শিলাবতীর পাড়ে
সুদীপ্ত মজুমদার
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই ঘুরতে বেড়িয়ে পড়াটা অনেকের মত আমারও জীবনের অঙ্গ হয়ে পড়েছে বহু বছর। এখন মনে হয় ওটাই জীবনে অক্সিজেনের কাজ করে। বন্ধু ও ছোট ভাইয়ের মত অজিত একদিন ফোন করে বলেছিল – দাদা টিকিট কেটে ফেলেছি, চলো গনগনি ঘুরে আসি। এক রাতের মামলা। মনে মনে ইচ্ছেটা ছিল অনেক দিনের কিন্তু কেন যেন যাওয়াটা আর হয়ে ওঠেনি। এবার শুধু দিনটা আসার অপেক্ষা। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা টাউন আর তার কাছেইই গনগনি। কথিত আছে, অজ্ঞাতবাসের সময় মধ্যপাণ্ডব ভীম এই গনগনিতেই বকাসুরকে বধ করেন। গড়বেতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানান দর্শনীয় মন্দির।
গত মার্চের নির্ধারিত দিনে বিকেল ৪টে ৫৫ মিনিটে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস হাওড়া ছাড়ল। সিট রিজার্ভ করা আমাদের। দলও বেশ বড়ই, চব্বিশ জনের শক্তপোক্ত দল। ট্রেন ছুটল জোর কদমে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আড্ডা, গল্প। দেখতে দেখতে খড়্গপুর। বলা বাহুল্য দীর্ঘ বা মধ্য দূরত্বের ট্রেন সফরের অন্যতম আকর্ষণ টুকটাক মুখ চালানো - আর ভাজাভুজির প্রতি চিরকালই আমার কেমন যেন এক দুর্নিবার আকর্ষণ। তাই বার কয়েক চা-কফির সঙ্গে ডিমের ডেভিল, পকোড়া, ঝাল মুড়ির সঙ্গতে জমজমাট ব্যাপার। ওদিকে মেদিনীপুর পার করে গেছি। ঝাপসা অন্ধকার চিরে ট্রেন চলেছে, কাছে দূরে কখনও কখনও আলো দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে রাত ৮-১০, পৌঁছে গেলাম গড়বেতা। রাজনৈতিক নানা কারণে গড়বেতা নামটি খবরের শিরোনামে এসেছে বিগত বছরগুলিতে। আজ পা রাখলাম গড়বেতার লাল মাটিতে।
রাত্রিবাসের বুকিং ছিল 'আপ্যায়ন' লজে। মালিক বিপ্লববাবুই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন গড়বেতা স্টেশন থেকে লজে পৌঁছবার। মারুতি ভ্যান, মিনিট দশেকের পথ, গাড়ি প্রতি ১০০ টাকা। নামলাম 'আপ্যায়ন'-এর দোড়গোড়ায়। অত্যাধুনিক না হলেও মোটামুটি ছিমছাম ব্যবস্থা। এসি, নন এসি দুরকমই ঘর আছে। ভাড়া ৯০০ টাকা ও ৩৫০ টাকা। খাদ্য-পানীয় সবই বিপ্লব বাবুর ব্যবস্থাপনা। আমিষ, নিরামিষ - ফিস ফ্রাই থেকে মোগলাই সবই পেতে পারেন আগাম বলে রাখলে। তবে বিরিয়ানি বা চাউমিন পাওয়া যায় কিনা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি!
গড়বেতার ইতিহাস কিন্তু যথেষ্ট প্রাচীন। নামকরণটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রচলিত মত হল, এর নাম ছিল বকদ্বীপ। আর বকদ্বীপ ছিল বকাসুরের রাজ্য বেত্রবতীর মধ্যে। ভীম বকাসুরকে বধ করার পর শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে এসেছিলেন ভীমকে অভিনন্দন জানাতে। শ্রীকৃষ্ণকে সম্মান জানাতে যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি তৈরি করান। অনেকে বিশ্বাস করেন বর্তমান কৃষ্ণনগর গ্রামের শ্রীকৃষ্ণরাই জিউ এর মূর্তিটিই সেই মূর্তি।
আর একটি মত হল, এক বিশাল অঞ্চলের নাম ছিল বার্গাটাটি। বাংলার তৎকালীন শাসক সিহারুদ্দিন বুগ্রাশাহ-এর নামে নাম হয় 'বাগ্রি'। রাজা বিক্রমাদিত্য এসেছিলেন এই বাগ্রিতে। বাগ্রির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং স্থানীয় দেবী সর্বমঙ্গলার অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে সর্বমঙ্গলা মন্দির নির্মাণ করেন। রাজা বিক্রমাদিত্যের সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী সর্বমঙ্গলা তাকে তাল-বেতালের উপর প্রভুত্ব করার বর দেন। বিক্রমাদিত্য ওই স্থানের নাম রাখেন বেতা। পরবর্তীকালে গুপ্ত যুগে এখানে তৈরি হয় একটি দূর্গ বা 'গড়'। কালক্রমে লোকমুখে নাম হয় গড়বেতা।
