ভলেনডাম – টুকরো গানের কলি
মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
~ তথ্য- ভলেনডাম ~ || ~ ভলেনডামের ছবি ~
পাখিগুলো চারপাশ দিয়ে আমাদের ঘিরে ধরেছে। দেখতে অনেকটা মাছরাঙার মতো। তবে অত রঙিন নয় বরং বেশ ধূসর চেহারা। তীক্ষ্ণ ঠোঁটে হাত থেকে ঠোক্কর মেরে মাছভাজা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার হাত-পা নেড়ে তাড়াতে গেলেই টুক করে উড়ে যাচ্ছে।
পাখিদের ভিড় থেকে মাথা তুললে চোখে পড়ছে মেঘলা আকাশ আর আইজে নদীর জলে তার প্রতিচ্ছবি। সকালেই এসে পৌঁছেছি ছবির মতো ছোট্ট সাজানো গোছানো গ্রাম ভলেনডামে। আমস্টারডামের হট্টগোল পেরিয়ে শান্তস্নিগ্ধ ভলেনডামে পৌঁছে ভারি ভালো লাগলো। গ্রাম বলতে আমাদের চোখে যে ছবিটা ভেসে ওঠে তার সঙ্গে ভলেনডামের কোনও মিলই নেই। চওড়া রাস্তার দু’পাশে লাল রঙের ছাদওয়ালা বাড়িগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সব বাড়িই প্রায় একইরকম, আলাদা করে চেনা যায় না। গাড়িঘোড়া প্রায় নেই বললেই চলে। তীব্র নিস্তব্ধতা ভাঙছে পাখির গানে অথবা রাস্তা দিয়ে গ্রামবাসীদের সাইকেলে করে যাওয়ার সময় ঘন্টির টিং-টিং আওয়াজে।
গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে আইজে নদী। আইজে নদীর মুখে অবস্থিত এই গ্রামের একমাত্র বন্দর এদাম। তীরের কাছে জেলেদের নৌকাগুলো বাঁধা রয়েছে। জেলে নৌকাগুলো দেখতে অনেকটা ডিঙির মতো। তবে ডিঙির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী, মজবুত ও আকারে বেশ বড়। বেশিরভাগ মানুষই জেলে। বাকিরা চাষ-আবাদ করেন।
সকাল থেকেই বেশ মেঘলা। মাঝে মাঝেই ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা বাড়ছে। আবার ওরই ফাঁকে ফাঁকে কখন একঝলক রোদ্দুর -মেঘের গায়ে ঝলসে উঠছে রামধনুর সাত রং। ভলেনডাম গ্রামে মাছের স্টলগুলো সংখ্যায় অনেক -বন্দরের ধারে নদীর গা ঘেঁষে বানানো। কিছুটা কলকাতার বেনফিশের স্টলগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। স্টলের ভেতরে রয়েছে ইন্ডাকশান কুকার আর মাছভাজার যাবতীয় সরঞ্জাম। প্রতিটি স্টলেই বসে আছেন ওলন্দাজ গ্রামবাসীরা বিভিন্নরকমের মাছভাজার তালিকা হাতে নিয়ে। তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকরকমের মাছভাজার নাম, পাশে মূল্যগুলো লেখা। ফিশ ফ্রাই, ফিশ বল, শুধু ছাঁকা তেলে মাছভাজা আরও কত কী! খেতে হবে মাস্টার্ড সস অর্থাৎ কাসুন্দি মাখিয়ে। স্টলগুলোয় বসার জায়গা নেই। হাতে কাগজের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া। মেঘলা দুপুরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির ব্যাকগ্রাউন্ডে ঠান্ডা হাওয়ার কামড় আর গরমাগরম হেরিং মাছভাজা খেতে খেতে আমরা উপভোগ করতে থাকলাম ভলেনডাম গ্রামটির নিসর্গচিত্র। তবে পাখিদের ব্যারিকেড আর হাত থেকে ঠোক্কর মেরে কেড়ে খাওয়ার চেষ্টার চোটে অন্য কোনওদিকে ঠিকমতো মনও দেওয়া যাচ্ছে না।
