হিরাপুরের যোগিনীরা
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
সালটা ১৯৫৩। জানুয়ারি মাস। ওড়িষার খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক কেদারনাথ মহাপাত্র পুরীর বালিয়ান্তা থানা এলাকায় প্রাচীন পুঁথি ও পুরাতাত্ত্বিক দ্রব্যাদির সার্ভে করতে আলওয়ারপুর গ্রামে ঘাঁটি গেড়েছেন। গ্রামের এক চৌকিদারের সঙ্গে গল্পে গল্পে হঠাৎই জানতে পারলেন, মাইল দুয়েক দূরে হিরাপুর গ্রামে একটি গোলাকার জায়গার মধ্যে অনেক দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন বলে উঠল, নিশ্চয় রানিপুরের ঝরিয়ালের মতো গোলাকার নতুন আরেকটি প্রাচীন মন্দির খুঁজে পাওয়া যাবে। ২৪ জানুয়ারি সকালে হিরাপুরে পৌঁছে চৌষট্টিযোগিনী মন্দিরটি দেখে নিজের ধারণাটি হুবহু মিলে যাওয়ায় দারুণ খুশি হলেন। এরপরে তাঁরই উদ্যোগে আই.এন.টি.এ.সি.এইচ.-এর ওড়িষা শাখার তত্ত্বাবধানে শুরু হল মন্দিরটির সংস্কার।
পুরাণ-গল্পকথা-ইতিহাস
যোগিনী পুজো ভারতের খুব প্রাচীন একটি প্রথা। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে ভীতি থাকার জন্যই ততোটা আলোচিত নয়। মূলত উত্তর ভারতের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় এই মন্দিরগুলি দেখতে পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে এই মন্দিরগুলির অধিকাংশের অস্তিত্বের কথাই উল্লেখ করেছেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক কানিংহাম। কিন্তু তার খুব সামান্য কয়েকটিই পরবর্তীকালে সেভাবে খুঁটিয়ে দেখা বা আলোচনা হয়েছে। এর কারণও সেই ভীতিই।
তান্ত্রিক দেবীরা ডাকিনি বা যোগিনী নামে পরিচিত। ভারতে নারীকে দেবীরূপে পুজোর চল কিন্তু বৈদিক যুগেরও আগে থেকে ছিল। দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃকা মূর্তির পুজো হত। কিন্তু ঠিক কোনসময়ে তন্ত্রশাস্ত্রের উদ্ভব হয় তা খুব স্পষ্ট নয়, সম্ভবতঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তবে নবম থেকে একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর সময়ে তন্ত্রচর্চার রমরমা বেড়েছিল। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মেই তান্ত্রিক প্রথার চল বেশি থাকলেও বৈষ্ণব এবং জৈন ধর্মের মধ্যেও এর প্রভাব কখনও কখনও লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন সময়েই নানা কারণে তান্ত্রিক চর্চার প্রথা কমেছে আর পরবর্তীকালে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখনও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে খেয়াল করলে দেখা যাবে গ্রামীণ দেবতা হিসেবে মাতৃকা মূর্তির পুজো হয়। আর তাকে ঘিরে থাকে নানান সব প্রাচীন ধ্যানধারণা, জাদুচর্চার কাহিনি।
প্রচলিত একটি কাহিনি হল দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি বা কসমিক ফোর্স থেকে অষ্টমাতৃকার সৃষ্টি হয়। এই অষ্ট মাতৃকার একেকজন আবার আরও আটটি ভাগে ভাগ হয়ে মোট চৌষট্টি যোগিনীর সৃষ্টি করেছে। এখানে মহিষাসুর নিধনের জন্য দুর্গার সৃষ্টির গল্প মনে পড়ে যায়।
ওড়িষায় মন্দির শহর ভূবনেশ্বরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে হিন্দু এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিক পুজোআচ্চা প্রসারলাভ করেছিল। বৈতাল মন্দির ও মোহিনী মন্দিরে ভীষণকায়া দেবী চামুণ্ডার মূর্তি তার প্রমাণস্বরূপ। ভূবনেশ্বরের আরও অনেক মন্দিরেই মাতৃকা দেবী মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। লিঙ্গরাজ মন্দিরের অষ্ট চণ্ডিকা মূর্তিগুলিও উল্লেখযোগ্য।
যোগিনী তন্ত্রকে মূলত ৬৪ টি ভাগে ভাগ করা হয়। তাই সাধারণভাবে যোগিনীর সংখ্যাও ৬৪ ধরা হয়। তবে কোথাও কোথাও ৪২ বা ৮২ যোগিনীর উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত যোগিনী মন্দিরগুলি বৃত্তাকার এবং ছাদবিহীন হয় – হাইপেথ্রাল টেম্পল। মন্দিরে ৬৪ টি ভাগ থাকে যেগুলিকে 'আরা' (কিরণ) বা 'ডালা'(পাঁপড়ি) বলা হয়।
স্কন্দ পুরাণ ও অন্যান নানা পুরাণে যোগিনীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে তাদের পূর্ণাঙ্গ দেবীর বিভিন্ন দিক রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়, এই যোগিনী রূপের মাধ্যমেই তিনি পূর্ণতার দিকে যান। চৌষট্টি যোগিনীদের আটটি করে একসঙ্গে নিয়ে অষ্ট মাতৃকা হিসেবে বন্দনা করার রেওয়াজও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। সপ্ত মাতৃকার আরেকটি উন্নত রূপ বলা যেতে পারে। নয় বা ষোলো মাতৃকা রূপও দেখতে পাওয়া যায় কোথাও কোথাও। অগ্নিপুরাণে অষ্ট মাতৃকার উল্লেখ রয়েছে। এই অষ্ট মাতৃকা হলেন – ব্রাহ্মণী, মহেওয়ারি, কৌমারি, বৈষ্ণবী, ঐন্দ্রী, চামুণ্ডা, মহালক্ষী, বরাহী। স্কন্দপুরাণে উল্লেখ আছে যে, দেবী মহিষাসুরমর্দিনী অসুরকে বধ করার সময় যুদ্ধে সহায়তার জন্য যোগিনী বৃত্তটি সৃষ্টি করেন। ভগবতী পুরাণে বলা আছে, দেবী ভূবনেশ্বরী মণিদ্বীপে বসবাস করে। এই দেবীর চৌষট্টিটি দিক বা কাতা-র নামেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
