফিরে মেক্সিকোসিটির সোকালোকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। সেই বিশাল স্কোয়ারটি চতুর্দিকে ফ্ল্যাড লাইটের আলোতে একেবারে ঝলমল করছে আর তার মধ্যিখানে বসানো একটি তিনতলা বাড়ির সমান প্লাস্টিকের মড়ার খুলি, তাকে ঘিরে আবার কয়েকশো বন্দুকধারী পুলিশ। মড়ার খুলির এহেন প্রোটেকশন দেখে অবাক হয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বললো 'জানো না আজ রাতে জেমস বন্ড আসছে এখানে শুটিং করতে'? আমার কপাল মন্দ, বহুরাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও 'ডবল ও সেভেনের' দর্শন না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম।
শেষ দিনটি রেখেছিলাম বিখ্যাত অ্যানথ্রোপলজি মিউজিয়মের জন্য। সবই স্প্যানিশ ভাষায় লেখা তাই একটি ইংলিশ গাইডের সাহায্য নিতে হল। বিভিন্ন দেবতার জেডপাথরের তৈরি মূর্তি চোখে পড়ল। জেডপাথর অ্যাজটেকরা কিনে আনত গুয়েতেমালা অঞ্চল থেকে। মূর্তিদের অনেকের গলাতেই ঝুলছে মানুষের দাঁত দিয়ে তৈরি হার। অনেক হাঁটু মোড়া নরকঙ্কালও দেখতে পেলাম, লম্বা হবার দরুন স্থানাভাবে তাদের সেইভাবে জীবিত অবস্থাতেই সমাধি দেওয়া হয়। দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য এদের নৃশংসভাবেই হত্যা করা হত। ভাবতে হাসি পেলেও অ্যাজটেকদের কিন্তু সত্যিই আঠারো মাসে বছর হত। প্রতিটি মাসের জন্য বরাদ্দ ছিল কুড়িটি দিন এবং একটি করে দেবতা। আপনি যে মাসে জন্মাবেন সেই মাসের বিশেষ দেবতাটি আপনাকে সবসময় বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে। অ্যাজটেকরা যদিও বিলক্ষণ জানত তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে এক বছর হয়, তাই তিনশো ষাট দিনের পর ওই বাড়তি পাঁচদিনকে কোন মাসের মধ্যেই ঢোকাতে না পেরে ওগুলিকে অশুভ বলে শুণ্যে ঝুলিয়ে রাখত। তাহলে কারুর জন্ম যদি ওই বাড়তি পাঁচদিনের মধ্যে হয় তার কি দশা হবে? কি আর হবে সেও অশুভ হয়ে ঝুলে থাকবে কারণ কোনও বিশেষ দেবতার আওতাতেই না পড়ায় কেউই তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। শুধু তাই নয়, এখনকার দিনের মত ছেলেমেয়েদের যে বাহারি নাম রাখবেন তখন কিন্তু সে বালাই ছিল না। প্রতি ঘন্টার জন্য একটি করে ছবি আঁকা থাকত অর্থাৎ বেলা একটায় জন্ম হলে ঘড়ির ছবির সঙ্গে মিলিয়ে যতজন সেইসময়ে জন্মাবে তাদের সবাইকেই একই নামেই ডাকা হবে। কী ভাগ্যিস সেই সময়ে জনসংখ্যা বেশি ছিলনা তাই বাঁচোয়া, এখনকার দিন হলে আর দেখতে হত না।
