নরওয়ের বন্দর শহরে
কণাদ চৌধুরী
~ নরওয়ের আরও ছবি ~
শৈশবে কোনও এক জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম একটি বই -"দেশে দেশে রাণা"। কে দিয়েছিলেন, কে লেখক সেসব এখন আর মনে নেই, শুধু মনে আছে বইয়ের নায়ক একটি কিশোর যার নাম রাণা, সে তার এক ভবঘুরে কাকার সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত দেশ। দেশগুলির বৈশিষ্ট আর দর্শনীয় যা কিছু আছে, রাণার চোখ দিয়ে দেখছে পাঠক। কোনও আর্টপ্লেটে ছাপা ঝকঝকে ছবি ছিল না বইটিতে, ছিল শুধু শিল্পীর হাতে আঁকা নানাদেশের দ্রষ্টব্যস্থানগুলির কয়েকটি রেখাচিত্র। অসম্ভব আকর্ষণীয় ছিল বইটি আমার কাছে, আমার পড়া প্রথম ভ্রমণকাহিনি। "নিশীথ সূর্যের দেশ" বা "The Land Of Midnight Sun" কথা কয়টির সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়, এটা ছিল বইটিতে নরওয়ে নিয়ে লেখা প্রচ্ছদটির শিরোনাম।
ডেনমার্ক, সুইডেন এবং নরওয়ে, এই তিনটি দেশকেই একত্রে স্ক্যান্ডেনেভিয়া (Scandinavia) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান পেনিনসুলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত নরওয়ের আয়তন প্রায় তিনলক্ষ পঁচাশি হাজার বর্গ কিলোমিটার, অর্থাৎ আমাদের দেশের প্রায় শতকরা এগারো ভাগ। আর জনসংখ্যা সাড়ে একান্ন লক্ষ, আমাদের দেশের শতকরা চার ভাগ। পাহাড়, জঙ্গল, ফিওর্ড, গ্লেসিয়র এবং নদীবহুল এই দেশের প্রায় শতকরা সত্তর ভাগ এলাকা জনবসতিহীন। আর্থ-সামাজিক বিকাশের নিরিখে নরওয়ে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত এবং ধনী দেশ। দেশের অর্থনীতি মূলত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও নরওয়ে নানা জলজ এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। রাজা দেশের সাংবিধানিক প্রধান হলেও, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই হলেন সরকারের আসল ব্যক্তি। অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য অনেকেরই বিবেচনায় নরওয়ে পৃথিবীর একটি অন্যতম সুন্দর দেশ। এই দেশটিতে কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কিছুদিন আগে, এই লেখাটি সেই ভ্রমণেরই একটি দিনের দিনলিপি।
নরওয়ের কথা বলতে গেলেই এদেশের যে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যটির কথা প্রথমেই মনে আসে, সেটা হল ফিওর্ড। লক্ষ লক্ষ বছর আগে, তুষারযুগের গ্লেসিয়ার সরতে থাকার সময় পাহাড়ের মাঝে যে গভীর খাঁজের সৃষ্টি করেছিল, সেখানে সমুদ্রের জল ঢুকে তৈরি হয়েছিল এই সব ফিওর্ড। নরওয়ের প্রায় সর্বত্রই ফিওর্ড উপস্থিত থাকলেও, দেশের পশ্চিমদিকটিতে রয়েছে বেশ কিছু বিখ্যাত ফিওর্ড, যার দুই পাশে উঠে গিয়েছে উঁচু পাহাড়, আর মাঝখানে দীর্ঘ সুগভীর জলরাশি। গভীরতার কারণে বড় বড় জাহাজ অনায়াসেই চলাচল করতে পারে এই ফিওর্ডগুলি দিয়ে। এইরকমই একটি বিখ্যাত,নরওয়ের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ফিওর্ড হল হারডাঞ্জেরফিওর্ড (Hardangerfjord)। নরওয়ে ভ্রমণের প্রথম দিনে আমরা রয়েছি সেই ফিয়র্ডের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটি গ্রামে, যার নাম নরহাইমসুন্ড (Norheimsund)। গ্রাম বলতে যে অনগ্রসরতার ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে, এটা তার থেকে অনেকটাই অন্যরকম। ঝকঝকে সুদৃশ্য