বৃত্ত সার্বিকভাবে সবচেয়ে সরল এবং পবিত্রতম অবস্থাকে নির্দেশ করে। এটি পুরাকাল থেকে বিম্ব বা প্রতিচ্ছবির চিহ্নকে বোঝায়। বৃত্ত একইসঙ্গে সূর্য, চক্ষু, সময়, রাশিচক্র এবং অনন্তকে বোঝায়। এটা কিছুই না অথচ সবকিছুই। এটা এমন একটা চেহারা ও অবস্থা যা তুলনামূলকতা এবং বিচ্ছিন্নতা উভয়ই বোঝায়। বৃত্ত কোনও সূচনা বা সমাপ্তি ব্যতিরেকেই নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। এবং বাইরের সমস্তকিছুকে আলাদা করে দেয়। বৃত্ত নিজেকেও বোঝায় - আত্মকে। প্রাচীনকাল থেকেই পবিত্র কোনও জায়গার সীমা নির্দেশ করতে বৃত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মেও বৃত্তের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বুদ্ধ ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত ভারত সংহিতায় এই ধরণের মন্দিরের উল্লেখ আছে। অগ্নিপুরাণে বৃত্তাকার নয় ধরণের মন্দিরের কথা পাওয়া যায়। সাধারণ মন্দিরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আকারের এই যোগিনী মন্দিরগুলির মধ্যে একমাত্র খাজুরাহোর মন্দিরটি চৌকাকার।
বিশেষ প্রকারের তন্ত্র সাধনায় চক্রের গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যখন বিভিন্ন যোগিনী মূর্তিগুলি সেই চক্রের মধ্যে অধিষ্ঠান করানো হয়, তাকে যোগিনীচক্র বা যোগিনী মন্দির বলা হয়। কোনও কোনও তান্ত্রিক পাঠে ওই মন্দিরকে 'মণ্ডল' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মাতোত্তারা তন্ত্রে যোগিনীচক্র এবং চৌষট্টি যোগিনীর উল্লেখ রয়েছে। ভারতে কৌলার্নাভা তন্ত্রের অধীনে তন্ত্র চর্চার জন্য যোগিনী মন্দিরগুলির নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশেষ এই তন্ত্রটির চর্চা ওড়িষার হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনী মন্দির থেকে শুরু হয়ে ভারতের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। হিরাপুর ছাড়া ভারতের অন্যান্য যেসব জায়গায় যোগিনী মন্দির বা তার ধ্বংসাবশেষের কিছু উল্লেখ পাওয়া গেছে তা হল, জব্বলপুরের ভেদঘাট, মধ্যপ্রদেশের দুদাহি, বাদো ও শাহদোল, উত্তরপ্রদেশের লোখারি, খাজুরাহ ও রিখিয়ান, গোয়ালিয়রের মিতাওলি ও নরেসার, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্তের হিংলাজগড়, ওড়িষার রানিপুর-ঝরিয়াল এবং দক্ষিণ ভারতে কাঞ্চিপুরম। এছাড়া উত্তরপ্রদেশের বেনারস বা কাশীতে গঙ্গার একটি ঘাট সংলগ্ন চৌষট্টি দেবী মন্দির রয়েছে। এখানে কিন্তু মন্দিরটি ছাদবিহীন নয়। একটিমাত্র দেবী মূর্তিই চৌষট্টি দেবীর প্রতিভূ। ঘাটটির নামও চৌষট্টি যোগিনী ঘাট। এরমধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গায় মন্দিরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। ভগ্নমূর্তিগুলি বিভিন্ন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।
ওড়িষায় তন্ত্রচর্চার চল বহু পুরনো। অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে মৎসেন্দ্রনাথের কৌলাজনানানির্ণয়-এ যোগিনী তন্ত্রের গোপন চর্চা এবং দর্শনকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিভুক্ত করা হয়। ওড়িষায় হিরাপুর ও রানিপুর-ঝরিয়ালে দুটি যোগিনী মন্দির রয়েছে। হিরাপুরের মন্দিরটি ভারতে ক্ষুদ্রতম। কুয়াখাই নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী অঞ্চলে গ্রামের বহির্ভাগে বৃহৎ একটি পুষ্করিণী এবং ধানক্ষেতের গায়ে অবস্থিত এই মন্দিরটি। মন্দির শহর ভূবনেশ্বর থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরে। এক লোককথা বলে, হিরাপুর গ্রামটির নাম তৎকালীন রানির নামে রাখা, আবার অন্য লোকগাথায়, এখানে কখনও হীরক বৃষ্টি হয়েছিল। তবে মন্দির প্রতিষ্ঠাকালীন কে যে ক্ষমতায় ছিলেন ওই অঞ্চলের তা খুব স্পষ্ট নয়। সম্ভবতঃ ভাঞ্জা শাসকেরা বা সোমবংশী রাজারা।
বৃত্তাকার মন্দিরটির বাইরের দিকের ডায়ামিটার তিরিশ মিটার। ল্যাটেরাইট পাথরে তৈরি মন্দিরটির বৃত্তাকার অংশটি স্যান্ডস্টোন ব্লক দিয়ে তৈরি। মূল দরজাটি একটি ছোট গলি দিয়ে বৃত্তাকার অংশের সঙ্গে যুক্ত। কালো ক্লোরাইট পাথরের স্ল্যাব থেকে কাটা যোগিনী মূর্তিগুলির একেকটি মোটামুটি দু ফিট উচ্চতার। সবকটি মূর্তির ভঙ্গীই দাঁড়ানো অবস্থার। মাটির কাছাকাছি ওপরে আর্চওলা প্রত্যেকটি যোগিনী মূর্তির ক্ষুদ্রাকার কুলুঙ্গিগুলিকে একেকটি ক্ষুদ্রাকার মন্দির রূপে ধরা হয়।
এবং ভ্রমণকাহিনি