মিউজিয়াম থেকে ফেরার পথে দেখি পার্কে বেশ কিছু মেক্সিকান শরীরটাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে ভাসিয়ে চিনে 'তাইচি' চর্চা করে যাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখেও সেখানে একটি চিনে চোখে পড়ল না। এযুগে অবশ্য আর কিছুতেই আশ্চর্য হই না। সেদিন সকালেই দেখেছি প্রাতরাশের সময় এক জার্মান ট্যুরিষ্ট ডিমভাজার ওপর প্রচুর পরিমাণে সাংঘাতিক ঝাল মেক্সিকান লংকা ছড়িয়ে অম্লানবদনে মুখে পুরছেন। বেজিং-এ গিয়ে দেখেছিলাম মেরি, জুলি ও বব নামধারী চৈনিক ছেলেমেয়ের দল পূর্ণউদ্যমে হ্যামবার্গার চিবিয়ে যাচ্ছে আর লন্ডনে ইংলিশম্যানরা অনেকেই ফিস্ এন্ড চিপস্ ছেড়ে গরম গরম সামোসা ধরেছেন। আধুনিক জাপানি ছেলেমেয়েরা আবার কাঠি ধরতে পারেন না বলে কাঁটা দিয়ে নুডলস্ তুলছেন কিন্তু তাই বলে ভুলেও মনে করবেন না কাঠি-সংস্কৃতি পৃথিবী থেকে লুপ্ত হতে বসেছে কারণ বহু আমেরিকান সাহেব সেটিকে ঠিকই ধরে রেখেছেন। তেনারা সাধুবাবাদের মতন যোগব্যায়াম সেরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে নুডলস্ তো নুডলস্ মায় ক্ষুদ্র চিনেবাদাম পর্যন্ত খপ করে কাঠি দিয়ে ধরে টপ করে মুখে ফেলেছেন। ভেবে লাভ নেই, বিশ্বায়নের যুগে এখন গোটা বিশ্বজুড়েই গোলমাল।
মেক্সিকো ছাড়ার সময় হয়ে এল কিন্তু কিডন্যাপার বা ড্রাগলর্ডদের দর্শন পাওয়া তো দূরের থাক শেষমুহূর্তে এসে জেমস বন্ডও হাতের মুঠো থেকে ফস্কে গেল শুধু একটি বড়সড় মড়ার খুলি দেখাই সার হল তাও কিনা প্লাস্টিকের! নিদেন পক্ষে ভিড় ট্রেনে উঠে 'পকেটমার হইতে সাবধান' কথাটিও যে আপনাদের কাছে ফলাও করে জানাব সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হলাম কারণ পকেটের জিনিস ইনট্যাক্ট পকেটেই থেকে গেল। 'চক্ষুদান'-এর পরিবর্তে লোকজন বরং উঠে দাঁড়িয়ে আমাকেই বসার জায়গা করে দিল। চাঞ্চল্যকর কোনও ঘটনার সম্মুখীন না হলেও বলব আমার কিন্তু মেক্সিকোদর্শন বৃথা যায় নি। চতুর্দিকে সরল মানুষগুলির নাচ দেখে, ফুটপাথে তামালে খেয়ে, অ্যাজটেকদের মন্দির দর্শন করে বা আকাপুলকোতে প্রশান্ত মহাসাগরের জলে গা ভাসিয়ে আমাদের সময়টা কিন্তু খুব ভালোই কেটেছে। রাস্তাঘাটে সস্তার কাঠের লাট্টু ও ঘুড়ি হাতে গরিব বাচ্চাদের খুশিতে উপচে-পড়া মুখগুলো দেখে কিছুক্ষণের জন্যও যেন নিজের ছোটবেলার দিনগুলিকে ফিরে পেয়েছিলাম।
মেক্সিকো সিটিকে বিদায় জানানোর আগে শেষবারের মত সোকালোর দিকে তাকিয়ে মানসপটে যেন ভেসে উঠেছিল একটি বিষণ্ণ রাজার মুখ। অশ্রুভরা চোখে রাজা মনটেজুমা যেন তার প্রজাদের বলছে— "তোমরা ক্ষমা কোরো আমায়। আমি পারলাম না এই সভ্যতার মুখোস-আঁটা বর্বর বিদেশি মানুষগুলির হাত থেকে তোমাদের আদরের টিনোশটিটলানকে রক্ষা করতে। তাই আমার সাথে সাথেই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে গেল একদা ঐতিহ্যময় অ্যাজটেক সভ্যতা।"
শ্রাবণী ব্যানার্জির জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির বাসিন্দা। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সঙ্গীত ও ইতিহাস পাঠে জড়িয়ে আছে ভালবাসা। কৌতূহল এবং আনন্দের টানেই গত কুড়ি বছর ধরে সারা বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত করে বেড়াচ্ছেন।