ভ্রমণ তো বানিয়ে তোলা গল্পকথা নয়, মানুষের সত্যিকারের জীবনকাহিনি। আর তাই ভ্রমণ কাহিনি মনে শুধু আনন্দই এনে দেয় না, চোখের জল অথবা প্রতিবাদের ভাষাও জাগিয়ে দিতে পারে। ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্ট্রির সহায়ক বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম ছাড়াও ভ্রমণ কাহিনির বড় পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপেও। তেমনই কিছু 'অন্য ভ্রমণ' কথা।
বনঘরের গেরস্থালি
পীতম চট্টোপাধ্যায়
বন আস্তানার শরীরে চান্দ্রমাসের অভিঘাত থাকে। যে টুকু ছুড়ুক পুড়ুক বন মেখেছি - স্মৃতির সেসব অভয়ারণ্যের আবহে এই আস্তানাগুলোর আদর ছিল অগাধ। চাঁদনী রাতে এমন কোনও ঠাঁই জোটালে বোনাস হিসেবে অনাবিল রবীন্দ্রনাথ এসে যান - হোক বেসুরো - পর্দা বদল - মিলিয়ে দিলাম গলা। আবার যখন জোছনাবিরহী অমাবস্যা - বাংলোর রাস্তা চেনায় জোনাকি মিছিল তখন তার অন্য রূপ। প্যাঁচার ডানায় জমা গাঢ় আঁধারে টের পাই এখানে জীবনানন্দ আছেন - আমি আসার ঢের আগে থেকেই।
অফিসের অফসিজনে ম্যানেজ করা ছুটি - তখন যখন ছুটি - সেসব সময় এমন হিসেব মেলেনা। তবে বন বাংলোর সঙ্গে একসাথে স্নান মেখেছি বিস্তর। মেঘের পাড়ায় – ভালুকপং-এ জিয়াভরলির পাড়ে। সেটা বেশ রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার - কিন্তু রাজকন্যে বলে কি তার মনকেমন নেই? সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগে উড়ে যাওয়া একলা বুনোহাঁস দোতলার বারান্দার সামনে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল - রঞ্জনা আমি আর আসব না - শীতকাল কোথায় তখন। এই খবরটা পেয়েই জারদৌসী অভিমানে ফুলে ওঠা অকালবৈশাখী - বন আস্তানার মনখারাপ এত সুন্দর হতে পারে?
কিছু জঙ্গল স্কুল পালানো মোহনবাগান মাঠ - দল বেঁধে না গেলে মজা নেই - ছোট্ট সময়ে অপার ক্লোরফিলের টাকিলা। সারান্ডায় শালবনের মধ্যে দিয়ে যখন জীপ চলেছে হুডটি খুলে - তখন কি জানি এমন ঘোর দুর্গের মধ্যে পেয়ে যাবো অলীক অ্যাফ্রোদিতি! কাঠের বাংলোর ঠিক পিছন দিয়ে ঘের দিচ্ছে মাঝ বর্ষার উথাল পাথাল কোয়েল নদী। যার পেটে পাশের আরেকটা কটেজের বারান্দা আর শোয়ার ঘরও। কিছু বুনো ফুল শহুরে ফ্লাওয়ার ভাসেও মাপ মত হাসতে জানে। এ বাংলোর সামনের টেনিস কোর্টে অবহেলার ঘাসের সাইড - বেস - ট্রাম লাইন। তারও পরে ঢেউ খেলানো বুনোফুলের চত্তরটা - নাইন হোল গল্ফ গ্রাউণ্ড। এমন বাংলোয় বৃষ্টি আড়াল করে আনা বিরিয়ানিতে অবিকল পার্কসার্কাসের আভিজাত্য। সন্ধের আড্ডার আবহে চিতাবাঘের গল্প - অল্প শহুরে সন্দেহ - আর অনেকটা মিঠে বনবিলাসী ভয়! সিগারেট খেতে বেরোলেও সঙ্গে কেউ থাকলেই ভালো! মাঝ রাতে বন্ধুর ডাকে ভয়ে ভয়ে বারান্দায় -কি যেন একটা হেঁটে গেল - আরে ধুর্ - চেয়ে দেখ - এমন চাঁদের আলো!
কখনও বিকল্পও পরিশ্রমী হয়ে ওঠে বোধ হয় - আর সফল হয় প্রধানকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রকল্প। পানিঝোরার নতুন বাংলোয় যেতে হয় মূল ভিআইপি ঠেক বাংলোর পাশ দিয়ে - ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ৪ কিমি বেপথে গাড়ি চালিয়ে। সামনে একটু নীচে মূর্তি নদীর রুপোর হাঁসুলি আর দিগন্তে ডুয়ার্সের অমোঘ ল্যাণ্ডস্কেপ, পাশ থেকে কাকু বলে উঠল – "দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা"। সারাদিন যে জঙ্গলে বীরপুঙ্গব হাঁটাহাঁটির পর কিস্যু পেলাম না – আফশোস - সুর্য পাটে বসলে সেখানেই হেঁসোরাম হুঁশিয়ারি খতম। তখন রাত ভর্তি অন্যরকম ভয় আর অচেনা শব্দ – না দেখা লেপার্ড - না শুনতে পাওয়া হাতির নিঃশব্দ হেঁটে আসার থেকে কি সহজে আগলে রাখে - এই বননীড়। দিনের বেলা সেখানে হরেক পরিযায়ী মানুষজনের ভিড় - রাত হলেই তার হাতায় চেয়ারগুলো শিশিরে স্নান করে নেয় একা। আধখোলা দরজায় মুখ বাড়িয়ে সাবধানে প্রাণিত হয় ফেরারি জীবন।
রাতের খাবার খেতে বেরোয় কেউ হাতে আর কেউ কেউ চোখে টর্চ লাইট নিয়ে - সাবধানে। ঘাসের ওপর খসখসে হঠাৎ কিছু সরে যাওয়ার আওয়াজ জন্ম দেয় কত যে সর্পিল কল্পনার!
বনঘরের গেরস্থালি - সবুজ অক্ষর - ভেজা স্বপ্নের রান্নাঘরে গল্প ফেঁদে বসলে চরিত্রের অভাব হয়না। কিন্তু সেই চরিত্র গুলোকে একসাথে গেঁথে রাখে যে আলোর আলপিন তাদের গায়ে সময়ের জং লেগে যায়। তার পর কোনও একটা জানলা - বা একলা অপেক্ষার বারান্দা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে - আমায় মুড়ে দেয় শ্রেষ্ঠ স্মৃতির আদুরে চাদরে!
শব্দে আশ্রয় নিই আর ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিগুলোকে ফের রোদ খাওয়াই - রাত হলে ঘোলাটে জ্যোৎস্নাও।
ফিসফিস করে বলি - ফিরে আসব।
পীতম চট্টোপাধ্যায় কর্মসূত্রে আইডিবিআই ফেডেরাল লাইফ ইনসিওরেন্স-এর ট্রেনিং ম্যানেজার। ভালোবাসেন বেড়াতে, পাখি দেখতে আর তাদের ছবি তুলতে। জঙ্গল সব চাইতে প্রিয়। লেখালিখি করতেও ভালো লাগে। চরম আড্ডাবাজ। স্বপ্ন দেখেন ভূ-পর্যটনের।।