গত মার্চের এক রোদ্দুরভরা বেশ গরম সকালে পুরী থেকে হাফ ডে ট্যুরে বেরিয়েছিলাম। গন্তব্য ধৌলি, চৌষট্টি যোগিনী মন্দির, পিপলি আর রঘুরাজপুর। ধৌলিতে অশোকের শিলালিপি দেখে মুগ্ধ হয়ে ফিরছি চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের দিকে। আমার আবার এই বয়সেও দুম করে অবাক আর মুগ্ধ হওয়ার বদ অভ্যেস আছে। মন্দিরের রাস্তা কেউ ঠিক বলতে পারছে না, মোবাইলে গুগুল ম্যাপ ভরসা করে এগোনো। মূল রাস্তা থেকে পাশের রাস্তায় নেমে গেছি অনেকক্ষণ। মন্দিরের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছলে কয়েকজন শেষ রাস্তাটুকুর সন্ধান দিলেন। বিশাল পুকুরের পাশে গাড়ি থামল – মহামায়া পুষ্করিণী। একটু এগিয়ে লোহার ছোট গেট পেরিয়ে সবুজে ভরা বড় চত্ত্বরের একেবারে শেষে মন্দির। গোলাকার ছাদবিহীন মন্দিরটা দেখে ভারী আশ্চর্য হয়ে গেলাম। রোদে তখন পাথরে পা রাখা যাচ্ছে না। জুতো খুলে এক দৌড়ে... নাহ্, মন্দিরের ঢোকার ছোট্ট গলিতে মাথা নীচু করতে হল। এভাবেই বানানো। ভেতরে কোথাও রোদ্দুর কোথাও বা মন্দিরের দেওয়ালের ছায়া। ওইটুকু জায়গার ভেতরে যে এতগুলি দেবীর অধিষ্ঠান তাও ভাবিনি। আবার সেই অবাক হওয়ার পালা। গোল মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালের নীচের দিকে ছোট ছোট কুঠুরিতে সুন্দরী সব দেবী, সুডৌল গঠন তাদের, যেমনটা দেখা যায় চিরাচরিত ভারতীয় ভাস্কর্যে। মূর্তির মুখ কখনও মানুষের, কোনটা বা পশুর। অনেকগুলি মূর্তির হাত বা কোনও অঙ্গ ভেঙে গেছে, তবু মোটের ওপর বোঝা যায়। মোট ষাটটি কুঠুরি। দরজার একেবারে সোজাসুজি মহামায়া মূর্তিটি গ্রামদেবী হিসেবে পূজিত। পরে জেনেছি যে ভারতের চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরগুলির মধ্যে একমাত্র এই মন্দিরেই পুজো চালু আছে। মন্দিরের কেন্দ্রে থাকা উঁচু চণ্ডীমণ্ডপে, আরও চার কুঠুরির মধ্যে একটি ফাঁকা, বাকি তিনটেয় তিন দেবী। এখানে চারটি ভৈরবের মূর্তিও রয়েছে।
মন্দিরের পুরোহিত মূর্তি চেনান ঘুরে ঘুরে। আমরাও যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে দেখি –
|
১) মায়া/বহুরূপা/চণ্ডিকা – মূর্তিটির চার হাত। ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় একটি সোজা করে রাখা মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথার ওপরে খোঁপা। গলায় হার, কোমরে গোট, হাতে বাজুবন্ধ ও পায়ে নূপূর। অধিকাংশ যোগিনী মূর্তির অঙ্গেই এই অলংকার বা কিছু অন্য অলংকার রয়েছে।
২) তারা – হাঁটু কিছুটা ভাঁজ করে মৃতদেহের ওপর দাঁড়ানো মূর্তি। দুটি হাত। মাথার বাঁপাশে কেশবন্ধন। অঙ্গে বিবিধ অলংকার প্রথম মূর্তিটির মতোই।
৩) নর্মদা – হাতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটির দুটি হাত। একটি হাতে নরকরোটির পেয়ালা (কাপালা) মুখের কাছে মতো ধরা – যেন রক্তপান করছে। গলায় মুণ্ডমালা ও সর্বাঙ্গে অন্যান্য নানা গহনা।
৪) যমুনা– চার হাত। ওপরের ডান হাতে কাপালা। বিরাট এক কচ্ছপের ওপরে দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে (প্রত্যালিধ ভঙ্গী)। মাথার ওপর কোঁকড়া চু্ল (জটামণ্ডল)।
৫) শান্তি/কান্তি/লক্ষ্মী/মানদা – দুই হাত, পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর দাঁড়ানো মূর্তি, মাথার ওপরে খোঁপা। প্রথম মূর্তিটির মতো গহনা ছাড়াও নাগের মাথাওলা বাজুবন্ধ (নাগকেয়ূর), পরনে ময়ূর পালকের ছোট ঘাগরা। প্রচলিত লক্ষ্মী মূর্তির সঙ্গে কোনও মিলই পাই না।
৬) বৃদ্ধি/ক্রিয়া/বারুণি – সমভঙ্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান দেবীমূর্তির দুই হাত। মাথার বাঁদিকে খোঁপার আকারে চুল বিন্যস্ত রয়েছে। মাথায় এবং বিভিন্ন অঙ্গে অলংকার। স্তম্ভমূলে ঢেউয়ের সারি।
৭) অজিতা/গৌরী/ক্ষেমঙ্করী – সমভঙ্গ মুদ্রায় কুমীরের ওপর দণ্ডায়মান দেবীমূর্তির চারটি হাত। মাথার ওপরে খোঁপা (চিগনোন)। অঙ্গে গোট, হার, বাজুবন্ধ, নূপূর ও মাথায় নানা অলংকার রয়েছে।
৮) ঐন্দ্রী/ইন্দ্রানী – প্রত্যালিধ মুদ্রায় হাতির ওপর দাঁড়ানো দেবীমূর্তিটির দুই হাত। খোঁপা মাথার ওপরে আর বিভিন্ন অঙ্গে ও মাথায় অলংকার রয়েছে।
৯) বরাহী – বরাহমুখী দেবীর চারটি হাত। প্রথম যোগিনী মূর্তির মতো দেহে অলংকার রয়েছে। তারসঙ্গে মুকুট এবং কিরীট। বাঁদিকের এক হাতে কাপালা ও অন্য হাতে ধনুক।
১০) রণবীরা/ পদ্মাবতী – সাপের ফনা আর শরীরে পা রেখে দাঁড়ানো ভীষণদর্শনা এই দেবীর দুই হাত। ডান হাতে খড়্গ। গলায় মুণ্ডমালা ও মাথায় অলকা। মাথার ওপরে খোঁপা।
১১) মূরতি/অষ্টগ্রীবা – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় উটের ওপর দণ্ডায়মান বানরমুখী দেবীর চার হাত।
১২) বৈষ্ণবী – গড়ুড় পাখির পিঠে দাঁড়ানো দেবীমূর্তির দুই হাত। অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী। কুঞ্চিত কেশে সর্পমুকুট। দেহেও নানা অলংকার।
১৩) বীরূপা/কালরাত্রী/পঞ্চবরাহী – ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় বরাহের ওপরে দণ্ডায়মান অনিন্দ্যকান্তি হাস্যমুখী দেবীমূর্তির দুই হাত। মাথার ওপর সুন্দর খোঁপাটি।