ফিরে আসা যাক বর্তমানে – আমাদের বেড়ানোর কথায় – পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূমের গরম তাদের নিজগুণে বিখ্যাত। তাই মার্চের শেষ হলেও ভাজা হওয়ার আশঙ্কাটা ছিলই। কিন্তু আমাদের কপাল ভাল, রাতে হাল্কা বৃষ্টি আর ভোরের সূর্যহীন আকাশ স্বস্তি দিল দারুণভাবে। সাত সকালে বেরিয়ে পড়লাম দেবী সর্বমঙ্গলা দর্শনে। দলের কেউ কেউ সর্বমঙ্গলাদেবীর মাহাত্ম্য সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাই তাঁদের উৎসাহে দল বেঁধে চললাম দেবী দর্শনে। মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। আধা গ্রাম্য পরিবেশে মন্দ লাগার কথা নয়। মন্দির নির্মাণে ওড়িয়া স্থাপত্যের প্রভাব। এসি বসানো গর্ভগৃহ। পাথরের নাটমন্দির ও প্রশস্ত উঠোন। গেরুয়া রঙে রাঙানো সমগ্র মন্দির চত্বর। দেবী দর্শন ও প্রসাদ পাওয়া হল। মন্দিরের প্রবেশ পথের বাইরে বাঁধানো বটতলায় চা-পর্বের পর ফেরার পথ ধরলাম। লজে ফিরে চা-টোষ্ট-অমলেট সহযোগে ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে বেরিয়ে পড়লাম উল্টো পথে। লক্ষ্য গনগনি। অটো এবং টোটো পাওয়া যায়। ১০/১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। আদিবাসীদের একটা ছোট্ট বসতি পার করে কাজুবাদামের বাগানের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে লাল মাটির পথ। মাঝে মধ্যে স্থানীয়দের আসা-যাওয়া, কেউ হেঁটে, কেউ সাইকেলে। পথের শেষ শিলাবতী নদীর ধারে গনগনিতে। প্রথম দর্শনে শিলাবতীকে দেখে মনে হল কবিতা থেকে উঠে আসা সেই নদী –
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
হুবহু তাই-ই। মুগ্ধ বিস্ময়ে অনেক নীচে বয়ে চলা শিলাবতীকে দেখছি, আর দেখছি নদীর বুকের ওপর দিয়ে পার হওয়া গরুর পাল। ডান দিক, বাঁ দিক যেদিকেই দেখি হাজার হাজার বছরের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লাল, গেরুয়া মাটির পাহাড়। বিচিত্র, বিভিন্ন আকৃতি তৈরি হয়েছে প্রকৃতির আপন খেয়ালে। দূর থেকে মনে হয় ক্ষয়িষ্ণু কোনো বেলে পাথরের থাম, কোথাও গুহামুখ আবার কোথাও সুড়ঙ্গপথের শুরু যেন। বাঁধানো সিঁড়ি আছে নদীর পাড়ে নামার জন্য। অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে কেউ কেউ ওই বিশাল রাঙামাটির পাহাড় ধরে নামেন, তবে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। শক্ত ঝুরো মাটিতে শরীরের ভারসাম্য রাখা বেশ কঠিন। যাই হোক নেমে এলাম নদীর পাড়ে। কোথাও কোথাও সবুজ ঘাসের গালিচা, নদীর বুকে চড়া, কোথাও হাঁটু জল, কোথাও বা কোমর সমান জল বয়ে চলেছে তির তির করে। ওদিকে মেঘের প্রভাব কাটিয়ে সূর্য ফিরছেন নিজের মহিমায়। দিব্যি মালুম হচ্ছে তার প্রভাব, তবে তখনও সহনীয়। সাঁতার কেটে কোনও নদী পার হবার অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে হয়নি আমার, তাই হাঁটু জল কেটে নদী পারাপারের লোভ সামলানো গেলো না, পৌঁছে গেলাম নদীর অপর পাড়ে। শক্ত বালিমাটির পাড়। মাঝে মাঝে ঘাসের ছোপ, কিছুটা এগিয়ে গেলে চাষের জমি আর এপাড়ে ছবির মত গনগনি - দ্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অফ বেঙ্গল। ঘোরাঘুরি হল ইতস্তত, ফটো তোলার পালা আর বাচ্চাদের মত জলে দাপানো আর জল ছোঁড়াছুঁড়ি। হু হু করে সময় চলে গেল, ঘড়ি তখন একটার ঘর ছুঁয়েছে। ধীর পায়ে শিলাবতীকে বিদায় জানিয়ে সিঁড়ির পথ ধরলাম। উপরে উঠে একটাই মাত্র দোকান, ঠাণ্ডা জল, আইসক্রিম রাখে। শুনলাম এক সময় বসার জায়গা, শৌচালয়, খাবার জল সবই ছিল কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোনটাই আজ নেই। একটা খুব ভাল ট্যুরিস্ট স্পট পড়ে আছে সম্পূর্ণ অনাদরে।
দোকান মালিকই ফোন করে টোটো ডেকে দিলেন, জনপ্রতি ১০ টাকা। লজে পৌঁছে গেলাম কয়েক মিনিটে। দু'রকম মাছ দিয়ে দুপুরের খাওয়াটাও বেশ হল। ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পর গাড়ি এসে গেল স্টেশনে পৌঁছে দিতে। বিকেল ৬টায় ফেরার ট্রেন 'রূপসী বাংলা' আমাদের হাওড়া পৌঁছে দেবে রাত ৯টা ৩০ নাগাদ। পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, হাজার পাখির কলরবে বিদায় জানালাম গড়বেতাকে। ইচ্ছে রইল কোনও এক শীতের সকালে আবার পা রাখব শিলাবতীর পাড়ে।
ইংরেজি সাহিত্য ও ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা সুদীপ্ত মজুমদারের। কিন্তু আসল নেশা বেড়ানো, ছবি তোলা আর লেখালেখি। ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহ তীব্র।