বাড়িঘর, দোকান, প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা নিয়ে যথেষ্টই সমৃদ্ধ জায়গা নরহাইমসুন্ড। আমাদের হোটেলটি হারডাঞ্জেরফিওর্ড-এর একটি ছোট্ট খাঁজের একেবারে মাথায় অবস্থিত। ফিয়র্ডের বিশাল ব্যাপ্তি এখানে অনেকটাই কমে এসেছে। ফিয়র্ডের কিনারায় হোটেলের লনে বসে দেখতে পাচ্ছি দূরে বরফাবৃত পাহাড়ের চূড়া, ঠিক অপর পারে কাছেই যে ছোট পাহাড়টি রয়েছে সেটি সবুজে ঢাকা, সব মিলিয়ে পরিবেশ অতি সুন্দর। এই সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে পাহাড়ের কোলে সাজানো ছোট ছোট কটেজ ধাঁচের বাড়িগুলো, মনে হচ্ছে একেবারে ক্যালেণ্ডারের পাতা থেকে তুলে আনা দৃশ্য। ঘড়িতে রাত নটা বেজে গেলেও আকাশে পরিষ্কার দিনের আলো। স্বাভাবিক আলোতে ছবি তুলতে কোন অসুবিধাই হচ্ছেনা। মাথার ওপর দিয়ে ক্রমাগত উড়ে চলেছে সিগালের ঝাঁক, হলুদ বেঁকানো ঠোঁট আর তেল চকচকে সাদা গায়ের রঙ, থেকে থেকেই তাদের কর্কশ গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। ফিয়র্ডের ধার দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম আমরা। হোটেলের পাশেই দেখলাম একটা পুরোনো কাঠের লগ-হাউস সংরক্ষিত করে রাখা আছে। পাশের ইনফর্মেশন-বোর্ড দেখে জানা গেল বাড়িটি অনেক আগে স্থানীয় কৃষকেরা ব্যবহার করত। কিছুটা দুরে একটি সুন্দর পার্ক, পার্কের পাশে ফিয়র্ডে স্নান করার একটা বাঁধানো ঘাট তৈরি করা আছে, সঙ্গে একটা ছোট ডাইভিং প্লাটফর্মও আছে দেখলাম। একটু ঘোরাঘুরি শেষ করে ফিরে এলাম হোটেলে, কাল সকালে উঠে আমাদের যেতে হবে বার্গন (Bergen)।
রাজধানী অসলো-র পরে বার্গন হল নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। রোমের মত বার্গনও সাতটি পাহাড় দিয়ে ঘেরা শহর। আনুমানিক ১০৭০ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত ওই শহর নরওয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। অতীতে নরওয়ের সঙ্গে ইউরোপের বাকি অংশের বাণিজ্যিক যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল এই বার্গন। এখনও শহরটি নরওয়ের রপ্তানী বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র এবং দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান। নরওয়ের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – "The Bergen International Festival" এই শহরেই অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর। নরওয়ের দুটি প্রধান ফিওর্ড, হারদাঙ্গরফিওর্ড এবং সনফিওর্ড (Sognfjord) কাছাকাছি হওয়ার জন্য ইউরোপীয় পর্যটকদের কাছে বার্গন ফিওর্ড সফরের এক জনপ্রিয় প্রবেশদ্বার। গ্রীষ্মের ভরা পর্যটক মরশুমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বড় বড় প্রমোদতরণী পর্যটকদের নিয়ে বার্গন-এর বন্দরে নোঙর ফেলে। বার্গন-এর অবশ্য বদনাম রয়েছে তার খামখেয়ালি আবহাওয়ার জন্য। যখনতখন বৃষ্টি নামে এখানে। আমাদের গাইড বলছিলেন যে এখানে নাকি বাগদানের সময় ছেলেরা মেয়েদের অঙ্গুরীয়ের বদলে ছাতা উপহার দিয়ে থাকে সচরাচর। তিনি ক্রমাগত সাবধান করে চলেছেন সঙ্গে ছাতা নিয়ে বেরোনোর জন্য, আর সেই কথামত আমরা সকলেই এক-একজন ছত্রধর হয়ে বেরিয়ে পড়েছি। নরহাইমসুন্ড থেকে বাসে বার্গন আশি কিমি রাস্তা, পৌঁছতে সময় লাগলো এক ঘন্টার কিছু বেশি। বৃষ্টির বদলে ঝকঝকে নীল আকাশ আর একরাশ রোদ্দুর নিয়ে বার্গন আমাদের স্বাগত জানাল।