১৪) বৈদ্যরূপা – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় ঢাকের ওপর দাঁড়ানো মূর্তিটির দুটি হাত। মাথার ওপরে খোঁপা।
১৫) চর্চিকা – ত্রিভঙ্গভাবে একটি পুরুষ মূর্তির ওপরে দাঁড়ানো দেবী মূর্তিটির দুই হাত। উপুড় হয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা পুরুষ মূর্তিটির মাথায় কুঞ্চিত চুল, ডানহাতে একটি পদ্মকাণ্ড আর বুকে একটি কাটারি।
১৬) মার্জারি/বেতালি – সমভঙ্গ মুদ্রায় মৎস্যের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চার হাত। মাথার ওপরে খোঁপা। গলায় মুণ্ডমালা। শরীরে অলংকারাদি প্রথম যোগিনীর মতোই।
১৭) ছিন্নমস্তকা – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় ছিন্ন নরমস্তকের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চারটি হাত। নীচের বাম হাতে ধরা ধনুক। মাথার ওপরে খোঁপা। এখানে চিরাচরিত ছিন্নমস্তা দেবী মূর্তির সঙ্গে পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। দেবী নিজে ছিন্নমস্তক নয়, বরং ছিন্নমস্তকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে মূর্তিটি। এখানে নারীর অসহায়তার বদলে শক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। প্রায় সবকটি দেবী মূর্তির ভাষ্যই যেন এই শক্তির প্রকাশ।
১৮) বৃষবাহনা/বিন্ধ্যবাসিনী – সম্মুখে একটি ছোট গর্ত বা গুহামুখওলা গুহার মাথায় পা রেখে দাঁড়ানো বৃষমুখী রাগতদর্শনা দেবীর দুটি হাত ও মাথায় জটামণ্ডল।
১৯) জলকামিনী – ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় বৃহৎ একটি দাদুরির ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুইটি হাত। মাথার ডানপাশে চমৎকার কেশবন্ধ। কোমরের গহনা এবং পোশাক বেশ কারুকার্যময়।
২০) ঘটভারা – অনিন্দ্যকান্তি এই মূর্তিটি নৃত্যভঙ্গীতে দণ্ডায়মান। এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়, ওড়িষার অন্য যে যোগিনী মন্দিরটি রানিপুর-ঝরিয়ালে রয়েছে তার সবকটি মূর্তিই নৃত্যভঙ্গীমায় দণ্ডায়মান। শক্তিশালিনী এই দেবী মূর্তিটি সিংহের ওপর দাঁড়িয়ে দুহাতে মাথার ওপর হাতি তুলেছে। হাতিটি মুখ লুকিয়ে রয়েছে।
২১) বীকারালি/কাকারালি – অনিন্দ্যকান্তি দেবীর মাথার ডানপাশে চমৎকার কেশবন্ধ। ডান পা তুলে বাম পায়ের থাইয়ের ওপর দুই হাতে শক্ত করে ধরা দেখে মনে হয় যেন নূপূরটি ঠিক করে পড়ছেন। ভঙ্গীটি ভারী চমৎকার। যেন শ্রী রাধিকা, পাছে নূপূরের শব্দ শোনা যায় তাই কাপড়ে বেঁধে রাখছেন। সেই মুহূর্তটি যেন বাঁধা পড়েছে অনন্তকালের জন্য।
২২) সরস্বতী – আমাদের চেনা সরস্বতী মূর্তি থেকে একেবারেই আলাদা এই দেবী মূর্তিটি একটি সর্পের ওপর দণ্ডায়মান। ডান কাঁধ থেকে একটি তারের বাদ্যযন্ত্র (তুমুরু) কোনাকুনিভাবে ঝুলছে। মাথার ওপরে চুলগুলি চালচিত্রের আকারে রয়েছে। দেবী বাম হাতে গুম্ফ মোচড়াচ্ছেন।
এইখানে এসে একটু থমকে যাই। মনে পড়ে যায় বিভূতিভূষণের বড় প্রিয় একটা গল্প –'মেঘমল্লার'। বিভূতিভূষণের নানা গল্পেই তন্ত্রের কথা বা অতীন্দ্রিয় শক্তির কথা ফিরে ফিরে এসেছে। এই গল্পে তান্ত্রিক গুণাঢ্য, প্রদ্যুম্ন নামে এক তরুণ শিল্পীকে ভুল বুঝিয়ে তার বাঁশির মেঘমল্লারের রাগে দেবী সরস্বতীকে বন্দী করে এই পৃথ্বীলোকে। দেবী আত্মবিস্মৃত হয়ে সাধারণ নারী হয়ে ওঠেন। গল্পের শেষে প্রদ্যুম্ন নিজে পাথর হয়ে গিয়েও দেবীকে তাঁর পূর্বরূপ ফিরিয়ে দেয়। প্রদ্যুম্নের প্রেমিকা সুনন্দাও কোনদিন জানতে পারেনি সে কথা। বহুদিন প্রদ্যুম্নের জন্য অপেক্ষা করে শেষে সন্ন্যাসিনী হয়ে গিয়ে সে মাঝে মাঝে স্বপ্নে জঙ্গলের মধ্যে এক পাথরের মূর্তিকে দেখতে পেত।
তান্ত্রিক এই সরস্বতী-র মধ্যে মেঘমল্লারের সেই দেবীকে খুঁজে না পেয়ে মনের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা খাই যেন!
আবার এগোই। পূজারী আমার অনুরোধে দু-তিনবার ঘুরে ঘুরে সব মূর্তিকে বারবার করে চিনিয়ে দেন। মন্দিরের যেখানে রোদ এসে পড়ছে পা রাখা যাচ্ছে না। মধ্যগগণে থাকা সূর্যের তাপ কাপড়ের টুপি ভেদ করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। তবু অবাক হতে আশ্চর্য হতে কিম্বা বিস্মিত হতে আমার আটকাচ্ছে না একটুও।
২৩) বিরূপা – দ্বিভঙ্গপদ মুদ্রায় ঢেউয়ের ওপর দণ্ডায়মান দেবী মূর্তির দুইটি হাত। মাথার ওপরে খোঁপা।
২৪) কুবেরী – পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর নৃত্যভঙ্গীমায় দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। পদ্মের ওপরে দেবীর পায়ের সামনে রাখা সাতটি রত্নকলস। মুকুট ও কিরীটিধারণ করা মস্তকের ডানপাশে চমৎকার কেশবন্ধন। অন্যান্য অলংকারের সঙ্গে কোমরে একটি রত্নখচিত গোট।
২৫) ভল্লুকা – ভল্লুকমুখী এই দেবীর দুই হাত। অঙ্গে বিবিধ অলংকার। ডানহাতে একটি ডমরু। মাথার ওপর চুলের জটা। স্তম্ভমূলে পদ্মলতা।