নেদারল্যান্ডস-এর নর্থ হল্যান্ডে অবস্থিত এই গ্রামটির ইতিহাস কিন্তু বেশ প্রাচীন। বৃষ্টিভেজা দুপুর -বিকেলে গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে থাকি আমাদের ট্যুর গাইডের মুখে। ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবিরা মিলে এখানে জনবসতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে মূল বসতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছোট একটি ক্যানেল আলাদাভাবে কেটে, তারপর জলাজমি ভরাট করে নতুন করে গ্রামটি গড়ে তোলা হয়। গ্রামের নামটির উৎপত্তিও সেইসময়। “ভলেনডাম” শব্দের আক্ষরিক অর্থ ভরাট করা ড্যাম। গ্রামটি এতই মনোরম যে পাবলো পিকাসো ও রেনোয়ার মত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বেরা এখানে বারবার এসেছেন ক্ষণিকের নিরিবিলি কাটানোর নেশায়।
পরেরদিন সকালবেলায় আমরা পৌঁছোলাম ভলেনডামের বিখ্যাত ‘ক্লগস’ ফ্যাক্টরিতে। ‘ক্লগস’ হচ্ছে একরকমের কাঠের জুতো যা পায়ে দিয়ে এই গ্রামের চাষি ও জেলেরা কাজ করেন। এখন অবশ্য রোজকার জীবনে ক্লগসের ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। বরং পর্যটকরা এখান থেকে স্যুভেনির হিসেবে ক্লগস সংগ্রহ করেন।
কাঠ চেরাই ও খোদাই করার কাজ মূলত হাতেই করা হয়। বিভিন্ন আকারের ও মাপের জুতোগুলো কাটা হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা মেশিনে, কিছুটা হাতে ক্লগসগুলো বানিয়ে ফেলা হয়। ক্লগসগুলো দেখে বেশ অবাক আর মজাও লাগছিল। বড়সড় একজোড়া ক্লগস পায়ে গলিয়ে ছবি তুলে ফেললাম। তারপর স্যুভেনির হিসেবে কিনেও ফেললাম কয়েকজোড়া ছোট ছোট রঙিন ক্লগস।
ক্লগস ছাড়াও ভলেনডাম গ্রামের কৃষকেরা খেত খামারে কাজ করার সময় পরে থাকেন বিচিত্র এক কালো রঙের পোশাক, যা তাঁদের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কালো জোব্বার মতো জামা, মাথায় বিচিত্র কালো টুপি বা বনেট আর পায়ে ক্লগস জুতো -এই হল নেদারল্যান্ডসবাসীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। বহু যুগ ধরে নারীপুরুষ নির্বিশেষে এই পোশাক পরে মাঠেঘাটে কাজ করার রীতি চলে আসছে। নবীন প্রজন্মে অবশ্য এই চল এখন আর নেই বললেই চলে। ভলেনডাম গ্রামে হয়তো জনা পঞ্চাশ প্রবীন মানুষকে আজও এই পোশাকে কর্মরত দেখা যাবে। অদূর ভবিষ্যতে এই পোশাক পরার রেওয়াজটাই হয়তো একেবারেই হারিয়ে যাবে।
ভলেনডামের আরেক দ্রষ্টব্য ওয়াইন ও চিজ তৈরির কারখানা। ট্যুরের তৃতীয় দিনে আমরা এই ফ্যাক্টরিটি দেখতে গিয়েছিলাম। এখানে দেখলাম কীভাবে নানারকম চিজ ও ওয়াইন তৈরি হচ্ছে। তবে শুধু দেখেই সন্তুষ্ট হওয়া নয়। চেখেও দেখলাম নানাধরনের অপূর্ব স্বাদের সব ফ্রুট ওয়াইন। খুবই মিষ্টি খেতে। বিশ-পঁচিশটি ছোট ছোটগ্লাসে সাজানো রয়েছে এই অমৃত -পর্যটকদের আস্বাদ গ্রহণের জন্য। আবার এব্যাপারে কোনও লাগামও নেই, পান করা যাবে যত ইচ্ছাই। একবার সাজিয়ে রাখা একটি ছোট গ্লাস পান করলে ইচ্ছে করবে সবকটি গ্লাসেরই রসসুধা পান করতে। আবার ফ্যাক্টরি থেকে বেশ কম দামে কিনেও নেওয়া যায় নানারকমের ওয়াইনের বোতল।