নরওয়েতে ফিওর্ডগুলি স্থলভূমির ভিতরে ঢুকে এসেছে অনেকটাই, তার গায়ে গায়েই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনবসতি। ফিয়র্ডের নীল জলের ধারে পাহাড়ের কোলে বার্গন শহর, একদিকে বার্গন ফিওর্ড, অন্যদিক থেকে অনেকটা যেন মুক্তমঞ্চের দর্শকাসনের মত উঠে গিয়েছে পাহাড়, এই দুইয়ের মাঝে গড়ে উঠেছে বসতি। বার্গন শহরে ঢোকার সময় দেখতে পাচ্ছিলাম কাঠের তৈরি সুন্দর সাদা রঙ করা বাড়ি, আর বাড়িগুলির পাশের সরু-সরু পাথরের রাস্তাগুলি। অনেক বাড়িতেই দেওয়ালের গায়ে লাগানো রয়েছে সুদৃশ্য নৌকার আকারে গাছের টব, রঙিন ফুলে ভরা। বাস আমাদের নিয়ে এল শহরের কেন্দ্রে মাউন্ট ফয়েন (Mount Floyen)-এর নীচে। বার্গন-এর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ফয়বানেন(Floibanen) আজ আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য। প্রথমে যদিও মনে হয়েছিল এটি একটি ট্রেন, কিন্তু পরে দেখা গেল এটি আদপে ফিউনিকুলার(funicular), অর্থাৎ পাহাড়ের গায়ে পাতা রয়েছে লাইন, তার ওপর দিয়ে কেবল-এর সাহায্যে দুটি কেবল কার ওঠানামা করছে। এই ফয়বানেন আমাদের নিয়ে যাবে মাউন্ট ফয়েন-এর শীর্ষে, মাটি থেকে প্রায় এক হাজার ফিট ওপরে, যেখান থেকে নীচের বার্গন শহরের বিহঙ্গমদৃশ্য আমরা দেখতে পাব। কেবল কারের স্টেশনের সামনে দর্শনার্থীদের একটি নাতিদীর্ঘ লাইন, আমাদের টিকিটের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল, সুতরাং স্টেশনে ঢুকে পড়লাম। কার-এর উপরিভাগ কাঁচের, সুতরাং পারিপার্শ্বিকের সবটাই দৃশ্যমান, প্রায় আশি জন চড়তে পারে একসঙ্গে। মিনিট সাতেক চলার পরেই উঠে এলাম পাহাড়ের একেবারে ওপরে। ওপরের এই স্টেশনটির নাম ফয়েন (Floien)। পাহাড়ের গায়ে ব্যালকনি, সেখানে দাঁড়ালে নীচের শহরকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রচুর পর্যটকের ভিড়, অনেকক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করলাম সে দৃশ্য। পাহাড়ের ওপরটি অনেকটা সমতল, মনে হবে প্রকৃতি একটি গোলাকার গ্যালারি বানিয়ে রেখেছে নীচের শহরকে দেখার জন্য। জল এবং পাহাড় দিয়ে ঘেরা সুন্দর শহরটি, বেশ কয়েকটি বড় বড় জাহাজ বন্দরে নোঙর ফেলেছে দেখতে পেলাম। ওপরে রয়েছে একটি কাফেটেরিয়া এবং একটি স্যুভেনিরের দোকান। কেবল কার ছাড়াও হেঁটে পাহাড়ের ওপরে উঠে আসা যায়, সে ব্যবস্থাও আছে। স্যুভেনিরের দোকান থেকে টুকটাক দু-একটি জিনিস কিনে নিলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক ওপরে কাটানোর পরে এবার নেমে আসার পালা। নীচে নেমে দেখলাম অপেক্ষমান দর্শনার্থীদের লাইন এখন অনেকটাই লম্বা হয়ে গিয়েছে। প্রচুর লোক অপেক্ষা করছেন স্টেশনের বাইরেও।
এবার শহর ঘুরে দেখার পালা। পার্কিং-এর অসুবিধার জন্য বাসে করে ঘোরা সম্ভব নয়, তাই বাস আমাদের নামিয়ে দেবে শহরের কেন্দ্রস্থলে, সেখান থেকে হেঁটে যতটা পারি ঘুরে দেখে নেওয়ার জন্য বরাদ্দ সময় তিন ঘণ্টা, তারপর আমাদের ফিরতি পথের যাত্রা শুরু হবে।