২৬) নরসিংহী/সিংহমুখী – দেবী সিংহমুখী ও চার হাত বিশিষ্ট। নীচের দুটি হাতে পাত্র ধরা রয়েছে। মাথার ওপরে সিংহের কেশরের মতো চুলের জটা বা জটামণ্ডল। স্তম্ভমূলে দেবীর পায়ের কাছে পাতাসহ পাঁচটি ফুল।
২৭) বীরজা – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় পদ্ম কুঁড়ি ও পাতার ওপর দণ্ডায়মান দেবীমূর্তির দুই হাত। অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তির মাথার ডানপাশে খোঁপাটি রয়েছে।
২৮) বিকটাননা – রাগত ভয়ালদর্শনা। দুই হাত। উদ্গত ঠোঁট। মাথায় কোঁকড়া জটা চুলে সর্প মুকুট।
২৯) মহালক্ষ্মী – পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর দণ্ডায়মান লাবণ্যময়ী দেবীমূর্তির দুই হাত। গলায় সর্পের মালা। একহাতে বজ্র এবং অন্য হাতে ঢাল। মাথার ডানপাশে কেশবন্ধন।
৩০) কৌমারি – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় ময়ূরের ওপর দণ্ডায়মান লাবণ্যময়ী দেবী মূর্তির দুই হাত। ডানহাতে অক্ষমালা। অন্যান্য যোগিনীদের মতো অঙ্গে হার, গোট, নূপূর নানান অলংকার। বাঁ হাতের ঢালটি ভেঙে গেছে। মাথার ডানপাশে কেশবন্ধ।
৩১) মহামায়া–পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর দণ্ডায়মান দেবীমূর্তিটি আকারে-আয়তনে অন্যান্য মূর্তিগুলির থেকে কিছুটা বড়। দশটি হাত চিরাচরিত দুর্গামূর্তির কথা মনে পড়ায়। মূর্তির পায়ের কাছে চৌকো আকারের শক্তিপিঠ। মাথায় মুকুট ও কিরীট। গলায় অপরূপ সুন্দর একটি হার। রত্নখচিত গোট, বাজুবন্ধ ও নূপূর। গ্রামদেবী হিসেবে এখনও পুজিত হন মহামায়া। তাঁর নামেই মন্দিরের স্থানীয় নাম মহামায়া মন্দির ও সংলগ্ন পুকুরটির নাম মহামায়া পুষ্করিণী। কালিকা পুরাণে যোগিনী মহামায়ার উল্লেখ আছে।
পুজোর ঠ্যালায় রঙিন কাপড় আর গাঁদা ফুলের স্তুপের আড়ালে এই দেবী মূর্তিকে দেখা বর্তমানে একেবারে অসম্ভব। তাই কৌতূহল রয়েই যায়। মহামায়ার আড়ালে চাপা পড়েছেন দেবী রতিও। কাপড় একটু সরিয়ে সেই মূর্তিটি দেখান পুজারী।
৩২) ঊষা/রতি – প্রবল রাগান্বিত মুখমণ্ডল। দুই হাত। মাথায় জটামণ্ডল। হাঁটু কিছুটা ভাঁজ করে দাঁড়ানো। স্তম্ভমূলে তীর-ধনুক হাতে আর কাঁধে তূণীর নিয়ে কামদেবের মূর্তি।
৩৩) কর্করী – ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় কাঁকড়ার ওপর দাঁড়ানো অনিন্দ্যকান্তি দেবী মূর্তিটির দুই হাত। মাথার বামপাশে কেশবন্ধন। কানে, মাথায় নানা অলংকার, কোমরে গোট ও গলায় হার।
৩৪) সর্পশা/চিত্তলা – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় দাঁড়ানো সর্পমুখী দেবীর চার হাত। অঙ্গে নানাবিধ অলংকার। স্তম্ভমূলটি ভেঙে গেছে তাই দেবীর বাহন কে তা আর বোঝা যায় না।
৩৫) যোশা – ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় চারপায়াওলা খাটের ওপর দাঁড়ানো দেবী মূর্তির দুই হাত। মাথার ওপর কিরীট আর জটামুকুট।
৩৬) অঘোরা/বৈবস্বতী – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় সিংওলা ছাগজাতীয় প্রাণীর ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। ভয়ালদর্শনা দেবীর দুই চক্ষু কোটর থেকে প্রায় বেরিয়ে এসেছে। চুল মাথার ওপর ছড়ানো।
৩৭) ভদ্রকালী/রুদ্রকালী – সমভঙ্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। ডান হাতে একটি তরোয়াল। বাহন কাক। জটিল নক্সাকরা পোশাক। মাথার ওপরে খোঁপাটি অগ্নিশিখার ন্যায়।
৩৮) মাতঙ্গী/শীতলা/বিনায়কি/গণেশানি/গজাননা – দেবীর পেটমোটা হাতিমুখো চেহারা দেখলে গণেশের কথা মনে পড়বেই। তবে বাহন গাধা। দুই হাত আর মাথায় জটাজুট বা জটামুকুট।
৩৯) বিন্ধ্যবালিনী – প্রত্যালিধ মুদ্রায় ইঁদুরের ওপর দাঁড়িয়ে দুই হাতে ধনুক থেকে তির ছোঁড়ার মুহূর্তটি যেন স্থির হয়ে রয়েছে। বাঁ হাতে ধনুকটি ধরা। ডান হাতে টান দিয়েছেন ছিলায়। মাথার ডানপাশে চমৎকার কেশবন্ধন।
৪০) অভয়া/বীরকুমারী – কাঁকড়াবিছের ওপর নৃত্যরত ভঙ্গীতে দাঁড়ানো দেবীমূর্তির চার হাতের ওপরের দুটি হাত নাচের ভঙ্গীতে উত্তোলিত। অপরূপ দেহভঙ্গিমা। মাথায় জটা মুকুট।
৪১) মাহেশ্বরী – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় ষাঁড়ের ওপর দাঁড়ানো দেবীর চারটি হাত। অঙ্গে নানা অলংকার। মাথার ডানপাশে কেশবন্ধন।
৪২) কামাক্ষী/অম্বিকা – বেজির ওপরে রাখা দুই চাকার ওপর হাঁটু মুড়ে দাঁড়ানো দেবীর চার হাত। নীচের দুই হাত দুই হাঁটুর ওপরে রাখা। ওপরের ডানহাতে একটি ডমরু। ভেঙে যাওয়া বাম হাতে সম্ভবত একটি পদ্ম। কেশবন্ধন মাথার ডানপাশে।
|
৪৩) কামায়ণী – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় মোরগের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। অঙ্গে বিবিধ অলংকার। মাথার ডানপাশে কেশবন্ধন।