ভলেনডামে ন -দশ রকমের চিজ তৈরি হয়। এদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত ‘গাউডা চিজ’, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। কীভাবে চিজ তৈরি হচ্ছে তা দেখতে গিয়ে টুকটাক রসনাতৃপ্তি করেছি সদ্যোজাত চিজের টুকরো মুখে দিয়ে।
আমরা যে বছর ভলেনডাম বেড়াতে গিয়েছিলাম সেবার সেখানে “রেমব্রান্ট ৪০০” পালিত হচ্ছিল। বিখ্যাত শিল্পী রেমব্রান্টের চারশত জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছিল সারা দেশ জুড়েই। সমগ্র নেদারল্যান্ডস-এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবকটি শহরেই প্রদর্শিত হচ্ছিল রেমব্রান্টের আঁকা বিভিন্ন ছবিগুলি। প্রদর্শনী চলেছিল সারাবছর ধরেই। আমরা সৌভাগ্যক্রমে সেইসময়ে শিল্পীর আঁকা বেশ কিছু ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।
সারভান্তেসের লেখা বিখ্যাত চরিত্র ডন কুইকজোটকে কে না চেনে! ডন কুইকজোট -যে নাকি ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে বিখ্যাত আর তেড়ে যেত উইন্ডমিলগুলোর দিকে -তার কাল্পনিক শত্রুদের সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্য। ভলেনডাম গ্রামে সেই উইন্ডমিল সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। সারি সারি উইন্ডমিল একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে আর হাওয়ার তালে তালে ঘুরছে মাথার ওপরে পাখাগুলো। আমরা প্রথম উইন্ডমিলটা দেখে ঠিক ডন কুইকজোটের মতোই দৌড়ে গেছি উত্তেজনার বশে -তবে শত্রু ভেবে ঢাল -তরোয়াল নিয়ে নয় -ডিজিটাল ক্যামেরা হাতে -ছবি তোলার আনন্দে।
ভলেনডামে সামুদ্রিক মাছভাজা আর সামুদ্রিক নানান খাবার খেয়ে কোথা দিয়ে যে তিনটে দিন কেটে গেল টেরই পেলাম না। নেদারল্যান্ডস-এর আরেক শহরে পাড়ি দেওয়ার আগের দিন রাতে হোটেলের ঘরে বসে গাউডা চিজ খেতে খেতে আর ডাচ ফ্রুট ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে মনের মধ্যে ফিরে ফিরে আসছিল এই তিনদিনের মনোমুগ্ধকর স্মৃতিগুলো। আজকে, দীর্ঘ চার বছর পরেও বারবারই মনে পড়ে যায় ভলেনডাম গ্রামের কথা। মানসচক্ষে ভেসে ওঠে সরলতা আর মায়ামাখানো গ্রামটির ছবি -যেখানে হয়তো আজও ক্লগস পায়ে দিয়ে কৃষক নারী তাঁর শিশুকে পিঠে বেঁধে মাঠে কাজ করে চলেছেন আর গুনগুন করে গাইছেন ডাচ ভাষায় কোনও এক গ্রাম্য গানের কলি।
~ তথ্য- ভলেনডাম ~ || ~ ভলেনডামের ছবি ~
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী মহুয়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছোট গল্প ও ভ্রমণকাহিনী লেখেন।