বাস আমাদের নামিয়ে দিল Fisketorget অর্থাৎ মাছের বাজারের ঠিক পাশে। বাঙালিকে মাছের বাজার দেখতে বলায় একটু মনক্ষুণ্ণ হলেও জানলাম, এই বাজারটি বার্গন-এর অবশ্যদ্রষ্টব্য জায়গা। সমুদ্রজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নরওয়ে, আর স্যামন (Salmon) মাছের সর্বপ্রধান রপ্তানিকারক এই দেশ। সুতরাং মাছের বাজার এদেশে যে একটা বিশিষ্ট দ্রষ্টব্যস্থান হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি! নরওয়েবাসীদের খাদ্যতালিকায় মাছের একটা বিশেষ জায়গা আছে, যদিও মাছের তৈরি পদগুলি, অন্তত হোটেলে যেভাবে পরিবেশিত হতে দেখেছি, সেটা আমাদের তৃপ্ত করতে পারেনি। আমাদের রসনা মাছের ওইধরনের রান্নার স্বাদে অভ্যস্ত নয়। বন্দরের এক প্রান্তে ছোট ছোট লাল তাঁবুর নীচে বাজার -ক্রেতা এবং দর্শনার্থীর ভিড়ে বোঝাই। নানা রকমের মাছ বিক্রি হচ্ছে, যেগুলোর কোনটাই আমাদের পরিচিত নয়, শুধু কিছু চিংড়ি জাতীয় মাছ, আর কমলা রঙ দেখে কাটা সামন মাছ চিনতে পারলাম। কাঁচের বাক্সের মধ্যে রাখা আছে বিচিত্র দেখতে কিছু জলজ্যান্ত সামুদ্রিক প্রাণী, সেগুলোও বিক্রির জন্য। বিক্রেতাদের হাঁক-ডাক আমাদের মাছের বাজারের মনে করালেও, বাজারের পরিচ্ছন্নতা তাকিয়ে দেখার মতো। যারা মাছ কাটছেন বা বিক্রি করছেন, সকলের গলায় ঝুলছে অ্যাপ্রন আর হাতে প্লাস্টিকের দস্তানা, বাজারে একটুও জল-কাদা নেই। মাছ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রান্না করা খাবারও পাওয়া যাচ্ছে দেখলাম অনেক স্টলে। মাছ ছাড়াও বিক্রি হচ্ছে নানা রকমের ফল, স্ট্রবেরি, কলা, আঙ্গুর ইত্যাদি। বারো নরওয়েজিয়ান ক্রোনার (Norwegian Kroner) অর্থাৎ প্রায় একশো টাকা দিয়ে চারটে কলা কেনা হল।
মাছের বাজার দেখা শেষ করে এবার আমরা চললাম এর পাশেই বার্গন-এর অন্যতম সেরা আকর্ষণ ব্রিগেন (Bryggen) দেখতে। যে জায়গাটিতে আমরা রয়েছি, সেটি আসলে একটি হোয়ার্ফ (Wharf), অর্থাৎ যেখান থেকে জাহাজে যাত্রী এবং পণ্য ওঠানামা করে। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতক অবধি এই জায়গাটি ছিল বার্গন-এর প্রধান সামুদ্রিক আমদানি-রপ্তানির বাণিজ্য-কেন্দ্র। জার্মান ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠন মূলত এই ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করত, যার নাম ছিল হানসেয়াটিক লিগ। সেই সময়কার কাঠের তৈরি গুদামঘরগুলিই ব্রিগেন - এখন একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। আসল বাড়িগুলি বেশ কয়েকবার আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে, সেই নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্য বজায় রেখে পুনর্নির্মিত হয়েছে বর্তমান একষট্টিটি বাড়ি। একইরকম দেখতে কিন্তু বিভিন্ন রঙের সারিবদ্ধ প্রতিটি বাড়িই কাঠের তৈরি, পিছনে উঠে গিয়েছে পাহাড়, সামনে বিশাল চত্ত্বর, তারপরে রাস্তা পেরিয়ে লম্বা জাহাজঘাটা। রাস্তার ধারে উন্মুক্ত চত্ত্বরে খাদ্য এবং পানীয়ের কয়েকটি দোকান, মেঘমুক্ত দিনে রোদ পোহানো আর সঙ্গে সুখাদ্য এবং পানীয়, সবই সমান তালে উপভোগ করছেন অনেক পর্যটক। অধিকাংশ বাড়ির নীচেই এখন স্যুভেনিরের দোকান। বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে ঘুরে ফিরে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়, তারপর জাহাজঘাটে এসে বসলাম। বন্দরে লাগানো রয়েছে অসংখ্য নৌকো, নীল আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের প্রেক্ষাপটে নৌকোর নানা রঙের মাস্তুলগুলো একেবারে ছবির মত লাগছে। বার্গন-এর বিখ্যাত বৃষ্টির দেখা নেই, ঝলমলে সূর্যস্নাত দিন, রোদের তাপ এবার বেশ গায়ে লাগছে। বৃষ্টির আশঙ্কায় যে ছাতা আনা হয়েছিল, সেগুলো রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা শুরু করলেন আমাদের