৪৪) ঘটবারি – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় সিংহের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। মাথার ওপরে কোঁকড়া চুলে নানাবিধ গহনা – করন্দ মুকুট।
৪৫) স্তুতি – সমভঙ্গ মুদ্রায় হলুদ বাটা রাখার পাত্রের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চারটি হাত। স্তম্ভমূলে একটি ফুলদানিও রয়েছে। মাথায় ফুলের মালা, গহনা ও মুকুট। ডানপাশে খোঁপা।
৪৬) কালী – চিরাচরিত কালী মূর্তিকে মনে করায় এক পায়ের তলায় শিব রয়েছে বলেই। যোগিনী মূর্তিটি দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতই অনেকটা ভাঙা। যোগিনীর কাছে একটি ত্রিশূল রয়েছে। মাথার ওপরে খোঁপা। পায়ের তলার পুরুষ মূর্তিটির ত্রিনয়ন। মাথায় মুকুট ও কিরীট। একটি হাত মাথার তলায় রাখা। ত্রিনয়ন বলেই শিব হিসেবে সনাক্তকরণ।
৪৭) উমা – পদ্ম ফুলের ওপর দণ্ডায়মান অনিন্দকান্তি দেবীর চারটি হাত। ওপরের বাম হাতে একটি নাগপাশা। নীচের বাম হাতে অভয় মুদ্রা। মাথায় কিরীট ও জটামুকুট।
৪৮) নারায়ণী – অনিন্দকান্তি দেবী মূর্তির দুই হাত। বাম হাত স্তম্ভমূলে রাখা একটি মদ্যভাণ্ডের ওপরে রাখা। ডান হাতে তরোয়াল। স্তম্ভমূলে একটি কোনাকৃতি ঢাকা বিশিষ্ট মাটির পাত্র রয়েছে। দেবীর মাথায় টায়রা, অঙ্গে বিবিধ অলংকার। মাথার ডান পাশে কেশবন্ধন।
৪৯) সমুদ্রী – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় শঙ্খের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। মাথায় টায়রা ও বামপাশে খোঁপা। অঙ্গে বিবিধ অলংকার।
৫০) ব্রাহ্মণী – দেবীর তিনটি মুখ ও চার হাত। আমার মনে হয়েছে ব্রহ্মার আদলে চারটি মুখই হয়ত ভাবা হয়েছিল। পেছনের মুখটি কি দেখা যাচ্ছে না? মূর্তির মাথায় কিরীট আর জটামুকুট। লক্ষ্যণীয়, লিঙ্গে স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য গলায় পৈতে রয়েছে। অঙ্গে বিবিধ গহনাদি। স্তম্ভমূলের ডানদিকে একটি সিংহ সজ্জিত রয়েছে। দেবীর বাহন বই।
৫১) জ্বালামুখী – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় আটটি পায়াওলা প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়ানো দেবীর দুই হাত। মুখটি কোনও পশু সদৃশ, যদিও ভেঙে যাওয়ায় বোঝা কঠিন। খাড়া দুটি কান দুপাশে উঁচু হয়ে আছে। মাথার দুপাশে জটাওলা চুলে দুটি বিনুনি বাঁধা রয়েছে।
৫২) আগ্নেয়ী – দেবীর দুই হাত। মাথার ওপরে তোলা ডান হাতে তরোয়াল। অঙ্গে বিবিধ অলংকার। পেছনে আগুনের শিখা।
৫৩) অদিতি - সমভঙ্গ মুদ্রায় পায়রার ওপর দাঁড়ানো দেবীর দুই হাত। মাথার ওপরে খোঁপা।
৫৪) চন্দ্রকান্তি – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় চার পায়া বিশিষ্ট কাঠের খাটের ওপর দাঁড়ানো দেবীর দুই হাত। অঙ্গে নানাবিধ অলংকার। মাথার ডানপাশে কেশবন্ধন।
৫৫) বায়ুবেগা – দ্বিভঙ্গ মুদ্রায় স্ত্রী ইয়াকের ওপর দাঁড়ানো অনিন্দ্যকান্তি দেবীর দুই হাত। অঙ্গে নানাবিধ অলংকার। মাথার ওপরে অপরূপ সুন্দর খোঁপা।
৫৬) চামুণ্ডা – ত্রিভঙ্গ নৃত্যরত মুদ্রায় কস্তুরী মৃগের ওপর দণ্ডায়মান অদ্ভুতদর্শনা দেবীর চার হাত। ওপরের দুহাতে মাথার ওপরে একটি সিংহ তুলেছেন। নীচের বামহাতে কাটারি, ডানহাতে কাটা মুণ্ড। গলায় নরমুণ্ডের মালা। দেবীর দেহ অস্থিচর্মসার, স্তনদুটি ঝুলছে।
৫৭) মারুতি – ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় সিঙেল হরিণের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। অঙ্গে নানাবিধ অলংকার। মাথার ওপরে চুল অগ্নিশিখার মতো।
৫৮) গঙ্গা – ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় মকরের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চার হাত। ওপরের ডান হাতে একটি পদ্মলতা ধরা। নীচের বামহাতে একটি নাগপাশা। অঙ্গে বিবিধ অলংকার। মাথার ওপরে খোঁপা।
৫৯) ধূমাবতী/তারিনী – সমভঙ্গ মুদ্রায় হাঁসের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাতে কুলো। মাথার ওপরে খোঁপা।
৬০) গান্ধারী – সমভঙ্গ মুদ্রায় অশ্বের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। মাথার বামপাশে কেশবন্ধন। দেবীর পশ্চাৎপটে একটি কদম্ববৃক্ষ।
মন্দিরের নীচের অংশের ৬০ টি কুঠুরিতে ষাটটি যোগিনী মূর্তি রয়েছে। বাকি চারটি যোগিনী মূর্তি ও চারটি ভৈরব মূর্তির অবস্থান মন্দিরের কেন্দ্রে একটু উঁচুতে অবস্থিত গোলাকার চন্ডীমণ্ডপ বা যোগিনী মণ্ডপে। বলা হয় কোনও একসময় এই মণ্ডপে নৃত্যরত নটরাজ মূর্তি পূজিত হত। কিন্তু এখন তার কোনও অস্তিত্ব নেই। এরমধ্যে ৬১ তম যোগিনী সর্বমঙ্গলার কুঠুরিটি ফাঁকা। এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে।
৬২) অজিতা – ত্রিভঙ্গ মুদ্রায় নৃত্যরত ভঙ্গীতে হরিণের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চার হাত। মাথার ওপর খোঁপাটি অগ্নিশিখার ন্যায়।
৬৩) সূর্যপুত্রী – চলন্ত ঘোড়ার ওপর দণ্ডায়মান লাবণ্যময়ী দেবী মূর্তির চার হাত। এক হাতে ধনুক। অন্য হাতে তূণীর থেকে তির বার করছেন। মাথায় কিরীট। অঙ্গে নানাবিধ অলংকার।
৬৪) বায়ুবীণা – নৃত্যরত ভঙ্গীতে কালো হরিণের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত। মাথার ডানপাশে খোঁপা। অঙ্গে বিবিধ অলংকার যার মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কানের রিং 'কাপা'। স্তম্ভমূলে দুটি ফুলদানি রয়েছে।
চণ্ডীমণ্ডপেই রয়েছে চার ভৈরব মূর্তি। মণ্ডপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের কুঠুরিতে রয়েছে একপদ বা অজৈকপদ ভৈরব। পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর একপায়ে দাঁড়ানো ভৈরব মূর্তিটির উর্ধ্বলিঙ্গ। মাথার পেছনে আলোর বলয়। মাথায় কিরীট, গলায় নরকরোটির মালা, হাতে সর্পবলয় আর পায়ে সর্পকেয়ূর। অস্ত্রশস্ত্রাদি খড়্গ, ঢাল আর মাছের কাঁটা। স্তম্ভমূলে দুজন দেহরক্ষী ঢাল-তরোয়াল নিয়ে। দ্বিতীয় ভৈরবের দশটি হাত। বিশ্বপদ্মাসনে বসে রয়েছেন। উর্ধ্বলিঙ্গ। মাথায় কিরীট এবং অক্ষমালা, কাপালা ও ড্রাম হাতে। মাথার আলোক বলয়ের ওপরে দুই উড়ন্ত নারী মূর্তি। স্তম্ভমূলে নারী দেহরক্ষীদের হাতে শাঁখ এবং কাপালা। তৃতীয় ভৈরবও প্রায় দ্বিতীয় ভৈরবের ন্যায়। পার্থক্য হল, এর অঙ্গে নানাবিধ অলংকার। হাতে অক্ষমালা ছাড়াও ঢাল, ডমরু ও ত্রিশূল। স্তম্ভমূলে থাকা নারী দেহরক্ষীদের ভয়াবহ মুখশ্রী, হাতে শুধুমাত্র কাপালা। চতুর্থ ভৈরবও প্রায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভৈরবের মতোই। পার্থক্য হল, এর হাতে শুধুই ডমরু ও অক্ষমালা। স্তম্ভমূলে একটি পুরুষ ও একটি নারী দেহরক্ষী। নারী দেহরক্ষীর হাতে তরোয়াল ও কাপালা। পুরুষ দেহরক্ষীটি শুয়ে রয়েছে যার করতলের ওপর ভৈরবের ডান পা রাখা রয়েছে।
মন্দিরের বাইরে দরজার দুপাশে দুই দ্বারপাল তো আছেই। ঢোকার গলির দুপাশেও দুটি পুরুষ মূর্তি রয়েছে। আর মন্দিরের বাইরের গায়ে রয়েছে নয় কাত্যায়ণী। এই পরিচারিকারাও মন্দির রক্ষা করছে। উচিত ছিল বাইরেটা দেখে নিয়ে ভেতরে ঢোকা। কিন্তু মন্দিরের পাথরগুলো রোদে এমন তেতে ছিল যে প্রায় এক্কাদোক্কা খেলার ভঙ্গীতে লাফিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। বার দুয়েক মূর্তি চিনতে চিনতে খালি পা অনেকটাই গরম সয়ে ফেলল। অতএব গলি দিয়ে বেরোতে যাই। পূজারীকে সঙ্গে নিয়েই বেরোই। গলির মধ্যে ভয়ঙ্কর দেখতে পুরুষ মূর্তিদুটি কারা জানতে চাই তাঁর কাছে। আমার বাম হাতে অর্থাৎ ঢোকার সময়ে ডান হাতের মূর্তিটি কাল ভৈরবের। আর অন্যটি বৈকাল ভৈরব। দুজনেরই কঙ্কালসার চেহারা, মাথায় জট পাকানো চুল আর লড়াকু ভঙ্গী। কাল ভৈরবের ডান হাতে একটি কাপালা আর বৈকাল ভৈরবের বাম হাতে একটি নরমুণ্ড। কাল ভৈরবের মূর্তির স্তম্ভমূলে একটি ফুলগাছ, একটি শেয়াল আর কাটারি ও কাপালা হাতে দুজন পরিচারক। বৈকাল ভৈরবের পরিচারক দুজনের মধ্যে একজন রক্তপানে ব্যস্ত আর আরেকজনের দুহাতে দুটি কাপালা।
মন্দিরে ঢোকার দরজার দুপাশে দুই পুরুষ দ্বারপাল। দুজনেরই দুই হাত এবং স্তম্ভমূলে পদ্মলতা। দক্ষিণের দ্বারপালের কানে অলংকার। উত্তরের দ্বারপালের একটু মোটাসোটা রাগী চেহারা। বাঁ হাতে একটি কাপালা।
এবারে নব কাত্যায়ণীদের দেখি ঠাঠা রোদ্দুর সইয়ে সইয়ে। হালকা হলুদ রঙের বালিপাথরে মূর্তিগুলি আড়াই থেকে প্রায় তিন ফুট পর্যন্ত লম্বায়। অধিকাংশেরই দুই হাত আর দাঁড়িয়ে রয়েছে ছিন্ন নরমুণ্ডের ওপরে। প্রথম কাত্যায়ণীর ডান হাতের তলোয়ার উঠেছে মাথার ওপরে। হাতে সোনার চুড়ি, গলায় হার। স্তম্ভমূলে দুই পরিচারক ড্রাম বাজাচ্ছে। দ্বিতীয় কাত্যায়ণীর অঙ্গে বাজুবন্ধ, হার ও নূপূর। মাথার বাঁপাশে খোঁপা। ডানদিকে এক পরিচারক মাথায় ছাতা ধরেছে। স্তম্ভমূলে একটি শেয়াল ও একটি কুকুর। তৃতীয় কাত্যায়ণীর ডান হাতে কাটারি, বাম হাতে কাপালা। ডানদিকে এক পরিচারিকা মাথায় ছাতা ধরেছে। স্তম্ভমূল দ্বিতীয় কাত্যায়ণীর অনুরূপ। চতুর্থ কাত্যায়ণী প্রায় তৃতীয় কাত্যায়ণীর মতোই। পার্থক্য হল, এর মাথার ডানপাশে খোঁপা, হাতে অক্ষমালা। স্তম্ভমূলে এক পরিচারিকা কুকুরটিকে খাওয়াচ্ছে। পঞ্চম কাত্যায়ণী প্রায় দ্বিতীয় কাত্যায়ণীর ন্যায়। এখানে শুধু পরিচারকের বদলে পরিচারিকা মাথায় ছাতা ধরেছে তৃতীয় ও চতুর্থের মতো। ষষ্ঠ কাত্যায়ণী অনেকটাই চতুর্থ কাত্যায়ণীর মতোই। পার্থক্য বলতে এর ডানদিকে একটি গাছ রয়েছে আর পরিচারিকাটি ছাতার বদলে মাথার ওপর চাঁদের কলা ধরেছে। কাত্যায়ণী সাত ও আট উভয়েই হুবহু কাত্যায়ণী তিনের মতো। নবম কাত্যায়ণী বাকি আটজনের থেকে কিছুটা ছোট আকারের। অনেকটা প্রথম কাত্যায়ণীর মতোই। পার্থক্য হল নবম কাত্যায়ণী নগ্ন, রাগত লোচনা, হাতে একটি ধনুকও রয়েছে। পরিচারক বা পরিচারিকা নেই। আর স্তম্ভমূলে দুইটি শিয়াল।
লিখছিলাম-আঁকছিলাম-ভাবছিলাম...