কয়েকজন সহযাত্রিণী। কিন্তু তাতে এক কৌতুকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, স্থানীয় অনেকেই আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন, কয়েকজন ছবিও তুলে ফেললেন। শেষে এক মেমসাহেব একগাল হেসে ছাতা দেখিয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, "Why this, it's not raining ?" সত্যিই তো, যে দেশে ছয়মাস সূর্যের আলো দেখা যায়না, সেখানে রোদ্দুর যে কী মহার্ঘ বস্তু, সেটা আমাদের মত কর্কটক্রান্তীয় দেশের লোকেরা বুঝে উঠতে পারবেনা। রোদ উঠলে এদেশে লোকে ঘরে বসে থাকেনা, রোদ্দুরকে যতটা সম্ভব উপভোগ করার জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়ে, গায়ে লাগিয়ে নেয় সূর্যের দুর্লভ কিরণ। আর সেই দেশে আমরা ছাতা মাথায় দিয়ে রোদ ঠেকানোর চেষ্টা করছি, সেটা ওদের কাছে এক অতীব বিচিত্র দৃশ্য।
বার্গন থেকে ফেরার পথে বাস থামলো নরহাইমসুন্ড-এর উপকন্ঠে একটি ছোট গ্রামে। গ্রামের নাম স্টাইন (Steine)। এই গ্রামে রয়েছে নরওয়ের আর একটি অন্যতম দর্শনীয় আকর্ষণ, স্টাইনডালফসেন (Steindalfossen) জলপ্রপাত। লেক মাইক্লাভাটনে (Myklavatnet) থেকে বেরিয়ে আসা ফসেলভা (Fosselva) নদী প্রায় দেড়শ ফিট ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে নীচে, জুন মাসের বরফগলা জলে প্রপাতের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকখানি, বিপুল জলরাশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে বহুদূর থেকে। জার্মানির সম্রাট দ্বিতীয় কাইজার উইলহেলম এই জলপ্রপাতটিকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রতিটি গ্রীষ্মেই তিনি এসেছিলেন এই জলপ্রপাতটি দেখতে, এতটাই প্রিয় ছিল তার কাছে এই জায়গাটি। এই জলপ্রপাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর জলের ধারা পাহাড়ের ওপর যেখান থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ছে, ঠিক তার নীচেই পাহাড়ে একটি গভীর খাঁজ রয়েছে। রাস্তা উঠে গিয়েছে সেই খাঁজের ভিতরে, জলধারাটির ঠিক পিছন দিয়ে জলপ্রপাতের একধার থেকে অন্য ধারে। ওপর থেকে লাফিয়ে পড়া জলের ধারার পিছনটিতে দাঁড়িয়ে জলপ্রপাতকে উপভোগ করাটা এক রোমাঞ্চকর এবং দুর্লভ অভিজ্ঞতা। বাস যেখানে দাঁড়াল, সেখান থেকে রাস্তা ধরে আমরা উঠে গেলাম জলের ধারার পিছনে, সুন্দর রেলিং দেওয়া বাঁধানো রাস্তা, জলের পিছনে দাঁড়ালে গায়ে একটুও জলের ছাঁট লাগছেনা। ওপর থেকে নীচের দৃশ্যটিও অতি মনোরম, পাহাড়ের কোলে ছোট্ট সবুজ উপত্যকা, সেই সবুজ প্রান্তরের ধার দিয়ে চলে গিয়েছে নদী, নদীর ধারে ছোট গ্রামের কয়েকটি ছোট ছোট বাড়ি, দূরে দেখা যাচ্ছে নরহাইমসুন্ড আর তার পিছনের বরফাবৃত পাহাড়চূড়া। কিছুটা সময় কাটিয়ে নেমে এলাম নীচে, এবার ফিরব হোটেলে। আমাদের আজকের ঘোরাঘুরি এখানেই শেষ।
এর পরে আমাদের সফরসূচীতে রয়েছে নেরোফিওর্ড (Naerofjord)-এ জাহাজ সফর, সুযোগ পেলে সেই গল্প বলা যাবে আর এক দিন।
~ নরওয়ের আরও ছবি ~
এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা এবং পরবর্তী সময়ে কর্মজীবন কেটেছে ভারতের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থায়। অবসরজীবনে কণাদ চৌধুরীর সময় কাটে বেহালা বাজিয়ে, নানান ধরনের গান-বাজনা শুনে, বই পড়ে, ফেসবুকে এবং সুযোগ পেলে একটু-আধটু বেড়িয়ে। লেখালেখির জগতে এটাই প্রথম পদক্ষেপ।