শিল্পী নই। তবু বই দেখে যোগিনীদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আঁকার খেয়াল চাপল মাথায়। বৈশিষ্ট্য বলতে হাতে, গলায়, মাথায়, কানে, পায়ে নানারকম অলংকার, মাথার চুলে কেশবন্ধন আর খোঁপার বৈচিত্র, পোশাকের ধরণধারন। গহনার যা বাহার সত্যি পি সি চন্দ্র কী অঞ্জলি জুয়েলার্স কোথায় লাগে! তাও অল্পই আঁকতে পারলাম। একটা লেখায় কতই বা আর দেওয়া যায়, খানিকটা ধারণা ছাড়া।
ছবি নং - ১ |
ছবি নং - ২ |
লিখছিলাম, আঁকছিলাম, ভাবছিলাম। ডুবে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। আসলে প্রথম দেখা এই যোগিনী মন্দিরটি আমার মনে বেশ নাড়া দিয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা যা দ্রাবিড় সভ্যতা নামে পরিচিত তাতে নারীকে সম্মান করার একটা প্রথা ছিল। পরবর্তীকালে বিদেশি অনুপ্রবেশ যত ঘটেছে ততো নারীর অবমূল্যায়ণ ঘটেছে সমাজে। এখনও দুর্গা বা কালী মূর্তির মধ্যে শক্তিময়ীরূপে নারীকে পুজো করার রীতি রয়েছে কিন্তু বাস্তবে তাকে অনেকটাই শক্তিহীনা বলেই বিবেচনা করে নেওয়া হয়। যেন আর্থিক স্বাধীনতা আর পোশাকের হৃষতাই নারী মুক্তির একমাত্র উপায়। অথচ মাত্র পঞ্চাশ-একশো বছর আগেও যে নারীরা লাঠি ছোরা খেলায় ওস্তাদ ছিলেন, অনায়াসে হারিয়ে দিতেন ডাকাতদলকে পেশীশক্তিতে অথবা বুদ্ধিমত্তায় অথবা বিদেশি শাসক কী স্বাধীন দেশের সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেন তাঁদের অধিকাংশই সেই অর্থে অর্থনৈতিক স্বাধীন ছিলেননা এবং পোশাক নিয়ে বা নিজেকে অন্যের চোখে সুন্দর প্রতিপন্ন করার জন্য সচেতন ছিলেন না। বরং একশো-দেড়শো বছর আগে যখন শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ বা অন্তর্বাস ব্যবহার করার চল ছিল না অথবা নামের পাশে পদবী ব্যবহার করার অনুমোদন ছিল না, সেই নিয়ে তাঁরা লড়েছেন সমাজ-সংস্কারের বিরুদ্ধে। শক্তিময়ী, বুদ্ধিমতী এইসব নারীরাই চিরকালের আধুনিকা।
যোগিনী পুজো কেন ভারতবর্ষে বারবার করে আড়ালে চলে গেছে বা একটা রহস্যময় ভয়ের সৃষ্টি করেছে তার মূলেও রয়েছে হয়ত নারীর প্রতি অবমাননার প্রকট অথবা প্রচ্ছন্ন ধারণা। ডাকিনী-যোগিনী নিয়ে প্রচলিত গল্পে বা প্রথায় তাদের সুন্দরী, যৌনতার প্রতিচ্ছবি এবং হিংস্র মানসিকতার দেখানো হয়। অথচ যোগিনী মূর্তিগুলি অপূর্ব লাবণ্যময়ী আকর্ষণীয় দেহ বা কখনও ভয়ানক চেহারা নিয়েও কিন্তু লাস্যময়ী - যৌনতা, ভীতি অথবা বীভৎসতার প্রতীক নয়। এভাবে সমাজ তাকে উপস্থাপিত করেছে। যাতে ভারতবর্ষের নারীর শক্তিময়ী সত্যিকারের রূপটি প্রতিষ্ঠিত না হয়।
ছবি নং - ৩ |
ছবি নং - ৪ |
কিন্তু আসলে মূল ভাবনা কি এই কল্পনা নির্মাণের সময় সত্যিই তাই ছিল নাকি শক্তিময়ী নারীকে, যে নারী জন্ম দেয়, পালন করে, রক্ষা করে তাকে সম্মান করেই করা হয়েছিল? আবার এও মনে হয়েছে, যেন কত যুগ আগের পুরুষ শাসিত সমাজের অভিশাপে শক্তিময়ী নারী ক্ষুদ্রাকার মূর্তিরূপে বাঁধা পড়েছিল কালো পাথর-মাটির আবরণে। একেকটা ভঙ্গী যেন এক একটা মুহূর্ত রচনা করেছে। যে মুহূর্তে তাদেরকে যেন বলা হয়েছিল, স্ট্যাচু। তারপর কেটে গেছে অনন্তকাল। এই অনন্তকাল ধরেই তারা অপেক্ষা করে আছে প্রদ্যুম্নের মতো প্রকৃত মানুষের, যার বাঁশির সুর তাদের বাঁধবে না। মুক্তি দেবে চিরকালের মতো।
ঐতিহাসিক বা গবেষক কোনটাই নই, পড়াশোনাও খুব সামান্যই। অনুভূতি থেকে যা সত্য বলে উপলব্ধ হয় তাই লিখি, লিখে যাই। ব্রাহ্মণী মূর্তিতে গলায় পৈতের উপস্থিতি ধর্মে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রকাশ করছে। এর বহু বছর পর লালন গেয়েছিলেন, 'বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কী প্রকারে?' অর্থাৎ মধ্যযুগে এসে ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের পৈতে পরার অনুমোদন শাস্ত্রে বা সমাজে আর ছিল না। শুধু নারীই বা বলি কেন? যোগিনী সরস্বতীর মূর্তিটি দেখলে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়েদের কথা মনে আসে। এখানে বাইরে থেকে দেখে নারী শরীরে যে পুরুষালি ভাব প্রকাশ পাচ্ছে তার জন্য দেবীর মধ্যে কোনও সংকোচ নয়; শক্তিময়ীর একটা অহংকার ফুটে উঠছে গোঁফ চুমড়ানোর মধ্যে। আবার কোনও কোনও যোগিনীর মুখমণ্ডল পশুর ন্যায় বা বিভিন্ন মূর্তির সঙ্গেই পশুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রেও মনে হয়েছে 'পশু' শব্দটা যে অনুভূতিতে আমরা চট করে ব্যবহার করে ফেলি এখানে তা করা হয়নি। নারীর মতোই পশুর স্থানও সম্মানীয়। প্রাচীন অনেক সভ্যতাতেই কোনও কোনও পশুকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হত। আরও একটা প্রশ্ন জাগে মনে। মোট ছটি প্রধান পুরুষ মূর্তি বা ভৈরবের মধ্যে মন্দিরের অভ্যন্তরের চারটি ভৈরবের মূর্তিরই উর্ধ্বলিঙ্গ কেন? এখানে কি নারী নয়, পুরুষকেই যৌনতার চিহ্ন বলে মনে করা হয়েছে?
এই সবই আমার নিজস্ব ভাবনা-কল্পনা। ফিরে আসতে আসতে মনে হল কখনও দিনের শেষে একলা এখানে আসব। সন্ধ্যা নেমে আসবে। পূজারীরাও ফিরে যাবে। বৃষ্টিভেজা পূর্ণিমা রাতে কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোয় মায়াময় হয়ে উঠবে নির্জন গ্রাম্য প্রান্তর। জোছনার আলো মেঘের কালো ছায়ার সঙ্গে খেলা করবে পুষ্করিণীর জলে। খুব কাছেই কোথাও প্রদ্যুম্নের বাঁশিতে বাজবে মেঘমল্লার রাগ। সেই আলোয় আর সুরে অনিন্দ্যকান্তি যোগিনী মূর্তিরা যেন প্রাণ ফিরে পাবে একে একে। খসে পড়বে এত যুগের মাটি-পাথরের বন্ধন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – Sixty Four Yogini Temple Hirapur by Suresh Balabantaray এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
'আমাদের ছুটি' আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত নেশায় লেখক, ভ্রামণিক, ভ্রমণসাহিত্য গবেষক। প্রকাশিত বই - 'অবলা বসুর ভ্রমণকথা' (সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত)